Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

Hoisting the national flag and releasing balloons before commencing the General Conference and Council of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization

Wagga, Rangamati, April 26, 2024 – The Bangladesh Tanchangya Welfare Organization (BTWO) hosted its pivotal General Conference and Council yesterday at the Wagga High School Compound, Kaptai Upazila, Rangamati, marking a significant step towards enhancing community welfare and cultural preservation of the Tanchangya people. The event was graced by the presence of notable figures, including Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs, who attended as the chief guest, and Dipankar Talukdar, MP of Rangamati District, who served as the inaugurator.

Special guests at the event included Jarati Tanchangya, Reserved MP for Women of Chittagong Hill Tracts, and Mr. Aungsuipru Chaudhuri, Chairman of Rangamati Zila Parishad, among other dignitaries who have been instrumental in Tanchangya community affairs.

Mr. Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs delivering the Chief Guest Speech

The conference commenced with the ceremonial hoisting of the Bangladesh national flag, followed by the enchanting rendition of a traditional Tanchangya song, setting a tone of unity and cultural reverence. The event was a gathering and vibrant celebration of Tanchangya heritage, with discussions centred around safeguarding their culture and consolidating efforts across various Tanchangya Kalyan Sangsta regional units.

Tanchangya singers singing song during the General Conference Council

The gathering was significant due to the elections to appoint new leadership within the BTWO. Mr. Diptimoy Talukdar was elected President, Mrinal Kanti Tanchangya was the General Secretary, and Najib Kumar Tanchangya was the Organizing Secretary. These leaders are poised to spearhead initiatives that will foster the development and growth of the Tanchangya community.

A section of the audience during the Conference and Council of BTWO

The Ad hoc Central Committee of BTWO appointed the Debtachhari Region of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization to host the General Conference and Council. However, all 12 regional committees contributed to executing the Conference and Council of BTWO. The 12 regional committees are spread across Rangamati, Bandarban, and Cox’s Bazar districts. They are: (1) Rangamati Sadar Region (2) Debtachhari-Raisyabili Region (3) Kaptai Region (4) Bilaichhari Region (5) Farua Region (6) Rajasthali Region (7) Rajbila Region (8) Bandarban Region (9) Roangchhari Region (10) Alikadam Region (11) Nakhyongchhari Region (12) Cox’s Bazar Region.

Group photo of Chief Guest and Special Guests during the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

The Ad hoc BTWO gave the responsibility to the Debtachhari-Raisyabili Regional Committee of the BTWO, which extended heartfelt thanks to all who supported the event physically, mentally, and financially. Special acknowledgement was given to the youth and students from local villages such as North Debatchari, Dakshin Debatchari, and others, whose tireless volunteer efforts were crucial in the smooth execution of the conference. As the event concluded, a vote of thanks was given, recognising the invaluable contributions of attendees from all 12 regions within the Rangamati and Bandarban districts. The BTWO expressed optimism that the solid foundation of cooperation during this conference will continue to strengthen in future endeavours, propelling the Tanchangya community towards greater heights of development and cultural preservation.

Note: Credit goes to the original owners of these photos, which the editors collected from Chandra Sen Tanchangya and Milinda Tanchangya.

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা

সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস। 

প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি। 

তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি। 

বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)। 

এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;

তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। 

আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত। 

বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল। 

উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস) 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল। 

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল। 

সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে। 

সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। 

তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা। 

১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান। 

অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।” 

দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়। 

সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।” 

অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। 

উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র। 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) 

তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়। 

দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়। 

এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়। 

একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। 

বাতকস এর লক্ষ্য 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।” 

বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য 

নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর

বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।

বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। 

২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে। 

বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল

তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল। 

বাতকস এর সম্মেলন সমুহ  

১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। 

এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল। 

এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।

১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। 

উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন। 

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। 

বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী 

বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-

১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়। 
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। 
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। 
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে। 
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা, বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : বাঘ ও শূকরের মিতালী

লেখক : বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

বনে নানা প্রজাতির পশু-পাখি বাস করে। কোন পশু মাংসভোজী, আর কোন কোন পশু তৃণভোজী। পাখিরা সাধারণতঃ শস্য, ফল, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মাংসভোজী পশুরা খুব হিংস্র হয়ে থাকে।

অপর দিকে তৃণভোজী পশুরা নিরীহ প্রকৃতির হয়ে থাকে। তৃণভোজী পশুদের মাংস খেয়েই মাংসভোজী পশুরা জীবনধারণ করে। তাই তৃণভোজী পশুদের উপর তারা বরাবরই চড়াও হয়। তারা আবার স্বজাতীয় পশুদের মাংসও বাদ দেয়না।

একে অপরকে মেরে মনের সুখে মাংস ভক্ষণ করে উদর পূর্তি করে। তৃণভোজী পশুরা তাই সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে বিচরণ করে থাকে। কোথাও কোন হিংস্র পশু ওঁৎ পেতে আছে কি-না সে জন্য তাদের সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়।

তাই স্বভাবই তারা চঞ্চল। পাখিরা মাটিতে বিচরণ করলেও তাদের ডানা থাকাতে কোন হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে তারা সহজে আত্মরক্ষা করতে পারে।

সে জন্য তারা অনেকটা নির্ভয়ে বাস করে। গাছের ডালে উড়ে বেড়ায়, কলকাকলী করে। তাদের কল কাকলী শুনে মনে হয় তারা কতই সুখী।

শত শত প্রজাতির পশু-পাখিদের অরণ্যে আইন শৃঙ্খলাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ আলাদা। অরণ্যের আইন নিতান্তই বন্য। যেখানে তৃণভূমি আছে কিংবা তৃণভোজী হরিণ, চঙরা, (সম্বর) শূকর, খরগোশ প্রভৃতি বিচরণ করে, তার কাছাকাছিই চুপিসারে বিচরণ করে হিংস্র বাঘ, সিংহ।

গণ্ডার, হাতি, বুনোমহিষ প্রভৃতি বৃহৎ জন্তুরাও সমগ্র বনাঞ্চলে বিচরণ করে থাকে। বাঘ-সিংহরা তাদের যেমন কিছু করতে পারে না, তাদের ধারে কাছেও যায় না। এদের মধ্যে ধূর্ত বুদ্ধির অধিকারী পশু হল শিয়াল।

হরিণ, শূকর প্রভৃতি তৃণভোজী পশু শিকার করা তার সাধ্যের বাইরে। শিয়ালও মাংসভোজী প্রাণী। সে বাঘ আর সিংহের পিছনে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে খুব সতর্ক হয়ে বিচরণ করে। যখন কোন হরিণ, সম্বর, শূকর মারা যায়, তখন মৃত পশুর একাংশ বাগিয়ে নেবার তালে থাকে।

অনেক সময় বেকায়দার ফলে হিংস্র পশুর থাবার শিয়ালকে অহেতুক প্রাণ হারাতে হয়। এ হল বেচারা শিয়ালের অবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য ধূর্ত বুদ্ধির আশ্রয় নেয়া ছাড়া তার কোন গত্যন্তর নেই।

গভীর অরণ্য ছেড়ে শিয়াল লোকালয়ের কাছে থাকা অধিক পছন্দ করে। সে লোকালয়ে একটু চেষ্টা করলেই গৃহপালিত হাঁস, মুরগী শিকার করতে পারে। বন মোরগ কিংবা অন্য পাখি শিকার করা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

পাখিদের মধ্যে পেঁচার একটু বিশেষত্ব আছে। পেঁচার চোখের পাতা নেই। তার চোখে পলক পড়ে না। অপলক নেত্রে সে আলো সহ্য করতে পারে না। তাই দিনের বেলায় সূর্য্যর আলো থেকে বাঁচার জন্য পেঁচা ঝোপের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকে অথবা ঘুমায়।

রাতের বেলাতেই সে চরে বেড়ায়, খাদ্য আহরণ করে। সারা রাত কুল-কুলায়। কিন্তু সকাল হলে ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য একটি চাকমা প্রবাদ আছে, সারা রাত পেঁচায় কুল-কুলায় খুরোল্যা (কাঠ ঠোকরা) সনার তুন (সোনার মুকুট) পায়।

তবে পেঁচাও ধূর্ত কম নয় বরঞ্চ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। সে যখন জেগে থাকে তখন চুপ করে থাকে। রাতে যখন গাছের ঝোপে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন শব্দ করে।

“পুকজুক পেদরললত পুক জুক পেদরললত, পুক জুক পেদরললত” তখন শিকারী নিশাচর বনবিড়াল মনে করে, পেঁচা বেটা তার আহরণ করা পোকা আরাম করে খাচ্ছে। তাই বনবিড়াল সে দিকে যায় না আর পেঁচাও নিরাপদে ঘুমায়।

সমগ্র বনাঞ্চল সিংহই হল অঘোষিত সম্রাট। হাতি, গন্ডার, বুনোমহিষ প্রকান্ড শরীরের অধিকারী হলেও অন্য পশুদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রকান্ড শরীরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য অহরহ খাদ্য অন্বেষণ করতে হয় তাদের।

অন্য কিছু করার বা ভাববার সময় তাদের নেই। সিংহ হিংস্র এবং শক্তিশালী। একটি হরিণ বা শূকর মারতে পারলে তার বেশ ক’দিন চলে যায়। নানা চিন্তা ভাবনা করার সময় তার আছে।

তার মূর্তি ও শক্তিমত্তা দেখে অন্যান্য পশু-পাখিরা তাকে সমীহ করে এবং এ সুযোগে সে নিজেকে সমগ্র বনাঞ্চলের সম্রাট বলে জাহির করে।

বন্য পশু-পাখিদের একটি সার্বজনীন প্রকৃতির ভাষা আছে। এটি সকলেই বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী ধ্বনিও উচ্চারণ করতে পারে। এটি তাদের লিংগুয়াফ্রাংকাই। এ লিংগুয়াফ্রাংকাই অরণ্য অঞ্চলের ভাষা।

এ লিংগুয়াফ্রাংকা দিয়েই অরণ্য সম্রাট সিংহ তার শাসন পরিচালনা করে। মানব সমাজে যেমন অন্যায়-অবিচার, অঘটন ঘটে এবং সেসবের বিচার হয়ে অপরাধীর শাস্তি ধার্য করা হয়।

পশু–পাখিদের মধ্যেও সে রকম অন্যায়, অবিচার, অঘটন সংঘটিত হয় এবং সেসবেরও বিচার করার উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হয়। দুর্বলেরা সিংহের নিকট তাদের প্রতি কৃত অন্যায়-অবিচারের বিচার প্রার্থী হয়।

সিংহ তার সভাসদের পরামর্শে বিচার নিষ্পত্তি করে। সেরকম একটি ঘটনা এখনও অরণ্য অঞ্চলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ঘটনাটি বা ঘটনার কাহিনী এখন মানব সমাজে রূপ কাহিনী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

একদা কোন এক গভীর অরণ্যে এক শিকারির গুলির আঘাতে এক বাঘিনী তার শিশু শাবক রেখে মারা যায়। মাতৃহারা শাবকটি অসহায়ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করার সময় সদ্য প্রসূতি হওয়া এক শূকরীর নজরে পড়ে।

শূকরীর একটি মাত্র শাবক। অসহায় ব্যাঘ্র শাবকটির প্রতি করুণা পরবশ হয়ে শূকরী ব্যাঘ্র শাবককে আপন শাবকের ন্যায় স্নেহের সাথে নিজের দুধ পান করিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এবং লালন পালন করতে থাকে।

ব্যাঘ্র শাবকটি দু’এক মাস শূকরীর দুধ পান করলেও তার জাতিগত স্বভাব অনুযায়ী ধীরে ধীরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী শিকার করতে আরম্ভ করে। ইতোমধ্যে শুকরছানা আর ব্যাঘ্র শাবকটির মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

এভাবে তারা বড় হতে থাকে এবং স্ব স্ব জাতিগত স্বভাব লাভ করে। এক সময় শূকরছানাটি তার মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাঘ্র শাবকের সঙ্গে বন হতে বনান্তরে বিচরণ করে জীবনযাপন করতে লাগল। উভয়ের মধ্যে যে প্রগাঢ় হৃদ্যতা তা বলাই বাহুল্য।

ব্যাঘ্র মাংসভোজী হিংস্র পশু। বনাঞ্চলে সিংহের পরেই তার স্থান। ব্যাঘ্র শাবকটি সারাদিন বন্য পশু শিকার করে আর শূকর ছানাটি শস্য ক্ষেত এবং তৃণভূমিতে বিচরণ করে সন্ধ্যায় দুই বন্ধু একত্রিত হয়ে এক জায়গায় রাত কাটায়।

এভাবে উভয়ে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে পরিপূর্ণ বাঘ আর শূকরে পরিণত হল। বাঘটি শক্তিশালী হিংস্র শিকারি পশু এবং শুকরটি চর্বি জমে মোটাসোটা, নাদুস নুদুস হয়ে এক লোভনীয় জন্তুতে পরিণত হল। শূকর দুর্বল প্রাণী।

অন্ততঃ বাঘের কাছেতো বটেই। প্রথম প্রথম সে বাঘটিকে সমশ্রেণী বা সমগোত্রীয় মনে করত। কিন্তু একদিন যখন দেখল বাঘটি তার সামনেই তাদের সমগোত্রীয় একটা শূকরের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে ফেলল এবং উল্লাস সহকারে মাংস ভক্ষণ করল, তখনই সে বুঝতে পারলো বাঘ তাদের সমগোত্রীয় নয়। কিন্তু তখনও বোধহয় হয়নি যে, সেও বাঘের ভোগ্য জন্তুতে পতিত হতে পারে।

একদিন বাঘ সারাদিন কোন শিকার জোটাতে না পেরে সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শূকরটি এ অবস্থায় চিন্তিত হয়ে তার পাশে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করল। বাঘ আরো গম্ভীর হল এবং এক সময় হঠাৎ এক লাফ দিয়ে শূকরের গলায় কামড় বসিয়ে দিল।

কিন্তু না, জোরে নয় অতি হালকাভাবে বাঘ কেবল শূকরকে বধ করছে–এই ভাবে অভিনয় বা ভান করল মাত্র। শূকর ভয় পেল। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে তবু সাহস করে বলল, একি বন্ধু! তুমি আমাকে এভাবে আক্রমণ করছ কেন?

তুমি কি শেষ পর্যন্ত আমাকেও হত্যা করে ফেলবে? এ কথায় বাঘ শূকরকে ছেড়ে দিল এবং লজ্জার ভান করে বলল, ছিঃ ছিঃ বন্ধু, তুমি একি বলছ? আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে, তোমার মত অকৃত্রিম বন্ধুকে হত্যা করব?

তোমার মত নাদুস নুদুস পশু ধরলেই আমার হাত থেকে পালিয়ে যায়, তাই একটু তালিম দিয়ে দেখলাম ভবিষ্যৎতে কিভাবে ধরতে হবে। নির্বোধ শূকর বাঘের এ কথায় আশ্বস্ত হল।

বাঘটির কয়েক দিন ধরে শূকরের নাদুস নুদুস শরীর দেখতে দেখতে তাজা মাংসের লোভে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে এতদিন লোভ দমন করে আসছে।

কিন্তু শূকরের কণ্ঠনালীতে কামড় বসাতে গিয়ে বাঘটির লোভ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল এবং তার পক্ষে লোভ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ল।

একদিন সকালে শূকর যখন আহার অন্বেষণে আস্তানা থেকে রওনা দিচ্ছে, বাঘ এক গাছের আড়াল থেকে এক লাফ দিয়ে শূকরের পিঠে কন্ঠনালীর দিকে মুখ নিতে নিতে বলে, বন্ধু এতদিন তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আজ কিন্তু তোমার তাজা মাংস খাব।

শূকর ভীষণ ভয় পেল। সে বাঘের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে উচ্চ লাফ দিল। আচমকা এ লাফে বাঘ নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না, শূকরের গায়ে আঁচড় কেটে মাটিতে পড়ে গেল। শুকরের গা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।

শূকর সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। একটি গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বাঘের পুনরায় সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হল। বাঘ কিন্তু আক্রমণ করল না। শুকরের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধু তুমি জাননা তুমি আমার ভক্ষ্য।

তুমি কোন বিশ্বাসে এবং কোন সাহসে ভক্ষকের সঙ্গে মিতালী কর? আমি আর তোমাকে রেহাই দেব না। তোমার পিঠ থেকে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বোধহয় বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছ।

শূকর তার দেহে বাঘের নখের আঁচড় লাগা স্থান থেকে রক্ত ঝড়তে দেখে এবার উপলব্দি করল যে, বাঘ তার সমগোত্রীয় নয় এবং যে কোন মূহুর্তে বাঘ তাকে মেরে ফেলতে পারে।

শিশুকাল থেকে সখ্যতা আছে বলে শূকর বাঘকে বন্ধুতের দোহাই দিতে থাকে এবং নম্রসুরে বলল, বন্ধু আমার মায়ের দুধ একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হয়েছি।

আমার মা তোমাকে আপন সন্তানের মত আদরযত্ন করেছে, সে কথা কি ভুলে গেছ বন্ধু? বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, কি আজেবাজে বলছ! বাঘের বাচ্চা কখনও শুকরের দুধ খায় নাকি? যাক এতদিন আমি তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আর রেহাই দেব না।

আসল কথা কি জান? আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি তোমাকে ঘাড় মটকিয়ে হত্যা করে তোমার তাজা রক্ত মাংস খাচ্ছি। স্বপ্নে আরো দেখলাম, বনের রাজা সিংহও অতি আনন্দের সঙ্গে তোমার তাজা রক্ত মাংস খেয়ে লাফাতে শুরু করেছে।

অন্য কোন কথা বলে লাভ নেই, তুমি প্রস্তুত হও, আমি আমার দেখা স্বপ্ন অনুযায়ী তোমাকে এখনই মেরে ফেলব। শূকর বুঝতে পারল বাঘটির কথায় কোন কৃত্রিমতা নেই। রূঢ় অথচ সত্যি কথাই বলছে বাঘ।

শূকর অনুনয় বিনয় করে আমতা এবং ভয় জড়িত কন্ঠে বলল, এ বনে অনেক পশু-পাখি আছে যারা এ বনেরই অপর প্রাণীর ভক্ষ্য। তথাপি বনের রাজা সিংহের শাসনাধীনে একই বনে যার যার প্রাণ রক্ষা করে বেঁচে আছে।

আমাদের সকলের রাজা সিংহ মহাশয়ের সমীপে চল, তিনি যদি বলেন, তোমার স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী তুমি আমাকে ভক্ষণ করতে পারবে, তাহলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। বন্ধুর জন্য আমার এ দেহ হাসিমুখে বিসর্জন দেব।

বাঘ জানে যে, শূকর কোনদিন তার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। সে যখন ইচ্ছা করে তখনই শুকরকে হত্যা করতে পারবে।

এও জানে যে, মহাপরাক্রমশালী পশুরাজ সিংহ অবশ্যই তার পক্ষেই রায় দেবে, স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী শূকরকে হত্যা করার নির্দেশ অবশ্যই দেবে। এসব কথা ভেবে বলল, ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে এ সুযোগ দিলাম। চল, পশুরাজ সিংহের দরবারে।

যথাসময়ে পশুরাজ সিংহের দরবারে হাজির হল তারা। পশুরাজ সিংহ শূকরকে দেখে অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করল এবং শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে তাজা রক্ত পান করার প্রবল ইচ্ছা কোন রকমে চাপা দিয়ে রাখল।

শূকর বাঘকে দেখিয়ে তার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পশুরাজ সিংহের কাছে প্রার্থনা জানাল। বাঘ কেন শূকরকে আক্রমণ করতে চায়, তা পশুরাজ জানতে চাইলে বাঘ দৃঢ় কন্ঠে তার স্বপ্নের বিবরণ পশুরাজকে খুলে বলল।

উভয়ের আর্জি শুনে সিংহ তার স্বভাবজাত কায়দায় গর্জন করে বলল, এ অরণ্য রাজ্যের ছোট, বড় প্রায় সকল পশু-পাখিই আমার দরবারে হাজির হয়েছ। শূকরের আবেদন এবং বাঘের স্বপ্নের বিবরণ সবাই শুনেছ। স্বপ্ন হল স্বর্গীয় ব্যাপার।

এটি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। বাঘ শুকরের মাংস খাচ্ছে বলে যে স্বপ্ন দেখেছে তা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশই হয়েছে। কাজেই বাঘ শূকরকে এখন খেতে পারবে। বন্য কুকুর এবং শিয়াল ভয়ে ভয়ে চাপা কন্ঠে বলল, স্বপ্নে যাহা দেখে বাস্তবে তা হয় বা হওয়া প্রয়োজন এরকম কোন নজির নেই।

অতএব বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে শূকরকে কি করে ভক্ষণ করবে তা বুঝা যায় না। পশুরাজ সিংহ রাগান্বিত হয়ে বলল, শিয়াল, কুকুর তোমারও মাংস পেলে ছাড় না………… তোমাদের মুখে এ কথা সাজে না, চুপ কর।

সিংহের গর্জনে তারা গুটিশুটি মেরে বসে রইল। হাতি তার বড় বড় কান দুটি এবং লেজটি নেড়ে সিংহের গর্জন শুনে তার শুঁড়টি উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঘের এ স্বপ্নটি অতি অদ্ভুত।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন স্বর্গীয় হবে কেন? আর সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ হলে স্বপ্নের মধ্যে শূকর মরে যেত……….. সেতো এখনো বেঁচে আছে। কাজেই এ স্বপ্নটি মিথ্যা।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন কেউ কি দেখে? তার পাশে দাঁড়ানো পর্বতের মত বিশাল দেহধারী গন্ডার তার নাকের উপর অবস্থিত শিং সহ দুবার উপর নীচে সঞ্চালন করে গোঁ গোঁ শব্দে হাতিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি জঙ্গলের সবার চেয়ে প্রকান্ড জন্তু, বনের অন্যদের সাথে তোমার তেমন সংশ্রব নেই। কে কী রকম স্বপ্ন দেখে তুমি জানবে কিভাবে?

শুধু বাঘ নয় আর অন্য কেউ এর চেয়েও অদ্ভুত লোমহর্ষক স্বপ্ন দেখতে পারে। কারণ এটি স্বর্গীয় ব্যাপার। এবার সে পশু রাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মহারাজ, বাঘ যা স্বপ্ন দেখেছে তা আমি বিশ্বাস করি। এবার আপনার রায় ঘোষণা করুন।”

গন্ডারের কথায় সিংহ আহ্লাদিত হয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে রায় ঘোষণা করল। বাঘ তার স্বপ্নের বিবরণ মত শূকরকে ভক্ষণ করবে আমি অনুমতি দিলাম। চারদিকে গুঞ্জন হল।

বাঘ মুখ ব্যাদান করে হাসতে হাসতে শূকরকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হচ্ছে এমন সময় হাতি বাঘের সামনে গিয়ে তার গতিরোধ করে সিংহকে লক্ষ্য করে বলল, মহারাজ বাঘকে ক্ষান্ত দিয়ে শূকরকে কিছুদিনের অবকাশ দিন। শূকর মৃত্যু ভয়ে কাঁপতে থাকে।

হাতির কথায় একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে পশুরাজকে কাতর হয়ে নিবেদন করল; মহারাজ! আপনি ধর্মাবতার, আমাকে একমাস অবকাশ দিন, আমি আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে হাজির করব। সিংহ তার নিবেদন শুনে হাতির কথা মনে করল।

হাতি প্রথম থেকেই স্বপ্নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। শূকরের অবকাশ অনুযায়ী তাকে অবকাশ দিল। তবে মাত্র পনের দিন, এক মাস নয়। বাঘ বিস্মিত হয়ে সিংহের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সিংহ আবার গর্জন করে শূকরকে বলল, পনের দিনের শেষ দিন তোমার উকিল হাজির করবে, না পারলে আর কোন ক্ষমা নেই। তারপর দিনই বাঘ তোমাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে। অন্যান্য পশু-পাখিদের সে দিন যথা সময়ে হাজির থাকার আদেশ দিয়ে বিচার সভা ভেঙ্গে দিল পশুরাজ।

তৃণভোজী এবং সমগোত্রীয় পশু এবং পাখিদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার পক্ষে ওকালতি করার জন্য শূকর কোন পশু কিংবা পাখি পেল না। সে উকিলের সন্ধানে অনিশ্চতার পথে পা বাড়াল।

কোন দিকে চলছে নিজেরও খেয়াল নেই, দিন-রাত শুধু চলছেই। দু’চোখ ভরে তার পানি। কিছুই দেখতে পায় না। তবু হাঁটতে থাকে যদি ভাগ্যক্রমে কোন শুভাকাঙ্ক্ষী পায়। সাত দিন একটানা হাঁটার পর একরাতে ভোর হয় এ অবস্থায় ক্লান্ত শূকরটি একটি মাঝারি গাছের কান্ডে ঢুঁ মারল।

গাছটি লিকলিকে হলেও মাথায় ঘন ঝোপ। ঝোপসহ গাছটি কেঁপে উঠল। শূকর মাথায় মারাত্মক যন্ত্রণা পেয়ে থেমে গেল। গাছের ঝোপে ঝিমুচ্ছিল পেঁচা।

সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত করার পর ভোররাতে একটু ঘুমুতে চেষ্টা করছিল আরাম-আয়েশ করে। ঝাঁকুনি খেয়েই আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। আপন মনে নিচে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, কে গাছকে এমন নাড়া দিল?

শূকরকে দেখতে পেল সে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এমনিতেই রেগে গিয়েছে পেঁচা, আর শূকরের মত একটি জড় বুদ্ধি সম্পন্ন আবর্জনা প্রিয় জন্তু দেখে তার রাগ শতগুণ বেড়ে গেল। ঝোপ থেকে নীচে নেমে শূকরের মাথায় কয়েক লাথি মেরে আশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আরম্ভ করে দিল।

বেঁটা অন্ধ, বেকুব, গন্ড, মূর্খ সামনে কোথায় কি আছে দেখতে পাচ্ছিসনা। শূকর তার বিপদের কথা বলে বিলাপ করতে আরম্ভ করল। পেঁচার চোখের পাতা নেই বলে সূর্যালোতে সে বের হতে পারে না, অগত্যা ঝোপের আড়ালে বসে কিংবা ঘুমিয়ে সূর্যালোকিত দিনের বেলাটা কাটিয়ে দেয়। সারারাত আহারের সন্ধান করে।

এজন্য অন্যান্য পাখিরা এদিক ওদিক উড়তে দেখে পেঁচা দিনের বেলায় ঝোপের মধ্যে থাকে বলে সে নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে। শূকরের অবস্থা দেখে এবং তার বিলাপ শুনে বুঝতে পারল শূকর মহাবিপদে নিপাতিত হয়েছে।

সিংহ ও বাঘ চক্রান্ত করে শূকরকে ভক্ষণ করার মতলব করেছে। পেঁচা তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বুঝে নিল। একবার বনের মধ্যে পাখিদের মাঝে কী একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সংগীতের কিংবা সে ধরণের এক প্রতিযোগিতা।

ঐ প্রতিযোগিতায় পেঁচাই বিজয়ী হয়ে পুরস্কার পেত, কিন্তু সারারাত ডাকাডাকি করে সবার চাইতে অধিক যোগ্যতা দেখালেও ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে বনের রাজা সিংহের সামনে হাজির হতে পারে নি।

পেঁচার ডাকাডাকিতে কাঠঠোকরার ঘুম ভাঙ্গলে ভোর রাতে সিংহের দরবারে গিয়ে কিচির-মিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে। ফলে আর কাউকে না দেখে সিংহ কাঠঠোকরাকে সোনার মুকুট দিয়ে পুরস্কৃত করে।

সে সময় থেকে কাঠঠোকরার মাথায় সোনার মুকুট শোভা পাচ্ছে। এ কারণে পেঁচা পশুরাজ সিংহের প্রতি খুবই ক্ষুব্দ। সে সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত রাখে আর কাঠঠোকরা ভোররাতে কয়েকবার কিচিরমিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে সিংহের সামনে হাজির হতেই সিংহ তাকে সোনার মুকুট মাথায় পরিয়ে দিল।

এ সম্পর্কে বনের অন্য পশু-পাখিরা নির্বুদ্ধিতার জন্য কটাক্ষ করে থাকে। এজন্য পেঁচার দুঃখের অন্ত নেই। বাঘের স্বপ্ন দর্শন অনুসারে সিংহের প্রদত্ত নির্দেশ শুনে শূকরের প্রতি তার সহানুভুতি জাগল।

তাকে সমবেদনা জানাল এবং সিংহকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যভাবে বলল, বাঘের স্বপ্নকে স্বর্গীয় ব্যাপার বলে তদনুযায়ী বাঘ শূকরকে ভক্ষণ করবে, সিংহের কী রকম বিচার এটা! আচ্ছা দেখা যাবে তারপর শূকরকে বলল, বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে তোমার ঘাড় মটকাবে!

