সবাই যেন মাতৃভাষাতেই শিক্ষা পায়

photo-1519147778

লেখক: জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা

আমি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারের সন্তান। শৈশব থেকে আমি আমার মাতৃভাষা বা জাতিগোষ্ঠীর ভাষা শিখে এসেছি। কিন্তু শিক্ষাজীবনের সূচনায় স্কুলে গিয়ে দেখতে পেলাম, সেখানে আমাকে বাংলা শেখানো হচ্ছে। শিক্ষা দিচ্ছেন বাঙালি একজন ব্যক্তি, যিনি আমাদের ভাষা জানেন না। ফলে বাংলাকে আমি আমার মাতৃভাষার মাধ্যমে শিখতে বাধ্য হই। ফলে অনেক শব্দের অর্থ আমি নিজেদের ভাষার মতো করে বুঝে নিয়েছি সে সময়। অথচ এখন দেখতে পাচ্ছি, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়েছে এবং শিশুরা নিজের ভাষায় প্রাইমারি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সেদিক থেকে আজ আমরা নিজেদের ভাষায় শিক্ষা অর্জনের দাবি জানাচ্ছি।

২.
তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি পাহাড়ি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের আবাসভূমিও গড়ে ওঠে নদীসংলগ্ন উপত্যকায়। ইতিহাসের মূল উপাত্ত খুঁজে পাওয়া না গেলেও খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর দিক থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সেই সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে আসছে ১১ ভাষাভাষী ১১টি নৃ-জনগোষ্ঠী। বৈচিত্র্যময় এই জনগোষ্ঠীগুলোর জীবন ও সংস্কৃতি চিরাচরিত ঐতিহ্যে লালিত ও নান্দনিক। তাদের বর্ণিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা খুবই সুন্দর ও দর্শনীয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন ভাষাভাষীর নৃ-জনগোষ্ঠী হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা টিপরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, চাক, খুমী, পাংখোয়া, লুসাই ও খিয়াং। প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা রয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে ক্রমানুসারে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাই প্রধান। অবশ্য এর পর রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী। তাদের জীবনধারা, ভাষা ও সংস্কৃতি অন্যদের থেকে পৃথক।

তঞ্চঙ্গ্যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ। পার্বত্য তিন জেলায় বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। তঞ্চঙ্গ্যাদের বেশির ভাগ বান্দরবান জেলার সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলা এবং রাঙামাটি জেলার কাউখালী, রাজস্থলী, কাপ্তাই, সদর, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলায় বসবাস রয়েছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার রইস্যাবিলিতেও তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার রামু, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস করতে দেখা যায়। বাংলাদেশের বাইরে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে এবং ভারতের ও অন্যান্য রাজ্যে তাদের আবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যারা দৈংনাক ও তৈন টংগ্যা নামে পরিচিত।

বাংলাদেশে তনচংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা এবং মিয়ানমারের উত্তরাংশে ও আরাকানে দৈংনাক নামে তাদের বসবাস। বর্তমানে দৈংনাকদের একাংশ আরাকানের উত্তর-পশ্চিম দিকের মাতামুহুরীর উপনদী তৈনছড়ির উপকূলে বসতি স্থাপন গড়ে তুলেছে। নৃতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণমতে, তঞ্চঙ্গ্যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলীয় নৃ-ধারাভুক্ত জনগোষ্ঠী বলে জানা গেছে। এদের ভাষা আর্য ভাষা সম্ভূত বাংলার আদিরূপের সমতুল্য। পালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা পরিপূর্ণ। তবে চাকমা ভাষার সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার মিল রয়েছে সমধিক। বিশেষত, তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষার মধ্যে শাব্দিক এবং ভাবগত অনেক মিল রয়েছে। সাম্প্রতিককালে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে। আসলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো অস্ট্রো-এশীয়, ইন্দোচীন, চীন-তিব্বতি, তিব্বতি-বর্মণ, ইঙ্গো-ইউরোপীয় ও দ্রাবিড়ীয় ভাষা পরিবারের কোনো না কোনটির অন্তর্ভুক্ত। বাংলা ভাষা গঠনের যুগে এই ভাষাগুলোর অবদান অপরিহার্য ছিল।

৩.
তঞ্চঙ্গ্যা বাংলাদেশের জীবিত ভাষার মধ্যে অন্যতম। জার্মান ভাষাবিজ্ঞানী জর্জ গিয়ারসনের সমীক্ষায় ১৯০৩ সালেই স্পষ্ট করে বলা হয়, তঞ্চঙ্গ্যা একটি পৃথক ভাষা। যা ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। এ ভাষার সাহিত্যও সমৃদ্ধ। এ ভাষায় বর্ণমালা মোট ৩৬টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ ও স্বরবর্ণ পাঁচটি। বর্ণমালায় নিজস্ব ফলা চিহ্নও আছে। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও ইউএনডিপির মাধ্যমে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় প্রাইমারি স্তরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু সেই কার্যক্রমের অগ্রগতি এখন শূন্য। এখন কম্পিউটার কিবোর্ড দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা লেখা যায়। মার্কিন নাগরিক জন ক্লিফটন এই কাজ করেছেন। কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা করেছিল ইউএনডিপি, সেভ দ্য চিলড্রেন ইউকে এবং এসআইএল বাংলাদেশ। তবে এসব কর্মকাণ্ড আমাদের মাতৃভাষার শিক্ষা খুব বেশি এগিয়ে নিতে পারেনি। অতীতে আমরা দেখতে পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনব্যাপী ব্যতিক্রমী এক ভাষার মেলার আয়োজন করে। যেখানে দেশের ১৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাষা উপস্থাপিত হয়। তন্মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাও ছিল। ওই আয়োজনে উপস্থাপন করা হয় তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার পরিচয় লিপি, ভাষিক এলাকা আর তাদের প্রাথমিক শিক্ষার কিছু বই ও প্রাচীন পুঁথির আলোকচিত্র। সঙ্গে ছিল তঞ্চঙ্গ্যাদের দৈনন্দিন জীবনাচারণ নিয়ে কিছু আলোকচিত্র।
বর্তমান পরিস্থিতি আমরা যতটুকু জানি, তাতে দেখতে পাই আমরা তঞ্চঙ্গ্যারা যারা রাঙামাটিতে থাকি, তাদের চেয়ে বরং বান্দরবানের তঞ্চঙ্গ্যা বাসিন্দারা মাতৃভাষার চর্চা করে বেশি। এর কারণ প্রধানত প্রভাবশালী ভাষার আধিপত্য। চাকমা ভাষার প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলার। তবে আমরা এখন ক্রমান্বয়ে সচেতন হচ্ছি। নিজেদের তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয়কে সবার সামনে তুলে ধরছি। আর নিজের ভাষা ব্যবহার করছি। পার্বত্যবাসীর ভাষার প্রতিবেশগত নৈকট্যের জন্য একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মিল থাকলেও আমরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। আমরা আমাদের জাতিত্ব ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করি। এ জন্য নিজের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মৌখিকভাবে আমরা মাতৃভাষার চর্চা করে চলেছি। তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে, এটাই এখন বাস্তবতা।

৪.
মূলত আমরা নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রথমত বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাশা করছি। কারণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করতে বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ জন্য আমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জন ও তার বহুল প্রচারের দাবি অযৌক্তিক কিছু নয়। তা ছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস। তঞ্চঙ্গ্যারা সুদীর্ঘকাল নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তার অনুভূতিতে ক্রমে ক্রমে নিজস্ব ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির জন্মলাভ ঘটেছে, যা পার্বত্য অঞ্চলের অপরাপর জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা। তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস, তাদের সাধারণ জনমানুষেরই ইতিহাস। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের অভিযান অগ্রগতি কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির খতিয়ান নয়, তা সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অভিযান, অগ্রগতি ও সাফল্যের খতিয়ান। এ জন্য তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার দাবি আজ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

লেখক : সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিলেট।

সংকলনঃ

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৩২ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:২৯

https://www.ntvbd.com/opinion/182463/তঞ্চঙ্গ্যা-ভাষার-স্বীকৃতি-চাই

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা – কলাত্থুর কন্যা (কলাবতী কন্যা)

Sketch-of-a-Tanchangya-Woman

লেখকঃ প্রয়াত- বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

এই কাহিনীটি হলো সেই সময়ের যে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়ে জুম করত। চক্রধন আঙুর আত্মীয় স্বজন সীতা মোইন বা সীতা পাহাড়েই বসতি স্থাপন করে। তার মেঝো মেয়ে সনামালা বিধবা। সে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। রোয়াঙে কলাডেন নদীর পাড়ে কুমুখ্যাং পাড়ায় তাদের ঘর ছিল। তার বাবা চক্রধন আঙু ও কার দল যখন এতদঞ্চলে আসে, বিধবা সনামালা তার একমাত্র সন্তান পাঁচ বছর বয়সী রাঙাধনকে নিয়ে এখানে আসে। সে তার বাপের পরিবারে থাকে না, রাঙাধনকে নিয়ে পৃথক ঘরে থাকে। তার ভাইয়েরা তার জুমের জন্য গভীর বন-জঙ্গল কেটে দেয়, শুকনো জঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সনামালা আধমরা গাছের ডাল-পালা সাফ করে জুমের ক্ষেত তৈরি করে। তার ভাইয়েরাও এতে সাহায্য করে। ক্ষেত তৈরি হলে ধান, তিল, কার্পাস এবং নানান ফসলের বীজ বুনে। ক্ষেতের আগাছা বাছে, ধান পাকলে ধান কেটে ঘরে তোলে। রাঙাধন এখন চৌদ্দ/পনের বছরের তরুণ। সে তার মামাদের সঙ্গে জুমের জঙ্গল কাটা এবং তার মাকে জুমের কাজে একটু আধটু সাহায্য করে। বেশির ভাগ সময় তার খেয়াল খুশি মত এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সময় কাটায়।
.
তখন রাম মোইন-সীতা মোইনে বিশাল বিশাল বৃক্ষাদির ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর ‘তেল্যাকলার’ (একপ্রকার জংলী কদলী) থোর (মোচা) হতো। এসব দেখতে বেগুনী রঙের, তেলতেলে ও মসৃণ হয়ে থাকে।
.
সেই সময় রাঙাধনের বয়স চৌদ্দ/পনের বছর। তার তরুণ মনের আকাশে সবে মাত্র রঙধনুর রঙ্গিন আল্পনার আবির্ভাব হচ্ছে। সে তার মামাদের সাথে জুমের জঙ্গল কাটতে যায় এবং অন্যান্য কাজেও যায়। কিন্তু মন দিয়ে কাজ করেনা, করতে চায় না। খেয়াল খুশি মত চলে। কাজ করতে করতে প্রায় সে ‘ছড়া’ বা ঝিরির পাড়ে গিয়ে তেল্যাকলার বনে গিয়ে তেল্যাকলার থোরগুলি চেয়ে দেখে, আর কলা গাছের আগায় পাতায় যে রৌদ্রের ঝলক পড়ে, সেইসব চেয়ে চেয়ে দেখে। কচি কলাপাতা মৃদু সমীরণে দোলে, সূর্যের আলো তাতে আছড়ে পড়ে, ঝিলিক তুলে। রাঙাধন সেই ঝিলিকে মোহিত হয়, আনমনে হেসে ওঠে। মনে মনে বলে, তেল্যাকলার থোর এত সুন্দর কী করে হয়! তার মামতুতো বোন ধংমালা তার চেয়ে দু’বছরের ‍বড়। রাঙাধন তাকে মনে মনে বলে তুলনা করে তেল্যা কলার থোরের সঙ্গে। পিছল বেগুনী রঙের তেলতেলে কলার থোরের যে মায়াময় লাবণ্য, তা ধংমালার মাঝে সে দেখতে পায়। মনে মনে ধংমালাকে তার বৌ কল্পনা করে আনে সে ঘরে। তার মাকে মাঝে মাঝে হঠাৎ জিজ্ঞাস করে – মা, ধংমালা কবে আমাদের ঘরে আসবে? তার মা সনামালা বুঝতে পারে রাঙাধনের মনের বনে যৌবনের ভ্রমর পাখা মেলতে শুরু করেছে। কিন্তু কিছু বলে না, কারণ, ধংমালার সঙ্গে চক্রধন আঙুর আর এক নাতির ‘আইফাই’ (ভালবাসা) চলছে।
.
এক বছর তরুণ যুবক রাঙাধন তার মামাদের সঙ্গে জঙ্গল কাটতে গেছে। সেদিন সে একটা ঝোপ কাটার পর তার মামাদের থেকে সরে গিয়ে জুমের প্রান্তে ঝিরির পাড়ে চলে এল। এখানে ঘন তেল্যাকলার বন। তখন ফাল্গুন মাস। মনোরম তেল্যাকলার থোরগুলো বাতাসে দোলছে আর সোনালী রোদের ঝিলিক কচি কোমল মোলায়েম মসৃণ কলা পাতায় পড়ে ঝিকমিক করছে। রাঙাধনের চোখ সে দিকে গিয়ে আটকে গেল। থোরের অপরূপ লাবণ্য এবং কচি পাতায় রোদ্রের ঝলকে রাঙাধন পুলকিত হয়ে খিল খিল করে হাসতে লাগল। তখন তার চোখে ধংমালার রূপ লাবণ্য স্পষ্ট প্রতিভাত হতে লাগল। লোভনীয় এই থোর আহরণের জন্য গাছ কাটতে শুরু করে দিল রাঙাধন। চারটা কলা গাছ কাটার পর পঞ্চম কলা গাছে কোপ দিতেই ‍রাঙাধনের কানে এল কোমল নারী কণ্ঠের আবেদন, রাঙাধন, তুমি কলা গাছ কেটে শেষ করলে, আমার থাকবার স্থান নষ্ট করে দিয়েছ। রাঙাধন বিস্ময়াপন্ন হয়ে চকিতে চারদিকে তাকায়, কাউকেও না দেখে প্রশ্ন করল, – “তুমি কোন অচেনা নারী আমার নাম ধরে কথা বললে?” এবার কলাগাছের আগা থেকে রাঙাধন স্পষ্ট শুনতে পেল, – “আমি কলাত্থুর কন্যা”। রাঙাধন সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময় বিস্ফোরিত দু’নয়নে দেখতে পেল – থোরের রঙে এক পরমা সুন্দরী ললনা। তার পোশাক পরিচ্ছদ ‘পিনন’ আর ‘খাদি’ কচি কলা পাতার রঙে সাজানো; মোলায়েম, কোমল এবং মসৃণ। রাঙাধন তাকে দেখে যেমন বিস্মিত হল, তেমনি যারপরনাই হল খুশি। এক মুহূর্ত ভেবে মৃদু হেসে বলল, – “আমি তোমাকে চিনি না অথচ তুমি আমাকে চেন, আমার নাম ধরে ডাকলে। তুমি কে বলতো?” কলাত্থুর কন্যা উত্তর দিল – “আমি কলাত্থুর কন্যা। আমি তোমাকে চিনি। কালাডেন গাঙের পাড়ে আমার ঘর। তোমরা এখানে আসার সময় আমার ঘরের সম্মুখ ‍দিয়ে এসেছিলে। আমার এখনো মনে আছে। তুমি আমার থাকার জায়গা নষ্ট করে দিয়েছ। তাই এখন আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও”।
.
রাঙাধন অতীব আশ্চর্যান্বিত হলেও কলাত্থুর কন্যার এই অনুরোধে দারুণ খুশি হল। কেননা, কলাত্থুর কন্যাকে দেখে সে মোহিত হয়ে গেছে। সিঁড়ি বানিয়ে সে উপরে উঠে কলাত্থুর কন্যাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে নীচে নামিয়ে আনল। তারপর তার এক হাত ধরে তাকে এনে ঘরের উঠানে নিয়ে এসে তার মাকে ডেকে বলল, “মা, মা, দেখ, আমি কলাত্থুর কন্যাকে বৌ করে এনেছি।”
.
তখন রাঙাধনের বড় মামা বিষুরাম আর কনিষ্ঠ মামা খুলারাম কাজ করতে করতে দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য ঘরে ওঠে ঘরের ‘চানায়’ (বারান্দায়) বসে আছে। রাঙাধনের মা সনামালা ভাত বেড়ে দিচ্ছে। তারা এক পলক দেখল কলাত্থুর কন্যাকে। দেখে চমকিত হল। কলাত্থুর কন্যা তাদেরকে দেখে ঘরে উঠল না। দৌড়ে কিয়ুদ্দুর গিয়ে বনে আত্মগোপন করল। রাঙাধনের কনিষ্ঠ মামা খুলারাম এখন পূর্ণ যৌবনের অধিকারী। এখনো সে বিয়ে করেনি। রাঙাধনের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। তার বয়োকনিষ্ঠ ভাগিনা রাঙাধন কলাত্থুর কন্যাকে বৌ নিয়ে এসেছে জেনে তার মনে খুব দুঃখ হলো। সে মনের দুঃখে অভিমান করে ভাত খেল না। তার দিদি সনামালা তাকে অনেক বোঝাল। খুলারাম জেদ করে থাকে; না সে ভাত খাবে না। সনামালা বার বার তাকে ভাত খেতে অনুরোধ করল। তবুও ভাত না খেয়ে খুলারাম অভিমান করে বসে রইল।
.
এইদিকে কলাত্থুর কন্যা সেই যে কলার বনে ঢুকেছে সেই কলার বন থেকে আর বের হচ্ছে না। ভাত খাবার পর খুলারামের বড় ভাই বিষুরাম আরার কাজ করতে জুমে গেল। খুলারাম অনাহারে ঘরে শুয়ে রইল, কাজ করতে গেল না। তার দিদি সনামালা তাকে বুঝিয়ে বলল, “তোমার ভাগিনা বৌকে দেখে তুমি রাগে অভিমানে ভাত খেলে না, লোকে তোমাকে দেখে হাসবে, তোমাকে পাগল বলবে। এসো ভাত খাও।” খুলারাম উত্তর দিল – “দিদি আমি পাগল নই। যারা যুবক অবিবাহিত তারাই আমার দুঃখ বুঝবে। তুমি আমার দুঃখ বুঝবে না। আমি ভাত খেতে পারি, যদি আমার ভাগিনা বৌ কলাত্থুর কন্যা আমাকে ভাত বেড়ে দেয়।” সনামালা বলল, “আচ্ছা।”
.
এদিকে রাঙাধন সারাক্ষণ ঘরের আশেপাশে, বনে কলাত্থুর কন্যার সন্ধান করল। কিন্তু ব্যর্থ হল। কোনখানে কলাত্থুর কন্যার সন্ধান পেল না। খুলারাম ভাবছে, আহা সে যদি রাঙাধন হত!
.
দিন শেষ হয়ে গেল। সূর্য অস্তমিত হলে সাঁঝের আঁধার নেমে এল। ফাল্গুনের নির্মল সুনীল আকাশে একটা করে অসংখ্য তারকা মিট মিট করে জ্বলে উঠল। তখন সে আলোয় ঘরের অদূরে বনে বলা গাছের উপরিভাগে কলাত্থুর কন্যাকে দেখা গেল। সনামালা, খুলারাম, রাঙাধন কলাত্থুর কন্যাকে দেখতে লাগল। রাঙাধন চট জলদি দৌঁড়ে গেল কলা গাছের গোড়ায়। কলা গাছের সিঁড়ি বানাতে বানাতে কলাত্থুর কন্যা তাকে বলল, “রাঙাধন, তুমি বদ্ধ ছেলে মানুষ, কলা গাছ কাটছ কেবল। এখন ঘরে যাও আমি আপনা আপনিই আসবো।” এদিকে খুলারাম তার দু’কানে যেন শুনতে পেল কলাত্থুর কন্যা তাকে বলছে, – “খুলারাম, তুমি কেন মনে দুঃখ পেলে। মনের দুঃখে অভিমান করে ভাত খেলে না কেন? তুমি আমাকে কলা গাছের উপর থেকে পেড়ে নিয়ে যাও – আমি তোমাকে ভাত বেড়ে দেব।” বলা বাহুল্য এই কথা শুধু খুলারামই নিজের কানে শুনল। অন্য কেউ শুনতে পেলনা। শুনে খুলারাম খুব খুশি হল। খুলারাম কাউকে কিছু না বলে বনের দিকে অগ্রসর হল।
.
সে সময় থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবিবাহিত পুরুষেরা ভাগিনার নবপরিণীতা বধূকে প্রথম যেদিন দেখে বা সাক্ষাৎ হয়, আকাশে তারকা দেখা না যাওয়া পর্যন্ত তাদের সে দিন ভাত খাওয়ার বিধান নেই। অবিবাহিত যুবকদের সঙ্গে বিবাহিত পুরুষেরাও ভাগিনার নববধূকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিন আকাশে তারা দেখা না যাওয়া পর্যন্ত ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই।

– বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা
তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী
( Collected from jumjournal blog )

সাপ্রে বা দৈনাক টং-চং-য়্যা বিবরণ

লেখকঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যক, অধ্যক ও প্রতিষ্ঠাতা, রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমী

1

2

3

4

5

6

7

8

9

 

Shri Dr. Kartrik Chandra Tanchangya

কবিরত্ন ডাঃ কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

Shri Dr. Kartrik Chandra Tanchangya was known as poet and physician. His fame spread outside Chittagong Hill Tracts.  Kartik Chandra Tanchangya was born in March 1920 in Kutubdia village in the Basin  of Rainkyong River, Bilaichhari upazila. His wife named was Latika Tanchangya, known as Sadhuma.

Books

He penned many books in Bengali and Tanchangya language, namely:

Discourse on Buddha’s Enlightenment (1984)

Verses of Salutation to the Buddha (written in Tanchangya Language)

Story of King Udayana (1961)

Garland of Buddha’s Stories

Episode of Buddha’s Renunciation

Life of King Asoka(1983)

Bijayagiri

Man’s Divinity (on the story of Buddha’s past lives)

Anagatvamsa- a notable unpublished  book

Among them, Men’s Divinity has regularly published up to four editions under Chaloin Magazine during the editorship of Milinda Tanchangya. Moreover, Bijoygiri Play has published the complete play from fifth Edition of Chaloin onward under the editorship of Karmadhan Tanchangya. Apart from this, his extraordinary stories, poems, essays were published in magazines such as Nairanjana Magazine, Sambodhi, Parbatya Bani, Jhorna, weekly papers etc.

He was a contemporary poet and writer with Shri Birajmohan Dewan (author of Chakma Jati Itibrita), Shri Probat Kumar Dewan (editor of Goirika). But senior to writer Shri Biro Kumar Tanchangya and Shri Rati Kanta Tanchangya.

Populous work and Award

Among his writing, there is a romantic poem named “Radhman Dhanpati Play” written by Sri Kartik Chandra Tanchangya published at Pohr Jangal (page 44-60). At that time the Dean of Bengali Department at the University of Chittagong described him as Gem of Poet (কবিরত্ন) in the Chittagong Hill Tracts.

Passing away

Poet and writer Shri Kartrik Chandra Tanchangya passed away in 1997 at the age of 77.

References:

1. Pohr Jangal, Editor Karmadhan Tanchangya

2. Tanchangya Jati, by  Rati Kanta Tanchangya

 

কবিরত্ন ডাঃ কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

কবিরত্ন ডাঃ কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা.png

লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা/ Milinda Tanchangya

শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একাধারে কবি ও ডাক্তার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত।শ্রী ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার জন্ম ১৯২০ সালে মার্চ মাসে বিলাইছড়ি উপজেলাধীন রাইংখ্যং নদীর অববাহিকায় কুতুবদিয়া গ্রামে। তাঁর স্ত্রী নাম লতিকা তঞ্চঙ্গ্যা যিনি সাধুমা নামে পরিচিত।  তাঁর রচিত বইয়ের নামঃ

মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪),

বুদ্ধ সালামী গাথা (তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত),

উদয়ন বস্তু (১৯৬১),

বৌদ্ধ গল্পমালা, তাঁর রচিত প্রকাশিত গ্রন্থ।

বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা

অশোক চরিত (১৯৮৩),

বিজয়গিরি,

মানুষ দেবতা (ভগবান বুদ্ধের অতীত জীবনী কাহিনী অবলম্বনে রচিত),

অনাগত বংশ তাঁর উল্লেখযোগ্য অপ্রকাশিত গ্রন্থ।

তন্মধ্যে “মানুষ দেবতা” নাটক (চালৈন দ্বিতীয় সংখ্যা- মিলিন্দ তনচংগ্যা’র সম্পাদিত সংখ্যা হতে নিয়মিত-ধারাবাহিকভাবে চতুর্থ সংখ্যা পর্যন্ত শেষ অবধি প্রকাশ করা হয়)

এবং “বিজয়গিরি” নাটক (পহর জাঙাল পঞ্চম সংখ্যা- কর্মধন তনচংগ্যা’র সম্পাদিত সংখ্যা হতে নিয়মিত-ধারাবাহিকভাবে ভাবে শেষ অবধি প্রকাশিত হয়)।

এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে তাঁর অসংখ্যা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তন্মধ্যে নৈরঞ্জনা, সম্বোধি, পার্বত্য বাণী, ঝরণা, সাপ্তাহিক বনভূমি উল্লেখযোগ্য পত্রিকাদি।

শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বিরাজমোহন দেওয়ান (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত লেখক), শ্রী প্রভাত কুমার দেওয়ান (গৈরিকা সম্পাদক) দ্বয়ের সমকালীন কবি ও লেখক ছিলেন এবং শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের অগ্রজ। শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্রের রচিত “রাধামন ধনপতি কাব্য” নামে রোমান্টিক একটা কবিতা রয়েছে। যা ২০০৮ সালে পহর জাঙালে (৪৪ পৃঃ-৬০ পৃঃ) ছাপা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের ডীন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে পাহাড়ের কবিরত্ন বলে আখ্যায়িত করেন।

 

কবি ও লেখক শ্রী ডা. কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৯৭ সালে ২২ মার্চ ৭৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

তথ্যসূত্র-

 

ক) পহর জাঙাল/সম্পাদক- কর্মধন তনচংগ্যা।

খ) তঞ্চঙ্গ্যা রতিকান্ত/ “তঞ্চঙ্গ্যা জাতি”

 

দৈংনাককের নব জন্ম: ভাগ্যের সন্তান তঞ্চঙ্গ্যাগণ

Bisumela

লেখকঃ বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে চতুর্থ স্থানের অধিকারী তঞ্চঙ্গ্যাগণ সর্বাধিক ভাগ্যবান বলে মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীসমূহের শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম ও আর্থসামাজিক যে অগ্রগতি সাধন হয়েছে, জনসংখ্যায় কম হলেও তঞ্চঙ্গ্যাগণ সে অগ্রগতির মানদণ্ড অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের কতিপয় ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় ও সাহিত্য ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

কোন ব্যক্তি বা জাতি যখন নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে, সমগ্র বিশ্বের আলোকে নিজেকে দেখতে আরম্ভ করে তখনই তার অন্তরে জাগরণ শুরু হয়। জাগরণের উজ্জ্বল রেখা বেয়ে সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল উৎসব তার মাঝে সমাবিষ্ট হয়। সেই ব্যক্তি বা জাতি সার্থক হয়। পরম ভাগ্যবান।

তঞ্চঙ্গ্যার সুযোগ্য সন্তান শ্রী ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু জীবনে উপসম্পদা গ্রহণ করতঃ শীমৎ অগ্রবংশ ভিক্ষু (বর্তমানে মহাস্থবির) নামে বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) বৌদ্ধ দর্শন ও ত্রিপিটকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। বার্মায় ১৯৫৪ সাল হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতি (আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ধর্ম মহাসম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির অন্যতম সংগীতিকারক (ধর্ম বিশ্লেষক) হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময় স্বধর্মপ্রাণ চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তাঁকে চাকমা রাজগুরু রূপে বরণ করার জন্যে স্বদেশে আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেন। তিনি বিদর্শন ও পালি ত্রিপিটকে এম. এ. ডিগ্রি গ্রহণ করে ত্রিপিটকাচার্য্য অভিষিক্ত হন।

উল্লেখ্য যে, তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে তাঁর ধর্ম বিনয় রাজগৃহে সপ্তাপর্নী গুহায় অরহৎ মহাকাশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে পাঁচশত অরহৎ কর্তৃক সংকলিত বা সংগৃহীত হয়। ইহা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে প্রথম সংগীতি নামে অভিহিত হয়েছে। এভাবে মাঝে মাঝে সম্মেলনী বা সংগায়নের মাধ্যমে তথাগত বুদ্ধের ধর্ম ও বিনয় পরিশুদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। এযাবৎ ছয়বার এরূপ ধর্মসংগীতি বা ধর্ম সংগায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এই ধর্ম মহা সম্মেলনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এরকম গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম মহাসম্মেলনীর অন্যতম সংগীতিকারক হিসেবে যোগদান করে শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির তঞ্চঙ্গ্যাগণকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করেছেন। তাঁকে ঐ সম্মেলনে তৎকালীন পাকিস্তানী বৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সদ্ধর্মপ্রাণ চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় সর্বাত্মক সহয়তা প্রদান করেন। বিশ্বের ক্ষুদ্রতর বৌদ্ধ সম্প্রদায় চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা এই গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম সংগীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সমগ্র বিশ্বে নিজেদের মর্যাদা সুমন্নত করেছে। দ্রষ্টব্য: The Chatta Snagayana Souvenir Album. পৃষ্ঠা – ৮৫।

বিংশ শতাব্দী তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য প্রথম সৌভাগ্য বহন করে এনেছে। তঞ্চঙ্গ্যাগণ ভাগ্যের সন্তান। কেননা, এত ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী অতিস্বল্প সময়ে সমগ্র বিশ্বের সদ্ধর্ম পুজারীর শুভেচ্ছা ও মৈত্রী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরের জন্য আত্বনিয়োগ করেন এবং অচিরেই অনেক চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা যুবক উপসম্পদা গ্রহণ করেন এবং চাকমা গ্রামে ক্যং বা বিহার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

উল্লেখ্য যে, তৎপূর্বে চাকমা সমাজে আগরতারা অবলম্বন করে লুরীগণ বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃতদেহের সৎকার ও অন্ত্যেষ্টী ক্রিয়া, ভাতদ্যা প্রভৃতি সামাজিক ও ধর্মীয় অনষ্ঠানাদিতে পৌরহিত্য করত। বৌদ্ধধর্মের মূল আদর্শ অনুসারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বিষয় লোকে একদম বিস্মৃত ছিল।

