ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়নঃ তঞ্চঙ্গ্যা উত্তরাধিকার প্রশ্ন  

ড. মনিরুজ্জামান (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

 ১। ভূমিকাঃ ভাষার আন্তঃসম্পর্ক, বিভিন্নতা আকস্মিক মিল

রবীন্দ্রনাথের একটা বাণী আছে যে,  জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা ‘। এটা ভাষাতত্ত্বেও প্রযোজ্য। বিশেষত তুলনার ক্ষেত্রে। বিষয়টা তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা ভাষার আলোচনার ক্ষেত্রে বিচারযোগ্য কিনা আমরা এখানে তা দেখার চেষ্টা করব। তার আগে আলোচনার একটা মডেল অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সকলেই জানেন ভাষা বড় নিরঙ্কুশ। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় অপরিচিত ধ্বনিপুঞ্জ মাত্র। তথাপি অবাক হবারও কিছু নেই যদি দেখি ইন্দোনেশিয়া মালেশিয়া ভাষায় ‘ পণ্ড ‘ শব্দ বাংলা ভাষার ‘ পণ্ডিত – এর কাছাকাছি কিংবা ঐ সব ভাষায়ও বাংলার মতো ‘ মাতা ‘ বলে শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এইসব শব্দের অর্থ একেবারেই ভিন্ন। আবার একই অর্থেও অভিন্ন শব্দ বা সমানুরূপ শব্দ দুই ভাষায় থাকা সম্ভব। যেমন পার্শি ‘বদ’ ইংরেজি ‘ bad ‘ (দুয়েরই অর্থ ‘ খারাপ ‘)। কিংবা পেরুর আন্তঃপাতি দেশীয় কোন ভাষায় ‘ইন্তি’ আর বলিভিয়ার কোন উপজাতীয় ভাষায় * ‘নৃতি’ – দুয়েরই অর্থ ‘দিন’। এইভাবে দেখা যায় সঠিক কোন ধারাবাহিকতা ছাড়াই বা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ক্রম ব্যতিরেকেই আপাত মিল প্রদর্শনকারী ভাষার উদাহারণ অবিদ্যমান নয়। এইসব আকস্মিক মিল শব্দ ভাষা আলোচনায় ও ভাষাবর্গ নির্মাণে কতটুকু সহায়ক এসব নিয়ে ইদানীং আলোচনা শুরু হয়েছে। ডেভিড পনি ও রবার্ট ক্রুসি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আরাওয়াক ও মাপুচেদের ভাষা তুলনা করতে গিয়ে দেখেন দুই ভাষার আকস্মিক মিলগুলি বিরহিত করা গেলে দুয়ের সম্পর্ক নৈকট্য বিচার সহজ হয়। এজন্য তাঁরা উপায় নিরূপণ করেন ও তার একটি মডেল উদ্ভাবন করেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে তাঁরা বংশগতিধারা নির্মাণের পূর্ববর্তী মডেলগুলি একেবারে বাদ দেন নি এবং নিত্য সম্বন্ধযুক্ত প্রায়ানুরূপ গঠনগুলির মিল পুনঃপরীক্ষার বিষয় বলেই মেনে নেন। আসলে তুলনামূলক পদ্ধতিতে অনুমান নির্ভরতার যে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি একসময় ধ্বনি পরিবর্তনের ধারা পুনর্গঠনে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতো , বর্তমানে তার স্থলে তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিকতা ও ঐ তথ্যের যাবৎ জ্ঞান সঞ্চারণ, সংগঠন ( organisation ) ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন ( modify ) আনয়ন করেন। তাঁদের এই প্রত্যয় ইদানীং আমেরিকার বহু ভাষারই সম্পর্ক উদ্ঘাটনে আদর্শ নমুনা হিসেবে আজ পরিগণিত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রজাতির ভাষা বিষয়ে আমরা যখন ভাবি তখন সে সব ভাষার আন্তঃসম্পর্ক আমাদেরও ভাবিত করে। আমরা কখনো অস্পষ্ট সনাতন ধারণা থেকে কথা বলি অথবা জাতীয়তাবাদের ধারণা মিশ্রিত করে কোন না কোন রাজনৈতিক ভাষ্য দেবার প্রয়াস পাই। এসবের কোনটাই ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে গ্রহণীয় নয়। সম্প্রতি ইউজিন ই . লুস – এর একটি আলোচনা পড়ে আমার এ প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় আমার প্রয়াস হবে লুসের চিন্তার খানিকটা অংশ এখানে যোজনা করার।

বর্তমান প্রবন্ধে উপজাতীয় ভাষার কিছু অপ্রকাশিত তথ্য থেকে দু’একটি প্রাক – গবেষণা মন্তব্য উপস্থিত করার চেষ্টা করা হবে উপরিল্লিখিত আদর্শের সামান্য প্রভাবের আলোতেই। তবে এই আলোচনা কোন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা – কর্ম নয়।

২। ভাষার বিকাশেউত্তরাধিকারসঙ্কট ভাষাঅনুগমন

আধুনিক ভাষাতত্ত্বে অনুসন্ধানের একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে বংশগত ধারানুক্রমের সমস্যা। তামিল ও জাপানী ভাষার মধ্যে যেমন বংশগত সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় না, তেমনি জাপানের বহু উপভাষা রয়েছে যাদের আন্তঃ সম্পর্ক নির্ণয় ও বংশগত সম্পর্ক ভিত্তিতে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব। পোল্যান্ডের এক ঐতিহাসিক – ভাষাতত্ত্ব সেমিনারে (১৯৮৩) উপস্থাপিত প্রবন্ধে এক ভাষাবিদ দেখান ভাষার প্রত্নস্তরে একাধিক রূপ থাকাটা বিচিত্র নয়, ফলে ধরা যাক, মূলে যদি থাকে

* নদ > সেখানে পরবর্তী স্তরে (Reflex) নদ থাকতে পারে, আবার পূর্ব স্তরের অন্যবিধ রূপগুলোও আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। যেমন * নদ-

দ (সরলীকরণ) নদ (সংরক্ষণ) ত (বিনাসিক্যীকরণ)

সুতরাং উত্তরাধিকার প্রশ্ন এখানে উপভাষার ব্যবহারিকতার মাত্রার (যদি না পার্শ্ববর্তী বা চাপানো ভাষা শক্তিশালী হয়) ওপর নির্ভর করে। নবায়ন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ধারানুসরণও এখানে বিশেষ বিচার্য এরূপ ক্ষেত্রে নদ > ত এই নবায়ন প্রক্রিয়া সরাসরি উত্তারাধিকার সংকটের পরিপন্থী।

সম্ভবত এখানে ত = ত + < দ । এবং দ = ত + দ শুধু তাই প্রত্নরূপ অর্বাচীন রূপ নতাকি আধুনিক রূপ মুদাখী / মুদা (অনুসর্গ যোগ ) (একীভূতি : k – i > ki এবং স্বরাঘাতে পরিবর্তন) (পুনর্গঠন অনুসর্গ লোপ ও অক্ষর গঠনে নব্য ব্যাকরণীকরন) এই রূপ বিবর্তনের কথাও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। এই ব্যাখ্যা থেকে অঘোষ দীর্ঘীভবন এই সহজেই বুঝা যায় এইসব সমজ শব্দে কালের প্রবাহে ঘোষ ঘোষ রূপের বৃত্ত , এবং অল্পপ্রাণ- > মহাপ্রাণ হ্রস্বস্বর নিয়মগুলি ও তাৎপর্য পেয়েছে সরল আবর্তনের মধ্যেই ভাষায় এইরূপ পরিবর্তনকে দ্বিরাপরিবর্তন বা দ্বিমুখ ধারা পরিবর্তন বলা হয়। আভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের সূত্রে এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের ব্যাখ্যা ও পথরেখা ক্রমসম্পর্ক (CR: Chronological Relation) আমরা পেতে পারি। ই . লুস এবং তার অনুসরণে আরো কেউ কেউ এই মতটাকে সাধারণ বলে মনে করেন। আভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন সূত্র ধরে পরিবর্ধন করে বংশগত সম্পর্ক বা ভাষার আস্ত সম্পর্ক বিচারেও প্রয়োগ করা সম্ভব। জাপানী ভাষাবিদ সুসম্মু ওনো এইভাবেই সক বিচ 1224 তামিল ও জাপানীর আন্তঃসম্পর্ক ও বংশগতির ধারা পুনর্নির্মাণে দুঃসাহসিকতা SEMIN www দেখিয়েছেন। এই দুই ভাষার সাথে তৃতীয় কোন ভাষায় বহু অতীতের কোন A ‘মিসিং লিংক’ আবিষ্কারের এটাই হয়ত এখন গ্রহণীয় ধারা হয়ে উঠবে, বিচিত্র WRIST KEH GOLS, D কি! অথবা এখানে হয়ত ভাষা অনুগমনের (Succession) কোন ইঙ্গিতও থাকা সম্ভব, কে জানে? বিষয়টাকে আমরাও গুরুত্ব সহকারে বিচারের বিষয় রূপে দেখতে পারি, বিশেষত বাংলাদেশের আন্তঃউপজাতীয় ভাষায় বিশেষতঃ চাকমা-তনচংগ্যার সম্পর্ক নির্ণয় ক্ষেত্রে। চাকমা ভাষাকে ‘ ভাষা অনুগমনে’রই একটি উদাহারণ বা রূপ বলা যাবে কি? আমরা সাহিত্যিক চুরির (Plagia rism) কথা জানি, কিন্তু অতীতে বহু ভাষাভাষী ও প্রাচীন যুদ্ধ বাহিনী গুলিতে বা যুদ্ধযাত্রার সামরিক পরিবেষ্টনে ‘ মেলে ‘ পরিণত হয়ে দেশ ছাড়া, সংস্কৃতি ছাড়া, এবং আত্নপ্রকাশের অধিকার ছাড়া হয়ে পরবাসী হয়েছে । ভারতের ‘ সৌরা ‘, DEL মধ্যপ্রাচ্যের ‘ হিট্টি ‘ এবং তুরস্ক প্রান্তের বহু প্রাচীন জাতি পরিচয়ের দিক থেকে আজ এভাবেই যেমন পরভাষা গ্রহণ করেছে তেমনি অপর প্রধান ভাষা বা নব্যজাত ভাষা ( জায়মান স্তরে) এইসব ভাষাভাষীকে স্বভাষায় অপহরণ ও উত্তরাধিকার দান করেছে। উর্দু ভাষার প্রকৃত ভাষাভাষী এখন যেমন অপহৃত , ঠিক তেমনি।

