তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাঃ একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে জন্ম

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সাহিত্যটা গড়ে উঠে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে বিশেষ করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যটা। জুম চাষের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাহিত্যের স্বপ্নগুলিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং জীবনের বীজ বুনতো। তঞ্চঙ্গ্যারা এই জুমকে ভালোবাসে এবং এই জুম সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা সেই স্বরণাতীতকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। স্বরণযোগ্য যে বর্তমানে যারা তন্চংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত, এককালে তারা দাইনাক বা দৈনাক পরিচয়ে আরাকান বা মায়ানমারের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য দান্যাওয়াদি থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। পরবর্তীতে তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে কক্সবাজার, টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী তৈনছড়ি-তৈনগাঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির অন্যান্য অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলার রইস্যাবিলি রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে। তবে কক্সবাজার এবং টেকনাফের তঞ্চঙ্গ্যারা এখনো অনেকে চাকমা পদবী ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন তঞ্চঙ্গ্যার ‘মো’ গছাদের মতো। আবার অনেকে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে আসল চাকমা বলেও মানেন, এটি অবশ্যই ইতিহাসের পাঠ্য। পরে অনেকে কাপ্তাই বাঁধের নতুন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী ও স্বীকার পরবর্তী বাসিন্দা ভারতের নানা প্রদেশ। সাধক কবি শিবচরণ, রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থির এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি আজ একটি  আলোকিত জাতি হিসেবে স্বকৃীত।   

আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকে একটি চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত, তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিয়ে। আমি যতটুকু জানি তঞ্চঙ্গ্যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলি তঞ্চঙ্গ্যাারা রক্ষা বা লালন-পালন করতে পারেনি এটি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ব্যর্থটা নয় এটি ঐতিহাসিকতার ব্যর্থটার ফল। 

তন্চংগ্যাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল শুধু এই কথা বলে বসে থাকলে আমাদের চলবে না,চর্চা এবং লালন-পালন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মুলতঃ এই আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্চংগ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রকাশনা বের করার চিন্তাটা প্রথমে আমার মাথায় আসে যখন আমি ২০০১-০২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্র্তি হই। তাছাড়া আমি যতদূর জানি তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়মিত কোন প্রকাশনা বের হয় না। পরে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকাশনা বের করার। অনেক নাম প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অজয় দা’র (অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা) দেওয়া নাম ‘পহ্ জাঙাল সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এরপর ১লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৩ ইংরেজী পহ্র জাঙাল প্রথম সংখ্যা সফলভাবে প্রকাশিত হয় এবং উদ্বোধনী সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন পলাশ তন্চংগ্যা। ১১ই এপ্রিল’০৩ ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এটির প্রথম সংখ্যা মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে অবশ্যই বলাকা, বিষু, ছিনা-মোইন(২০০২)এক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পহ্র জাঙাল এর হাত ধরে তৈনগাঙ, রাঙাফুল, ন-আ শমন প্রকাশ হয়। তৈনগাঙ এখনো নিয়মিত প্রকাশ হলেও বাকীগুলো কিছু সংখ্যার পর আর প্রকাশ হয়নি। তবে প্রতিটি সংখ্যায় এক ঝাক প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আগমনীর বার্তা আমাদের আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণীত করেছিল।তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- 

(ক)    প্রথম ভাগে– সাধক শিবচরণ এবং ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী

(খ)     দ্বিতীয় ভাগে– রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র 

তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির,ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির,যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর 

কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

(গ)     তৃতীয় ভাগে– লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যাড.দীন নাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, 

ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন),পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় 

বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা,উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা 

(মনিচান), দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা। আরো অনেকে। 

 ক. প্রথম ভাগের লেখকদের মধ্যে আমি তন্চংগ্যা সাহিত্যের পটভূমিকার সমৃদ্ধ বীজ লক্ষ্য করি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেও এই লক্ষণটি সম্প্রসারিত হয়। যদিও প্রথম ভাগটি শুরু হয় মধ্যযুগীও সাহিত্যের সাথে মিল রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে। এটি মূলতঃ লেখকের সাথে সময়ের একটি যোগসূত্র, আমরা এটাকে সময় বা সমাজের চাহিদাও বলতে পারি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভাগের রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের লেখার মধ্যেও এই লক্ষণটি স্পষ্ট। তবে এখানে ইতিহাসও যোগ হয়েছে। মূলত একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের জন্ম। যা জাতি হিসেবে যে কেউ গর্ববোধ করতে পারে। তারা সমাজ এবং ইতিহাসকে সাথে নিয়ে বাংলা, তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা ভাষায় এইসব রচনা করেন। 

খ. দ্বিতীয় ভাগের প্রত্যেকটি লেখক সমাজ সচেতন ও প্রগতিযশা ছিলেন। সমাজ ও জাতির জন্য তাদের অবদান অনেক। রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যার নিজস্ব হস্তচালিত প্রেস ছিল। সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রেস। এখানে উল্লেখ্য যে, বিংশ শতকের দিকে এসে ‘গৈরিকা’(১৯৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের একটা ধারা সৃষ্টি করলেও তার আগে কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’(১৯৩১),‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’(১৯৩৩) রচিত হয়। তার এই ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’পয়ার ছন্দে রচিত একটি মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। এই প্রেক্ষিতে তন্চংগ্যা সাহিত্যিকগণই গৈরিকার পথ প্রর্দশক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ধর্ম-সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি (ড.মনিরুজ্জামান, পহর জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা-২০০৮, পৃষ্ঠা-১০)। এই পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাাকে রাজা ভুবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে ছন্দ বাক্য রচনা করতে পারতেন(তথ্যঃ এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা)। ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’ সম্পাদনা ও সংশোধিত আকারে প্রকাশের জন্য রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক ‘পন্ডিত’ এবং রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রিয়দর্শী ভিক্ষু কর্তৃক ‘উদয়ন বস্তু’ রচনার জন্য তাকে ‘কবিরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট্য ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাকে ‘পাহাড়ী বাংলার কবি’ বলেছেন। তার কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক (কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) তাঁর পুত্র দিলিপ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার মাধ্যমে উদ্ধার করেন ১২ই জুন ২০০৮ সনে রাজস্থলী থেকে। তার এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক দায়িত্ব নিয়ে ‘পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ’ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে রাধামন ধনপতি কাব্য, বিজয়গিরি, মানুষ দেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সবার ক্ষেত্রেও পহ্র জাঙাল একই আগ্রহ পোষণ করে।  আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিস্তারে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রাজা ত্রিদিব রায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ‘রাজগুরু’ পদে বরণ করেন। এর আগে রাজা নলিনাক্ষ রায় কর্তৃক শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরকেও (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা) ‘রাজগুরু’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত‘ষষ্ঠ বিশ্ব বৌদ্ধ মহাসংগীতি’তে একজন সংগীতিকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। তারই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজক কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপন্ডিত উপাধিতে সম্মানিত করেন। এছাড়া ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক তাকে ‘অগ্গমহাসধম্মজোতিকাধ্বজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এর মাধ্যমে সম্ভবতঃ পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে তন্চংগ্যারাই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার সুবিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘রাউলী’ সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়। সেসময় রাউলী সম্প্রদায় চাকমা ও বড়ুয়াদের ধর্মীয় পুরোহিত হিসেবে ছিলেন। এই অগ্রবংশ মহাস্থবির ও ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের অপ্রকাশিত অনেক লেখা রয়ে গেছে। এই লেখাগুলি ছাপানোর ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন এবং বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কারণ এগুলি আমাদের জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। আমি যতটুকু শুনেছি এরই মধ্যে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুযোগে কেউ হয়তো নিজের নামে চালিয়ে বা ছাপিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যেটা হলে আমরা ঠিক আগের মতো ঐতিহাসিক ভাবে আবার ভুল করবো বা ভুল করতে যাচ্ছি।

 গ. তৃতীয় ভাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। তার লেখার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণাদায়কও তিনি। আমার জানা মতে ১৫-২০টি পসন এবং ৩৫০-৪০০টি প্রবাদ তার সংগ্রহে রয়েছে যা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ড.মনিরুজ্জামান স্যারকে তার ‘প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ’(৫ম সংখ্যা, ৯ই আগস্ট-২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) লেখার জন্য এই প্রবাদ সংগ্রহশালা থেকে লেখক রেফাসেন্স হিসেবে সংগ্রহ করে দেন। ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাসের পুরনো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত ‘আদামর ফুল’ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ যা পহ্র জাঙাল প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আর এ্যাড. দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ নামে একটি লেখা ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র ৫ম ভলিউমে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘বাংলা পিডিয়া’তেও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। নারী লেখিকাদের মধ্যে পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা অগ্রগামী, পুরো পার্বত্য অঞ্চলেও তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তার লেখা সাহিত্যগুলি জুম্ম জাতি ও নারী সমাজকে আলোড়িত করে। পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা নারী লেখকের প্রতিনিধি। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘পহ্র জাঙাল’ প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং উদ্যেগটা। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। তার মোট প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় ১৫-২০টি। তার লেখা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (বাতকস) এর মুখপত্র সিঙকাবা এর প্রধান সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত আদিবাসীদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রদেঁভু’ এর তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাস এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘খৈয়ুম’ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূপছায়া’ এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্ভবত তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক।   

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাটি এগিয়েছে কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান এবং সময়ের পটভূমিকে কেন্দ্র করে।

১. জুম সাহিত্যঃ 

পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুম চাষের জন্য প্রতি বছর উর্বর জায়গার সন্ধানে পাহাড়ের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরীত হয়। যার ফলে তাদের জীবনচক্রও গড়ে উঠেছে এই জুমকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের জীবন ধারণ এবং সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে জুম উঠে এসেছে খুব সহজে। যেটি আমরা লক্ষ্য করেছি তন্চংগ্যাদের আদি সাহিত্যের মধ্যেও। বারোমাস,উভাগীত,পসন্,ধাঁধা,কবিতা,ছড়ার মধ্যে আমরা এই জুমকে খুজে পাই। এই জুমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পালাও রচিত হয় তার মধ্যে ‘জুম কাবা, রাইন্যা বেড়ানা পালা’ অন্যতম। ইতিহাস বলে তৎসময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও চিত্ত বিলাসের অন্যতম স্থানও এই জুম। যেটি গিংগুলী গানের গায়কের কন্ঠে আমরা লক্ষ্য করি। বিষ’ুর সময় যে পাইসন রান্না হয় তার বেশী ভাগ সবজি কিন্তু পাওয়া যায় এই জুম থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড়(পিনউন, খাদি, মাদা কাবং, পা-দুরি, সালুম) বুননে যে ফুল গুলি ব্যবহার করা হয় তার বেশীর ভাগ নাম এই জুম সবজি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায়(এম.এল.ই) যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওখানেও জুম বিষয়ে গল্প, ছড়ার বই ও থিম পিকচার করা হয়েছে। বর্তমানের লেখকদের মধ্যেও এই জুম সংস্কৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

২. সাধক শিবচরণ এবং গসাইন্ লামাঃ

আমরা কম-বেশী সবাই শিবচরকে কবি হিসেবে চিনলেও কিন্তু কবি’র চেয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাধক বা ব্যাদি হিসেবে বড় ছিলেন। ব্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এই আছে এই নেই,তারা মুহুত্বের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তারা চারিযুগ অমর এবং যমসুরী। এই চারিযুগ হচ্ছে-সত্যযুগ,দ্বাপরযুগ,টেট্টাযুগ ও কলিযুগ। শিবচরণ শৈশব কাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। জগৎ সংসার থেকে মুক্তিই যেন তার একমাত্র নেশা। তার আধ্যাত্বিকটা মা,ভাই ও ভাবীকে ভাবনা এবং চিন্তার দোলাচলে ফেলে দিলেও মাঝে মধ্যে বৎসনা করতেন জগৎ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা দেখে। 

