Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

Hoisting the national flag and releasing balloons before commencing the General Conference and Council of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization

Wagga, Rangamati, April 26, 2024 – The Bangladesh Tanchangya Welfare Organization (BTWO) hosted its pivotal General Conference and Council yesterday at the Wagga High School Compound, Kaptai Upazila, Rangamati, marking a significant step towards enhancing community welfare and cultural preservation of the Tanchangya people. The event was graced by the presence of notable figures, including Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs, who attended as the chief guest, and Dipankar Talukdar, MP of Rangamati District, who served as the inaugurator.

Special guests at the event included Jarati Tanchangya, Reserved MP for Women of Chittagong Hill Tracts, and Mr. Aungsuipru Chaudhuri, Chairman of Rangamati Zila Parishad, among other dignitaries who have been instrumental in Tanchangya community affairs.

Mr. Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs delivering the Chief Guest Speech

The conference commenced with the ceremonial hoisting of the Bangladesh national flag, followed by the enchanting rendition of a traditional Tanchangya song, setting a tone of unity and cultural reverence. The event was a gathering and vibrant celebration of Tanchangya heritage, with discussions centred around safeguarding their culture and consolidating efforts across various Tanchangya Kalyan Sangsta regional units.

Tanchangya singers singing song during the General Conference Council

The gathering was significant due to the elections to appoint new leadership within the BTWO. Mr. Diptimoy Talukdar was elected President, Mrinal Kanti Tanchangya was the General Secretary, and Najib Kumar Tanchangya was the Organizing Secretary. These leaders are poised to spearhead initiatives that will foster the development and growth of the Tanchangya community.

A section of the audience during the Conference and Council of BTWO

The Ad hoc Central Committee of BTWO appointed the Debtachhari Region of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization to host the General Conference and Council. However, all 12 regional committees contributed to executing the Conference and Council of BTWO. The 12 regional committees are spread across Rangamati, Bandarban, and Cox’s Bazar districts. They are: (1) Rangamati Sadar Region (2) Debtachhari-Raisyabili Region (3) Kaptai Region (4) Bilaichhari Region (5) Farua Region (6) Rajasthali Region (7) Rajbila Region (8) Bandarban Region (9) Roangchhari Region (10) Alikadam Region (11) Nakhyongchhari Region (12) Cox’s Bazar Region.

Group photo of Chief Guest and Special Guests during the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

The Ad hoc BTWO gave the responsibility to the Debtachhari-Raisyabili Regional Committee of the BTWO, which extended heartfelt thanks to all who supported the event physically, mentally, and financially. Special acknowledgement was given to the youth and students from local villages such as North Debatchari, Dakshin Debatchari, and others, whose tireless volunteer efforts were crucial in the smooth execution of the conference. As the event concluded, a vote of thanks was given, recognising the invaluable contributions of attendees from all 12 regions within the Rangamati and Bandarban districts. The BTWO expressed optimism that the solid foundation of cooperation during this conference will continue to strengthen in future endeavours, propelling the Tanchangya community towards greater heights of development and cultural preservation.

Note: Credit goes to the original owners of these photos, which the editors collected from Chandra Sen Tanchangya and Milinda Tanchangya.

তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি: পাহাড় কোলে নক্ষত্ররাজি

লিখেছেনঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাগুনিয়া উপজেলা, কক্সবাজার, টেকনাফ এবং উখিয়া অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি নাম দাইনাক, অনেকে দৈনাক নামেও ডেকে থাকেন। যার অর্থ যোদ্ধা। ইতিহাসের তথ্য মতে- তাঁরা শৌর্য, বীর্যে এবং বীরত্বে জগৎ খ্যাত ছিলেন। আরাকানে স্বাধীন দান্যাওয়াদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকাল ঐ অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন এবং বসবাস করে এসেছেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার তৈনছড়ি নদীর তীরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই তৈনছড়ি থেকে তাঁরা অন্য অঞ্চলে বা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তৈনছড়ি নদীটি তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এখনো ঐতিহাসিক এবং আবেদনের একটি জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে, সাথে ভালোবাসার একটি নামও। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান পঞ্চম এবং শিক্ষার হার দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তাদের আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১.০০ (এক) লাখের কাছাকাছি এবং শিক্ষার হার ৮০% এর উপরে। পরিসংখ্যান তথ্যমতে  ৪৭% তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরাম সিএডিসি ও এর বাইরে ৩.৩% শতাংশ লোক বসবাস করে, অবশিষ্ট ৫০% শতাংশ তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর- ২০১০ খ্রি)

গছা বা গোত্র

তঞ্চঙ্গ্যারা মোট ১২ টি গছা বা দলে বিভক্ত। গছাগুলো হলো- কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসা গছা, অঙ্যা গছা, মুলিমা গছা, রাঙী গছা, ওয়া গছা, তাশী গছা। কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা এই সাতটি গছা বাংলাদেশে বসবাস করে বর্তমানে। বাকিগুলো মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জানা যায়। আবার প্রতিটি গছায় রয়েছে উপগছা বা উপশাখা। যেমন: কারবআ গছার কয়েকটি উপগছা হলো- বউ গোত্তি, বলা গোত্তি, বাঅ-ল গোত্তি, আরয়া গোত্তি, ফারাঙচা গোত্তি ইত্যাদি। এভাবে অন্য গছায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে উপগছা রয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। তাদের মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তঞ্চঙ্গ্যাদের মাতৃভাষার নাম “তঞ্চঙ্গ্যা” ভাষা। জনগোষ্ঠীর নামের সাথে মিল রেখে ভাষার নামটি নির্ধারণ করা হয়।

জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন ১৯০৩ সনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে  তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারাবিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত দেন। তিনি আরো মত দেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক ভাষার (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) সাথে একই অন্তর্ভুক্ত হলেও তিবেতো-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করেছে। অনেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত বাংলা ভাষা বলে মত দেন। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে প্রচুর আরাকান বা মারমা শব্দের উপস্থিতি, প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ব্যবহ্ত বর্ণমালাগুলো বার্মিজ বর্ণমালার সাথে মিল রয়েছে এই মূল উৎপত্তি “মনখমের” দের থেকে। ব্রাহ্মী লিপি থেকে এই বর্ণমালার উৎপত্তি বলে অনেকে মত দেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার নাম দাইনাক বর্ণমালা এবং বর্তমানে ব্যবহ্ত বর্ণমালার নাম ছালাম্যা বর্ণ বা ছালামী পাঠ যার অর্থ গোলাকার। বর্ণমালার সংখ্যা সর্বমোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ ০৫ আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আরো আছে নিজস্ব সংখ্যা বা গননা পদ্ধতি।  

তাদের বর্ণমালার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কথ্য এবং লিখিত রূপ আ-কারান্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত হচ্ছে এর উচ্চারণ এবং কথ্যরীতি ¯স্বর কোমল, নরম এবং কর্কশ নয় শ্রবণে মধুর। শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রকৃতির একটা সরলতা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ গছা বা শাখাভেদে তাদের ভাষা অভিন্ন।

পোশাক ও অলংকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার রয়েছে। গছাভেদে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য রয়েছে। তবে কারবআ গছা রমণীদের রাজকীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় সবাইকে আকর্ষণ করে। রঙে, ঢঙে এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। এই পাঁচ কাপড়গুলো হলো- পিনৈন (নির্মাঙ্গ বস্ত্র), জুম্ময়া সালুম (লম্বা হাঁটা শার্ট), মাদা কাবঙ (পাগড়ি), পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) এবং জুম্ময়া খাদি (ওড়না বিশেষ)। প্রতিটি পোশাকে রয়েছে নিজস্ব এবং ¯স্বতন্ত্র নকশা, ফুল এবং ডিজাইন। এসকল নকশা এবং ফুলগুলো জুম এবং প্রকৃতি থেকে নেওয়া, পাওয়া। আর ছেলেদের পোশাক সাদা ধূতি এবং লম্বাহাটা সাদা শার্ট। অলংকার হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যারা প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব স্টাইল এবং ডিজাইনে অলংকার পড়ে থাকে। এক সময় রৌপ্য অলংকার ব্যবহারে প্রচলন ছিল বেশ। এখন রৌপ্য পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতুর অলংকার ব্যবহার করে তাঁরা। যেমন- কানে রাইজ্জু ও জংগা, কব্জিতে বাঘোর, কুসই খারু, কিয়াইংশিক, বাহুতে তাজ্জুর, গলায় চন্দ্রহার, আলচুরি, জামছড়া, পিসিছড়া ইত্যাদি। তবে আধুনিককালে গলায় স্বর্ণ, রুপোর চেইন, আংটি, নুপুর, নেকলেস পড়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা। পুরুষরাও চেইন, আংটি পড়ে থাকে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জুনু তঞ্চঙ্গ্যা (হিল এক্সপ্রেস)

ঘর-বাড়ি ধরণ এবং বসতঘর

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এই পাহাড় এক সময় প্রচুর বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। চারিদিকে গহীন বন। তখন এই বনে প্রচুর পরিমাণে হিংস্র বন্য পশু-পাখি বসবাস করতো। আদিবাসীরা যেহেতু পাহাড়ে এবং বনের মধ্যে বসবাস করে তাই বন্য হিংস্র পশু-পাখির সাথে এক প্রকার সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। মূলতঃ বন্য পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘরগুলো মাচাং আকারে মাটি থেকে একটু উচুতে তৈরি করতো। মূল ঘরের সাথে একটি ইচরও থাকতো। ইচর মূলতঃ খোলা হাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা। একটি মূলঘরের সাথে কয়েকটি অংশ থাকে। অংশগুলো হলো- সিঙকাবা, পিনা, গুদি, বারান্দা এবং রান্না ঘর। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঘর থাকে তঞ্চঙ্গ্যাদের। ঘরগুলো হলো-জুমঘর (জুম চাষের সময় তৈরি করা হয়। একে প্রভাস্যা ঘরও বলা হয়), ডেইরি ঘর (যেখানে ঘরের নানা জিনিসপত্র যেমনঃ চাষের নানা যন্ত্রপাতি, উপকরণ রাখা হয়), গোয়াল ঘর, ছাগল ঘর, হাসঁ-মুরগী ঘর, দারবআ ঘর (জ্বালানি কাঠ রাখার ঘর)। তবে বর্তমানে তাদের মূল ঘর তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা আর মাচাঙ ঘর তৈরি করে না। কারণ আগের মতো পাহাড়ে আর গভীর বন নেই, সাথে নেই হিংস্র পশুপাখিও। বাঁশ এবং শনের পরিবর্তে এখন ইট, কংক্রিট, টিন, রড, সিমেন্টের ঘর তৈরি করে তাঁরা। বর্তমান বসতগুলো মজবুত এবং দীর্ঘাস্থায়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরগুলো তার ঐতিহ্য এবং নিজস্বটা হারিয়ে  ফেলেছে।

ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান

তঞ্চঙ্গ্যারা মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাদের প্রতিটি পাড়া বা গ্রামে একটি করে  বৌদ্ধ বিহার আছে। ওখানে ভিক্ষু সংঘ আছে। তাদেরকে সকলে মিলে ভরণপোষণ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। এছাড়া আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা বা ফানুস উত্তোলন পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার পর একমাস ব্যাপি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম দান শ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িতেও তাঁরা সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করে।

রাজগুরু শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাথেরো (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা), ষষ্ঠ সংগীতিকারক রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা), ত্রিপিটক বিশারদ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, আর্যানন্দ মহাস্থবির, শ্রীমৎ অজিতা মহাথেরো (ধ্যান ভান্তে), ধর্মানন্দ মহাস্থবির, সুমেধানন্দ মহাস্থবির প্রমূখ বৌদ্ধ ধর্মের সাধক পুরুষ। তাঁরা হলেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সূর্য সন্তান এবং ধর্মীয় পন্ডিত। 

সামাজিক উৎসব

বিষু (বাংলা নববর্ষ) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান এবং অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব। বিষু উৎসবকে তাঁরা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে। ফুল বিষু, মূল বিষু এবং বিষু।

ফুল বিষু মূলত চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন। মূল বিষু হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আর বিষু হলো পহেলা বৈশাখ। ফুল বিষু দিনে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় এবং নদীতে ফুল পূজা দেওয়া হয় (অনেকে ফুল ভাসানোও বলে থাকেন) এই দিনে ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

মূল বিষুতে প্রায় শতপদের সবজি দিয়ে পাইচন রান্না করা হয়। এই পাইচন বিষু’র অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ। বহুপদের সবজি দিয়ে এই পাইচন রান্না হয় বলে এর ঔষধিগুনও বেড়ে যায় বহুগুণ। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মুল বিষু’র দিনে পাইচন খেলে শরীরে যত রোগব্যাধি আছে সব চলে যায়। মূল বিষুর দিনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়োবৃদ্ধদের গোসল করানো হয়।

বিষু দিন সকলে নতুন কাপড় -চোপড় পড়ে, বুদ্ধ এবং ভিক্ষুদের জন্য আহার্য নিয়ে বিহারে যায়। প্রার্থনা করে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সমাজ, জাতি, দেশ এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল এবং সুখ-শান্তির, সমৃদ্ধির জন্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুয়ে আর্শীবাদ নেয়। বিষু দিনে সকলে সকলের বাড়িতে বেড়াতে ঘুরতে যায়। সকলে যে যার সাধ্যমতো খাবার এবং নাস্তা-পানির আয়োজন করে থাকে। সে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা- সাইন্ন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, মালি পিঠা, আলসী পিঠা, তেলের পিঠা, কলা পিঠা, কাঁকন চালের পায়েস  আয়োজন করে থাকে। সাথে মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকে। বিষু’র মূল আনুষ্ঠানিকতা তিন দিন হলেও পুরো সপ্তাহ দশদিন এর আমেজ থাকে গ্রামে এবং পাড়ায়।

এই অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ভাত খাওয়া, আর্শীবাদ অনুষ্ঠান, আহলপালানী উৎসবও হয়ে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য চর্চা

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। সাধক, ব্যাধি এবং আদি কবি শিবচরণ তাদের অনুপ্রেরণা। শিবচরণের রচিত “গোসাইন লামা” তাদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম ভিত্তি। পরবর্তীতে রাজকবি শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা যিনি তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যকে নতুন একটি মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর রচিত “ধর্ম্মধ্বজ জাতক” (১৯৩১) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গ্রন্থ। এছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার দিক থেকেও প্রথম।  ‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’ (১৯৩৩) তাঁর অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ। তিনি “চান্দোবী বারমাস, রুত্তি বারমাস,আলস্যা মেলার কবিতা এবং বিয়াল্লিশর ভাতরাদ” বারমাস রচনা করেন। তিনিই প্রথম হস্তচালিত প্রেস স্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা রাজ সভার সভাকবি বা রাজকবি ছিলেন তিনি।

লোকসাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোকসাহিত্যর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব রূপকথার গল্প আছে, আছে প্রবাদ-প্রবচন। ঘুমপাড়ানি ছড়াও আছে। সাথে আছে কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক অনেক পালাও। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, জুমকাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা ইত্যাদি।

পূজা-অর্চনা

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তাঁরা প্রকৃতিকে সেবা-যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা সরূপ নানা পূজা অর্চনা করে থাকে। তাঁরা মনে করে প্রকৃতির ভালোবাসা, আর্শীবাদ এবং আনুগত্য ছাড়া কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাস এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি করলে প্রকৃতি মাথা খুশি, সন্তুষ্ট হয় এবং আর্শীবাদ করে। এজন্য গাঙ পূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, মিত্তিনি পূজা,লক্ষ্মী পূজা, কে- পূজা এবং বুল পারা পূজাসহ বেশ কিছু পূজা-অর্চনা তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকে।

জুমচাষ, জীবন এবং জীবিকা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে জুমচাষ। জুমচাষ মূলতঃ মাল্টি এগ্রিকালচার। একই জায়গায় বহু ফসলের চাষ করা হয় এবং একটির পর একটি ফসল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই চাষের একটি বছরের সমাপ্তি হয়। জুমচাষ মূলতঃ বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত সময়। তবে এর দুই তিন মাস আগে থেকে জুম প্রস্তুতি অংশ হিসেবে জুমের জায়গা নির্বাচন, জুম কাটা, কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়া এবং পরিস্কার করতে হয়। এই জুম চাষে পুরুষ মহিলা সকলে একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।

এক সময় এই জুমচাষই তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র উপার্জন এবং জীবন- জীবিকার অবলম্বন ছিল। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের সাথে এই জুম প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা লেখাপড়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যও করছে অনেকে। আবার অনেকে ফলজ বাগান করে আয়-রোজগার করছে। আধুনিক কৃষির সাথেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া অনেকে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শুকর পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

জুমচাষ করতে হলে জুম কাটার স্থানে একটি জুমঘর তৈরি করতে হয়। জুমঘর মূলতঃ বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা আর কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে রাতে থাকা, জুমের নতুন ফসল মজুদ করণের উদ্দেশ্য এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। আর একজন জুম চাষীর তাঁর গ্রামের ঘর থেকে জুমের দুরত্ব যদি বেশি হয় সময় কমিয়ে আনা, কাজের সুবিধার্থেও এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। এই জুমঘর শুধু শস্য উঠা পর্যন্ত— মানে একবছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা জুমঘরকে ‘প্রবাস্যা ঘর’ও বলে থাকে।

বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা উচ্চ শিক্ষিত

কৃষকের পাশাপাশি, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, এমবিবিএস ডাক্তার, ডেন্টাল, হোমিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী জজ, সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন এবং নন-কমিশন অফিসার, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি সদস্য, যুগ্ম সচিব (অবঃ), ইউএনও, উপ-সচিব, দূতাবাসের ১ম কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (অবঃ), সাংবাদিকতাসহ নানা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে থেকে এযাবত মহান জাতীয় সংসদে দুজন প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমজন ছিলেন মালতি প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা (এরশাদ সময়কার), আর অন্যজন হলেন জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা ৩৪৮ আসনের সংসদ হিসেবে শপথ নেন। উভয়ের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়েরা দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে স্কলারশিপ নিয়েও বাইরে লেখাপড়া করছে। দেশের বাইরেও অনেকে চাকরি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

সম্পত্তি উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেরা পেয়ে থাকে। তবে ছেলে সন্তান না থাকলে মেয়েরা এর অধিকার পায়। স্বামী মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী যদি পূনরায় বিয়ে না করে তাহলে স্বামী সকল সম্পত্তি সে পাবে।

সামাজিক প্রথা

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধভাবে এবং গ্রামে বসবাস করে। তাদের গ্রামের প্রধান হলেন কার্বারী। তিনি গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচার এবং যেকোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তিনি মৌজা প্রধান হেডম্যান এর অধীন এবং হেডম্যান সার্কেল চীপ বা রাজার অধিনে কাজ করেন। গ্রামে বা সমাজে যেকোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা

ঘিলা খেলা, নাদেঙ খেলা, ধুধু খেলা, কুমির কুমির খেলা, গোল মরিচ খেলা, গাত্তয়া খেলা, গাইত খেলা, তেদোই বিচি খেলা, গোয়াং খেলা, পুত্তি খেলা, আংগী খেলা, তিং খেলা,লুআলুই খেলা, গুদু খেলা,বুলি খেলা,কক্কেমা বা খাবামা খেলা, শামুক খেলা এবং তুম্বুর খেলা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসকল খেলা বিশেষ করে ঘিলা এবং নাদেঙ খেলা অন্য সময় খেলা হলেও বিষু দিনে এর আকর্ষণ এবং আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন যুবক-যুবতীরা এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের এই খেলায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁরা অনেক আনন্দ মজা করে। বিবাহিত  পুরুষ এবং মহিলারাও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে।

সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, নাট্য সাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে সংগীত প্রিয়। এই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেক ঐতিহাসিক পালা পর্ব রয়েছে। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসকল পালাগুলো যারা সুর, তাল এবং সুকণ্ঠ দিয়ে পরিবেশন করতেন তারা হলেন চারণ কবি গিঙ্গিলি।

জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন গিঙ্গিলি আছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। তাঁর সময়কাল এবং আজ পর্যন্ত তাঁর সমমান কোন গিঙ্গিলি কোন আদিবাসী সমাজে বা জাতিতে জন্ম হয়নি। তিনি অন্ধ ছিলেন, এজন্য তিনি কানা গিঙ্গিলি নামেও সবার কাছে পরিচিত। তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল তিনি রাজগিঙ্গিলি ছিলেন। পরবর্তীতে ভাগ্যধন গিঙ্গিলি, দুলামন গিঙ্গিলি অনেক সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, আদি চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে নামডাক পরিচিতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা এবং আদিবাসী সমাজে। তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে দেশাত্মবোধক, রোমান্টিকসহ নানা ধাঁচের গান উপহার দিয়েছেন। তঞ্চঙ্গ্যা সংগীত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের ছোঁয়ায়।