বাহঃ কী সুন্দর যুক্তি সিংহের। আর বাঘের স্বপ্ন কত স্বর্গীয়। স্বপ্ন স্বর্গীয় বটে, আমিও কত স্বপ্ন দেখি, সে সবই স্বর্গীয়। একটু আগেও আমি রাজ সিংহাসনে বসে এ বনে রাজত্ব করতে স্বপ্ন দেখলাম।

শূকরকে অভয় দিয়ে পেঁচা বলল, সে শূকরের পক্ষে ওকালতী করবে সিংহের নির্ধারিত দিবসে সে দরবারে হাজির হয়ে যথাযতভাবে তার পক্ষে ওকালতী করবে। এ বলে পেঁচা সেখান থেকে উড়াল দিয়ে গভীর বনে ঢুকে গেল।

পেঁচার কথা গুলো বাগাড়ম্বর মাত্র মনে করল শূকর। পেঁচা কি তাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে? তার আশংকা দূর হলনা। জীবনের আশা একদম ছেড়েই দিল শূকর।

তবে বিচারের নির্ধারিত দিনে রাজদরবারে হাজির হবে এবং তার পক্ষে ওকালতী করবে বলে পেঁচা যে বলে গেল, একথাকে সিংহকে জানালে ভাল হয় মনে করে শূকর সেদিনই সিংহকে তার উকিল পেঁচার কথা জানিয়ে আসল।

ইতিমধ্যে বাঘের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। বাঘটির উদ্দেশ্য কত জঘন্য তা ভাবতে ভাবতেই শূকর বুঝতে পারল সবলের সঙ্গে দুর্বলের বন্ধুত্ব কত ভঙ্গুর।

পশুরাজ সিংহ যে দিনটি বিচারের জন্য নির্ধারণ করেছিল সে দিনই ঠিক বিচার সভা বসল। বনের পশু-পাখি একে একে হাজির হচ্ছে। হরিণ, খরগোশ, সজারু, বানর প্রভৃতি তৃণভোজী পশুর দল শূকরের চারপাশ ঘিরে বসেছে।

তারাও যেন শূকরকে সমবেদনা জানাচ্ছে। এছাড়া তাদের কিছু করার নেই। শিয়াল, বন্য কুকুর, নেকড়ে বাঘের সামনে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তারা ঘন ঘন বাঘ আর সিংহের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। বুনো মহিষ, সম্বর, হরিণ, গয়াল, গন্ডার, হাতি সবাই পরস্পর সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ দরবারের পাশে ঘন ঝোপের বন ছিল।

পশুরাজ তার রাজকীয় আসনে এতক্ষণে এসে বসেছে। প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে শূকরের আগমন জানতে চাইল।

তখন শূকর ভীষণ ভাবে কাঁপতে কাঁপতে এক লাফ দিয়ে বেদনার্ত কন্ঠে জবাব দিল, আমি হাজির, ধর্মাবতার। সিংহ জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোর উকিল? দুবার, তিনবার জিজ্ঞেস করলেও শূকর কোন জবাব দিতে পারল না।

তার উকিল পেঁচার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। সিংহ গর্জন করে উঠল এবং শূকরকে লক্ষ্য করে বলল, তুই ছেলে খেলা পেয়েছিস, তোর উকিল হাজির করবে বলে অনর্থক সময় নষ্ট করেছিস, আমাকেও অপমান করলি। তারপর বাঘকে সিংহ বলল বাঘ তুমি তৈরি হও।

সভায় পশুদের গুঞ্জন উঠল। বাঘ শরীর একঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শূকরের মৃত্য সে যেকোন সময় ঘটাতে পারে। কেবল পশুরাজের হুকুমের জন্য অপেক্ষা। পশুরাজ তাকে তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছে।

হত্যা কর বললেই সে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবে না, প্রয়োজনও নেই। এক লাফেই সে শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে দেবে। সিংহ এবার তার শেষ নির্দেশ দেবার জন্য গলা পরিষ্কার করে নিল।

ঠিক তখনিই সিংহের মাথার উপ্রে অবস্থিত ঝোপের আড়াল হতে বের হয়ে পেঁচা পশু সভার মধ্যে মহা উল্লাসে নাচতে লাগল। নাচছে তো নাচছেই, নাচতে নাচতে এক পর্যায়ে উড়ে বাঘের মাথায় লাথি মারে, আবার শুন্য উঠে।

আবার নীচে নেমে সিংহের সামনে উল্লাসে নাচতে থাকে। শূকর খেয়াল করল তারই উকিল পেঁচা। কিন্তু এরকম করছে কেন তার উকিল? রাজ সভায় ওকালতী করতে এসে একি বেয়াদবি। এতে আরও বিপদ বেড়ে গেল, নয় কি? রাজা ভীষণ রেগে যাচ্ছে।

এখনি হুকুম করে সব শেষ করে দেবে। শিয়াল বাহাদুরী দেখাবার জন্য এক থাবা দিয়ে সিংহের সামনে নৃত্যরত পেঁচাকে ধরে ফেলল। পেঁচা তখন আর্তনাদ করে উঠল; আ-হা-হা, করলে কি! করলে কি!

রাজ সিংহাসনে বসতে না বসতেই তুমি আমাকে ধরে ফেললে! তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে! তারপর পেঁচা সিংহকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহারাজ আপনি ধর্মাবতার! আপনি বিচার করুন। আমার স্বর্গীয় স্বপ্ন শিয়াল ভেঙ্গে দিল।

সিংহ উম্মত হয়ে গর্জন করে উঠল। বেটা তোর আবার কি স্বপ্ন? যত সব আজগুবি ব্যাপার। তখন পেঁচা শিয়ালের হাত থেকে এক সুযোগে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে উঠে বসল। তারপর বলল, বনের পশু-পাখি ভাই বোনেরা, আপনারা কেউ কি স্বপ্ন দেখেন না?

কোন দিন কেউ স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখেছেন। শুধু এ বাঘই স্বপ্ন দেখে কি? স্বপ্ন দেখার কি তারি একচেটিয়া অধিকার? তখন গন্ডার তার মুখ উঁচু করে গোঁ গোঁ করে বলল, স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে এবং সবাই স্বপ্ন দেখে, কেন না স্বপ্ন হচ্ছে স্বর্গীয় ব্যাপার।

সিংহ একটু নরম হল। পেঁচাকে বলল, তোর স্বপ্নটা আবার কী? পেঁচা বলল, স্বপ্নটা বর্ণনা করতে আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ। আপনি যদি অভয় দেন আমি বলব। সিংহের মুখে একটু বিদ্রুপ ভ্রূকুটি দেখা গেল।

তাচ্ছিল্য ভরে বলল, দেখি, বল দেখি, তোর কেমন স্বর্গীয় স্বপ্ন! যার দর্শনে তুই উম্মাদ হয়ে গিয়েছিস! এবার পেঁচা খুব বিনয় সহকারে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল; মহারাজ ধর্মাবতার!

আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনি আপনার মেয়েকে মহা ধুমধামের সহিত আমার সাথে বিয়ে দিয়ে সুসজ্জিত রাজ সিংহাসন দান করছেন তারা সবারই আপনার আস্তানায় বিপুল খাদ্য ভোজ্য উদর পূর্তি করছে। আহা! কত আনন্দ! কী স্বর্গীয় আনন্দ মহারাজ!

সিংহের রাগ শতগুণ, সহস্রগুণ বেড়ে গেল। উম্মত আক্রোশে আসন ছেড়ে উঠে হুংকার ছাড়ল; বেটা কোন সাহসে তুই একথা উচ্চারণ করলি? তুই বেটা স্বপ্ন দেখলি কেন?

আহাম্মক কোথাকার! তখন হাতি তার দুইকান ও লেজ নেড়ে শুঁড় উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে বলল, কি অদ্ভুত স্বপ্নরে বাবা! বড় অদ্ভুত স্বপ্ন! বাঘের স্বপ্নের কথা আমি বিশ্বাস করতাম না। এবার কিন্তু বিশ্বাস করলাম।

পেঁচাকে আমাদের সবার সামনে রাজ সভায় উল্লাসে নৃত্য করতে দেখলাম। রাজার সামনে এরূপ নৃত্য করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু পেঁচা যে স্বপ্ন দেখেছে এটি স্বর্গীয় ব্যাপারই বটে, তা সত্য, অতি সত্য। গন্ডার গোঁ গোঁ করে বলল, আমিও বলেছিলাম শুধু বাঘ নয়, আরো অনেকেই নানা রঙের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং দেখেও থাকে।

তৃণভোজী প্রাণীরা এবার উল্লাসিত হয়ে উঠল। তারা বলল, রাজকন্যার সঙ্গে পেঁচার বিয়ে হতে হবে, এখনই বিয়ে হোক। পেঁচাকে সিংহাসন প্রদান করে বনের পশু-পাখিগণকে বিয়ের খানা ভুরি ভোজ দেয়া হোক। আমরা উদর পূর্তি করে খাব।

সিংহ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইল। বাঘ অম্লান মুখে সিংহের দিকে আর মাঝে মাঝে শুকরের দিকে তাকায়।

পেঁচা আবার খুব নম্র এবং বিনয়ের সাথে সিংহকে বলল, মহারাজ ধর্মাবতার, আপনি বনের অধিবাসী পশু-পাখিদের রাজা, সর্বময় কর্তা বাঘের স্বপ্নের শর্তপূরণ করার জন্য বাঘকে যদি শূকরকে মারতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি সে স্বপ্নের শর্ত অনুযায়ী রাজ কন্যা বিয়ে করতে এবং সিংহাসন লাভ করার জন্য আমাকেও নির্দেশ দেন।

পশুরাজ সিংহ নিজের ফাঁদে নিজে জড়িয়ে পড়ছে দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। উপস্থিত বনের পশু-পাখিরা কলরব করে উঠল।

বাঘ তখন ম্লান মুখে পশুরাজ সিংহের প্রতি চেয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর পশুরাজ সিংহ স্বপ্ন দর্শন অনুসারে শূকরকে ভক্ষণ করার বাঘকে যে অধিকার দিয়েছিল তা নাকচ করে দিল।

অধিকন্তু, শূকরটির কোন বিপদ হলে তাতে বাঘকেই দায়ী করা হবে। এই ফরমান জারি করে পশুরাজ নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস পেল।


তথ্যসূত্র : তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : তেন্দেরার পচ্ছন

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা

জালিম্বর একজন আঙু। “আঙু” হল সমাজপতি বা দলপতি। পরবর্তীতে কোন তালুকের অধিকারীকে আঙু বলা হয়।

জালিম্বর একদল লোক নিয়ে রোয়াঙ্গ (আরাকান) থেকে যখন আনকে (চট্টগ্রাম অঞ্চলকে রোয়াঙ্গারা আনক অর্থাৎ পশ্চিম দেশ বলে) আসে তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোগলদের প্রভাব ছিল।

তাই দলবল নিয়ে সে নাক্ষ্যংছড়ি ও রামু হয়ে উত্তর দিকে সরে ক্রমে ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে কোন সরকারী বনাঞ্চল ছিল না, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল মুক্ত বনাঞ্চল। জালিম্বর আঙুর দলবল তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের এক সুবিধাজনক স্থানে গ্রাম পত্তন করে জালিম্বর আঙু তাঁর দলবল নিয়ে বাস করতে থাকে। তাঁর দলের লোকেরা জালিম্বরকে আঙু বলে মেনে নেয়।

সে জালিম্বর-আঙু নামে পরিচিত হয়। বিয়ের সাত বছর পর তাঁর একমাত্র পুত্রের জন্ম হয়। জালিম্বর এবং তাঁর স্ত্রী বাদীমুই ছেলেটিকে কিভাবে আদর করবে তা নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হত।

তাঁরা অতি আদরের ছেলেটির নাম রাখল চিজিগুলা। কিন্তু পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ আদর করে কিংবা বিদ্রুপ করে ডাকে গুলা। চিজি বাদ দিয়ে শুধু গুলা। তাঁরা অতি আদর যত্ন নিয়ে ছেলেটিকে বড় করতে লাগল।

কিশোর বয়সে চিজিগুলার জন্য বৌ আনতে শখ জাগল জালিম্বর আঙুর। পাড়ার সবচাইতে সুন্দরী ফুলরেণুকে চিজিগুলার জন্য বৌ ঠিক করা হল।

ফুলরেণু বয়সে গুলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং পূর্ণ যুবতী না হলেও তার বিয়ের সাধ হয়েছে। বাগল্যার সঙ্গে তার আইপাই (মন দেয়া নেয়া) এবং ঘনিষ্টতার কথা কারোর অজানা ছিল না।

ফুলরেণু এ বিয়েতে কোন মতেই রাজি নয়। তার অভিযোগ হচ্ছে গুলা তার চেয়ে বয়সে ছোট, এখনো কিশোর এবং গুলা ভাল করে কথা বলতে পারে না, তার জিহ্বায় আড়ষ্টতার দোষ আছে।

ফুলরেণুর বাবা মা আঙুর একমাত্র সন্তান বিবেচনা করে গুলার সঙ্গে মেয়ে ফুলরেণুর বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে। বিয়ে যে দিন হবে, তার আগের রাতে ফুলরেণু বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে যায়।

সকাল হতে না হতেই ঐ খবরটি জালিম্বর জানতে পারে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একজন বিশ্বাসী লোক পাঠিয়ে দিল ভিনগ্রামের তাঁর মামাত ভাই নাগর্য্যার কাছে।

লোকটি গিয়ে নাগর্য্যাকে বলল, জালিম্বর তাঁর ছেলে চিজিগুলোকে বর সাজিয়ে নিয়ে আসছে, সে যেন তার মেয়ে মুগুলিকে কনে সাজিয়ে রাখে।

চিজিগুলা আর মুগুলির আজই বিয়ে হবে। সব ব্যবস্থা যেন নাগর্য্যা করে রাখে। নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী খবরটি পেয়ে বিস্মিত হলেও বরঞ্চ খুশি হল।

তার মেয়ে মুগুলির বয়স চিজিগুলার চেয়ে দু বছরের বড়। এমনিতে আত্মীয় আর জালিম্বর হচ্ছে আঙু বা দলপতি, কাজেই নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী জালিম্বরের কথায় বেরাজী হল না।

মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল নাগর্য্যা মহা ধুমধাম সহকারে না হলেও সে দিন ঠিক ঠিক চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ে হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভুরি ভোজন করে চিজিগুলা আর মুগুলিকে আশীবাদ করল।

জালিম্বর আঙু জুম চাষ করলেও তার কিছু ধান্যজমি আছে। গরু, ছাগল, মহিষ, শূকর, হাঁস-মুরগি গৃহপালিত পশু-পাখি তাঁর অঢেল আছে। তাঁর পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। একেবারে ধনী বলা না গেলেও দরিদ্র নয় জালিম্বর আঙু।

মুগুলির সঙ্গে বিয়ে হলেও চিজিগুলা ফুলরেণুকে ভুলতে পারেনি। তার কথা মাঝে মাঝে মুগুলিকে শোনায়।

উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটি হয়। চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ের তিন বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী মারা যায়।

এর চার বছর পর জালিম্বরও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চিজিগুলা আর মুগুলির জোড়া তালি দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা তাদের শেষাংশ উচ্চারণ করে ডাকে। যেমন – চিজিগুলাকে শুধু গুলি।

উভয়ের কথা বলতেই শুধু গুলাগুলি উচ্চারণ করে হাসে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। গুলাগুলির সংসারে বিয়ের দীর্ঘ ছয় বৎসরেও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি।

জালিম্বর আঙু স্বপ্নে দর্শন দিয়ে গুলাকে বলে, চিজিগুলা তোমরা বড় একা হয়ে গেছ, আমি আসছি। আমি তোমার ঘরে আসছি।

কিছুদিনের মধ্যে গুলা বুঝতে পারল গুলি গর্ভধারণ করেছে। সে তার স্বপ্নের কথা গুলিকে বলে ফেলল। তাদের বিশ্বাসমতে গুলার পিতা জালিম্বর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে।

এতে তারা খুশি হল। ঠিক দশ মাস দশদিন পর মুগুলি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাদের আনন্দ এখন দেখে কে!

সন্তানটি বড় হতে থাকে। যখন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, পাড়া মাতিয়ে রাখে ছেলেটি। তার বাবা-মাকে সে বাবা-মা ডাকে না।

বাবাকে ডাকে গুলা আর মাকে ডাকে গুলি। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে ছেলেটা। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচরণে চাতুর্য প্রকাশ পেতে থাকে।

পাড়ার লোকেরা তাকে তেন্দেরা নামে ডাকতে থাকল। একদিন গুলা এবং গুলিও ছেলেটিকে তেন্দেরা নামেই ডাকতে থাকে।

একদিন গুলা জঙ্গল থেকে একটি কচ্ছপ ধরে নিয়ে এল ঘরে। ডিমওয়ালা কচ্ছপ। কচ্ছপ কেটে রান্না করা হলে তেন্দেরা বলল যে, সে ডিমগুলোই খাবে, ডিম বাদে কিছুই খাবে না।

গুলা এবং গুলিও এতে খুশি। একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে খাবে কে? কিন্তু কচ্ছপের সেই হলদে রঙ্গের ডিমগুলো খাওয়া শেষ করে তার বাবা-মাকে বলতে লাগল, ইস!

তোমরা কী খাচ্ছ? আমাকে একটুও দিলে না। আমিও কচ্ছপের মাংস খাব। কচ্ছপের মাংস পেট ভরে খেল ডিমগুলো খাওয়ার পর।

খেয়ে বলতে লাগল, ইস এটা ডিমের চেয়ে সুস্বাদু। সে মুরগি বা মোরগের গিলা, কলিজা খায় না, শুধু খায় মাথা, ঠ্যাং ইত্যাদি। গুলাগুলি এই ডানপিটে ছেলে তেন্দেরার কান্ডে অবাক হয়ে থাকে।

বয়স বার, তের হতে না হতেই তেন্দেরার দেহে, মনে যৌবন এসে গেল। সে পাড়ার তরুণীদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়।

পাড়ার ছেলেরা তাকে চোখে চোখে রাখে, সাবধান করে। গুলাগুলি ছেলের এই আচরণ দেখে মর্মাহত হয় এবং তার জন্য বৌ আনার সিন্ধান্ত নেয়।

পাড়ায় অনেক তরুণী তাকে পছন্দ করলেও তেন্দেরা বিয়েতে রাজি হয়নি। তাই একদিন তারা তেন্দেরাকে ঘর থেকে নামিয়ে দেয়। তাকে বলে দেয় যে, সঙ্গে বৌ না নিয়ে আসলে ঘরে উঠতে পারবে না।

তেন্দেরা কোন কথা না বলে বেড়িয়ে পড়ল শূণ্য হাতে। পকেটে টাকা পয়সা নেই। কোন যুবতীর মন পেতে হলে নূন্যতম পক্ষে সুগন্ধি তৈল, আয়না, চিরুনি দিতে হয় একথা তেন্দেরার জানা আছে কিন্তু সে এগুলো পাবে কোথায়?

টাকা পয়সা থাকলে বাজার থেকে সে কিনে নিতে পারত। কিভাবে টাকা পাওয়া যায় একথা ভাবতে ভাবতে তেন্দেরা এক স্থানে গিয়ে দেখে একজন চাষী হাল চাষ করছে।

এক জোড়া মহিষের হাল। সে মিষ্টি কথা বলে চাষীর সঙ্গে সখ্যতা করে বলল, দাদা তুমি বিশ্রাম কর, আমি তোমার বদলে হাল চালাই। লোকটি তাতে রাজি হল এবং তেন্দেরা হাল চষতে লাগল।

বেশ খানিকক্ষণ চষার পর তেন্দেরা লোকটিকে বলল, দাদা মশা-মাছি মহিষ দুটোর গায়ে বসে বড় উৎপাত করে। এতে মহিষগুলো বিরক্ত হয়, লাঙ্গল টানতে চায় না।

বরঞ্চ মহিষ দুটোর গায়ে কাদা লেপে দিলে মশা-মাছি গায়ে বসে উৎপাত করবে না। মহিষ দুটো আরাম করে হাঁটবে, লাঙ্গল টানবে। দাদা, আমি তাই করি,  কী বল?

লোকটি আপত্তি করল না। তেন্দেরা মহিষ দুটোর গায়ে ভালভাবে কাদা লেপে দিল। সূর্যের তাপে কাদা শুকালে মহিষ দুটোর কালো রং সাদা হয়ে গেল এবং দুটো সম্পূর্ণ নতুন মহিষ বলে মনে হতে লাগল।

তেন্দেরা একটু পর লোকটিকে বলল, দাদা আমার পানির তৃঞ্চা পেয়েছে, তোমার ঘরে গেলে কি পানি খেতে পারব? লোকটি বলল, “সে কি কথা? পানি কেন পাবে না?

যাও ঐ যে টিলার ওপর ঘর, ওখানে গিয়ে স্ত্রীকে বললে পানি দেবে। তেন্দেরা সন্দেহের ভান করে বলল, দাদা যদি পানি না দেয়, তখন আমি তোমাকে বলব, দিচ্ছে না তাহলে তুমি তাকে দাও, দাও বলবে তো?” লোকটি স্বাচ্ছন্দে রাজি হল।

তেন্দেরা ধীর পায়ে টিলার ওপর লোকটির ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিনয় সহকারে কুশল জিজ্ঞেস করে, খুশি করল।

তারপর বলল, বৌদি দেখ, দাদা মানে তোমার স্বামী একটু আগে আমার কাছ থেকে এক জোড়া হালের মহিষ কিনেছে ঐ দেখ সাদা মহিষগুলি।

তোমার নিকট থেকে মহিষ দুটোর দাম দু’শো টাকা নেবার জন্য দাদা পাঠিয়েছে, তুমি আমাকে দু’শো টাকা দাও। তখন স্ত্রী লোকটি উত্তরে বলল, কি যাতা বলছ, আন্দাজে কেন টাকা দেব?

তেন্দেরা বলল, তাহলে আমি তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছি, দেখ সে কি বলে। তেন্দেরা ডাক দিয়ে লোকটিকে বলল, দাদা কথামত তোমার স্ত্রী দিচ্ছে না। এই কথা শুনে লোকটি রাগত স্বরে জোরে জোরে বলল, আরে দাও, দাও।

অগত্যা স্ত্রী লোকটি বাক্স থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দুশো টাকা দিয়ে দিল। তেন্দেরা টাকা পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে চম্পট দিল দূরে অনেক দূরে।

হাঁটতে হাঁটতে সাত গাঙ সাত পাড়া পার হয়ে এক বাজার থেকে সুগন্ধি তেলের বোতল, আয়না, চিরুনি এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী কিনে থলে ভর্তি করে নিল।

একদিন সাঁঝের বেলা শামুকছড়ি পাড়ে এক পাড়ায় এসে পৌঁছাল তেন্দেরা। পাড়ার এক প্রৌঢ়া ও একজন তরুণী। মা ও মেয়ে। মা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি আনতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি সাঁঝের বেলায় একা পানি আনার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে।

তেন্দেরা তরুণীকে দেখে পছন্দ করল। প্রৌঢ়া মহিলাকে মাসী সম্বোধন করে কুশল জিজ্ঞাসা করল। প্রৌঢ়া মহিলা বিস্মিত হয়ে তেন্দেরাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো! আমাকে কেন মাসী ডাকছ, আমার তো এ জম্মে কোন বোন নেই।

তুমি কোথেকে এলে? তেন্দেরা বিনীতভাবে বলল, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই দেখছি। আমার মায়ের চেহারা ঠিক তোমার মত। যা হোক আমি তোমাকে মাসি বলে ডাকব।

মাসী আমাকে কলসিটা দাও, আমি পানি এনে দিচ্ছি। মা ও মেয়ে উভয়ে খুশি হল। তরুণীটি কলসিটি তেন্দেরার হাতে দেওয়ার সময় তেন্দেরা তার থলেটি তরুণীর হাতে দিয়ে বলল, বোন এই থলেতে যা আছে সব তোমার জন্য এনেছি, তুমি রেখে দাও।

তেন্দেরা কলসিটি ভরে পানি নিয়ে উঠানে পৌঁছার আগে থেকে প্রৌঢ়া বকবক করছিল। তেন্দেরার কানে গেল প্রৌঢ়ার কথা গুলো, কোথা থেকে কে আসল এই সাঁঝের বেলা।

তাকে রাত্রে থাকতে দেব কিভাবে? তেন্দেরা মনে মনে ভাবল তাহলে তাকে কি এখানে থাকতে দেবে না? সে ফন্দি আঁটতে লাগল কিভাবে এই ঘরে থাকা যায়?

পানির কলসি ঘরে তুলে দিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, মাসীমা কী কী কাজ আমাকে দাও আমি করে ফেলি। আমাকে অন্য ঘর খুঁজতে হবে থাকার জন্য। মহিলা বুঝল তেন্দেরার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, অথচ কাজ করে দিতে বলছে।

তখন তেন্দেরাকে জিজ্ঞস করল, তুমি কোথা থেকে আসছ? কে তুমি? তেন্দেরা জবাব দিল সে আঙু জালিম্বরের নাতি। তখন মাহিলার মনে আগের কথা স্মরণ হল, ভাবতে লাগল সে।

জালিম্বর আঙু তার ছেলে চিজিগুলার জন্য তাকে বৌ ঠিক করেছিল। কিন্তু যে দিন বিয়ে হবে তার আগের রাতে বাগল্যার সঙ্গে সে পালিয়ে গিয়েছিল।

ছয়/ সাত বছর সুখে ঘর করে একমাত্র কন্যা কুকলিকমালা জম্ম গ্রহণ করে এবং তার জম্মের এক বছর পর বাগল্যা মারা যায়।

প্রৌঢ়া ফুলরেণু তেন্দেরার বাপের নাম জিজ্ঞেস করতেই তেন্দেরা জবাব দিল, তার বাপের নাম গুলা। এবার ফুলরেণু বলল, তুমি চিজিগুলার ছেলে তাহলে?