শিবচরণ ‘মানবজন্ম’ এবং ‘ফুইরা আলাম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেন। ‘মানবজন্ম’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের শরীরগত বিদ্যাকে নিয়ে। শরীর কি,শরীর কি দিয়ে তৈরী বা গঠিত হয়েছে,শরীরের কোথায় কি আছে,কার কি কাজ ইত্যাদি বিষয়কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘ফুইরা আলাম’ গ্রন্থে তন্চংগ্যাদের ৩৬(ছত্রিশ)টি অক্ষরের(বর্ণমালা)বর্ণনা আছে। যেগুলোকে  ‘আন্জী অক্ষর’ বলা হয়। আনজী অক্ষর হলো-একটি অক্ষরের ‘গভীরতম অর্থ’ যেখানে সৃষ্টির পেছনে কারণ বা রহস্য নিহিত থাকে। যেমন-‘অ’তে বুদ্ধ অনিত্য বুঝেছেন। এই অক্ষরগুলো মাধ্যমে পুরো শরীরের অবস্থান,অংশ বা গঠনকে বুঝা যায়। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার কোথায় অবস্থান এই আনজী অক্ষর দিয়ে নির্ধারণ এবং চিহ্নিত করা যায়। বৈদ্য বা কবিরাজ-রা এই আনজী অক্ষরের মাধ্যমে ‘নাড়ীবেদ’ পরীক্ষা করে রোগী চিকিস্যা করে। এই বিষয়ে প্রত্যেকটি বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। ‘মানবজন্ম ও ফুইরা আলাম’ দুটো গ্রন্থের ভূমিকা হচ্ছে মূলতঃ গসাইন বা গোসাইন লামা। শিবচরণ সাধক বা ব্যাদি ছিলেন। (তথ্যঃ বৈদ্য ফুলেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা,গর্জনীয়া পাড়া-ওয়া¹া,বয়স:৬৫,তারিখঃ১১/০৯/২০১০,রোজ শনিবার)। তিনি তার গসাইন্ বা গোসাইন্ লামায় উল্লেখ করেছেন যে,“সাকিন্ ছালাম য্যং মুই কাপ্তেই গাং,মানিয়া পুরীত্তুন্ তুরি যাং” অর্থাৎ সাকিন কাপ্তাই গাঙকে ছালাম জানিয়ে,আমি মনুষ্য ধরাধম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে,চাকমারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গোজেন বলে না। তারা বলে গোই(ঐ)। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গসাইন বা গোসাইন বলে। তাছাড়া আমি আরো লক্ষ্য করেছি যে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান কর্তৃক সংগৃহীত ‘চাকমা ভাষায় শব্দ কোষে’গ্রন্থে(সুগত চাকমা কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯৬ সনে প্রকাশিত) গোজেন শব্দটি অনুপস্থিত। গসাইন বা গোসাইন লামা গ্রন্থ থেকে জানা যায় শিবচরণের জন্ম ১১৮৪ মঘী বা মঘাব্দ আর ইংরেজী সন হচ্ছে ১৮২২ সাল। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)

এই সাধক বা ব্যাদি শিবচরণের জন্ম কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ে। আবার অনেকের মতে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত রাজস্থলী বাজারের নিকটবর্তী বাজার নাড়ামূখ পাড়া গ্রামে। লক্ষনীয় বিষয় দুটি নামের মধ্যে কিন্তু একটা শব্দগত মিল আছে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে এই পাড়ার পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নাম কাইত্তি গাঙ বা কাপ্তাই নদী। তাছাড়া আগে কাপ্তাই,বিলাইছড়ি,রাজস্থলীটি চন্দ্রঘোনার থানার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এই পাড়ার গ্রামবাসীরা এক সময় মাতামহুরীর তৈনগাঙে বসতি স্থাপন করেন। আমরা যদি ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখব তন্চংগ্যারা আরাকান থেকে এসে প্রথমে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা ছোট ছোট অংশে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে(রাইংখং,কাপ্তাই ওয়া¹া অঞ্চল)। আর তারা আরাকান থেকে আসার সময় কাল্লাঙের (ঝুড়ি) করে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে আসে।(রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)। পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণে তারা তাদের এত দিনের বাসস্থান(কাপ্তাই)ছেড়ে আবার তাদের আদি বাসস্থান মাতামুহুরি নদীর উপনদী তৈনছড়িতে চলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সবাই অবগত যে তৈনছড়ি বা তৈনগাঙ এর সাথে তন্চংগ্যাদের ইতিহাস অতোপ্রতোভাবে জড়িত আর এখানেই কিন্তু শিবচরণের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। এই ঐতিহাসিক যুক্তি বা তথ্য থেকেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় কিনা-কবি শিবচরণ তন্চংগ্যা জাতির গর্বিত সন্তান ছিলেন। তার রচিত গসাইন/গোসাইন লামা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এর সাথে গেঙ্গুলী বা উবাগীতের পালা,বারোমাস,গল্প,প্রবাদ-প্রবচনের মতো ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলিও দাবীর তালিকায় থেকে যাচ্ছে। কারণ শিবচরণের গসাইন লামার সাথে এইসব সৃষ্টির একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যদি উল্লেখিত বিষয় বা মতগুলি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয় তাহলে আমি বলবো পার্বত্য জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস বিশেষ করে চাকমা জাতির ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন করে ভাববার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বা সময় এসেছে।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা, বর্ণমালা ও ভাষার বই

 তন্চংগ্যাদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বর কোমল ও নরম। উচ্চস্বরে এবং গলা তুলে কথা বলা তাদের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাদের স্বরের মধ্যে সবসময় নরম ও কোমল টান লক্ষণীয়। বর্তমানে এসে ভাষার আদিরূপটা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন লক্ষনীয় হলেও বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা নিজ ভাষা ব্যবহার ও চর্চাকে অধিকারবোধ থেকে চিন্তা এবং বিচার করে। তারা সবসময় সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকে চর্চার অভাবে নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কিনা বা অন্যের ভাষার প্রভাবে নিজ ভাষা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষনীয়। জানিনা তারা নিজেদেরকে অভার র্স্মাট বা অতি বিশ্বায়নী হিসেবে ভাবেন কিনা। আমি ভাষা জানাকে প্রয়োজনীয় হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের সমৃদ্ধ ভাষাকে ছেড়ে অন্যের ভাষাকে নিজ মাতৃভাষার মতো ধারণ এবং চর্চাকে প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। ভাষার মধ্যে দিয়ে কিন্তু জাতির পরিচয় ফুটে উঠে বা বহন করে। ভাষার মাধ্যমেই জানা যায় কে কোন জাতির বা জনগোষ্ঠীর লোক। এই মাঝে ভাষা নিয়ে নিজের একটা চোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- একদিন অফিস থেকে বের হয়ে গরু দুধ কিনব বলে দোকানে গিয়ে দোকানিকে (দোকানি ৪০/৪৫ বছর বয়সের একজন চাকমা ভদ্র মহিলা) বললাম তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়- ‘ম-ই গোরু দোউত্ আহে’ ( মাসি গরু দুধ আছে)। আমার কথা শুনে দোকানি বলল- আছে। আমার কথা শুনে চাকমা ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- তুই কি তঞ্চঙ্গ্য নে ? আমি বললাম হ্যাঁ। পরবর্তীতে আমি চিন্তা করলাম শুধুমাত্র ভাষার জন্য হয়তো উনি আমাকে ‘বাবু আপনি তঞ্চঙ্গ্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন বা চিনতে পেরেছেন। না হলে হয়তো উনিও দশজনের  মতো চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে আমাকেও একজন চাকমা বলে জানতেন। সুতরাং শুধুমাত্র ভাষার কারণে উনি আমাকে তন্চংগ্যা হিসেবে চিনতে পেরেছেন, অন্যথায় নয়। হয়তো এই উপলদ্ধি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন আগে নিজ ভাষা গাথুনী পরে অন্য ভাষা। কারণ আমি বুঝি আমি যদি আমার ভাষা চর্চা বা ব্যবহার না করি অন্য কেউ এসে তা করে দিবে না। আর সেটি চর্চার অভাবে কোন একদিন হারিয়ে যাবে। আর আমরা সবাই অবগত প্রতিদিন পৃথিবী থেকে দুই/একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তন্চংগ্যাদের ভাষাও যে হারিয়ে যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তঞ্চঙ্গ্যাদর ভাষা ও বর্ণমালা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ১২টি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যেও নিজস্ব বর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা এবং বর্ণমালা নেই তাহলে তিনি আইনগত অপরাধী হিসেবে গন্য হবেন। এর আগে অবশ্যই বর্ণমালা ব্যবহার ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা বৈদ্যরা অগ্রগামী। তবে শুনে এসেছি তন্চংগ্যা বৈদ্যরা যে বর্ণমালা ব্যবহার করতেন সেগুলো নাকি চাকমা বর্ণমালা। পরে ইতিহাস পাঠে জেনেছি তঞ্চঙ্গ্যারা যদি আসল চাকমা হন তাহলেতো এই বর্ণমালাগুলি চাকমা বর্ণমালা পক্ষান্তরে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সাথে বর্তমান উভয়(তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা) বর্ণমালার একটা সাদৃশ্যের ঐক্যমান লক্ষণীয়। যেটি চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- তঞ্চঙ্গ্যারা অধিক মাত্রায় বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে (কিছিম্যা কা, গছিম্যা খা, চাইন্দ্যা গা- খাই, যাই, গাই ইত্যাদি) এবং কথা বলেও আ-কারান্ত দিয়ে। আর চাকমারা তাদের বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে কিন্তু কথা বলে অধিক মাত্রায় এ-কারান্ত দিয়ে(চুচাঙ্যা কা, গুজাঙ্যা খা, চান্দ্যা গা-খেই, যেই, গেই ইত্যাদি)। একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে এই বিষয়টি আলাপ করলে তিনিও গবেষণার যোগ্য এবং লক্ষণীয় বিষয় বলে মত দেন।

অনেক আগে থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা থাকলেও সেটি কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। পরে ভারতীয় এক গবেষক রূপক দেবনাথ বার্মা, ভারত ও বাংলােেদশ ঘুরে একটা সাজানো এবং গোছানো রূপ দাঁড় করান। একে সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যাকল্যাণ সংস্থা(বাতকস)। মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যারা ‘তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার একটি গোছানো রূপ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে  রূপক দেবনাথ ও এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার অবদান স্বরণীয়। আর সফ্ওয়ার উন্নয়নে জন্ ক্লিফটন্। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য স্ববর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানে গল্প বই(বিগ বুক),ছড়া বই(শুনার গল্প),বর্ণমালার বই,বর্ণমালা চার্ট,নাম্বার চার্ট,কার্ড এবং অংক বই প্রকাশিত হয়। সাথে আরো ছবি সম্বলিত সিরিজ পিকচার এবং থিম পিকচার প্রকাশিত হয়। এগুলি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাও কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা(মাল্টিলিংগুয়াল শিক্ষা অফিসার যখন ছিলেন)। এই শিক্ষা কার্যক্রমে গল্প ও ছড়া লেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন-সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা,লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, মিলন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা,বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা (কুতুবদিয়া)। আর বর্তমানে ক্লাস ওয়ানের উপযোগী ‘আমার বই আর গণিত বই’ তৈরী করার কাজ চলছে। আর এইসব বই বা উপকরণ তৈরীর জন্য ১৫(পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটিও আছে।

৪. লোকসাহিত্যঃ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অন্যতম অহংময় উপাদান হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য্যময় লোকসাহিত্যের ভান্ডার। সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আচার-আচরণের সাথে নিত্যদিনের কর্মকান্ডে এবং চিন্তা ভাবনা এই সাহিত্য ফুটে উঠছে। তার মধ্যে উবাগীত, প্রবাদ, ধাঁধা, গল্প, ছড়া ও বারোমাস উল্লেখযোগ্য।

উবাগীতঃ আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল গেঙ্গলী/উবাগীতের অনুষ্ঠান। নবান্ন উৎসবে এই গানের আসর বসত। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় কীত্তনের পাশাপাশি এই গেঙ্গলী গান হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানেও এই গানের আয়োজন হতো। যারা এই গানের রচয়িতা তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান অকল্পনীয়। তারা তাদের চিন্তাকে সুপ্রসারিত করেছে সে সময়ের জ্ঞানকে আশ্রয় করে। বিশেষ করে তারা রোমান্স ও ইতিহাসকে সাথে নিয়ে এই অমর সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছে। এই গানে একটা সুর থাকত যেটা আমরা পাহাড়ী বা আদিবাসী সুর বলি। এই সুরের সাথে প্রাকৃতি,ঝর্ণা,পাখির কূজন,বনভূমি একাকার হয়ে যেত। যেন স্বয়ং প্রকৃতি সুর দিচ্ছে, সুর তুলছে এবং সুর মিলাচ্ছে। এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি কাহিনী থাকে এবং পঙ্তির শেষে অন্ত মিল থাকবে। আর এটি গাইতে হয় বেহেলা দিয়ে। এই গেঙ্গুলীদের মধ্যে জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। যাকে সবাই কানাগেঙ্গুলী হিসেবে চিনে। স্বরস্বতীর অকৃপন কৃপায় তিনি অসাধারণ অনুভূতি শক্তি ,স্মৃতি ও মর্মাবধারণ সম্পন্ন সেকাল একাল শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ভূবন মোহন,নলিনাক্ষ ও ত্রিদিব রায় এই তিন রাজার অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষ রায় তাকে ‘রাজগেঙ্গুলী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। সেই অগনিত নাম না জানা ত্যাগী, গুণী ও জ্ঞানীদেরকে অসীম নমঃ নমঃ এবং জয়তু। এই রকম কিছু পালা বা রচিত সাহিত্য তন্চংগ্যা সমাজে খুবই পরিচিত। 