৩। ভাষাপরিচয় চুরি আয়তন তত্ত্ব

বিশেষ বিশেষ এলাকায় বিশেষ ভাষাগুলি কিভাবে বিস্তার পায় ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করে এবং সে ক্ষেত্রে কিসের ভিত্তিতে আয়তনের তারতম্য নির্দিষ্ট হয়, এইসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একবার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে । এই মাঠকর্মের রিপোর্টটির প্রতি লক্ষ্য রাখেন SIL (ভাষা তাত্ত্বিক সামার স্কুল) রিপোর্টে দুটো জিনিস বোঝা যায়।

যথা –

১। কোন মহাদেশের কোন এলাকায় কোন ভাষায় কত জনসংখ্যা কি আকার লাভ করবে এটা একেবারেই পারিবেশিক বিষয় । পরিবেশের আনুকুল্য কিসে নির্ভর করে তার উপরই এর উত্তর নির্ভরশীল। (এরও বহু তত্ত্বীয় প্রসঙ্গ আছে এবং সমাজ – ভাষাতাত্ত্বিক আদর্শ (norm) ও পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের Log norm সংক্রান্ত ধারণাও এর সাথে প্রযুক্ত)

২। ভাষা এখানে নিশ্চল নয় , পারস্পরিক লেনদেন সাপেক্ষ। তবে যারা বিশেষ অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে পরস্পরকে অর্থাৎ পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারে না তাদের মধ্যে দ্বিভাষিকতা বৃদ্ধি পায় অথবা তাদেরই ভাষা ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন মনে করা হয়। যেমন ৫৪৪৫ টি ভাষার মধ্যে প্রতি ৪ টি ভাষার মধ্যে একটি ভাষার জনসংখ্যা বাস্তবিক সৌভাগ্যসূচক। কিছু কিছু ভাষা তো রীতিমতই ঈর্ষণীয় , কিছু ভাষা মোটামুটি মানানসই যদিও তাতেও অতিরঞ্জন থাকা অস্বাভাবিক নয়। আবার একইভাবে কিছু ভাষার ভাগ্য অপহত ; এগুলি অবমূল্যায়নকৃত ও হৃতমূল্যক। SIL কৃত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে এতে সামগ্রিক বিচারের ওপর কোন প্রভাব পড়ে নি। সম্ভাব্যতা বা সম্ভাবনা তত্ত্ব মেনে নিলে বলতে পারি এটা দ্বিভাজক ও দ্বিপদী বিন্যাস ও স্বাভাবিক বিন্যাসে সঠিকতা নির্দেশের ক্ষেত্রে একটি প্রয়াস বা প্রক্রিয়া। সঠিক সত্য সবসময়ই সম্ভাব্য সত্য, কারণ তার ভিত্তি আপাত প্রাপ্ত তথ্য নির্ভর । কিন্তু আসলে এরূপ আপাত প্রাপ্ত তথ্য নির্মিত লগ – নর্মের ছক রেখা (lognormal curve) থেকে সত্যের দূরত্ব ঘটা সম্ভব। এই দূরত্ব হতাশা ও বঞ্চনা বোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিরুত্তাপ ও ক্ষণিকতার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না বা তারও বেশি এমনকি কোন ভাষা সংঘাত বা অন্দোলনের উৎস মুখ গড়ে তুলবে না এটাই বা কি করে মনে করা যায়? এছাড়া একপার্শ্বিক তথ্যপ্রাপ্তির কারণে বা পক্ষপাতিত্বের ফলে এই কার্ভ রেখা যে যথার্থ ও সামগ্রমানক নয় (total population), তার নিশ্চয়তাই বা কি? এখানে আরো একটি গুণনীয়ক বিষয় যোগ করা আবশ্যক। উপরোক্ত রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে উত্তর আমেরিকায় কিছু ভাষা মরে যাচ্ছে, বা ম্রিয়মান হচ্ছে আর বাকীগুলি এখনো বিপদাক্রান্ত হয়নি। গ্রস্ত না হওয়ার কারণ পারিবারিক ভাবে টিকে থাকার ব্যাপারটাকেই তুলে ধরা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে তাদের বলা হচ্ছে ‘ উপভাষা ’। বহু ক্ষেত্রে এগুলোর পরিচয় ‘ বিকৃত ‘ (dis torted)। বহু ক্ষেত্রে এগুলি শ্রুতিভাষা মাত্র (কথ্য ভাষার বিপরীত) , যদিও একই বা প্রতিযোগিতামূলক (আংশিক বা পূর্ণ) পরিবেশে ভাষা কথকের সংখ্যাও যথেষ্ট বিদ্যমান। এরা পাশাপাশিই বাস করছে। দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, শিল্পায়ন, দ্রুতনগরায়ণ, যুদ্ধ, সংঘাত, সাম্প্রদায়িক আঘাত সবকিছু নিয়েই মানুষের এই অবস্থান। কিন্তু ভাষা তাতে মরে না। ভাষা মরে উপনিবেশি অধিকার আরোপে এবং দুর্বলতার সুযোগে মান্য ভাষার বিস্তারে। এছাড়াও আশ্চর্য নয় যে অবস্থাভেদে ‘ রাক্ষুসী ভাষা’র কথাও জানা যায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে এক ভাষা অন্য ভাষাকে আত্নসাৎ করে নেয় বা তার ভাষাভাষীকে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নেয়। Some language occasionally gobble up others , or steal speakers from them , in what is known as ‘ language succcesion ‘ ( J.E. Grimes )। এ ক্ষেত্রে ভাষা অনুগমনের কথা আগে বলেছি।

৪। তনচংগ্যাদের অবস্থান

তঞ্চগ্যা, তংচঙ্গা, তংচৈংগা, টংচঙ্গা, তনচংগ্যা – এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন বানানে যাদের পরিচয় সেই তাদের প্রকৃত অবস্থানের কথা আগে বলে নেওয়া আবশ্যক।

১৯৯১ সালের জনসংখ্যা পরিগণনায় চাকমা ও তনচংগা ভাষাভাষীর সংখ্যা যথাক্রমে ২৫২৯৮৬ এবং ২১০৫৭ জন। চাকমাদের অবস্থান বরিশাল (১০৪৯), খুলনা (৬১৪), চট্টগ্রাম (২৪৮৩২১) , ঢাকা (২৯৯৯), রাজশাহী (৩) বিভাগের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু তনচংগাদের অবস্থান শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেই দেখা যায়। বাংলাদেশে হরিজন বাদে জনসংখ্যায় নিম্নতম জনবাসী হিসেবে অর্থাৎ দুই হাজার বা তার নিচে যাদের অবস্থান তাদের মধ্যে রয়েছে বংশী, চাক, খ্যাং, খমই, লুসাই, মুণ্ডিয়া, টিপরা, উরুয়া এবং অনামা পাহাড়ী (?) প্রভৃতি এবং ‘বিবিধ’ শ্রেণীর আরো কিছু জাতি বা উপজাতির লোকেরা।

তবে লুসাইদের অবস্থানই সাধারণ পাহাড়ীদের মধ্যে সর্বনিম্ন (৬৬২)। জনসংখ্যা তত্ত্বের বড় দুর্বলতা এখানে যে তাদের হাতে তথ্য সম্পূর্ণভাবে আসেনা , এলেও শ্রেণীবিভাজনের সনাতন রীতিই সেক্ষেত্রে কার্যকর থাকে। কারা লোহারু, কারা কামার, কিংবা কারা পাহাড়ী এসব তথ্য যাচাই করা যেমন অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, বিভিন্ন পাহাড়ীদের চিহ্নিত করাও তেমনি কষ্টকর। দক্ষ লোকবলের অভাবই নয়, জনতত্ত্ব, নৃ – বিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্বের জ্ঞানের সংমিশ্রণে যে পরিচিতি বা বিবরণ প্রদান সম্ভব সেটা সরকারী কর্মী বা কর্মচারীদের আয়ত্তের বাইরে। এছাড়া জনসংখ্যা গণনার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কোন দেশেই এক নয়, এমনকি বিভিন্ন সরকারের আমলেও বিভিন্ন হয়। তথাপি বিচিত্র কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন রাজবংশীদের ক্ষেত্রে। এরা নিজেদের কোচ জাতির বংশধর বলে দাবী করেন। সম্ভবত এরা বোরোদেরই অংশ। লোকগণনা – প্রতিবেদনে ‘বংশী’রা ঢাকাবাসী একটি বর্ণ (caste) আর ‘রাজবংশী’গণ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জনবাসী জাতি। কিন্তু রাজবংশী মুসলমানও হয়, বৈষ্ণবও হয়। জনসংখ্যা গণনা মতে (১৯৯১ সন) এদের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার (৫৪৪৪ জন) হলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কারণ এদের অন্তঃপাতি গোত্র সংখ্যাই ১২ টি । এরা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের প্রতিটি জেলা ছাড়া ময়মনসিংহেও এদের বহু বসবাস। ঠাকুর গাঁ অঞ্চলে তাদেরই একটি বিশেষ গোত্র বা উপ – বর্ণ হচ্ছে পলিয়্যা ; তদেরই সংখ্যা রাজবংশীদের মোট জনসংখ্যারই প্রায় অর্ধেক। (উল্লেখ্য রাজবংশীরা এখন নেপাল, ভূটান, আসাম, তিব্বত ও হিমালয়ের নানা উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে , যাদের পরিচয় সন্ধান নৃ – বিজ্ঞানী ও ভাষাবিজ্ঞানিদের একটি বিশেষ প্রিয় এলাকা। তনচংগ্যাদেরও অবস্থান ভারত ও ব্রহ্মদেশের আরাকানে থাকা সম্ভব।