চাকমা রাণী কালিন্দী ১৮৫৬ সালে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের সংঘনায়ক শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবিরকে রাজগুরু পদে বরণ করে এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের পূনর্জাগরন এনেছিলেন। পরবর্তীকালে একশত বৎসরের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম পরিহীন হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে সদ্ধর্ম প্রবর্ধক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে রাজগুরু পদে বরণ করে পুনরায় এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম পূনর্জাগরণের মহতী উদ্যোগ নেন। ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে মহাস্থবির পদে বরণ করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং নেপালের রাষ্ট্রদূত শ্রী কিস্তিনিধি কিস্তা (পরবর্তীকালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী) সস্ত্রীক যোগদান করেন। রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবিরের প্রচেষ্টায় এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পূনর্জাগরণ কি আশ্চার্য্যজনকভাবে সম্পন্ন হয় চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় তাঁর ‘Buddhist Revival in the Chittagong Hill Tracts’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে চিত্তাকর্ষকভাবে সুন্দর বর্ণনা প্রদান করেছেন: “Kalindi’s reforms had far reaching effects not only on the Chakmas but also on the Marmas and Buruas. Since her time, Buddhism has gradually advanced at the expense of animist and other non-Buddhist practices. However, the number of Chakma monks and monasteries in the Chakma country were still far-smaller than in the case of the Barua and the Marma. The great change in the Buddhist practices of the Chakmas came in the 1950’s almost exactly a hundred years after Rani Kalindi and Sangharaja Saramedha. In 1958, at the invitation of the Chakma Raja Tridiv Roy, the venerable Agravamsa Thera (now Mahathera) came to Rangamati to be appointed the Chakma Raj Guru. In 1959, “The Parbatya Chattagram Bhikkhu Samiti”, was established under the Rajgurus leadership and the number of monasteries. These effects were felt even among the smaller peoples such as Mro and Khyang. The Rajguru remained in Rangamati upto 1976 and the Buddhists of Chittagong Hill Tracts recall the venerable Agravamsa’s name with much gratitude. The learned Pali scholar and exponent of the Tripitaka who studied in Burma for more than ten years has left behind a rich legacy.” (দ্রষ্টব্য: বিংশতিতম কঠিন চীবর দান স্বরণিকা ’৯৩। রাজবন বিহার, রাজবন, রাঙ্গামাটি পৃ: ৪৬, ৪৭) রাজা দেবাশীষ রায় মহোদয়ের এই বক্তব্যে রাজগুরু শ্রীমৎ অংগ্রবংশ মহাস্থবিরের অবদানের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি এবং তাঁর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়ছে।

চাকমা সমাজে স্বদ্ধর্মের পূনর্জাগরণের মূলে শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবিরের মহান অবদানের জন্য চাকমাগণ তাঁর কাছে ঋণী একথা অকপটে স্বীকার করা হয়ে থাকে। লক্ষণীয়; – সত্যকথা বলতে হলে ২০/২৫ বৎসর পূর্বে চাকমা সমাজে কঠিন চীবর দানের নানা বিধি বিধান জানা ছিলনা। অন্যান্য ধর্মাচরণ বিধিও খুব যে জানা ছিল তাও নয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (তখন স্থবির) বার্মায় শিক্ষা সমাপন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখনকার চাকমা প্রধান স্বনামধন্য মেজর ত্রিদিব রায় সঙ্গে সঙ্গে তখন তাঁকে রাজগুরু পদে বরণ করে নেন। ইহা সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে, সর্ব প্রথম তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই চাকমা সমাজে ধর্মের জাগরণ আসে। শীল পালন, উপসথ গ্রহণ, চীবর দান, সংঘদান ইত্যাদি বিষয়ে আমরা তাঁর কাছেই প্রথম পাঠ নিই। তখনকার দিনে অবশ্য পূর্বে বর্ণিত তৃতীয় প্রণালী মতে পূর্বে প্রস্তুত চীবর দিয়েই কঠিন চীবর দান করা হত। কিন্তু সেই যুগে তাও কম ছিলনা। আর এভাবে তাঁর কাছে হাতেখড়ি না নিলে পরবর্তীকালে বনভান্তের মত মহাসাধকে বুঝার মত, গ্রহণ করার মত আমাদের সামর্থ হতনা। এযেন অনেকটা মহাসাধক মুক্ত পুরুষ বনভান্তের কল্যানময় আবির্ভাবের জন্যই আগে ভাগে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখা। (দ্রষ্টব্য: “বুদ্ধ প্রশংসিত কঠিন চীবর দান ও আধুনিক বৌদ্ধ সমাজ, শ্রী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, প্রাক্তন সম্পাদক, রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটি; বৃহতের সন্ধানে। শ্রীলঙ্কা সরকার কর্তৃক উপহার প্রদত্ত বোধি বৃক্ষ চারা রোপণ ও শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ ভিক্ষু (বনভান্তে) মহাস্থবির বরণোৎসব ’৮১ স্বরণিকা”) প্রবন্ধে লেখক বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ডি.সি. অফিসের হেডক্লার্ক ছিলেন। তিনি চাকমা উত্তরাধিকার আইন ও চাকমা প্রবাদবাক্য গ্রন্থের রচয়িতা এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক।

কালিন্দী রাণীর আমলে তঞ্চঙ্গ্যাগণ ব্রিটিশদের কুকি দমন অভিযানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল। রাইংখ্যং কুতুবদিয়া অধিবাসী (তৎকালীন সুবলং বরকলের বাসিন্দা) শুভধন তঞ্চঙ্গ্যা, কুণ্ড মহাজন, হিচাধন আমু বিভিন্নভাবে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিলেন বলে জানা যায়।

পাকিস্তান আমলেই তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা দীক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাত্রা শুরু হয়। চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী কাগজকল প্রতিষ্ঠিত হলে এতদ এলাকার তঞ্চঙ্গ্যাগণ অনেকেই চাকুরী এবং বাঁশ সরবরাহের ঠিকাদারী গ্রহণ করে। এই প্রথম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তাদের ব্যাপক যোগাযোগ ঘটে। কাপ্তাইতে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ ১৯৬০ সালে সম্পন্ন হয়। জমিজমা, ঘরবাড়ী জলমগ্ন হলে রাইংখ্যং অঞ্চলের বহু তঞ্চঙ্গ্যা বান্দরবান, রেজা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি, নোয়াপতং এলাকায় চলে যায়। ঐ প্রকল্পের অধীনে শ্রী ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (তিনি তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্ব প্রথম বি.এ. ডিগ্রিধারী) কানুনগো হিসেবে এবং শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা এসিস্ট্যান্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। পূর্বে জেলা প্রশাসক কার্যলয়ে শ্রী যোগেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও শ্রী রবিকুমার তঞ্চঙ্গ্যা এম.এল.এস.এস. চাকুরীতে নিযুক্ত ছিলেন।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সুযোগ্য সন্তান শ্রী যতীন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৬ সালে এল. এল. বি. ডিগ্রী অর্জন করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অপর কেউ তৎপূর্বে ঐ ডিগ্রী লাভ করেছিলেন বলে জানা যায় না যদিও তৎকিয়ৎ পরবর্তীকালে চাকমা ও মারমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এল. এল. বি. ও এল. এল. এম. ডিগ্রী অর্জন করেছেন। শ্রী যতীন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৯ সালে ই. পি. সি. এস. পাশ করে ১৯৭০ সালে ডেপুটি ম্যজিষ্টেট পদ লাভ করেন এবং ১৯৯০ সালে মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক পদে ২রা জুলাই যোগদান করেন।

ষাট ও সত্তরের দশকের দিকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অনেকেই সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কয়জন তারা হলেন – শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (আমিন); তিনি পরে রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমীর অধ্যক্ষ হন। তদানীন্তন জেলা প্রশাসক জনাব শফিকুল ইসলাম মহোদয় (পরবর্তী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার) এই একাডেমী স্থাপন করে দেন। ১৯৮১ ইং ১লা জানুয়ারী বঙ্গভবনে যুব সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরা শিল্পী (চারু) হিসেবে সম্বর্ধিত হন। অন্যান্যদের মধ্যে শ্রী চিত্র কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড), শ্রী নতুন চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রজনী কান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (ব্লক সুপারভাইজার), শ্রী অজিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও শ্রী মতি শাসনা তঞ্চঙ্গ্যা (অফিস সহকারী, জেলা প্রশাসক অফিস) এবং শ্রী নবকুমার তঞ্চঙ্গ্যা (এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পরবর্তীতে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী), শ্রী সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যা (ফার্মাসিস্ট), শ্রী মনোজ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী মোহন লাল তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রবি মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (রাঙ্গামাটি পৌরসভা), শ্রী হীরাবালা তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী রাবন তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী বাল্মীকি তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী নেত্র (লত্র) তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রীমতী পুষ্প তাকুকদার (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী ভুবন মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী অতুল তঞ্চঙ্গ্যা (ফরেস্টার), শ্রী যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (ফার্মাসিস্ট) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে বহু তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষ মহিলা সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন বা করেছেন।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের অধ্যয়ন সত্তরের দশক হতে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। প্রকৌশল, চিকিৎসা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থী পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তঞ্চঙ্গ্যাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে যখন পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন আরম্ভ হয় তখন চট্টগ্রাম জেলার লোক, দলে দলে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ধাবিত হয়। রাজবিলা, নোয়াপতং, তাছারা (বান্দরবান), রাজস্থলী, রাইংখ্যং এর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ও দুর্ভেদ্য জংগল অতিক্রমকালে তাদেরকে ঐ এলাকার তঞ্চঙ্গ্যাগণ আহার পানীয় দিয়ে সহায়তা করে এবং নিরাপদ পথে সীমান্ত পাড় করে দেয়। রাজস্থলীর ভাইস চেয়ারম্যান জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, নূতন চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), মুনু তঞ্চঙ্গ্যা, আরো অনেকে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। ঐসব এলাকাতে এবং হোয়াগ্গা, বারঘোনিয়া অঞ্চলে পাঠান পাঞ্জাবীদের হাত থেকে বাঁচাতে বহু বাঙ্গালী পরিবারকে আশ্রয় প্রদান করা হয়। হোয়াগ্গার অধিবাসী বর্তমানে ১নং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী অনিল তঞ্চঙ্গ্যা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বান্দরবানের বালাঘাটা নিবাসী উদয়সেন তঞ্চঙ্গ্যা ও লাল মোহন তঞ্চঙ্গ্যা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। বান্দরবানে অদ্যাবধি তাঁদের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের রাজনৈতিকভাবে পৃথক জাতিসত্ত্বা হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ সালের ১৯ নং আইন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ সালের ২১ নং আইন পাশ ও বলবতের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতিনিধিত্ত্বের জন্য যথাক্রমে দুইটি ও একটি পৃথক পৃথক আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের উল্লেখযোগ্য বসতি না থাকায় ঐ জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য পৃথক আসন সংরক্ষণ করা হয়নি। ১৯৮৯ সালের ২৫শে জুন প্রথম স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১০০ নং হোয়াগ্গা মৌজার হেডম্যান বিশিষ্ট সমাজকর্মী শ্রী পরিমল তালুকদার এবং ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজার স্বনামধন্য মেঘনাদ কার্বারীর সুযোগ্য পুত্র শ্রী রূপময় তঞ্চঙ্গ্যা (বাবুল) রাঙ্গামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে ১৩১ নং বল্লালছড়া মৌজার প্রাক্তন হেডম্যান শ্রী সাতকমল আমু বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী প্রসন্নকান্তি তঞ্চঙ্গ্যা (দুর্জয়) সদস্য পদে নির্বাচিত হন।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকার পরিষদ প্রবর্তনে সরকারের সহায়তা করে শ্রী পরিমল তালুকদার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যাগণ স্বীকৃতি লাভ করে এবং প্রশাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার সুযোগ লাভ করেছে।

 


লেখকঃ বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, তঞ্চঙ্গ্যা মহা সম্মেলন ১৯৯৫ ইং।

 

 

 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

লেখকঃ প্রয়াত বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

অদ্যাবধি পৃথক তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস রচনা করা হয়নি। তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বর্তমান সম্পর্কে কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কেবলমাত্র চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। তাও অনুমান নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে চাকমা জাতির একটি শাখা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যাদের পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে মাত্র।

চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমার একটি শাখা বলে স্বীকার করে। এমনকি আসল বা মূল চাকমাও বলে থাকে। কিন্তু আশ্চার্য‌ের বিষয় এই যে, চাকমাদের যে গোজা গুষ্টি আছে সেই সব গোজা গুষ্টির সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের বারটি গোজা বা সকল গুষ্টির নামের সাথে কোন মিল নেই। চাকমা জাতির ইতিহাস রচয়িতাগণ তাঁদের রচিত ইতিহাসে এমনকি আধুনিক চাকমা লেখকগণ তাঁদের চাকমাজাতি বিষয়ক রচনায় তঞ্চঙ্গ্যাদের গোজা গুষ্টি বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির নাম চাকমাদের গোজা গুষ্টি বা আচার অনুষ্ঠান বলে উল্লেখ করেননা। যদি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা একই জাতিভুক্ত বলে স্বীকার করা হয় – তবে তঞ্চঙ্গ্যাদের গোজা গুষ্টি বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদিও চাকমাদের নিজস্ব বলে স্বীকার করার দুর্বলতা থাকবে কেন? হিন্দুগণ বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্ম বা সনাতন ধর্ম বলে দাবী করেন, তাই তথাগত বুদ্ধকে হিন্দুদের অবতার (দশম অবতার) রূপে পূজা করেন।

চাকমা জাতির উত্থান পতন, জয় পরাজয়, আশা আকাঙ্খা, সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা, অভিযান অগ্রগতি বা সমবৃদ্ধির বিবরণীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। কেবলমাত্র ইতিহাসের শো’কেসে তঞ্চঙ্গ্যাদের পুতুল বানিয়ে আবদ্ধ করেই রাখা হয়েছে।

Tanchangya people by Heronmoy Tanchangya Emon

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে চাকমা ইতিহাস গ্রন্থে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তঞ্চঙ্গ্যাগণকে চাকমা জাতির একটি শাখা বলে ধরে নিতে কষ্ট হয়। শ্রী সতীশ চন্দ্র ঘোষ প্রণীত “চাকমা জাতি”, শ্রী মাধব চন্দ্র চাকমা রচিত শ্রী শ্রী রাজনামা, শ্রী বিরাজ মোহন দেওয়ান কর্তৃক লিখিত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” এবং চাকমা জাতি সম্পর্কীয় অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তি প্রসঙ্গে একই ধারা অনুসরণ করা হয়েছে। মূলতঃ একই সূত্রকে কিঞ্চিৎ রদবদল করে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তির ইতিবৃত্ত সাজানো হয়েছে।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ রচিত “চাকমা জাতি” গ্রন্থে দৈংনাক বা তঞ্চঙ্গ্যার উৎপত্তির কাহিনী নিম্নরূপঃ “৬১৫ মঘাব্দে (১৩৩৩-৩৪ খৃঃ অঃ) আরাকানাধিপতি মেংগদি সমীপে লামুন ছুগ্রীনামা জনৈক দূত আসিয়া সংবাদ দিলেন, উচ্চব্রহ্মের চাকমা রাজা নানা উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছেন। এই সংবাদে তিনি প্রধানমন্ত্রী (কারেংগ্রী) রাজাংগ্যা ছাংগ্রাইর অধীনে দশসহস্র সৈন্য দিয়া চাকমা রাজার বিরুদ্ধে পাঠাইলেন। পরে রিজার্ভ হইতে আরও বিশ সহস্র সৈন্য তাহার সাহায্যার্থে দিলেন। কিন্তু ছাংগ্রাই আরও সৈন্য সংগ্রহ করে করিয়া তং থংজার শাসনকর্তা হিংজচুর অধীনে দশ হাজার এবং তংশুর শাসনকর্তা রেমাচুর সঙ্গে দশ হাজার সৈন্য দিয়া মংদ্রুমের পথে ……শাসনকর্তা ছাদোয়ং এর তত্ত্বাবধানে দশ হাজার সৈন্য দিয়া দালার ছারংকামার পথে, দালাকের শাসনকর্তা ক্যচুংঙের সহিত দশ হাজার সৈন্য দিয়া দালার পথে, …… নামক শাসনকর্তাকে দশ হাজার সৈন্য দিয়া রুচ্চারুইর পথে, মাইয়ং এর শাসনকর্তা থেচুকে দশ হাজার এবং চিংথোজার শাসনকর্তা লাচুই-এর অধীনে দশ হাজার সৈন্য দিয়া ছালোক্যার জল পথে প্রেরণ করেন। মন্ত্রী নিজে বিশ হাজার রিজার্ভ সৈন্য, পঞ্চাশ হাজার অপরাপর সৈনিক এবং বিশ হাজার বাঙ্গালী কুলী সমভিব্যাহারে চানীর পথে যাত্রা করিলেন। এইরূপ প্রত্যেকেই যথাস্থানে প্রস্তুত হইয়া রহিলেন।