উবাগীতের পালাসমূহঃ জুম কাবা পালা,রাইন্যা বেড়ানা পালা,নাকসু ফুল পারা পালা,ঘিলা পারা পালা,রদংস পালা,বার্কী ধরা পালা,চাদিগাঙ ছড়া পালা,রাধামন ধনপতি পালা,লক্ষী পালা,ধর্ম পালা,রিজার্ভ পালা,অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা(রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা),লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা,মেদঙা-মেদঙী পালা,মিয়াধন-মিয়াবী,কুঞ্জধন-কুঞ্জবী,নিলংধন-নিলংবী,কামিতধন-কামিতবী,হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন তাদের মধ্যে অন্যতম।(পালাগুলি লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) নিম্মে একটি উবাগীতের পঙ্তি দেওয়া হলো-

             নানান-ভই-চর নানান রং,

             ধানে সুধায়  উ-ল সং।

             ধান ছরাত ধুল্ল রঙ,

             গাবুজ্যা গাবুরী উলাক সং।

             দেবংশী ফুলর গিলার তাক্,

             আদামত্ বেড়াইদন গাবুরী ঝাক।

             উদানত্ খেলিদন্ গুরালক্,

             পাল,পাল বেড়াইদন্ গাবুরলক।

             উরায় বইয়ারে তুলা-নি,

             আইছ্যা গাবুর লক্কুন কি গরন্ কি জানি।

             ই-চ-র মাদাত ধান তলই,

             জলা-জলি গাইততন্ গাবুরীলই।

             মিল্লা ধানতলই কুরায় খায়,

             কি জানি পরান বিরে আইছ্যা কন্না পায়।

             পশ্চিমে ডুবেল্লই পুব বেল,

             চুবে-চাবে গাবুজ্যা গাবুরীরে কই গেল।

             জুন পইজ্যা ভূই আদে,

             পরান দ ন জুড়ায় তুই বাদে।

             কদান কইনে লাঙ্যা দা গিয়ে গই,

             ঘর উবরে উইচ্ছে গই।

             ঝুবুক গাইছত্ পাইছ্ বাহ্,

             বাঁশি বা-ধল্লই লাঙ্যা দা।

             বাঁশী র শুনি মন কানে,

             ইন্দি লাঙ্যাবী চন রানে।

             চন তাবা চিদলে,

             লাঙ্যাবী মন দি ন পারের গমে দোলে।

             চনান উদুরাই পরেল্লই পেলাত্তুন,

             ঔল গুরি ভাত পেলা বাদ দি-লই নুন।

             জুরি পজ্যেই বু-য় খাদিয়ান ,

             মাদিত্ পজ্যেই কাদিয়ান।

             ধারা বা-ই-নে পরের ঘাম,

 লাঙ্যাবীত্তুন আদত ন উদের কন কাম।। (বি.এন তঞ্চঙ্গ্যা,আদামর ফুল। পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা)

প্রবাদ/ধাঁধা/গল্প/ছড়া

ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে অনেক গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধা শুনেছি। আবদার করতাম সময় সুযোগ পেলে। বিশেষ করে যখন অবসরে থাকতাম সবাই। আর সঙ্গী-সাথী ও ভাই-বোন মিললেতো কোন কথায় নেই। প্রবাদ ও ধাঁধা ধরাধরি করতাম কে কতটা বলতে পারে। মাঝে মধ্যেতো এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি হতো তবে সব কিছু সাময়িক পরে আবার ঠিক হতো। এভাবে অতিবাহিত ছোট বেলার প্রত্যেকটি দিন। মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেটাম মা-বাবারা যখন রাক্ষস বা ভূতের গল্প বলতেন। তবে রাজপুত্র যখন রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন রাক্ষসপুরী থেকে তখন আবার ভয় না পেয়ে খুশী বা মজাই পেতাম বেশী। 

তঞ্চঙ্গ্যাদের গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধার মধ্যে প্রকৃতির সাথে মানবিক ভারসাম্যতা বিদ্যমান। এখানে প্রতিটি বাক্য এবং চিন্তার সাথে প্রকৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সাথে আরো আশেপাশের প্রাণীকুল। তাদের নিত্য দিনের জ্ঞান,স্বভাব,অভ্যাস এবং আচরণগত নানা দিক। তন্চংগ্যারা প্রকৃতির সন্তান বলে তাই তাদের চিন্তার সাথে প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তারা প্রকৃতির মতো কোমল-নরম,বিনয়ী,নম্রভাষী এবং লাজুক। প্রকৃতির মতো তাদের হাত পাথার(ভিক্ষা)কোন অভ্যাস নেই। কাউকে সহজে বড় কথাও বলতে পারে না। কথাবার্তা সবসময় সংযত। তন্চংগ্যাদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে চিন্তার সাথে তাদের আচরণগত ভারসাম্যতা । তাই তাদের প্রত্যেকটি সাহিত্যবার্তা বা সৃষ্টিবার্তার মধ্যে এই আচরণ ও অভ্যাসগত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্মে সে রকম কিছু প্রবাদ,ধাঁধা ও গল্প তুলে ধরা হলো-

(ক) কিট্সা/ দা-অ কদা/প্রবাদঃ 

পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান, মুয়ত জয় মুয়ত খয়, পেদৎ বোক মুয়ত লাইত, এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কা(আ)ড়া, নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান, মরা বাই-স সমারে জেদা বাই-স পুরি জান, আক্কল বাধি অনা, ইচা শুউনি অনা, ইহিম কামত্ ফল পানা,উসুনা কুড়ায় ডাক কারা না, কুড়া লাইত্, চি-ল দরে কুড়া ছ ন পুছানা, সিনডালে-অ লো ন নিড়ানা, মুঅ গুনে ব্যাঙ মরা, ঠেঙ(অ) কোইত্ ঊরি দেনা, দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা,পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্, গুউত্তুন মুত্ গম্ অনা, রাঙা কালা মু অনা, ভুত্তোয়্যা কুউরে রোঙ কারা-না, আইদে আইদে ধদাডোদি টিক্ষ্যা কা(অ)রা গুরি, দা-শি দিলে নাচি খায় সবা-ইত্ ন পালে মা-ই খাই, ইসা-ব(হিসাব)গোরু(গরু) বায়ে(এ) খাই, খাঙ ন খাঙ ন খাঙ বালা যাঙ ন যাঙ ন যাঙ বালা, মুয়ত যউক পেদৎ ন যউক,বায়ু ফিরানা, নিমায়া নিতু,চিয়ন পআ কদা কুরা গু,সর্গ গু ন চিনা না,টাউ সুমা,ছাঅ-ল কানত্ মন্ত্র বরায় দেনা,আইছ কানত্ কুউরে বোউ না,সাপ্য়া উলে পুদাই দ ব্যাঙয়্যা উলে লাফাই দ,আগে গেলে বা-য় খায় পিছে তালে সোনা পাই । (ড. মনিরুজ্জামান,প্রবাদ ও তন্চংগ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ- পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত )

(খ) ধাঁধাঃ 

এক কা-য়া খালে এক কা-য়া তায়(শামুক), মাদি বিধিরে রোউত্ পুদি(হলুদ),ফিরের গুর গুর ফাদের মাদি(লাঙ্গল), মাদিত্তুন অচল ঘরততুন নিচল(মাচাং), মা-বা কানে ছ-বা দাঅর অই(নাদি সিরা/নাতাই ও সুতার টুম), ধুজ্যা সাগরত্ থালা ভাস্ন(তারা), আকাশত্ ঘর পাদালত্ দুয়ার কোই ন পাইলে খাবে চয়ার(বাবুই পাখির বাসা), ন পালে তয়ায় পালে ন আনে(পথ),গাইচ বুরে পানি কয়া(ডাব), এক বুজ্জ্যা খান দ্বি-বুজ্জ্যা চায় তান(মুখ ও দুটি হাটু), চিয়ন লক্কে কাদা বুড়া উলে পাদা(শন), বিল ছোয়ালে বয়া মরে(কেরোসিনের বাতি), বাঁ ঘরত্ বুজ্জ্যা দুদ্দুরায়(খই ভাঙ্গানো), ঘর আহে দুয়ার নাই মানু-অত্ আহন র নাই(উই পোকার বাসা), দুইল্লে এক মুঠ ইরি দিলে এক্ বেদেরাং(জাল), আখা আহে দুছা নাই দেল্লা আহে পাদা নাই(স্বর্ণলতা), বুক ডুব বিছি কালা কদা কয় মধুমালা(বেহেলা), কাইদে গুলা বুদুনী নাই(ডিম), এক বুজ্জ্যা কদা কয়(বই),শিরা নাই বুজ্জ্যা মানইত্ গিলে(শার্ট), একুল পানি ওকুলত্ যাই(মদ), আহা কাবিলে দুসা মরে(গাঙ), চাইত্ উবা খাইলত্ লেত্(দোলনা), রাজার আইত্ লেজত্ দোইলে কাইত্(ঢেঁঙি), লুদি টানিলে মোইন গুচুরে(কিংখরঙ), এরিং বিরিং তিরিং বাই চোক দ্বি-বা তার মাদা নাই(কাকঁড়া)। (লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) 

(গ) পস(গল্প)

কলাত্থুর কন্যা,বাঘ ও শূকরের মিতালী,তেন্দেরার পচ্ছন,দুলুক্কুঙী,পিত্তয়া চান,চিমুজ্যার লুক্ষীবর পানা,পুরীকন্যা মানোহারী,নিতাং সুতাং,রাঙকাইত্ বুলির সর্গ মারা না,মানিক পুদি কন্যা,বেঙ্গমা-বেঙ্গবী,টুনটুনি ও কুস্যা ব্যাঙ,ভূতের গল্প, কুজ্যা কুইনি পসন,বুজ্যা বুড়ির পিদা খানা,মিত্তিন্যা পসন,কবী-ধবী,বেঙ্যা,বান্দুরী,আল্চিয়া,ভলা গুরু,দুলোক কুনি,মিরা রাচা,সুবাত্তুরী আ পেত্তয়া ফিউং,আলচিয়া মিদি ঙ্যা,এক বিগৈইশ্যা,গুল চিনা,ভুলা-ভুলি,শেয়াল্যা আ হ্আইতস্যোয়া,বুজ্যা-বুড়ী আ বাঘ্যা,বুড়ী আ ভুত্তোয়া,বেলেই কন্যা,খুস্যোয়া বেঙ আ সুবাত্তুরী,শুগ মা,রাচা ভাগান্যা নাক্কোন্ চিলা,কাইত্ কন্যা,শুগবা বাঘ্যা আ পেচাবা,বুজ্যা বুড়ী,দাদু ঙ্যা দাদুঙী,মিরা আ পারান্ বন্,চানমুনি সূর্য মুনি,আল্চিয়া,ঊইঙোয়া আ কবাবা বন। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

(ঘ) ছরা/ছআ (ছড়া) ঃ 

ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের একটি উর্বর উপাদান। আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক ছড়া দেখেছি বিশেষ করে ঘুম পাড়ানী ছড়া। এই রকম ঘুম পাড়ানী ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করি। মা যখন জুমে যায় কাজ করতে তখন ছোট ভাই-বোনকে লালন পালন করতে বড় ভাই-বোনকে যে কি রকম বিড়ম্বনা সইতে হয় এই ছড়ার মধ্যে তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর সময়। এই ঘুম পাড়ানী ছড়া ছাড়াও আরো আছে খেলাধূলা(৬ নং ছড়া)আর রোমান্টিক টাইপের কিছু ছড়া(৪নং ছড়া)। 