তেন্দেরা হ্যাঁ বলল, এই সাঁঝের বেলা আর কোথায় যাবে, এখানেই থাক। এর আগে কোনদিন কোন ছেলে বা পুরুষকে আমাদের ঘরে থাকতে দেইনি, আমার মেয়ে কুকলিকমালা।

মেয়ে কুকলিকমালাকে তেন্দেরাসহ তিনজনের ভাত রাঁধতে বলল ফুলরেণু। কুকলিকমালা ইতোমধ্যে তেন্দেরার দেওয়া থলে থেকে সুগন্ধি তেল মাথায় দিয়ে আয়না দেখে চুল আঁচড়িয়ে মনের মত সেজেছে।

সে কোন কথা না বলে ভাত রাঁধতে শুরু করে। তেন্দেরার আগমনে সে খুশি হয়েছে!

একদিন দুদিন থেকেও তেন্দেরা ঘর থেকে চলে যাওয়ার নাম করল না। মা আর মেয়েও উচ্চবাচ্য করেনি।

তেন্দেরা ফন্দি আঁটে কিভাবে কুকলিকমালাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবে। ফুলরেণু মাঝে মাঝে ভাবে, চিজিগুলা ভালভাবে কথা বলতে পারে না।

জিব্বায় যেমন জড়তা আছে তেমনি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তার ছেলে তেন্দেরার বুদ্ধিইবা কত হবে, আর এই তেন্দেরা তার মেয়ে কুকলিকমালার জামাই হবে কিভাবে?

ফুলরেণু একদিন রাত্রে তেন্দেরাকে বলল, তুমি দেখছি এখানে থেকে চলে যাবার নামও করছ না, এভাবে থাকলে লোকে বদনাম করবে।

তুমি আমার জন্য তিনটা জিনিস নিয়ে আস, যদি নিয়ে আসতে পার তবে এখানে থাকতে পারবে এবং আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করলে তার সাথে বিয়ে দেব।

আর যদি তিন দিনের মধ্যে এ জিনিস গুলি আনতে না পার তবে এখান থেকে চলে যাবে বুঝলে? সেই তিনটি জিনিস হল – (১) বোঁটাহীন ফল, (২) যে ফলের বিচি বাইরে এবং (৩) যে জিনিস এক বাটি খেলেও সেই বাটি পূর্ণ থাকে সেই জিনিসে।

এই তিন দ্রব্যের নাম শুনে তেন্দেরা বোকা বনে গেল। আসলে সে ঐগুলি চিনে না। সে হতাশ হয়ে গেল।

তেন্দেরা ম্লান মুখে কুকলিকমালাকে বলল যে, সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। কুকলিকমালা তেন্দেরাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই তেন্দেরাকে এই তিনটি দ্রব্য কী কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তার সন্ধান দিল।

সে বলল, তুমি চিন্তা কর কেন? এগুলো নিয়ে আস যাও। সে বলল, আমাদের ঘরের পাশে যে ছড়া তার নাম শামুকছড়ি।

এই ছড়ার উজানে যেতে যেতে ডানে একটা ছড়া দেখবে তার নাম তামছড়ি। সেই ছড়ার দু’ধারে অনেক ফল গাছ। ওগুলো তাম গাছ। দেখবে তাম (কাগু বাদাম) ধরে আছে গাছে। ফলগুলোর বাইরে বিচি।

এখান থেকে তাম পেড়ে নিয়ে আসার সময় দেখবে ছড়াতে অনেক শামুক। সেই শামুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। যাও দেরি করোনা।

তেন্দেরা তার কথামত গিয়ে দেখে সত্যই গাছে তাম ফল ঝুলতেছে। সে পাকা তাম ফল এক থলে নিয়ে আসার সময় এক থলে শামুকও কুড়িয়ে নিল ছড়া থেকে।

তখন দুপুর হয়ে গেছে। ঠিক তখন কুকলিকমালার মুরগিটা কক কক কতাক কক কক কতাক করে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো খোপ থেকে নেমে গেল।

তেন্দেরা সেখানে পৌঁছলে কুকলিকমালা তাকে ঐ খোপ থেকে মুরগির পাড়া ডিম নিয়ে আসতে বললে তেন্দেরা ঠিক ডিমটা নিয়ে এল।

এবার কুকলিকমালা তেন্দেরাকে ঐ তিনটা জিনিস সহ তার মার কাছে নিয়ে গেল। ইশারায় ঐসব জিনিস তার মাকে দিতে বলল কুকলিকমালা।

ফুলরেণু তিনটা জিনিস পেয়ে খুশি হল। তখন কুকলিকমালা তেন্দেরাকে বলল ডিম হচ্ছে বোঁটাহীন ফল, তার কোন বোটা নেই। তামের বিচি ফলের বাইরে। ফলের নিচে ঝুলে থাকে।

আর শামুক একবাটি খেলেও (তার সাঁশ খাওয়া যায়) খোলসগুলো পড়ে থাকে কাজেই একবাটি খেলেও এক বাটিই অবশিষ্ট থাকে।

তেন্দেরা কুকলিকমালার কথা মত বুঝিয়ে বলল। ফুলরেণু খুশি হল। কিন্তু তা স্বত্বেও তার মেয়ে কুকলিকমালাকে চিজিগুলার ছেলে তেন্দেরার জন্য বৌ দিতে রাজি নয় ফুলরেণু।

কুকলিকমালা জানে তার মা ফুলরেণু তার বাবা বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কাজেই তার মা যদি পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে পারে, সে কেন তেন্দেরার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না, ভাবে কুকলিকমালা।

এক রাত্রে সত্যি সত্যি তেন্দেরার হাত ধরে পালিয়ে গেল কুকলিকমালা। তেন্দেরা কুকলিকমালাকে নিয়ে সোজা ঘরে ফিরে এল। গুলাগুলি ছেলে আর ছেলের বৌ দেখে মহা খুশি হল।

কিছুদিন পর গুলা তেন্দেরাকে নিয়ে পাড়ালিয়াদের সঙ্গে কাট্টনে গেল। নৌকার কাট্টন। তারা এক মাসের খোরাকি নিয়ে দেড় দিনের হাঁটা পথের গভীর বনে চলে গেল।

ঘরে রইল গুলি আর তেন্দেরার নববধূ কুকলিকমালা। একমাসের প্রায় শেষ, কিন্তু নৌকার কাজ এখনো অনেক বাকি এদিকে খোরাকিও প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

তাই তেন্দেরা বাড়ি ফিরল খোরাকি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল তার মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কুকলিকমালা কী করবে দিশেহারা হয়ে আছে।

তেন্দেরা বৈদ্য এনে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাল। কিন্তু কয়েকদিন পর তার মা গুলি মারা গেল। তেন্দেরা তার বাবা গুলাকে খবর দিতে পারল না – তার মা শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করল।

এদিকে খোরাকি নিয়ে না গেলে তার বাবা উপোসে মরবে, আর খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবার কাছে গেলেও ঘরে কুকলিকমালা একা থাকতে পারবে না।

তাই একদিন সে ফুলরেণুকে তেন্দেরার নিজেদের ঘরে আনতে গেল। তেন্দেরা অবশ্য ভেবে নিয়েছে- ফুলরেণু তাদের ঘরে কোনদিন যাবে না।

তাই ফুলরেণুর কাছে  পৌঁছামাত্র হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমরা বাপবেটা নৌকার কাট্টনে গিয়েছিলাম- সেখানে নৌকার কাজ অর্ধেক করে বাবা গুলা মারা গেছে আর সেদিন মা গুলিও মারা গেল।

এখন নৌকাটার কাজ সম্পন্ন করে নিয়ে আসতে হবে। বিক্রি করলে টাকা পাবে। তাই আমি কাট্টনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে কুকলিকমালা একা থাকবে কিভাবে?

আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তেন্দেরার কথা ফুলরেণু ভেবে দেখল।অমনি সে একা থাকা পছন্দ করেনা – এখন তার মেয়ের সঙ্গে তাদের ওখানে থাকলে খারাপ কিছু নয়, তাই তেন্দেরার কথায় সে সহজেই রাজি হয়ে গেল।

ঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারে তেন্দেরা নিয়ে নিল। ফুলরেণুও তার কাপড় চোপড় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যা পারল সঙ্গে নিয়ে তেন্দেরার ঘরে এসে পৌঁছল।

দুদিন পর তেন্দেরা কিছু দিনের খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবা গুলার কাছে চলে গেল। সে তার মা গুলির মৃত্যুর কথা তার বাবা গুলার কাছে গোপন রাখল।

সে বরঞ্চ বলল যে, তার মা গুলি ভয়ানক অভিমান করে আছে। এত দীর্ঘ সময় যে কোনদিন প্রবাসে কাটায়নি। এবার দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে গুলা।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর প্রতি দিওয়ানা হয়ে আছে।ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আফসোস করল। মনে মনে ভাবল এতদিন প্রবাসে থাকা কী ঠিক হল ?

তেন্দেরা আবার বলল, তুমি ঘরে গেলে মা কামরাতেই পড়ে থাকবে দেখো। গুলা মনে মনে ঠিক করল তাতে কী আছে যায়, ঘরে গিয়ে সোজা কামরার ভিতরে গুলিকে জড়িয়ে ধরলে সব অভিমান ভেঙ্গে যাবে গুলির। তাই সে জড়িয়ে ধরবে। মনে মনে ঠিক করল গুলা।

কয়েকদিন পরিশ্রম করে বাপ-বেটা অসস্পূর্ণ নৌকাটি সম্পূর্ণ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। দেড় দিন নদীর পথে নৌকাটি ভাসিয়ে এনে একদিন সন্ধ্যায় বাজার ঘাটে ভিড়াল তারা।

তেন্দেরা তার পিতাকে বলল, তুমি নৌকাটি বাজারে বিক্রি কর আর আমি আমাদের কুড়াল, দা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ঘরে নিয়ে যাই।

মাকে তুমি এসেছ বলে সংবাদ দিব-তাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। এই কথা বলে সে ঘরে এল আর গুলা নৌকাটি বিক্রির জন্য বাজারে থেকে গেল।

ঘরে এসে তেন্দেরা ফুলরেণুকে বলল, আমরা নৌকাটা নিয়ে এসেছি, আমি একা পারিনা বলে আমার এক মামাও সঙ্গে এসেছে।

তাকে নৌকা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠিয়েছি। সে নৌকা বিক্রি করে রূপার টাকা নিয়ে ঘরে আসবে। সে হয়ত ফিরতে রাত হবে।

তোমার খওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে পার ,আমি আমার মামার জন্য জেগে থাকব।গ্রামে সন্ধ্যা হতে না হতেই লোকজন খাওয়া–দাওয়া করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তেন্দেরার কথামতে তারা সাঁঝের আঁধার হতে না হতে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তেন্দেরা যতদিন কাট্টনে ছিল, ততদিন ফুলরেণু আর তার মেয়ে কুকলিকমালা ঘরের বারান্দাতে ঘুমাত।

আজ তেন্দেরা ঘরে আসাতে কুকলিকমালা আর তেন্দেরা ঘরের পিছনের কক্ষ অজলেঙে ঘুমাবে। তেন্দেরা গুলরেণুকে বলল, আমার মামা এলে খাওয়া দাওয়া, করে এখানে থাকবে। সে বারান্দাতে ঘুমাবে, কাজেই তুমি ভিতরের কামরাতে ঘুমাও।

ফুলরেণু ঘরের ভিতরে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কুকলিকমালা তাদের জন্য অজলেঙে বিছানা প্রস্তুত করে তেন্দেরার কথিত মামার জন্য বারান্দাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুলা বাজারে নৌকাটি বিক্রি করে রাত হলে রূপার টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে এল। গুলার মনে আছে, তেন্দেরা বলেছে গুলি তার প্রতি অভিমান করে আছে।

গুলা ঘরে ফিরে তেন্দেরা আর কুকলিকমালাকে দেখল কিন্তু গুলিকে দেখলনা। গুলি নিশ্চয়ই অভিমান করে ভিতরে শুয়ে আছে মনে করে গুলা সোজা ভিতরে চলে গেল।

তখন সেখানে অন্ধকার। গুলা হাতড়িয়ে ধরতে পেল কে একজন শুয়ে আছে। সে জড়িয়ে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ঘুম থেকে জেগে হতভম্ব হয়ে হাত–পা ছঁড়তে লাগল।

গুলা ততোধিক জোরে চেপে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ভূত ভূত বলে চিৎকার করলে গুলা বলতে লাগল–না–না আমি ভূত নই।  ফুলরেণু ভয়ে গুলাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।

তাদের এই হৈ চৈ কালে তেন্দেরা আর কুকলিকমালা বাতি নিয়ে সেখানে হাজির হল। বাতির আলোতে ফুলরেণু দেখল গুলাকে আর গুলা দেখল ফুলরেণুকে উভয়েই হতভম্ব। লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে গেল।

তাদের এ অবস্থা দেখে তেন্দেরা বলল, তোমরা এভাবে জড়াজড়ি করেছ একথা লোকে জানতে পারবে। কলঙ্কের একশেষ হবে। তার চেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাল।

গুলা আর ফুলরেণু কিছুই বলতে পারল না। তাদের স্মরণ হল – কৈশরেই তো তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন হয় নি এখন শেষ বয়সে হলে ক্ষতি কী?


[পচ্ছন – রূপকথা। চিজি – (তুলনীয়) খোকা, গুলা- ফল/fruit.]

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা- রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী


তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (সা-চি)

তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘সা-চি’ বলা হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্নি পদ্ধতি: স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সামাজিক রীতি ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘সা-চি’ হতে পারেঃ-

ক) স্বামী/স্ত্রী/যে কেউ সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের আওতায় ‘সা-চি’ করা যায়।

গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট/নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন করে ‘সা-চি’ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে (যদিও তা সামাজিক প্রথাসিদ্ধ নয়)।

কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘সাচি’ দাবী করে থাকে: নিম্নোক্ত কারণে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘সা-চি’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ

ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় বা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন যদি তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে অপরজন ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ একজন নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ তাদের সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘সা-ছি’ সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।

ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে।

চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ জঘন্য অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন সাজা ভোগ করে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

ছ) যদি স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বৌদ্ধ পুরোহিত বা সাধুমা (হ্লুদমা) হয়, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহ প্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে। তবে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথমবারের মতো সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।

বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল:

ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

খ) ‘সা-চি’ হবার পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ হিসেবে গণ্য হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক পূনঃ সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য লাসং/ফং গয়ানা, খানা সিয়ানা’ এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।

ঘ) ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।

ঙ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।

চ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ওপর স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘সা-চি’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।

ছ)‘সা-চি’ সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের | দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে কনেপণ সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।

সাচি’ সম্পাদনকালে স্ত্রীর গর্ভবতী অবস্থা :

ক) ‘সা-চি’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের দায় মেনে নিতে হয়।

উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। বিচ্ছেদকালে গর্ভবতী স্ত্রীকে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ হতে ৩ বছর পর্যন্ত ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবকালীন যাবতীয় খরচ স্বামীকে দিতে হয়।

তবে সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে। বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে এবং সন্তান যদি তখন মাতৃদুগ্ধ পান না করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।

খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘সা-চি’ এর তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে ধারণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় এবং বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য। তবে ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে তখন গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়টি ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।

গ) তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের রীতি অনুসারে স্বামী নিজে তার স্ত্রীর সাথে ‘সা-চি’ করলে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বামীর সম্পত্তির অংশ এবং স্বামীর দেয়া জরিমানার অর্থ পায় । ঐ স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ না হলে বিচ্ছেদদাতা স্বামীর নিকট হতে খোরপোষ পায় ।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি: পাহাড় কোলে নক্ষত্ররাজি

লিখেছেনঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাগুনিয়া উপজেলা, কক্সবাজার, টেকনাফ এবং উখিয়া অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি নাম দাইনাক, অনেকে দৈনাক নামেও ডেকে থাকেন। যার অর্থ যোদ্ধা। ইতিহাসের তথ্য মতে- তাঁরা শৌর্য, বীর্যে এবং বীরত্বে জগৎ খ্যাত ছিলেন। আরাকানে স্বাধীন দান্যাওয়াদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকাল ঐ অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন এবং বসবাস করে এসেছেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার তৈনছড়ি নদীর তীরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই তৈনছড়ি থেকে তাঁরা অন্য অঞ্চলে বা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তৈনছড়ি নদীটি তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এখনো ঐতিহাসিক এবং আবেদনের একটি জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে, সাথে ভালোবাসার একটি নামও। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান পঞ্চম এবং শিক্ষার হার দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তাদের আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১.০০ (এক) লাখের কাছাকাছি এবং শিক্ষার হার ৮০% এর উপরে। পরিসংখ্যান তথ্যমতে  ৪৭% তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরাম সিএডিসি ও এর বাইরে ৩.৩% শতাংশ লোক বসবাস করে, অবশিষ্ট ৫০% শতাংশ তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর- ২০১০ খ্রি)

গছা বা গোত্র

তঞ্চঙ্গ্যারা মোট ১২ টি গছা বা দলে বিভক্ত। গছাগুলো হলো- কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসা গছা, অঙ্যা গছা, মুলিমা গছা, রাঙী গছা, ওয়া গছা, তাশী গছা। কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা এই সাতটি গছা বাংলাদেশে বসবাস করে বর্তমানে। বাকিগুলো মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জানা যায়। আবার প্রতিটি গছায় রয়েছে উপগছা বা উপশাখা। যেমন: কারবআ গছার কয়েকটি উপগছা হলো- বউ গোত্তি, বলা গোত্তি, বাঅ-ল গোত্তি, আরয়া গোত্তি, ফারাঙচা গোত্তি ইত্যাদি। এভাবে অন্য গছায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে উপগছা রয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। তাদের মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তঞ্চঙ্গ্যাদের মাতৃভাষার নাম “তঞ্চঙ্গ্যা” ভাষা। জনগোষ্ঠীর নামের সাথে মিল রেখে ভাষার নামটি নির্ধারণ করা হয়।

জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন ১৯০৩ সনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে  তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারাবিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত দেন। তিনি আরো মত দেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক ভাষার (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) সাথে একই অন্তর্ভুক্ত হলেও তিবেতো-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করেছে। অনেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত বাংলা ভাষা বলে মত দেন। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে প্রচুর আরাকান বা মারমা শব্দের উপস্থিতি, প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ব্যবহ্ত বর্ণমালাগুলো বার্মিজ বর্ণমালার সাথে মিল রয়েছে এই মূল উৎপত্তি “মনখমের” দের থেকে। ব্রাহ্মী লিপি থেকে এই বর্ণমালার উৎপত্তি বলে অনেকে মত দেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার নাম দাইনাক বর্ণমালা এবং বর্তমানে ব্যবহ্ত বর্ণমালার নাম ছালাম্যা বর্ণ বা ছালামী পাঠ যার অর্থ গোলাকার। বর্ণমালার সংখ্যা সর্বমোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ ০৫ আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আরো আছে নিজস্ব সংখ্যা বা গননা পদ্ধতি।  

তাদের বর্ণমালার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কথ্য এবং লিখিত রূপ আ-কারান্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত হচ্ছে এর উচ্চারণ এবং কথ্যরীতি ¯স্বর কোমল, নরম এবং কর্কশ নয় শ্রবণে মধুর। শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রকৃতির একটা সরলতা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ গছা বা শাখাভেদে তাদের ভাষা অভিন্ন।

পোশাক ও অলংকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার রয়েছে। গছাভেদে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য রয়েছে। তবে কারবআ গছা রমণীদের রাজকীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় সবাইকে আকর্ষণ করে। রঙে, ঢঙে এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। এই পাঁচ কাপড়গুলো হলো- পিনৈন (নির্মাঙ্গ বস্ত্র), জুম্ময়া সালুম (লম্বা হাঁটা শার্ট), মাদা কাবঙ (পাগড়ি), পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) এবং জুম্ময়া খাদি (ওড়না বিশেষ)। প্রতিটি পোশাকে রয়েছে নিজস্ব এবং ¯স্বতন্ত্র নকশা, ফুল এবং ডিজাইন। এসকল নকশা এবং ফুলগুলো জুম এবং প্রকৃতি থেকে নেওয়া, পাওয়া। আর ছেলেদের পোশাক সাদা ধূতি এবং লম্বাহাটা সাদা শার্ট। অলংকার হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যারা প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব স্টাইল এবং ডিজাইনে অলংকার পড়ে থাকে। এক সময় রৌপ্য অলংকার ব্যবহারে প্রচলন ছিল বেশ। এখন রৌপ্য পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতুর অলংকার ব্যবহার করে তাঁরা। যেমন- কানে রাইজ্জু ও জংগা, কব্জিতে বাঘোর, কুসই খারু, কিয়াইংশিক, বাহুতে তাজ্জুর, গলায় চন্দ্রহার, আলচুরি, জামছড়া, পিসিছড়া ইত্যাদি। তবে আধুনিককালে গলায় স্বর্ণ, রুপোর চেইন, আংটি, নুপুর, নেকলেস পড়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা। পুরুষরাও চেইন, আংটি পড়ে থাকে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জুনু তঞ্চঙ্গ্যা (হিল এক্সপ্রেস)

ঘর-বাড়ি ধরণ এবং বসতঘর

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এই পাহাড় এক সময় প্রচুর বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। চারিদিকে গহীন বন। তখন এই বনে প্রচুর পরিমাণে হিংস্র বন্য পশু-পাখি বসবাস করতো। আদিবাসীরা যেহেতু পাহাড়ে এবং বনের মধ্যে বসবাস করে তাই বন্য হিংস্র পশু-পাখির সাথে এক প্রকার সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। মূলতঃ বন্য পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘরগুলো মাচাং আকারে মাটি থেকে একটু উচুতে তৈরি করতো। মূল ঘরের সাথে একটি ইচরও থাকতো। ইচর মূলতঃ খোলা হাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা। একটি মূলঘরের সাথে কয়েকটি অংশ থাকে। অংশগুলো হলো- সিঙকাবা, পিনা, গুদি, বারান্দা এবং রান্না ঘর। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঘর থাকে তঞ্চঙ্গ্যাদের। ঘরগুলো হলো-জুমঘর (জুম চাষের সময় তৈরি করা হয়। একে প্রভাস্যা ঘরও বলা হয়), ডেইরি ঘর (যেখানে ঘরের নানা জিনিসপত্র যেমনঃ চাষের নানা যন্ত্রপাতি, উপকরণ রাখা হয়), গোয়াল ঘর, ছাগল ঘর, হাসঁ-মুরগী ঘর, দারবআ ঘর (জ্বালানি কাঠ রাখার ঘর)। তবে বর্তমানে তাদের মূল ঘর তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা আর মাচাঙ ঘর তৈরি করে না। কারণ আগের মতো পাহাড়ে আর গভীর বন নেই, সাথে নেই হিংস্র পশুপাখিও। বাঁশ এবং শনের পরিবর্তে এখন ইট, কংক্রিট, টিন, রড, সিমেন্টের ঘর তৈরি করে তাঁরা। বর্তমান বসতগুলো মজবুত এবং দীর্ঘাস্থায়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরগুলো তার ঐতিহ্য এবং নিজস্বটা হারিয়ে  ফেলেছে।

ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান

তঞ্চঙ্গ্যারা মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাদের প্রতিটি পাড়া বা গ্রামে একটি করে  বৌদ্ধ বিহার আছে। ওখানে ভিক্ষু সংঘ আছে। তাদেরকে সকলে মিলে ভরণপোষণ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। এছাড়া আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা বা ফানুস উত্তোলন পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার পর একমাস ব্যাপি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম দান শ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িতেও তাঁরা সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করে।

রাজগুরু শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাথেরো (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা), ষষ্ঠ সংগীতিকারক রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা), ত্রিপিটক বিশারদ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, আর্যানন্দ মহাস্থবির, শ্রীমৎ অজিতা মহাথেরো (ধ্যান ভান্তে), ধর্মানন্দ মহাস্থবির, সুমেধানন্দ মহাস্থবির প্রমূখ বৌদ্ধ ধর্মের সাধক পুরুষ। তাঁরা হলেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সূর্য সন্তান এবং ধর্মীয় পন্ডিত। 

সামাজিক উৎসব

বিষু (বাংলা নববর্ষ) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান এবং অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব। বিষু উৎসবকে তাঁরা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে। ফুল বিষু, মূল বিষু এবং বিষু।

ফুল বিষু মূলত চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন। মূল বিষু হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আর বিষু হলো পহেলা বৈশাখ। ফুল বিষু দিনে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় এবং নদীতে ফুল পূজা দেওয়া হয় (অনেকে ফুল ভাসানোও বলে থাকেন) এই দিনে ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

মূল বিষুতে প্রায় শতপদের সবজি দিয়ে পাইচন রান্না করা হয়। এই পাইচন বিষু’র অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ। বহুপদের সবজি দিয়ে এই পাইচন রান্না হয় বলে এর ঔষধিগুনও বেড়ে যায় বহুগুণ। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মুল বিষু’র দিনে পাইচন খেলে শরীরে যত রোগব্যাধি আছে সব চলে যায়। মূল বিষুর দিনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়োবৃদ্ধদের গোসল করানো হয়।

বিষু দিন সকলে নতুন কাপড় -চোপড় পড়ে, বুদ্ধ এবং ভিক্ষুদের জন্য আহার্য নিয়ে বিহারে যায়। প্রার্থনা করে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সমাজ, জাতি, দেশ এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল এবং সুখ-শান্তির, সমৃদ্ধির জন্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুয়ে আর্শীবাদ নেয়। বিষু দিনে সকলে সকলের বাড়িতে বেড়াতে ঘুরতে যায়। সকলে যে যার সাধ্যমতো খাবার এবং নাস্তা-পানির আয়োজন করে থাকে। সে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা- সাইন্ন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, মালি পিঠা, আলসী পিঠা, তেলের পিঠা, কলা পিঠা, কাঁকন চালের পায়েস  আয়োজন করে থাকে। সাথে মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকে। বিষু’র মূল আনুষ্ঠানিকতা তিন দিন হলেও পুরো সপ্তাহ দশদিন এর আমেজ থাকে গ্রামে এবং পাড়ায়।

এই অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ভাত খাওয়া, আর্শীবাদ অনুষ্ঠান, আহলপালানী উৎসবও হয়ে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য চর্চা

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। সাধক, ব্যাধি এবং আদি কবি শিবচরণ তাদের অনুপ্রেরণা। শিবচরণের রচিত “গোসাইন লামা” তাদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম ভিত্তি। পরবর্তীতে রাজকবি শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা যিনি তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যকে নতুন একটি মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর রচিত “ধর্ম্মধ্বজ জাতক” (১৯৩১) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গ্রন্থ। এছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার দিক থেকেও প্রথম।  ‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’ (১৯৩৩) তাঁর অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ। তিনি “চান্দোবী বারমাস, রুত্তি বারমাস,আলস্যা মেলার কবিতা এবং বিয়াল্লিশর ভাতরাদ” বারমাস রচনা করেন। তিনিই প্রথম হস্তচালিত প্রেস স্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা রাজ সভার সভাকবি বা রাজকবি ছিলেন তিনি।

লোকসাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোকসাহিত্যর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব রূপকথার গল্প আছে, আছে প্রবাদ-প্রবচন। ঘুমপাড়ানি ছড়াও আছে। সাথে আছে কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক অনেক পালাও। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, জুমকাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা ইত্যাদি।