এতদ্ভিন্ন বলিয়া দেওয়া হইয়াছিল, তং থংজার শাসনকর্তা নিকট পেঁগো রাজ্য থাকিবে। পেগুরাজ বাধা দিতে চাহিলে তোমরা বলিবে, “আমরা যুদ্ধ করিতে আসি নাই।“ মঘরাজ মিত্রতা স্থাপনের নিমিত্ত এক পরমা সুন্দরী রমণী উপহার লইয়া আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন। পরে তোমার স্ত্রী লোকটিকে সুসজ্জিত করিয়া দেখাইও। দালার পথযাত্রী ক্যুচুংকেও এইরূপে শ্যামরাজাকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত উপদেশ দেওয়া হইল। বলা বাহুল্য তাঁহাদের সঙ্গে এক  একটি সুন্দরী রমণীও দিয়াছিলেন। অনন্ডর মন্ত্রী প্রবর ইহাও জানাইয়া দিলেন যে, তিনি স্বয়ং চাকমা রাজার রাজধানী (উচ্চব্রহ্মে) মইচাগিরি আক্রমণ করিবেন, সুতরাং উচ্চ ও নিম্নব্রহ্মের সকলে সাবধানে থাকিবে। যখন যাহা ঘটে, যেন অবিলম্বে তাঁহার কাছে সংবাদ প্রেরিত হয়।

মন্ত্রী ছাংরাই তংদাপ্রু নগরে উপস্থিত হইয়া চান্দাই নামক জনৈক শাসনকর্তাকে একখানি পত্রসহ চাকমা রাজার দরবারে দূতরূপে পাঠাইলেন। পত্রে উল্লেখিত হইল, মঘরাজা এক পরমাসুন্দরী যুবতীর সহিত তাঁহাকে প্রেরণ করিয়াছেন। চান্দাই নিজমুখেও এতাদৃশ বিবরণী বেশ সাজাইয়া গুছাইয়া বলিলেন। চাকমা রাজা ইহাতে বিশেষ পরিতুষ্ট হইয়া চান্দাইকে যথোচিত পুরস্কৃত করিলেন এবং  প্রধানমন্ত্রীর নিমিত্ত একটি হস্তী, একখানি সুবর্ণ যাঁতি, দুইটি ঘোড়া, সুবর্ণ নির্মিত রেকাব ও জিন এবং একটি সোনার থোকদান পারিতোষিক লইয়া স্বীয় মন্ত্রী ব্রাচমীকে পাঠাইলেন। ব্রাচমী আসিতেছে শুনিয়া ছাংগ্রাই সৈন্য বাহিনী পোচন্দাও পাহাড়ে লুকাইয়া রাখিলেন। নিজে মাত্র কয়েকজন লোক লইয়া রহিলেন। ব্রাচমী আসিয়া উপস্থিত হইলে তাঁহাকে এক সুন্দরী রমণী প্রদর্শিত হইল। অনন্তর এই যুবতীকে লইয়া যাইতে লোকজন পাঠাইবার নিমিত্ত পত্র দিয়া ব্রাচমীকে বিদায় করিলেন। ব্রাচমী প্রত্যাবৃত হইয়া রাজার কাছে সুন্দরীর অলৌকিক রূপলাবণ্য বর্ণনা এবং ছাংগ্রাই-এর (কূটনীতি প্রসূত) পরিচয়ানুসারে যুবতীকে মঘরাজ মেংগদির সহোদরা বলিয়া জ্ঞাপন করিলেন। পরিচয় শুনিয়া চাকমা রাজা আরও আহ্লাদিত হন এবং সবিশেষ আড়ম্বর সহকারে রাজাসহোদরাকে আনয়নের জন্যে অনেক লোক পাঠাইলেন। মন্ত্রী এই রমণীর সহিত একশত হস্তী ও চাকমা রাজাকে উপটৌকন প্রদান করিতে ঢাকার শাসনকর্তা রেয়ংকে দশ হাজার সৈন্য সঙ্গে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু রেয়ংকে গোপনে বলিয়া দিলেন, চাকমা রাজা নৃত্যগীতাদি অতিশয় ভালোবাসেন, মদ্যসেবীর অপরদিকে দৃষ্টি থাকে না, সুতরাং সুযোগ পাইলেই আপনি সুবিধা করিয়া লইবেন। পরে কাঁইচার শাসনকর্তা ওয়ান্টবোর সঙ্গে দশ সহস্র সৈন্য দিয়া পশ্চাদিক হইতে আক্রমণের নিমিত্ত পাঠাইলেন।

এদিকে রজনী সমাগমে চাকমা রাজা ইয়ংজ অনল লুব্দ পতঙ্গ প্রায় প্রমোদ নিকেতনে নৃত্য গীতাদিতে প্রমত্ত আছেন, এমন সময়ে রেয়ং যুবতীকে আনিয়া তদীয় করে সমর্পণ করিলেন। রাজা অতিশয় আনন্দের সহিত যুবতীকে পার্শ্ববর্তী আসনে উপবেশন করাইয়া পুনরায় আমোদ প্রমোদে নিমগ্ন হইলেন। রাত্রি প্রায় বারটার সময় রেয়ং চতুর্দিকে আক্রমণ করেন। ওয়ান্টবা ও পশ্চাদভাগের জঙ্গল পথে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ছাংগ্রাই এইরূপে দলে দলে ক্রমশ অপর সমুদয় সৈন্য পাঠাইয়া পরিশেষে দলবল সহ স্বয়ং যোগদান করিলেন। এখানে তাহদিগকে কোন যুদ্ধ ক্লেশ পাইতে হয় নাই। অতি সহজেই চাকমা রাজ ইয়াংজ এবং মধ্যম পুত্র চোফু ও কনিষ্ঠ পুত্র চৌতুকে বন্দি করিয়া মইচাগিরির পর্বতাকীর্ণ নগর মধ্যবর্তী রাজ প্রাসাদ অবরোধ করেন। সেখানেও বিনাক্লেশে যুবরাজ চজুং, রাণী তিনজন, দুইজন রাজকন্য এবং দাসদাসীগণকে বন্দি করিলেন। অতঃপর মন্ত্রী প্রবর ছাংগ্রাই ৬৯৫ মঘাব্দের (বাংলা ৭৪০ সাল) ২রা মাঘ চাকমা রাজা এবং তদীয় তিন রাণী, তিন পুত্র, দুই কন্যা ও দাসদাসীদিগের সহি রেয়ংকে মঘরাজ মেংগদি সমীপে পাঠাইয়া দেন। এইরূপে চাকমা রাজ্য অতি সহজেই মঘরাজার করতলগত হইল। অবশেষে ১৩ই মাঘ বিজিত রাজ্য হইতে পঞ্চাশটি হস্তী, কুড়িটি গয়াল, অপরিমিত স্বর্ণ-রৌপ্য এবং দশ সহস্র চাকমা প্রজা লইয়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

মন্ত্রী বর রাজাংগ্রা ছাংগ্রাইর কর্মদক্ষতায় অতিশয় পরিতুষ্ট হইয়া আরাকানাধিপতি মেংগদি তাঁহাকে “মাহাউছা ওয়ান্না” অর্থাৎ মহাপ্রজ্ঞা খেতাব ও একখানি স্বর্ণমণ্ডিত পাল্কী উপহার প্রদান করেন এবং হস্তীর উপর চড়িয়া যাতায়াতের অনুমোদন করিলেন। ইহাছাড়া তাঁহার পুত্র অংজাউর সঙ্গে  চাকমা রাজার কনিষ্ঠ কন্যার বিবাহ দিলেন। জ্যোষ্ঠা কন্যা চমিখাঁকে মেংগদি নিজেই  রাখিয়া দেন। অনন্তর চাকমা রাজা ইয়ংজকে আরাকানের অন্তঃপাতী কামুছা নামক স্থানের কাফ্যা জাতির আধিপত্য অর্পণ করেন। তাঁহার জৈষ্ঠপুত্র চজুং ও মধ্যমপুত্র চোফুর হস্তে যথাক্রমে কিউদেজা ও মিঃ রাজ্যের শাসন কর্তৃত্ত্ব দেওয়া হয় এবং কনিষ্ঠপুত্র চৌতুকে কাংজা নামক স্থানের জলকর তহলশীলদার দিয়া নিকটে রাখেন। অপর দশ সহস্র চাকমা প্রজাকে এংখ্যং এবং ইয়ংখ্যং নামক স্থানে বাস করিবার অনুমতি দেওয়া হইল। সঙ্গে সঙ্গে তাহদের পূর্বতন উপাধি পরিবর্তন করিয়া দৈংনাক আখ্যা প্রদান করিলেন।

স্বজাতীয় পোষাকে তঞ্চঙ্গ্যারা, ছবিঃ বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা জাতীয় ঘিলা খেলা গোল্ডকাপ টুর্ণামেন্টের ফেসবুক পেজ

এতাদৃশী অধীনতায় জীবন যাপন রাজপুত্রত্রয়ে ক্রমেই অসহনীয় বোধ হইতে লাগিল। ৭০৫ মঘাব্দে (১৩৪৪ খৃঃ অঃ) মেংগদি লিম্ব্রু যাত্রা করিলে তাঁহারা তিন ভ্রাতাই একত্রযোগে পোচন্দাও পার হইয়া উচ্চব্রহ্মে পলাইয়া গেলেন। মঘরাজ ইহা শুনিয়াও কোন উচ্চ বাক্য করিলেন না। অনন্তর জ্যৈষ্ঠভ্রাতা চজুং (সূর্য্যজিত) ভূতপূর্বাবশিষ্ঠ প্রজাগণকে লইয়া মংজাপ্রু নামক স্থানে রাজত্ত্ব আরম্ভ করেন। মধ্যম ভ্রাতা চৌফ্রু (চন্দ্রজিত) ক্যজম রাজার  নিকট হইতে “মংরেনা” খেতাব এবং প্রুম রাজ্যের আধিপত্য প্রাপ্ত হইলেন। কনিষ্ঠ চৌতু (শত্রুজিৎ) চাখাম নামক রাজার অধীনে থাকিয়া ক্রমে ৭২৪ মাঘিতে (১৩৬২-৬৩ খৃঃ অঃ) “তারদ্যা” উপাধি ও আমায়ু দেশের শাসনভার লাভ করেন। (চাকমা জাতি – সতীশ ঘোষ পৃঃ ২০-৩৩)।

চাকমা জাতির ইতিহাসে দৈংনাকদের (তৈনটংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা) উৎপত্তির কাহিনী ইহাই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, আরাকানাধিপতি কর্তৃক ধৃত চাকমা রাজা অরুনযুগের (ইয়ংজ) যে দশ সহস্র প্রজাকে এংখ্যাং এবং ইয়ংখ্যাং নামক স্থানে বাস করিবার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের পূর্বতন উপাধি পরিবর্তিত করে দৈংনাক বা দৈননাক আখ্যা প্রদান করা হয় তাঁরা আদৌ চাকমা ছিল কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। আরাকানী ভাষায় দৈংনাক অর্থে যোদ্ধাকে বোঝায়। সেই প্রজাগণ নিশ্চই যোদ্ধা ছিল কিংবা যোদ্ধা হিসেবে গণ্য ছিল। কোন রাজার সৈন্য দলে স্বজাতীয় যোদ্ধা ব্যতীত বিভিন্ন জাতি গোত্রীয় লোক থাকে। অতএব সেই দৈংনাকেরা কোন জাতি বা গোত্রীয় ছিল নিশ্চিত করে বলা যায় না।

অপরপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আদিবাসী চাকদের উৎপত্তির ইতিহাসও প্রায় তদনুরূপ। দৈংনাকদের উৎপত্তির প্রচলিত ইতিহাসের সাথে চাক উৎপত্তি কাহিনীর তেমন কোন পার্থক্য নেই। নিচের অংশটি সেটি পরিস্কার হওয়া যাবে।

“আরাকান রাজা মাং ভিলুর পুত্র রাজা মাংথির (মেংগদি?) শাসনামলে চাক রাজার নাম ছিল য়েংচো। তাঁর রাজধানীর নাম মিছাগিরি। মন্ত্রী কোরেংগ্রী লামুর শাসনাকর্তা পরামর্শক্রমে এক অদ্ভুত উপায়ে মিছাগিরি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি চারজন সেনাপতির নেতৃত্বে প্রত্যেকের সঙ্গে এক একজন সুন্দরী যুবতীসহ সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন পথে মিছাগিরি পাঠালেন। এক দূত মারফৎ য়েংচোর কাছে প্রস্তাব পাঠানো হল যে রাজা মাংথি নিজ ভগ্নী ব্রাহমীকে উপহার দিতে চান। প্রস্তাবে খুশি হয়ে রাজা য়েংচো আরাকানী দূত সাংতাংকে প্রচুর অর্থ আর একটি হাতি উপহার দেন এবং বলেন যে, ৬৯৫ মঘীর তাপোথায় মাসের ১২ তারিখ (১৩৩৩ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী ১২ তারিখ) তিনি ব্রাহমীকে গ্রহণ করবেন। নির্দিষ্ট দিনে ১০,০০০ হাজার সৈন্যসহ রেঅং নামক আরাকানী সেনাপতি ব্রাহমীকে মিছাগিরি নিয়ে আসে। ব্রাহমীর রূপ দেখে য়েংচো মুগ্ধ হন। এদিকে মূল আরাকানী হঠাৎ রাত্রিতে রাজ প্রাসাদ আক্রমণ করে এবং তাঁর দুই পুত্র ও দুই কন্যার সাথে য়েংচো বন্দি হন। একমাত্র জ্যৈষ্ঠ পুত্র চোচুং তাঁর অনুগত সৈন্যদের নিয়ে সুদূর ব্রহ্মদেশে পালিয়ে যান। আরাকান রাজ মাংথি রাজা য়েংচোকে ক্যখকা রাজ্যের শাসনভার, রাজকুমার চৌপ্রুকে মিঙ রাজ্যের শাসনভার, রাজকুমার চৌতুংকে কঙ রাজ্যের শাসনভার দেন এবং রাজকুমারী চোমে খানকে নিজে বিয়ে করেন। পরে চৌপ্রু বার্মায় পালিয়ে যান। চাকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠে এবং তাদেরকে পূর্ববর্তী স্থান থেকে উঠিয়ে এঙ নদী, রো নদী প্রভৃতির তীরে বসবাস করার ব্যবস্থা হয়। এভাবে সুবিখ্যাত চাকরাজ্য ১৩৩৪ খৃষ্টাব্দের দিকে ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীকালে কনিষ্ঠ রাজ পুত্র আনুমানিক ১৩৬৪ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে আসেন। অন্যান্য চাকরা তাকে অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে লামা মহকুমায় পৌঁছে। অনেকে তাঁর খোঁজ না পেয়ে আরাকানে ফিরে যায়।“ (মংমং চাক, চাক উপজাতি পরিচিতি; সাময়িকী গিরি নির্ঝর ১ম সংখ্যা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি)। এই হল চাক জাতির ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