    (১)   নাক্সো গাইছর রিয়াং জু,

               দোলউন্ বুনি কেরেং জু।

               কেরেং দোলাইত্ কেরেক চাক্,

               উয়াং দইত্তন ঝুইতগি থাক্ ।

       (২)    ডুলু বাইছর দোলইন্,কাই-জ্যা উদাল দুরি।

               ঘুম যাবদে ম লক্ষোবা,সোনা দোলইনত্ গুরি।

       (৩)   বেঙয়া দরের করক করক,ভাইজ্যা ডুবাত্ তলে।

               লক্ষোবিরে বৌ দিবং, রাঙা শুক্ষোর বারে।

       (৪)   জুম লেছাত্ উবা কইন, 

               সমারে বেরাইদন্ দ্বি-বা বইন্।

               দ্বি-বইনত্তুন কন্ন্যা লইন,

               দাঅর বইন্যা ন পালে, চিয়োন্যা লইন,

               কারে-য়-ন পালে , মৈন্ছাঙ অইন।

(৫)       আম পাদা তেল তেল,কাট্টল পাদা বেল।

  ম-হ(অ)াদত্ ভাত্ জরাবা , লক্ষো পেদত্ গেল।

  ভাততুন খাইনে দাঞর অইনে, কোন্ দেশত্ গেল ।

       (৬)   আম পাদা লক্ষণ, তরে মাইত্তে কদক্ষণ।

              আমত্ তলে সমালুং, বরই কাদা ফুদা লুং।

              বরই কাদা এদক বিদ, তিবিরিত তিবিরিত।

              শমই পাদা লরে চরে, তরে লড়াইদে বল্ পড়ে। (বি.এন তন্চংগ্যা থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

৫. পার্বত্য চুক্তি ও সাহিত্য চর্চা

১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সাথে প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একটা নবজাগরণ সূচিত হয়। এটি সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যারাও পিছিয়ে নেই। এর মধ্যে নবীন কিন্তু প্রতিভাবান একটা লেখক শ্রেণীর উদয় হয় যার সংখ্যা অনেক। এই ক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রকাশনা গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পহ্র জাঙাল এখানে অগ্রগামী। তারা দেশ, সমাজ ও জাতি নিয়ে চিন্তা করে এবং সাথে তারা আদিবাসী অধিকার নিয়েও সচেতন। সেজন্য আমি এই সময়কে  তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নবজাগরণের সময় বা যুগ বলি। তারা সব কিছু ভেদাভেদ ভুলে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সদয় প্রত্যয়ী। এই ক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা(এনজিও)গুলোর ভূমিকাও অনেক। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

৬. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর অবদান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’(পূর্বনাম উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট)আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বিশেষ একটা জায়গায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুটিকয়েক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে। উক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের(রাঙ্গামাটি) কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলে আমার এই সত্য উপলদ্ধিতা আরো গভীর এবং বদ্ধমূল হয়েছে। আমি মনে করি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামের যথার্থতা বা সার্থকতা মুল্যায়িত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ভবিষ্যতে এই দায়িত্বটা স্বরণে রাখবে আশা রাখি। 

৭. তঞ্চঙ্গ্যারা সম্মানিত ও গর্বিত জাতিঃ 

আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারাই সবচেয়ে সম্মানিত এবং গর্বিত জাতি। কারণ তাদের জাতির মধ্যে রয়েছেন এমনসব বিরল সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি যাদের কর্মকান্ড বা অবদান দেশ,কাল,সমাজ ও জাতির উর্ধে উঠে পুরো পৃথিবীকে করেছে আলোকিত আর জাতিকে করেছেন সম্মানিত। তারা হলেন সাধক কবি শিবচরণ,রাজগুরু প্রিয়রতœ মহাস্থবির(গৃহী নাম পালকধন তন্চংগ্যা), রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির(গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা),রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী বা রাজগেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা(কানা গেঙ্গুলী), শ্রেষ্ঠ বলি লাল মুনি তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। সবগুলি রাজকীয় মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ত্বের স্বীকৃতি। এত রাজকীয় মর্যাদা বা উপাধি এবং স্বীকৃতি প্রাপ্তি একটি জাতির জন্য আর কি চাওয়া থাকতে পারে।  

উপসংহার

এইভাবে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্য বিকশিত এবং প্রসারিত হয়। স্বরণযোগ্য বলে এই বাক্যটি শেষে এসে আবার বলছি। তঞ্চঙ্গ্যা জাতি যদি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আরো একটু সচেতন হয় তাহলে আমি আশা রাখতে পারি সামনে তাদের সুদিন আসছে। বর্তমানে প্রচুর তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়ে দেশে এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছে। তারা ভবিষ্যতে জাতির কান্ডারী হবে। যদি আমরা চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। সেটি হচ্ছে শিক্ষিত প্রজম্মের মধ্যে জাতিত্ত্ববোধের সচেতনতা। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রীধারীদের ক্ষেত্রে। তারা যদি নিজ জাতির প্রতি জাতিপ্রীতি হন তাহলে আমরা হয়তো এই সুফলটা পেতে পারি অন্যথায় নই। বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের(বিবাহ)ক্ষেত্রে। এই সময় তারা যদি একটু বেশী নিজ জাতিকে নিয়ে ভাবেন জাতি এতে উপকৃত হবে। এইক্ষেত্রে অবশ্যই জাতির অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখানে টার্গেট করা হচ্ছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্মকে। যাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক মর্যাদা অপেক্ষা করছে। দিনের আলোর মতো খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ লোক যারা অন্য সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করেছে তারা আত্বীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,সমাজ এবং সর্বোপুরী সামাজিক ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের অর্ধাঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এসে ‘তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের একজন’ হয়ে উঠতে পারেননি। সুখে দুঃখে এখনো সে তার মাতৃজাতির যাবর কাটছেন বা স্বপ্ন দেখছে। জানিনা এটি জাতির জন্য নতুন একটি ষড়যন্ত্র বা কূটকৌশল কিনা। কারণ অতীতে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমরা সেরকম অনেক ইতিহাস দেখেছি। তবে বেশীদূর যেতে হবে না ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তের দিকে তাকালে হবে। সেসময় পাকিস্তানীরা এবং তাদের সহযোগীরা যখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পেরে উঠছে না তারা বুদ্ধিজীবি এবং শিক্ষিত প্রজন্ম নিধনে পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং অনেকটা সফলও হয়। আমি এই কথাগুলি এই কারণে এখানে বলছি কারণ শিক্ষিত প্রজন্মই জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। তাদের চিন্তায় এবং সহচার্যে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হবে এবং টিকে থাকবে। একটি পত্রিকার ভাষ্য মতে-বৃটিশ পুরুষরা নাকি অন্য জাতি বা সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। কারণ তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস বা বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এতবড় সম্পত্তিশালী এবং শক্তিশালী জাতির যদি জাতি বা সংস্কৃতি ধ্বংসের চিন্তাটা মাথায় আসে তাহলে আমরা সাগরের এক কণা বালির মতো একটি জাতি হয়ে নিজ জাতির জন্য কি চিন্তা বা ভূমিকা রাখছি। আমি সব সময় আশঙ্কায় থাকি জাতি থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি নাতো। কারণ পৃথিবী থেকে নাকি প্রতিদিন কিছু না কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস ও বিলুপ্ত আশঙ্কা হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষিত এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এইক্ষেত্রে অভিভাবকদেরকেও ছাড় দিতে হবে জাতি ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে। নাই বা কম বলে আমি এই আশঙ্কাটুকু করি। এটি কিন্তু চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে নয়। তবে আমি আশাবাদী কারণ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা সমাজ বিকশিত হয়। তন্চংগ্যা সমাজও সেভাবে বিকশিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তঞ্চঙ্গ্যাদেরও সে সুদিন আসবে, সেই প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

পরিশেষে উল্লেখিত সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম ছাড়াও আরো অনেক সাহিত্যিক  এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম হয়তো আছে যেগুলো এখানে আসেনি বা আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি, পরবর্তীতে তথ্যপ্রাপ্তিতে সংযুক্তির সুযোগ রেখে তাদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

                                                         …………………………

তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক রচিত, প্রকাশিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের একটা তালিকা নিম্মে দেওয়া হলো-

১. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক রচিত সাহিত্যকর্ম

  ১।  সাধক শিবচরণ

       মানবজন্ম , ফুইরা আলাম,আর ‘গোসাইন লামা’ হচ্ছে (মানব জন্ম ফুইরা আলাম) এর ভূমিকা মাত্র।

  ২।  কবিরাজ পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা

 ক. ধর্ম্মধ্বজ জাতক(১৯৩১) – কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা।

 খ. চান্দোবী বারমাস, সত্য নারায়ণের পাঁচালী (সিন্নি পুঁথি), চাংমা লেখা শিক্ষা(১৯৩৮),

              রুত্তি বারমাস, আলস্যা মেলার কবিতা,বিয়াল্লিশর ভাত্রাদ(বারমাস)।

       ৩। কবি গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা  

            ক্যাঝুরী,মুলি,কলিযুর্গ ও দ্বিমুক্যা বারমাস নামে চারটি বারমাস রচনা করেন।

  ৪। শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা 

      ক. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (আগষ্ট-১৯৮৫)

      খ. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা (১৯৪৫),উদয়ন বস্তু বা কর্মফল(১৩৬৮),মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বৌদ্ধ গল্পমালা(১৯৮৭) 

       সম্পাদিত গ্রন্থ: ধর্ম্মধ্বজ জাতক(কবিরাজ পমলাধন তন্চংগ্যা মূলগ্রন্থের সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা)।

      প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ:

            ক. রাধামন ধনপুদি কাব্য (পহ্র জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা ২০০৮ প্রকাশিত)

            খ. অশোক চরিত(১৯৮৩); অনাগতবংশ।

            নাট্য কাব্য: 

            ক. বিজয়গিরি (পহ্র জাঙাল-৫ম সংখ্যা, ২০০৯ থেকে প্রকাশিত)

            খ. চরিত নাটক(ধর্মীয়): মানুষ দেবতা,মোহবসান এবং কুলধর্ম(কাব্য)

            গ. তপর্কীতন ও যাত্রাপালা : বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা(২৫/০৪/১৯৮৫)

            ঘ. শ্রী বুদ্ধের বারোমাস স্মৃতি(রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়-২৬/০৩/১৯৭৮)

            ঙ. কল্পতরু দান ফল কথা, বন্দনা ও দান ফল কথা, অক্ষর গাথা। 

এছাড়া রাজবলাকা,  নৈরঞ্জনা, সম্বোধি, পার্বত্য বাণী পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।

         ৫। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

–        তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি(গ্রন্থ)।

এছাড়া বান্দরবান থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘ঝর্ণা’,রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘পার্বত্য বাণী’ ও সাপ্তাহিক  ‘বনভূমি’ তার ভিবিন্ন সময় কবিতা প্রকাশিত হয়।তার মধ্যে- অবিস্মরণীয়া,নিশা,আমি একাকী,পথিক,বান্দরবন,মায়াময় পৃথিবীতে,পার্বত্য চট্টলার প্রতি,অব্যক্ত অনুভূতি,বরষা,বৈশাখী পূর্ণিমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

   ৬।  রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির

              প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

সমবায় বুদ্ধোপাসনা, বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বুদ্ধপাসনা (লোকত্তর বিভাগ), বুদ্ধপাসনা(লোক বিভাগ), চাঙ্মা গীদেন্দি মঙ্গল সূত্র, পরিণাম(নাটক), শ্রামণ কর্তব্য, মানব ধর্ম পঞ্চশীল, The Stop Genocide Hill Tracts of Bangladesh.

