—-অজিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা
————————————————————————————————————————————–
ইতিপূর্বে পাক-ভারত উপমহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে যত মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠী লোক ছিল এবং বর্তমানে আছে তাদের মধ্যে চেহারাগত বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য খোঁজা খুব দুরুহ কাজ। সকলে কম বেশি মনে হয় এক ও অভিন্ন। ভুটানি, নেপালী, থাইল্যান্ডী, বার্মিজ, কম্বোডিয়ান, ভিয়েটনামী এবং অপেক্ষাকৃত কম জনগোষ্ঠীর লোক যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর লোকদের চেহারাগত তফাৎ খোঁজা খুবই কঠিন কাজ। এতো গেল এ অঞ্চলে বসবাসরত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর চেহারাগত মিল-অমিলের দিক।
বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার কিয়দাংশে বসবাসরত এগারটি বড় কিংবা ছোট দলভুক্ত পাহাড়িদের মধ্যে কমবেশী প্রত্যেকটি জাতিসত্ত্বার নিজস্ব ভাষা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, ধরণ-ধারণ তথা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারা স্ব-স্ব রীতিতে বহমান। তন্মমধ্যে কিছু সংখ্যক জাতিদের বাংলা ভাষা ও নিজ নিজ মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্ষার রীতি প্রাচীন ও অপেক্ষাকৃত উন্নত। কিছু কিছু জাতির জীবনাচার ঘোরাচ্ছন্ন ও অজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল বিধায় হয়তো পুরানো রীতি নীতি থাকলেও তা তারা ধরে রাখতে পারেনি। প্রত্যেকে কিছু না কিছু নিজেদের জাতিসত্ত্বার ইতিহাস ও ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি মৌখিক কিংবা লিখিত দলিলের মাধ্যেমে বংশ পরম্পরায় জিইয়ে রেখে চলেছে, কেহ হারিয়েও ফেলেছে। এ অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের নিয়ে সেই পর্তুগীজ, বৃটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে গুটি কয়েক লেখক যেমন- জন হেমিল্টন বুকানন, ড. ফ্রান্সিস, ফেরী, হ্যার্সিসন, ওয়াজিবুল আজিজ, ডে-বোরোস, সতীশ ঘোষ, টি. এইচ. লুইন, আবদুল হক প্রমুখ লিখে গেছেন। কেহ শখের বশবর্তী হয়ে, কেহ রাজনৈতিক কারনে নিজ নিজ ইতিহাসের ধারাকে শ্রোতধার রূপে বজায় রেখে মূল বাস্তবতাকে এড়িয়ে ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবতা ধামাচাপা থেকেই গেছে বৈকি।
বেশি দিনের কথা নয়- বিগত ৬০ থেকে ৭০ বৎসরেরও আগে এখানকার মানুষের জীবনধারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণ বর্তমানের চেয়ে বহুলাংশে অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিল। অশিক্ষা-কুশিক্ষায় সমাজ জীবন ছিল ঘোরাচ্ছন্ন যুগের মতই। তদ্রুপ ১০০ থেকে ১৫০ বছর আগের অবস্থা হয়তো আরো অনেক অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ও অঘোর ঘোরাচ্ছন্নে ছিল। এই অঞ্চলে বিভিন্ন লেখকের লিখনিতে ও প্রবীন ব্যক্তিবর্গের ভাষ্যমতে জানা যায় যে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীরাই মূল চাকমা জাতি ছিল- এ কথা প্রবীণ চাকমা সমাজে বহুল প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল এবং বর্তমানে ও চাকমাদের কাছে এ বদ্ধমূল ধারনাটি আছে। চাকমা জাতি সম্পর্কে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস রচনা করেছেন। বর্তমানে চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা একই জাতিসত্ত্বার উত্তরসূচী বলা হলেও আদৌ সত্য কিনা তার প্রকৃত তথ্য ও সাক্ষ্য প্রমাণ সঠিকভাবে কোথাও পায়নি। পর্তুগীজ, মোগল ও