পূজা-অর্চনা

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তাঁরা প্রকৃতিকে সেবা-যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা সরূপ নানা পূজা অর্চনা করে থাকে। তাঁরা মনে করে প্রকৃতির ভালোবাসা, আর্শীবাদ এবং আনুগত্য ছাড়া কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাস এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি করলে প্রকৃতি মাথা খুশি, সন্তুষ্ট হয় এবং আর্শীবাদ করে। এজন্য গাঙ পূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, মিত্তিনি পূজা,লক্ষ্মী পূজা, কে- পূজা এবং বুল পারা পূজাসহ বেশ কিছু পূজা-অর্চনা তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকে।

জুমচাষ, জীবন এবং জীবিকা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে জুমচাষ। জুমচাষ মূলতঃ মাল্টি এগ্রিকালচার। একই জায়গায় বহু ফসলের চাষ করা হয় এবং একটির পর একটি ফসল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই চাষের একটি বছরের সমাপ্তি হয়। জুমচাষ মূলতঃ বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত সময়। তবে এর দুই তিন মাস আগে থেকে জুম প্রস্তুতি অংশ হিসেবে জুমের জায়গা নির্বাচন, জুম কাটা, কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়া এবং পরিস্কার করতে হয়। এই জুম চাষে পুরুষ মহিলা সকলে একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।

এক সময় এই জুমচাষই তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র উপার্জন এবং জীবন- জীবিকার অবলম্বন ছিল। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের সাথে এই জুম প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা লেখাপড়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যও করছে অনেকে। আবার অনেকে ফলজ বাগান করে আয়-রোজগার করছে। আধুনিক কৃষির সাথেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া অনেকে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শুকর পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

জুমচাষ করতে হলে জুম কাটার স্থানে একটি জুমঘর তৈরি করতে হয়। জুমঘর মূলতঃ বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা আর কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে রাতে থাকা, জুমের নতুন ফসল মজুদ করণের উদ্দেশ্য এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। আর একজন জুম চাষীর তাঁর গ্রামের ঘর থেকে জুমের দুরত্ব যদি বেশি হয় সময় কমিয়ে আনা, কাজের সুবিধার্থেও এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। এই জুমঘর শুধু শস্য উঠা পর্যন্ত— মানে একবছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা জুমঘরকে ‘প্রবাস্যা ঘর’ও বলে থাকে।

বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা উচ্চ শিক্ষিত

কৃষকের পাশাপাশি, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, এমবিবিএস ডাক্তার, ডেন্টাল, হোমিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী জজ, সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন এবং নন-কমিশন অফিসার, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি সদস্য, যুগ্ম সচিব (অবঃ), ইউএনও, উপ-সচিব, দূতাবাসের ১ম কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (অবঃ), সাংবাদিকতাসহ নানা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে থেকে এযাবত মহান জাতীয় সংসদে দুজন প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমজন ছিলেন মালতি প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা (এরশাদ সময়কার), আর অন্যজন হলেন জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা ৩৪৮ আসনের সংসদ হিসেবে শপথ নেন। উভয়ের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়েরা দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে স্কলারশিপ নিয়েও বাইরে লেখাপড়া করছে। দেশের বাইরেও অনেকে চাকরি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

সম্পত্তি উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেরা পেয়ে থাকে। তবে ছেলে সন্তান না থাকলে মেয়েরা এর অধিকার পায়। স্বামী মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী যদি পূনরায় বিয়ে না করে তাহলে স্বামী সকল সম্পত্তি সে পাবে।

সামাজিক প্রথা

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধভাবে এবং গ্রামে বসবাস করে। তাদের গ্রামের প্রধান হলেন কার্বারী। তিনি গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচার এবং যেকোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তিনি মৌজা প্রধান হেডম্যান এর অধীন এবং হেডম্যান সার্কেল চীপ বা রাজার অধিনে কাজ করেন। গ্রামে বা সমাজে যেকোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা

ঘিলা খেলা, নাদেঙ খেলা, ধুধু খেলা, কুমির কুমির খেলা, গোল মরিচ খেলা, গাত্তয়া খেলা, গাইত খেলা, তেদোই বিচি খেলা, গোয়াং খেলা, পুত্তি খেলা, আংগী খেলা, তিং খেলা,লুআলুই খেলা, গুদু খেলা,বুলি খেলা,কক্কেমা বা খাবামা খেলা, শামুক খেলা এবং তুম্বুর খেলা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসকল খেলা বিশেষ করে ঘিলা এবং নাদেঙ খেলা অন্য সময় খেলা হলেও বিষু দিনে এর আকর্ষণ এবং আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন যুবক-যুবতীরা এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের এই খেলায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁরা অনেক আনন্দ মজা করে। বিবাহিত  পুরুষ এবং মহিলারাও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে।

সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, নাট্য সাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে সংগীত প্রিয়। এই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেক ঐতিহাসিক পালা পর্ব রয়েছে। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসকল পালাগুলো যারা সুর, তাল এবং সুকণ্ঠ দিয়ে পরিবেশন করতেন তারা হলেন চারণ কবি গিঙ্গিলি।

জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন গিঙ্গিলি আছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। তাঁর সময়কাল এবং আজ পর্যন্ত তাঁর সমমান কোন গিঙ্গিলি কোন আদিবাসী সমাজে বা জাতিতে জন্ম হয়নি। তিনি অন্ধ ছিলেন, এজন্য তিনি কানা গিঙ্গিলি নামেও সবার কাছে পরিচিত। তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল তিনি রাজগিঙ্গিলি ছিলেন। পরবর্তীতে ভাগ্যধন গিঙ্গিলি, দুলামন গিঙ্গিলি অনেক সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, আদি চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে নামডাক পরিচিতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা এবং আদিবাসী সমাজে। তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে দেশাত্মবোধক, রোমান্টিকসহ নানা ধাঁচের গান উপহার দিয়েছেন। তঞ্চঙ্গ্যা সংগীত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের ছোঁয়ায়।

গুনী শিল্পী হিসেবে দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনীলা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সুচন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যানি তঞ্চঙ্গ্যা, রিনি তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। পরবর্তীতে চম্পা তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যাকলিন তঞ্চঙ্গ্যা, সূর্যসেন তঞ্চঙ্গ্যা, অমিত তঞ্চঙ্গ্যা, সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রক শিল্পী হিসেবে বুলু তঞ্চঙ্গ্যা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে অনেক নৃত্য শিল্পী রয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। বাঁশি,ধুরূক, খিংকরং, শিঙা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নাট্য সাহিত্যে তঞ্চঙ্গ্যারা বহুদূর এগিয়েছে। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা নাটকের পুরোধা। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার হাত ধরে আধুনিক তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাঁর হাত ধরেই- “বর পরঙ, মন উকুলে, রত্নমালা” নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। “চানপুদি” নামে তাঁর একটি শিশু চলচ্চিত্রও ঢাকা শিশু চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করে দর্শক এবং সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বিবাহ পদ্ধতি

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিয়ে সাধারণত দুইভাবে হয়। অনুষ্ঠান করে বিয়ে এবং পলায়ন করে বিয়ে। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাকে ‘সাঙা’ বিয়ে বলে আর পালিয়ে করাকে ‘ধাবারা’ বিয়ে বলে।

সাঙা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবশীকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। আর ধাবারা বিয়েটে এসব কোন কিছুই হয় না। এই ধাবারা বিয়েটে অনেক সময় ঘরের সকল সদস্যদের (মা, বোন জানলেও) জানার সুযোগ থাকে না। তবে কনে এবং বর বিষয়টি অবগত থাকে, সাথে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।

ধাবারা বিয়ের জরিমানা হিসেবে বর পক্ষ কনে পক্ষকে শুকর বা সামান্য কিছু টাকা দিতে হয় যুব সমাজ এবং সামাজিক দাবী হিসেবে। বিয়ে নিয়ে কিছু ধরাবাঁধা এবং সামাজিক নিয়ম রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে। যেমন: নিজের আপন ভাই-বোনের মধ্যে, মাসি-পিসি, চাচা-চাচিকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অবৈধ একটি কাজ। আপন চাচাত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে অবৈধ। মামা, পিসি, মাসিত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ করা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি আছে।

এই একই সম্পর্কে বিধবা মেয়ে বা বিপত্নীকেও বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে বর কনে উভয়ে উভয়কে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী কিছু অলংকার দিতে হয়। তবে কি পরিমাণ দিতে হবে তার কোন নিয়ম নেই, দাবীও নেই। আর এর বাইরে বর কনে উভয়ে উভয় পক্ষ থেকে কোন কিছু দাবী করার পারিবারিক, সামাজিকভাবে দাবি করার কোন সুযোগ এবং নিয়ম নেই। দাবি করা ন্যায় এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিষয় যা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ এবং জাতিতে ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করে এতে জাতি, সমাজ এবং পরিবারের শৃক্সখলা নষ্ট হয়। জাতির অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়ার একটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তৈরি হয়।

অবস্থান ও বসতি

তঞ্চঙ্গ্যারা রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, জুরাছড়ি, কাউখালী উপজেলায় বসবাস করে। বান্দরবান জেলার মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, নাক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে রাঙ্গুনিয়া আর কক্সবাজার জেলার মধ্যে টেকনাফ, উকিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা, আগরতলা আর মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বসবাস রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তঞ্চঙ্গ্যারা স্থায়ী বা চাকরিসূত্রে বসবাস করছে।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি

এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র বা পদ্ধতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। বৈদ্য, কবিরাজ এবং কালেভদ্রে ভান্তেরা একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। বনজ গাছ-গাছড়া, বাকল, শেকড়, লতাপাতা, ফলমূল দিয়ে বানানো বনৌষধি নানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। বৈদ্য, কবিরাজগণ ঔষধের সমস্ত তালিক বা তালিকা নিজস্ব খাতায় বা নোটে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বৈদ্যরা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বান-টনা, আঙ ডালি, পূজা কর্ম দিয়েও নানা রকম চিকিৎসা করতো। তাছাড়া তখনকার সময়ে চিকিৎসায় একমাত্র সম্বল ছিল এই বৈদ্য এবং কবিরাজরা। বর্তমান সময়ে এসেও আদিবাসী সমাজে বৈদ্য, কবিরাজের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।

নারীর অবস্থান

আদিবাসী জনগোষ্ঠী মতো তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও অনেকটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে থাকেন।

তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে মিলেমিশে জুম, ক্ষেতে খামারে কাজ করে থাকেন। তবে গৃহস্থালি কাজগুলো মেয়েরা বেশির ভাগ সময় করে থাকে, পুরুষরাও সহযোগিতা করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমমর্যাদা ভোগ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পরেই তাদের অবস্থান।

নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর সকল প্রকার ভরণপোষণ স্বামীর নিকট থেকে সে পেয়ে থাকে। যদি স্বামী দিতে অপারগ করে বা অস্বীকৃতি জানাই তাহলে সে চাইলে গ্রাম প্রধান বা কার্বারী নিকট আইনগত আশ্রয় চাইতে পারে। স্ত্রীর অমতে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করলে প্রথম স্ত্রী সতীনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মতি জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী ভিটায় বা বাবার বাড়িতে অবস্থান কালীন সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব সে স্বামী থেকে পাবে। যদি সেও দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করে সেটি আর পাবে না।

বর্তমানে এসে সময় এবং যুগ পাল্টে গেছে অনেক। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে এবং তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তাঁরাও এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতায়। তাঁরা নিজের পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাঁরাও পরিবারকে সুন্দরভাবে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে এবং রাখছে। এটি সৃষ্টি মানবজাতির জন্য সুন্দর একটি দিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি এবং সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে তঞ্চঙ্গ্যারাও অংশগ্রহণ করে। দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাঁরা। সমতল থেকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নির্যাতনে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে আসা শত শত বাঙালি পরিবারকে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অসুস্থ রোগীকে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। নাম না জানা অনেক তঞ্চঙ্গ্যা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন সরকারি গেজেটেড এবং ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি কাপ্তাই কাপ্তাইয়ের উপজেলার ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার আগুনিয়াছড়া গ্রামে। তিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য  যুদ্ধ করেছেন।

শ্রীমতি গনমালা তঞ্চঙ্গ্যা, স্বামী- ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা, বাড়ি রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ইউনিয়নের তাইতং পাড়া যৌথ খামার গ্রামে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

স্বভাব এবং সামাজিক মূল্যবোধ

তঞ্চঙ্গ্যারা স্বভাবে শান্ত, নম্র এবং ভদ্র। তাঁরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ, পালন ও আচরণ করে। অপরের সাথে রাগ, বদমেজাজ স্বরে কথা বলে না। কথা বলার মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে চলে। স্বভাবে একঘেয়েমিতা নেই। কথায় কথায় মুখে অসুন্দর শব্দ, বাক্য প্রয়োগ করে না এবং করা থেকে বিরত থাকে। চেহেরার মধ্যেও একটা প্রকৃতিকতার আবেদন আছে।

সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে অন্যান্য চিকিৎসার মতো নবজাতক জন্মদান এখন নিরাপদ এবং সহজ হয়ে উঠেছে।

একসময় তঞ্চঙ্গ্যা তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সন্তান জন্মদান ভগবানের কৃপা এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল সকলে। তখন গ্রামে “অসা বুড়ি”(ধাত্রী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়ার সাথে থাকতেন। তখন সাবান, ব্লেড বা ছুরি কাঁচি পরিবর্তে বাঁশের ধারালো কঞ্চি দিয়ে কাটাছেঁড়া কাজটি সম্পূর্ণ করা হতো এবং ভুত্তোয়া লতা নামক একধরনের লতার কান্ড দিয়ে সাবান বা পরিস্কারের কাজটি ছাড়তে হতো। নিমপাতা সিদ্ধ করে সন্তান প্রস্রবের স্থানটি পরিস্কার করা হতো।

সন্তান জন্মদানের সাত দিনের মাথায় একটি অনুষ্ঠান করা হয়, যা ‘কসুই পানি লনা’ নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠান না হওয়া আগ পর্যন্ত নতুন মাকে ঘরের সকল কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়। মূলতঃ এসময় নতুন মা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘরের কাজ পুনরায় করার অনুমতি পান। এই সময় অসাবুড়িকে  কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ স্বরূপ কিছু নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়া হয়। তাঁকে যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। গ্রাম প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করা হয় এসময়। তাঁরাও নতুন অতিথি এবং মায়ের জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেন। পরবর্তী ঘরের সদস্য সকলে মিলে জন্মবার এবং পঞ্জিকা দেখে সন্তানের জন্য সুন্দর একটি নাম রাখেন।

ছয় মাস পর বিহারের বড় ভান্তের হাত দিয়ে এবং আর্শীবাদ নিয়ে বা ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তাঁকে মুখে প্রথম ভাত খাওয়ানো হয়।

মৃত্যু, সৎকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা

মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। দাহ করার আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো হয়। এরপর “বিয়াঘর” তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে ঐ ঘরে রাখা হয় (বিয়াঘর মূলতঃ শ্মশান যাত্রার আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে রাখার অস্থায়ী ঘর)

পরবর্তীতে বাঁশ, তার, দড়ি বা রশি এবং নানা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা মন্দির সাদৃশ্য ‘প্যারাসাইট’ নামক একটি প্যাটিকায় আবদ্ধ করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকে অশ্রুজলে বিদায় নিয়ে জগত সংসারের সকল আনুষ্ঠানিকতা মেনে এবং ছেড়ে কাঁধে বহন করে চিদাকলায় (শ্মশান) নিয়ে যাওয়া হয়।

ছেলেদের শ্মশান সাজানো হয় পাঁচ ধাপ/টাক দিয়ে আর মেয়েদের সাত ধাপ বা টাক গাছ দিয়ে। নদীর গতিপথ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির মাথা এবং পা কোন দিকে হবে সেটি নির্ণয় করা হয়। নদী বা ছড়া যদি উত্তর থেকে দ¶িণ দিকে নেমে যায় তাহলে মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে শুয়ানো হবে মাথা উত্তর দিকে করে আর পা দক্ষিণ দিক করে। দাহ করার পরদিন পরিবারের এবং আত্মীয় -স্বজন গিয়ে মৃত ব্যক্তির ধাতুগুলো(হাড়) খুঁজে নিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নদীতে বিসর্জন বা ভাসিয়ে  দেওয়া হয়। নদীতে গিয়ে ঘাটের উভয় পারের টাকা-পয়সাও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তি যেন বিনা বাঁধায় তাঁর সুপথে গমন করতে পারে।

দাহ করার সাত দিনের মধ্যে ভালো একটি দিন দেখে সাপ্তাহিক সংঘদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ শান্তি এবং সদ্গতি কামনা করে। সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানকে তঞ্চঙ্গ্যারা ‘সাতদিন্যা’ বলে। এই দিনে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য “চেরাগঘর” নামে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের পরম আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্য গৃহহীন যেন না থাকে এই উদ্দেশ্য ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাথে মৃত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার জন্য তৈরি করে দওয়া হয় “তামাঙ-ত ঘর”।

সংঘদানে ভিক্ষু সংঘকে ফাঙ বা দাওয়াত করা হয় সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া- প্রতিবেশীকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য আয়জন করা সকল খাবার রাত বারোটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয়। যদি থেকে থাকে এগুলো নদীতে পেলে দিতে হয়। কাউকে দেওয়া যায় না। ছোট বাচ্চাদের উক্ত সংঘদানে অংশগ্রহনে নিরুৎসাহিত করা হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের ছোট সদস্য ছাড়া।

সংঘদান অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তোলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক এবং বস্তুগত উপাদান দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে। এই সহযোগিতা তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সামাজিক এবং নৈতিক একটি দায়িত্ব বলে মনে করে। মৃত দুধের শিশুকে দাহ করা হয় না, তাঁকে কবর বা দাফন করা হয়। এই কবরকে ‘পআকাবা’ বলে।

উপসংহার

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নিজেদের সংস্কৃতিকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা আরো বিশ্বাস করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষায় নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

জুম, পাহাড়, ছড়া, ঝিরি -ঝর্ণার মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃপ্রেমে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির উপাদানসূহ সকলের সাথে বিনিময়ের পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিনগুলো। দেশ, জাতির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে এবং সংকট প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে চাই সকলের সাথে মিলেমিশে হাতে হাত রেখে।

লেখকঃ “পহর জাঙাল” প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা, সম্পাদক, প্রকাশক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, নাট্যকার ও ভাষা গবেষক”

পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা , কবিরত্ন (১৯২০- ২২শে মার্চ ১৯৯৭)


ড. মনিরুজ্জামান

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য-চর্চার ইতিহাস দুই ধরণের। এক. গেঙ্গুলি তথা চারণকবিদের গীত উভাগীত, ধনপুদির গীত, ‘পুরান কদা’ কিংবা শিবচরণের (অষ্টাদশ শতক) গােসাইনলামা অথবা রামায়ণ-মহাভারত ও জাতকাদির জনপ্রিয় কাহিনীর ব্যাখ্যামূলক নীতি বা গীতিকা রচনা। 

এসব গীত গেঙ্গুলিদের সংগৃহীত, হস্তলিখিত এবং প্রাচীন চাকমা (মনক্ষেমর) ও বার্মা লিপিতে চাকমা/তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। এর সবই অপ্রকাশিত (উভাগীতের কিছু অনুবাদ যথা সলিল রায় কৃত ইংরেজি অনুবাদ ও বঙ্গীয় সংস্করণ এর ব্যতিক্রম)। গেঙ্গুলি সংগ্রহের কিছু নমুনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারে ফটোকপি হিসাবে চয়িত আছে।

এই ধরণের রচনা ব্যতীত আর যা পাওয়া যায় তা বাংলা ভাষায় রচিত পার্বত্যবাসীদের নানা গ্রন্থ ও সম্পাদিত নানা পত্রিকা ও সাময়িকা, – যার প্রধান ভাষা বাংলা। অর্থাৎ এ গুলিকে চাকমা ও অন্যানা পার্বত্যজাতির বাংলা ভাষাপ্রীতির ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রকাশ। এবং সাহিত্যের নানা দিকে নিজেদের প্রতিভা স্ফুরণের প্রচেষ্টা। 

এখানে বাংলাভাষী লেখকদের সাথে প্রতিযােগিতার কোনও প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা যায় না যদিও বাংলা সাহিত্যের (বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির) সমালোচনার যােগ্যতা তারা রাখেন এবং সেসব রচনা বাস্তবিক উপভােগ্য। 

সাহিত্যের নানা বর্গে (genre) তাদের এই পদচারণার(নাটকে উপন্যাসে গল্পে আলােচনায়। অনুবাদে ও গানে এবং মৌলিক কবিতায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা তাদের এসব সৃষ্টির প্রয়াস যথেষ্ট উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়) কোন স্বতন্ত্রমূল্য আছে বা হবে কি না তা এখনও বলার সময় আসে নি। 

তবে এই সব সৃষ্টি বা প্রকাশনার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ভাষিক ও সাহিত্যিক মূল্য একদিন হয়তবা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আজ কাল ডায়াসপােরা ( Diaspora) বা অভিবাসিতের সাহিত্যের যে মূল্যায়ন হচ্ছে, সেই রকম এসব বিভাষীদের বাংলা চর্চার মূল্যও যে কালের দাবী হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে? এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় আমরা রাজস্থলী (কাপ্তাই) এক অস্ফুট কিন্তু অসাধারণ এক প্রতিভা কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার পরিচিতি প্রদানে প্রবৃত্ত হবাে।

পটভূমিঃ

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর পার্বত্যবাসীদের উল্লেখ করে প্রমথবিশী বলেছিলেন, বঙ্গভূমি কেবল পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলাই নয়, পার্বত্য বাংলাও। যাই হােক, বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় পার্বত্যবাসীরাও বাংলা চর্চায় আগ্রহী হন। 

যদিও নন্দলাল শর্মার ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের অবাধ বিচরণের সংবাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত’। যাই হােক তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস চাকমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের সাথে যুক্ত। 

একথা সত্য যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রথম আলিঙ্গন জানান চাকমা রাজবাড়ির প্রধান পুরুষগণ। তবে যতদূর জানা যায় এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়েরও একটি সক্রিয় ভূমিকা আছে। স্কুলটি বিশ শতকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘােষ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ত্রয়ােদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (কলিকাতা, ১৩১৪) ‘চাকমাদিগের ভাষা তথ্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। 

পরে তিনি (সম্ভবত রাজবাটির উৎসাহ ও প্রণােদনায়) ‘জ্যোতি’ পত্রিকার লেখক গগনচন্দ্র বড়ুয়ার সূত্র ব্যবহার করে ও বহু শ্রম স্বীকার করে ‘চাকমাজাতি’ ( ১৩১৬ সন) শীর্ষক একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। 

সিবিলিয়ানদের পরে ও বাংলাভাষাতে এটিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বঙ্গীয় অম্বেষণ। এক দশক পরে রাজা ভুবনমােহন রায়-এর ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এটিই চাকমাদের কর্তৃক বাংলা চর্চার আদি নির্দশন। 

তবে কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় (বিচিত্রা, দেশ প্রভৃতি) রাজ পরিবারেরই লেখা কিছু কিছু গল্প কবিতা এর আগেও প্রকাশিত হয়ে থাকবে। কুমার কোকনদক্ষ রায়ের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। 

যাই হােক, বাংলা ভাষা চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা দানে পরবর্তী কালেও রাজবাটির উৎসাহের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রানী কালিন্দী রায়, রানী বিনতা রায়, রাজা নলিনাক্ষ রায়, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, এঁরা সকলেই যেমন নিজেরা যােগ্যতার সাথে বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছেন, তেমনি অন্যদেরও সে সুযােগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা-চর্চার এই পরিবেশটি আসলে গড়ে ওঠে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকেরও মধ্যকালে এসে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্য- পটভূমিতেও নানা পরিবর্তন যােজিত হতে থাকে। 

নতুন পত্র পত্রিকার আবির্ভাব, উনিশ শতকের সাহিত্যের ভিন্ন মূল্যায়ন, মাক্সির্য় দর্শনের প্রভাব, লােকসংস্কৃতির পঠনপাঠন (কবি জসীম উদদীনেরও আবির্ভাব এই সময় : রাখালী ও কর’ ১৯২৭, নকশীকাঁথার মাঠ ১৯২৯, সােজন বাদিয়ার ঘাট ১৯৩৩ প্রভৃতি) এবং রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নৰ জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ‘কাল-চিহ্ন’ বহন করে চলছিল সময়ের নিম্নবাহী স্রোত। 

সমকালীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আধুনিকতার নামে এক ‘তিমির তীর্থ’ পরিক্রমণে উদ্যোগী তখন। এই পটভূমি বৃহত্তর দেশ ও তার সংস্কৃতিকে অন্যরকম প্রতিক্রিয়ার মুখােমুখি করে। অর্থাৎ একদিকে এক ধরেণর নম্রজাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে নাগরিক বােধ সৃষ্টি ও বিশ্বমুখিন চেতনা বিকাশের নামে শিকড়বিহীন যে আধুনিক সাহিত্য ও নব সংস্কৃতি সৃষ্টি, তার প্রতি অনীহা সংস্কৃতি- সচেতন মানুষকে তার অন্তবােধের প্রতি বিশ্বস্ত হতে প্রেরণা যােগায়। 

বৃত্তের মধ্যে যে কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির কথা বলা হয়। এখানে যেন তারই উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। এইভাবেই কেন্দ্র থেকে দূরে প্রান্তীয় অবস্থানে বাংলাভাষার লােকজ, আঞ্চলিক বা গ্রামীণ, এবং উপসীমান্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠতে থাকে। 

রেঙ্গুনে ‘বুদ্ধবাণী’ প্রকাশ ও পার্বত্য চট্টগ্রােম ছাত্র সমিতির মুখপত্র ‘প্রগতি’ প্রকাশনা (যদিও অস্থায়ী) এবং রাঙ্গামাটিতে গৈরিকা-গােষ্ঠীর উত্থান তারই প্রামাণ্য বহিঃপ্রকাশ। 

গৈরিকা’র প্রভাবে ও গৈরিকা’র অবর্তমানে পরে আরও কিছু পত্রিকার ও আবির্ভাব ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। ‘গৈরিকা’র প্রকাশ কাল (১৯৩৬- ১৯৫১), পরে বান্দরবানে ‘ঝরণা’ (১৯৬৬), এবং আরও পরে রাঙ্গামাটিতেই ‘বনভূমি’, ‘পার্বত্যবাণী’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ‘পার্বত্যবাণী’ সম্পাদনা করেন বিরাজমােহন দেওয়ান (১৯৬৭-১৯৭০;মােট সংখ্যা ২৬টি)। এতে আগরতারা ও উভাগীত এবং রাজ পরিবারের অনেকের রচনা ও স্মৃতি কথাও (রানী বিনীতা রায়ের জীবনস্মৃতি সহ) প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বিশেষ করে রাঙ্গামাটি থেকে পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশিত হলেও (বিস্তৃত তালিকার জন্য বর্তমান লেখকের গােষ্ঠী পত্রিকা ও সাময়িকী ২০০৬ দেখা যেতে পারে। এছাড়া নন্দলাল শর্মারও একটি সমীক্ষা রয়েছে)। ‘গৈরিকা’র ভূমিকা ঐতিহাসিক। ‘গৈরিকা’র নামকরণেরও ঐতিহ্য আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। রানী বিনীতা রায়ের পরিচালনায় রাঙ্গামাটি থেকেই এটি প্রকাশিত হয়। 