               অপ্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

 বিশুদ্ধিমার্গ(৩য় খন্ড), বিদর্শন ভাবনা নীতি(৫ম খন্ড),বুদ্ধোসামন্তিকা (৫ম খন্ড), অভিধম্মার্থ সংগ্রহ, ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ, জন্ম মৃত্যুর কথা, সাম্য বীথিকা, চন্দ্রগুপ্ত (নাটক), বাসবের পথে(নাটক), রূপনন্দা(নাটক), সঞ্চয়িতা, বাংলাদেশ বড়–য়া জাতি, মহা কঠিন চীবর বর্ণনা,বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ, অগ্নিমশাল(গীতি মঞ্জুরী),চাঙ্মা কধাদি ধর্মপদ,পথ তগেয়ে মন(চাক্মা ভাষায় নাটক), মহামানব গৌতম বুদ্ধ, আবিলাস্যা সংসার(চাক্মা ভাষায় নাটক), সিদ্ধার্থ চরিত, মহাস্বপ্ন (চাকমা ভাষায় নাটক), বেসান্তর কীর্ত্তন, মহাযাত্রী(গীতিনাট্য), দর্শন ও বিদর্র্শন, ধর্ম ও সমাজ, বুদ্ধের অবদান (৩য় খন্ড)।(তথ্যঃ মানব ধর্ম পঞ্চশীল,রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির)।

    ৭। ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির

             প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহঃ

শাতিকাধাতু কথা স্বরূপিনী, অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরূপিনী, যমক স্বরূপিনী, অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গ প্রকরণ, বুদ্ধ প্রকাশনী, পথ প্রদর্শন, চলার পথে।

     ৮। শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

  • ১৯৭৬ সালে বিরাজ মোহন কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘পার্বত্য বাণী’র প্রথম সংখ্যায় ‘কালিন্দী’ নামক ইতিবৃত্তমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কলিকাতা ‘বোধিভারতী’ পত্রিকায় তার কয়েকটি গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  •  রাঙ্গামাটি পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ‘অঙ্কুর’ প্রকাশিত হয়।
  • রাঙ্গামাটি সাপ্তাহিক বনভূমি থেকে ‘সীমান্তের শান্তি’ চার সংখ্যা পর্যন্ত বের হয়।
  • ‘রুনুখাঁর উপাখ্যান’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস কয়েকটি অধ্যায় বের হয়েছে।
  • বুদ্ধের জীবনের উপর রচিত ‘অমিতাভ’ ১৯৬৭ সালে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়।
  • ১৯৭০ সালে চাকমা নাটক ‘মূড়া যেক্কেনে’ নানিয়াচর উপজেলায় কৃঞ্চমাছড়া গ্রামে অভিনীত হয়। 
  • গিরি নির্ঝর পত্রিকায়  ‘রক্ততিলক’ প্রকাশিত হয়। 
  • তিনি রাঙ্গামাটি বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত ‘গান ও কথিকা’ লেখক।
  • ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করে। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ফোরামও ২৭শে চৈত্র ১৪১০ বাংলা সম্মাননা প্রদান করে। 
  • চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ২৫ বৎসর পূর্তি’ উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান করে। 
  • তার প্রণীত গ্রন্থ সমূহ- ‘তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, ভাগ্যরতœ’ । 
  • ছ. বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে ২০০৮ সালে সাহিত্যে সম্মাননা দেওয়া হয়।

      ৯।  অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান 

  • ক. তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা-রূপ প্রসঙ্গ (১ম সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৩, সম্পাদকঃ পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • খ. ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়ন: তন্চংগ্যার উত্তরাধিকার প্রশ্ন (২য় সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৪ সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • গ. পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন (৪র্থ সংখ্যা, ১৪ই আগস্ট-২০০৮, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • পার্বত্য কথাসম্ভার তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ (৫ম সংখ্যা, ৯আগষ্ট,২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)

      ১০।  রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

            তঞ্চঙ্গ্যা জাতি, গীত পোই, চিত্রা (আর্ট বই)। এছাড়া স্থানীয়,জাতীয় অনেক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তার বহু মূল্যবান গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি একজন প্রতিবাদী লেখক এবং সমাজ চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে আতœস্বীকৃত। 

      ১১।  রূপক দেবনাথ (ভারত)

     Rupak, Debnath, Ethnograpic Study of the Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South Tripura Kolkata: Kreativmind, 2008.

.

      ১২।  কর্মধন তন্চংগ্যা

      প্রবন্ধ সমূহঃ 

  • আচ্ছ্যা বিষু-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১১ই এপ্রিল’০৫।
  • লুউই-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৯শে মে’০৫।
  • তন্চংগ্যা সমাজে বিষু উৎসব-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৮ই এপ্রিল’০৬।
  • আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরাই বাচিঁয়ে রাখবো-রঁদেভূ,৬ষ্ঠ সংখ্যা,০৬।
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও মিডিয়া- রঁদেভূ ,৫ম সংখ্যা,০৫।
  • বিপন্ন আদিবাসী ভাষা-সমুজ্জ্বল সুবাতাস,ফেব্রয়ারী’০৫।
  • তন্চংগ্যাদের জুম চাষ,মিথলজি- পহ্র জাঙাল,৫ম সংখ্যা’০৯।
  • চাকমা কবিতায় তন্চংগ্যা ধনপুদি- পহ্র জাঙাল,৪র্থ সংখ্যা’০৮।
  • তন্চংগ্যাদের রাষ্ট্রভাষা চর্চা ও একটি প্রস্তাবনা- পহ্র জাঙাল,১ম সংখ্যা’০৩।
  • আদিবাসীরা বেঁচে থাকবে চিরদিন-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা),৮ম সংখ্যা, ২০০৬।
  • ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এর মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম-যেন প্রকৃতির ভাষার মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলো, 

     সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট,সাস,ডিসেম্বর-২০০৯।

           ছোট গল্পঃ 

  • সাঙা -দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,৫ই জানুয়ারী’০৭।
  • নীলাকাশ- রদেঁভূ ,৭ম সংখ্যা’০৮।
  • পু-কাল্লাঙ-তৈনগাঙ,আদিবাসী দিবস সংখ্যা-২০০৬।

কবিতাঃ

  • জুমফুল পথ খোঁজার সাথী হয় না; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৪ নভেম্বর’০৬।
  • জুম দেশের বৃষ্টি; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৯জানুয়ারী’০৭। 
  • বয়স ৩; পহর জাঙাল,৩য় সংখ্যা’০৫।
  • জীবনের গদ্যকবিতা,ধূপছায়া,২য় সংখ্যা,২০০৩।
  • স্বপ্ন,নব সভ্যতার-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা), ২০০৪।

           গুচ্ছ কবিতাঃ

  • রুমালের ফুলে মুখ লুকাতে, তুমি যাবে আমাদের গ্রামে, বনে আলো প্রবেশ করে না;

      দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১৬ই ফেব্রয়ারী’০৭। 

  • নূপুরবিহীন জুমনৃত্য, প্রকৃতির লজ্জা; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২রা ফেব্রয়ারী’০৭।
  • তিনটা জীবন, ওপর-নিচ সমান্তরাল; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৪ জুলাই’০৫।
  • আজ কবিতা লিখব না চিঠি লিখব, শুধু ভালোবাসে না তারা আমাকে; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৮শে আগষ্ট’০৫।
  • জুম পরানীর আত্মা, স্যারের কবিতা বাতাসে উড়ে যায়; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৩মে’০৫।
  • অনন্ত কাল ধরে বহুদিন, আমরাও জেগে আছি ধরিত্রীর মাঝে, যদি তোমায় একটি বার দেখা পাই; 

           দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৮শে এপ্রিল’০৫।

           অনুবাদ কবিতাঃ (তন্চংগ্যা ভাষায়) 

           ন-য়া ব-সর; (শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড.মনিরুজ্জামান স্যারের ‘ইদানিং বিপন্ন বড়ো’র পঞ্চতপার গান এর ‘নববর্ষ’ কবিতার অবলম্বনে)।

           সম্পাদনা করেন : 

  • পহ্র জাঙাল (একটি তন্চংগ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা)। ২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা, প্রকাশনায়ঃ পহ্র জাঙাল  প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  •  রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক), ৬ষ্ঠ, ৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহ:সম্পাদক। 

২. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন সমূহ

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা, রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদনায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তন্চংগ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তন্চংগ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তন্চংগ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তন্চংগ্যা-৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তন্চংগ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তন্চংগ্যা-৩য় সংখ্যা,অমিত তন্চংগ্যা-৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা, সুতিল কুমার তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক: সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক: আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক),৬ষ্ঠ,৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক- কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহঃসম্পাদক: কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা । 

     ৩. তন্চংগ্যাদের সম্পাদিত নিজস্ব প্রকাশনা:

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা,রাংগামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদরায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তঞ্চঙ্গ্যা -৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা,অমিত তঞ্চঙ্গ্যা -৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,সুতিল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক:সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক:আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 

                                                ……………………………

তথ্য সূত্রঃ 

১. পহ্র জাঙাল (একটি তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা-সব সংখ্যা)।

২. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা।

৩. গোজেনের লামা বা গোঁসাই পালা- বিরাজ মোহন দেওয়ান। পার্বত্য বাণী, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ফেব্রয়ারী-১৯৬৮।

৪. সাধক শিবচরণ-যামিনী রঞ্জন চাকমা। গিরি নির্ঝর, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা,মে-১৯৮২।

৫. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। 

৬. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি-শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

৭. তৈনগাঙ, ন-আ শমন, রাঙাফুল প্রকাশনা।

৮. সাধক কবি শিবচরণ জীবনালেখ্য-আশীষ চাকমা,রঁদেভূ,আগষ্ট-২০০৫।

১০. প্রয়াত সুবাস তঞ্চঙ্গ্যা, বারঘোনীয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, রেশম বাগান-কাপ্তাই।

তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন এবং সংস্কৃতি

কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সুপ্রচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তনচংগ্যাদের বসবাস রয়েছে। এই বসবাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বটে। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যারা দাইনাক নামে পরিচিত। এই দাইনাক/দৈনাক শব্দটি একটি ঐতিহাসিক শব্দ, যার অর্থ যোদ্ধা। ঐতিহাসিকভাবে তঞ্চঙ্গ্যারা যুদ্ধজাতি হিসেবে পরিচিত। ভারতে নানা প্রদেশে, অঞ্চল বিশেষে তারা তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা এবং চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত। তনচংগ্যারা তিবেতো-বর্মন-ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠীভুক্ত, যদিও বর্তমানে তাদের ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার অর্ন্তভুক্ত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান বসতি। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় রাঙ্গুনীয়া উপজেলার উত্তরা-পূর্বাংশে এবং কক্রবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের বসতি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ(সিএডিসি) অঞ্চলে তাদের প্রধান বসতি। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের মূল বসতি বর্তমানে আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কলদান নদীমুখ অবদি। তাছাড়া বসতি রয়েছে আরাকানের ভুসিডং,রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে, মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়। তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলা নববর্ষ বা বিষু হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এর পাশাপাশি ধর্মীয় নানা পূজা-পার্বনও তারা পালন করে থাকে। 

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সুদীর্ঘকালের যে ইতিহাস সেটি শুরু হয় মায়ানমারে আরাকান প্রদেশ/রাজ্য থেকে। যেখানে দান্যায়াদি নামে একটি ঐতিহাসিক স্বাধীন রাজ্যের গড়া পত্তন হয়। মূলতঃ দাইনাক বা দৈনাক থেকে দান্যায়াদি নামের ঊৎপত্তি। বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান বা দান্যায়াদিতে দাইনাক বা দৈনাক নামে বসবাস করে যা এখনো বর্তমান। ইতিহাস বলে তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে প্রথমে বান্দরবান জেলায় আলিকদম উপজেলায় তৈনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয় এই তৈনছড়ি থেকে তঞ্চঙ্গ্যা নামটি উৎপত্তি। এর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত হয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে যা এখনো বর্তমান। শ্রী মধাব চন্দ্র চাকমা তার রাজনামা গ্রন্থে চাকমাদের দুটি শাখার কথা বলেছেন। একটি হচ্ছে ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘আনক্যা চাকমা’। এই ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আর ‘আনক্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান চাকমারা। একদা ইতিহাসে আরাকান/দান্যায়াদি অংশকে বলা হতো ‘রোয়াঙ্গ্যা’ আর চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বলা হতো ‘আনক’। এই আনক্ থেকে ‘আনক্যা’ শব্দটি এসেছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস শুরু হয় মূলতঃ আরাকান-পার্বত্য চট্টগ্রাম-ভারত আর চাকমাদের ইতিহাস শুরু হয় ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাই ইতিহাসের সরল ভাষ্যমতে এই আনক্যা চাকমারা আদৌ আরাকানে বসতি স্থাপন করেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। ইতিহাস গবেষকদের মতে রাজনামা বা চাকমা রাজনবর্গে তাদের ধারাবাহিক ইহিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি) থেকে সাত্তুয়া (পাগলা রাজা) পর্যন্ত রাজারা ছিলেন রোয়াংগ্যা চাকমাদের(তঞ্চঙ্গ্যা) বংশধর আর ধাবানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজারা হচ্ছেন আনক্যা চাকমাদের(বর্তমান চাকমা) বংশধর। তাছাড়া চাকমা ইতিহাস লেখকদের লেখনীতে তাদের ইতিহাসের দোলাচলতা আমরা লক্ষ্য করি। ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে অশোক কুমার চাকমা বলেছেন- চাকমা জাতির ইতিহাসের একটি কাহিনী বা অংশ চাক জাতিও নিজেদের বলে দাবী করছে। তাহলে কি এই কাহিনী চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছে ? না আমরাই তাদের কাহিনীকে নিজেদের (চাকমাদের) বলে চালিয়ে দিচ্ছি। তাই অশোক কুমার চাকমা ‘চাক ও চাকমাদের মিলে যাওয়া ইতিহাসের’ অংশ নিয়েও এই রকম একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। আর জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যারা নাকি আসল চাকমা, এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। তাই আমরা লক্ষ্য করেছি তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস compromise এর ইতিহাস। 