ইংরেজ আমলের বিভিন্ন অফিস আদালতের তথ্যাদি ও সমসাময়িক ইতিহাসবিদগণের বর্ণনায় বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এতে কেহ তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা জাতির ভিন্নতার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেহ কেহ এক ও অভিন্ন বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে ভাষা, ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অধিকাংশই মিল আছে বলেই অনুমান ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা একই জাতিভূক্ত।
বাবু বিরাজ মোহন দেওয়ান কতৃক রচিত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” বইটিতে বলা হয়েছে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেবল কালের গর্ভে ও কালক্রমে পৃথক অবস্থানের ফলে ভাষা, আচারণ, কথন ভঙ্গিতে পরিবর্তন হয়েছে। যেহেতু লোকসাহিত্যে বা লোকগীতি “গীংগুলি” গীতের সুর, ব্যক্তি, উপাত্ত-উপখ্যান, উপকরণাদি (যেমনঃ- চান্দবী বার মাস, চাদিগাং ছাড়া পালা, রাধামন পালা, গীলা পাড়া পালা, মিঙাবি বারমাস ইত্যাদি), উবাগীত প্রভৃতি উভয় সংস্কৃতিতে প্রবাহমান হয়ে এসেছে।
অপরদিকে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি পরিচিততে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রখ্যাত লেখক বাবু বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি আলাদা জাতি হিসেবে বিভিন্ন প্রমাণাদি প্রদর্শন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতেএ যেহেতু চাকমাদের ৪৬ট গোজা-গোষ্ঠির মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ১২টি গোজার একটিরও অন্তর্ভূক্তি নেই। সেই দৃষ্টিতে তাঁর যুক্তি অকাট্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে অনেক বাংলা শব্দ প্রয়োগ আছে বলে বিভিন্ন লেখক বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে জেনেছেন। বাংলা ভাষার শব্দ তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রচলিত হওয়ার কারণে যুক্তি এই পতুর্গীজ আমল, মোগল আমলও বৃটিশ আমল পর্যন্ত ভারতবর্ষের অমঙ্গোলিয়া সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে (বর্তমান চট্টগ্র্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে) দীর্ঘ প্রায় ৫শ থেকে পৌনে সাত’শ বছর ধরে তৎকালীন ভারতবর্ষীয় হিন্দু ও পরবর্তীতে মোগলীয় উত্তরসূরীর সংস্রবে (খাঁ বংশীয়)আসায় তাদের সংস্কৃতি কিছু কিছু ঢুকে পড়াটা বিচিত্র কিছু নয়। যেমন- ছোট বেলায় দেখেছি “ছিন্নী” করতে, বড়দের ভারত রামায়ন পড়তে, কারোর রোগমুক্তির জন্য কালী বাড়িতে মানত করতে বা “মা লক্ষীকে” পূজা দিতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যুগের পরির্বতনের ফলে সে সকল প্রথা আর নেই। বর্তমানে নিজেদের শাক্যবংশের অনুসারী রূপে তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বিশদভাবে বলতে গেলে বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলার মানচিত্রের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে তা পরিষ্কার বুঝা যাবে। দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার জেলা সদর, টেকনাফ উখিয়া ও বান্দরবান জেলা সদর, রুমা লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, আলীকদম, রোয়াংছড়ি উপজেলা সমূহের বিভিন্ন মৌজাগুলোতে এবং তদসংলগ্ন চট্টগ্রাম জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস।