চাক জাতির এই কাহিনীর সাথে সতীশ ঘোষের চাকমা জাতি ইতিহাসে বর্ণীত দৈংনাকদের উৎপত্তির কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নামগুলি বা স্থান সমূহের বানানে এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ পার্থক্য ব্যতীত উভয় কাহিনীই অবিকল এক। সতীশ ঘোষের চাকমা রাজ ইয়ংজ চাক ইতিহাসে য়েংচো, চাকমা রাজধানী মইচাগিরি চাক ইতিহাসে মিছাগিরি। ব্রহ্মদেশীয় মন্ত্রী ব্রাচমীকে চাক ইতিহাসে রাজকুমারী ব্রাহমী এবং চাকমা রাজা মারেক্য জয় ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পালিয়ে আসার তারিখটি চাকদের কাহিনীতে আনুমানিক ১৩৬৪ খৃঃ অঃ ধরা হয়েছে। রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের একজন প্রাক্তন পরিচালক বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও গবেষক বাবু অশোক কুমার  দেওয়ান তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থে (প্রথম সংস্করণ) প্রদত্ত মন্তব্য খুবই প্রনিধানযোগ্য।

তাঁর মন্তব্য এইঃ “তাহলে দেখা যায় এই যাবৎকাল পর্যন্ত প্রচলিত চাকমা জাতির ইতিহাসের অধ্যায়টি চাক জাতিও নিজের বলে দাবী করেছে। এই কাহিনী কি চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছে? না আমরাই তাঁদের কাহিনীকে আমাদের বলে চালিয়ে দিচ্ছ? সন্দেহ নেই যে, চাকরাও এই কাহিনী দেংগ্যাওয়াদি বা অনুরূপ কোন পুঁথি থেকে সংগ্রহ করেছে। অতএব আমাদের নির্ণয় করা দরকার দেংগ্যাওয়াদি কাহিনীকার সাক জাতির নাম আসলে কাদের কাহিনী বিবৃত করেছেন।“ (চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার – পৃষ্ঠা ৬৪, ৬৫, প্রথম সংস্করণ)।

Phayre এর History of Burma গ্রন্থটির উল্লেখ করে তিনি তাঁর ইতিহাস বিচার গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ “উপরের বর্ণিত বিবরণে তথকথিত চাকমা রাজা ইয়ংজ বা অরুনযুগের পতন কাহিনী বড় করুন। এতবড় শক্তিধর রাজা এবং একটি সমৃদ্ধ জাতির এই পরিণতি তাও আবার ছলনার মাধ্যমে; যার সঙ্গে কিনা আরাকান রাজ্য দুই লক্ষ সৈন্য দিয়েও সম্মুখ যুদ্ধে মুখোমুখি হতে সাহস পাননি অত্যন্ত দুঃখাবহ সন্দেহ নেই। চাকমা জাতির ইতিবৃত্তকারগণ একারণে এঘটনাকে বেশ ফলাও করে বর্ণনা করেছেন। লক্ষণীয় যে, দেঙ্গ্যাওয়াদির কাহিনীকার এই ঘটনাড় সঙ্গে আগেরগুলির ন্যায় অতি প্রাকৃত ঘটনার বিবরণ যোগ করে এটিকে কল্প কথায় পর্যবসিত করেননি। কিছু অতিরঞ্জন এবং অলঙ্কারের আতিশয্য সত্ত্বেও এই ঘটনার বিবরণ আগেরগুলির তুলনায় অনেক বাস্তবসম্মত কিন্তু এতবড় একটি মহীরুহের পতন যা প্রচণ্ড শব্দে চারিপাশের বনভূমিকে প্রকম্পিত করে তোলার কথা, অথচ আশ্চার্য্যের বিষয় ফেইরীর, ব্রহ্ম ইতিহাসে এই ঘটনার কোন ছায়া মাত্র পড়েনি।”

তঞ্চঙ্গ্যাদের ফা-কালাং (অলংকার রাখার ঝুড়ি) ও আদি অলংকার, ছবিঃ তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি – বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

 

 

সেই সময়ের আরাকান ইতিহাস ফেইরী এইভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “Arakan became subordinate to Pugan monarchy when Letyamegnan was placed on the throne of his ancestors. He fixed his capital at Parin. The country enjoyed rest for a long period, and there is nothing in the annals worthy of remark until after the centure of Pugan by the Mougals. In the early part of the fourteenth century mention is made of invasion by the Shans which apparently refers to attacks by kings of Myinsaing and Panya. (Phayre – History of Burma; p-76)

আরাকান ইতিহাসে মেংগদির  রাজত্ত্বকাল ১২৭৯ খৃঃ অঃ থেকে ১৩৮৫ খৃঃ পর্যন্ত (অবিশ্বাস্যভাবে দীর্ঘ ১০৬ বৎসর)। এই মেংগদির সময়েই উপরে দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণীত ১৩৩৩ খৃষ্টাব্দের মইচাগিরির পতনের ঘটনা। কিন্তু ফেইরীর ব্রহ্ম ইতিহাসে আরাকান রাজ মেংগদি কর্তৃক সাকরাজ্য জয়ের কোন বিবরণ নেই বরং  Myinsaing  এর শান জাতি কর্তৃক উল্টো আক্রমণেরই উল্লেখ আছে। দুটি পুস্তকে এই দু’ধরণের সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীতধর্মী বক্তব্য ধাঁধাঁর সৃষ্টি হয়।“

বিভিন্ন সূত্র পর্যালোচনা করে এই কাহিনী চাকদেরই দাবী করা সহজ বলে শ্রী দেওয়ান মন্তব্য করেন, “বর্তমানে চাক জাতি নানা কিছুর বিচারে উচ্চব্রহ্মের কাদু জনগোষ্ঠীর একটি শাখা বলে অনুমিত হয়। সে কারণে চাকদের পক্ষেই সাক পরিচয় দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত এবং যদিও ইয়াংজ কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ আছে তবুও সে কাহিনী তাদেরই দাবী করা সহজ।“ (প্রাগুক্ত – পৃঃ ৬৭)

দৈংনাক বা তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তির কাহিনী অনুসন্ধানকালে আরাকান এবং  উচ্চব্রহ্মেই দৃষ্টি নিবদ্ধ থেকে যায়। চাকমা জাতির ইতিহাসবেত্তাগণের সুদীর্ঘকালের ব্যাপক গবেষণার ফলশ্রুতিতে আরাকান বা ব্রহ্ম ইতিহাসের অতলগর্ভে দৈংনাক বা তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতিসন্ধির সম্ভাব্যতা সমধিক বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রসঙ্গে Sir Arther Phayre তাঁর ১৮৪১ খৃঃ অব্দে প্রকাশিত “An account of  Arakan” নামক নিবন্ধে দৈংনাকদের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর নিবন্ধে তিনি দৈংনাকদের যে বিবরণ দিয়েছেন তা সংক্ষিপ্ত হলেও খুবই প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বর্ণনা নিম্নরূপঃ “The remaining hill tribes are the  Doingnak and the Murung. They both inhabit the upper course of the Mayariver. The language of the first is a corrupt Bengali. They call themselves kheim-ba-nago. Of their descent I could learn nothing, probably they may be offspring of Bengalees carried into the hills as slaves, where their physical appearance has been modified by change of climate. In religion they are Buddhists.” (Lt. Phayre – An account of Arakan, Journal of  the Asiatic society of Bengal 1841)

দৈংনাকরা বর্তমানে আরাকানের রাসিডং, ভুসিডং, মংদু, ক্যাকতও কতিপয় জায়গায় বাস করে। উচ্চব্রহ্মেও তাঁরা বসবাস করছে বলে জানা যায়। ১৯২১ সালে বর্মার আদমশুমারিতে তাঁদের সংখ্যা ৪৯১৫ জন ধরা হয়েছিল। দীর্ঘ চুয়াত্তর বছরে তাঁদের সংখ্যা কত হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়।

শ্রী আশোক কুমার দেওয়ান তাঁর চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থে ফেইরীর উপরোক্ত বিবৃতিতে নিম্নলিখিত মন্তব্য করেছেন – “চাকমাদের একটি দল দৈংনাকেরা সুদীর্ঘকাল পূর্ব থেকে আরাকানে বসবাস করে আসছে। দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাঁদের কথা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। তাঁদের কথা নূতন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় Sir Ather Phayre তাঁর ১৮৪১ সালে প্রকাশিত An account of Arakan নামক নিবন্ধে। ফেইরী বলেছেন যে, দৈংনাকরা নিজেদের “থেইম বানগো” বলে পরিচয় দেয়। এই “থেইমবানগো” কথাটির অর্থ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আরাকানী ভাষায় বা প্রতিবেশী কোন উপজাতীয় ভাষায় শব্দটির কোন অর্থ হয় না। সুতরাং আমাদের কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। অনুমান হয় যে ফেইরীর আলাপ করার সময় তাঁর আসলে নিজেদের চম্পকনগরের লোক বলে পরিচয় দিয়েছিল। ফেইরী সেই সময় ছিলেন লেফটেনেন্ট পদমর্যাদার একজন তরুণ অফিসার। সেই তরুণ বয়সে তিনি আরাকানী ভাষা আয়ত্ত্ব করেছিলেন বলে মনে হয় না। সম্ভবতঃ কোন আরাকানী দোভাষীর মাধ্যমেই তাঁদের কথাবার্তা চলেছিল। আরাকানী ভাষায় শব্দের শেষে হলন্ড ব্যঞ্জন উচ্চারিত হয় না। অতএব চম্পকনগর শব্দটির উচ্চারণ আরাকানী দোভাষীর উচ্চারণে “চেইম্বপানগো” হওয়াই স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ এই চেইম্বপানগো শব্দটিকে শোনার ভুলে হোক বা নোট করার ভুলে হোক ফেইরী “থেইমবানগো” লিখেছেন। এটি নিছক অনুমান। এই অনুমান ছাড়া দৈংনাকরা নিজেদের থেইমবানগো হিসেবে পরিচয় দেওয়া আর কী অর্থ হতে পারে আমরা ভেবে পাই না। দৈংনাকদের মধ্যে বরাবরই চম্পকনগরের বিজয়গিরির রাজ্যাভিযান সম্পর্কিত জনশ্রুতি প্রচলিত এই ধারণার কারণ এই যে আরাকানবাসী দৈননাকদেরই প্রত্যাগত অংশ তংটঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের প্রতিটি লোকই আজ পর্য্যন্ত সেই একই বিশ্বাসে গভীরভাবে বিশ্বাসী। দৈননাকদের সঙ্গে এই অঞ্চলে জনগণের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে কম করে হলেও প্রায় ৩০০ বছর। ইতিপূর্বে আলোচনা অনুযায়ী রাধামোহন ধনপুদি উপাখ্যানসহ চম্পকনগরের বিজয়গিরির গোটা কাহিনী যদি ঊনবিংশ শতাব্দী বা তারও কিছু পূর্বে রচিত বলে অনুমিত হয়, তবে দৈননাকদের মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে ফেইরীর আমলে সেটি প্রচলিত হওয়ার কথা নয়। সুতরাং রাজা বিজয়গিরির নেতৃত্বে চম্পকনগর থেকে দক্ষিণাভিমুখে যুদ্ধাভিযানে আসার পর তাঁরা আর পূর্বস্থানে ফিরে না গিয়ে এ অঞ্চলেই বসতি স্থাপন করেছিল। দৈননাকসহ চাকমা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সে বিশ্বাসের মূলে অবশ্যই একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে।” (প্রাগুক্ত) চাকমা রাজা অরুনযুগ বা ইয়ংজ এর আরাকান রাজা মেংগদির হাতে পরাজয়বরণ ও দশ সহস্র চাকমা প্রজাসহ স্বপরিবারে বন্দী হওয়ার ঘটনা সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন আরাকান বা উচ্চব্রহ্মে দৈংনাক নামধেয় একটি পৃথক জাতি বা জনগোষ্ঠী থাকার কথা কদাপি মিথ্যা নহে। দৈংনাক শব্দটি আরাকানী বলে সবাই একমত। ইহার অর্থ হল যোদ্ধা। যোদ্ধা বলে কোন জাতি থাকতে পারেনা। কোন জাতি বা রাজার সৈন্যকে বা সৈন্যদলকে যোদ্ধা বলা যায় মাত্র জাতি বলা যায় না। সেই সৈন্যদলে সেই জাতি বা রাজার স্বজাতীয় সৈন্য ব্যতীত অন্য কোন জাতির লোক থাকা অসম্ভব নহে। ব্রিটিশের সৈন্যদলে গুর্খা, অহমিয়া, বাঙ্গালি প্রভৃতি জাতির লোক যেমন রয়েছে।

স্বকীয় পোষাক ও অলংকারে তঞ্চঙ্গ্যা কিশোরী, ছবিঃ তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি – বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

ফেইরী বলেছেন দৈংনাকেরা বৌদ্ধ এবং তাঁরা মায়া নদীর (মায়ু) উর্দ্ধভাগে বসবাস করেন। তাঁদের ভাষা বিকৃত বাংলা। তাঁদের ভাষা বিকৃত বাংলা বিধায় তিনি অনুমান করেন যে, তাঁরা দাসরূপে আনীত বাঙ্গালিদের উত্তর পুরুষ হওয়া সম্ভব। সেখানে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে দৈহিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন হয়েছে।

ফেইরীর এই অনুমান সঠিক নহে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোন জনগোষ্ঠীর শারীরিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার আমুল পরিবর্তন কোনদিন সম্ভব হতে পারে না। মঙ্গোলীয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে একই জলবায়ুতে পাশাপাশি শতশত বৎসর বাস করেও কোন বাঙ্গালির (অমঙ্গোলীয়) দৈহিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন হয়ে মঙ্গোলীয় উপজাতীয়তে রূপান্তরিত হয়েছে বলে কোন দৃষ্টান্ত এযাবৎ দেখা যায়নি। বৈবাহিক কারণে রক্তের সংমিশ্রণ ব্যতীত দৈহিক গঠন, আকৃতি ও চেহারার পরিবর্তন সম্ভব নহে। কাজেই ফেইরীর এই সিন্ধান্ত আমরা বাতিল করতে পারি এবং বলতে পারি দৈংনাকরা নৃতাত্ত্বিক বিচারে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার লোক বিধায় প্রাচীন Tai বা Shan দের গোত্রীয়।