ইতিহাসে উলেখ আছে তঞ্চঙ্গ্যাদের আগে বর্তমান চাকমারা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেন, সেজন্য তারা তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে ‘পরঙী’ বা বসবাসের জন্য আগমনকারী হিসেবে অভিহিত করতেন। আর চাকমরা যদি কোন কারণে বা কালে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকেন তাহলে তারা আরাকানকে স্বদেশ বা মাতৃভূমি হিসেবে মেনে নেয়নি বা গ্রহন করেননি। তার কারণ মগ রাজার সাথে তাদের সর্ম্পক ভালো ছিলনা। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে আরাকান বা মগ রাজাদের সর্ম্পক ভালো ছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিজয়গিরি প্রচুর সৈন্য সামান্ত নিয়ে রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন। এই সৈন্য সামান্তরা যে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বংশধর ছিলেন সেটাও ইতিহাস বলে। কারণ তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে মারমা এবং রাখাইনরা সেসময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত “দৈনাক” বলে সম্বোধন করেন। ইতিহাসে আছে বিজয়গিরি যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু অংশ এখানে থেকে যায় আর কিছু অংশ স্বদেশে বা আরাকানে চলে যান (বিচগ্রী যুদ্ধ জয়ের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়া)। ইতিহাসের তথ্যমতে রোয়াংগ্যা চাকমা বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধনদের যোদ্ধাদের বংশধর এবং উত্তরসুরী। ইতিহাস আরো বলে তঞ্চঙ্গ্যারাই গৌতম বুদ্ধের বংশীয় শাক্য বংশের উত্তর পুরুষ। আরাকানে বসবাসরত তন্চংগ্যাদেরকে শাক্যবংশীয় উত্তরসুরী হিসাবে তদান্তিন জেনারেল উনু প্রতি বৎসর এ জাতির দম্পতিকে রেঙ্গুনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করতেন।

আবার অনেকে বলেন তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমারা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রদায় ছিল। উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজা ধাবানা তার শাসন থেকে ‘চাকমা’ নামে একটি জাতি বা সম্প্রাদয়ের সংস্কার গড়ে তুলেন। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমারা কি নামে সম্বোধন হতেন তা গবেষকগণ বলতে পারেননি। তবে লুইনের মতে চম্পক নগর থেকে আগত বলেই চাকমা নাম ধারণ করা হয়। কিন্তু চম্পক নগরের অস্থিত্ব নিয়ে ইতিহাসে নানা প্রশ্ন আছে। আর ত্রিপুরা রাজমালা’র মতে অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ের শব্দটি এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে চাকমা নামের উলেখ পাওয়া যায় এই রাজমালা গ্রন্থে। আবার অনেকের মতে পূর্ব পুরুষদের আচার,আচারণ, অভ্যাাস ও অবস্থান দেখে আরাকানীরা হেঁয়ালীভাবে তাদেরকে চাংমাং বা চামা এবং তংসা নামে ডাকত। পরবর্তীতে এই শব্দদ্বয় থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা শব্দদ্বয় রূপান্তরিত  হয়ে থাকতে পারে। 

আরাকানের ভুসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে,মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করে আসছে। তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু। আরাকান থেকে এসে তারা তৈনছড়ি কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় ক্রমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খৃীষ্টাব্দে দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলের এক রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছে স্থানীয় প্রবীনদের মত রয়েছে। ইতিহাস বলে পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরুপে বিবেচিত হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আর রাজা ধরমবক্স খাঁ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বজাতি হিসেবে গ্রহণ করেননি। ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে তার আমলে ৪,০০০(চার হাজার) তঞ্চঙ্গ্যা আগমন করেন। এদের রাজা ছিলেন ফাপ্র“। তারা পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুটির’ (বর্তমানে ডিসি বা নজরুল স্কয়ারের পাহাড়ের উপর বিল্ডিংটি) ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দেন।

ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যারা জাতিতে মঙ্গোলীয় এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা চর্চা অনেক দিনের। জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট্য ভাষাতাত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েষ্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (Linguistic Survey of India)’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষাকে পৃথক ভাষা বলে উলেখ্য করেছেন এবং উভয় ভাষাকেই আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অর্ন্তভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেন। তঞ্চঙ্গ্যাদর নিজস্ব লিপি আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের লিপি অনেকটা বার্মিজ লিপির কাছাকাছি। এর মূল উৎপত্তি হচ্ছে ‘মন’দের থেকে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা যে বর্ণমালাটা ব্যবহার করছে সেটি হচ্ছে দাইনাক বর্ণমালা। তাদের বর্তমান মোট বর্ণমালার সংখ্যা ৩৬টি। তার মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ হচ্ছে ৩১টি আর স্বরবর্ণ হচ্ছে ৫ টি। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সহজাত উচ্চারণ হচ্ছে ‘আকারান্ত’। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা শান্ত, নরম এবং কোমল। 

সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকারটা বিশেষ করে জমি-জমা, পাহাড়-পর্বত লাভ প্রথাগত। তারা এক পুরুষ ভোগ করার পর পরবর্তী পুরুষকে তার সম্পত্তিকে দেখভালে দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ছেলেরাই অগ্রাধিকার বেশী পায়। তবে পুত্র সন্তান যদি না থাকে মেয়ে সন্তান থাকলে মেয়েরাই সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর পুত্র মৃত্যু পর পুত্রবধু যদি দ্বিতীয় বিবাহ না করে সে ঘরে যদি কোন সন্তান থাকে সেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। নিঃসন্তান হয়ে তারা যদি পালক সন্তান পালন করেন বা কেউ তাদেরকে লালন-পালন করেন (ভাইয়ের বা বোনের সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ) তখন তারা সম্পত্তির ভাগ পান। যদি স্বামী-স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে তারা চাইলে তাদের সম্পত্তিগুলি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দানও করে দিতে পারেন। 

পোষাক-পরিচ্ছদ এবং আলঙ কানিঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা সরকারী ভাষায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রয়েছে তনচংগ্যাদের পোষাক তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ। মূলত এই বৈচিত্র্যময় পোষাক দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের আলাদা এবং স্বকীয়ভাবে সহজে চেনা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের ‘পাঁচ কাপড়ের’ পোষাকটা। মেয়েদের এই পাঁচ কাপড় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছে। এই পাঁচ কাপড় হচ্ছে- পিনন(পরনের কাপড়), খাদি (ওড়না), মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী), পা-দুরি(কোমড় বন্ধনি), সালুম(শার্ট) এগুলি হচ্ছে মেয়েদের জাতীয় পোষাক। আর ছেলেদের জাতীয় পোষাক হচ্ছে- ধুতি, হাফ হাটা সাদা ফুটুয়া এবং মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী)। মেয়েরা তাদের কাপড়গুলি নিজেরাই তৈরী করে, কোমড় তাঁত এর মাধ্যমে। ‘আলঙ কানি বা আলাম’ হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের নকশা পুথি। এটি মূলত একটি নকশা করা কাপড় যেখানে সমস্ত বুননের ডিজাইনগুলি নকশা করা থাকে। এই ডিজাইনের ফুলগুলি জুমে উৎপাদিত নানা ফুল,ফল এবং প্রকৃতি ও জীবজন্তুর নানা উপাদান থেকে নেওয়া। তাই এই বুনন উপাদনের সাথে জুমের একটা আত্মার সর্ম্পক রয়েছে। এই জুমের ফুল নিয়ে তনচংগ্যা সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছে গান, সাহিত্য। রয়েছে ঐতিহাসিক উবাগীত, রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যেও। রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যে রাধামন-ধনপুদি পোষাকের মধ্যে আমরা এই জুমফুল এবং আলঙ কানি ফুলগুলির বর্ননা পাই। যেমন- কুরা চোখ ফুল(মুরগী চোখ ফুল),বিঅন বিচি ফুল(বেগুন বীজের ফুল),রাধাচুলা ফুল(মোরগের ফুল),গাইত ফুল(বিশেষ করে শার্ট বোনা হয়), কুরাঙা কাবা ফুল,কাঙারা চোখ ফুল,প্রজাপতি ফুল(বিশেষ করে থলে তৈরী করা হয়),বিসন ফুল(এই ফুল দিয়ে শার্ট বোনা হয়),কুমুড়া বুক্ক্যা ফুল,মাম্মা বিচি ফুল,ধুদি পাল ফুল,আইদ ফুল, আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল,বুল চুক্ক্যা ফুল, কই ফুল(শার্ট বোনা হয়),কেরেঙ ফুল, জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড় (পোষাক) হচ্ছে রাজকীয় পোষাক। তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাক বিশেষ করে মেয়েদের পোষাক নিয়ে সমাজে আরো কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময় চাকমা শাসক ছিলেন রানী কালিন্দী। আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার সময় ব্রিটিশ লর্ড নাকি রানী কালিন্দীর সাথে দেখা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং তারা দূত মারফত সে খবরটি পৌঁছে দেন। আর অনুরোধ করেন আসার সময় চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নিয়ে আসার উপহার হিসেবে। সেগুলি উপহার স্বারক হিসেবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখবে। রানী কালিন্দী নিজে না গিয়ে তার কিছু হেডম্যানকে ব্রিটিশ লর্ডের সাথে সাক্ষাতের করার জন্য প্রেরণ করেন এবং চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক (পিনন, খাদি এবং ব্লাউজ) উপহার হিসেবে পাঠান। ব্রিটিশ লর্ড তাদের সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং রানী কালিন্দীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এক পর্যায়ে হেডম্যানরা রানীর দেওয়া চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকগুলি ব্রিটিশ লর্ডের হাতে তুলে দেন। ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি পেয়ে খুশী হন এবং রানীকে হেডম্যানদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান। পরে তাদের সামনে ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি খুলে দেখেন এবং অবাক হয়ে নাকি বললেন-“এগুলিতো চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নয়”। তখন এই হেডম্যানরা নাকি পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যাদের পাঁচ কাপড়(পিনন,খাদি,সালুম,পা-দুরি, মাদাকাবঙ) দিয়ে আসেন এবং ব্রিটিশ লর্ড বললেন- এগুলিই হচ্ছে চাকমাদের আসল পোষাক। তার জন্য আবারো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানান। জনশ্রুতিতে আরো আছে এই পাঁচ কাপড়গুলি নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে তখনকার স্বারক শাসনের স্বারক হিসেবে। 

জুম চাষের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাকের একটা মিল আমরা দেখতে পাই। আর এই মিলটা হচ্ছে ফুলের। এই ফুলগুলি তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাককে বৈচিত্র্যভাবে এবং নানা রঙে ফুটিয়ে তোলার ভূমিকা পালন করেন। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যেসব পোষাক হাতে এবং বুননের মাধ্যমে তৈরী করে তার মধ্যে যেসব ফুলের কারুকাজ ব্যবহার করা হয় সে ফুলের নামগুলিও জুমে উৎপাদিত নানা ফল বা ফলের বীজ এবং ফুল থেকে নেওয়া। যেমন- বেউন বিচি ফুল, কুরা চোখ ফুল, গাইত ফুল, বিসইন ফুল, সুইচ্ছাং ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কাঙারা বিচি ফুল, কুমুড়া বুক্কয়া ফুল, মাম্মা বিচি ফুল, ধুদি পাল ফুল, আই-দ ফুল,আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল, বুল চোক্কয়্যা ফুল, কই ফুল, বিঞ্চ ফুল, হাদি চ ফুল, প্রজাপতি ফুল,মাইত ফুল। রাধামন-ধনপদি পালার পোষাকের মধ্যে আমরা তঞ্চঙ্গ্যাদের এই জুম ফুলগুলির বর্ণনা পাই।