গুনী শিল্পী হিসেবে দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনীলা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সুচন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যানি তঞ্চঙ্গ্যা, রিনি তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। পরবর্তীতে চম্পা তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যাকলিন তঞ্চঙ্গ্যা, সূর্যসেন তঞ্চঙ্গ্যা, অমিত তঞ্চঙ্গ্যা, সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রক শিল্পী হিসেবে বুলু তঞ্চঙ্গ্যা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে অনেক নৃত্য শিল্পী রয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। বাঁশি,ধুরূক, খিংকরং, শিঙা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নাট্য সাহিত্যে তঞ্চঙ্গ্যারা বহুদূর এগিয়েছে। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা নাটকের পুরোধা। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার হাত ধরে আধুনিক তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাঁর হাত ধরেই- “বর পরঙ, মন উকুলে, রত্নমালা” নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। “চানপুদি” নামে তাঁর একটি শিশু চলচ্চিত্রও ঢাকা শিশু চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করে দর্শক এবং সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বিবাহ পদ্ধতি

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিয়ে সাধারণত দুইভাবে হয়। অনুষ্ঠান করে বিয়ে এবং পলায়ন করে বিয়ে। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাকে ‘সাঙা’ বিয়ে বলে আর পালিয়ে করাকে ‘ধাবারা’ বিয়ে বলে।

সাঙা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবশীকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। আর ধাবারা বিয়েটে এসব কোন কিছুই হয় না। এই ধাবারা বিয়েটে অনেক সময় ঘরের সকল সদস্যদের (মা, বোন জানলেও) জানার সুযোগ থাকে না। তবে কনে এবং বর বিষয়টি অবগত থাকে, সাথে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।

ধাবারা বিয়ের জরিমানা হিসেবে বর পক্ষ কনে পক্ষকে শুকর বা সামান্য কিছু টাকা দিতে হয় যুব সমাজ এবং সামাজিক দাবী হিসেবে। বিয়ে নিয়ে কিছু ধরাবাঁধা এবং সামাজিক নিয়ম রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে। যেমন: নিজের আপন ভাই-বোনের মধ্যে, মাসি-পিসি, চাচা-চাচিকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অবৈধ একটি কাজ। আপন চাচাত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে অবৈধ। মামা, পিসি, মাসিত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ করা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি আছে।

এই একই সম্পর্কে বিধবা মেয়ে বা বিপত্নীকেও বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে বর কনে উভয়ে উভয়কে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী কিছু অলংকার দিতে হয়। তবে কি পরিমাণ দিতে হবে তার কোন নিয়ম নেই, দাবীও নেই। আর এর বাইরে বর কনে উভয়ে উভয় পক্ষ থেকে কোন কিছু দাবী করার পারিবারিক, সামাজিকভাবে দাবি করার কোন সুযোগ এবং নিয়ম নেই। দাবি করা ন্যায় এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিষয় যা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ এবং জাতিতে ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করে এতে জাতি, সমাজ এবং পরিবারের শৃক্সখলা নষ্ট হয়। জাতির অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়ার একটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তৈরি হয়।

অবস্থান ও বসতি

তঞ্চঙ্গ্যারা রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, জুরাছড়ি, কাউখালী উপজেলায় বসবাস করে। বান্দরবান জেলার মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, নাক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে রাঙ্গুনিয়া আর কক্সবাজার জেলার মধ্যে টেকনাফ, উকিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা, আগরতলা আর মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বসবাস রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তঞ্চঙ্গ্যারা স্থায়ী বা চাকরিসূত্রে বসবাস করছে।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি

এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র বা পদ্ধতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। বৈদ্য, কবিরাজ এবং কালেভদ্রে ভান্তেরা একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। বনজ গাছ-গাছড়া, বাকল, শেকড়, লতাপাতা, ফলমূল দিয়ে বানানো বনৌষধি নানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। বৈদ্য, কবিরাজগণ ঔষধের সমস্ত তালিক বা তালিকা নিজস্ব খাতায় বা নোটে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বৈদ্যরা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বান-টনা, আঙ ডালি, পূজা কর্ম দিয়েও নানা রকম চিকিৎসা করতো। তাছাড়া তখনকার সময়ে চিকিৎসায় একমাত্র সম্বল ছিল এই বৈদ্য এবং কবিরাজরা। বর্তমান সময়ে এসেও আদিবাসী সমাজে বৈদ্য, কবিরাজের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।

নারীর অবস্থান

আদিবাসী জনগোষ্ঠী মতো তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও অনেকটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে থাকেন।

তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে মিলেমিশে জুম, ক্ষেতে খামারে কাজ করে থাকেন। তবে গৃহস্থালি কাজগুলো মেয়েরা বেশির ভাগ সময় করে থাকে, পুরুষরাও সহযোগিতা করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমমর্যাদা ভোগ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পরেই তাদের অবস্থান।

নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর সকল প্রকার ভরণপোষণ স্বামীর নিকট থেকে সে পেয়ে থাকে। যদি স্বামী দিতে অপারগ করে বা অস্বীকৃতি জানাই তাহলে সে চাইলে গ্রাম প্রধান বা কার্বারী নিকট আইনগত আশ্রয় চাইতে পারে। স্ত্রীর অমতে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করলে প্রথম স্ত্রী সতীনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মতি জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী ভিটায় বা বাবার বাড়িতে অবস্থান কালীন সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব সে স্বামী থেকে পাবে। যদি সেও দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করে সেটি আর পাবে না।

বর্তমানে এসে সময় এবং যুগ পাল্টে গেছে অনেক। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে এবং তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তাঁরাও এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতায়। তাঁরা নিজের পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাঁরাও পরিবারকে সুন্দরভাবে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে এবং রাখছে। এটি সৃষ্টি মানবজাতির জন্য সুন্দর একটি দিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি এবং সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে তঞ্চঙ্গ্যারাও অংশগ্রহণ করে। দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাঁরা। সমতল থেকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নির্যাতনে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে আসা শত শত বাঙালি পরিবারকে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অসুস্থ রোগীকে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। নাম না জানা অনেক তঞ্চঙ্গ্যা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন সরকারি গেজেটেড এবং ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি কাপ্তাই কাপ্তাইয়ের উপজেলার ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার আগুনিয়াছড়া গ্রামে। তিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য  যুদ্ধ করেছেন।

শ্রীমতি গনমালা তঞ্চঙ্গ্যা, স্বামী- ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা, বাড়ি রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ইউনিয়নের তাইতং পাড়া যৌথ খামার গ্রামে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

স্বভাব এবং সামাজিক মূল্যবোধ

তঞ্চঙ্গ্যারা স্বভাবে শান্ত, নম্র এবং ভদ্র। তাঁরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ, পালন ও আচরণ করে। অপরের সাথে রাগ, বদমেজাজ স্বরে কথা বলে না। কথা বলার মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে চলে। স্বভাবে একঘেয়েমিতা নেই। কথায় কথায় মুখে অসুন্দর শব্দ, বাক্য প্রয়োগ করে না এবং করা থেকে বিরত থাকে। চেহেরার মধ্যেও একটা প্রকৃতিকতার আবেদন আছে।

সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে অন্যান্য চিকিৎসার মতো নবজাতক জন্মদান এখন নিরাপদ এবং সহজ হয়ে উঠেছে।

একসময় তঞ্চঙ্গ্যা তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সন্তান জন্মদান ভগবানের কৃপা এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল সকলে। তখন গ্রামে “অসা বুড়ি”(ধাত্রী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়ার সাথে থাকতেন। তখন সাবান, ব্লেড বা ছুরি কাঁচি পরিবর্তে বাঁশের ধারালো কঞ্চি দিয়ে কাটাছেঁড়া কাজটি সম্পূর্ণ করা হতো এবং ভুত্তোয়া লতা নামক একধরনের লতার কান্ড দিয়ে সাবান বা পরিস্কারের কাজটি ছাড়তে হতো। নিমপাতা সিদ্ধ করে সন্তান প্রস্রবের স্থানটি পরিস্কার করা হতো।

সন্তান জন্মদানের সাত দিনের মাথায় একটি অনুষ্ঠান করা হয়, যা ‘কসুই পানি লনা’ নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠান না হওয়া আগ পর্যন্ত নতুন মাকে ঘরের সকল কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়। মূলতঃ এসময় নতুন মা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘরের কাজ পুনরায় করার অনুমতি পান। এই সময় অসাবুড়িকে  কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ স্বরূপ কিছু নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়া হয়। তাঁকে যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। গ্রাম প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করা হয় এসময়। তাঁরাও নতুন অতিথি এবং মায়ের জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেন। পরবর্তী ঘরের সদস্য সকলে মিলে জন্মবার এবং পঞ্জিকা দেখে সন্তানের জন্য সুন্দর একটি নাম রাখেন।

ছয় মাস পর বিহারের বড় ভান্তের হাত দিয়ে এবং আর্শীবাদ নিয়ে বা ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তাঁকে মুখে প্রথম ভাত খাওয়ানো হয়।

মৃত্যু, সৎকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা

মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। দাহ করার আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো হয়। এরপর “বিয়াঘর” তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে ঐ ঘরে রাখা হয় (বিয়াঘর মূলতঃ শ্মশান যাত্রার আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে রাখার অস্থায়ী ঘর)

পরবর্তীতে বাঁশ, তার, দড়ি বা রশি এবং নানা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা মন্দির সাদৃশ্য ‘প্যারাসাইট’ নামক একটি প্যাটিকায় আবদ্ধ করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকে অশ্রুজলে বিদায় নিয়ে জগত সংসারের সকল আনুষ্ঠানিকতা মেনে এবং ছেড়ে কাঁধে বহন করে চিদাকলায় (শ্মশান) নিয়ে যাওয়া হয়।