এই উদাহারণ থেকে বুঝাতে চাইছি, তনচংগ্যাদের অবস্থান নিয়ে ইদানীং যে সব লেখালেখি হচ্ছে (যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা এবং আরো অনেকে), তাতে করে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে তাদের নাম ও অবস্থান নিয়ে সমস্যা খুব সামান্য নয়। যথা-

১) নাম সম্পর্কে সঠিক শব্দ কোনটি বা তার যথার্থ উচ্চারণ, বানান ও ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট গোল রয়েছে;

২) সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান (সরকারি সংখ্যা মেনে নিয়েও);

৩) গছা (গোজা) সংখ্যা নির্ণয় সম্পর্কে তথ্য অপর্যাপ্ত;

৪) ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে ভিতরে ও বাইরে পরস্পর বিপরীত মত আছে;

৫) চাকমাদের সাথে তনচংগাদের সম্পর্ক ও সামাজিকতার নানা বিতর্ক রয়েছে।

আমাদের বর্তমান লক্ষ্য এই শেষোক্ত বিতর্কটির দিকে । নানা প্রমাণে আমি অন্যত্র এদেরকে একটি চাকমাদের প্রাচীন অপরিবর্তিত অংশ রূপে (তুলনীয়: পালিয়্যা ও রাজবংশী- যার উল্লেখ একটু আগেই করা হয়েছে) ভেবেছি। এখন এই দুয়ের সম্পর্কের বিষয়টি জটিল হয়ে উঠছে বিধায় এ বিষয়ে আলোচনা আবশ্যক।

তনচংগ্যাদের মধ্যে ইদানিং সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে শিক্ষারও বিস্তার ঘটছে। বান্দরবানে রোয়াংছড়িতে মারম, বম ও ত্রিপুরাদের পাশাপাশি এদের অবস্থান প্রতিযোগিতামূলক । বান্দরবান সদরেও তাই। এই ভাবে রাঙ্গামাটি সার্কেলেও রাজস্থলী ও বাঘাইছড়িতে (সম্ভবত কিছুটা খাগড়াছড়িতেও) এদের অবস্থান অনুল্লেখ্য নয়।

“আরণ্য জনপদে ” -র লেখক আবদুস্ সাত্তার লেখেন ( ১৯৭৫ : ১২০ ) তংচঙ্গ্যা এবং দৈংনাক একই জনগোষ্ঠি , উপাধির ভিন্নতা মাত্র। দ্বিতীয়ত : এই তংচঙ্গ্যাগণ আবার “ মূলত চাকমা ” , পার্থক্য শুধু এই যে , তাদের মধ্যে “ ধর্মীয় ব্যাপারে অনেক পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ” আবার ‘ অঞ্জলি ‘ পত্রিকার ১/৫ সংখ্যায় ( পৃ .১১৫ ) গগনচন্দ্র বড়ুয়া উল্লেখ করেন যে , তংচঙ্গ্যাদের মূল পরিচয় তারা আরাকানের এক পাহাড়ী জাতি ; তারে সাথে অপর কোন পাহাড়ী জাতির মিশ্রণ ঘটে । এই মিশ্র জাতিটির ভাষা বা লেনদেনের ভাষা ছিল চাকমা । কিন্তু “ চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভুক্ত করিয়া লয় নাই । এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোন রূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ নাই । চাকমারা সাধারণত ইহাদিগকে একটু ঘৃণার চোখে দেখিয়া থাকে । ” ( উদ্ধৃতি , আবদুস্ সাত্তার , ঐ ) এই পরিচিতি মোটামুটি বা কমবেশী সকলেই মেনে নিয়েছেন , অর্থাৎ এর মধ্যে অতিরঞ্জনের কিছু নেই । কিন্তু উৎস ও দল নিয়ে যে মতগুলি বিদ্যমান সেগুলি হচ্ছে

ক। দৈংনাক প্রসঙ্গঃ

১. কর্নেল ফেইরীর মত: (১৮৪১: ১১৭)

ক) চাকমা ও তঞ্চগ্যা বা দৈংনাকেরা ভিন্ন জাতি।

খ) দৈংনাকেরা সিম বা নাগো ‘ নামে পরিচিত।

গ) দৈংনাকেরা খুব সম্ভবত বাঙ্গালী সংমিশ্রণের সন্তান সন্ততি।

ঘ) আরাকানের সান্নিধ্যে থাকায় এবং আবহাওয়ার ক্রম পরিবর্তনে তাদের চেহারাগত বৈশিষ্ট্যে সামান্য পার্থক্য লক্ষিত হয়।

ঙ) এরা গৌতম বুদ্ধের অনুসারী।

২. ক্যাপটেন লুইনের মত: (১৮৬৯: ৬৪)-

ক) দৈংনাকেরা চাকমাদেরই অন্যতম শাখা ।

খ) রাজআদেশে বিজাতীয়দের সংগে এদের সম্পর্ক হয়।

গ) আরাকান প্রভাবে “তাদের কথাবার্তায় অনেক মগী শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে; এমনকি বিকৃত বাংলা ব্যবহারের প্রচলনও লক্ষ্যযোগ্য।”

খ। তনচংগ্যা প্ৰসঙ্গঃ

৩. স্যার রিজলির (১৮৯১: ১৭০) মত

ক) তনচংগ্যারা চেহারাগত বৈশিষ্ট্যে আদি মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতি।

খ) তারা বৌদ্ধধর্মের পুরোপুরি অনুসারী নয়।

৪. ক্যাপ্টেন লুইনের মতে (ঐ ৭৬-৭৭)

ক) তনচংগ্যাদের ধর্মভাবে জড়োপাসনা (religion of na । ture) ছাড় বা প্রকৃতি উপসনা ধারা সম্পৃক্ত। এবং: They have vague and undefined ideas of some divine power which over as shadows all?

খ) এদের মধ্যে প্রাচীন প্রবীণরা আরাকানি ভাষায় কথাবার্তা বলে আর নবীনরা চাকমাদের অনুকরণে বিকৃত বাংলা ব্যবহার করে থাকে। (ঐ, পৃ ৬৮)

উপরোক্ত মতবাদগুলিতে তংচংগ্যাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় বোঝা যায়। উদ্ধৃত উক্তিগুলিতে তনচংগ্যাদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই জন্মে। যেমন-

১. এরা জাতিগত ও ধর্মগতভাবে এবং ভাষাগতভাবেও আরাকান মূলক্রমী।

২. দৈংনাক এদেরই অপর মিশ্রগোষ্ঠী এবং ধর্মে বৌদ্ধ (গৌতমবুদ্ধ অনুসারি)

৩. চাকমা, দৈংনাক ও তনচংগ্যারা ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পৃথক পৃথক কিন্তু সমউৎসক, মঙ্গোলীয় জাতি। (‘যোগেশচন্দ্ৰ’)

. চাকমা প্রসঙ্গ:

ক) সতীশচন্দ্র ঘোষের মতে চাকমারা মোঘলদের বংশধর তবে একবার উৎপত্তি মগদের থেকে স্থানীয় ধারণা, মুগল সৈন্য ও আরাকানী নারীদের মিলনে সেকদের উৎপত্তি হয় । এরা সাক নামে পরিচিত ।

খ) জে. পি. মিলস- এর মতে, চাকমারা মগনারী ও মুগলসৈন্যদের সমন্বয়জাত। (উদ্ধৃতি যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৮৫: ৩৫।

গ ) বিরাজ মোহন দেওয়ান , সতীশ চন্দ্র ঘোষ , কামিনী মোহন দেওয়ান প্রমুখ গবেষকগণ চাকমাদের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তথ্য দেন । এঁদের মতে চাকমারা শাক্যবংশীয়। তারা চম্পক নগরের কথা উল্লেখ করেন এবং এই মত প্রতিষ্ঠা করেন যে প্রাচীন রাজা সাদেংগ্রীর বংশধর বিজয়গিরি (বিজগ্রী , ৫৯৫ খ্রী:) আরাকান অভিযানে বিজয়ী হয়ে সা: প্রে: নগরী স্থাপন করেন ও বিজাতীয় রমণী বিবাহ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তনচংগ্যাদের অনেকেই এখনো নিজেদের ‘ সা: প্রে: কূল্যা ‘ পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালবাসেন।