সামাজিক সংগঠন বা গছা/গোত্রঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের বংশ পরিচয় পিতৃসূত্রীয়। তাদের সর্বমোট বারটি গোত্র আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় গোত্রকে গছা বলে। তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার সংখ্যা হচ্ছে ১২(বার)টি। এই গছাগুলি হচ্ছে -র্কারআ গছা, মুঅ গছা, ধন্যা গছা, লাং গছা,মংলা গছা, মেলং গছা, অঙ্যা গছ, রাঙ্যা গছা, লাপ্যোসা গছা, ওয়াহ গছা, মুলিমা গছা,তাসসি গছা। এই গছাগুলির আবার রয়েছে উপগছা। তঞ্চঙ্গ্যাদের মৌজা প্রধানের নাম হেডম্যান এবং গ্রাম/পাড়া প্রধান হচ্ছেন কার্বারী। তারা সামাজিক নানা বিচার-আচার পরিচালনা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

জীবন জীবিকা এবং চাষাবাদঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তাদের জুম চাষের মুল পর্বটা শুরু হয় বৈশাখের পরে। তবে বৈশাখের পূর্ববর্তীতে তারা জুমকে অনেকাংশে চাষের উপযোগী করে তৈরী করে রাখে। জুমকে কেন্দ্র তারা করে তাদের জীবন পুঞ্জিকা তৈরী করে। এই জুমে ধান, হলুদ, আদা, কলা, কচু, মরিচসহ নানা রকম সবজি উৎপাদন করে। জুম থেকে তারা সারা বছরের জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ পেয়ে থাকে। এই জুমকে কেন্দ্র করে তাদের ঐতিহাসিক নানা সাহিত্য এবং কাহিনী বা পালা রচিত হয়েছে। তার মধ্যে জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা। আর আছে নানা পৌরানিক উপখ্যান। তার মধ্যে লক্ষী মা ও মিত্তিন্যা পসন। বিষু সময় গ্রামের যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে জুমে তরকারী খুজতে যেত। 

ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসঃ

 তঞ্চঙ্গ্যারা জন্মগতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তারা গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনে অনুসারী। তাদের প্রত্যেকের গ্রামে একটি করে বিহার/প্যাগোডা রয়েছে। সকাল বিকাল তারা বিহারে গিয়ে পূজা-আর্চনা করে, বুদ্ধ এবং ভান্তেকে বন্দনা করে। সাথে প্রার্থনা করে জগতে সকল প্রাণী সুখী হওয়ার জন্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের একটা রীতি আছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত একবার হলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে শ্রামন্য দীক্ষা গ্রহন হরতে হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর পাশাপাশি মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমাও তারা যথাযত ধর্মীয় অনুশাসনে পালন করে থাকে। 

পরিবারের ধরণঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একক এবং যৌথ পরিবার লক্ষ্য করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যারা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান। তবে পিতার অবর্তমানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠই পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবার নেই বললে চলে।  

সঙ্গীত ও সাহিত্য

সাধক কবি শিবচরণ, রাজ কবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে আলোকিত করেছে। সাধক কবি শিবচরণ তার গোসাইন লামা সাহিত্য তঞ্চঙ্গ্যাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তেমনি ভাবে সাদিগাঙছড়া, জুম কাবা, রাইন্যা বেড়া, ফুল ফারা, রাধামন ধনপুদি পালা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যকে সমৃদ্ধ শিখরে নিয়ে গেছে। সে সময় চারণ কবি গেঙ্গুলীরা গানের আসর জমিয়ে তুলতো এই পালাগুলি গেয়ে বেহেলার সুরে। তঞ্চঙ্গ্যাদের চারণ কবি বা শিল্পীদের গেঙ্গুলী বলা হয়। ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এবং রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার। দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনিলা তঞ্চঙ্গ্যা, মিনা তঞ্চঙ্গ্যা, শোভা তঞ্চঙ্গ্যারা তঞ্চঙ্গ্যা গান এবং নৃত্যকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সমকালীন আধুনিক লেখকদের মধ্যে বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা(পরলোকগত), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। ‘পহর জাঙাল’(তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রকাশনা সাহিত্যে অন্যতম পথ প্রদর্শক। এটির স্বপ্নদ্রষ্টা হচ্ছেন কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি যখন ২০০১-০২ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে বিষু উপলক্ষে। আর এটির উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় ওয়াগ্গা হাই স্কুলের হল রুমে। পরবর্তীতে পহ্ র জাঙাল এর পথ ধরে সিঙহাবা, চালৈন, তৈনগাঙ প্রকাশনাগুলি তঞ্চঙ্গ্যা আধুনিক সাহিত্য চর্চাকে অনেক দুর নিয়ে গেছে। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক। 

বিবাহ

 তঞ্চঙ্গ্যাদের বিয়ে সাধারণত দুই রকেমের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ‘দাবারা’ বিয়ে মানে পালিয়ে বিয়ে করা আর অন্যটি হচ্ছে ‘সাঙা’ করে বিয়ে করা মানে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা। এই দাবারা বা সাঙা বিয়ে অনেকটা পরিবারের আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। বর্তমান সময়ে সাঙা করে বিয়ে হলেও আগেকার দিনে বেশীর ভাগ বিয়ে হতো দাবারা করে। তখন এই বিয়েটা পালিয়ে এমনভাবে হতো পরিবারের কোন সদস্য জানতো না। শুধুমাত্র মেয়ের কিছু সঙ্গী-সাথী ছাড়া। পরের দিন জামাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু মুরুব্বী এসে বলতো আমরা তোমাদের মেয়েকে বিয়ে নিয়ে গেছি তোমরা কোন চিন্তা করো না। তখন জামাইয়ের পক্ষ থেকে চুরি করে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে ক্ষতিপূরণ হিসেবে শুকর দিতে হতো। বিয়ের এক সপ্তাহ পর জামাই তার নতুন বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো মিষ্টি-জিলাপী, বিনি পিঠা, সাইন্যা পিঠা, নারিকেলসহ নানা খাদ্য উপকরণ। এই ভাবে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে দুইবার বেড়াতে আসতে হতো। প্রথম বেড়াকে বলা হতো ‘জোড় পুরায় দে-না’ বা জোড় বেঁধে দেওয়া আর দ্বিতীয় বেড়ানকে বলে দ্বিতীয় বেড়া। তঞ্চঙ্গ্যারা মামাতো বোন, মাসিতো বোন এবং দুর-সম্পর্কের ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে। তবে ‘বড় কুদুম’ বা মাতৃতুল্য(মাসি, ফিসি) বিয়ে করা যায় না এবং এটি সামাজিক এবং নীতি বিরোধী। আর আপন ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে সামাজিক নীতি বিরোধী। 

সামাজিক অনুষ্ঠান এবং পূজা-পার্বন

তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিষু। তার পাশাপাশি নবান্ন উৎসব, আল পালনী, চুমুলাঙ, মিত্তিনি পূজা ইত্যাদি। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষে বিষু উৎসব খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়।  তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বিষুর আনুষ্ঠানিকতা মোট তিনদিন। ফুল বিষু, মুল বিষু এবং বিষু। ফুল বিষু সময় তারা ফুল তোলে এবং ঘর সাজায়। মুল বিষু দিন তারা পাইসন রান্নার জন্য জুম থেকে সবজি খুজে নিয়ে আসে আর খাবার পানি তোলে রাখে।  বিষুর দিনে সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঘুরতে বের হয়, বড় জনকে পায়ে ধরে প্রণাম করে। গ্রামে বড়োবুড়ি থাকলে তাদের গোসলের ব্যবস্থা করে। এই বিষু দিনে প্রত্যেক বাড়িতে নানা পিঠা-পুটুলি আর নাস্তা পানি আয়োজন করা হয় এবং আপ্যায়ন করা অতিথিদেরকে। বিষু উপলক্ষে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতী মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। এবং গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় গেঙ্গুলী গানের আসর। 

বাসস্থানের ধরণ

তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐত্যিগত বাসগৃহ হচ্ছে বাঁশ এবং শন দিয়ে তৈরী মাচাংঘর। তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের একটা নিদিষ্ট ডিজাইন আছে যা প্রত্যেক গৃহস্থ অনুসরণ করে। যা সহজে দেখলে চেনা যায়। ১. মূল ঘর, ২. বারান্দা, ৩.ইচর, ৪. টংঘর। 

খেলা-ধুলা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম খেলা হচ্ছে ঘিলা খেলা এবং নাদেং খেলা। ঘিলা খেলা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের জাতীয় খেলা। বিষু উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলার আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতীরা মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। তাছাড়া টুম্বুল খেলা, দু-দু খেলা, তেদই বিচি খেলা, গয়াঙ খেলা, শামুক খেলা, গাত খেলা, সই খেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, ইচিবিচি খেলা, গাইত খেলা,কুত্তা খেলা,লু-আ লুই খেলা,কাইন বা কঞ্চি খেলা, ঢাঙগুলি খেলা, গুলিক খেলা, চি কুতকুত খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি। 

শিক্ষার হার এবং জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকদুর এগিয়েছে। তাদের শিক্ষার হার প্রায় ৭৫-৮০% এর মতো। তারা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে যোগ্যতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। আর বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এর মতো। আর সারা পৃতিবীতে ৩-৪ লক্ষ এর কাছাকাছি।  

পিঠা-পুটুলি

তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের বাড়িতে নানা পিঠা তৈরী করে। অনেক সময় নানা উৎসবকে কেন্দ্র এই পিঠা তৈরী করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা যেসব পিঠা তৈরী করে সেগুলি হল- সাইন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, আইলসি পিঠা, তেল পিঠা,মালি পিঠা(গুলিক/গাইস্যা পিঠা),কলা পিঠা, পাতি সাপ্তা ইত্যাদি পিঠা তৈরী করা হয়। তাছাড়া কইন ভাত, বিনি ভাত,মিষ্ঠান্নও তৈরী করা হয় নানা উপলক্ষ উপলক্ষে।

খাদ্যাভাসঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান খাবার হচ্ছে ভাত। এই ভাতের সাথে মাছ, মাংস (মুরগী, ছাগল, হাঁস, শুকর) তাদের প্রিয় খাবার। এর পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে ‘নাপ্পি/ছিদল’ এবং সিদ্ধ যেকোন তরকারী বা শাক-সবজি। শুটকিও তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের জঙ্গল প্রাপ্ত নানা শাক-সবজিও তাদের খুব প্রিয়। 

জন্ম এবং মৃত্যুঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে শিশু জন্মের পর সাতদিন পর্যন্ত মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরের কোন কাজ করতে দেয় না রান্না-বান্নাসহ। এটি মূলত একটি নিষেধাজ্ঞা যেখানে পরোক্ষভাবে অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সবার সহযোগিতা করা। সন্তান প্রসবের পরবর্তী কয়েকটা দিন সে যেন নিজেকে সুস্থ করে তোলার সুযোগ পায়। সাতদিন পর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাকে তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘পেলা আরি ধরানা’ বা ‘কসই পানি লনা’। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মূলত বাচ্চাকে ঘরের একজন সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া এব্ং সামাজিকভাবে স্বকৃীতি প্রদান করা হয়। 

মৃত্যুর পর তঞ্চঙ্গ্যাদের আগুনে দাহ করা হয়। এই দাহ করার স্থানকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘ছিদাখলা’ বলা হয়। আর দাহ করতে যাওয়াকে ‘মগদায় যাওয়া’ বলে। তবে দুধের বাচ্চা হলে কবর দেওয়া হয়। ছোট বাচ্চাদের কবরকে ‘পআ কবা’ বলে। মৃত্যুর পর সাতদিনের মধ্যে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করে দেওয়ার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করতে তার যেন কোন সমস্যা না হয়। তবে অনেক জায়গায় সমাজের ঘর প্রতি এক কেজি চাল এবং কিছু টাকা দেওয়ার নিয়ম প্রচলন আছে। একে তঞ্চঙ্গ্যা ‘সাত দিন্যা’ বলে। এই সময় ভিক্ষুদের আপ্যায়নসহ নানা ব্যবহার্য সামগ্রি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করে দেওয়া হয় তার স্বর্গ লাভের হেতুর জন্য। সাথে আপ্যায়ন করা হয় পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতী গোষ্ঠী এবং আত্মীয়-স্বজনকে।  