আরাকান ও উচ্চব্রহ্মে অপরাপর মঙ্গোলীয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর দৈংনাকরা অন্যতম তা প্রাচীন আরাকান ইতিহাসে পাওয়া যায়। যথাঃ “প্রাচীন আরাকান রাজ্য ছিল মোঙ্গল, তিব্বত ব্রহ্ম জনগোষ্ঠী ও মুরুং, খুমী, চাক, সিন, সেন্দুজ, ম্রো, খ্যাং, ডইনাক, মারুমিউ প্রভৃতি কিরাত উপজাতি অধ্যুষিত দেশ।” দ্রষ্টব্যঃ (প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসীঃ আবদুল হক চৌধুরী। বাংলা একাডেমী, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ; ১৪০০ সাল, জানুয়ারী ১৯৯৪ পৃষ্ঠা ৩)। পুস্তকে বর্ণীত ডৈনাকই দৈংনাক। অপরপক্ষে চাক বলতে চাকমা কিংবা চাক কাকে বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চাকমা এবং দৈংনাকদের একসঙ্গে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়। ধর্ম এবং ভাষার সাদৃশ্য থাকাতে উভয় জাতিসত্ত্বার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মৈত্রী থাকার কথা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। আরাকানবাসীদের সঙ্গেও দৈংনাকদের কোনরূপ দ্বন্দ ও সংঘাত ছিল না। অন্ততঃ ইতিহাসে কোন দ্বন্দের উল্লেখ নেই। সেইজন্য অদ্যাবধি আরাকানে ও উচ্চব্রহ্মে দৈংনাকগণ শান্তিতে বসবাস করছে।

আরাকানীদের সঙ্গে চাকমাদের সুদীর্ঘকাল ধরে, দ্বন্দ ও সংঘাত ছিল। এই দ্বন্দ ও সংঘাতের পরিণতি এমন হয়েছিল যে আরাকানীদের (মগদের) অত্যাচার বেড়ে যায় এবং চাকমাগণ আরাকানে থাকতে পারেনি। তাঁরা আরাকান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। স্বদেশভূমি চম্পকনগর ফিরে যাবার জন্য তখন শ্লোগান রচিত হয় তা উদ্ধৃত করা হল।

চল বাব ভেই যে যে যে

চম্পকনগরত ফিরি যে।।

এলে মৈসাং লালস নেই

ন এলে মৈসাং কেলেশ নেই।।

ঘরত থেলে মগে পায়

ঝাড়ৎ গেলে বাঘে খায়।।

মগে ন পেলে বাঘে পায়

বাঘে ন পেলে মগে পায়।

অর্থাৎ

চল বাপ ভাই চল যাই

চম্পকনগরে ফিরে যাই।

আসলে মৈসাং লালসা নাই

না আসলে মৈসাং ক্লেশ নাই।

ঘরে থাকলে মগে পায়

ঝাড়ে (জংগলে) গেলে বাঘে খায়।

মগে না পেলে বাঘে পায়

বাঘে না পেলে মগে পায়।

এতে বোঝা যায়, চাকমাদের অবস্থা কি নিদারুণ কষ্টকর হয়েছিল তখন। চাকমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় এবং উভয়ের ভাষা প্রায় একই হবার কারণে দৈংনাকরাও আরাকানীদের হাতে নিগৃহীত হতে পারে অনুমান করলে ভুল হবে না। কারণ চাকমাদের সঙ্গে দৈংনাকদের একাংশ ও আরাকান ত্যাগ করে বলে ইতিহাসে দেখা যায়।

চাকমা ইতিহাসের তথ্য অনুসারে মৈসাং রাজার পুত্র মারেক্যা ও তৈনসুরেশ্বরীর নেতৃত্বে চাকমারা ১৪১৮ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আলীকদম নামক স্থানে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন এবং তথায় তৎকালীন চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা মোঃ জালাল উদ্দীনদের অনুমতিক্রমে ১২ খানি গ্রামে সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র চাকমা রাজ্য গঠন করেন। উক্ত ১২ খানি গ্রামকে বলা হতো “বার তালুক”। তখন তৈন সুরেশ্বরী নামানুসারে মাতামুহরীর একটি উপনদীর নাম তৈনসুরেশ্বরী রাখা হয়।

শ্রী আশোক কুমার দেওয়ান চাকমা ইতিহাসে উল্লিখিত মৈসা কিংবা মারেক্যা আসলে চাকমা রাজা কিনা এবং আরাকান থেকে চাকমা প্রজাদের নিয়ে পলায়নের ইতিহাস বিভ্রান্তি মূলক বলে তাঁর “চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার” গ্রন্থে (পৃঃ ৭৪, ৭৫, ৭৬) উল্লেখ করেছেন।

চাকমাদের রাজা বা দলপতি সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য যাই থাক না কেন চাকমাগণ মগদের অত্যাচারে নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়ে আরাকান যে ত্যাগ করেছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে হয়ত একই জাতিভুক্ত এই বিশ্বাসে দৈংনাকদের তাঁদের সঙ্গে আরাকান ত্যাগ করে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে আলীকদমের তৈনসুরেশ্বরী নদী অববাহিকায় বার তালুকে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতে থাকে।

দৈংনাকরা যে বৌদ্ধ তা History of Burma রচয়িতা তৎকালীন আরাকান বিভাগের কমিশনার ফেইরী উল্লেখ করেছেন। তাঁদের  সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র ত্রিপিটক ছিল। চাকমাগণও বৌদ্ধ। শত অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হলেও তাঁরা আরাকান ত্যাগের সময় বৌদ্ধ ধর্মকে ত্যাগ করেনি। তাঁদের পরবর্তী ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে তাঁরা আরাকান ত্যাগ করার প্রাক্কালে ধর্ম‌শাস্ত্র সঙ্গে বহন করেছিল। কিন্তু মূল ত্রিপিটক দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অথবা তাঁদের কাছে না থাকাতে তাঁরা মূল ত্রিপিটক সঙ্গে নিতে পারেনি। দৈনন্দিন কাজে বা মৃত্যু, বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারোপযোগী প্রয়োজনীয় সূত্র মূল ত্রিপিটক হতে লিপিবদ্ধ (Copy) করে নেয়। ঐ সূত্রগুলির প্রত্যকটি এক একটি তারা এবং সম্মিলিত নাম আগরতারা। এযাবৎ মোট আটাশটি তারার সন্ধান পাওয়া গেছে। শত্রুতা ও সংঘর্ষের কারণে আরাকানীদের (আরাকানীরাও প্রথম থেকে বৌদ্ধ) কাছে অবস্থিত ত্রিপিটক হতে সূত্র অনুলিপি করা কোন চাকমার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। লক্ষণীয় যে, যেসব দৈংনাক আরাকান ত্যাগ করে  আলীকদম বা তৈনছড়িতে চলে যায় তাঁদের কোন আগরতারা ছিল না – বরঞ্চ মূল ত্রিপিটক ছিল  বলে ধারণা করা যায়। নতুবা তারাও সংকলিত সূত্র বা আগরতারা কিংবা অন্য কোন নামধেয় ধর্মশাস্ত্র সঙ্গে বহন করত। কাজেই ইহা অনুমান করা ভুল হবে না যে চাকমাগণ দৈংনাকদের কাছে অবস্থিত ত্রিপিটক থেকেই আগরতারা লিপিবদ্ধ করে থাকতে পারে তবে ইহা নিছক অনুমান মাত্র।

কথিত আছে চাকমাগণ চট্টগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করলে আলীকদম ও আরাকানের বহু দৈংনাক স্বজাতীয় বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকমাদের সান্নিধ্যে বসবাস করার উদ্দেশ্য তত্র অঞ্চলে চলে আসে। আলীকদম থেকে কিছু দৈংনাক হ্নাক্ষ্যংছড়ি, লামা ও বর্তমান কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। অদ্যাবধি সেই সব জায়গায় তাঁরা বসবাস করছে।

উত্তরদিকে আসার পথে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, হোয়াকক্ষ্যং, রাজবিলা, শুকবিলাস, বাঙ্গালহালিয়া, নারানগ্রী, কাপ্তাই উপত্যকা অঞ্চল, নোয়াপতং, রাইংখ্যাং উপত্যকা সম্পূর্ণ অঞ্চল, হোয়াগ্গা, বড়াদম, ঘাগড়া, রইস্যাবিলি এসব অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁর আমলে জনৈক ফাপ্রু নামক ব্যক্তিকে দলনেতা করে একজোড়া হাতি ও বহু স্বর্ণালঙ্কারাদি উপটৌকন দিয়ে চারিহাজার দৈংনাক এতদঅঞ্চলে (স্থায়ী) বসবাসের নিমিত্ত রাজা ধরম বক্স খাঁর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে। রাজা ধরম বক্স খাঁ তাঁদেরকে এতদঅঞ্চলে বসবাসের অনুমতি দেন কিন্তু স্বজাতি চাকমা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি বলে জনশ্রুতি আছে।

তখন সমতল জমিতে কৃষি পদ্ধতি সবেমাত্র আরম্ভ হয়। অধিকাংশ প্রজারাই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। দৈংনাকগণও জুমচাষী ছিল। চাকমা রাজ সরকারের জুম তৌজিতে তাঁদেরকে চাকমা উল্লেখ না করে তৈনটংগ্যা (অধিকাংশ আলীকদমের তৈনছড়ি থেকে আগত বলে) নামে উল্লেখ বা তৌজিভুজ করা হল। তৈনটংগ্যা শব্দটি ক্রমে ক্রমে “তঞ্চঙ্গ্যা” এই লিখিত রুপ লাভ করে।

Tanchangya Aalam 1
তঞ্চঙ্গ্যা আলাম (ডিজাইন ক্লথ), ছবিঃ তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি – বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

 

চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ দৈংনাক বা তঞ্চঙ্গ্যা দিকগকে স্বজাতি চাকমা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও অবহেলা করেছিলেন বলে মনে হয় না। কেননা, চাকমা হেডম্যানের সমমর্যাদা সূচক হেডম্যান পদে কতিপয় তঞ্চঙ্গ্যাকেও নিযুক্ত করা হয়। বর্তমানে ১০০ হোয়াগ্গা মৌজা, ১০৮ মানিকছড়ি মৌজা, ১২০ ছাক্রাছড়ি মৌজা, ১৩০ বারুদগোল্লা মৌজা, ১৩১ বল্লালছড়া মৌজা, ৩৩৩ ঘিলাছড়ি মৌজা, ১১৭ কৌশল্যাঘোনা মৌজা, বান্দরবানের তম্রু মৌজাগুলির হেডম্যান সকলেই তঞ্চঙ্গ্যা। উল্লেখ্য যে, চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায়ের আমলে চাকমা অধ্যুষিত ১১৭ কৌশল্যাঘোনা মৌজার চাকমা হেডম্যান লাল মোহন তালুকদার মারা গেলে ঐ মৌজাবাসী শ্রী যতীন তঞ্চঙ্গ্যাকে হেডম্যান পদে নিযুক্ত করা হয়।  চাকমা হেডম্যানদের যে মর্যাদা রাজ দরবারে প্রদান করা হয়, তঞ্চঙ্গ্যা হেডম্যানদেরকেও সেই মর্যাদা প্রদান পূর্বকাল থেকেই চলে আসছে। দৈংনাকগণ এতদঅঞ্চলে আগমণের কিয়ৎকাল পরে রাজা ধরম বক্স খাঁ বসবাসের সুবিধার জন্য চট্টগ্রাম শহরে একটি পাকা দালান তৈরি করিয়ে রাজাকে উপহার প্রদান করে। ঐ দালান লালকুঠি নামে বিখ্যাত এবং কমিশনার বাহাদুরের বাসভবনরূপে ব্যবহৃত হয়। রাজা নিজের খাস মৌজা ১১৬ রাঙ্গামাটি, ৫৯ বন্দুক ভাঙ্গাতে ও দৈংনাকদের বসবাসের অনুমতি প্রদান করেন। ১১৬ রাঙ্গামাটি মৌজায় অদ্যাবধি বহু তঞ্চঙ্গ্যার বসবাস দেখা দেয়।

তঞ্চঙ্গ্যা আলাম (ডিজাইন ক্লথ), ছবিঃ তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি – বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

বর্তমান গ্রন্থের রচয়িতা সরকারী পুর্নবাসন বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার চাকুরী করার সময় বন্দুক ভাঙ্গা মৌজায় বেশ কয়েক পরিবার চাকমার সন্ধান লাভ করেন যারা নিজেদের তঞ্চঙ্গ্যা বলে তাঁর কাছে উল্লেখ করেন। ঐ মৌজার খারেক্যং এলাকায় এখনো তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া নামে একটি স্থানের নাম আছে। উক্ত মৌজা স্বনামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তি প্রয়াত ধর্ম মোহন কার্বারী চেয়ারম্যান (তিনি দীর্ঘদিন ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন) নিজেকে ধন্যা গোজার (তঞ্চঙ্গ্যার অন্যতম গোজা) তভাদাঘির লোক বলে প্রকাশ করতেন। অর্থাৎ তাঁর পূর্বপুরুষ ঐ গোজার লোক (তঞ্চঙ্গ্যা) ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্র শ্রী সাধন মানিক কার্বারী সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত। অন্যতম প্রবীণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি শ্রী মিয়াচান তালুকদারও নিজেকে তঞ্চঙ্গ্যা বলে উল্লেখ করতেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী শ্রী রমেশ চন্দ্র চাকমা ও সিলেট জেলার মৎস্য কর্মকর্তা শ্রী চন্দ্র কুমার চাকমা তাঁদের পূর্বপুরুষ তঞ্চঙ্গ্যা ছিলেন বলে প্রকাশ করে থাকেন।

এতদঅঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমণ ও বিকাশের ইতিবৃত্ত যাই হোক না কেন সুদীর্ঘকাল নিজেদের স্বতন্ত্র সত্ত্বার অনুভূতিতে ক্রমে ক্রমে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব কৃষ্টি, সাংস্কৃতির জন্মলাভ ঘটেছে যা এতদঅঞ্চলের অপরাপর জনগোষ্ঠীর কৃষ্টির, সংস্কৃতি থেকে সহজে আলাদা মনে হয়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস কোন রাজবংশ বা দলনেতার ইতিহাস নয়। তাঁদের ইতিহাস, তাঁদের সাধারণ জনমানুষেরই ইতিহাস। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের অভিযান অগ্রগতি কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির খতিয়ান নহে তা সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অভিযান অগ্রগতি ও সাফল্যের খতিয়ান।

  লেখকঃ প্রয়াত বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা , তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, তঞ্চঙ্গ্যা মহা সম্মেলন ১৯৯৫ ইং

সংগৃহীতঃ https://www.jumjournal.com/ইতিহাস/তঞ্চঙ্গ্যা-ইতিহাস-2052

Tanchangya people

Tong

By Sujan Tanchangya, Thailand

This article is primarily in response to a couple of emails that I received from readers who wanted to know more about the Tanchangya people. This is despite the fact that there are a number of fragmented articles appearing on the online webs and of course a number of books, booklets and magazines about the Tanchangyas and their life have been published in the recent time. However, given its holistic nature of the article – though it may not be the perfect in every sense – it wouldn’t be far from the truth to claim that this article is probably the first of its kind to be circulated over the internet world. Therefore, it is our humble hope that this article will shed some light on the Tanchangya Tribe for those who are yet to know who or what ‘Tanchangya’ is.

‘Tanchangya’ is an indigenous tribal community living in the greater Chittagong Hill Tracts (CHT) of South-eastern part of Bangladesh. Tanchangya is one of the thirteen tribal communities of the CHT, namely, Chakma, Marma, Tripura, Tanchangya, Mro, Ryang, Khumi, Chak, Murung, Khyang, Bunjugi, Pankhu and Lushai. The members of all these thirteen indigenous communities are also collectively known as ‘Jumma’, a national ideology that gave birth after the independence of East Pakistan (Bangladesh) from West Pakistan in 1971.