ঘ) যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা উল্লেখ করেন, চাকমা ও তনচংগ্যারা এক কালে একই সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল। (১৯৮৫: ভূমিকা) ঙ) শ্রী মাধব চন্দ্র চাকমা (শ্রী শ্রী রাজনামা বা চাকমা রাজন্যবর্গ ‘) উল্লেখ করেন, চাকমারা দ্বিধা বিভক্ত, এবং তার এক অংশ “রোয়াঙ্গ্যা” চাকমা (তঞ্চঙ্গ্যা), আর অপর অংশ “আনক্যা” চাকমা। (অর্থাৎ আরাকান থেকে রোয়াইং > রোয়াঙ্গ্যা এবং তার বাইরে চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অর্থে ‘ আনক ‘ থেকে ‘ আনক্যা ‘।

তনচংগ্যাদের অন্যান্য তথ্য:

তনচংগাদের সম্পর্কে ১৯ শতকের পূর্বার্ধকাল থেকেই সিবিলিয়ানদের দ্বারা অনুসন্ধানের কথা জানা গেলেও বাংলা ভাষায় এবং স্বজাতিদের মধ্যে সম্ভবত শ্রী পমলা ধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রথম (১৯৩৭-৩৮) সনাতন ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে সচেতনতার পরিচয় দেন। মাঠ তথ্য ভিত্তিতে “আরণ্য জনপদে” -র লেখক আবদুস সাত্তার প্রায় ৩০ বছর পরে (১৯৬৬) কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন এবং গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে তনচংগাদের পরিচয় সহ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি চিত্র উপস্থাপন করেন। পরবর্তী কালে যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৮৫), বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও অন্যান্য (১৯৯৫), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (২০০০) প্রমুখের আলোচনা পাওয়া যায়। এইসব আলোচনার বাইরে কিছু সাংস্কৃতিক- ধর্মীয় প্রসংগ ও সৃষ্টিমূলক রচনা সম্বলিত ম্যাগাজিন ও গ্রন্থিকার কথা জানা গেলেও ( যথা- “ পহর জাঙাল ” -এর পূর্ববর্তী সংখ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ‘বিষু’ -প্রকাশনা প্রভৃতি) এগুলিকে আমরা সনাতন ধর্মী বা ট্রাডিশনাল রচনা বলতে পারি।

জগৎ ও জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন চাহিদা মেটানোর উপযোগী রচনা এখনও অপেক্ষিত। যাই হোক, এই সব রচনায় তনচংগ্যাদের ভাষা সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট বলা হয়নি, যদিও আবদুস সাত্তারই প্রথম উল্লেখ করেন যে এদের প্রবীণ প্রজন্ম এখনো আরাকানী বা মগ দ্বিভাষী। এই বিষয়ে এর অধিক তথ্য জানা যায় না। চাকমাদের সাথে এদের পার্থক্যের মৌলিক কয়েকটি ব্যাকরণী ভেদের কথা জানান শ্রী যোগেশচন্দ্ৰ ৷ এছাড়া এদের গোজা ভাগ নিয়েও সংশয়াত্মক উক্তি ও পরস্পর বিরোধী ধারণা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আবদুস সাত্তার উল্লেখ করেন এদের মধ্যে ৬ টি গছা (গোজা) ভাগ আছে , এরা পরস্পরকে প্রীতি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে জাতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে থাকে। রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (২০০০) উল্লেখ করেন, এই গোজা (গছা) সংখ্যা ৬টি নয়, ৭টি। তবে বলেন যে , চাকমা ইতিহাসে তঞ্চঙ্গ্যা নামের উল্লেখ মাত্র পাওয়া যায় না। অথচ “ শোনা যায় তঞ্চঙ্গ্যা গণই আসল চাকমা। ” তবে ইদানীন্তন রাঙ্গামাটির কোন এক সাময়িকী মতে চাকমা জাতি থেকে অপভ্রংশ বা চাকমা জাতির গোজা থেকে রূপান্তরিত রূপে বিকাশ পায় তঞ্চঙ্গ্যা গছা । যেমন- টোন্যা গোঝা থেকে নাকি তঞ্চঙ্গ্যা গছা; ধর্মেই গোঝা থেকে ধৈন্যা গছা মুলিমা গোঝা থেকে মু’গছা; কাম্বেই গোঝা থেকে কারবোয়া গছা এবং এভাবে লার্মা থেকে প্লাং, আঙু থেকে অঙ্য ও অপর কোন গোঝা থেকে মগলা গছার বিকাশ। রতিকান্ত এই ‘ ভ্রান্তি ‘ যুক্তি বা তথ্য দ্বারা খন্ডন না করে বলেছেন ‘ বিষয়টি সম্পূর্ণ কাল্পনিক । ‘ রতিকান্ত আবদুস সাত্তার এর মতও গ্রহণীয় নয় বলেছেন, বিশেষত চাকমা – তঞ্চঙ্গ্যা সম্পর্কের কথা (‘ঘৃণা’ সূচক মনোভাবের কথা আগে উল্লেখিত হয়েছে। তিনি আবদুস সাত্তার উল্লেখিত গছার ( ৬ টি ) সাথে একটি অতিরিক্ত গছা নাম (মেলং গছা) উল্লেখ করেন ও যোগেশ চন্দ্রের ন্যায় তাদের অন্তর্গত ডেল বা দলের পরিচিতি দেন। যোগেশচন্দ্র ১২ টি গছার কথা জানালেও ৬ টিরই নাম উল্লেখ করেন ও বলেন অন্যান্য গছার গুত্তির বিবরণ অদ্যাবধি পাওয়া যায় নি।

তনচংগ্যা কি চাকমা থেকে পৃথক?

ভাষা পৃথক হয় কেন এই বিষয়ে প্রবন্ধের গোড়ায় কিছু তত্ত্বীয় উদাহারণ দিতে চেষ্টা করেছি । তারই আলোকে এখানে আমার ধারণাটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো । প্রসংগত উল্লেখ্য এখানে তনচংগ্যা চাকমা ভাষার গঠন অর্থাৎ ভাষাতাত্বিক যে বিশ্লেষণ আবশ্যক অন্যত্র আমি তা দেখিয়েছি।

আলোচনা আমার ‘ উপভাষা চর্চার ভূমিকা ‘ (১৯৯৪) ও Studies in the Bangla Language (1991) গ্রন্থদ্বয়ে এবং কিছু প্রবন্ধ যথা- “ পহর জাঙাল ” প্রথম সংখ্যা (২০০৩) প্রভৃতি সম্পাদিত গ্রন্থ ও পত্রিকায় দেখে থাকবেন। উভয় ভাষার সম্পর্ক বা নৈকট্য / দূরত্ব অন্যান্য সমালোচক যে উদাহারণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন তার দুটি নমুনা দেখা যাক । সদানন্দ চাকমা সুহৃদ ( ২০০৩ : ১৩০-৩১ ) ৬২ টি শব্দ দিয়ে দেখিয়েছেন তাতে শুধু যে বাংলা প্রভাবই আছে তা নয় এতে বিকৃতি সাধনও ঘটেছে প্রচুর । এইসব অপ্রকৃত শব্দের কারণে চাকমা – বাংলার সমাকৃতি বা সদৃশতা বেশী করে মনে হয় । আমরা উদাহারণগুলি এভাবে সাজাতে পারি –

চাকমা – বাংলা > joda / juta, bodol / botol, kenjan / ken, doar / dorja, goloch / glass, kaboj / kagoj, bigol / pichol – etc. চাকমা – চট্টগ্রামী > no mattye (reserved), boyer (wind), lobadasya (shaky), koroli (sand), kuluk (dark), El (green), dhub (white), bijon (hand fan), pujor gorana (asking), oiran (tired), phuni (comb), boi thana (sit) etc.

বাংলা / চট্টগ্রামী মাধ্যমে বিদেশী শব্দ > door (door), tojje (trouble), goloch (glass), kadire (chair), kabil (expert), mattol (mad), boda (egg) -etc.

প্রভাবিত চাকমা শব্দ > khamakkai (ofcourse), kojoli (request), chhatrosan (ransacked), sidhe (gentle), oma (Oh God), Ejo (still), tip batti (torch) – etc.

বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা সম্পাদিত (১৯৯৫) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা পালি, প্রকৃত ও সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার ‘পরিপূর্ণ ‘ বলে

উল্লেখ করেছেন (পৃ .৫) যথা- আক্থ (সময়), গরবা (অতিথি), মুক্যা (ভুট্টা), অভিচ (অফিস), স্কুল (বিদ্যালয়)

প্রভৃতি বিদেশী শব্দ এই ভাষায় ব্যবহার হয় এবং ব্যবহৃত মানাই, মানেই/মানাই (মানুষ), মেলা (স্ত্রী লোক), কদা

(কথা), উসু (সোজা), চিত (চিত্ত) প্রভৃতি শব্দ আর্য মূল। অনার্য শব্দের তালিকা দেন নিম্নরূপ। যথা- তাগল (দা), কালাং

/ কাল্লং (বেতের ঝুরি), কুরুম (ঐ, ছোট আকার), পুল্লাহ্ (বোতল), কিচিং (পাহাড়ের মধ্যবর্তী নিম্ন অংশ), তারেং /

তাং / তারাং (পাহাড়ের খাড়া ভাগ), ক্যাং (মন্দির), স্যং / সোয়াইন (ভিক্ষুদের আহার্য), মংচাং/মৈসাং (শ্রামণ), খবং

(পাগড়ী), কী/কাহ (বাটি বিশেষ), পোই (থালাবাসন বা যেমন কলাপাতার পোই যা পেতে পাওয়া যায়) ধহ (চাল