রাজা নলিনাক্ষ রায়ের প্রয়াণে তার স্মৃতি সংখ্যাটিই এর শেষ সংখ্যা ছিল (১৯৫১)। প্রভাতকুমার দেওয়ান ও পরে অরুণ রায় পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। অরুণ রায়ের প্রথম প্রকাশ ‘বুদ্ধবাণী’তে (রেঙ্গুন)। 

আরও অনেকের প্রাথমিক প্রস্তুতি বাইরের, তন্মধ্যে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ও রবীন্দ্রপ্রভাবিত গীতিকার চূণীলাল দেওয়ানের কথাও বলা যায়। কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের কথা আগেই বলা হয়েছে। 

কিন্তু নন্দলাল শর্মার উক্তিটি সমর্থন করে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালে চাকমা ভাষায় যে কবিতা চর্চা হচ্ছে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে ‘গৈরিকা’। নন্দলাল শর্মা গৈরিকা’র লেখকদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন এভাবে। 

প্রভাত কুমার দেওয়ান, অরুণ বা, কন্যার কোকনদাক্ষ রায়, বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ান, রানী বিনীতা রায়, অবিনাশচন্দ্র দেওয়ান, কালাঞ্জয় চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান, ভগবানচন্দ্র বর্মন, শেখর দেওয়ান, ও সােমেন দেওয়ান (আসলে বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ানের দুটি ছদ্মনাম), কুমার বিপাক্ষ রায়, গােপাল চন্দ্র গুর্খা, তনুৱাম খীসা, নীলা রায়, বিপুলেশ্বর দেওয়ান, রাজা নলিনাক্ষ রায়, চমীকাল দেওয়ান, শান্তি রায়, সুনীতিজীবন চাকমা, গিরীন্দ্র বিজয় দেওয়ান, নীরােদরঞ্জন দেওয়ান, কুমার রমণী মােহন রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, জগদীশ চন্দ্র বর্মন ও রাজেন্দ্রনাথ তালুকদার। 

এই তালিকায় হয়তাে আরও দু একটা নাম যুক্ত হতে পারে যেমন, কুমার কুবলয়াক্ষ রায়, সৌমেন্দ্র নারায়ণ দেওয়ান, নােয়ারাম চাকমা, বেণীমাধব বড়য়া প্রভৃতি। পরবর্তীতে আমরা এমন অনেককে পাই যাদের নাম এই তালিকায় পাই, যেমন- বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়কেতন চাকমা বা মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা প্রভৃতি। 

হতে পারে গৈরিকা-গােষ্ঠী ভুক্ত ছিলেন না তারা। সেই রকমই একটি নাম হল কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯২০-২২শে মার্চ ১৯৯৭)। 

তিনি কোনও দলভুক্ত হয়ে সাহিত্য চর্চার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি স্বাধীনভাবেই সাহিত্য চর্চা করেছেন, যদিও ‘পার্বত্যবাণী’তে তাঁর কিছু রচনা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। 

অন্য পত্রিকায়ও তার রচনা প্রকাশিত হয়ে থাকবে। বস্তুত কার্তিকচন্দ্রের আবির্ভাব কালের সময় ও পরিবেশ ছিল এটাই। অবশ্য তাঁর প্রথম আবির্ভাবের তথ্যটি অর্থাৎ প্রথম রচনা প্রকাশের তথ্য এখনও অস্পষ্ট। তাঁর অনেকগুলি পান্ডুলিপি পাওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা স্বীকার্য। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ভূমিকা ও অবস্থান 

কবি কার্ত্তিকচন্দ্র যা কিছু রচনা করেছেন তা মূলত বৌদ্ধ সাহিত্য এবং তাঁর সবই বাংলা ভাষায় রচিত। তিনি কি বৃহত্তর পাঠকের চিন্তা থেকেই তা করেছিলেন? তঞ্চঙ্গ্যা সমাজেই বা তার অবস্থান কোথায়? – এ প্রশ্নের উত্তরে ও বিশ শতকের তৃতীয় দশকেই যেতে হবে আমাদের, যখন পালিসাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন বিলাইছড়ি রাইংখ্যং-এর আশাছড়িমুখ নিবাসী এক লােক চিকিৎসক- কবি পমলাধন।

পমলাধনের সমকালে বা সামান্য আগে শরৎ রােয়াজার এবং চূনীলাল দেওয়ানের সংগীত ও কাব্যচর্চার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেন (দ্রষ্টব্য, নন্দলাল শর্মা, ঐ), কিন্তু। তাদের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। 

পলাধন ধর্ম- সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি। তারই যােগ্য উত্তর পুরুষ কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। পলাধনের সাহিত্যকে বিস্তৃত করেন তিনি। এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়েই তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থানকে উজ্জ্বল করেন এই দুই কৃতিমান পুরুষ। 

কার্তিকচন্দ্রের জন্ম হয় ১৯২০ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর । তিনি চাকমা জাতির ইতিকথা’র বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমকৃষ্ণা দেওয়ান এর সমবয়সী এবং বিরাজ মােহন দেওয়ান (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত), প্রভাতকুমার দেওয়ান (গৈরিকা-সম্পাদক), চূনীলাল দেওয়ান (চাকমা কবিতা, জুমিয়া গৃহিণী –লেখক), কবি অরুণ রায়, গল্পকার জগদীশ দেব বর্মন, প্রবন্ধকার ভগবানচন্দ্র বর্মন, ‘প্রগতি’ সম্পাদক শরৎচন্দ্র তালুকদার ও সুনীতিজীবন চাকমা, কবি-অনুবাদক সলিল রায়, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি’র লেখক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখের তিনি সমকালীন বা অগ্রজ। তাঁর “বৌদ্ধগল্পমালা’ (১৩৯৬) গ্রন্থের ভূমিকায় (আমার কথা) প্রদত্ত দুটি তথ্য নিম্নরূপ:

“… রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া শাক্যমনি বিহারের অধ্যক্ষ বৌদ্ধসাহিত্য সুসাহিত্যিক ও সুপন্ডিত শ্রীমৎ প্রিয়দর্শী মহাস্থবির মহােদয় আমার রচিত এই বৌদ্ধগল্পমালা পুস্তকের পান্ডুলিপিখানা আগাগােড়া পড়ে আমাকে ধর্ম প্রচারের জন্য বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেন। আমি মহাস্থবির মহােদয়ের নিকট চির কৃতজ্ঞ। 
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটী সরকারী কলেজের বাংলার অধ্যাপক বাবু নন্দলাল শৰ্মা তাঁহার লিথিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের (বাংলা) সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ পুস্তকে আমার রচিত পুস্তক সমূহ বিশেষভাবে সমালােচনা করে আমাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রেখেছেন।”…

দুটি মন্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য তাঁর অপরাপর গ্রন্থেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ কবি তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনও না কোনও ধর্মগুরু বা রাজগুরুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং ধর্মপ্রচার ও মানুষের মঙ্গলের বিবেচনাকেই সেখানে প্রধান্য দিতে দেখা গেছে। 

মহাস্থবির মহােদয়ের প্রভাবে তিনি এই গ্রন্থ শেষেও বলেছেন, ‘এই পুস্তকের দ্বারা ধর্মপ্রাণ নর-নারীগণের যৎসামান্য উপকারে আসলে আমার রচনা শ্রম সার্থক মনে করবাে।’ এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৩৯৪/১৯৮৭ ইং। অর্থাৎ এর আগেও তিনি যেসব ধর্মকেন্দ্রি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেমন- মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বুদ্ধ সালামী গাথা (১৯৮৫) কিংবা যেসব রচনার পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে যেমন – রাধামন ধনপতি প্রভৃতি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােক গাথা এবং “অশােক চরি” নামীয় একটি চরিত কাব্য ও অন্যান্য কিছু রচনা, – সেগুলিরও প্রত্যেকটি মধ্যেই কবির এই ধর্মপ্রীতি ও ধর্মপ্রচারের আকাঙ্খা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

আগেই উল্লেখিত হয়েছে, (১৯৩৬ সালে) পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘ধর্মজ জাতক’ গ্রন্থটি মূল পালি থেকে পদ্যানুবাদ করে বা পদ্যরীতিতে ভাবানুবাদ করে এবং তৎসহ ‘ধর্ম্ম হিত উপদেশ’ সংযােজন করে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সাহিত্য রচনার সূচনা করেছিলেন, কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাকেই আদর্শ হিসাবে নিয়েছেন। 

এই সাহিত্যের শাখাকে বিস্তৃত করাতেই মনােযােগী হয়েছেন তিনি। কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন, দুই ভাবে- মননী মেধা প্রয়ােগে (যেমন, তত্ত্ব- কাব্য ও ধর্মকাব্যের মাধ্যমে) ও সৃজনী মেধার মাধ্যমে বা মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ চরিত কাব্য, কাহিনী বা গাথা কাব্য ও কাব্য নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে। 

রচনার বিষয় ও তার সরস প্রকাশ, নাটকীয় গুণ ও কাব্যবােধ মিলিয়ে উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সকল সৃষ্টিতেই। উল্লেখ্য কার্ত্তিকচন্দ্র ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’র সাথে পমলাধনের ‘ধর্যধ্বজ জাতক’ গ্রন্থটিও সম্পাদিত ও সংশােধিত আকারে প্রকাশ করেন। 

এই কারণে তিনি রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক “পন্ডিত” ও ‘উদয়ন যন্ত্র’ রচনার জন্যে প্রিয়দর্শী মহাস্থবির কর্তৃক “কবিরত্ন” উপাধি লাভ করেন রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির আয়ােজনে। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা রচনা পরিচিতি 

কবি তাঁর একাধিক গ্রন্থে অধ্যাপক নন্দলাল শর্মার উল্লেখ করে বলেছেন তিনি তাঁর (কবির) গ্রন্থের মূল্যায়ন করেছেন, এজন্য তিনি তাঁর (অধ্যাপক শর্মার) কাছে কৃতজ্ঞ। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ (১৯৮১) পুস্তিকায় নন্দলাল শৰ্মা পাহাড়ী বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার কথাও এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। উক্ত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে কার্ত্তিকচন্দ্রের মূল্যায়ন সমূহ আমরা প্রথমে তুলে ধরতে চাই। তা নিম্নরূপ –

১. উদয়ন বস্তু:

১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘উদয়ন বস্তু’। পয়ার ছন্দে লিখিত এবং ছাব্বিশটি ছােট ছােট অধ্যায়ে বিভক্ত। এই কাব্য গ্রন্থে বর্ণিত শ্যামাবতীর কাহিনী যুদ্ধের সমকালীন ঘটনা হলেও অনেকটা বুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা সম্বলিত। 

বার্মায় ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vathu) অনুসরণে কাব্যটি রচিত। কর্মফলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কবি এ কাব্যের শেষাংশে বলেছেন- 

“দানশীল ভাবনাতে মন কর স্থির
কুশল কর্মেতে লিপ্ত থাক সদা ধীর।”

২. অনাগত বংশ : 

“অনাগতবংশ’ নামে তিনি একখানা কাব্য প্রণয়ন করেছেন। বর্মী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন চিনি অং মাষ্টার। সেখান থেকে কার্তিক বাবু সরল পয়ার ছন্দে বইটি রচনা করেন। এ কাব্যে আর্থমিত্র প্রমুখ অনাগত বৃদ্ধদের সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণিত হয়েছে।” (পৃ. এগার)

৩. বিজয়গিরি:

“মূলত কবি হলেও কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (জন্ম ১৯২০) দু’খানা নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকদ্বয় প্রকাশিত হয় নি। ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘বিজয়গিরি’ চার অঙ্কের নাটক। 

চম্পক নগরের রাজা উদয়গিরির পুত্র বিজয়গিরিকে রাজ্যভার অর্পন করে শ্রী বৌদ্ধ মন্দিরে গমন করতে চান। কিন্তু বিজয়গিরি বের হতে চান দিগ্বিজয়ে। এ সময় উদয়পুরের রাজা জংলী কুকীরাজ কালঞ্জয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁদের শরণাপন্ন হন। 

বিপুল বিক্রমে বিজয়গিরি মিত্ররাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোয়াং দেশের রাজা মঙ্গল উদয়পুর লুণ্ঠন করতে আসলে সেনাপতি তা প্রতিহত করেন। বিজয় অভিযানে বের হয়ে বিজয়গিরি রােয়াং রাজ্য জয় করেন। এই হল নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। 

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি অনুগত থেকেও নাট্যকার কতিপয় কাল্পনিক চরিত্র-নাগরিকগণ, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, গয়ারাম, গঙ্গরাম প্রভৃতি চরিত্র উপস্থাপন করে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। 

এ নাটকের সংলাপ কখনাে গদ্যে আবার কখনাে মিলহীন প্রবহমান। পয়ার ছন্দে রচিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কথনাে দৃশ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে। বিবেক চরিত্র ও সংগীতের সংযােজন নাটকটিকে যাত্রাভিনয়ের মর্যাদা দান করেছে।” 

৪. মানুষ দেব :

“ ভগবান গৌতম বুদ্ধের অতীত (জাতক) কাহিনী অবলম্বনে কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ‘মানুষ দেবতা’ নামে তিন অঙ্কের একখানা নাটক রচনা করেছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। 

মঘবা নামে বােধিসত্ত্ব মানুষকে পঞ্চশীল পালনে ও জনহিতকর কার্যে উধুদ্ধ করেন। মাতালদের বিচার করে উৎকোচ করত মন্ডল। মদ্যপান বন্ধ হয়ে গেলে সে মঘবাকে ডাকাত বলে রাজ সমীপে নালিশ করে। বিনা বিচারে মঘবার শাস্তি হয়। কিন্তু মহমী মঘবাকে পদলিত না করায় রাজা নিজের ভুল বুঝে মঘকে মুক্তি ও মন্ডলকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। 

জাতকের এ কাহিনীকে যাত্রাগানের মত নাট্যকার উপস্থাপিত করেছেন। আধুনিক নাট্যকলা শ্ৰী তঞ্চঙ্গ্যার নাটকে অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনাই তাঁকে নাট্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।” 

৫. রাধামন ধনপুদি গেঙ্গুলী গীত : 

“ বান্দরবান মহকুমার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হেডম্যান ও জনসাধারণের একমাত্র মুখপত্র ত্রৈমাসিক ‘ঝরণা’র প্রথম সংখ্যার ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয়। 

… চার সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ‘ঝরণা’ বন্ধ হয়ে যায়। ঝরণা’তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘রাধামােহন ধনবতী কাহিনী অবলম্বনে ‘গেঙ্গুলী গীত’ … ইত্যাদি।”

৬. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষাঃ

শ্রী নন্দলাল শর্মার বর্ণিত গ্রন্থে কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এই পাঁচটি গ্রন্থের বিবরণ ছাড়া আর একটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় গ্রন্থের পরিশিষ্টে ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের তালিকাংশে। উক্ত গ্রন্থের নাম ‘বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা’। 

গ্রন্থটির প্রকাশকাল দেওয়া নেই এবং প্রকাশের স্থানে উল্লেখ আছে (রাইংখ্যং মুখ?), অর্থাৎ প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যটি অনিশ্চিত বা অজ্ঞাত। এছাড়া ‘পার্বত্যবাণী’ পত্রিকায় বা অন্যত্র ও অন্যভাবে কবি যে ‘কালেভদ্রে’ দুএকটা কবিতা প্রকাশ করেছেন তার উল্লেখ আছে কিছুটা সমালােচনার ভঙ্গিতে-

“কবি অরুণ রায় ও কবি কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা সত্তরের দশকে নিজ নিজ কাব্য প্রতিভার অবক্ষয় অপরােক্ষ করলেও কালে ভদ্রে দু’চার চরণ। কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না।”

পাঁচ. কবির মাধ্যম, প্রকরণ ও মূল্যায়নঃ কবির পূর্ণ গ্রন্থতালিকা এটি নয়। বর্ণিত তালিকা ও বিবরণ থেকে কবির একটি সামান্য পরিচয় মাত্র লাভ করা যায় যা অধ্যাপক গবেষক নন্দলাল শর্মা পরিশ্রম সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 

আমার অপর ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তনচংগ্যার সহায়তায় আমি একটি শ্রেণীকৃত রচনা তালিকা তৈরীর প্রয়াস পেয়েছি, সেটি পরিশিষ্টে যােগ করা হল। 

কবির রচনাপঞ্জি (আংশিক নয়) নির্মিত না হলে এবং সমুদয় রচনা প্রকাশিত না হলে। তাঁর সম্পর্কে পূর্ণ মূল্যায়ন অপেক্ষিত থাকে। আমরাও এখানে কবির কর্মের সম্পূর্ণ মূল্যায়নে বিরত থাকলাম তার অধিকাংশ রচনাই অপ্রকাশিত থাকার কারণে।

কবির মূল রচনা সমূহ কাব্যাকারে রচিত, যদিও এসব রচনা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত, যথা রাধামন ( রাধামােহন)-ধনপুদি (ধনবতী) গাথা একটি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােকগাথা শ্রেণীর, অশােক চরিত একটি কাব্যনাট্য শ্রেণীর, অনাগত বংশ একটি মিশ্র রীতির রচনাগুচ্ছ, অধিকাংশ নাটক আবার পালা বা যাত্রা জাতীয় এবং কাব্য শ্রেণীর গ্রন্থগুলি ধর্মদেশনা ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক। কবির সব রচনাই আবার পয়ার ছন্দে বদ্ধ। 

তাঁর প্রবন্ধ সমূহ ও কিছু কিছু গীতি ও নীতি কবিতা এর ব্যতিক্রম মাত্র। অধিকাংশ বা প্রায় সমুদয় রচনা বাংলা ভাষায় রচিত হলেও ‘বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা’ (১৯৮৫) এই বার পৃষ্ঠার প্রার্থনামূলক গ্রন্থটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। তাঁর ভাষার নমুনা এই রূপ – 

বুদ্ধ ধৰ্ম্ম সংঘ গুণ 
ভাবনা গরং মনত্তুন। 
কায়ামনে কধায়ে,
ভজন গরং সদায়ে। 

এখানে ভাষাই পরিবর্তিত হয় নি, ছন্দরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। 

ছয়. পরিশিষ্ট – ১ 

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের প্রকাশনা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য

১. বৌদ্ধ শিক্ষা (১৩৪৬) ও ২. উদয়ন বন্ধ (১৩৬৮):

“মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪) গ্রন্থের ভূমিকায় (‘আমার কথা’) উল্লেখ আছে : “আমি ইতিপূর্বেও কয়েকখানা বই লিখেছিলাম। ১৩৪৬ সন বাংলাতে ‘বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামক একখানা বই লিখে প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করেছিলাম। 

আর ১৩৬৮ বাংলা সনে উদয়ন বস্তু” নামে একখানা বই লিখে, তাহা প্রেসে ছাপিয়ে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নর-নারীগণের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আরও কিছু বই লিখেছি। কিন্তু ছাপাকারে প্রকাশ হয়নি। …” 

৩. উদয়ন বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮/১৯৬১ ইং), গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১৩০ 

গ্রহারম্ভে ‘মূল গাথা’, ‘পরিচিতি’ ও ‘আমার কথা’ যুক্ত ‘পরিচিতি থেকে উদ্ধৃতি- 

“অপ্রমাদ মূল পাথা ভাষিত যখন 
মহারাজ উদয়ন সময়ে তখন। 
আরম্ভ করিব গল্প কাহিনী বিস্তার,
কার্তিক তঞ্চঙ্গ্যা রচে শ্বায় পার।” 

“আমার কথা” 

“বৌদ্ধধর্ম কর্মহী; লােকে যাহা কর্ম করে তাহাই কর্মের ফলরূপে ভােগ করিয়া থাকে। ‘উদয়ন বন্ত্র’ গল্প কাহিনী কর্মফলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ ।…

বার্মার ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma ( ধর্মের আলাে) নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vatlu) ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে ‘উদয়ন বন্ধু’ নামকরণে এই পুস্তক প্রণয়ন করিলাম ।…”

সূচিপত্র

বিষয় – দুইবন্ধু – উদয়ন- উদয়নের রাজ্যলাভ – অভিষেক উৎসব- তৃষ্ণালয়ে জন্ম দাসীর ভাগ্য- সাধু সঙ্গ লাভের ফল- কৰ্ম্মফল ভুগিতে হয়- কৰ্ম্ম রাখে যারে কে মারিতে পারে- ঘােষক শ্ৰেষ্ঠী- সুখ দুঃখ চক্রবৎ-শ্রেষ্ঠী কুমারী শ্যামাবতী- মহারাজ চন্দ্র প্রদ্যোতরাজকুমারী বসুল দত্তা- দ্বিজ নন্দিনী মাগন্দ্বিরা – অর্দ্ব উপোসথের ফল- কৌশাম্বীতে বুদ্ধের শুভাগমন- কুজোত্তরা- মাগন্দ্বিয়ার শক্রতা- শ্যামাবতীর বর লাভ কৰ্ম্মফলমাগন্দ্বিয়ার সাজা- ভিক্ষগণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশ- উপসংহার । 

৪. মহাৰােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); গ্রন্থ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮। প্রকাশকের (শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: ভিক্ষু) নিবেদন’… ভগবান বুদ্ধের অমৃতময় দেশবাণীকে প্রচার করা (র) … সংকল্প পােষণ করে আমার দায়ক শ্রদ্ধাবান উপাসক কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচিত ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ তৎসঙ্গে স্বর্গীয় কবিরাজ মশাধন তঞ্চঙ্গ্যা রচিত ‘ধৰ্ম্মধ্বজ জাতক’ বই খানা … প্রকাশ করতে কৃত সংকল্প… হলাম । এই পুস্তক প্রচারের দ্বারা ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নরনারী গণের যৎকিঞ্চিৎ উপকার হলে আমার আশা পূর্ণ হবে।’ 

আমার (গ্রন্থকার) কথা- 
‘মহাকারুণিক শান্তা তথাগত ভগবান গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে আমি বহুদিন ধরে আশা পােষণ করে আসছি।… বুদ্ধের… এসব বিষয়ে সর্বসাধারণের সহজে যাতে বােধগম্য হতে পারে মােটামুটি এক নজরে বুদ্ধকে জানবার জন্য আমি ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ নাম দিয়ে এই বইখানা… মহাবােধি পালঙ্কের আদি বিবরণ সরল বাংলা পয়ার ছন্দে লিখে… পাঠ করে শুনালে শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: স্থবির বইখানা প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি শ্রদ্ধেয় ভান্তের নিকট চির কৃতজ্ঞ।’ 

উৎসর্গ – 
‘স্বর্গীয় পিতৃদেব আন্তখা তঞ্চঙ্গ্যা (কালাবৈদ্য) স্বর্গীয় মাতৃদেবী মনপুরি তঞ্চঙ্গ্যা – তাঁহাদের পূণ্য স্মৃতি স্মরণে’ । (১০ ঢরণের কবিতা সহ)। 
বিষয়: বন্দনা – মাতাপিতা গুরু বন্দনা – মহাবােধি পালঙ্ক কথা – কুলপুত্র নন্দিয় কথা। 

৫. ধর্মধ্বজ জাতক : কবিরাজ পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রণীত, পন্ডিত শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবি রত্ন কর্তৃক সংশােধিত ও সম্পাদিত ১৩৯০: পৃ. ৩৯-৮০। সুচিপত্র। বন্দনা- সূচনা- বারমাসী পুরীর বর্ণনা- বিনিশ্চয় বিচার- ধর্থ ঋজকে পঞ্চকৰ্ম্ম আদেশ-বিশ্বকৰ্মাকর্তৃক গজদন্ডময় গৃহ নিৰ্মাণ- ছত্রপানি কর্তৃক চণ্ডুবিধ গুণ।

ব্যাখ্যা- রাজা যশাপানিকে পঞ্চজের উপদেশ দান- কবিরাজ পমপান তঞ্চঙ্গ্যা সংক্ষিপ্ত জীবনী।

৬. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (১৯৮৫/২৫২৯ বুদ্ধাব্দ) 
উৎসর্গপত্রঃ ‘আমার পিতামহ পরম উপাসক স্বর্গীয় শােভাধন তঞ্চঙ্গ্যা ও তাহার সহধর্শিনী উপাসিকা স্বর্গীয় কইবী তঞ্চঙ্গ্য-এর পূণ্যস্মৃতি স্মরণে’। (১২ চরণের কবিতা সহ)

সাত, পরিশিষ্ট -২

কবিরত্ন কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচনাসমূহ
(শ্রেণীকৃত তালিকা) 

১। প্রকাশিত গ্রন্থ (কাব্য বা ধৰ্মকাব্য)
ক. ভাষা: তঞ্চঙ্গ্যা- বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা (আগষ্ট ১৯৮৫)। 
খ. ভাষা: বাংলা – বৌদ্ধশিক্ষা (১৩৪৬); উদয়ন বস্তু বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮); মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); বৌদ্ধ গল্পমালা (১৯৮৭)। 
২। সম্পাদিত গ্রন্থ 
ক. ধৰ্ম্ম ঋজ জাতক – পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা মূলগ্রন্থের সংশােধন ও সম্পাদনা (১৩৯০)। 
৩। প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ-
ক. লােকগাথার কাব্যরূপ ঐতিহাসিক) : রাধামন ধনপুদি কাব্য। 
খ. চরিত কাব্য: অশােক চরিত (রচনা ১৯৮৩); অনাগতবংশ। 
গ. নাট্য কাব্য (ঐতিহাসিক) : বিজয়গিরি। 
ঘ. চরিত নাটক (ধর্মীয়); মানুষ দেবতা। 
ঙ. তপ কীর্তন ও যাত্রা পালা । বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা (রচনা ২৫/০৪/১৯৮৫) শ্রীবুদ্ধের বারােমাস স্মৃতি (রাজস্থলী মৈত্রী বিহার প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ, ২৬/০৩/১৯৭৮) 
চ. বিবিধ শ্রেণীর কল্পতরু দান ফল কথা; বন্দনা ও দান ফল কথা; অক্ষর গাথা। 
৪। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা – 
ক. ‘নববর্ষ’। রাজবলাকা (১৫ এপ্রিল ১৯৮৭ সংখ্যা)। 
খ. ‘আশ্বিনী পর্ণিমা’। নৈরঞ্জনা (সম্পা, সয় চাকমা, ২০ আশ্বিন ১৩৮৮ সংখ্যা)। 
গ. দেবৱিলােকন’। সম্বােধি (সম্পা. ভিক্ষু শদ্ধা প্রিয়, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ১৩৯০)। 
ঘ. ‘জীবন রহস্য’। পার্বত্যবাণী (সম্পা. বিরাজ মােহন দেওয়ান) ১ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।

৫। প্রকাশিত প্রবন্ধক- 
ক. ‘চাকমা পেঙ্গুলীগীত’ (লােক কাহিনী): 
ঝরণা ১ম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা মার্চ ১৯৬৭ (সম্পাদক, সৈয়দ খাজা আহমদ) 
ঝরণা ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জুন ১৯৬৭ (সম্পাদক, সুনীতি বিকাশ চাকমা)। 
ঝরণী ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ (সম্পাদক,সুনীতি বিকাশ চাকমা) 
খ. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি (জাতিতত্ত্ব) : সাপ্তাহিক বনভূমি, ২৬ মার্চ ১৯৮৪ (সম্পাদক : এম মকসুদ আহমদ)*