ছেলেদের শ্মশান সাজানো হয় পাঁচ ধাপ/টাক দিয়ে আর মেয়েদের সাত ধাপ বা টাক গাছ দিয়ে। নদীর গতিপথ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির মাথা এবং পা কোন দিকে হবে সেটি নির্ণয় করা হয়। নদী বা ছড়া যদি উত্তর থেকে দ¶িণ দিকে নেমে যায় তাহলে মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে শুয়ানো হবে মাথা উত্তর দিকে করে আর পা দক্ষিণ দিক করে। দাহ করার পরদিন পরিবারের এবং আত্মীয় -স্বজন গিয়ে মৃত ব্যক্তির ধাতুগুলো(হাড়) খুঁজে নিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নদীতে বিসর্জন বা ভাসিয়ে  দেওয়া হয়। নদীতে গিয়ে ঘাটের উভয় পারের টাকা-পয়সাও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তি যেন বিনা বাঁধায় তাঁর সুপথে গমন করতে পারে।

দাহ করার সাত দিনের মধ্যে ভালো একটি দিন দেখে সাপ্তাহিক সংঘদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ শান্তি এবং সদ্গতি কামনা করে। সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানকে তঞ্চঙ্গ্যারা ‘সাতদিন্যা’ বলে। এই দিনে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য “চেরাগঘর” নামে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের পরম আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্য গৃহহীন যেন না থাকে এই উদ্দেশ্য ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাথে মৃত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার জন্য তৈরি করে দওয়া হয় “তামাঙ-ত ঘর”।

সংঘদানে ভিক্ষু সংঘকে ফাঙ বা দাওয়াত করা হয় সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া- প্রতিবেশীকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য আয়জন করা সকল খাবার রাত বারোটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয়। যদি থেকে থাকে এগুলো নদীতে পেলে দিতে হয়। কাউকে দেওয়া যায় না। ছোট বাচ্চাদের উক্ত সংঘদানে অংশগ্রহনে নিরুৎসাহিত করা হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের ছোট সদস্য ছাড়া।

সংঘদান অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তোলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক এবং বস্তুগত উপাদান দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে। এই সহযোগিতা তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সামাজিক এবং নৈতিক একটি দায়িত্ব বলে মনে করে। মৃত দুধের শিশুকে দাহ করা হয় না, তাঁকে কবর বা দাফন করা হয়। এই কবরকে ‘পআকাবা’ বলে।

উপসংহার

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নিজেদের সংস্কৃতিকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা আরো বিশ্বাস করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষায় নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

জুম, পাহাড়, ছড়া, ঝিরি -ঝর্ণার মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃপ্রেমে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির উপাদানসূহ সকলের সাথে বিনিময়ের পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিনগুলো। দেশ, জাতির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে এবং সংকট প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে চাই সকলের সাথে মিলেমিশে হাতে হাত রেখে।

লেখকঃ “পহর জাঙাল” প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা, সম্পাদক, প্রকাশক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, নাট্যকার ও ভাষা গবেষক”

“তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস প্রসঙ্গে”

লেখকঃ সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা

স্বজাতির অতীত সম্পর্কে জানার সাধারণ ও স্বাভাবিক আগ্রহের কারণে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি সম্পর্কে কিছু লেখা পড়েছি। এ থেকে আমার মনে হয়েছে আমাদের অতীত ইতিহাসের উপর ধারণা অপেক্ষাকৃত বেশী যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । একই সাথে বর্তমানে আর্থ – সামাজিক অবস্থান ও সংস্কৃতির ধরণ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ গতিমুখ সম্পর্কে একটা আভাস / সম্ভাবনা অনুমান করাও আবশ্যক ।

“বার্মা ও ভারতে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান এবং তাদের অন্যান্য বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান শিরোনামে একটি প্রবন্ধে (ন – আ শমন , ৩য় সংখ্যা , ৩য় বর্ষ , ২০০৬ ইং ) এ সি তঞ্চঙ্গ্যা পরিসংখ্যান সহ উল্লেখ করেছিলেন যে , “তঞ্চঙ্গ্যাদের ৭ টি গছার লোকজন দাইনাক নামে বার্মায় বসবাস করছে । “তঞ্চঙ্গ্যাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্বনামধন্য লেখক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( ১৯৩৪-২০১৪ খ্রীঃ ) একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন- “ আরাকানের দানাওয়াদি তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য ” (পহর জাঙাল , ৫ম সংখ্যা, ২০০৯ ইং )। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন- “ তঞ্চঙ্গ্যাগণ দাইনাক পরিচয়ে দানাওয়াদি’র (আরাকান) মূল অধিবাসী ছিল ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমা ভাষা, অঞ্জলী ১ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ১১৫ পৃ: (তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল সমূহের প্রবীণ ডেপুটি ইস্পেক্টর শ্রীযুক্ত গগন চন্দ্র বড়ুয়া কর্তৃক লিখিত বলে অনুমিত) থেকে উদ্ধৃত করে ‘ চাকমা জাতি ‘ গ্রন্থে (১৯০৯ ইং সনে । প্রকাশিত) সতীশ চন্দ্র ঘোষ লিখেছেন- আরাকানের পাহাড়ী জাতির অপর এক সম্প্রদায়  তাহাদের সহিত মিশ্রিত হইয়া চাকমার অনুকরনে কথাবার্তা বলিতে শিখিলেও চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে । “(অনলাইন সংস্করন, পৃ : ৫৩-৫৪ ) । এর পর সতীশ ঘােষের মন্তব্য- “ এংখ্যং ও ইয়ংখ্যংবাসী দৈনাকেরাই আরাকানের পাহাড়ী তঞ্চঙ্গীয়া হইবে । অতএব এখানে আমরা আরও দৃঢ়তার সহিত দৈংনাক ও তঞ্চঙ্গ্যাদিগকে এ অভিন্ন জাতি বলিয়া স্বীকার করিতে পারি । ” একই গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ” দৈনাকেরা যে চাকমাগণেরই অন্যতম শাখা তাহা সর্বদিসম্মত । ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে । বিবাহ সম্বন্ধীয় গোলযোগই ইহার কারণ । ” অথচ ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “ অনেক প্রাচীন চাকমাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছি দৈনাক ‘ টিও তাহাদের অত । পরন্তু মঘেরা টংচঙ্গ্যাদিগকেই দৈনাক নামে অভিহিত করিয়াকে । ”

‘চাকমা দুই রাজবংশ ‘ (২০১৪ ইং সনে প্রকাশিত) পুস্তকের পৃঃ – ১০ এ লাইন ১৩- ২০ তে লেখক কুমুদ বিকাশ চাকমা তার আরাকান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন “যাদুঘর ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমন এক জায়গা ও কক্ষে স্বামী – স্ত্রী বা পুরুষ – মহিলার মডেল হিসাবে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পোষাকে দেয়ালে রাখা হয়েছে ।

১ নং মডেল খুমী জাতি ।

২ নং মডেল ম্রো জাতি ।

৩ নং মডেল রাখাইন জাতি ।

৪ নং মডেল দৈনাক ‘ জাতি । (যেটা আমাদের বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি)

৫ নং মডেল থেক বা সেক জাতি ।

Tanchangya Community, Bangladesh.

এই থেক বা সেক ‘ জাতির পোশাক অবিকল আমাদের চাকমা মহিলাদের পিনন খাদি । পিননের উপরে চাবুগীটা রয়েছে। ”উপরোক্ত বিভিন্ন সূত্রের আলােকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা হচ্ছে- দাইনকি ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষ একই গোত্রজাত তথা এক জাতি । তাদের উত্তরসূরী বর্তমান মায়ানমার এর আরাকানে দাইনাক এবং বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা । তাহলে একই ধারার জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় দুই নামে হলো  কিভাবে ? এবং কোনটি আগে, কোনটি’র নামকরণ বা পরে! এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সতীশ ঘোষের ‘ চাকমা জাতি ’ বই এর ৫৩ পৃষ্ঠা এবং সাংবাদিক জামালউদ্দিন এর লেখা “ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ‘ ( প্রকাশকাল- ২০১১ ইং ) বই এ ( পৃ: – ১১৩ ) উল্লিখিত লাইনগুলাে পড়তে হয় । Captain T H Lewin ( D C of Chittagong Hill tracts in 1866- 69 & 1871- 74 ) লিখিত Hill Tracts of Chittagong and dwellers there in ( 1869 তে প্রকাশিত ) গ্রন্থের বরাত দিয়ে লেখকগণ উল্লেখ করেছেন যে , “ ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান থেকে ফা’র নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার টুংটইংগা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে এসেছিল । এই টুইংগারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অনুমতি লাভে নিজেদের শ্রম ও অর্থকড়িতে চট্টগ্রাম নগরীতে জব্বার খা প্রতিষ্ঠিত রাজাপুর নামক স্থানে একটি মনােরম বাড়ী নির্মাণ করে দেয় । ধরম বক্স খা ঐ সময় ফাপ্র , কে টুংটইংগাদের প্রধান হিসাবে স্বীকার না করায় তাদের অনেকে তার সাথে অন্যত্র চলে যায় । বর্তমানে ( ১৮৬৯ খ্রীঃ অব্দে এখানে ) ইহাদিগের সংখ্যা ২৫০০। প্রাচীনেরা আরাকানী ভাষায় আলাপাদি করে ; পরবর্তী পুরুষ অন্যদের ( অর্থাৎ চাকমাদিগের ) অনুকরনে বিকৃত বাঙ্গালা ব্যবহার করিয়া থাকে । ” এই টুংটইংগা ‘ নামটির বানান ইংরেজীতে লুইন সাহেব লিখেছিলেন Taungjyny । তার উল্লিখিত টুংটইংগাদের চট্টগ্রাম আগমনের সময় থেকে ৫০ বছর পর জনগোষ্ঠীটার নাম তিনি নিশ্চয়ই সরকারী নথি থেকেই পেয়েছেন অথবা শুনেছেন । আরাকান থেকে আগত উক্ত জনগোষ্ঠী যদি দৈনাক বা দাইনাকদের একটা অংশ হয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের নাম কেন ‘ Taungjyny ‘ হল , ‘ চাকমা ‘ হলো না কেন ? ফাপ্রু যদি দলপ্রধান হিসেবে ধরম বক্স খা কর্তৃক স্বীকৃত হতেন তাহলে হয়তো আগত লোকেদের জাতিগত / সম্প্রদায়গত অথবা গছার পরিচিতি ফাপ্রুর নামে হত । তা হয়নি ।  

শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- পৃ : – ৪ ) , শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয় পৃ: – ৫ ) এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- পৃ : – ১২ ) প্রমূখ লেখকগণের মতানুসারে- “তৈনছড়ি থেকে আগত বলে তারা তৈ – তং – য়্যা / তৈনতংগ্যা / তংচয়্যা নামে অভিহিত হয়েছেন ।” উল্লেখ্য যে , বর্তমানে বান্দরবান জেলার অন্তর্গত আলীকদম উপজেলায় মাতামুহুরীর একটি উপনদী হচ্ছে তৈনছড়ী। মারমারা নদী বা খালকে দুং বলেন । তৈনছড়ী উপনদীকে মারমারা বলেন তৈনছং । “দৈনাকদের একটা অংশ দীর্ঘদিন ধরে তৈনছড়ি এলাকায় বসবাস করে ছিল ” (Tanchangya- by Rupak Devnath , page- 89 ) । তাই তৈনছড়ী বা তৈনচং থেকে আগত রাজানগরে ধরম বক্স খার নিকট আশ্রয়প্রার্থী জনগোষ্ঠীকে যদি রাজ – কর্মচারী বা কর্মকর্তাগণ Taungjyny বলে রেকর্ডভূক্ত করেন তবে সেটাই স্বাভাবিক । Taungjyny থেকে টংতংয়া ( চাকমারা যে নামে বলেন ) , টংতংয়া থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে আগত দাইনাক জনগোষ্ঠীর একটা অংশের বর্তমান জাতিগত পরিচয় বাংলা বানানে ‘ তঞ্চঙ্গ্যা ’ ( Tanchangya ) নামে অভিহিত হচ্ছে।

দাইনাকদের সম্পর্কে এ.সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন । এ কথা বলা আবশ্যক যে , দাইনাকদের জাতিগত নামকরণের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় তিনি সতীশ চন্দ্র ঘােষের বর্ণিত দেঙ্গাওয়াদি আরেদফুং ( দান্যাওয়াদি আরে তবুং ) এবং আরাকান নিবাসী বােলয়্যা দাইনাকের মত অনুসরণ করেছেন । মনিজগিরি ( মইচাগিরি ) ‘ র কথিত যে রাজা ইয়ংজ আরাকান রাজা মেঙ্গাদি কর্তৃক পরাজিত ও বন্দী হবার ফলে ধৃত তার দশ হাজার প্রজাদেরকে দাইনাক আখ্যা দেয়া হয়েছিল বলে উল্লিখিত হয়েছে- সেটি ইতিহাসের বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ । Hisyory of Burma ( 1883 ) গ্রন্থের লেখক Sir Arthur Phayre এর বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অশোক কুমার দেওয়ান তার চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ‘ বই ( প্রকাশকাল -১৯৯১ ইং ) এর ৬১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , “ ফেইরীর ব্রহ্মইতিহাসে আরাকান রাজ মেংদি কর্তৃক সাক রাজ্য জয়ের কোন বিবরণ নেই বরং Myinsaing এর শান জাতি কর্তৃক উল্টো আক্রমনেরই উল্লেখ আছে । “দেঙ্গ্যাওয়াদিতে যে সময়ে রাজা মেংদি কর্তৃক শাক রাজ্য জয়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ঠিক সে সময়ে Myinsaing এর সান রাজাগণের বংশতালিকায় রাজা U – Za – Na বা Usana- র নাম পাওয়া যায় , যিনি ৬৮৪ মঘাব্দে বা ১৩২২ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৪২ খৃষ্টাব্দ অবধি বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত তারিখ যদি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তবে উপরোক্ত ঘটনা তারই সময়ের ।”

উপরে উদ্ধৃত বক্তব্য সঠিক গণ্য করলে যুদ্ধবন্দী দশহাজার চাকমা থেকে দৈনাক জাতির উৎপত্তি’র যে কাহিনী প্রচলিত তা ‘ বানোয়াট ও মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় ।

এ সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে যুক্তি দিয়ে অনুমিত সিদ্ধান্ত টেনেছেন আরাকানের প্রাচীন নগরী ‘দান্যাওয়ার্দীতে যাদের উৎপত্তি বা বিকাশ ঘটেছে তারা দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছেন অথবা বলা যেতে পারে দাইনাকদের আবাস অঞ্চল কিংবা তাদের শাসিত অঞ্চলকে দানাওয়াদি নামে অভিহিত করা হয়েছে ‘।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অতীত ইতিহাস দাইনাক নামের সাথে সম্পর্কিত । একারণে দাইনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথাযথ যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । তেমনি দেশান্তরিত হয়ে দাইনাকদের একটা অংশের চট্টগ্রাম আগমন ও জমিদার ধরমবক্স খাঁ’র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণও স্পষ্ট হওয়া দরকার । এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আরাকানের ইতিহাস থেকে এ সম্পর্কে হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে ।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়- খ্রীষ্টপূর্ব হাজার বছর আগে থেকে আরাকানের রাধানী হিসেবে ধান্যাওয়াদি ( Dhanyavadi ) নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । শেষ পর্যায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইন্দো – আর্য ভাষা ভাষী দ্বন চন্দ্র ( Dvan candra ) নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ১০১ জন রাজাকে পরাভূত করে আরাকানে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাপূর্বক তৃতীয় ধান্যাওয়াদি নগর নির্মাণ করান । উক্ত ধান্যাওয়াদি নগর থেকে তিনি ৩৭০- ৪২৫ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানে অধিকৃত অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন। ( মায়ানমার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আবিষ্কৃত একটি ধান্যাওয়াদি নগর সিত্তোয়ে শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটার উত্তরে কলাদান ও লেমরু নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত )। উক্ত রাজার উত্তরসূরীগণ ধান্যাওয়াদি নগরের ৯ কিলোমিটার দক্ষিনে ভেসালি (Vesali / VVetheli) নামে একটি নগর স্থাপন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে এর পূর্ব থেকে তিব্বেতো – বার্মান ভাষা ভাষী বৈদেশিক শক্তির আক্রমনে চন্দ্রবংশের রাজ – শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে । ৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে আরাকান পাগানের করদ রাজ্যে পরিণত হয় । ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে এ্যা- মিঙ – ঞা তুন ( Nga – Meng nga tun) নামে সাঃ (Sak বা Thek) বংশীয় ( Harvey এর অনুমান) একজন রাজপুত্র ভেসালি ( Vesali / Wetheli ) অধিকার করে ইহার নাম দেন সম্বক ( Sambawak )। পাগানরাজের স্লাইনমা ( বমী ) বাহিনীর সহায়তায় লোমিন – নান (Letyamin – nan) নামে একজন রাজা ১১১৮ খ্রীষ্টাব্দে তার পূর্বসূরীদের সিংহাসনে বসেন এবং আরাকানের রাজধানী পারেইন (Parein) এ সরিয়ে নেন। পরবর্তী সময় পাগানের শক্তি দূর্বল হয়ে পড়লে ১২৩৭ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) এ রাজধানী স্থাপিত হয় । এর কয়েক বছর পর থেকে ১৩৭৪ পর্যন্ত আরাকান রাজারা অনেকটা স্বাধীন থাকে। এ সময়ে আরাকান রাজ্য পশ্চিমে বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । চতুর্দশ শতাব্দির প্রথম দিকে Myinsaing ও Panya থেকে সান রাজা আরাকান আক্রমন করেছিল বলে Phayre উল্লেখ করেছেন । চতুর্দশ শতাব্দির শেষ দিকে রাজ্যে বেশ কিছু অভ্যুত্থান ঘটে । একের পর এক ক্ষমতার হাত – বদল হয় । অবশেষে ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) বার্মারাজ মেঙখামং এর দখলে চলে যায় । আরাকানরাজ মিঙ সমউন বঙ্গদেশে পালিয়ে গিয়ে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র দরবারে আশ্রয় নেন । আরাকান উচ্চব্রহ্মে আভার মাইনমা ( বর্মী ) এবং নিম্নব্রহ্মে রাজধানী পেশুর মনদের ক্ষমতার লড়াইয়ের গুটিতে পরিণত হয় । বাংলায় ২৪ বছর আশ্রিত থাকার পর ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ’র সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিজ রাজ্য ফিরে পেলেন এবং লউংগ্রেট ( Launggret ) থেকে রাজধানী (Mrauk U ) বা ম্রোহং – এ স্থানান্তরিত করেন । পরবর্তীতে বাংলার শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগে মিঙসমউন এর পূত্র বা স পু চট্টগ্রাম দখল করেন । উক্ত ক্রমের দ্বাদশতম রাজা মিন বিন ( ১৫৩১- ৫৩খ্রীঃ ) পর্তুগীজদের সহযোগীতায় ঢাকা পর্যন্ত রাজ্য সম্প্রসারণ করেন । মিন বিনের মৃত্যুর পর ( ১৫৫৩ খ্রীঃ) রামু থেকে উত্তরের ভূ – খন্ড আরাকানের হাতছাড়া হয় । আরাকান রাজ মেনখ ফলিঙ ( ১৫৫০-১৫৯৩ ) রামু এবং গােটা চট্টগ্রাম দখলে নেন , তখন থেকে ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইহা আরাকান রাজ্যের অধীনে থাকে। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে বাংলার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উমেদ যা চট্টগ্রাম দখল করেন । শঙ্খনদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোগল আমলে মোগল অধিকারভূক্ত থেকে যায়।

উল্লেখ্য যে , অধিকাংশ ইতিহাস গ্রন্থ নির্দিষ্ট কোন স্থান / অঞ্চল / রাজ্য বা দেশের শাসক / রাজা কিংবা কীর্তিমান ব্যক্তিগণের বংশপরিচয় , জীবন বৃত্তান্ত , কীর্তিকলাপ , যুদ্ধ সংঘাত ইত্যাদির বিবরণ নিয়ে লিখিত । সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনধারা , ভাষা , সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর আলোকপাত তাতে কমই বিবৃত থাকে । তা সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ সময়ের সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাজা – রাজড়াদের অভিযান , যুদ্ধ – বিগ্রহ ইত্যাদির বিবরনের মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট গণমানুষের জীবন প্রবাহ সম্পর্কে রূপরেখা টানা সম্ভব। উপরে বর্ণিত বিবরণ থেকে হয়তাে দাইনাক দের অতীত সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। উল্লিখিত হাজার / দেড় হাজার আগে ধান্যাওয়াদীর উৎপাদন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল?

মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ও রাজাদের রাজ্য শাসনপ্রণালীর আলোকে অনুমান করা যেতে পারে – ধান্যাওয়ার্দীর রাজপরিবার , রক্ষীদল , রিজার্ভ সেনা , কর্মাধ্যক্ষ , কর্মচারী , দাস – দাসী প্রভৃতি পরিজন পরিবৃত হয়ে রাজা প্রাচীর বেষ্টিত নগরের অভ্যন্তরে থাকতেন , এ ছাড়া অধিকাংশ লোকের বসবাস ছিল নগরের বাইরে । এ ছাড়া ছিল জেলে , তাঁতী , কামার , কুমার , সুতার , প্রভৃতি বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর লােকজন , পরিবার পরিজন নিয়ে তারা নগরের উপকণ্ঠে জনপদগুলোতে থাকতো । নগরের নিকটে কলাদান ও লেমরু নদীর অববাহিকায় সমতল জায়গাগুলোতে ভূমিদাসরা চাষাবাদ করে । নগরবাসীদের জন্য রসদ যোগাতো। আজ্ঞাবহ বিভিন্ন গোত্রের লোকজন পাহাড় এলাকাগুলোতে জুমচাষ , পশুশিকার , পশুপালন , মধু আহরণ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। গোত্র প্রধানদের মাধ্যমে রাজা কর আদায় সহ তাদেরকে পরিচালনা করতেন , যুদ্ধের সময় গোত্র প্রধানরা প্রয়োজনে রাজার সেনাদলে লোক যোগান দিত , যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত । যুদ্ধবাজ কোন কোন গোত্রপ্রধান অথবা বিজিত ১০১ জন রাজাদের অনুসারী কেউ কেউ হয়তো মাঝে মধ্যে বিদ্রোহ করতো , রাজ্যে উৎপাত সৃষ্টি করতো। শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন দেব – দেবীর মন্দির নির্মাণ করে রাজাগণ ভারতবর্ষ থেকে ব্রাহ্মণ এনে পূজা অর্চনার জন্য তাদেরকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন , প্যাগোডা , চৈত্য , মন্দির নির্মাণ করে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন ।

৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পাগান থেকে স্রাইনমা ( পরবর্তীতে বর্মী নামে অভিহিত ) বাহিনী কর্তৃক ধান্যাওয়াদী অধিকৃত হবার ফলে তথায় ইন্দো – আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমশ : হ্রাস পেলো , বিপরীতে চীনের ইউনানের নানজাও রাজ্য থেকে আগত স্রাইনমা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো , নগরের প্রশাসনিক কাঠামো ও সমাজের শ্রেণীবিন্যাস পরিবর্তিত হলো। লেত্ত্যা মিন নান ‘ এর সময় নগরের বাইরে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের রাজার প্রতি আনুগত্যেরও পরিবর্তন ঘটলো। হত্যা , লুণ্ঠন , যুদ্ধ , সংঘাত প্রভৃতি কারণে এক একটি এলাকা বা অঞ্চল কয়েক বছর অথবা কয়েক দশকের জন্য জনশূন্য হয়ে থাকা , নিরাপত্তা এবং শুধু অর্থনৈতিক ( জুম চাষাদি) কারণেও সমগোত্রীয় বা সমভাষী জনগোষ্ঠীর বাসস্থান পরিবর্তন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা । এরূপই যদি হয়ে থাকে তাহলে হয়তো আরাকান রাজের অনুগত কোন গোত্রের আদি বাসভূমি ধান্যাওয়াদি নাম থেকে তাদের পরবর্তী জনগোষ্ঠী দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । মধ্যযুগীয় গছা ( গোত্র ) ভিত্তিক কাঠামোর উপর দাইনাক এবং তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠির সমাজ গঠিত । উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোর উপর লোকসমাজের জীবনধারা ও সংস্কৃতি আবর্তিত হয় । এই গছা , গুত্তি ( উপ – গোত্র ) ও ডেল (বংশধারা )  ভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক কাঠামো অর্ধ শতাব্দী পূর্বেও যথেষ্ট দৃঢ় অবস্থায় ছিল । তখন একটি পাড়াতে প্রধানতঃ একই গছার লোকজনই বসবাস করত । সামন্তযুগীয় আর্থ – সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সৃষ্ট গোত্র ভিত্তিক সামাজিক কাঠামো তাই হাজার বছর ব্যাপী বিবর্তনের মাধ্যমে এসে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সাম্প্রতিক কালেও বিদ্যমান ছিল । হয়তো ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রবংশীয় রাজাগণের প্রতিষ্ঠিত সম্বক ( Sambawak ) নগরেও এককালে পূর্বপুরুষগণ বাস করেছিলেন বলে প্রাচীন দাইনকরা কেউ কেউ বলতেন যে , তাদের আদি বাসস্থান সম্বক নগর বা তারা সম্বক নগর থেকে এসেছেন ।

১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্মী বাহিনী কর্তৃক রাজধানী লউংগ্রেট ( Launggret ) দখল হবার পর আরাকান রাজ মিঙসমউন ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গদেশে গিয়ে আশ্রয় নেয় । তার প্রতি অনুগত বিধায় বর্মী সেনাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে নিজ নিজ গোত্র সর্দারদের নেতৃত্বে দাইনকরাও পশ্চিমে আরাকানের শেষপ্রান্তে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ করে নাফ নদীর পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী নদীর উপত্যকার দিকে সরে এসেছিল। সংখ্যাল্পতা কিংবা শক্তি – সামর্থ্যের দূর্বলতার কারণে তখন হয়তো তারা। দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় প্রধানতঃ জুম চাষের উপর নির্ভর করে এ সময় যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল।

ক্যাপ্টেইন লুইন এর লেখার মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত বলতে পারছি যে , ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে Taungjyny রা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলিতে এসেছিল এবং তারা জমিদার ধরমবক্স খার অনুমতিক্রমে এখানে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল। তারও অনেক আগে এই জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীগণ অত্র পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল বলে হয়তোনিশ্চিতভাবে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , কিন্তু অনুমান করা সহজ যে- মিন সমউন এর বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড়ে ২৪ বছর অবস্থানের সময় আরাকানে চরম অরাজক অবস্থা বিরাজ করেছিল । গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দিন এর সেনাদের সাহায্যে ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে মিন সমউন সামন্ত রাজার মত পূন : আরাকানের সিংহাসন লাভ করেন। তখন হয়তো পুর্বোক্ত শরনার্থীদের কিছু অংশ নাফনদীর পূর্বদিকে ফিরে যায় । আবার পরবর্তী আরাকান রাজ মেঙ খ্য রী ( ১৪৩৪- ১৪৫৯ ) বাংলার সুলতানের কর্তৃত্ব মেনে নেননি এবং তিনি পূর্বোক্ত সুলতানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকজনদের প্রতি বিরূপ ছিলেন।

১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের পর আবার আরাকানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে শাহ সুজার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে মোগলদের সাথে আরাকান রাজার বিরোধ শুরু হয়। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মোগল বাহিনী চট্টগ্রাম ও রামু থেকে আরাকানী সেনা ও তাদের সহযোগী পর্তুগীজদের বিতারিত করে ।

১৬৬৯ থেকে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সর্দাররা পর্যায়ক্রমে আলীকদমে জুমিয়া জমিদারী পরিচালনা করেছিলেন। ফতে খাঁ ( ১৬৬৯ ) থেকে জালাল খাঁ ( ১৭১৬- ১৭২৪) প্রত্যেকে ছিলেন শাহ্ সুজার সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মাধ্যক্ষ বা সেনাপতি । রামুতে জমিদারী পরিচালনাকালে জালাল খার সাথে চট্টগ্রামের নবাবের সম্পর্কের অবনতি হলে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের মোগল সেনাধ্যক্ষ কিষাণ চাদ ও শের জামাল খাঁ অভিযান চালিয়ে আলীকদমের সকল স্থাপনা ধ্বংস করে দিলে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সেখানকার জমিদারী চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় । এর পর ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে দেয়াঙ ( বর্তমান আনোয়ারা ) এর মোগল বংশীয় জমিদার শেরমস্ত খা আলীকদমে বসবাসকারী সহযোদ্ধাদের জন্য চট্টগ্রামের নবাব জুলকর খাঁর কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা এলাকার পার্বত্য ভূমি বন্দোবস্তি নিয়ে বসবাস ও জমিদারী প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেন এবং উদ্বাস্তু চাকমা জুমিয়াদের জড়ো করে কোদালায় নিয়ে আসেন এবং চাষাবাদে নিয়োজিত করেন (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস- জামাল উদ্দিন , পৃঃ ২১৯-২২০ )।

১৭৩৭ থেকে ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পরম্পরা কয়েকজনের পর মোগল বংশীয় শেষ জমিদার ধরম বক্স খার সময় Taungjyny রা আরাকান (?) থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বসবাসের জন্য (রাজানগরে) এসেছিল । তাই এখান থেকে (১৮১৯ খ্র 🙂 দাইনাকদের একটা অংশের ইতিহাসের বাঁক তঞ্চঙ্গ্যা নামে শুরু ।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস দীর্ঘ না হলেও জটিলতা মুক্ত নয় । এ জন্য নিমে লিখিত কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক । যথাঃ(১) চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পর্ক । (২) চাকমাদের রাজা (ধরম বক্স খা) র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণ । এবং (৩) তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক ।

দৈনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্কিত ইয়ংজ কাহিনীর ভিত্তিতে সতীশ ঘোষ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে লিখেছিলেন – “দৈনাকেরা যে চাকমাগনেরই অন্যতম শাখা , তাহা সর্ববাদিসম্মত” সতীশ ঘোষের এ লেখার প্রেক্ষিতে প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যারা চাকমাদের একটি শাখা । অর্থাৎ ইতিহাসের গতিধারায় একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয়ে চাকমা নামের উৎপত্তি আগে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের একটা অংশ দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । ক্যাপ্টেইন লুইন এর মতে- “চাকমা নামটি চট্টগ্রামের অধিবাসীদিগেরই দ্বারা প্রদত্ত ” ( সতীশ ঘোষের বই এর পৃ : ৮ এবং জামাল উদ্দিনের বই এর পৃ : ১৬৭ ) । তা – ই যদি হয় , তবে দৈনাক নামটি কি ইহার পরে ?