মাপুনি বাঁশের টুকরো বিশেষ), এবং ধুদুক (বাঁশের মাঝে ফাঁক করা বাদ্যযন্ত্র) লক্ষণীয় বিভিন্ন প্রভাবের

কারণে এইগুলি বর্তমানে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মাঝে ব্যবহৃত হচ্ছে, কম বা বেশি বৈচিত্র্য ও বিকৃতির মাধ্যমে। যদি

পরিসংখ্যানিক logarithm এ রেখাংকন নির্মাণ করা যেত, তাহলে বুঝা যেত ভাষা অধিগ্রহণে পার্থক্যসূচকগুলির

কোনটি বঙ্কিমতা বা তীর্যকতা লাভ করেছে। কোনটির গতিধারা, পর্যায় ও পরিণতি কোন মুখী। এখানে “রেখাঙ্কন”

প্রশ্নে বলে রাখা ভালো যে, পরিসংখ্যান নির্মাণে অনুভূমিক ও আলম্বিক মাত্রাদুটির সূচক হতে পারে সময় এবং স্থান।

সময় বলে দেয় ভাষা ব্যবহারের রূপ, ব্যবহারিক, মাত্রা, গতি ও বেগধারা বা বিস্তার। স্থান নির্দেশ করে বৈচিত্র্য ও

অবস্থান বা গতিক। কোন কোন ক্ষেত্রে ছোট ভাষাও বলশালী হয় এবং তা মর্যাদা প্রাপ্ত সাধারণ ভাষা হয়েও উঠে

আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। ইউরোপ ভূখণ্ডে গল ভাষা দূর দূরান্তরেও ছড়িয়েছে, আবার জার্মান ভাষায় বহু

ভাষা একীভূত হয়ে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। রাশিয়াতেও তাই। তুরস্কে, এলমে বহুভাষা মৃত হয়ে গেছে বা অন্য ভাষাভাষীর

মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। বহুভাষী দেশ ছাড়াও উদাহরণ দেখানো যায় যেখানে কোন ছোট ভাষাভাষী পার্শ্ববর্তী দুর্বল

ভাষাভাষীদের দলভূক্ত করার জন্য তাদেরকে বা তাদের অংশকে কেড়ে নিয়ে আসতে পারে। এটাকে বলে “gobble

up” করা। উত্তরবঙ্গে সৈয়দপুরে, লালমনির হাটে ভাষা অবস্থা যেরকম অর্থাৎ আভিবাসী উর্দু ভাষীরা অন্যদের ওপর

আধিপত্যই বিস্তার করেনি, বঙ্গভাষীদেরকে নিজদের লুকিয়েও নিয়েছে। জোসেফ গ্রাইমস এরকম অবস্থায়

“ভাষাভাষী চুরিকরণ” (steel speakers) বলেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও নিম্নবঙ্গের অবস্থান নিয়েও দেখা যায় সেখানে

মার্মা-রাখাইন অবস্থান (distribution) প্রাকৃতিক ধর্মী হয় নি, অবস্থান ধর্মী হয়েছে। এজন্য রামু- কক্সবাজার বান্দরবান

(সামান্য) মানিকছড়ি-তিনটেহরি ও বরগুনা-আমতলী প্রভৃতিতে যে “সমভাষাভাষী” জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে জানা যায়,

তাদের মধ্যে ভূগৌলিক পার্থক্যকে সীমিত করেছে তাদের আন্তঃসাংস্কৃতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক (যথা মায়ানমার

সংস্কৃতির আগমণ) অথচ চাকমা-তনচংগ্যাদের ক্ষেত্রে পাই ভিন্ন চিত্র। এখানেই একভাষী ও দ্বিভাষীদের স্বাতন্ত্র্য এবং

সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভেদ ও বৈচিত্র্যের কথা আসে। রাখাইনদের একভাষী বলা যাবে না, চাকমাদের তা বলা যাবে ।

দ্বিতীয়ত চাকমা, তনচংগ্যা ও রাখাইন সবাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও তনচংগ্যাদের ধর্ম – সমাজ – সংস্কৃতির বিষয়গুলির

মধ্যে তারা নিজেরাই একটা রক্ষণশীলতার বাতাবরণ নির্মাণ করে রেখেছে (দ্রষ্টব্য, ক্যাপ্টেন লুইনের মত) যেমন

উখিয়ার (রামু – কক্সবাজার) তনচংগা ও বড়ুয়াদের মধ্যে ধর্ম উৎসব ও সাংস্কৃতিক আচারে যে পার্থক্য তা সমভূমিক

বৌদ্ধ বড়ুয়াদেরও বিস্মিত করে । চাকমাদের সাথে তনচংগাদের পার্থক্য এখানেও প্রবল । তনচংগারা অন্ত তঃ তাদের

প্রবীণ প্রজন্ম মগ (আরাকান) ভাষী – যদিও তা তিন টেহরীর মগদের থেকে ভিন্ন। এই বিষয়টি এই ছোট প্রবন্ধে বিস্তারিত

আলোচনার সুযোগ অল্প। সংক্ষেপে তাই শুধু বলা যায় তনচংগা ও চাকমা জনগোষ্ঠির দিক থেকে (ethnically) এক

এটা বড় কথা নয়। ওরা আচারে ভাষায় ও ধর্ম – সংস্কৃতিতে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অভিসারী। এরই ফলে উদ্ভব ঘটেছে

মনস্তাত্ত্বিক কলহ, কে বড়, কে জাতে সম্মানে ও আত্মগরিমায় শ্রেষ্ঠ, কে আদি, কে আগত বা পরাগত, কে গোজাধর,

অথবা কার গছা সংখ্যা বেশী বা কম, গছায় গছায় ভাষা পার্থক্য। সীমা কার মধ্যে হ্রাসবদ্ধ বা নিরপেক্ষ, কে প্রকৃতিতে

অরণ্যচারী ও নিষ্ঠুর স্বভাবী কে শীলাচারী, ভদ্রতা প্রকাশের গরীয়ান … ইত্যাদি । এই প্রশ্নের সমাধান সমাজতত্ত্ব ও

ইতিহাসের গভীরে । ভবিষ্যত গবেষকগণের উৎসাহ উদ্রেক করে বর্তমান আলোচনার ইতি হবে এখানেই । পরিশেষে

শুধু বলতে। চাই ভাষাগত প্রমাণে এদের মিল আকস্মিক বা ব্যবহারক্রমী · ধ্বনি পরিবর্তনের পুনর্গঠন, সম্পর্ক নির্ণায়ক

ভাষাকাল নির্ণয় ও ক্রম নির্ধারণ যাকে ভাষাতত্ত্বে বলা হয় RC পদ্ধতি বা Relative cronology. ঐতিহাসিক শাখায়ন

নির্মাণ ইত্যাদিও সম্ভব।

একটি সম্ভাব্য ঐতিহাসিক বিচার পদ্ধতিতে এদের মূল ভাষা পুনর্গঠন ও শাখা – উপশাখা নির্দেশের একটি নমুনা (মডেল) এখানে তৈরী করা হয়েছে। এর অর্থ এভাবে একটা পরীক্ষামূলক শাখায়ন (পৃথকায়ন বা reflex ঘটিতরূপ প্রতিষ্ঠা) ও গোষ্ঠিবদ্ধকরণ (ঐকায়ন রূপ) এইভাবে নির্মাণ করা যায়, যা অবশ্যই পূর্ন বা পূরক তথ্য ভিত্তিতে সম্পূর্ন করা সম্ভব।

*আদি চাকমা-    ক) রোইয়াঙ্গা খ) আনক্যা (ধৃত চাকমা)

ক) সেখ বা সাক (?)

রোইয়াঙ্গা-          ক) চাকমা (৬৫ গছা/গজা) খ) আদি তঞ্চঙ্গ্যা ((১২ গছা)

আনক্যা (ধৃত চাকমা) — দৈংনাক (চেইম্পানগো — বাংলাদেশী দৈংনাক।

সেখ বা সাক- বর্তমানে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী চাক নামে পরিচিত।

চাকমা (৬৫ গছা/গজা) — বাংলাদেশী চাকমা।

আদি তঞ্চঙ্গ্যা ((১২ গছা) অর্বাচিন তঞ্চঙ্গ্যা (মগভাষীসহ) — ৭ গছাসহ তঞ্চঙ্গ্যা — দৈংনাক মিশ্রিত গোষ্ঠী (ব্রহ্মদেশ ত্যাগী)

প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ

ড. মনিরুজ্জামান (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

বাংলা ভাষা ও পার্বত্যজাতির ভাষার মধ্যে গোত্রগত বা নৃতাত্ত্বিক সূত্রের ব্যবধান যোগাযোগসূত্রকে কখনও খন্ডিত বা ব্যাহত করে নি। তার একটি প্রমাণ প্রবাদে ব্যবহার-সমতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তুলনামূলক পঠন পাঠন প্রক্রিয়ায় বিচার করে ধারণা দিতে চেষ্টা করেছিলেন যে বাংলাদেশের ‘হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁও’ জার্মান শিশুদের কাছেও নিজস্ব জিনিষ হয়ে আছে এবং কখন কিভাবে এই নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল তা অনুসন্ধানের বিষয় মাত্র। কিছুদিন আগে তুলনামূলক সংখ্যা বিচার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গণিত ভাষাবিজ্ঞানীগণ অবাক হয়ে দেখেছেন যে সংখ্যাশব্দ ভ্রমণশীল (এ বিষয়ে ‘ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন’ গ্রন্থে আমার বিস্তারিত আলোচনা আছে।)