The Chittagong Hill Tracts region, which has been a bloody insurgency zone between the tribal guerrilla organization known as the ‘Shanti Bahini’ (The Peace Force) formed by the thirteen indigenous tribal communities collectively known as ‘Jumma’ and the Government of People Republic of Bangladesh from 1973 to until the well-known signing of a Peace Accord officially known as the ‘CHT Peace Accord’ in 1997), covers an area of 13,189 sq. km., which is about 1/10th of the total surface area of the country. The CHT region shares borders with Arakan Hills, Burma on the East, Mizoram and Tripura on the Northeast and Chittagong district, Bangladesh on the West. The CHT consists of three hill districts of Bandarban (bordering Burma), Rangamati (bordering India and also partially Burma) and Khagrachari (bordering India). Rangamati is the administrative capital of this specially designated hill region.

Tanchangya is used as an adjective and as a noun too, for instance, I am a Tanchangya. My name is Nimal Tanchangya. Or as a nominal adjective like – I saw a Tanchangya girl yesterday.

It is to be mentioned here that since the Tanchangya people share a common religion, a slightly- differed language, many similar social and traditional customs and norms with the Chakma people, and the fact that their history is no different from that of the Chakma’s, the Tanchangya Tribe has often been labeled as a Sub-tribe of the larger dominant Chakma Tribe. But, whatever the case be, it is equally worth mentioning that the Tanchangya tribe has been officially recognized as a separate and distinct tribe by the Government of Bangladesh and many Institutions.

In terms of population, the Tanchangya tribe ranks fifth among the thirteen tribal communities but in general reference they are mentioned as the fourth as shown above. According to the 1991 national census, their number was 21,057 and the number of Tanchangya households was 4,043 and according to the latest Bangladesh national census of 2004, the Tanchangya population is 35,000. However, some Tanchangya activists claim that their population number is much higher than officially estimated.

 

Anthropologically the Tanchangyas are Mongoloid but more popularly categorized as Sino- Tibetans by some. According to their folktales and oral history, the Tanchangyas claim that they originally belonged to a powerful and prosperous kingdom called ‘Champak-nagar’ (probably giving the meaning: the city of magnet) ruled by a king named ‘Bijoy-giri/vijaya-giri’ (the winner of hills) – the name signifies that he conquered many hills on which to cultivate on. The traditional practice of cultivation on burnt hills known in the CHT as ‘jhum’ (slash cultivation on hills), and this particular jhum cultivation practice gave birth to the collective name of the 13 indigenous tribal communities as ‘Jumma’ – with the help of a brave army commander named ‘Radhamon’ in a place called Arakan in modern day Burma. They migrated to the CHT region of Bangladesh approximately in the middle of the thirteen century AD. At the time of their migration, the CHT was then an independent Buddhist kingdom ruled by a king of the Chakma dynasty. When a large number of Tanchangya migrants arrived in the Chakma Buddhist kingdom, the king at first did not permit them to settle down in his kingdom. So the Tanchangya leaders had to pledge allegiance to the king with large sum of money and jewelries, only then were they allowed to settle down in seven allocated villages nearby a famous river called ‘Rang- khyong gang’ in the Rangamati district partially bordering Burma. As time passed by, Tanchangyas of these seven villages spread in all parts of the three hill districts.

Recent researches into the history of the Tanchangya people have suggested a more fascinating story of the reason behind the historical migration of the Tanchangya people from the Arakan hills to the CHT.

It has been (mythically) suggested that the Tanchangyas were forced to flee their ancient kingdom due to a war between their kingdom and another neighboring kingdom, in which their king was defeated. In order to escape the onslaught of the advancing invading king, the Tanchangyas took temporal shelter in deep jungles and forests while some fled their kingdom and took refuge in CHT.

Even up to now, Tanchangyas, who had been scattered in various parts of that region due to the above mentioned war, have still been living in the southeastern regions of Tripura, Mizoram and Manipur States of India, as well as in the Arakan region of Burma. The number of Tanchangyas living outside the CHT region could far exceed the number living in the CHT. In Arakan, the Tanchangyas are known as ‘dounnak’, the undefeated.

Tanchangyas have their own form of language which, in actual sense, is more of a dialect. It is a mixture of Pali, Sanskrit, Prakrit and Bengali with some English terminologies included. Tanchangya language has no written script. However, recently, some Tanchangya writers and intellectuals and a handful of non-natives have been trying to put into script the grammar structure of the Tanchangya language using the Bengali script in an organized and easy-to- reference format. It has been a tough job though due to its complex spoken structure.

Like many of the tribal communities, Tanchangyas also have a very organized social and family structure. A Tanchangya family usually consists of 5-10 members but generally the sons who get married choose to live separately in a separate house. When the parents are old, usually the youngest or the eldest son is supposed to look after them. However, any son has the right to look after the parents if he so desires, so do the daughters.

 

A Tanchangya village generally consists of not more than 60-70 households, the largest of which may consist of may be 100 and the smallest of which may consist only of 5-10 households. Tanchangyas are well known for their choice of building their houses and huts on hill-slopes and green hill valleys, often in remote part of dense jungles. The Tanchangya hierarchical system states that only the sons are entitled to receive a portion of father’s wealth and daughters cannot claim any. Since hill cultivation also known as Jhum cultivation is the main source of income, lands and hills are vital in the survival of the Tanchangya people.

Traditionally, Tanchangyas have an extensive lineage system. The entire Tanchangya tribe consists of seven ‘gocha/gosha’ which can be well translated as ‘clan’, of which the Karwa- gocha, the Mua-gocha and the Dhunya-ghocha are the main and leading clans. These three clans dominate the larger Tanchangya tribe. The majority members and the most educated, with some exception of course, belong to either of these three clans.

Moreover, each of the seven clans also has its own sub-clans locally known as ‘guit-ti’. The extensive Tanchangya lineage system becomes important when it comes to the linguistic and some behavioral points and matters. The dialects, dressing, behaving and some social norms differ from clan to clan and even to a lesser extent from sub-clan to sub-clan. Therefore, it can be concluded that the Tanchangya language, as a whole, is a combination or encompasses the slightly-different dialects of all these seven clans and thus the larger Tanchangya tribe is a combination of slightly-different cultures, dressing, social norms and customs of all the seven clans. However, it is also to be noted that all the Tanchangyas do not introduce themselves by name of clans or sub-clans but by the common designated title ‘Tanchangya’.

As to the marital relationship, traditionally three kinds of marriages can be found within the Tanchangya social structure:

1. A pre-arranged marriage in which the bridegroom brings the bride in his parents’ home. This is the most accepted, approved and prevalent marital system in the Tanchangya society. This kind of marriage is arranged by the help of a third party between the parents of both parties with the prior approval of the would-be bridegroom and the bride. In this kind of marriage, the parents are the decision-makers.

2. A pre-arranged marriage in which the bridegroom goes to live with the bride in her parents’ house. This is the rarest practice among the three.

3. A marriage in which the would-be husband and wife elope as lovers and decide to live as legal couple. This can be called from modern context as ‘love marriage’. Traditionally this kind of marriage is also accepted but not approved specially by the conservatives. The decisions of the couple play the most vital role in this kind of marriage. Nowadays, this third kind of marriage i.e. choosing one’s own life partner is the most chosen criteria for marriage, the influence of which can be partially due to the Western influence of so-called modernization.

Tanchangyas are also quite famous for the husband being younger in age than his wife, a practice which can not be found in other communities. And this practice is quite commonly seen in the Mua-gocha clan of the larger Tanchangya tribe. A Tanchangya marriage does not in any way come under the influence of Buddhism. However, it is also customary for the new couple to go to the village temple for blessings of monks and listening to the chanting of the ‘Mangalasutta’ (A Buddhist Holy Scripture). The entire marriage ceremony is generally conducted by village elders who are expert in traditional values. In Tanchangya marriages, pigs, hens and fishes are killed in order to entertain the guests and well-wishers with delicious dishes. More interestingly, there is a special sacrificial offering called – shumulang – without which a couple is not considered as legally married. In this special sacrificial offering which must be conducted by a village physician [a village physician known as ‘Boiddo’ in the Tanchangya language acts as a doctor in Tanchangya villages. In most cases, these particular ‘boiddos’ also have black magical powers to drive away evil spirits and they even have powers to kill people or bring immense disasters by means of their black magical charms], two hens or cocks are killed in the name of the protecting house guardian for happiness and prosperity for the new couple.

The traditional clothing attire of the Tanchangya women in particular is yet another spectacular outlook to be observed. It is said that the Tanchangya women excel all other hilly women in wearing colorful dresses and ornaments. Like some of their counterparts of other tribes, the Tanchangya women weave, sew and make their own clothing by means of traditional handicrafts.

Traditional Tanchangya women also wear lavish jewelries over their clothing. Usually these lavish jewelries – ear-rings, hand-rings and foot-rings, necklace, bracelets and many different varieties of neck-garlands made of ancient coins and beads – have come down from many generations from mother to daughter. These jewelries are the only wealth daughters get from their mothers mostly at the time of their marriage and these jewelries become precious treasures for the daughters.

A Tanchangya woman-attire basically consists of five main sets:

1. Pinoin or skirt: this is the main set which is weaved with mere threads of different colors, arranged and decorated with colorful lines of designs

2. Jumo shalum or blouse: this is a piece of cloth also weaved and then later on sewn with hands with traditional designs in the form of a blouse

3. Paa-duri or waist belt: this is a piece of long cloth weaved with traditional designs and worn over the waist to support the tightness of the pinoin or the skirt

4. Mada-habong or head scarf: this is quite similar to (but not the same as) the paa-duri but is of different designs worn over the head to protect the head from sunshine and to escape from dust and it also helps to carry heavy stuff on the head

5. Hadhi or scarf: this is also similar to the paa-duri but it is a bit bigger and weaved with elaborate designs of different shining silk threads and worn over the body hanging from the shoulders up down below the waist. Sometimes it is also worn around the chest. This hadhi is a vital clothing set of decoration especially for young girls.

However, due to the rapid globalization and continuous evolution of so-called modernization, nowadays the Tanchangya women of the younger generation are neglecting their traditional dress of which their mothers and grandmothers were once proud of. These days, the so-called modernized Tanchangya girls hardly even know how to weave her set of traditional clothing. Traditionally it had been very hard for a Tanchangya girl to get a husband if she didn’t know how to weave her own set of clothing.

The Tanchangya men, on the other hand, only wear two sets of clothing, a sarong/ lung-gi or a dhoti and a shirt. Usually they buy these from markets.

Probably because of Arakanese Buddhist influences, Tanchangyas also have been Buddhists from the inception. Nowhere in their history were they recorded as followers of some other organized form of religions other than Buddhism and of course a little bit of animistic influence were inevitable.

Tanchangyas are followers of Theravada form of Buddhism. However the form of Buddhism the Tanchangya people follow is very much mixed with some animistic and tribal cults, some of which even include animal sacrifices to gods of various kinds and purposes, which are not Buddhistic in nature. Broadly speaking, these practices can be said of the influences from early Brahmanic civilization. Nevertheless, the Tanchangya people do not consider these practices as Buddhist but more of social and traditional and this makes the argument fair. Generally, there is a Buddhist temple in every Tanchangya village known in their language as ‘khyong’. They observe religious rites such as worshipping Gotama Buddha, listening to Buddhist sermons on auspicious occasions, celebrating the Buddhist Pravarana and Kathina festivals, Full Moon Days and many other Buddhist related festivals and celebrations.

Somehow or other, up to date, Tanchangyas have not been converted into Christianity as in the case of Lushai indigenous community and few others. Thus the term Tanchangya also implies a Buddhist. But at least a half or more of the Tanchangya population, given their practices and influence of animistic rituals, cannot be considered Buddhists in the strict sense of the term either. As is the case, any indigenous community is not exempted from some sort of animistic rituals and so are the Tanchangyas.

There are a number of animistic rituals which can be observed in a Tanchangya society. Some of these animistic rituals contain elaborate rites in which pigs, goats and a huge number of hens and cocks are sacrificed in the name of gods and spirits of various purposes. Tanchangyas also have some bloodless animistic rituals like candle and flower offering to the spirit of the village river and offering of cooked-rice mixed with red chili to the spirit of sunshine, to name but a few.

Hunting with spears, bows and arrows along with hand-made nets in the deep and dense jungles up the green hills is also a part of Tanchangyas’ daily activity which, in a way, is also a means of their survival especially in the remote jungle areas where modernity has not yet found a footing. Nevertheless, the aforementioned animistic ritualistic elaborate sacrifices and hunting for wild animals have almost come to a stop due to the relentless efforts of some socially engaged Buddhist monks who have been trying hard to bring a stop to all these non-Buddhist ritualistic practices.

Apart from this, however, the most celebrated festival of the Tanchangya people is the ‘bishu’ festival which corresponds to the Bengali New Year of the month of April. Bishu is celebrated for a lengthy period of four to five days, during which Tanchangya people also go to temples to pray for a better and prosperous beginning of the New Year and say good bye to the old year and also pray for a better agricultural harvest. All the Tanchangyas decorate their houses and temples with wild flowers and creepers. During the bishu festival, all the Tanchangya people shun all form of daily activities but enjoy it with their heart-fill followed by elaborate traditional entertaining concerts. This is the day of family union. This is the day of exchanging visits among friends and relatives. This is the day of enjoyment and merry-making. This is the day of happiness for all Tanchangyas.

The Tanchangya people also have a long oral history in which many interesting and elaborate traditional or even historical incidents and stories are recorded. As recorded in the oral history, [the Tanchangya oral history is still being preserved without being committed to writing in any form. There are some special groups of people known locally as ‘ging-guli’ who are preserving the history orally. These people are invited in traditional festivals and weddings to relate the history of the Tanchangya people and even love stories. They only use a violin and relate in poetic form which may continue the whole night non-stop. But sadly due to modernization, the young generation, nowadays, hardly pay attention to this invaluable traditional form of entertainment. As a result, only a handful of ‘ging-gulis’ can be found nowadays], the story of Radhamon, the commander-in-chief of King Bijoy-giri and his fiancée Dhonpudi is worth mentioning. Radhamon and Dhonpudi were lovers. And this traditional love story is one of the most well-known told stories among the Tanchangya people but most popular among the older generation. This love story is pretty much like the Roman love story of Romeo and Juliet.

Besides these, there are also many traditional songs known as ‘uba-git’ and folktales known as ‘kit-ta’ and moral-related stories known as ‘poshon’ preserved in the Tanchangya oral history. No doubt, if the entire Tanchangya oral history is put into writing, it will form yet another large volume of fine world literature.

However, in spite of having some unique traditional and cultural values and a rich literature, the Tanchangyas still lag behind some of the larger contemporary indigenous communities in the region of the CHT in respect of modern education, regional politics and cultural awareness. The 1991 national statistics showed that not even one third of the Tanchangya population is educated in its modern sense. Nevertheless very lately, quite a large number of Tanchangyas have been holding some government civil posts in the fields of education, health and to a lesser extent regional politics. During the past two decades or so, a considerable number of Tanchangyas also have undergone and have been undergoing higher educational training locally and in abroad. But still the majority of the Tanchangya population is yet to get the smell of modernity.

Lately many books, articles, magazines and leaflets have been published about the life and culture of the Tanchangya people. In them, the Tanchanya people have been described by many anthropologists and writers as – ‘shy, modest in nature, honest, easily approachable and hospitable’.