পক্ষান্তরে অপেক্ষাকৃত উত্তর খাগড়াছড়ি জেলায় কোন তঞ্চঙ্গ্যা বসতি নেই। উত্তর-পূর্বে যেমনঃ- রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও নানিয়াচর্ উপজেলা গুলোতে তঞ্চঙ্গ্যা জনবসতি খুবই কম। থাকলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালীদের (হিন্দু ও মুসলিম) সংস্রবে থেকে থেকেই কিছু কিছু বাংলা শব্দ তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় ঢুকে পড়েছে।
প্রত্যেক জাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিজ নিজ রমনীদের স্বকীয় পোশাক পড়লে ঐ জাতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। যেমনঃ- শাড়ি পরা রমণী দেখলে বোঝা যায় বাঙ্গালী রমণী, স্কাট পরা রমণী কোন পশ্চিমা, থামি পরা কোন রমণী বার্মিজ বা থাইল্যান্ডিয় ইত্যাদি বোঝায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের এগারোটি আদিবাসী মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারা খাগড়াছড়ি জেলা ব্যাতিত উল্লেখিত চার জেলায় আনুমানিক ৭০ কি ৮০ হাজারের কম নয়। অবশ্য সরকারি তথ্য মতে তত নয়। তার প্রধান কারণ চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার সদর, উখিয়া উপজেলা ও টেকনাফ উপজেলা এবং পার্বত্য বান্দরবান জেলার রুমা, লামা নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম উপজেলার অধিকাংশ তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের জমি জমার দলিল পত্রের চাকমা বলে পরিচয় দেয় মূলত তারা “মো-গছা” ও “ধন্যা-গছাভূক্ত” তঞ্চঙ্গ্যা। শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসরতা ও উত্তরাঞ্চলের বর্তমান শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাথে বিচ্ছিন্নতার কারণেই নিজেরা এখনো চাকমা বলে পরিচয় দেয়। হয়তো বা চিরাচরিত জনশ্রুতি বজায় রেখে চাকমা বলে পরিচয় দেয়।
এ বিষয়ে বিশদভাবে বর্ণনা দিতে সুদূর অতীতের দিকে এগোতে হয়ঃ চাকমা জাতির ইতিহাস লেখকগণের মতে জানা যায়- কালা বাঘার রাজার দুই রাজপুত্র- বিজয়গীরি ও উদয়গীরি দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে উত্তর থেকে যখন দক্ষিণ দিকে দুই সেনাপতি রাধামন ও কুঞ্জধনকে নিয়ে অভিযানে বাহির হন তখন চাদিগাং (বর্তমান চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণাংশে) জয়ের পর রোয়াং (বর্তমান লোহাগড়া, উখিয়া ও কক্সবাজার অঞ্চল) বিজয় করে পরবর্তীতে আরাকান দখন করেন। তথায় মগদের পরাজয় করে বংশানুক্রমে রাজত্ব করতে থাকে চাকমা রাজবংশরা। ১৩৩৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা অরুন যুগের রাজত্বকালে পর্তুগীজ সহায়তায় মগ রাজা মিনধি বিদ্রোহ ঘোষণা করে চাকমা রাজা অরুণ যুগকে পরাজিত করে তিন রাজপুত্র ও দুই রাজ কণ্যাকে বন্দী করে। এই যুদ্ধো ১০,০০০ যোদ্ধা বন্দী হয় বলে কথিত আছে। যুদ্ধের পরাজিত যোদ্ধা বা সৈনিকরা (তথা চাকমা সমাজে সকল শক্ত- সামর্থ্য সকল পুরুষগণ) পলায়ন করে গভীর অরণ্যে অবস্থান নিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা উত্তর দিকে সরে আসতে থাকে। যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষ হওয়ার পর পরবর্তীতে আরাকান রাজা চাকমা রাজার জ্যৈষ্ঠ রাজপুত্র সূর্যজিতকে (আরাকানি নাম “সাজুই”) নিজের অধীনে ক্যকডোজা প্রদেশের শাসক, দ্বিতীয় রাজপুত্র চন্দ্রজিতকে (আরাকানি নাম “চৌতা”) কংজা নামক স্থানে রেভিনিউ কালেক্টর হিসেবে নিয়োজিত করেন।