একইভাবে পূর্ব ইউরোপে যাঁরা লোকসাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক কাজ করেছেন তাঁরা এই বিষয়টা আরও বিস্তৃতভা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং সে সব তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমুলক আলোচনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে Broken down myth theory, Historical- geographical contact theory বা ফিনিশিয়ান তত্ত্ব প্রভৃতির মধ্যে। এসব তাত্ত্বিক ধারণা এখন আরও প্রসার লাভ করেছে এবং আমেরিকা ও বিশেষত ফিনল্যান্ডে অনেক অগ্রসরতা ঘটেছে। Tribal Culture  নিয়েও দক্ষিণ ভারতে এবং Red Indian  দের বিষয় গাম্পার্জের বিষয় অনুসৃত ধারায় নৃ-ভাষাতত্ত্বে এবং এলার্ন ডান্ডি, লী উটশী প্রমুখ লোকবিদগণের হাতে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ অজস্র ও বৈচিত্রশালী লোকউপাদানের দেশ। কিন্ত এদেশের সম্পদ নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির জগত এখনও নিশ্চুপ। একদা রামোঁলার কথায় আমাদের প্রত্যয়ের কিছুটা প্রসার ঘটেছিল। মূলভূখণ্ডের বিষয় নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করা গেলেও (যথা-বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘লোকসাহিত্য’ সিরিজ, ইত্যাদি) আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের লোকগত প্রথা ও জ্ঞান নিয়ে কখনও কেউ কোন কৌতুহল বোধ করেন নি। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ- এর ‘কর্ণফুলি’-র পথ নিয়ে এই তথ্য উন্মোচনের শুরুটা ঘটেছিল, পরবর্তীকালে সে পথর খননী কাজ আর বেশীদূর অগ্রসর হয়নি। পার্বত্য সংস্কৃতিকে মূল সাংস্কৃতিক ধারা থেকে সব সময় দূরে রাখা হয়েছে। নৈকট্য সৃষ্টির পরিবেশ গড়ে ওঠেনি কখনও। এই চিত্র কেবল বাংলাদেশেরই নয়; রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ সহ সর্বত্রই একই চিত্র; কেবল মাত্রা ভেদ।

সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও অন্যান্য সমতলীয়তা মিশ্র সমতলী ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর সাথে বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকার নৃ-গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন -যাপনের পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। একসময় আরাকান-ব্রহ্মদেশের সাথে এদের একটা সংযোগ ছিল এবং তারও আগে।

দক্ষিণ চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সাথেও যোগসূত্রটি গভীর ছিল এই সব জনগোষ্ঠীর। তাদের মধ্যে যারা স্থায়ীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে (বৃটিশ আমলে ও পরেও যাকে CHT বলা হত প্রশাসনিক সুবিধার্থে) বসতি স্থাপন করে অদ্যাবধি স্থায়ী হয়ে আছে, অর্থাৎ লুসাই কুকি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর অংশ বিশেষ যারা সিলেট ও আসামের দিকে বসতান্তরিত হয়েছে তদের কথা বাদ দিয়ে,- অন্যদের সাথে স্থানীয় অধিবাসী ও মূল ভূখণ্ডের প্রশাসকদের রাজনৈতিক ছাড়াও আর্থ (বাণিজ্য ঘটিত)- সামাজিক সম্পর্কটি ছিল হার্দ্য এবং দীর্ঘ দিনের। রানীর হাত, মহামুনি, কাপ্তাই বা রাজস্থলী এমনকি বান্দরবান অদ্যাবধি পাহাড়ী ও সমুদ্রতীরের বাসিন্দাদের মিলনস্থান হয়ে আছে এই ভাবেই। এই স্থানের বার্ষিক মেলাগুলি উভয় জনগোষ্ঠীর জন্যই আজও আকাঙ্ক্ষিত। তথাপিও ওপর ও নীচের বাসিন্দাদের মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে সেই নৈকট্য সূচিত হয়নি- ভাষাতত্ত্বে যাকে বলা হয় Linguistic Convergence এবং নৃতত্ত্বে Acculturation; এর কোনটাই সৃষ্টি হয়নি দীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থানের পরেও। সে কি কেবল উভয় জাতির অন্তর্গত রক্ষণশীলতা না অন্য কিছু?

অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায় পার্বত্য জাতির অনেকেই একটি মধ্যবর্তী ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন, অথবা সেই রকম কোনও মিশ্র বুলি বললে তারা তা বোঝেন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এটাই স্থানীয়ভাবে ‘ফাংশনাল’ বা বঙ্কিমচন্দ্রের পরিভাষায় বলা যায় ‘কার্যকারিনী’ ভাষা বা প্রকাশ। ভাষা হিসেবে তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য তা মোটামোটি কার্যকরী। তুলনা দিয়ে বলা যায়, আলতামিরা গুহায় যে চিত্রলিপি বা রেখাবয়ব পাওয়া যায় তা যেমন লিপিও নয় চিত্রকর্মও নয়, কেবলমাত্র টোটেমের নিদর্শন ও যাদুধর্মের বিকাশ,- ভাষার ক্ষেত্রে আদি মানুষের অভিব্যক্তিও সেই রূপ অর্থাৎ অন্যের কাছে নিজেকে উপস্থিত করারই একটা চেষ্টা। ‘ইন্দ্রধ্বজ’ দেখিয়ে অসুর বা সাধারণ মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা বিশুদ্ধ নাটকে থাকলেও ‘নাটগীতে’ তা থাকেনা। সে রকম সাধু বা শিষ্ট ভাষার শিক্ষণ বা ব্যবহার যাদের নেই তার গড়ে তুলে ‘লোকভাষা’? এখানে বুঝাতে চেয়েছি ভাষা সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু মুখে বলা আর মুখের কথাকে স্থায়ী করার মধ্যে প্রভেদ আছে। সেই প্রভেদ সূত্রই ভাষাকে সীমিত করে আর ভাষিক উপাদানকে অন্যের অংশীদারিত্বে নিয়ে যায় আরো দূর। তখন বাংলার রাক্ষস জার্মানেও হাঁউ মাঁউ করে, প্রকাশ ভঙ্গী যেমনই হোক। India Theory-তে এভাবেই জার্মানী লোক উপাদান আর ভারতীয় লোক উপাদানে সমতা দৃষ্ট হয়। লোক সাহিত্যের অনেক শাখা, অনেক তার বিস্তার। কিন্তু সব শাখাই ভ্রমণশীল নয়। আবার Cosmic Theory অনুযায়ী অনেক বস্তুই স্বতোঃস্ফূর্ত কিংবা ‘সাধারণ’ হিসাবে জাত। ‘শাদীর রাতে বিড়াল মারা’ রেড ইন্ডিয়ানদের জীবনেও That’s for once’ গল্পে পাওয়া যায়, কেবল ‘বিড়াল’ এর স্থলে সেখানে এসেছে ‘ঘোড়া’। আবার অনেকের মতে এবং এই মত সর্বজন স্বীকৃত যে লোক-সাহিত্য বা সংস্কৃতি জিনিষটা খুবই স্থানিক- Insularity তত্বে সে কথা প্রমাণিত। পাশাপাশি থেকেও দুই গোত্র বা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জগৎ ভিন্ন থাকে। এটা নদী-পর্বতের মত প্রাকৃতিক বাধা বা Sibolethistic পরিবেশের কারণেও হয় বা হতে পারে, তেমনি আবার স্বতন্ত্র ‘Cultural Area’ (তুলনীয়: ‘India is a cultural Area’- E.B Emenw) বা ‘Sub-Area’-র কারণেও হতে পারে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বা সীতাকুণ্ড, নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থানগুলি এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে দূরত্বের মাঝে নৃতাত্ত্বিক প্রসঙ্গটিও বিদ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে চাকমাদের বা তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে সেই দূরত্বা প্রকৃত প্রস্তাবে কোন বাধা হয়ে থাকে নি। অথচ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সাথে সেটাই কম বেশি প্রধান বাধা হয়ে আছে। Comearative Folk Studies আমাদের সে তথ্য বিচারে সহায়ক হতে পারে। আইরিশ লোকবিদ পাদরী জেমস লঙ্ বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ ও আলোচনার যেমন অন্যতম অগ্রপথিক, রাশিয়ায় অবস্থান কালে তেমনি তিনি রুশ প্রবাদ নিয়ে তিনি তেমনি শ্রেণীকৃত ও তুলনামূলক আলোচনা করেন। দুষ্প্রাপ্য হলেও মহাদেব প্রসাদ সাহা ঠিকই বলেন, তাঁর আলোচনা এখনও আমাদের জন্য আদর্শ বিশেষ।