কুমুদ বিকাশ চাকমা বর্ণিত আকিয়াব যাদুঘরে রক্ষিত মডেল থেকে যে একটা তথ্য স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, আরাকানে প্রাচীন অধিবাসী কোন জনগোষ্ঠীর নাম ‘চাকমা ছিল না, ছিল দাইনাক। থেক / সেকদের পোষাকের সাথে চাকমাদের মিল থেকে এটুকু মাত্র বলা যায় যে থেক / সেকদের একটা অংশ বাংলার ভূমিতে আসার পর ‘চাকমা ‘ নামে অভিহিত হয়েছে । থেক / সেক ‘ এবং ‘ দাইনাক’ দুইটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী । তদ্রুপ তঞ্চঙ্গ্যা ‘ এবং চাকমা ‘ ভিন্ন জনগোষ্ঠী।

অনলাইনে Daingnak ওয়েব সাইট এ দেখা যায় – দাইনাকেরা নিজেদেরকে Sangma বলেন । উখিয়া, টেকনাফ এলাকায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের নামের শেষে চাকমা লেখেন । এ থেকে আবার দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে একই জনগোষ্ঠীর তিনটি শাখা বলে প্রতীয়মান হয় ।

চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থে (পৃঃ ৬৬-৬৭) অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন – ব্ৰহ্ম আরাকান ইতিহাস বরাবরই একটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত শাক্য জাতি বা শাক বা সাক জাতির অস্থিত্ব কল্পনা করা হয়ে আসছে । আরাকানীরা সম্ভবত: তাদের প্রাচীন Legend এর ধারাকে অনুসরণ করে উত্তর দিক থেকে আগত যে কোন নবাগত বা অপরিচিত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীকেই সাক নামে অভিহিত করতো।

আরাকানীদের উচ্চারণে শব্দের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায় উহ্য থাকে। তাই ‘ সাক ‘ উচ্চারণ প্রায় সাঃ এর মত হয়। রাজাকে বলা হয় মাং । সাক রাজাকে সাঃ মাং এবং সাক লোকদেরকে সাঃ মেও বলেন। সাঃ মেও বা চাকমাদের পূর্বসূরীগণ হয়তো কোন এক কালে সম্বক ( Sambawak ) নগরে বসবাস করেছিলেন । দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণের ন্যায় তাদের একটা অংশ দশম / একাদশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ – বিগ্রহ ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে মাতামুহুরী উপত্যকায় এসে উপনীত হয়ে তথায় বসতি স্থাপন করেন। সম্ভবত : তদকালে গৌড়ে আশ্রিত রাজা মিঙ সউন এর প্রতি অনুগত ছিল বিধায় তারা গৌড়ের সুলতানের অনুগ্রহ লাভ করে আলীকদমের পার্বত্য ভূমিতে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । বহু ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দে কথিত ধাবানা নামে একজন সর্দারের নেতৃত্বে , তারা ‘ সাংমা ‘ নামে নতুনভাবে সংগঠিত হয়। সতীশ চন্দ্র ঘােষ তার চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থের ১ ম অধ্যায়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- “ ধুর্যা , কুর্যা , ধাবানা , পীড়াভাঙ্গা ইত্যাদি নেতৃচতুষ্টয়ের নামানুসারেই সর্বপ্রথমে চারিটি গোষ্ঠী গঠিত হয় । এই চারিটি গোষ্ঠী লইয়াই বংশবিভাগ আরম্ভ হইয়াছিল । ধুর্য, কুর্যাদি নের্তৃবৃন্দ যাহাদের উপর প্রভূত্ব করিত, তাহারও চারিটি দলে বা গোছা’য় বিভিন্ন ছিল” লেখক এর পরে উক্ত চারিটি গছা থেকে শাখা – প্রশাখায় বর্ধিত চাকমাদের তদুকালে মোট একত্রিশটি গোছা ও ১৩৩ টি গুত্তির তালিকা দেন (পৃঃ ৫৬-৬০) উক্ত তালিকায় দাইনাক (তঞ্চঙ্গ্যাদের পুর্বেল্লিখিত ৭ টি গোছার নাম নেই । এ থেকেও বলা যায় -দাইনাক ( তঞ্চঙ্গ্যা) এবং চাকমারা ভিন্ন গোত্রজাত।

১৬৬০ এর পরবর্তী সময়ে শাহ সুজার অনুসারী সেনাদের উপস্থিতির ফলে দক্ষিন চট্রগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে । ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে তারা মোগল বংশীয় জমিদারগণের প্রজা হিসেবে পরিগণিত হয় । জমিদারগণের বাসস্থান ( রাজধানী ) পরিবর্তনের সাথে সাথে উক্ত চাকমা প্রজাগণও বাসস্থান বদলাতে থাকেন । জমিদারের নৈকট্যে থেকে চাকমা প্রজাদের মধ্য থেকে দেওয়ান , তালুকদার , খীসা প্রভৃতি খেতাব নিয়ে একটা ক্ষুদে সমস্ত শ্রেণি তৈরী হয় । সামন্তপ্রভুদের মত বিশেষ করে দেওয়ান স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা সাধারণ প্রজাদেরকে তাদের সেবক বা হুকুমের পাসের মত গণ্য করত । অপরদিকে দাইনাকেরা নিজ নিজ গোত্র প্রধানদেরকে কেন্দ্র করে সম্ভবত : পূর্বের মাতামুহুরী উপত্যকা বা উহার নিকটবর্তী অঞ্চলে জুম চাষ করে যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল । ফলত : তাদের মধ্যে অনুরূপ কোন শ্রেণি বিভাজন গড়ে উঠেনি। সে সময় মূলত : চাকমাদের দেওয়ান প্রভৃতি সামন্ত শ্রেণির লোকেরাই দৈনকদের প্রতি হেয় মনোভাব পোষণ করতো । হয়তো তাই সতীশ ঘোষের লেখাতে পাই- “ চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃনার চক্ষে দেখিয়া থাকে। ” উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য সূচিত হবার ইহা আর একটা কারণ । উপরোক্ত চাকমা ও দাইনাকদের পূর্বপুরষগণ শত বর্ষ পূর্বে যদি একটা গোত্রের লোকও হতেন তবুও দুইটা জনগোষ্ঠীকে আলাদা গণ্য করার জন্য এই শ্রেণি বিভাজনের পার্থক্যই যথেষ্ট । পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে , জমিদার শেরমস্ত খা’র সময় ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে অধিকাংশ চাকমা আলীকদম এলাকা থেকে কোদালায় স্থানান্তর হয়েছিল । ধারণা করা যায় – জুমচাষে অভ্যস্ত দাইনাক লোকেরা হয়তো হাল চাষে অনীহার কারণে পূর্ব বসতি পাহাড় জঙ্গলের জায়গা ছেড়ে চলে আসেনি অথবা আসার পর আবার জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যত্র কোন পাহাড় – জঙ্গলময় এলাকায় চলে যায় । এ জন্যই হয়তো সতীশ ঘোষ আরো লিখেছিলেন- “ ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈনাকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে ” । অর্থাৎ দৈনাকদেরকে তিনি চাকমা থেকে বেরিয়ে যাওয়া ( ! ) একটি শাখা হিসেবেই গণ্য করেছেন (১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে উল্লিখিত গছাভিত্তিক সামাজিক কাঠামোতে চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার ভিন্নতা বিবেচনায় এ বক্তব্য সমর্থনযোগ্য হয় না )

মাঝখানে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মোগল সম্রাটের নিকট থেকে পুরো ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায় । জমিদার শের দৌলত খাঁ ( ১৭৬৫-১৭৭২ ) এর সময় থেকে টব্বর খা ( ১৭৯৮-১৮০১ ) পর্যন্ত চাকমাগণ বৃটিশ বিরােধী সংগ্রাম চালান । জমিদার জব্বর খা ( ১৮০১-১৮১১ ) এর সময় থেকে বৃটিশদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে চাকমারা কিছুটা শান্তিতে বসবাস করতে পারে । সম্ববত : দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ থাকার কারণে দক্ষিণে রোয়াঙ ( রামু থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব ভূভাগ এক সময় রোয়াঙ নামে পরিচিত ছিল) থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজানগরে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ’র নিকট এসে ৪০০০ দাইনাক আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল । (আমার বাবার কাছ থেকে ১৯৬৩-৬৬ খ্রীঃ সময়ে জেনেছি , তাঁর পিতামহ তারও পিতামহের মুখ থেকে শুনেছেন – রাজার অনুমতিক্রমে তাদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ রোয়াঙ থেকে আগত লোকেরা প্রথমে চন্দ্রঘোনার নিকটে সীতা পাহাড় ও রাম পাহাড় এলাকায় জুমচাষ করে ছিলেন । সেখান থেকে এক অংশ ক্রমান্বয়ে উত্তরে ওয়াগৃগী এবং অপর অংশ পূর্বে কর্ণফুলীর উপনদী কাপ্তাই ও রাইংখ্যং এর দিকে ছড়িয়ে পড়েন )।

যে কারণেই হোক, কিছু লোক অন্যত্র চলে যায় । পরিসংখ্যান সূত্রের ভিত্তিতে জনসংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পাবার কথা । অথচ ৫০ বছর পর ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তাদের সংখ্যা অবশিষ্ট ছিল ২৫০০ (ক্যা, লুইন) । একান্তই স্বজাতি বোধে এসে থাকলে কিংবা দেওয়ান পরিষদ বেষ্টিত জমিদার তাদেরকে একই চাকমা জাতি গণ্য করলে তাদের বেশীর ভাগ লোক নিশ্চয় থেকে যেত।

১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বার্মারাজ বোধাপায়া আরাকান দখল করে । বর্মীবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায় , কয়েক লাখ লোক আরাকান থেকে বিতারিত হয়ে বৃটিশ অধিকৃত পূর্ববঙ্গে , প্রধানত : চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়। ইংরেজ সরকার তাদেরকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) এবং পটুয়াখালিতে পূনর্বাসিত করে । ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে বোমাং তার মগ ( মারমা ) অনুসারীগণ সহ বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অথবা উপরোক্ত উদ্বাস্তু লোকেদের আসার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়, হয়তো জুমচাষের পাহাড় ভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণেও দাইনাকদের কিছু অংশ বসবাসের জন্য সমগোত্রীয় গণ্য করে উত্তরদিকে চাকমাদের কাছাকাছি এসেছিল । ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান সহ সমগ্র বার্মা বৃটিশের অধীনে চলে যায় । সীমান্তের বাধা নিষেধ রইল না। বৃটিশ সরকার ইতিপূর্বে উদ্বাস্তু হয়ে আসা লোকজনদেরকে পূনরায় আরাকানে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে। এটাও হতে পারে – যাযাবর জুমিয়া দাইনাকদের কিছু অংশ হয়তো তখন আরাকানে ফিরে গিয়েছিল।