তথ্য নির্দেশ 
১। শ্রী নন্দলাল শর্মা (১৯৮১): পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক। 
রাঙ্গামাটি 
২। বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৯৫) : তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। 
৩। ‘গৈরিকা’র ফাইল 
৪। শ্রীমান কর্মধন তন্চংগ্যার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

* টিকা : কার্তিকচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থের নামপত্রেও অনেকগুলি গ্রন্থের নাম আছে। কিন্তু সব গ্ৰন্থই প্রকাশিত কিনা জানা যায় না। নন্দলাল শর্মার গ্রন্থে (১৯৮১) বৌদ্ধ ধর্ম। শিক্ষার উল্লেখ থাকলেও কবির ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ র আখ্যাপত্র প্রদত্ত পুস্তক তালিকার মধ্যে এবং উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা (আমার কথা”)-তেও বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামটিই পাওয়া যায়। নন্দলাল শর্মা ‘ধর্মপ্লজ জাতক’ এর প্রকাশ কাল ১৯৩৬ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি গ্রন্থটি সম্পাদিত রূপ (কবিরত্ন কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকর্তৃক ১৯৮৪ সংস্করণ)- টি সম্ভবত পান নি।

প্রসঙ্গঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রসঙ্গ

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা*

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রী: পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দিনটিও সুন্দর ছিল, বছরের শেষ দিন এবং অফিস ছুটিও ছিল তখন। তাছাড়া পরিবারকে নিয়ে বের হওয়া যায় না সহজে। সময়, সুযোগ, বাস্তবতা অনেকটা অনুকূলে থাকে না। আর পরিবারের সদস্যদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বিশেষ করে ছোটদের, বড়দের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ এটি নয়। তবে যৎসামান্য প্রসঙ্গও থাকবে বৈকি।

বহুদিন থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে যথেষ্ট আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক হচ্ছে। আলোচনাগুলো মূলত: তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক অন্যদের দ্বারা বিকৃতি, অসম্মান, অসুন্দর উপস্থাপন এবং ব্যবহার প্রসঙ্গ নিয়ে। “তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র” (অনলাইন)- গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রীঃ তারিখে একই প্রসঙ্গ একটি পোস্ট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় (facebook)। স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা – সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক শুরু হয় এবং নানা মতভেদ দেখা দেয়। মূলতঃ দুজন চাকমা যুবক-যুবতীর ‘খবং’ পরাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি তর্কের সূত্রপাত। তঞ্চঙ্গ্যাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংগুলো তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী “মাধা হাবং”( তঞ্চঙ্গ্যারা অনেক সময় খবং বা মাধা খবং’ও বলে। তবে গ্রামের মানুষজনকে ‘মাধা হাবং’ উচ্চারণ করতে শুনেছি । আমিও আমার লেখায় ‘মাধা হাবং’ শব্দটি ব্যবহার করছি) এবং চাকমা রমণীরা অতীতে কখনো এরকম খবং পরেনি এবং কেউ পরেছে সেরকমও চোখে পরেনি। পিনন, খাদি, ব্লাউজ এই থ্রী বস্ত্র চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান পোশাক। অন্যদিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকের মত- চাকমারা (পুরুষ-মহিলা) আগে থেকেই এই খবং ব্যবহার করতো। ব্যবহার না করার ফলে হারিয়ে ফেলেছে তবে বর্তমানে চেষ্টা করছে পুরনো ঐতিহ্যকে (খবং) ফিরিয়ে আনতে।

‘খবং’ কোন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বা করে না এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনস, যুক্তি-তর্কের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগটি এককভাবে আমার নেই, তাই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘কারা ঠিক বলছে?’ প্রশ্নটি সামনে রেখে একটু স্টাডি করতে শুরু করি। স্টাডি অংশ হিসেবে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি, চাকমা সমাজের কিছু গুণী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং সাথে কিছু পরিচিত চাকমা রমণীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি।

প্রথমে বই এর রেফারেন্স প্রসঙ্গে আছি- সুগত চাকমা তাঁর ‘বাংলাদেশের উপজাতি’ (পৃষ্ঠা-১২) গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫ খ্রী:, বাংলা একাডেমি, ঢাকা) চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে নিম্নাংগে ‘পিনোন’ এবং বক্ষবন্ধনী ‘খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরুষরা পোশাক হিসেবে কবোই, ধুতি, গামছা এবং খবং (এক জাতীয় পাগড়ি) ব্যবহার করেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন।

বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আর পুরুষদের পোশাক হিসেবে ধুতি, চাদর, উঞ্চীষ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে উক্ত গ্রন্থে।

ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন তাঁর ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ’ গ্রন্থে (প্রকাশ:১৮৬৯) যে ছবি (পৃষ্ঠা: ২৩৮ থেকে শুরু) তিনি ব্যবহার করেছেন সেখানে চাকমা রমণীদের (যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সকল মহিলার মধ্যে) পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় কোন খবং ছিল না। শুধু পিনন, খাদি, ব্লাউজ আর সাথে অলংকার ছিল।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ-১৯০৯ খ্রী:। পৃষ্ঠা-২২১) তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের পোশাক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- চাকমা পুরুষদিগের পোশাক ছিল সাধারণত হিন্দুগণের ন্যায়, দেখিতে বড়ুয়া অর্থাৎ বাঙ্গালী মঘ বলিয়াই মনে হয়। পৌঢ়সমাজ মস্তকে ‘খবং’ বাঁধিয়া থাকে। নানা পূজা, অনুষ্ঠানে সাধারণত তাঁরা এই খবংটি পরে থাকে। নারীরা খবং পরে বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেননি।

মুস্তফা মজিদ তাঁর ‘চাকমা জাতিসত্তা’ গ্রন্থে (প্রকাশ: ২০১৯ খ্রীঃ। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা -৮৮) তিনি চাকমা পৌঢ় বা বৃদ্ধরা খবং বাধঁতেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনোন এবং খাদি’র কথা উল্লেখ করেন। বস্ত্র হিসাবে খবং এর কথা তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৭। ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী'(৫) খন্ডে (এই খন্ডে মোট ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা আছে) ‘চাকমা’ পর্বে (লেখক: সুগত চাকমা) যে পোশাক-পরিচ্ছদ এর বর্ণনা আছে (পৃষ্ঠা:৭৪-৭৬) সেখানে লেখক চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম শুধু ‘পিনোন- খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাথায় সাদা কাপড় এবং মধ্যবয়সী মহিলারা অন্য রঙযুক্ত কাপড় সামান্য পেঁচিয়ে পরেন বলে মত দেন। এই পেচাঁনো কাপড়কে তিনি ‘খবং’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুল খোলা অবস্থায় খাবারে বা যত্রতত্র যাতে চুল না পড়ে (চুল দিয়ে অনেকে কালো যাদু করে এই আশঙ্কা থেকে), জুমে বা জমিতে খররৌদ্র, ঝুড়ি বহনে সহায়ক হিসেবে এই খবং এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও খবং চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যের একটি পোশাক সে কথাটি উল্লেখ করেননি। ৩১/১২/২০২২ খ্রি: পরিবার নিয়ে আগ্রাবাদস্থ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঘুরতে গেলাম আমরা, যে কথাটি শুরুতেই বলেছি আমি। জাদুঘরে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রদর্শন রয়েছে। সেখানে চাকমা রমণীদের ব্যবহার্য বস্ত্র হিসাবে ‘খবং’ ছিল এরকম কোন প্রদর্শনী আমার চোখে পড়েনি, সঙ্গে যারা ছিল তাদেরও চোখে পড়েনি।

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” (প্রকাশ:১৯৯৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে খবং বা মাধা হাবং এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ গ্রন্থেও একই কথা লিখেছেন। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি’ গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের খবং বা মাধা হাবং ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে করে আমার মনে হয়েছে ‘খবং’ চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী বা সংস্কৃতির অংশের পোশাক নয় বিধায় লেখকগন (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেনি বা এড়িয়ে গেছেন।

এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে আসি-

চাকমা ইতিহাস রচয়িতাদের (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) গ্রন্থে কোথাও ‘খবং’ হিসেবে চাকমা রমণীদের পোশাক ছিল এই কথাটি উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে চাকমা জাতির দু’জন বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষকের সাথে কথা হয় আমার । তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল উল্লেখিত ব্যক্তিদের লেখার মধ্যে তো চাকমা রমণীদের খবং ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উল্লেখ নেই। তাই আমি বা আমরা কি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি চাকমা রমণীদের ‘খবং’ এর ব্যবহার ছিল না অতীত থেকে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আশ্চর্য এবং অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন আমাকে। তিনি বললেন- বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা মহোদয়রা কখনো চাকমা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। কথাটি শুনে আমি বিষম অবাক হলাম এবং শক খেয়েছি। কারণ আমি যতটুকু জানি একজন লেখক যখন নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেন, তিনি কিন্তু প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অগোচরে নিজের এবং জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাথে এটাও সত্য আমরা সকলে কোন না কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করি। বিষয়টি নিয়ে আমি আরো পরিচিত কয়েকজন চাকমা জনগোষ্ঠীর রমণীর সাথে কথা বলি। সকলেই মত দেন চাকমাদের (পুরুষ মহিলা উভয়ে) মধ্যে অনেক আগে থেকে খবং ব্যবহার ছিল। তবে এখন ব্যবহার করে না আগের মতো। তাদের সকলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে- খবং তাঁরা (চাকমা) আত্মরক্ষার বস্ত্র (ধুলোবালি, রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা এবং কাঠ, পানি বহনের সময় নিরাপত্তা) হিসেবে ব্যবহার করতো। তাছাড়া কোন অনুষ্ঠান (যেমনঃ বৈদ্যরা তাদের পূজা অর্চনা) সময় এটি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে । আর বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বরণ, অভিষেক (রাজ্যাভিষেক) সময়ও এই খবং ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে। তবে সব তথ্যকে চাপিয়ে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন- চাকমারা ‘খবং’ ব্যবহার করলেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘পাঁচ কাপড়'(মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পাদুরি, পিনন) এর মতো অবিচ্ছেদ্য কোন বস্ত্র নয় এটি। তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বা কাঠামো নেই। এক টুকরো সাদা কাপড়,অনেক সময় ফুল তোলা কাপড় (আমি আমার দিদিকেও দেখেছি ফুল তুলে মাপলার বুনতে। বাবা এবং আমাদের জন্য), গামছা, তোয়ালে, মাপলারও এই খবং হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিনা আমরা? চাকমাদের ‘খবং’ ব্যবহার ছিল সিজনাল (Seasonal) আর তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘মাধা হাবং’ ব্যবহার ছিল ট্রেডিশনাল (Traditional)।

খবং’ বা পোশাক হিসেবে কে কি কাপড় ব্যবহার করবে এটি ব্যক্তির বা জাতির পছন্দ-অপছন্দ এবং রুচির ব্যাপার, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা -সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো কাউকে নিষেধ করেনি বা বলেনি যে, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ছাড়া কেউ এই ‘তঞ্চঙ্গ্যা পোশাক’ পরতে পারবে না, অবশ্যই পরতে পারবে। তবে পরার পেছনে কোন অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্য এবং বিকৃত উপস্থাপন যেন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যে পরে একে অন্যের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সন্মান করার। সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক, ছোট নৃ-গোষ্ঠীরা যেন সকল বিষয়ে আগ্রাসনের স্বীকার না হয়। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের “মাধা হাবং” কে চাকমা জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘খবং’ এর অংশ হিসেবে যদি দাবি বা উপস্থাপন করেন বা করতে চান তখন অবশ্যই যুক্তি-তর্ক, আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন আছে, সাথে প্রতিবাদও হবে। কারণ আমরা চাইলে চাকমা রমণীদের পিননকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পিনন হিসেবে দাবী করতে পারবো না। দাবির পিছনে ঐতিহাসিক, যৌক্তিক একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার থাকতে হবে। আমি মনে করি চাকমা জনগোষ্ঠীর সে সুযোগটি নেই, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবংকে তাদের ‘চাকমা খবং’ হিসেবে দাবি করার বা প্রতিষ্ঠা করার। অন্তত সেই প্রমাণ বা কথাটি বলছে বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা এর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ এবং অন্যান্য গবেষণাপত্র। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের কাছে মাধা হাবং মানে গামছা, তোয়ালে, মাপলার বা সাদা কাপড় নয়। তাদের কাছে খবং মানে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ের (মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি, পিনন) অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম, ঐতিহ্য, প্রতীক এর নাম। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ে একটা স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা রয়েছে। এই কাপড়গুলো বুনার সময় মেয়েরা নানা নকশা এবং ফুল তুলেন। এই ফুলগুলো তারা জুম এবং প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। সুতরাং মাধা হাবং সহ অন্য সকল পোশাকের ফুলের সাথে ঐতিহ, জুম এবং প্রকৃতির একটা হৃদতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা নিম্নে ফুলগুলো সাধারণত তাদের মাধা হাবং এ ব্যবহার করে- “দাঅর পদ্ম ফুল, চিয়ন পদ্ম ফুল, কর্ণধাদী ফুল, ক্যারাবক ফুল, উলু ফুল, বুলচুগ্ ফুল, তালুকতিজ্যা ফুল, বিসইন ফুল, চাবুরি ফুল, সাম্মাদোলি ফুল, কুরাচুগ্ ফুল, বেয়ুনবিচি ফুল, গাইত ফুল, কই ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কুমড়া বুক ফুল, দিইহরা ফুল, কা-রা বিচি ফুল, আলসুরি ফুল, পাইন্যাপোক ফুল, আয়ত্তলা ফুল (তুলতে ভুলে গেলে অমঙ্গল হয়), মাম্মাবিচি ফুল, কা-ড়া দার ফুল, পাইন্নাঙ ফুল, ছেরাবক ফুল, সুচ্ছাং ফুল, রোবক ফুল, ঘিলাটাক ফুল, রে ফুল” দিয়ে মাধা হাবং বুনা হয়। শুধু মাধা হাবং নয়, পিনন, জুম্ময়া খাদি, জুম্ময়া সালুম, পা-দুরির জন্যও আলাদা আলাদা ফুল রয়েছে। তবে প্রায় জুম্ময়া সালুম, মাধা হাবং, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি’র জন্য ঘুরেফিরে একই ফুল ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কে কোন ফুল কোথায় ব্যবহার করবে নিজের পছন্দ অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আর তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো ‘মাধা হাবং’কে আলাদা করে ‘খবং’ বা ‘হবং’ বলে না। শব্দটি ‘মাধা হাবং’ যুগল করে বলে। পুরনো দিনে এই পাঁচ কাপড় আমাদের রমণীরা সব সময় পরতো। বর্তমান সময়ে সব সময় না পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহারে দিন দিন সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা দলবেঁধে পাঁচ কাপড় পরে যাচ্ছে। এতে জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রচার হচ্ছে এবং পাশাপাশি জাতির প্রতি দায়িত্ব, গৌরব ও অহংবোধ তৈরি হচ্ছে। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা বর্তমানে বক্ষবন্ধনী হিসেবে যে খাদিটি ব্যবহার করে সেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম্ময়া খাদি’ নয়। সেটি চাকমা খাদি। তঞ্চঙ্গ্যা খাদি বৈচিত্র্যময়, ইউনিক এবং আভিজাত্য। আর বর্তমান বৈচিত্র্যতা এবং আধুনিক নামে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাককে ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলে নানা রকম বাহারী ডিজাইনে এত বিকৃত করা হচ্ছে কিছুদিন পর তঞ্চঙ্গ্যা পাঁচ পোশাক তার ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা হারাতে বসবে। তখন হয়তো তঞ্চঙ্গ্যা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে, বলতে হবে। এটি আমাদের জাতির জন্য অশনিসংকেত। এই পোশাক বিকৃতি আমাদের জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নষ্ট করছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যময় বৈচিত্র্যতাকে।

যে ছবি নিয়ে এত যুক্তি-তর্ক, আলোচনা -সমালোচনা, চাকমা লেখকদের খবং বর্ণনায় খবং এর অনুপস্থিতি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবং- তৈরিতে ফুলের যে ব্যবহার এই থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘মাধা হাবং’ ছিল(!!!) সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বিচারের ভারটি পাঠক গবেষক এবং সুধীমহলের জন্য তোলা রইল। আর বর্তমান সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অনেকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী হয়তো এসব কাপড়গুলো (খবং) পেয়েছে। এসব কাপড় বিক্রয়ে বিক্রেতা হয়তো সাময়িক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় কিন্তু সাথে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাদের নামে সাপ্তাহিক ক্রিয়া (সংঘদানে) এই পাঁচ কাপড় দান হিসেবে দেওয়ার একটা প্রচলন আছে। পুনর্জন্মে তাঁর (মৃত ব্যক্তিনীর) যেন কাপড়ের অভাব না হয় এই বিশ্বাস থেকে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) এই পাঁচ কাপড় দান করে। এগুলো অনেকে পুরো সেট (পাঁচ কাপড়) ভান্তে থেকে নামমাত্র ৩০০-৫০০ মূল্যে কিনে অন্যজনদের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে দেওয়ারও কথা প্রচলন রয়েছে সমাজে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে একটা সংস্কার প্রচলিত আছে এসব মরা-মৃত্যু এবং দানীয় বস্তু(কাপড়) বিধবা মহিলা ছাড়া কেউ পরতে পারে না, পরলে অমঙ্গল হয়। আরো অনেকে মত দেন যে, তঞ্চঙ্গ্যা ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ের মাধ্যমেও তাঁর আত্নীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড়ের প্রসার এবং অপব্যবহার ঘটছে। যে খবং নিয়ে এত বিতর্ক এবং আলোচনা চাকমাদের মধ্যে নতুন করে এর প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বয়স কিন্তু বেশিদিন নয়, বছর ৪/৫ হবে মাত্র।

আর নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক নিজের কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, সন্মান, শ্রদ্ধার। অন্যদের কাছে এটি শুধু একটি পরনের বস্ত্র। সুতরাং তাদের হাতে এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি। এই শঙ্কা তৈরি থেকে আজকে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে হচ্ছে। এই তঞ্চঙ্গ্যা পোশাককে বিকৃত উপস্থাপন (নৃত্যে) নিয়ে এর আগেও আমার বেশ কিছু লেখা, আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে।

খবং হিসেবে কে, কি কাপড় ব্যবহার করবে একজন ব্যক্তি বা জাতির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তবে অসঙ্গতি প্রশ্নে অবশ্যই তর্ক বির্তকের প্রয়োজন আছে। সময়ের ব্যবধানে তঞ্চঙ্গ্যারা মহামূল্যবান ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ/সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে মত দেন- চুরি হয়ে গেছে। সময়, সুযোগের অপব্যবহার করে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাধামন ধনপুদি পালা, গেঙ্গুলীর উবাগীত, শিবচরণ এর গোসাইনলামাসহ সকল উপাদানগুলো। এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমা জনগোষ্ঠী উভয় নিজেদের বলে দাবী করে। এখন তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের একটি অংশ “মাধা হাবং” এর উপর এত আলোচনা যুক্তি তর্ক মূলতঃ অতীতের অসুন্দর অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা থেকে। তাই তঞ্চঙ্গ্যারা আর চাই না নতুন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় এবং অন্য সকল সংস্কৃতি উপাদানগুলো চুরি বা বেহাত হয়ে যাক। তাই তারা চাই সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকুক তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি উপাদানগুলো।

এই আলোচনা যুক্তি তর্ক আসলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্ম, চিন্তা, মেধা এবং চেষ্টাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য নয়, আমাদের একে অপরের সংস্কৃতিকে সন্মান এবং ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ও সহযোগিতা মানস গড়ে তোলার লক্ষ্য এই আলোচনা। আর এই আলোচনায় আমি আমার জাতির অস্তিত্ব এবং সংকটের কথা বলছি, আমার অধিকারের কথা বলছি। কারো অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার কথা বলছি না। সময়ের দাবী হিসেবে হয়তো হয়তো আমরা অনেক কিছু গ্রহন করেছি আর অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। কিন্তু যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা সংরক্ষণের নিমিত্তে আর নিজেদের শেকড়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ও প্রশ্নে আমাদের সচেতন হওয়া এবং এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলকে নিতে হবে। হ্যাঁ অনেকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা লিখতে চান না, তাঁরা এর বদলে সম্প্রীতি ভ্রাতৃপ্রেমের কথা বলেন। আমরাও অবশ্যই সকলে চাই সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বপ্রেমের। কিন্তু আমাদের এটাও সাথে মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতের সংকটের সময় নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের কথা বলতে হবে জানান দিতে হবে। তাই আমি মনে করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যেখানে জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব হুমকি, সংকট তৈরি হবে সেখানে আওয়াজ তুলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐক্যে জাতি এগিয়ে যাবে। জাতি হবে সমৃদ্ধ উর্বর। প্রাণ ফিরে পাবে তার হারানো অতীত ঐতিহ্য গৌরব।

আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ককে সাথে নিয়ে সত্য, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অনুপ্রেরণা হোক আমাদের পথ চলা। আর আগ্রাসনের স্বীকার না হয়ে আমাদের সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক, সংরক্ষণ থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়।

———————

ছবি- বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া। তাই নির্দিষ্ট কাউকে ছবির ক্রেডিট দিতে পারছি না। তার জন্য সকলের কাছে সুন্দর ক্ষমা প্রার্থনা কামনা করছি।

———————

*সাবেক সম্পাদকঃ ‘পহর জাঙাল’, ‘রঁদেভু’ এবং ‘সিঙকাবা’ প্রকাশনা।

পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর ১ম ম্যাজিষ্ট্রেট প্রয়াত জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যার কর্মজীবন।

লেখক: বিশু তনচংগ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর প্রথম বি.কম. এল.এল.বি পাশ করা ম্যাজিষ্ট্রেট জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা । কবি কার্তিক চন্দ্র ে বড় ছেলে জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৪০ সালে ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজা রাঙামাটি সদর মহকুমায় জন্ম গ্রহণ করেন। 

তারা দুই মায়ের ৭ বোন এবং ৫ ভাই মোট ১২ ভাইবোন ছিলেন। 

রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি লাভকারী তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম ব্যাক্তি তিনি। তারপরে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা মঞ্জু। জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৯ সালে ইষ্ট পাকিস্তান সার্ভিস কমিশনের (ইপিসিএস- বর্তমানে বিসিএস) অধীনে চট্টগ্রামের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম সুনামগঞ্জ,পাবনা ও সিরাজগঞ্জে

 ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সদরে সাব ডিভিশনাল কর্মকর্তা, ৪ জানুয়ারি ১৯৮২ থেকে ২১ অক্টোবর ১৯৮২ রাজশাহীতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১ নভেম্বর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সারিয়াকান্দি বগুড়াতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক, ১৯৮৯-৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে মন্ত্রীর একান্ত সচিব, ১৯৯১ সালে মৌলভিবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভুমি মন্ত্রণালয়ের ভুমি জরিপ অধিদপ্তরের উপ মহা পরিচালক, ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং সর্বশেষ ১২ মে ১৯৯৯ সাল থেকে দুই বছর চুক্তি ভিত্তিক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলিক পরিষদের সর্বপ্রথম মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন এক ছেলে ও‌ দুই মেয়ে সন্তানের পিতা। তার একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী অনুপম তঞ্চঙ্গ্যা বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী। অনুপমের বড়বোন জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা স্বপরিবারে দুবাই ও ছোট বোন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জয়া তঞ্চঙ্গ্যা অষ্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেন। স্ত্রী নিরুপমা তঞ্চঙ্গ্যা ২০১৬ সালে পরলোক গমন করেন।

এবং জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা গত ৮ জানুয়ারী ২০১৯ সোমবার বিকাল ৩ টায় রাঙামাটি শহরের পূর্ব ট্রাইবেল আদামের নিজ বাস ভবনে বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি পরলোক গমন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। প্রয়াত জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা তিনি এক ছেলে দুই মেয়ে সহ আদিবাসীদের মধ্যে ১ম বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজনকে রেখে যান।

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাঃ একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে জন্ম

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সাহিত্যটা গড়ে উঠে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে বিশেষ করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যটা। জুম চাষের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাহিত্যের স্বপ্নগুলিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং জীবনের বীজ বুনতো। তঞ্চঙ্গ্যারা এই জুমকে ভালোবাসে এবং এই জুম সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা সেই স্বরণাতীতকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। স্বরণযোগ্য যে বর্তমানে যারা তন্চংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত, এককালে তারা দাইনাক বা দৈনাক পরিচয়ে আরাকান বা মায়ানমারের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য দান্যাওয়াদি থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। পরবর্তীতে তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে কক্সবাজার, টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী তৈনছড়ি-তৈনগাঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির অন্যান্য অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলার রইস্যাবিলি রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে। তবে কক্সবাজার এবং টেকনাফের তঞ্চঙ্গ্যারা এখনো অনেকে চাকমা পদবী ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন তঞ্চঙ্গ্যার ‘মো’ গছাদের মতো। আবার অনেকে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে আসল চাকমা বলেও মানেন, এটি অবশ্যই ইতিহাসের পাঠ্য। পরে অনেকে কাপ্তাই বাঁধের নতুন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী ও স্বীকার পরবর্তী বাসিন্দা ভারতের নানা প্রদেশ। সাধক কবি শিবচরণ, রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থির এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি আজ একটি  আলোকিত জাতি হিসেবে স্বকৃীত।   

আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকে একটি চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত, তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিয়ে। আমি যতটুকু জানি তঞ্চঙ্গ্যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলি তঞ্চঙ্গ্যাারা রক্ষা বা লালন-পালন করতে পারেনি এটি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ব্যর্থটা নয় এটি ঐতিহাসিকতার ব্যর্থটার ফল। 

তন্চংগ্যাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল শুধু এই কথা বলে বসে থাকলে আমাদের চলবে না,চর্চা এবং লালন-পালন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মুলতঃ এই আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্চংগ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রকাশনা বের করার চিন্তাটা প্রথমে আমার মাথায় আসে যখন আমি ২০০১-০২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্র্তি হই। তাছাড়া আমি যতদূর জানি তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়মিত কোন প্রকাশনা বের হয় না। পরে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকাশনা বের করার। অনেক নাম প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অজয় দা’র (অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা) দেওয়া নাম ‘পহ্ জাঙাল সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এরপর ১লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৩ ইংরেজী পহ্র জাঙাল প্রথম সংখ্যা সফলভাবে প্রকাশিত হয় এবং উদ্বোধনী সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন পলাশ তন্চংগ্যা। ১১ই এপ্রিল’০৩ ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এটির প্রথম সংখ্যা মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে অবশ্যই বলাকা, বিষু, ছিনা-মোইন(২০০২)এক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পহ্র জাঙাল এর হাত ধরে তৈনগাঙ, রাঙাফুল, ন-আ শমন প্রকাশ হয়। তৈনগাঙ এখনো নিয়মিত প্রকাশ হলেও বাকীগুলো কিছু সংখ্যার পর আর প্রকাশ হয়নি। তবে প্রতিটি সংখ্যায় এক ঝাক প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আগমনীর বার্তা আমাদের আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণীত করেছিল।তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- 

(ক)    প্রথম ভাগে– সাধক শিবচরণ এবং ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী

(খ)     দ্বিতীয় ভাগে– রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র 

তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির,ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির,যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর 

কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

(গ)     তৃতীয় ভাগে– লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যাড.দীন নাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, 

ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন),পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় 

বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা,উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা 

(মনিচান), দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা। আরো অনেকে। 

 ক. প্রথম ভাগের লেখকদের মধ্যে আমি তন্চংগ্যা সাহিত্যের পটভূমিকার সমৃদ্ধ বীজ লক্ষ্য করি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেও এই লক্ষণটি সম্প্রসারিত হয়। যদিও প্রথম ভাগটি শুরু হয় মধ্যযুগীও সাহিত্যের সাথে মিল রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে। এটি মূলতঃ লেখকের সাথে সময়ের একটি যোগসূত্র, আমরা এটাকে সময় বা সমাজের চাহিদাও বলতে পারি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভাগের রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের লেখার মধ্যেও এই লক্ষণটি স্পষ্ট। তবে এখানে ইতিহাসও যোগ হয়েছে। মূলত একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের জন্ম। যা জাতি হিসেবে যে কেউ গর্ববোধ করতে পারে। তারা সমাজ এবং ইতিহাসকে সাথে নিয়ে বাংলা, তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা ভাষায় এইসব রচনা করেন। 

খ. দ্বিতীয় ভাগের প্রত্যেকটি লেখক সমাজ সচেতন ও প্রগতিযশা ছিলেন। সমাজ ও জাতির জন্য তাদের অবদান অনেক। রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যার নিজস্ব হস্তচালিত প্রেস ছিল। সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রেস। এখানে উল্লেখ্য যে, বিংশ শতকের দিকে এসে ‘গৈরিকা’(১৯৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের একটা ধারা সৃষ্টি করলেও তার আগে কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’(১৯৩১),‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’(১৯৩৩) রচিত হয়। তার এই ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’পয়ার ছন্দে রচিত একটি মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। এই প্রেক্ষিতে তন্চংগ্যা সাহিত্যিকগণই গৈরিকার পথ প্রর্দশক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ধর্ম-সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি (ড.মনিরুজ্জামান, পহর জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা-২০০৮, পৃষ্ঠা-১০)। এই পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাাকে রাজা ভুবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে ছন্দ বাক্য রচনা করতে পারতেন(তথ্যঃ এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা)। ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’ সম্পাদনা ও সংশোধিত আকারে প্রকাশের জন্য রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক ‘পন্ডিত’ এবং রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রিয়দর্শী ভিক্ষু কর্তৃক ‘উদয়ন বস্তু’ রচনার জন্য তাকে ‘কবিরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট্য ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাকে ‘পাহাড়ী বাংলার কবি’ বলেছেন। তার কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক (কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) তাঁর পুত্র দিলিপ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার মাধ্যমে উদ্ধার করেন ১২ই জুন ২০০৮ সনে রাজস্থলী থেকে। তার এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক দায়িত্ব নিয়ে ‘পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ’ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে রাধামন ধনপতি কাব্য, বিজয়গিরি, মানুষ দেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সবার ক্ষেত্রেও পহ্র জাঙাল একই আগ্রহ পোষণ করে।  আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিস্তারে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রাজা ত্রিদিব রায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ‘রাজগুরু’ পদে বরণ করেন। এর আগে রাজা নলিনাক্ষ রায় কর্তৃক শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরকেও (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা) ‘রাজগুরু’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত‘ষষ্ঠ বিশ্ব বৌদ্ধ মহাসংগীতি’তে একজন সংগীতিকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। তারই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজক কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপন্ডিত উপাধিতে সম্মানিত করেন। এছাড়া ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক তাকে ‘অগ্গমহাসধম্মজোতিকাধ্বজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এর মাধ্যমে সম্ভবতঃ পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে তন্চংগ্যারাই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার সুবিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘রাউলী’ সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়। সেসময় রাউলী সম্প্রদায় চাকমা ও বড়ুয়াদের ধর্মীয় পুরোহিত হিসেবে ছিলেন। এই অগ্রবংশ মহাস্থবির ও ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের অপ্রকাশিত অনেক লেখা রয়ে গেছে। এই লেখাগুলি ছাপানোর ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন এবং বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কারণ এগুলি আমাদের জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। আমি যতটুকু শুনেছি এরই মধ্যে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুযোগে কেউ হয়তো নিজের নামে চালিয়ে বা ছাপিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যেটা হলে আমরা ঠিক আগের মতো ঐতিহাসিক ভাবে আবার ভুল করবো বা ভুল করতে যাচ্ছি।

 গ. তৃতীয় ভাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। তার লেখার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণাদায়কও তিনি। আমার জানা মতে ১৫-২০টি পসন এবং ৩৫০-৪০০টি প্রবাদ তার সংগ্রহে রয়েছে যা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ড.মনিরুজ্জামান স্যারকে তার ‘প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ’(৫ম সংখ্যা, ৯ই আগস্ট-২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) লেখার জন্য এই প্রবাদ সংগ্রহশালা থেকে লেখক রেফাসেন্স হিসেবে সংগ্রহ করে দেন। ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাসের পুরনো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত ‘আদামর ফুল’ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ যা পহ্র জাঙাল প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আর এ্যাড. দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ নামে একটি লেখা ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র ৫ম ভলিউমে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘বাংলা পিডিয়া’তেও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। নারী লেখিকাদের মধ্যে পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা অগ্রগামী, পুরো পার্বত্য অঞ্চলেও তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তার লেখা সাহিত্যগুলি জুম্ম জাতি ও নারী সমাজকে আলোড়িত করে। পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা নারী লেখকের প্রতিনিধি। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘পহ্র জাঙাল’ প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং উদ্যেগটা। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। তার মোট প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় ১৫-২০টি। তার লেখা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (বাতকস) এর মুখপত্র সিঙকাবা এর প্রধান সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত আদিবাসীদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রদেঁভু’ এর তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাস এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘খৈয়ুম’ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূপছায়া’ এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্ভবত তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক।   

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাটি এগিয়েছে কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান এবং সময়ের পটভূমিকে কেন্দ্র করে।

১. জুম সাহিত্যঃ 

পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুম চাষের জন্য প্রতি বছর উর্বর জায়গার সন্ধানে পাহাড়ের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরীত হয়। যার ফলে তাদের জীবনচক্রও গড়ে উঠেছে এই জুমকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের জীবন ধারণ এবং সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে জুম উঠে এসেছে খুব সহজে। যেটি আমরা লক্ষ্য করেছি তন্চংগ্যাদের আদি সাহিত্যের মধ্যেও। বারোমাস,উভাগীত,পসন্,ধাঁধা,কবিতা,ছড়ার মধ্যে আমরা এই জুমকে খুজে পাই। এই জুমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পালাও রচিত হয় তার মধ্যে ‘জুম কাবা, রাইন্যা বেড়ানা পালা’ অন্যতম। ইতিহাস বলে তৎসময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও চিত্ত বিলাসের অন্যতম স্থানও এই জুম। যেটি গিংগুলী গানের গায়কের কন্ঠে আমরা লক্ষ্য করি। বিষ’ুর সময় যে পাইসন রান্না হয় তার বেশী ভাগ সবজি কিন্তু পাওয়া যায় এই জুম থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড়(পিনউন, খাদি, মাদা কাবং, পা-দুরি, সালুম) বুননে যে ফুল গুলি ব্যবহার করা হয় তার বেশীর ভাগ নাম এই জুম সবজি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায়(এম.এল.ই) যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওখানেও জুম বিষয়ে গল্প, ছড়ার বই ও থিম পিকচার করা হয়েছে। বর্তমানের লেখকদের মধ্যেও এই জুম সংস্কৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

২. সাধক শিবচরণ এবং গসাইন্ লামাঃ

আমরা কম-বেশী সবাই শিবচরকে কবি হিসেবে চিনলেও কিন্তু কবি’র চেয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাধক বা ব্যাদি হিসেবে বড় ছিলেন। ব্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এই আছে এই নেই,তারা মুহুত্বের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তারা চারিযুগ অমর এবং যমসুরী। এই চারিযুগ হচ্ছে-সত্যযুগ,দ্বাপরযুগ,টেট্টাযুগ ও কলিযুগ। শিবচরণ শৈশব কাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। জগৎ সংসার থেকে মুক্তিই যেন তার একমাত্র নেশা। তার আধ্যাত্বিকটা মা,ভাই ও ভাবীকে ভাবনা এবং চিন্তার দোলাচলে ফেলে দিলেও মাঝে মধ্যে বৎসনা করতেন জগৎ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা দেখে। 

শিবচরণ ‘মানবজন্ম’ এবং ‘ফুইরা আলাম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেন। ‘মানবজন্ম’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের শরীরগত বিদ্যাকে নিয়ে। শরীর কি,শরীর কি দিয়ে তৈরী বা গঠিত হয়েছে,শরীরের কোথায় কি আছে,কার কি কাজ ইত্যাদি বিষয়কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘ফুইরা আলাম’ গ্রন্থে তন্চংগ্যাদের ৩৬(ছত্রিশ)টি অক্ষরের(বর্ণমালা)বর্ণনা আছে। যেগুলোকে  ‘আন্জী অক্ষর’ বলা হয়। আনজী অক্ষর হলো-একটি অক্ষরের ‘গভীরতম অর্থ’ যেখানে সৃষ্টির পেছনে কারণ বা রহস্য নিহিত থাকে। যেমন-‘অ’তে বুদ্ধ অনিত্য বুঝেছেন। এই অক্ষরগুলো মাধ্যমে পুরো শরীরের অবস্থান,অংশ বা গঠনকে বুঝা যায়। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার কোথায় অবস্থান এই আনজী অক্ষর দিয়ে নির্ধারণ এবং চিহ্নিত করা যায়। বৈদ্য বা কবিরাজ-রা এই আনজী অক্ষরের মাধ্যমে ‘নাড়ীবেদ’ পরীক্ষা করে রোগী চিকিস্যা করে। এই বিষয়ে প্রত্যেকটি বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। ‘মানবজন্ম ও ফুইরা আলাম’ দুটো গ্রন্থের ভূমিকা হচ্ছে মূলতঃ গসাইন বা গোসাইন লামা। শিবচরণ সাধক বা ব্যাদি ছিলেন। (তথ্যঃ বৈদ্য ফুলেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা,গর্জনীয়া পাড়া-ওয়া¹া,বয়স:৬৫,তারিখঃ১১/০৯/২০১০,রোজ শনিবার)। তিনি তার গসাইন্ বা গোসাইন্ লামায় উল্লেখ করেছেন যে,“সাকিন্ ছালাম য্যং মুই কাপ্তেই গাং,মানিয়া পুরীত্তুন্ তুরি যাং” অর্থাৎ সাকিন কাপ্তাই গাঙকে ছালাম জানিয়ে,আমি মনুষ্য ধরাধম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে,চাকমারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গোজেন বলে না। তারা বলে গোই(ঐ)। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গসাইন বা গোসাইন বলে। তাছাড়া আমি আরো লক্ষ্য করেছি যে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান কর্তৃক সংগৃহীত ‘চাকমা ভাষায় শব্দ কোষে’গ্রন্থে(সুগত চাকমা কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯৬ সনে প্রকাশিত) গোজেন শব্দটি অনুপস্থিত। গসাইন বা গোসাইন লামা গ্রন্থ থেকে জানা যায় শিবচরণের জন্ম ১১৮৪ মঘী বা মঘাব্দ আর ইংরেজী সন হচ্ছে ১৮২২ সাল। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)

এই সাধক বা ব্যাদি শিবচরণের জন্ম কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ে। আবার অনেকের মতে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত রাজস্থলী বাজারের নিকটবর্তী বাজার নাড়ামূখ পাড়া গ্রামে। লক্ষনীয় বিষয় দুটি নামের মধ্যে কিন্তু একটা শব্দগত মিল আছে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে এই পাড়ার পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নাম কাইত্তি গাঙ বা কাপ্তাই নদী। তাছাড়া আগে কাপ্তাই,বিলাইছড়ি,রাজস্থলীটি চন্দ্রঘোনার থানার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এই পাড়ার গ্রামবাসীরা এক সময় মাতামহুরীর তৈনগাঙে বসতি স্থাপন করেন। আমরা যদি ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখব তন্চংগ্যারা আরাকান থেকে এসে প্রথমে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা ছোট ছোট অংশে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে(রাইংখং,কাপ্তাই ওয়া¹া অঞ্চল)। আর তারা আরাকান থেকে আসার সময় কাল্লাঙের (ঝুড়ি) করে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে আসে।(রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)। পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণে তারা তাদের এত দিনের বাসস্থান(কাপ্তাই)ছেড়ে আবার তাদের আদি বাসস্থান মাতামুহুরি নদীর উপনদী তৈনছড়িতে চলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সবাই অবগত যে তৈনছড়ি বা তৈনগাঙ এর সাথে তন্চংগ্যাদের ইতিহাস অতোপ্রতোভাবে জড়িত আর এখানেই কিন্তু শিবচরণের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। এই ঐতিহাসিক যুক্তি বা তথ্য থেকেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় কিনা-কবি শিবচরণ তন্চংগ্যা জাতির গর্বিত সন্তান ছিলেন। তার রচিত গসাইন/গোসাইন লামা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এর সাথে গেঙ্গুলী বা উবাগীতের পালা,বারোমাস,গল্প,প্রবাদ-প্রবচনের মতো ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলিও দাবীর তালিকায় থেকে যাচ্ছে। কারণ শিবচরণের গসাইন লামার সাথে এইসব সৃষ্টির একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যদি উল্লেখিত বিষয় বা মতগুলি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয় তাহলে আমি বলবো পার্বত্য জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস বিশেষ করে চাকমা জাতির ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন করে ভাববার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বা সময় এসেছে।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা, বর্ণমালা ও ভাষার বই

 তন্চংগ্যাদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বর কোমল ও নরম। উচ্চস্বরে এবং গলা তুলে কথা বলা তাদের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাদের স্বরের মধ্যে সবসময় নরম ও কোমল টান লক্ষণীয়। বর্তমানে এসে ভাষার আদিরূপটা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন লক্ষনীয় হলেও বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা নিজ ভাষা ব্যবহার ও চর্চাকে অধিকারবোধ থেকে চিন্তা এবং বিচার করে। তারা সবসময় সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকে চর্চার অভাবে নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কিনা বা অন্যের ভাষার প্রভাবে নিজ ভাষা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষনীয়। জানিনা তারা নিজেদেরকে অভার র্স্মাট বা অতি বিশ্বায়নী হিসেবে ভাবেন কিনা। আমি ভাষা জানাকে প্রয়োজনীয় হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের সমৃদ্ধ ভাষাকে ছেড়ে অন্যের ভাষাকে নিজ মাতৃভাষার মতো ধারণ এবং চর্চাকে প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। ভাষার মধ্যে দিয়ে কিন্তু জাতির পরিচয় ফুটে উঠে বা বহন করে। ভাষার মাধ্যমেই জানা যায় কে কোন জাতির বা জনগোষ্ঠীর লোক। এই মাঝে ভাষা নিয়ে নিজের একটা চোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- একদিন অফিস থেকে বের হয়ে গরু দুধ কিনব বলে দোকানে গিয়ে দোকানিকে (দোকানি ৪০/৪৫ বছর বয়সের একজন চাকমা ভদ্র মহিলা) বললাম তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়- ‘ম-ই গোরু দোউত্ আহে’ ( মাসি গরু দুধ আছে)। আমার কথা শুনে দোকানি বলল- আছে। আমার কথা শুনে চাকমা ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- তুই কি তঞ্চঙ্গ্য নে ? আমি বললাম হ্যাঁ। পরবর্তীতে আমি চিন্তা করলাম শুধুমাত্র ভাষার জন্য হয়তো উনি আমাকে ‘বাবু আপনি তঞ্চঙ্গ্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন বা চিনতে পেরেছেন। না হলে হয়তো উনিও দশজনের  মতো চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে আমাকেও একজন চাকমা বলে জানতেন। সুতরাং শুধুমাত্র ভাষার কারণে উনি আমাকে তন্চংগ্যা হিসেবে চিনতে পেরেছেন, অন্যথায় নয়। হয়তো এই উপলদ্ধি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন আগে নিজ ভাষা গাথুনী পরে অন্য ভাষা। কারণ আমি বুঝি আমি যদি আমার ভাষা চর্চা বা ব্যবহার না করি অন্য কেউ এসে তা করে দিবে না। আর সেটি চর্চার অভাবে কোন একদিন হারিয়ে যাবে। আর আমরা সবাই অবগত প্রতিদিন পৃথিবী থেকে দুই/একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তন্চংগ্যাদের ভাষাও যে হারিয়ে যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তঞ্চঙ্গ্যাদর ভাষা ও বর্ণমালা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ১২টি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যেও নিজস্ব বর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা এবং বর্ণমালা নেই তাহলে তিনি আইনগত অপরাধী হিসেবে গন্য হবেন। এর আগে অবশ্যই বর্ণমালা ব্যবহার ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা বৈদ্যরা অগ্রগামী। তবে শুনে এসেছি তন্চংগ্যা বৈদ্যরা যে বর্ণমালা ব্যবহার করতেন সেগুলো নাকি চাকমা বর্ণমালা। পরে ইতিহাস পাঠে জেনেছি তঞ্চঙ্গ্যারা যদি আসল চাকমা হন তাহলেতো এই বর্ণমালাগুলি চাকমা বর্ণমালা পক্ষান্তরে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সাথে বর্তমান উভয়(তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা) বর্ণমালার একটা সাদৃশ্যের ঐক্যমান লক্ষণীয়। যেটি চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- তঞ্চঙ্গ্যারা অধিক মাত্রায় বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে (কিছিম্যা কা, গছিম্যা খা, চাইন্দ্যা গা- খাই, যাই, গাই ইত্যাদি) এবং কথা বলেও আ-কারান্ত দিয়ে। আর চাকমারা তাদের বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে কিন্তু কথা বলে অধিক মাত্রায় এ-কারান্ত দিয়ে(চুচাঙ্যা কা, গুজাঙ্যা খা, চান্দ্যা গা-খেই, যেই, গেই ইত্যাদি)। একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে এই বিষয়টি আলাপ করলে তিনিও গবেষণার যোগ্য এবং লক্ষণীয় বিষয় বলে মত দেন।

অনেক আগে থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা থাকলেও সেটি কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। পরে ভারতীয় এক গবেষক রূপক দেবনাথ বার্মা, ভারত ও বাংলােেদশ ঘুরে একটা সাজানো এবং গোছানো রূপ দাঁড় করান। একে সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যাকল্যাণ সংস্থা(বাতকস)। মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যারা ‘তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার একটি গোছানো রূপ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে  রূপক দেবনাথ ও এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার অবদান স্বরণীয়। আর সফ্ওয়ার উন্নয়নে জন্ ক্লিফটন্। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য স্ববর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানে গল্প বই(বিগ বুক),ছড়া বই(শুনার গল্প),বর্ণমালার বই,বর্ণমালা চার্ট,নাম্বার চার্ট,কার্ড এবং অংক বই প্রকাশিত হয়। সাথে আরো ছবি সম্বলিত সিরিজ পিকচার এবং থিম পিকচার প্রকাশিত হয়। এগুলি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাও কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা(মাল্টিলিংগুয়াল শিক্ষা অফিসার যখন ছিলেন)। এই শিক্ষা কার্যক্রমে গল্প ও ছড়া লেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন-সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা,লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, মিলন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা,বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা (কুতুবদিয়া)। আর বর্তমানে ক্লাস ওয়ানের উপযোগী ‘আমার বই আর গণিত বই’ তৈরী করার কাজ চলছে। আর এইসব বই বা উপকরণ তৈরীর জন্য ১৫(পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটিও আছে।

৪. লোকসাহিত্যঃ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অন্যতম অহংময় উপাদান হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য্যময় লোকসাহিত্যের ভান্ডার। সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আচার-আচরণের সাথে নিত্যদিনের কর্মকান্ডে এবং চিন্তা ভাবনা এই সাহিত্য ফুটে উঠছে। তার মধ্যে উবাগীত, প্রবাদ, ধাঁধা, গল্প, ছড়া ও বারোমাস উল্লেখযোগ্য।

উবাগীতঃ আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল গেঙ্গলী/উবাগীতের অনুষ্ঠান। নবান্ন উৎসবে এই গানের আসর বসত। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় কীত্তনের পাশাপাশি এই গেঙ্গলী গান হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানেও এই গানের আয়োজন হতো। যারা এই গানের রচয়িতা তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান অকল্পনীয়। তারা তাদের চিন্তাকে সুপ্রসারিত করেছে সে সময়ের জ্ঞানকে আশ্রয় করে। বিশেষ করে তারা রোমান্স ও ইতিহাসকে সাথে নিয়ে এই অমর সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছে। এই গানে একটা সুর থাকত যেটা আমরা পাহাড়ী বা আদিবাসী সুর বলি। এই সুরের সাথে প্রাকৃতি,ঝর্ণা,পাখির কূজন,বনভূমি একাকার হয়ে যেত। যেন স্বয়ং প্রকৃতি সুর দিচ্ছে, সুর তুলছে এবং সুর মিলাচ্ছে। এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি কাহিনী থাকে এবং পঙ্তির শেষে অন্ত মিল থাকবে। আর এটি গাইতে হয় বেহেলা দিয়ে। এই গেঙ্গুলীদের মধ্যে জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। যাকে সবাই কানাগেঙ্গুলী হিসেবে চিনে। স্বরস্বতীর অকৃপন কৃপায় তিনি অসাধারণ অনুভূতি শক্তি ,স্মৃতি ও মর্মাবধারণ সম্পন্ন সেকাল একাল শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ভূবন মোহন,নলিনাক্ষ ও ত্রিদিব রায় এই তিন রাজার অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষ রায় তাকে ‘রাজগেঙ্গুলী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। সেই অগনিত নাম না জানা ত্যাগী, গুণী ও জ্ঞানীদেরকে অসীম নমঃ নমঃ এবং জয়তু। এই রকম কিছু পালা বা রচিত সাহিত্য তন্চংগ্যা সমাজে খুবই পরিচিত। 

উবাগীতের পালাসমূহঃ জুম কাবা পালা,রাইন্যা বেড়ানা পালা,নাকসু ফুল পারা পালা,ঘিলা পারা পালা,রদংস পালা,বার্কী ধরা পালা,চাদিগাঙ ছড়া পালা,রাধামন ধনপতি পালা,লক্ষী পালা,ধর্ম পালা,রিজার্ভ পালা,অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা(রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা),লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা,মেদঙা-মেদঙী পালা,মিয়াধন-মিয়াবী,কুঞ্জধন-কুঞ্জবী,নিলংধন-নিলংবী,কামিতধন-কামিতবী,হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন তাদের মধ্যে অন্যতম।(পালাগুলি লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) নিম্মে একটি উবাগীতের পঙ্তি দেওয়া হলো-

             নানান-ভই-চর নানান রং,

             ধানে সুধায়  উ-ল সং।

             ধান ছরাত ধুল্ল রঙ,

             গাবুজ্যা গাবুরী উলাক সং।

             দেবংশী ফুলর গিলার তাক্,

             আদামত্ বেড়াইদন গাবুরী ঝাক।

             উদানত্ খেলিদন্ গুরালক্,

             পাল,পাল বেড়াইদন্ গাবুরলক।

             উরায় বইয়ারে তুলা-নি,

             আইছ্যা গাবুর লক্কুন কি গরন্ কি জানি।

             ই-চ-র মাদাত ধান তলই,

             জলা-জলি গাইততন্ গাবুরীলই।

             মিল্লা ধানতলই কুরায় খায়,

             কি জানি পরান বিরে আইছ্যা কন্না পায়।

             পশ্চিমে ডুবেল্লই পুব বেল,

             চুবে-চাবে গাবুজ্যা গাবুরীরে কই গেল।

             জুন পইজ্যা ভূই আদে,

             পরান দ ন জুড়ায় তুই বাদে।

             কদান কইনে লাঙ্যা দা গিয়ে গই,

             ঘর উবরে উইচ্ছে গই।

             ঝুবুক গাইছত্ পাইছ্ বাহ্,

             বাঁশি বা-ধল্লই লাঙ্যা দা।

             বাঁশী র শুনি মন কানে,

             ইন্দি লাঙ্যাবী চন রানে।

             চন তাবা চিদলে,

             লাঙ্যাবী মন দি ন পারের গমে দোলে।

             চনান উদুরাই পরেল্লই পেলাত্তুন,

             ঔল গুরি ভাত পেলা বাদ দি-লই নুন।

             জুরি পজ্যেই বু-য় খাদিয়ান ,

             মাদিত্ পজ্যেই কাদিয়ান।

             ধারা বা-ই-নে পরের ঘাম,

 লাঙ্যাবীত্তুন আদত ন উদের কন কাম।। (বি.এন তঞ্চঙ্গ্যা,আদামর ফুল। পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা)

প্রবাদ/ধাঁধা/গল্প/ছড়া

ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে অনেক গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধা শুনেছি। আবদার করতাম সময় সুযোগ পেলে। বিশেষ করে যখন অবসরে থাকতাম সবাই। আর সঙ্গী-সাথী ও ভাই-বোন মিললেতো কোন কথায় নেই। প্রবাদ ও ধাঁধা ধরাধরি করতাম কে কতটা বলতে পারে। মাঝে মধ্যেতো এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি হতো তবে সব কিছু সাময়িক পরে আবার ঠিক হতো। এভাবে অতিবাহিত ছোট বেলার প্রত্যেকটি দিন। মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেটাম মা-বাবারা যখন রাক্ষস বা ভূতের গল্প বলতেন। তবে রাজপুত্র যখন রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন রাক্ষসপুরী থেকে তখন আবার ভয় না পেয়ে খুশী বা মজাই পেতাম বেশী। 

তঞ্চঙ্গ্যাদের গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধার মধ্যে প্রকৃতির সাথে মানবিক ভারসাম্যতা বিদ্যমান। এখানে প্রতিটি বাক্য এবং চিন্তার সাথে প্রকৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সাথে আরো আশেপাশের প্রাণীকুল। তাদের নিত্য দিনের জ্ঞান,স্বভাব,অভ্যাস এবং আচরণগত নানা দিক। তন্চংগ্যারা প্রকৃতির সন্তান বলে তাই তাদের চিন্তার সাথে প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তারা প্রকৃতির মতো কোমল-নরম,বিনয়ী,নম্রভাষী এবং লাজুক। প্রকৃতির মতো তাদের হাত পাথার(ভিক্ষা)কোন অভ্যাস নেই। কাউকে সহজে বড় কথাও বলতে পারে না। কথাবার্তা সবসময় সংযত। তন্চংগ্যাদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে চিন্তার সাথে তাদের আচরণগত ভারসাম্যতা । তাই তাদের প্রত্যেকটি সাহিত্যবার্তা বা সৃষ্টিবার্তার মধ্যে এই আচরণ ও অভ্যাসগত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্মে সে রকম কিছু প্রবাদ,ধাঁধা ও গল্প তুলে ধরা হলো-