বলা হয় প্রবাদ আদি সমাজের সৃষ্টি। প্রাক-সভ্য সমাজে মানুষ কি জ্ঞান-বৃত্তির চর্চা করতো? যেহেতু প্রবাদ Folk wisdom-এর ভান্ডার তাই সে কথা মেনে নিতে হয় এবং বিশ্বাস করতেই হয়। যেমন কৃষি জীবনের বিষয়গুলো যা আসলে যাদু নির্ভরতার শিকারী জীবন (গুহাবাস) এবং আরও পরে পশু পালনের জীবন ও পশুচারণ ক্ষেত্রে সন্ধানে যাযাবর জীবন যাত্রার পরবর্তী জীবনেরই কে বাস্তবতা। তবে শুরুতে সম্ভবত সে জীবনও ছিল অধিক সংগ্রাম মূখর ও অনিশ্চিত এবং তাতে প্রাপ্তি ছিল কম। মানুষ স্থায়ী, অধিকতর নিশ্চিত ও সঞ্চয়ী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় যখন পশু মড়ক ও অতিরিক্ত পশু নিধনের ফলে অবিকল্প কৃষিজীবন তর কাছে সত্য হয়ে ওঠে। সূর্যদেব, মেঘদেবতা, জননী ধরিত্রী-চিন্তা এবং ক্রমে পুরাণ-তত্ত্বের(মিথলজি) কল্প-বাস্তবতায় প্রবেশ ঘটলো তার। দলবদ্ধতা আগেই ছিল, এখন বহু দলের সমাজ গঠন, আত্মরক্ষার্থ ও সঞ্চিত সম্পদ রক্ষার্থ প্রভৃতি পূজা, কৌম সমাজ রক্ষার ব্যবস্থায় নতুন করে এলে যাদু-মন্ত্র ও দলপতির মাধ্যমে দৈব বাণী। একেই বলি আমরা আদিম ধর্ম এবং তার আচরিত কথাসূত্রগুলিকে বলতে পারি আদি মহাজন বাক্য। ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘(আদিম) সমাজে যিনি ছিলেন বয়স্ক এবং অপেক্ষাকৃত বিচক্ষণ, বিভিন্ন যাদুবিদ্যার অধিকারী, তিনিই সাধারণত হতে দলপতি, তাঁর বাণী বা নির্দেশই ছিল আদিম প্রবাদ বাক্য। পরবর্তীকালে আর্যদের আগমনের পর যাকে বলা হয় জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা এবং পরিবেশবিদ্যা, যা তার চারপাশের দর্শনীয় বস্তু-তা নিয়েই  প্রবাদের প্রাচুর্য গড়ে উঠেছে। লিখিত উপকরণের অভাবে এই মৌখিক দৃষ্টান্ত, উপদেশ বা অনুকরণীয় বিষয়গুলি অতি সহজেই শ্রুতিধর ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশেও পৌছেঁ যায়‍’।

সমাজপ্রিয় মানুষ উন্নত ও শক্তিধর সমাজের অনুকরণেও আসক্ত। তার সমাজ জিজ্ঞাসা ও আন্তসামাজিক কৌতুহল তাকে এই আচরণে লিপ্ত করে। আকাশ-সংস্কৃতির যুগে আজ মানুষ সমানাধিকারের চিন্তা করতে শিখেছে সেও এই ভাবেই। নারীবাদ, ধরিত্রী সম্মেলন, মানবাধিকার প্রভৃতি ধারণা ও কার্যক্রম যে প্রসারতা পেয়েছে তাও যে ক্রমেই প্রসারমাম হচ্ছে তার মূলেও সেই একই লোকজীবনের সত্যের তাড়না। ‘সিবোলেথের’ বাধা সত্ত্বেও অন্যে সংস্কৃতি জগতে আপনার কৌতুহল প্রবেশ সাধারণ-সেখানে সে আপনার অন্তর্সত্যকে যেমন প্রকটিত করতে চায় তেমনি অন্যের সত্যকূলকেও সে স্পর্শ করতে চায়। এ যেন সেই রবীন্দ্র বারতা- ‘দিবে আর নিবে মিলাবে আর মিলিবে, যাবেনা ফিরে’। ‘ভাষা’ যদিও সীমিত ‘কোড’, সংস্কৃতি সেক্ষেত্রে অনেক তরল ও প্রবাহমূলক ‘ফ্লুইড’ স্বরূপ। প্রবাদ, ধাধাঁ প্রভৃতি লোকসৃষ্টি এমন কি যা ‘লোকভাষা’ তারও বহু উপাদানকে তাই আমরা ভ্রমণশীল রূপে দেখতে পাই। অনুকূল ও প্রতিকূল সমাজ নির্বিশেষে ‘এক-সংস্বৃতি’ এলাকা (One Cultural Area) গড়ে ওঠে, যেভাবে গোটা ভারতবর্ষে ৪০০-এর অধিক ভাষা থাকা সত্ত্বেও ইমেন্যূ সাহেব তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন যে, ‘India is a linguistic area’.

এভাবে একটা কথা যোগ করা আবশ্যক যে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটাই স্থানিক লোকসংস্কৃতি ততটাই অসংকীর্ণ ও বিস্তৃত। গ্রামজীবনের অনেক জিনিষ লোকসংস্কৃতির ধারক বা পরিচায়ক নয়, যেমন গ্রামেও আজকাল ‘বিউটি পারলার’ দেখা যাচ্ছে এবং পাল্কীর পরিবর্তে নতুন বর বধূ রিক্সায় শ্বশুরালয় বা পিত্রালয়ে যাচ্ছে। একইভাবে গ্রামীণ যে কোনও অনুষ্ঠানে সামাজিক হোক বা ব্যবসায়িক হোক তাতে সারাদিন-রাত মাইকে গান বাজানো হয় এবং সে সব গান সিনেমার গান, এমন কি হিন্দি গান ও। মানুষ গ্রামেও লোকস্বভাবের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এগুলি গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষদের প্রদর্শনী মনোভাব বা রুচির একটি দিক। গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরাও বিশেষত মহিলার মোবাইলে অহরহ প্রবাসী স্বামী বা পুত্রের সাথে কথা বলে। এসবই গ্রামীণ বাস্তবতা, কিন্তু লোক সংস্কৃতির সৃজনশীল কর্মের সঞ্চারণ রহিত।

অন্যদিকে শহুরে সংস্কৃতিতে লোকসংস্কৃতির অনাযাস বিস্তার বা প্রভাবও অগ্রামীণ, কিন্তু লোকজ। যথা বৈশাখী মেলা ব রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন এং স্বাধীনভাবে সৃষ্ট শহীদ দিবস, বিজয় মেলা, চিকামারা বা দেওয়াল লিখন, প্রভাতফেরী, মিছিল এমন কি গ্রন্থমেলাও। এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘কাবাডি খেলা’ ও অন্যান্য লোকজ খেলা (লাঠি খেলা ইত্যাদি) প্রভৃতির প্রদর্শণী হতে শুরু করেছে। সবগুলিতে লোকজ জীবনের পরিচয় শতভাগ না থাকুক এগুলিও যে আধুনিক প্রসারিত ধারণায় ফোকলোরের উপাদান সম্বলিত তা মানতেই হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে তা ‘পরম্পরাগত’ (ঐতিহ্যবাহিত) কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পরম্পরাভাবই ফোকলোরে মৌল বিষয় নয়, লোক গ্রাহ্যতাই তার মূল পরিচয়কে সনাক্ত করে। তাই কখনও যদি গ্রামে মোবাইল ব্যবহার, মাইকিং (ওয়াজ মাহফিল বা জানাজার সময় ঘোষণীয় ইত্যাদি) ইত্যাদিতে লোকরূপ লক্ষ্য করা যায় এবং লোকজ শৈল্পিকতা বা সৃজনশীলতার রূপ প্রকাশ পায় তখন তা ‘ফোকলোর’ বা লোকসংস্কৃতির রূপেই গ্রহীত হবে তা যত আধুনিক হোক। লোক সংস্কৃতির উপাদান সমভূমিতেও যা, দ্বীপাঞ্চল বা পার্বত্য এলাকাতেও তাই। যা ফোকলোর তার ভিন্নতা নেই কোথাও, স্থানভেদে তার বৈচিত্র্য ঘটতে পারে মাত্র। কিন্তু তর ‘উপাদন’ সর্বত্র সমরূপী। সাধারণ বা লোক মনুষের স্বভাবের জন্যই তার এই সমরূপিতা বা সমমৃদ্ধিতা এবং বৈচিত্র্যও। যেমন, প্রাক ইসলামী যুগে আরববাসীরা কবিতা ভালবাসতো, হাটেবাজারে গিয়ে একজন কবিতা পড়ে শোনাতো, লোকেও তা শুনতে পছন্দ করতো। প্রাচীন কা’বার মেলায় ইমরুল কায়েসের কবিতা বিনোদনের অন্যতম বিষয় ছিল। ভারত উপমহাদেশে আজ যে মুখায়রা হয়, সেটা তারই স্থানীয় রূপ মাত্র। ভূত প্রেত ডাইনী নিয়েও বিভিন্ন দেশের ধারণার সমিলতা আমাদের এইভাবে অবাক করে। আমাদের দেশে বাচ্চাদেরকে জুজু-র ভয় দেখানো হয়। এই ‘জুজু’র উৎপত্তি ও তার বিভিন্ন ধরণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন ‘লোককৃতি কথাগুচ্ছে’র গ্রন্থাকার লোক ও শিশু সাহিত্য গবেষক আতোয়ার রহমান। ‘পরী’ এবং সমরূপী অন্যান্য জীব নিয়েও অনেক তথ্য উপস্থিত করেছেন তিনি। ধারণাগুলি আদি লোকজীবনের নানা রহস্যগুণাত্মক।