১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে প্রতিবেশী বাঙ্গালীদের সংস্পর্শে থাকায় চাকমাদের ভাষাতে বহুল পরিমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ প্রবিষ্ট হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামে (১৬৬৬ খ্রীঃ পর্যন্ত আরাকানের অংশ) বসবাসের সময় এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রামী বাঙ্গালীদের সাথে প্রয়োজনে কথাবার্তায় দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যারাও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতে শেখেন ( যে কারণে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলা বলে অনেকে মনে করেন ) এবং ধীরে ধীরে তাদের ভাষায় ঐ শব্দগুলো প্রবিষ্ট হতে থাকে । তাই ভিন্নভাষী , বিশেষ করে বাঙ্গালীদের নিকট চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলারূপে আপাত : একই রকম মনে হতে পারে । তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমাদের একটি শাখা বলে গণ্য করার পেছনে এটিও একটি কারণ । অথচ চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যা সাধারণের কথা অনেক সময় বুঝতে পারেন না । একশ ‘ বছর আগে সতীশ ঘোষের লেখা ( ১৯১০ খ্রীঃ) থেকে জানা যায়- তকালে তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা নিজেদের মধ্যে আরাকানী ভাষায় কথা – বার্তা বলে আর কম বয়সীরা চাকমাদের অনুকরণে বিকৃত বাংলায় বলে । এ থেকে ধারণা করা যায়- তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চাকমাদের বেলায়ও সে একই কথা প্রযোজ্য।

জমিদার ধরম বক্স খা’র মৃত্যুর (১৮৩২ খ্রীঃ) ১২ বছর পর রানী কালিন্দী জমিদারী লাভ করেন ( ১৮৪৪ খ্রী ) । জামাল উদ্দিন তার পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ( প্রকাশ কাল ২০১১ খ্রী ) গ্রন্থে ( পৃ : ১৫৬-২৫৭ ) লিখেছেন- “ জমিদারীর কর্তৃত্ব লাভের জন্য বিপক্ষীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রানীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তঞ্চঙ্গ্যারা । ” এ কারণে পরবর্তী সময়ের জমিদার তথা চাকমা রাজাগণ তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন বলে জানা যায় । শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা’র “ তঞ্চঙ্গ্যা জাতি ” গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি- চাকমা রাজা ভূবন মােহন রায় ( ১৮৭৬-১৯৩৪ খ্রীঃ ) কবিরাজ শ্ৰী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে রাজকবি উপাধিতে ভূষিত করে রাজসভায় সমাসিন করেন । রাজা নলিনাক্ষ রায় ( ১৯০২-১৯৫১ খ্রীঃ) শ্রীমৎ প্রিয় রত্ন মহাস্থবির ( গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু মর্যাদায় ভূষিত করেন । জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( যিনি কানা গিংখুলী নামে খ্যাত ) কে ‘ রাজুগিংখুলী ’ উপাধি দিয়ে প্রতিবছর রাজপূণ্যাহ উপলক্ষে রাজসভায় সমাসিন করতেন । রাজা ত্রিদিব রায় (১৯৩৩- ২০১৩ খ্রীঃ) ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির (গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু পদে অভিষিক্ত করেন । উক্ত রাজাগণের সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মৌজা হেডম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেন । একালের প্রতীকী ‘ রাজা ’ নামে চাকমা জমিদারগণ গুণীজনদের মর্যাদা দিয়েছেন , সম্মান রক্ষা করেছেন , তঞ্চঙ্গ্যা , গোত্র বা জাতিগতভাবে ভিন্ন কি না তা বিবেচনা করেননি।

বৃটিশদের পর ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের একটা অংশরূপে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিবর্তিত হয় । জমিদারী প্রথা রহিত হয় । সমাজে শ্রেনীগত স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে । কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু আধা – সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যায় । পূর্বোক্ত দেওয়ান তথা কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতা খর্ব হয় । তা সত্ত্বেও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির (তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা , পৃ : ১১২ ) রেশ এর পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়েছিল । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কাগজের কল বসে । ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হয় , কর্ণফুলী নদীতে বাঁধের জলে উজানে ৪০০/৫০০ বর্গমাইল এলাকা হ্রদে পরিণত হলে প্রায় ৫৪,০০০ একর আবাদী জমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে । এতে ১৮,০০০ পরিবারের লক্ষাধিক লোক (অধিকাংশ চাকমা , কিছুসংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাঙ্গালী ) ক্ষতিগ্রস্ত হয় । প্রায় ৪০,০০০ লোক ভারতে ( এদের বেশীর ভাগই চাকমা এবং কিছু সংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা ) এবং ২০,০০০ লোক আরাকানে চলে যায় । এসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী পরিচালিত ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার ঘটে । এ ক্ষেত্রেও তঞ্চঙ্গ্যাদের তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায়নি ।

পাকিস্তানের সময় থেকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রসার ঘটে । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে রামগড় হাইস্কুল , ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কে , পি , এম উচ্চ বিদ্যালয় , ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি শহরে শাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিত -১৮৯০ খ্রীঃ) সহ ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের শুমারীতে মোট উচ্চ বিদ্যালয় ৭ টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ১৪ টি, এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৬১ টি (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস জামাল উদ্দিন , পৃ : ৩২৩) পাওয়া যায় । ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে নতুন রাঙ্গামাটি শহরে একটি কলেজ স্থাপিত হয় ।

বলা বাহুল্য – বিদ্যালয়গুলো অধিকাংশ চাকমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে স্থাপিত হওয়ায় সাধারণ চাকমা ছেলে-মেয়েরাই সে সুযোগ লাভ করে। মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যতীত তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশই উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ নিতে পারেনি। ফলত: শিক্ষাগত দিক দিয়েও চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয় ।

১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। বনায়নের জন্য বিস্তীর্ণ পাহাড় ভূমি অধিগ্রহণ, রাবার বাগানের জন্য ধনী ও প্রভাবশালী লোকদেরকে হাজার হাজার একর পাহাড় ইজারা প্রদান প্রভৃতি কারণে জুমচাষের ভূমি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে জুমিয়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকেদের জীবিকা নির্বাহের প্রথান উপায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশ লোক ছিল জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ; এখন তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ বাগান ইত্যাদি গড়ে তুলে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে ; চাকরী , ব্যবসা প্রভৃতি পেশাতেও প্রতিযোগীতায় পিছনে পড়ে থাকে। অধিকাংশ দিন মজুরী থেকে শুরু করে যখন যা পাচ্ছে সে কাজ করে কোন রকমে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । যাদের পক্ষে সম্ভব তারা ছেলে – মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করছেন , যদিও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তারা অনুমানিক ১০ % এর বেশী হবে না।

মূলত : জুম পদ্ধতির আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল যাযাবর দাইনাক তথা তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর লোকজন হাজার বছরের জীবন পরিক্রমায় গোত্রগত তথা জাতিগত পূর্বপরিচয় ইতিহাসের ঝরা পাতায় রেখে এখন নতুন যুগে পরিবর্তিত ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী যারা তিনশ ’ বছর পূর্বেও একই জাতিরূপে একই দেশে বসবাস করে ছিল , এখন তারা ত্রিধা বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ভারত – এ তিনটা দেশের নাগরিক। ভিন্ন তিনটা দেশে তারা তিনটা ভিন্ন নৃ – গোষ্ঠী নামে পরিচিত হবে , নিজস্ব মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও সংস্কৃতিচর্চা না থাকলে উক্ত পরিচিতিও এক সময় হারিয়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ সম্ভাবনাটা আরো বেশী প্রকট।

জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা আবশ্যক; কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশগত কারনে শিক্ষিত ছেলে – মেয়েরা নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে , পূর্বে প্রচলিত ছিল এমন অনেক শব্দ তাদের কথাবার্তায় ক্রমাগত বাংলা অথবা ইংরেজী শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে । তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় কোন সাহিত্য – সংস্কৃতির চর্চা তেমন না থাকায় তাদের ভাষার সংরক্ষণ হচ্ছে না , বিকাশও ঘটছে না । চাকমা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের একাংশ এ বিষয়ে যথেষ্ট সক্রিয়, তারা চাকমা বর্ণমালা শিক্ষাদান সহ মাতৃভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা বহু বছর পূর্ব থেকে শুরু করেছেন , প্রজন্ম পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন । তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষিত ব্যক্তি তথা বুদ্ধিজীবিগণ বলতে গেলে এখনো ঘুমিয়ে । আলাদা একটি জাতিসত্ত্বা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে- এটা আনন্দের বিষয়; এটি দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে জাতি হিসেবে চাকমা থেকে আলাদা বলতে পারা যায়। কিন্তু ইতিহাসের গতিধারায় আমরা কী দেখতে পাই ? দাইনাক চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করে আসছেন যে, সবাই (পূর্ব পুরুষগণ) একসময় চম্পক (সম্বক!) নগরে ছিলেন । কাব্য রূপে কিংবদন্তী রাধামন – ধনপদী কাহিনীও প্রত্যেকে নিজেদের পূর্বপুরুষগণের ইতিহাস (!) বলে মনে করেন । হয়তো দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষগণ অতীতে কোন এক সময় একই গোত্র বা জাতিভূক্ত ছিল । প্রবন্ধে আলোচিত বিবরণ অনুযায়ী এ কথা বললে সম্ভবত: ভুল হবে না- তঞ্চঙ্গ্যা / দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণ (সর্দারগণ) সমকালীন পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি বিধায় উত্তরসূরীগণ অগ্রযাত্রায় চাকমাদের তুলনায় পর্যায়ক্রমে পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিল । ভাষা হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জাতি হিসেবে গণ্য হবার প্রাথমিক ও মূল ভিত্তি , সংস্কৃতি হচ্ছে তার আবরণ । জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

লেখক- রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৭ ইংরেজী তে অবসরপ্রাপ্ত একজন সহকারী শিক্ষক । এবং সদস্য – সচিব, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা আহ্বায়ক কমিটি (২০০৮ ইং গঠিত) ।