যুদ্ধ বিগ্রহের পর সকল নিরীহ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী শিশুদেরকে আরাকানের উত্তর অংশের পাহাড়িয়া এলাকায় বসবাসের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। মগেরা পাহাড়কে টং বলে।পাহাড়ে বসবাসের অনুমতি প্রাপ্ত চাকমা জাতির ঐ অংশকে তঞ্চঙ্গ্যা বা দৈনাক বলে। অনেকের ভাষ্যমতে তৈন গাং নামক স্থানে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীকে তৈন গাঙিয়া নামকরণ হয়ে আসছে। যা পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যা উচ্চারিত হয়ে আসছে। এখনো চাকমা সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে তঞ্চঙ্গ্যারাই মূল বা আসল চাকমা এবং বর্তামানে শিক্ষিত চাকমাদের ইতিপূর্বে বলা হতো “আনক্যা চাকমা”।এর প্রধান কারণ হচ্ছে মূল চাকমা রমণীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রমণীর পাণি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফলে তাদের মধ্যে কিছু স্বকীয়তা হারিয়ে গিয়ে কেহ কেহ খাস মঙ্গোলীয় চেহারা বিবর্তন এসে অপেক্ষাকৃত সুঠামদেহী ও সুন্দর চেহারাধারী হয়না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে- প্রকৃত মঙ্গোলীয়রা তত সুন্দর চেহারাধারী হয়না। যেমন -চীনা, থাইল্যান্ডি, ভিয়েৎনামী, কম্বোডিয়ান ইত্যাদি দেশের লোকেরা তত সুন্দর না। কি নারি কি পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই এমন লক্ষ্য করা যায়।মঙ্গোলীয়দের মুখাবয়ব বিশেষতঃ মুখের চোয়াল বেটে, নাক সুউচ্চ নয়, অপেক্ষাকৃত চেপ্টা, গাল ফোলা, বেটে ও প্রশন্ত হয়ে থাকে।তদ্রুপ গড় হিসাবে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চেহারাগত পার্থক্য সুস্পষ্ট বোঝা যাবে। তঞ্চঙ্গ্যা রমনীরা শারীরিক ভাবে স্থুল দেহী হয়, ব্যতিক্রমে শীর্ণ দেহী হয়। পক্ষান্তরে চাকমা রমনীরা বেশির ভাগ মাঝারী দেহী হয়, স্থুল দেহী অপেক্ষাকৃত কম হয়। অপরদিকে মূল চাকমা রমণীরা (দৈনাক রমণীরা) তাদের স্বভাব জাত আচরণ ও হাতে বোনা কাপড় পড়নের অভ্যস্থ বিধায় পোশাকের কোন পরিবর্তন না করে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে যুগের পর যুগ ব্যবহার করে এসেছে এবং আজও ঐ ঐতিহ্য বজায় রেখেছে বলেই গর্ব করে কথা প্রসংগে বলে থাকে “পাঁচ পোশাকধারী তঞ্চঙ্গ্যা” বা মূল চাকমা। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা ও চাকমাদের বর্ণমালার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কেবলমাত্র কয়েকটা বর্ণমালার তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। তাও অতি সম্প্রতি গবেষণায় জানা গেছে অধিকাংশ বর্ণমালার কেবল উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে।
১৩৩৩ খ্রীষ্টাব্দে যুদ্ধের পর আরাকানে পাহাড়িয়া অঞ্চলে বসবাস করতে দেয়া দৈনাকগণ বহু বৎসর ধরে সেখানে বসবাস করে। পরবর্তীত মগদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিতারিত চাকমাদের সাথে পুনঃ যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে কিছু সংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা আরাকান ত্যাগ করে উত্তর দিকে নিজেদের দলভূক্ত চাকমাদের সাহচর্য্যের আশায় টেকনাফ, উকিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিকদম, রুমা, লামা, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। যুগের বিবর্তনে কিছু কিছু দৈনাক মগদের জনগোষ্ঠির মধ্যে মিশে যাওয়াটা অবাস্তব কিছু নয়। কারণ বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফে বসবাসরত চাকমাদের সাথে (মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যা) বর্তমান শিক্ষিত চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে আলাপ কালে দেখা যায় তারা এমন বিদঘুটে শব্দ ব্যবহার করে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হয়না।অধিকাংশ শব্দগুলো বর্মী টিউনে উচ্চারণ করে ও কথা বলে।