এইবার পার্বত্য ও সমভূমিজ প্রবাদের কথায় আসি। আমি অন্যত্র বলেছি বাংলাভাষার ‘প্রবাদ’ এক সময় ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতো। যেমন, প্রবাদ আছে মানুষ অপকর্ম করে মারা গেলে বা অতৃপ্ত আশা রেখে অপমৃত্যু ঘটলে তার আত্মা গাছে বেতালের মত ঝুলে থাকে। অর্থাৎ জনশ্রুতি, সুভাষণ, মহাজন উক্তি, মিনতি শিলুক প্রভৃতি অর্থে বা ভাবার্থে ‘প্রবাদ’ -এর ব্যবহার ছিল। লঙম্যান চৎড়াবৎন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন উইলিয়াম মর্টন বা নীলরত্ন হালদার প্রমূখ তাঁর পূর্বসুরীরা ‘কবিতারত্ন’, ‘দৃষ্টান্ত বাক্য’ প্রভৃতি শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহৃত করেছেন। (দ্রষ্টব্য মৎ প্রণীত ‘লোকসাহিত্যের ভিতর ও বাহির’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০২: পৃষ্ঠা. ১০১-১০৩) ইংরেজী শব্দের সাথে ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকায় তিনি ‘প্রবদা’ কথাটি ব্যবহার করেন এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রচলিত হয়ে অভিধানেও স্থান পায়। প্রবাদের বৈশিষ্ট্য বা গুণ তার চিরত্ব, শব্দ প্রকৃতির বৈচিত্র্য (বাঘ/বাঘা; জুতা/জুতুয়া ই:) ও যদৃচ্ছাকৃত বাক্যরূপ।

এই ধরণের প্রবাদের কথা আমি আমার পার্বত্য এলাকার বন্ধু ছাত্রদের মুখে বিশেষ শুনতে পাই নি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সভাপতি থাকা কালে ছাত্রদের নিয়ে মনিকছড়িতে (খাগড়াছড়ি) ফিল্ড ওয়ার্ক করার সময়ও তেমন তথ্য লাভ করতে পারিনি। ১৯৮০-০৩ ড. দুলাল চৌধুরী ‘চাকমা প্রবাদ’ প্রকাশ করেন। কিন্তু সংকলনটি মিশ্র বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া গ্রন্থটি প্রচারও লাভ করেনি তেমন। এই সব কারণে বর্তমান উদ্যোগতে আমি মনোযোগী হই। এক্ষেত্রে আমার সহায়ক হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কৃতি ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তার এবং তার বন্ধুদের সংগ্রহ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা তথা পার্বত্য এলাকার প্রবাদের মধ্যে নিম্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে পারি-

১. গঠন ও ভাবগত দিক থেকে চাকমা প্রবাদের সাথে এর অনেকাংশে মিল বিদ্যমান, যদিও তঞ্চঙ্গ্যা গঠনে কিছুটা তীব্রতা ও প্রাচীনতাও লক্ষ্য করা যায় যা চাকমার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যেমন, ‘সর্গ (স্বর্গ) গু খাই দিককনে’? বা ‘সাপপয়া উলে পুদাই-দ, ব্যাঙয়া উলে ফালাই-দ’ ইত্যাদি।

২. বাংলা ভাষার (চট্টগ্রামসহ) সাথেও এর মিল দূরাগত নয়, যথা-

ক. ‘পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান’

(বাংলায়= ‘পাতিলে পাতিলে ঠোক্কর লাগেই’)

খ. ‘পয়ায় ন কানিলে দুধ খায় ন পান/ পায়’

(বাংলায়= ‘পুতে না কান্দলে মাও দুধ দেয় না’)

গ. ‘মুয়ত জয় মুয়ত খয় (ক্ষয়)’

বাংলায়= ‘যেই মুহে (মুখে) জয় হেই মুহেঐ (মুখেই) ক্ষয় অয়”)

ঘ. ‘পেদৎ বোক মুয়ত লাইত’

(ঢাকা= ‘পেডে ভূখ থুইয়া মুহে শরম’

(চট্টগ্রাম= “প্যেডৎ বোক মুগোৎ/ মুয়ৎ লাজ”)

ঙ. ‘এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কাঁড়া’

(বাংলায়= “নানা মুনির নানা মত/ যার ঘরে সে রাজা”)

৩. কিছু কিছু প্রবাদে ভাবগত মিলটা খুবই সাধারণ ও নৈকট্যসূচক-

ক. ‘খাং খাং মাইনসত্তুন গেয়াহ্ নাই,

দাং দাং মাইনসত্তুন বউত্ নাই’

(বাংলা= “অতি গেরস্থ না পায় ঘর, অতি ঘরণী ন পায় বর”)

এখানে তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদটির আক্ষরিক অর্থ হল- ‘খাই-খাই মানুষর শরীর থাকেনা, পালাই-পালাই মানুষের কোন বস্তুই থাকেনা’। ইংরেজীতে সম্ভবত এটাকেই বলে- ‘rolling stone, gathers no moss,’। এর সমার্থকতার বাংলা প্রবাদটি ভিন্ন গঠনের, যথা- ‘যে রহে সে সহে’। কিংবা ‘যে চলে সে রহে’।

৪. তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদ এক বাক্যিক গঠন, দ্বিচরণিক গঠন, ছড়ার গঠন ছাড়ও কখনও কখনও সদর্থক বাক্য ও নঞর্থক বাক্য মিলেও একটি রূপ পায়, যথা- ‘যে গাছৎ উদি জানে তারে টেলি ন দিলেও উদি পারে, আর যে ন পারে তরে ঠেলি দিলেও ন পারে’।

এই সব প্রবাদ- উক্তিতে ভাষার বৈচিত্র ও ভিন্নতা থাকলেও সাংস্কৃতিক অবিচ্ছেদ্যতাই প্রমাণিত হয়।

৫. ‘ছায়-ল কানত্ (কান) মন্ত্র বড়ায় দেনা’।

(বাংলা= ‘কথায় কান না দেওয়া’)

৬. ‘নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান’

(বাংলায়= ‘নরম বা দুর্বলকে সবাই ঠকাতে চায়’)

৭. ‘এক্কয়া কুউরে (কুকুর) ভাত খালে আর এক্কয়া কুউরে চাই থাই ন পারে’

(বাংলা= ‘একজনের সুখ অন্য জন সহ্য করতে পারে না’)

৮. ‘মরা বাই-স (বাঁশ) সমারে জেদা (জীবিত) বাই-স পুরি যান’

(বাংলা= ‘দোষীর সাথে নির্দোষীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়’

৯. ‘আদে দুরি দুখ টা (আ) না’

(বাংলা= ‘জেনে শুনে কষ্ট/দুঃখ পাওয়া’)

১০. ‘আওই ন কুড়ে ঘি গনানা’

(বাংলা= নারীর সংস্পর্শে পুরুষের মন নরম হওয়া’)

১১. ‘আই-স (হাতি) পুনত কুউরে ভুয়ানা’

(বাংলা= (শক্তিধরের কাছে দুর্বলের নিষ্ফল আকুতি)

১২. ‘আউইনত্ (আগুন) পানি দেনা’

(বাংলা= চরম সমস্যার সমাধান করা)

১৩. ‘আক্কল বাধি অনা’

(বাংলা= স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া)

১৪. ‘আলু কুইল্যে গাত্তয়া (গর্ত) থাই’

(বাংলা= ঘটনা ঘটলে প্রমাণও থাকে)

১৫. ‘ইচা শুউনি (শুটকি) অনা’

(বাংলা= মিশুক হওয়া)

১৬. ‘ইহিম কামত্ ফল পানা’

(বাংলা= মনোযোগের কাজে সুফল পাওয়া)

১৭. ‘ইচা (চিংড়ি) কবালত্ গু’

(বাংলা= ‘অতি চালাকির বোকামি প্রকাশ)

১৮. ‘উসুনা কুড়ায় ডাক কারানা’

(বাংলা= অসম্ভব ব্যাপার)

১৯. ‘কুড়া (মুরগী) লাইত’

(বাংলা= প্রথম অবস্থায় লজ্জা পাওয়া)

২০. ‘চিল দরে কুড়া ছ ন পুছানা’

(বাংলা= ক্ষতির আশঙ্কায় ভাল কাজ না করা)

২১. ‘সিনডালে ও লো (রক্ত) ন নিগানা’

(বাংলা= অতি কৃপনতা)

২২. ‘মুঅ গুনে ব্যাঙ ময়ে/মরে’

(বাংলা= নিজের দোষে নিজের বিপদ ডেকে আনা)

২৩. ‘ঠেঙ (অ) কোইত্ উরি দেনা’

(বাংলা= অসৌজজন্যতা)

২৪. ‘দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা’

(বাংলা= সুসম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে দেওয়া)

২৫. ‘পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্’

(বাংলা= কান কাজ করতে করতে অভ্যাস হওয়া)

২৬. ‘বিচ্যা গরুর দাঁত চাইনে লাভ নাই’

(বাংলা= গৃহিত সিদ্ধান্তের পরে পর্যালোচনা নিষ্প্রয়োজন)

২৭. ‘গুইত্তুন মু্ত্ গম অনা’

(বাংলা= আগে খারাপ থেকে বর্তমানে এসে ভালো সাজা)

২৮. ‘ঘ-র উন্দুরে বেড়া কামারান’

(বাংলা= ঘরের শত্রু দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া)

২৯. ‘রাঙা কালা মু অনা’

(বাংলা= কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া)

৩০. ‘ভুত্তোয়া কুউরে/কুগে রোঙ কারা-না’

(বাংলা= খালি কলসি বাজে বেশি)

৩১. ‘গরু-ছাঅল ডরে ক্ষেত গিরাদি রাখানা/রাগানা’

(বাংলা= নিজের সম্পদ নিজে যত্ন নেওয়া)

৩২. ‘আইডে আইডে ধদাডোদি/দলাডুলি টিক্ষ্যা (নলখাগড়া) কা(অ)রা গুরি’

(বাংলা= দুই পক্ষ সবলের শক্তি প্রদর্শনের ফলে দুর্বলের ক্ষতি হওয়া)

৩৩. ‘দা-শি দিলে নাচি খায়, সবা-ইত ন পালে মা-ই খাই’

(বাংলা= প্রথমে দিলে খাই না পরে নিজে খুজেঁ খাই)