(ক) কিট্সা/ দা-অ কদা/প্রবাদঃ 

পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান, মুয়ত জয় মুয়ত খয়, পেদৎ বোক মুয়ত লাইত, এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কা(আ)ড়া, নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান, মরা বাই-স সমারে জেদা বাই-স পুরি জান, আক্কল বাধি অনা, ইচা শুউনি অনা, ইহিম কামত্ ফল পানা,উসুনা কুড়ায় ডাক কারা না, কুড়া লাইত্, চি-ল দরে কুড়া ছ ন পুছানা, সিনডালে-অ লো ন নিড়ানা, মুঅ গুনে ব্যাঙ মরা, ঠেঙ(অ) কোইত্ ঊরি দেনা, দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা,পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্, গুউত্তুন মুত্ গম্ অনা, রাঙা কালা মু অনা, ভুত্তোয়্যা কুউরে রোঙ কারা-না, আইদে আইদে ধদাডোদি টিক্ষ্যা কা(অ)রা গুরি, দা-শি দিলে নাচি খায় সবা-ইত্ ন পালে মা-ই খাই, ইসা-ব(হিসাব)গোরু(গরু) বায়ে(এ) খাই, খাঙ ন খাঙ ন খাঙ বালা যাঙ ন যাঙ ন যাঙ বালা, মুয়ত যউক পেদৎ ন যউক,বায়ু ফিরানা, নিমায়া নিতু,চিয়ন পআ কদা কুরা গু,সর্গ গু ন চিনা না,টাউ সুমা,ছাঅ-ল কানত্ মন্ত্র বরায় দেনা,আইছ কানত্ কুউরে বোউ না,সাপ্য়া উলে পুদাই দ ব্যাঙয়্যা উলে লাফাই দ,আগে গেলে বা-য় খায় পিছে তালে সোনা পাই । (ড. মনিরুজ্জামান,প্রবাদ ও তন্চংগ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ- পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত )

(খ) ধাঁধাঃ 

এক কা-য়া খালে এক কা-য়া তায়(শামুক), মাদি বিধিরে রোউত্ পুদি(হলুদ),ফিরের গুর গুর ফাদের মাদি(লাঙ্গল), মাদিত্তুন অচল ঘরততুন নিচল(মাচাং), মা-বা কানে ছ-বা দাঅর অই(নাদি সিরা/নাতাই ও সুতার টুম), ধুজ্যা সাগরত্ থালা ভাস্ন(তারা), আকাশত্ ঘর পাদালত্ দুয়ার কোই ন পাইলে খাবে চয়ার(বাবুই পাখির বাসা), ন পালে তয়ায় পালে ন আনে(পথ),গাইচ বুরে পানি কয়া(ডাব), এক বুজ্জ্যা খান দ্বি-বুজ্জ্যা চায় তান(মুখ ও দুটি হাটু), চিয়ন লক্কে কাদা বুড়া উলে পাদা(শন), বিল ছোয়ালে বয়া মরে(কেরোসিনের বাতি), বাঁ ঘরত্ বুজ্জ্যা দুদ্দুরায়(খই ভাঙ্গানো), ঘর আহে দুয়ার নাই মানু-অত্ আহন র নাই(উই পোকার বাসা), দুইল্লে এক মুঠ ইরি দিলে এক্ বেদেরাং(জাল), আখা আহে দুছা নাই দেল্লা আহে পাদা নাই(স্বর্ণলতা), বুক ডুব বিছি কালা কদা কয় মধুমালা(বেহেলা), কাইদে গুলা বুদুনী নাই(ডিম), এক বুজ্জ্যা কদা কয়(বই),শিরা নাই বুজ্জ্যা মানইত্ গিলে(শার্ট), একুল পানি ওকুলত্ যাই(মদ), আহা কাবিলে দুসা মরে(গাঙ), চাইত্ উবা খাইলত্ লেত্(দোলনা), রাজার আইত্ লেজত্ দোইলে কাইত্(ঢেঁঙি), লুদি টানিলে মোইন গুচুরে(কিংখরঙ), এরিং বিরিং তিরিং বাই চোক দ্বি-বা তার মাদা নাই(কাকঁড়া)। (লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) 

(গ) পস(গল্প)

কলাত্থুর কন্যা,বাঘ ও শূকরের মিতালী,তেন্দেরার পচ্ছন,দুলুক্কুঙী,পিত্তয়া চান,চিমুজ্যার লুক্ষীবর পানা,পুরীকন্যা মানোহারী,নিতাং সুতাং,রাঙকাইত্ বুলির সর্গ মারা না,মানিক পুদি কন্যা,বেঙ্গমা-বেঙ্গবী,টুনটুনি ও কুস্যা ব্যাঙ,ভূতের গল্প, কুজ্যা কুইনি পসন,বুজ্যা বুড়ির পিদা খানা,মিত্তিন্যা পসন,কবী-ধবী,বেঙ্যা,বান্দুরী,আল্চিয়া,ভলা গুরু,দুলোক কুনি,মিরা রাচা,সুবাত্তুরী আ পেত্তয়া ফিউং,আলচিয়া মিদি ঙ্যা,এক বিগৈইশ্যা,গুল চিনা,ভুলা-ভুলি,শেয়াল্যা আ হ্আইতস্যোয়া,বুজ্যা-বুড়ী আ বাঘ্যা,বুড়ী আ ভুত্তোয়া,বেলেই কন্যা,খুস্যোয়া বেঙ আ সুবাত্তুরী,শুগ মা,রাচা ভাগান্যা নাক্কোন্ চিলা,কাইত্ কন্যা,শুগবা বাঘ্যা আ পেচাবা,বুজ্যা বুড়ী,দাদু ঙ্যা দাদুঙী,মিরা আ পারান্ বন্,চানমুনি সূর্য মুনি,আল্চিয়া,ঊইঙোয়া আ কবাবা বন। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

(ঘ) ছরা/ছআ (ছড়া) ঃ 

ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের একটি উর্বর উপাদান। আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক ছড়া দেখেছি বিশেষ করে ঘুম পাড়ানী ছড়া। এই রকম ঘুম পাড়ানী ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করি। মা যখন জুমে যায় কাজ করতে তখন ছোট ভাই-বোনকে লালন পালন করতে বড় ভাই-বোনকে যে কি রকম বিড়ম্বনা সইতে হয় এই ছড়ার মধ্যে তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর সময়। এই ঘুম পাড়ানী ছড়া ছাড়াও আরো আছে খেলাধূলা(৬ নং ছড়া)আর রোমান্টিক টাইপের কিছু ছড়া(৪নং ছড়া)। 

    (১)   নাক্সো গাইছর রিয়াং জু,

               দোলউন্ বুনি কেরেং জু।

               কেরেং দোলাইত্ কেরেক চাক্,

               উয়াং দইত্তন ঝুইতগি থাক্ ।

       (২)    ডুলু বাইছর দোলইন্,কাই-জ্যা উদাল দুরি।

               ঘুম যাবদে ম লক্ষোবা,সোনা দোলইনত্ গুরি।

       (৩)   বেঙয়া দরের করক করক,ভাইজ্যা ডুবাত্ তলে।

               লক্ষোবিরে বৌ দিবং, রাঙা শুক্ষোর বারে।

       (৪)   জুম লেছাত্ উবা কইন, 

               সমারে বেরাইদন্ দ্বি-বা বইন্।

               দ্বি-বইনত্তুন কন্ন্যা লইন,

               দাঅর বইন্যা ন পালে, চিয়োন্যা লইন,

               কারে-য়-ন পালে , মৈন্ছাঙ অইন।

(৫)       আম পাদা তেল তেল,কাট্টল পাদা বেল।

  ম-হ(অ)াদত্ ভাত্ জরাবা , লক্ষো পেদত্ গেল।

  ভাততুন খাইনে দাঞর অইনে, কোন্ দেশত্ গেল ।

       (৬)   আম পাদা লক্ষণ, তরে মাইত্তে কদক্ষণ।

              আমত্ তলে সমালুং, বরই কাদা ফুদা লুং।

              বরই কাদা এদক বিদ, তিবিরিত তিবিরিত।

              শমই পাদা লরে চরে, তরে লড়াইদে বল্ পড়ে। (বি.এন তন্চংগ্যা থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

৫. পার্বত্য চুক্তি ও সাহিত্য চর্চা

১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সাথে প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একটা নবজাগরণ সূচিত হয়। এটি সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যারাও পিছিয়ে নেই। এর মধ্যে নবীন কিন্তু প্রতিভাবান একটা লেখক শ্রেণীর উদয় হয় যার সংখ্যা অনেক। এই ক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রকাশনা গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পহ্র জাঙাল এখানে অগ্রগামী। তারা দেশ, সমাজ ও জাতি নিয়ে চিন্তা করে এবং সাথে তারা আদিবাসী অধিকার নিয়েও সচেতন। সেজন্য আমি এই সময়কে  তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নবজাগরণের সময় বা যুগ বলি। তারা সব কিছু ভেদাভেদ ভুলে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সদয় প্রত্যয়ী। এই ক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা(এনজিও)গুলোর ভূমিকাও অনেক। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

৬. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর অবদান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’(পূর্বনাম উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট)আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বিশেষ একটা জায়গায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুটিকয়েক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে। উক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের(রাঙ্গামাটি) কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলে আমার এই সত্য উপলদ্ধিতা আরো গভীর এবং বদ্ধমূল হয়েছে। আমি মনে করি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামের যথার্থতা বা সার্থকতা মুল্যায়িত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ভবিষ্যতে এই দায়িত্বটা স্বরণে রাখবে আশা রাখি। 

৭. তঞ্চঙ্গ্যারা সম্মানিত ও গর্বিত জাতিঃ 

আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারাই সবচেয়ে সম্মানিত এবং গর্বিত জাতি। কারণ তাদের জাতির মধ্যে রয়েছেন এমনসব বিরল সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি যাদের কর্মকান্ড বা অবদান দেশ,কাল,সমাজ ও জাতির উর্ধে উঠে পুরো পৃথিবীকে করেছে আলোকিত আর জাতিকে করেছেন সম্মানিত। তারা হলেন সাধক কবি শিবচরণ,রাজগুরু প্রিয়রতœ মহাস্থবির(গৃহী নাম পালকধন তন্চংগ্যা), রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির(গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা),রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী বা রাজগেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা(কানা গেঙ্গুলী), শ্রেষ্ঠ বলি লাল মুনি তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। সবগুলি রাজকীয় মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ত্বের স্বীকৃতি। এত রাজকীয় মর্যাদা বা উপাধি এবং স্বীকৃতি প্রাপ্তি একটি জাতির জন্য আর কি চাওয়া থাকতে পারে।  

উপসংহার

এইভাবে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্য বিকশিত এবং প্রসারিত হয়। স্বরণযোগ্য বলে এই বাক্যটি শেষে এসে আবার বলছি। তঞ্চঙ্গ্যা জাতি যদি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আরো একটু সচেতন হয় তাহলে আমি আশা রাখতে পারি সামনে তাদের সুদিন আসছে। বর্তমানে প্রচুর তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়ে দেশে এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছে। তারা ভবিষ্যতে জাতির কান্ডারী হবে। যদি আমরা চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। সেটি হচ্ছে শিক্ষিত প্রজম্মের মধ্যে জাতিত্ত্ববোধের সচেতনতা। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রীধারীদের ক্ষেত্রে। তারা যদি নিজ জাতির প্রতি জাতিপ্রীতি হন তাহলে আমরা হয়তো এই সুফলটা পেতে পারি অন্যথায় নই। বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের(বিবাহ)ক্ষেত্রে। এই সময় তারা যদি একটু বেশী নিজ জাতিকে নিয়ে ভাবেন জাতি এতে উপকৃত হবে। এইক্ষেত্রে অবশ্যই জাতির অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখানে টার্গেট করা হচ্ছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্মকে। যাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক মর্যাদা অপেক্ষা করছে। দিনের আলোর মতো খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ লোক যারা অন্য সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করেছে তারা আত্বীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,সমাজ এবং সর্বোপুরী সামাজিক ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের অর্ধাঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এসে ‘তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের একজন’ হয়ে উঠতে পারেননি। সুখে দুঃখে এখনো সে তার মাতৃজাতির যাবর কাটছেন বা স্বপ্ন দেখছে। জানিনা এটি জাতির জন্য নতুন একটি ষড়যন্ত্র বা কূটকৌশল কিনা। কারণ অতীতে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমরা সেরকম অনেক ইতিহাস দেখেছি। তবে বেশীদূর যেতে হবে না ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তের দিকে তাকালে হবে। সেসময় পাকিস্তানীরা এবং তাদের সহযোগীরা যখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পেরে উঠছে না তারা বুদ্ধিজীবি এবং শিক্ষিত প্রজন্ম নিধনে পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং অনেকটা সফলও হয়। আমি এই কথাগুলি এই কারণে এখানে বলছি কারণ শিক্ষিত প্রজন্মই জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। তাদের চিন্তায় এবং সহচার্যে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হবে এবং টিকে থাকবে। একটি পত্রিকার ভাষ্য মতে-বৃটিশ পুরুষরা নাকি অন্য জাতি বা সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। কারণ তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস বা বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এতবড় সম্পত্তিশালী এবং শক্তিশালী জাতির যদি জাতি বা সংস্কৃতি ধ্বংসের চিন্তাটা মাথায় আসে তাহলে আমরা সাগরের এক কণা বালির মতো একটি জাতি হয়ে নিজ জাতির জন্য কি চিন্তা বা ভূমিকা রাখছি। আমি সব সময় আশঙ্কায় থাকি জাতি থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি নাতো। কারণ পৃথিবী থেকে নাকি প্রতিদিন কিছু না কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস ও বিলুপ্ত আশঙ্কা হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষিত এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এইক্ষেত্রে অভিভাবকদেরকেও ছাড় দিতে হবে জাতি ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে। নাই বা কম বলে আমি এই আশঙ্কাটুকু করি। এটি কিন্তু চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে নয়। তবে আমি আশাবাদী কারণ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা সমাজ বিকশিত হয়। তন্চংগ্যা সমাজও সেভাবে বিকশিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তঞ্চঙ্গ্যাদেরও সে সুদিন আসবে, সেই প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

পরিশেষে উল্লেখিত সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম ছাড়াও আরো অনেক সাহিত্যিক  এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম হয়তো আছে যেগুলো এখানে আসেনি বা আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি, পরবর্তীতে তথ্যপ্রাপ্তিতে সংযুক্তির সুযোগ রেখে তাদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

                                                         …………………………

তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক রচিত, প্রকাশিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের একটা তালিকা নিম্মে দেওয়া হলো-

১. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক রচিত সাহিত্যকর্ম

  ১।  সাধক শিবচরণ

       মানবজন্ম , ফুইরা আলাম,আর ‘গোসাইন লামা’ হচ্ছে (মানব জন্ম ফুইরা আলাম) এর ভূমিকা মাত্র।

  ২।  কবিরাজ পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা

 ক. ধর্ম্মধ্বজ জাতক(১৯৩১) – কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা।

 খ. চান্দোবী বারমাস, সত্য নারায়ণের পাঁচালী (সিন্নি পুঁথি), চাংমা লেখা শিক্ষা(১৯৩৮),

              রুত্তি বারমাস, আলস্যা মেলার কবিতা,বিয়াল্লিশর ভাত্রাদ(বারমাস)।

       ৩। কবি গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা  

            ক্যাঝুরী,মুলি,কলিযুর্গ ও দ্বিমুক্যা বারমাস নামে চারটি বারমাস রচনা করেন।

  ৪। শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা 

      ক. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (আগষ্ট-১৯৮৫)

      খ. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা (১৯৪৫),উদয়ন বস্তু বা কর্মফল(১৩৬৮),মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বৌদ্ধ গল্পমালা(১৯৮৭) 

       সম্পাদিত গ্রন্থ: ধর্ম্মধ্বজ জাতক(কবিরাজ পমলাধন তন্চংগ্যা মূলগ্রন্থের সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা)।

      প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ:

            ক. রাধামন ধনপুদি কাব্য (পহ্র জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা ২০০৮ প্রকাশিত)

            খ. অশোক চরিত(১৯৮৩); অনাগতবংশ।

            নাট্য কাব্য: 

            ক. বিজয়গিরি (পহ্র জাঙাল-৫ম সংখ্যা, ২০০৯ থেকে প্রকাশিত)

            খ. চরিত নাটক(ধর্মীয়): মানুষ দেবতা,মোহবসান এবং কুলধর্ম(কাব্য)

            গ. তপর্কীতন ও যাত্রাপালা : বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা(২৫/০৪/১৯৮৫)

            ঘ. শ্রী বুদ্ধের বারোমাস স্মৃতি(রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়-২৬/০৩/১৯৭৮)

            ঙ. কল্পতরু দান ফল কথা, বন্দনা ও দান ফল কথা, অক্ষর গাথা। 

এছাড়া রাজবলাকা,  নৈরঞ্জনা, সম্বোধি, পার্বত্য বাণী পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।

         ৫। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

–        তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি(গ্রন্থ)।

এছাড়া বান্দরবান থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘ঝর্ণা’,রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘পার্বত্য বাণী’ ও সাপ্তাহিক  ‘বনভূমি’ তার ভিবিন্ন সময় কবিতা প্রকাশিত হয়।তার মধ্যে- অবিস্মরণীয়া,নিশা,আমি একাকী,পথিক,বান্দরবন,মায়াময় পৃথিবীতে,পার্বত্য চট্টলার প্রতি,অব্যক্ত অনুভূতি,বরষা,বৈশাখী পূর্ণিমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

   ৬।  রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির

              প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

সমবায় বুদ্ধোপাসনা, বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বুদ্ধপাসনা (লোকত্তর বিভাগ), বুদ্ধপাসনা(লোক বিভাগ), চাঙ্মা গীদেন্দি মঙ্গল সূত্র, পরিণাম(নাটক), শ্রামণ কর্তব্য, মানব ধর্ম পঞ্চশীল, The Stop Genocide Hill Tracts of Bangladesh.

               অপ্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

 বিশুদ্ধিমার্গ(৩য় খন্ড), বিদর্শন ভাবনা নীতি(৫ম খন্ড),বুদ্ধোসামন্তিকা (৫ম খন্ড), অভিধম্মার্থ সংগ্রহ, ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ, জন্ম মৃত্যুর কথা, সাম্য বীথিকা, চন্দ্রগুপ্ত (নাটক), বাসবের পথে(নাটক), রূপনন্দা(নাটক), সঞ্চয়িতা, বাংলাদেশ বড়–য়া জাতি, মহা কঠিন চীবর বর্ণনা,বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ, অগ্নিমশাল(গীতি মঞ্জুরী),চাঙ্মা কধাদি ধর্মপদ,পথ তগেয়ে মন(চাক্মা ভাষায় নাটক), মহামানব গৌতম বুদ্ধ, আবিলাস্যা সংসার(চাক্মা ভাষায় নাটক), সিদ্ধার্থ চরিত, মহাস্বপ্ন (চাকমা ভাষায় নাটক), বেসান্তর কীর্ত্তন, মহাযাত্রী(গীতিনাট্য), দর্শন ও বিদর্র্শন, ধর্ম ও সমাজ, বুদ্ধের অবদান (৩য় খন্ড)।(তথ্যঃ মানব ধর্ম পঞ্চশীল,রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির)।

    ৭। ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির

             প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহঃ

শাতিকাধাতু কথা স্বরূপিনী, অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরূপিনী, যমক স্বরূপিনী, অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গ প্রকরণ, বুদ্ধ প্রকাশনী, পথ প্রদর্শন, চলার পথে।

     ৮। শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

  • ১৯৭৬ সালে বিরাজ মোহন কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘পার্বত্য বাণী’র প্রথম সংখ্যায় ‘কালিন্দী’ নামক ইতিবৃত্তমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কলিকাতা ‘বোধিভারতী’ পত্রিকায় তার কয়েকটি গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  •  রাঙ্গামাটি পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ‘অঙ্কুর’ প্রকাশিত হয়।
  • রাঙ্গামাটি সাপ্তাহিক বনভূমি থেকে ‘সীমান্তের শান্তি’ চার সংখ্যা পর্যন্ত বের হয়।
  • ‘রুনুখাঁর উপাখ্যান’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস কয়েকটি অধ্যায় বের হয়েছে।
  • বুদ্ধের জীবনের উপর রচিত ‘অমিতাভ’ ১৯৬৭ সালে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়।
  • ১৯৭০ সালে চাকমা নাটক ‘মূড়া যেক্কেনে’ নানিয়াচর উপজেলায় কৃঞ্চমাছড়া গ্রামে অভিনীত হয়। 
  • গিরি নির্ঝর পত্রিকায়  ‘রক্ততিলক’ প্রকাশিত হয়। 
  • তিনি রাঙ্গামাটি বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত ‘গান ও কথিকা’ লেখক।
  • ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করে। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ফোরামও ২৭শে চৈত্র ১৪১০ বাংলা সম্মাননা প্রদান করে। 
  • চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ২৫ বৎসর পূর্তি’ উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান করে। 
  • তার প্রণীত গ্রন্থ সমূহ- ‘তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, ভাগ্যরতœ’ । 
  • ছ. বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে ২০০৮ সালে সাহিত্যে সম্মাননা দেওয়া হয়।

      ৯।  অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান 

  • ক. তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা-রূপ প্রসঙ্গ (১ম সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৩, সম্পাদকঃ পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • খ. ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়ন: তন্চংগ্যার উত্তরাধিকার প্রশ্ন (২য় সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৪ সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • গ. পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন (৪র্থ সংখ্যা, ১৪ই আগস্ট-২০০৮, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • পার্বত্য কথাসম্ভার তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ (৫ম সংখ্যা, ৯আগষ্ট,২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)

      ১০।  রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

            তঞ্চঙ্গ্যা জাতি, গীত পোই, চিত্রা (আর্ট বই)। এছাড়া স্থানীয়,জাতীয় অনেক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তার বহু মূল্যবান গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি একজন প্রতিবাদী লেখক এবং সমাজ চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে আতœস্বীকৃত। 

      ১১।  রূপক দেবনাথ (ভারত)

     Rupak, Debnath, Ethnograpic Study of the Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South Tripura Kolkata: Kreativmind, 2008.

.

      ১২।  কর্মধন তন্চংগ্যা

      প্রবন্ধ সমূহঃ 

  • আচ্ছ্যা বিষু-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১১ই এপ্রিল’০৫।
  • লুউই-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৯শে মে’০৫।
  • তন্চংগ্যা সমাজে বিষু উৎসব-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৮ই এপ্রিল’০৬।
  • আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরাই বাচিঁয়ে রাখবো-রঁদেভূ,৬ষ্ঠ সংখ্যা,০৬।
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও মিডিয়া- রঁদেভূ ,৫ম সংখ্যা,০৫।
  • বিপন্ন আদিবাসী ভাষা-সমুজ্জ্বল সুবাতাস,ফেব্রয়ারী’০৫।
  • তন্চংগ্যাদের জুম চাষ,মিথলজি- পহ্র জাঙাল,৫ম সংখ্যা’০৯।
  • চাকমা কবিতায় তন্চংগ্যা ধনপুদি- পহ্র জাঙাল,৪র্থ সংখ্যা’০৮।
  • তন্চংগ্যাদের রাষ্ট্রভাষা চর্চা ও একটি প্রস্তাবনা- পহ্র জাঙাল,১ম সংখ্যা’০৩।
  • আদিবাসীরা বেঁচে থাকবে চিরদিন-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা),৮ম সংখ্যা, ২০০৬।
  • ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এর মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম-যেন প্রকৃতির ভাষার মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলো, 

     সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট,সাস,ডিসেম্বর-২০০৯।

           ছোট গল্পঃ 

  • সাঙা -দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,৫ই জানুয়ারী’০৭।
  • নীলাকাশ- রদেঁভূ ,৭ম সংখ্যা’০৮।
  • পু-কাল্লাঙ-তৈনগাঙ,আদিবাসী দিবস সংখ্যা-২০০৬।

কবিতাঃ

  • জুমফুল পথ খোঁজার সাথী হয় না; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৪ নভেম্বর’০৬।
  • জুম দেশের বৃষ্টি; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৯জানুয়ারী’০৭। 
  • বয়স ৩; পহর জাঙাল,৩য় সংখ্যা’০৫।
  • জীবনের গদ্যকবিতা,ধূপছায়া,২য় সংখ্যা,২০০৩।
  • স্বপ্ন,নব সভ্যতার-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা), ২০০৪।

           গুচ্ছ কবিতাঃ

  • রুমালের ফুলে মুখ লুকাতে, তুমি যাবে আমাদের গ্রামে, বনে আলো প্রবেশ করে না;

      দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১৬ই ফেব্রয়ারী’০৭। 

  • নূপুরবিহীন জুমনৃত্য, প্রকৃতির লজ্জা; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২রা ফেব্রয়ারী’০৭।
  • তিনটা জীবন, ওপর-নিচ সমান্তরাল; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৪ জুলাই’০৫।
  • আজ কবিতা লিখব না চিঠি লিখব, শুধু ভালোবাসে না তারা আমাকে; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৮শে আগষ্ট’০৫।
  • জুম পরানীর আত্মা, স্যারের কবিতা বাতাসে উড়ে যায়; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৩মে’০৫।
  • অনন্ত কাল ধরে বহুদিন, আমরাও জেগে আছি ধরিত্রীর মাঝে, যদি তোমায় একটি বার দেখা পাই; 

           দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৮শে এপ্রিল’০৫।

           অনুবাদ কবিতাঃ (তন্চংগ্যা ভাষায়) 

           ন-য়া ব-সর; (শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড.মনিরুজ্জামান স্যারের ‘ইদানিং বিপন্ন বড়ো’র পঞ্চতপার গান এর ‘নববর্ষ’ কবিতার অবলম্বনে)।

           সম্পাদনা করেন : 

  • পহ্র জাঙাল (একটি তন্চংগ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা)। ২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা, প্রকাশনায়ঃ পহ্র জাঙাল  প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  •  রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক), ৬ষ্ঠ, ৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহ:সম্পাদক। 

২. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন সমূহ

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা, রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদনায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তন্চংগ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তন্চংগ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তন্চংগ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তন্চংগ্যা-৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তন্চংগ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তন্চংগ্যা-৩য় সংখ্যা,অমিত তন্চংগ্যা-৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা, সুতিল কুমার তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক: সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক: আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক),৬ষ্ঠ,৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক- কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহঃসম্পাদক: কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা । 

     ৩. তন্চংগ্যাদের সম্পাদিত নিজস্ব প্রকাশনা:

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা,রাংগামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদরায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তঞ্চঙ্গ্যা -৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা,অমিত তঞ্চঙ্গ্যা -৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,সুতিল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক:সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক:আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 

                                                ……………………………

তথ্য সূত্রঃ 

১. পহ্র জাঙাল (একটি তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা-সব সংখ্যা)।

২. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা।

৩. গোজেনের লামা বা গোঁসাই পালা- বিরাজ মোহন দেওয়ান। পার্বত্য বাণী, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ফেব্রয়ারী-১৯৬৮।

৪. সাধক শিবচরণ-যামিনী রঞ্জন চাকমা। গিরি নির্ঝর, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা,মে-১৯৮২।

৫. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। 

৬. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি-শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

৭. তৈনগাঙ, ন-আ শমন, রাঙাফুল প্রকাশনা।

৮. সাধক কবি শিবচরণ জীবনালেখ্য-আশীষ চাকমা,রঁদেভূ,আগষ্ট-২০০৫।

১০. প্রয়াত সুবাস তঞ্চঙ্গ্যা, বারঘোনীয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, রেশম বাগান-কাপ্তাই।