১৯৬০ সনের আগ পর্যন্ত সর্বশেষ উত্তরের মৌজা মানিকছড়ি ঝগড়াবিল, বড়াদম, ওয়াগ্গা ও ঘাগড়া মৌজার সীমা পর্যন্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতি ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে বহু তঞ্চঙ্গ্যার পরিবার ও পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যভাগে যথাক্রেমে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত উপজেলা সমূহে উদ্বাস্তু হয়েছিল।পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে- তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় কোন তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস নেই। কেবল ব্যবসা বাণিজ্যে বা চাকরির কারনে গুটি কয়েক পরিবার হয়তো বসবাস করে থাকতে পারে। এখনও জনশ্রুতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরাই চাকমা চাকমা জাতির রাজ পরিবারের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ পোশাক যথাক্রমেঃ- (১)সালুম (চাকমা-সিলুম, বাংলা-জামা), (২) খাদি(চাকমা-খাদী, বাংলা- বক্ষবন্ধনী), (৩)পিনৈন (চাকমা-পীনোন, বাংলা- পরনের কাপড়), (৪) ফাউদুরী (চাকমা- ফারদুরী, বাংলা- কোমর বন্ধনী), (৫) মাধাকবং (চাকমা-খবং, বাংলা-পাগড়ী)।
পার্বত্য অঞ্চলে জনগোষ্ঠি আছে ৫০/৬০ দশকের পূর্বে (বর্তমান পার্বত্য সভ্যতার পূর্বে) কোন জনগোষ্ঠির পোশাক-আশাকে এত দৃষ্টিনন্দন ও অপূর্ব কারু কার্য খচিত বাহারী পোশাক বুনন- শৈলীর রেওয়াজ দেখা যেতনা। তৎকালীন সময়ে অপরাপর জনগোষ্ঠির পোশাকের সাথে তুলনা করলে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত সম্ভ্রমশীল পোশাক দ্বিতীয় ছিলনা। প্রত্যেকটি পোশাক বিচর বিশ্লেষণ করলে তবেই বুঝা যাবে এর অতুলনীয় শৈল্পিক কাজ। অবশ্য বর্তমানে পাহাড়িদের মধ্যে সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আধুনিকতার চিন্তা-চেতনায় সুন্দর সুন্দর পোশাক বুননে কমবেশী সকলেই সচেষ্ট। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের গুণগত মান ও ঐতিহ্যের বিচারের কথা বলা হচ্ছে আজ থেকে ১০০ থেকে ১৫০ বছরের সময় কালের পোশাকের। অথচ সেই সময় থেকে পোশাকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ জনগোষ্ঠির নারীরা বুননে অনুন্নত ছিল। এ পাঁচ পোশাক বিচর বিশ্লেষণ করলে সুস্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে- এই পোশাগুলোই চাকমা রাজ পরিবারের হৃত গৌরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক যা অতীতে কোন কোন যাত্রা থিয়েটারে রাজা-বাদশার মাথায় পাগড়ি পরিধানের রেওয়াজ লক্ষ্যে করা যায়। এই পাগড়ি সম্মানের ও অভিজাত্যের প্রতীক। হয়তো কেহ কেহ বলবেন- কোন কোন আদিবাসী পুরুষ বা মহিলারা ও তো পাগড়ি ব্যবহার করে থাকেন। এ কথাটা শতঃসিদ্ধভাবে বলা যায় যে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের উল্লেখিত পাঁচ পোশাকের মত অন্যান্য কোন জনগোষ্ঠির রমণীদের মধ্যে এত সুচারু, সুনিপুন ও সমান মাপের এবং সুনির্দিষ্ট ডিজাইনের ছিল না।
নৃতাত্বিক, সাংস্কৃতিক, কৃষ্টি, ভাষা ও বর্ণমালা তথা সামগ্রিক বিচারে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা বলতে আদৌ কোন দ্বি-জাতি ছিলনা। একই জাতির হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও নির্মম পরিণতিতে সুদীর্ঘ সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় ও অন্য জাতির সংস্কৃতির ছোঁয়ায় কথায়, আচার- আচরণে যৎকিঞ্চিৎ বিবর্তনের ফলেই আজ তঞ্চঙ্গ্যা জাতির উদ্ভব।