Existence and survival of any human society is a continuous flux of evolution, transformation and preservation. Many distinct human races have been uprooted from this world or at least on the brink of complete annihilation and destruction. The Tanchangya Tribe is no exception. And this realization has given birth to a thing called ‘cultural awareness’ in the minds of the modern educated Tanchangya people. These people have formed a number of societies and organizations in the CHT for the re-evaluation, transformation and preservation of the Tanchangya cultural and traditional values. Hopefully, this cultural awareness of the Tanchangya people would help maintain and persist the existence and survival of the Tanchangya Tribe in the long run.

*****************************************

* This article, written by Sujan Tanchangya who is currently engaged in undergraduate research studies in Thailand, is basically for general reference. The writer wishes to stress the point that the lifting of ideas and information from this article is not copyrighted provided he/she is responsible for any outcome of his/her action. The ideas and information in this article are based purely on the personal knowledge, experience, observation and research reading of the writer. Any misinformation in this article is therefore open to creative criticism and correction; and any feedback, suggestions and recommendations are cordially welcomed.

অভিধর্ম বিশারদ “ভদন্ত ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির

লেখক: মিলিন্দ তনচংগ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম প্রচার প্রসারের কথা লিখতে, বলতে গেলে তৎকালীন রাজগুরু প্রিয়রত্ন মহাথেরর (পালকধন তনচংগ্যা, ১৮ শতক) পরবর্তী সময়ের রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ) ভান্তের সমসাময়িক শ্রীমৎ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের (তেজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা) কথা আসবেই। আমার লেখা এ ক্ষেমাঙ্কর ভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবন নিয়ে। শুরুতে বলে রাখি ক্ষেমাঙ্কর ভান্তেরর জীবনী নিয়ে তেমন কোন লেখা নেই বললেই চলে এবং পাওয়া যায়নি। আমি যেটা উপলব্ধি করেছি তিনি প্রচারবিমুখ ছিলেন। এখনকার সময়ে ধর্মীয় গুরুরা যেভাবে প্রচারে প্রসার করে বেড়ান সেক্ষেত্রে উনি বা উনারা (বিশেষত পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ) ব্যতিক্রমধর্মী। আমার ভাগ্য হয়েছে ক্ষেমাঙ্কর ভান্তেকে কাছ থেকে দেখার, কিন্তু সেই সময় আর এই সময় অনেক ব্যবধান। কে জানত তাকে নিয়ে যে কোন একদিন আমাকে লিখতে হবে! তবে চেষ্টা করেছি এ ধর্মীয় গুরুকে নিয়ে সামান্য কিছু লেখার। স্বীকার করছি এ তথ্য খুবই কম, প্রত্যাশা থাকবে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে আমার লেখার ভর বাড়িয়ে দিবেন।

ভদন্ত ক্ষেমাংকর মহাস্থবিরের জীবনী আলোচনা করার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম বৌদ্ধধর্ম বিকাশ ও প্রচারের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা যাক। পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধধর্ম অধ্যুষিত অঞ্চল। বৌদ্ধধর্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও বর্তমানের মতো তৎকালিন সময়ে এভাবে ধর্মীয় প্রচার করার দৃশ্যগত চোখে পড়তোনা। গ্রামের পর গ্রাম চোখে পড়লেও বিহার চোখে পড়েনা, বিহার থাকলে ভান্তে পাওয়া কঠিন। যার মূল কারণ ভৌগলিক, ভাষাগত পার্থক্য ও শিক্ষার অনগ্রসরতা। আর যেখানে শিক্ষা নেই, সেখানে ধর্মীয় বিনয় সম্মত বিধি বিধান পড়াশোনা অসম্ভব। এ বাধাবিপত্তির মুখে তৎকালীন রানী কালিন্দী রায় ১৮৮৫ সালে তাঁর রাজধানী রাজানগর বিহারে আরাকানি বংশোদ্ভূত বৌদ্ধধর্ম ধারক, সাধক ও পণ্ডিত সংঘরাজ সারমেধ থেরকে রাজগুরু পদে বরণ করে আনেন। যেটার লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম প্রচার। কিন্তু তাঁর এ উদ্যোগ বেশিদিন টিকেনি। যেটার মূল কারণ ভিক্ষুসংঘ অভাব এবং শিক্ষাদীক্ষার অভাব। তাছাড়া লুরী নামক একপ্রকার ধর্মীয় যাজকশ্রেণী তখনকার সময়ে সমাজে সর্বত্র প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যার ফলে বৌদ্ধধর্ম দর্শন নিয়ে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এভাবে প্রায় ৭০ বছর পর রাজা মেজর ত্রিদিব রায় (বর্তমান চাকমা রাজ পিতা) নেতৃত্বে ১৯৫৪-৫৬ সালে মায়ানমার রাজধানী তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) অনুষ্ঠেয় ষষ্ঠসংগীতিকারক ত্রিপিটক বিশারদ, পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের প্রতিষ্ঠাতা, গুণীব্যক্তি শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথেরকে (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) স্বদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫৭ সালের শেষ সপ্তাহে অগ্রবংশ মহাথেরকে মায়ানমার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমে অগ্রবংশ তাঁর জন্মস্থান বিলাইছড়ির কুতুবদিয়ায় অবস্থান করেন। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজা মেজর ত্রিদিব রায়ের আহবানে অগ্রবংশ চাকমা রাজবিহারে রাজগুরু পদে বরণ হয়ে আসেন। মহীয়সী নারী রাণী কালিন্দী রায়ের কয়েক দশকের ব্যবধানে রাজা ত্রিদিব রায় রাজগুরু পদে আগ্রবংশ ভিক্ষুকে বরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম দর্শন প্রচারের এবং নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে। মহাস্থবির অগ্রবংশ রাজগুরু পদে আসীন থেকে নিজের মেধা, শ্রম দিয়ে বৌদ্ধধর্ম বিনয় বিধি বিধান, বৌদ্ধদর্শন প্রচারে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। অগ্রবংশ মহাথের পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যেমনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, আর সেসময়ের তাঁর সমসাময়িক সহযোগী যাঁরা ছিলেন তন্মধ্যে ক্ষেমাংকর মহাস্থবির অন্যতম একজন।

রাঙামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলাস্থ কুতুবদিয়া গ্রাম হলো তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, বলা যায় অবিস্মরণীয় গ্রাম। কেন না, তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের যা যা গুণী ব্যক্তি আছে তার প্রায় অধিকাংশ এ গ্রামের সন্তান। শ্রীমৎ ক্ষেমাংকর মহাস্থবির তন্মধ্যে একজন। আর কুতুবদিয়া বগলতলী বৌদ্ধ বিহারেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম বৌদ্ধদের অন্যতম কঠিন চীবর দানোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। যেটার মূল উদ্যোক্তা মহাজন শ্রীধন তঞ্চঙ্গ্যা। সাল ১৯৪৫ এবং বগলতলী বিহার নির্মাণ হয় ১৯২৪ সালে, রাইংখ্যং এলাকার ১২০ নং ছাক্রাছড়ি মৌজার হেডম্যান শ্রী ভক্কলী তঞ্চঙ্গ্যা (আমু)। পাঠক এবার বোধহয় বুঝতে সক্ষম হয়েছেন কেন ক্ষেমাংকর ভান্তের জীবনীর আগে পিছনে ফেরত যাওয়া হলো। এখন ক্ষেমাংকর ভান্তের মূল জীবনীতে আলোচনা করা যাক। জ্ঞানী, স্বধর্ম প্রচারক ধারক ও বাহক ক্ষেমাংকর মহাস্থবির বর্তমান বিলাইছড়ি আওতাধীন ১২১ নং কেংড়াছড়ি মৌজার পূর্বপ্রান্ত রাইংখ্যং নদীর তীরবর্তী সবুজাভ পাহাড়ের পাদদেশস্থ শামুকছড়ি গ্রামে ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম- কালিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, মাতার নাম রূপসী বালা তঞ্চঙ্গ্যা। ভান্তের পিতামাতা উভয়ই ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও সংস্কারবাদী। ক্ষেমাংকর ভান্তের গৃহীর নাম তেজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। ছয় সন্তানের মধ্যে তেজেন্দ্র ছিলেন তৃতীয় সন্তান। উল্লেখ্য শ্রী কালিচন্দ্র (ভান্তের পিতা) ছিলেন ভিক্ষু এবং কাপ্তাই বারোঘোনিয়া বৌদ্ধ বিহারেই সন্ন্যাসী অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজের আগ্রহ ও পরিবারের সম্মতিতে ১৯৪৪ সালে কোন এক পূর্ণিমাতিথিতে গৃহী তেজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা চিৎমরম বৌদ্ধ বিহারে প্রব্রজিত হন। তাঁর পড়াশুনা হাতেখড়ি গ্রামে হলে শ্রামণ জীবনেও তা অব্যাহত রাখেন। বিহারে অবস্থান কালে নিজের পাঠ্যসূচির বাইরে ধর্মীয় বিষয়ে বিশদ জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেন বলে জানা যায়। শ্রামণ্য জীবনের ৫ বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালে তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতায় তিনবছর অবস্থান করার পর ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষার জ্ঞান অর্জন করার আশায় মায়ানমার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান এবং ত্রিপিটকের অভিধর্ম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে অবস্থান কালে ১৯৫৪ সালে রেঙ্গুনে অনুষ্ঠেয় ষষ্ঠ সংগীতিতে কোন এক সংগীতিকারকের নিকট হতে উপাসম্পদা গ্রহণ করে ক্ষেমাংকর নামে পরিচিতি লাভ করেন। মহাস্থবির ক্ষেমাংকর পালি শাস্ত্রে পড়াশোনা পাশাপাশি ভেষজ শাস্ত্র নিয়েও পড়াশোনা করেন বলে তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়।

মায়ানমারে ১০ (দশ) বছর অবস্থান করার পর ১৯৬৩ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে মহাস্থবির প্রথমে রাঙামাটি চাকমা রাজবিহারে অবস্থান করেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে শিজক, গোলছড়ি, মারিশ্যা, জীবতলী বৌদ্ধ বিহারে বিহারধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে জীবতলী বৌদ্ধবিহার থেকে পুনরায় রাজবিহার ফেরত আসেন এবং পরে ১৯৬৫ সালে বারোঘোনিয়া জ্ঞানোদয় বৌদ্ধ বিহারের সাধারণ দায়ক দায়িকা ও মুরব্বিদের আহবানে সেখানে বিহারধ্যক্ষ হিসেবে চলে যান। তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতায় বারঘোনিয়া পালি টোল প্রতিষ্ঠা হয়।

৬ বছর সাত বর্ষাবাস অতিক্রান্ত করে ১৯৭১ সালে তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন এ মহাস্থবির। তীর্থ ভ্রমণ শেষে বারঘোনিয়া বিহারে না এসে তিনি সরাসরি চলে যান রাজানগর রাজবিহারে। ১৯৭৭ সালের ১০০ নং ওয়াগগা মৌজার হেডম্যান শ্রী পরিমল চন্দ্র তালুকদার ও এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় ওয়াগগা জনকল্যাণ বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। হেডম্যান পরিমল চন্দ্র তালুকদার, তাঁর সহধর্মিণী জানকী প্রভা তালুকদার ও সুরেন্দ্রলাল তালুকদার রাজানগর রাজবিহারে গিয়ে ক্ষেমাংকর ভান্তে ওয়াগগা বিহারে আসার অনুরোধ (ফাং) করলে তিনি এতে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন। দীর্ঘসময় ধরে উক্ত বিহারে অবস্থান করে তিনি কিছু বই লেখায় হাত দেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে একদিন তিনি ওয়াগগা বিহার ছেড়ে সোনাইছড়ি চলে যান। পরে আবার এলাকাবাসীর আহবানে পুনরায় ফেরত আসেন। এ ওয়াগগা জনকল্যাণ বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করে ৮৪ বছর বয়সে ৫০ বর্ষাবাস যাপন করে ২০০৪ সালে ১০ ফেব্রুয়ারিতে পরলোক গমন করেন এ জ্ঞানী পুরুষ। পাঠক তাঁর জীবনী আলোচনায় যেটা অনুমান করা যায় তিনি ভবঘুরে জীবন পছন্দ করতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু তাঁর বৌদ্ধধর্ম দর্শন ও গভীর তথ্য নিয়ে লেখা চারটি বই বা গ্রন্থই বৌদ্ধসমাজ তাঁকে মনে রাখবে। এ চারটা বই তিনি ওয়াগগা জনকল্যাণ বৌদ্ধবিহারে অবস্থান কালেই রচনা ও প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর রচিত চারটি গ্রন্থ হলো-

প্রকাশকালঃ-

১। ‘অভিধর্ম্মার্থ স্বরূপিনী’ প্রকাশকাল – ১৯৯৩ খ্রীঃ

২। ‘মাতিকা ধাতু কথা স্বরূপিনী’ প্রকাশকাল – ১৯৯৯ খ্রীঃ

৩। ‘বুদ্ধ প্রকাশনী’- প্রকাশকাল ২০০১ খ্রীঃ

৪। ‘অভিধর্ম্ম পিটকের বিভঙ্গঁ প্রকরণ’- প্রকাশকাল – ২০০৩খ্রীঃ

তথ্যসূত্র-

ক) আর্যানন্দ মহাথের স্মরণে প্রকাশিত ম্যাগাজিন- ২০০৬ খ্রীঃ

খ) ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির অন্তোষ্টিক্রিয়ায় তাঁর স্মরণে প্রকাশিত ছোট্ট কাগজ/২০০৪।

Rajguru Priyo Ratana Mahathera

Priyo Ratana Mahāthera was a Buddhist guru entitled the Rajguru in Chakma Raj Bihar and was the first known Tanchangya monk who went abroad for Buddhist studies in Sri Lanka in 19th century.

Early life

His named was Palak Dhan, born in 1879 to a poor family in Tanchangya tribe. Tanchangya tribes consist of many sects. Out of that  Mahāthera belongs to Karva Ghosa. During his childhood his mother died, and he was raised by a Chakma family. His name, eventually became Palak Dhan Tanchangya which implies a foster child in Tanchangya Language.

He became a novice at Chittagong Buddhist Temple. He was an intelligent and obedient student and continued both  his general and religious study. He traveled to Sri Lanka for his further Buddhist studies.

Royal Patriarch

In 1935 after the passing away of Chakma King Bhuvan Mohan Roy, prince Nalinakha Roy was appointed him to the throne of Rajguru. Thus, Piyaratana was received as a Chakma Royal Patriarch.[1]

Career

While he was a Royal Patriarch, Hindu practices proliferated in Chittagong Hill Tracts. The numbers of monks were fewer than Luri in the northern part of Chittagong Hill Tracts. The Luri were religious preachers who deviated from Buddhist monastic lives. Their lives were like  laymen, with wives and children. They become monks to avoid the torture experienced by non-Buddhist rulers, later adopting it as their spiritual practice. They followed a “debased” Buddhism, possibly Tantric Buddhism. Their texts deviated from the original Buddhist texts. At that time Chakma Queen Benita Roy was a Hindu and practiced Hindu religious ceremonies. The entire palace worshiped the Sanathan Dharma. Hence, due to the strong practise of Hinduism, Venerable Bhante could not propagate Buddhism in Chittagong Hill Tracts.2

Passing away

He died as a king preceptor in 1954.

References

  1. Tanchangya, Rati Kanta (2000). Tanchangya Jati (Bengali). Rati Kanta Tanchangya. p. 136.
  2. Ibid.

Collected and edited:  https://en.wikipedia.org/wiki/Rajguru_Priyo_Ratana_Mahathera