উপসংহার

অন্য দশটা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতিসত্বার মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও দেশ, সমাজ এবং জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা দেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হয়ে সবার সাথে এগিয়ে যেতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ তাদের গর্ব এবং অনুপ্রেরণা। কেননা এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক তঞ্চঙ্গ্যাও সরাসরি এবং প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহন করে দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তঞ্চঙ্গ্যারা বেঁচে থাকতে চায় অন্য দশটা সাধারণ মানুষের মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে। বেঁচে থাকতে চায় তার নিজের সংস্কৃতির স্বকীয়টাকে সাথে নিয়ে। সাথে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় সামনে দিকে মায়ের মতো ভালোবেসে।  

রাধামন-ধনপদি পালাঃ প্রেম এবং প্রকৃতি

কর্মধন তন্চংগ্যা

ভূমিকাঃ

রাধামন ধনপদির পালাতে ব্যক্তির প্রনয়-বিরহ এর পাশাপাশি সমন্ধয় ঘটেছে দেশপ্রেম, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের। আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য একই উপাদনে সংমিশ্রণ রয়েছে এই সৃষ্টি কর্মে। তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা পৌরানিক ইতিহাসে বেশ কিছু পালা (উপাখ্যান) আছে। যে উপখ্যানগুলি দেশ,কাল, সামাজিক জীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। এই উপখ্যানগুলির রচয়িতাদের সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এর কাহিনী এবং বিষয়বস্তু কালে কালে ছুয়ে গেছে দেশ,কাল,জাতি ও সমাজকে। বিশেষ করে গেঙগুলীদের কন্ঠে বেহেলার সুরে এই পালাগুলি যখন পরিবেশিত হয় তখন ব্যক্তি আর তার মধ্যে থাকে না সে ফিরে যায় শত বছর আগে আপন জনের ফেলে আসা স্মৃতির মধ্যে। চাদিগাঙ, জুম কাবা, রান্যা বেড়া, ফুল পারা ও রাধামন-ধনপদি পালাগুলি হচ্ছে অন্যতম। আমরা ইতিহাসে দেখি রাজা বিজয়গিরির সেনাপতি হচ্ছেন রাধামন আর রাধামনের সহধর্মিনী হচ্ছেন ধনপদি। 

রাধামন-ধনপদি পালা পৌরানিক সাহিত্য ইতিহাসে তেমনি একটি ঐতিহাসিক প্রনয়োখ্যান। উক্ত উপাখ্যানে তারা নায়ক-নায়িকা, পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা দেখতে পাই। রাধামন এখানে বীর যোদ্ধা, সেনাপতি, বলবান, বীর্যবান, রূপবান এবং আর্দশবান একজন পতি। স্ত্রীর আকুল ভালোসাকেও যত্নে পাশে রেখে দেন,স্বযত্নে মাতৃভূমিকে রক্ষা এবং বিপদে প্রতিবেশী বা বন্ধুকে সাহায্য করাই যেন তার ব্রত নিয়ে। আর ধনপতি পতিভুক্তি একজন সতী  নারী, যেখানে স্বামীর মঙ্গলই তার একমাত্র কামনা। তারা চম্পক নগরের নরপতি সাদেংগিরির কন্যাদ্বয় মেনকা এবং কপতি’র পুত্র এবং কন্যা সন্তান। মেনকার-জয়মঙ্গলের গর্ভে জন্ম নিল রাধামন আর কপতি-নিলগিরির গর্ভে জন্ম নিল ধনপতি। রাধামন এবং ধনপতির শৈশব কৈশোর কেটেছে হেলেদুলে হাসি আনন্দে, রাঙাপুতুল খেলে, সুশীতল স্নীন্ধ ঘন ছায়াতল। জুমের ফুলপথে ঘুরে ফিরে আর দল বেঁধে জুম ঘরে বসে হাসি খেলে দিনগুলি অতিবাহিত হতো। তারা যুবক যুবতীরা মিলে জুমে নানা তরকারী খুজঁতে যেতো। বিষু দিন হলেতো কথাই নেই। পাইসনের জন্য যুবক-যুবতীরা দল বেধেঁ জুমে যেত তরকারী খুজঁতে। জুম থেকে নিয়ে আসতো মা শমোই, কুরাঙা শমই,মারফা, জুম্ম্যা বেগুন, জুম কুমড়াসহ নানা তরকারী। আর বাড়িতে ফিরার সময় নিয়ে আসতো জু-ম ফুলের গাছ। তারা এসে এটি রোপন করতো ছড়ার কোন বড় মরঙের (প্রকৃতি সৃষ্ট বড় কোয়া) পাশে। আর প্রার্থনা করতো তারা যেমন জীবন এইভাবে হেসেখেলে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। আর সাথে ছিল সবুজ গাছের সারি ও জঙ্গল আর নানা রকম ফল-ফলালি, পাখির কলকাকলী এবং আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । 

রাধামন এবং ধনপদির যৌবনের প্রথম বসন্ত কেটেছে সৌরভিত ফুল বনে। তাদের প্রেম-ভালোবাসা দেখে বসুন্ধরা হেসে উঠে আপন মনে। বসন্তের কোকিলও গেয়ে উঠেছে গান আপন মনে। ফাগুনের নব হিলোলে তাদের প্রাণে জাগে নব শিহরণ। ধনপতি শুরু থেকে নানাভাবে রাধামনকে ভালোবাসার কথা জানান দিলেও রাধামন ধনপতির ভালোবাসাকে সেভাবে গ্রহন করতে চাইনি প্রকৃতির নিয়মে। সে রাধামনকে পাওয়ার জন্য কুমারী বয়সে শ্রীবুদ্ধ চরণে পূজা দিবে মানস করে রেখেছে। ধনপদি রাধামনকে যখন তার ভালোবাসার কথা জানায় তখন প্রকৃতিও যেন খুশীতে ভরে উঠেছে তবু রাধামন বিনয়ের সাথে বলেছে সমাজের নানা বাধাঁধরা নিয়ম আছে। রাধামনের কথা শুনে ধনপতি বলেছেন- আমি মানিনা এইসব বাধাঁধরা নিয়ম কানুন। তিনি রাধামনকে মিনতি করে বলেছেন- 

                “তব পায়ে এ মিনতি মম, 

                  আশা তুমি করহে পূরণ, 

                  দাসী হয়ে চিরদিন সেবিব জীবনে তব দু’চরণ”। 

ধনপদি- চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাদের ধর্ম সাক্ষী রেখে আরো বলে- 

                 ‘তুমি বিনে পতি নাই নিজে আমিত্য জীব জীবন, 

                  তোমায় চরণ বিনে কিছুই নাই মম’। 

ধনপদির কথা শুনে রাধামনের মন গলে যায়। তখন রাধামন বলে- 

                 ‘ধর্ম সাক্ষী করে আজ হতে তুমি মম ধর্ম পত্নী হলে,

                  মানবের সত্যধর্ম বিনা নাই কিছু এই মহীতলে, 

                  সত্যের মহিমা সতী নারী নাম ভবে রবে চিরদিন”। 

শেষ পর্যন্ত রাধামন ধনপদির পবিত্র প্রেমে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। এরপর তারা প্রেমের সাগরে ভাসতে থাকে। একে অপরকে দাদা এবং বোন হিসেবে সম্বোধন করলেও রাধামন আদর করে ধনপদিকে ডাকেন ‘প্রাণেশ্বরী, ওগো সতি, সুব দনি’ হিসেবে আর ধনপদি স্বামীকে আদর করে ডাকে ‘প্রাণ নাথ, প্রাণেশ্বর’ হিসেবে। সে স্বামীকে খুব বেশী ভালোবাসে এবং স্বামীর মঙ্গল কামনা করে শয়নে স্বপনে সাথে স্বামীর আপদে বিপদে সবসময় মঙ্গল কামনা করেছে। 

এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে ধনপদি মাঝে মধ্যে রাধামন কাছে নানা কিছু আবদার করে বসত। সেরকম একদিন ধনপদি নদীতে গোসল করতে গিয়ে দেখল সুন্দর একটি ফুল নদীর পানিতে ভেসে আসছে। সে ফুলের গন্ধ কি মনোরম। এই পর্যন্ত যতগুলো ফুল সে দেখেছে এবং গন্ধ নিয়েছে এই ফুলটির কাছাকাছি কোনটি নয়। ফুলটি তুলে নিয়ে তার মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল- মা এটি কিসের ফুল। মা বলল এটি ‘দেব নাগেশ্বর ফুল’। ধনপতি আরো জিজ্ঞেস করল এই ফুল কোথায় পাওয়া যায় ? মা বলল- উজানে গাঙে ইরাবতী নদীর (এটি মায়ানমারের একটি নদী) তীরে শৈলগিরি কাননে এই ফুল ফোটে। মা আরো বলল- অলি মধু খেয়ে এই ফুল নদীতে ফেলে দিয়েছে। ধনপদি তখন মনে মনে ভাবতে থাকল সদ্য ফোটা এই ফুল যে কি সুন্দর হবে। তখন তার মনে বাসনা জাগে সদ্য ফোটা এই দেব নাগেশ্বর ফুলটি একদিন দেখবে এবং দাদা রাধামনকে সে তার মনের বাসনা কথা জানাবে। একদিন বাসন্তী পূর্ণিমার শুভ্র রাতে সে তার মনের কথা রাধামনকে বলছে, ধনপতি ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্নগুলি দেখছে। একটু একটু শীতল আমেজতা আলোর ছলকানি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে দিনমনি পূর্বাকাশে জ্বল জ্বল করে উঠেছে। 

বছর শেষ বাসন্তী পূর্ণিমা তিথি। ধনপতি ঠিক করল বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামনকে তার বাসনার কথা জানিয়ে দেবে। এই বাসন্তী উৎসবে সবাই নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা নিয়ে। সেসময় রাধামন-ধনপতির মতো প্রেমিক যুগল; কুঞ্জবী-কুঞ্জুধন, নিলংবী-নিলংধন, মেয়াবী-মেয়াধন, কানেকবী-কানেকধন সবাই মিলে ঘিলা খেলা খেলবে বলে ঠিক করল। বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামন আর ধনপদি দেব নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইরাবতী নদীতে চলে যায়। তারা বনে গিয়ে দেখে অতি উচ্চ ডালে এই ফুলগুলি ফুটে আছে। সে মনে মনে ভাবে এই ফুল নিতে হলে অবশ্যই বৃক্ষ দেবতার আর্শীবাদ লাগবে। এই দিকে রাধামন যখন দেব নাগেশ্বর ফুল নেওয়ার জন্য লতাগুলিকে বাশেঁর মতো করে বেঁধে তৈরী করতে লাগল তখন ধনপদি বলল যে, আমি এই অন্ধকারে কিভাবে নিচে একা থাকব। তাছাড়া তখন এই ইরাবতী নদীর বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্য হাতি, ভলুক, বাঘ, নেকড়ে আরো অনেক বন্যপ্রাণী। ধনপদির বিপদের কথা ভেবে রাধামন জলের উপর এটা জলটংগি মাচাং তৈরী করে দেয় এবং ধনপতিকে নিজের কাঁধেতুলে সে জলটংগীতে তুলে দেয়। যেন ধনপতি নির্ভয়ে থাকতে পারে। সে যখন ফুলের জন্য বৃক্ষ শাখায় উঠে হঠাৎ আগে দেখা ফুলগুলি অদৃশ্য হয়ে গেল, দুরের শাখায় মাত্র একজোড়া ফুল দেখা যাচ্ছে। রাধামন বুঝতে পারে বৃক্ষ দেবতা ফুলগুলি অদৃশ্য করে রেখেছে। পরক্ষণে রাধামন লক্ষ্য করেছে বৃক্ষ দেবতা তাকে বাঘের ছায়া হয়ে ভয় দেখাচ্ছে। এতে রাধামন ভয় পেয়ে গাছ থেকে ভূতলে পড়ে গিয়ে মূর্ছা গেল। ধনপতি হঠাৎ লক্ষ্য করল কি যেন একটা নিচে পড়ে গেল এবং শব্দ হল। চেয়ে দেখল রাধামন নিচে পড়ে গিয়ে মূর্ছা যায়। মূর্ছা পাওয়া রাধামনকে ধনপতি কোলে তুলে নিয়ে খাদির আচল দিয়ে মুখ মুছে দেয় এবং রাধামনকে ডাকতে থোকে প্রাণেশ্বর, প্রাণেশ্বর বলে। রাধামনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ধনপতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শোকাকুল হয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্বরণ করে বলে- প্রভু দাও হে আমায় কুল। তখনও বৃক্ষ দেবতা নানাভাবে ধনপতিকে ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাঘের গর্জনে, মাঝে কালান্তর সাপ হয়ে, আর মাঝে মধ্যে বৃহৎ হস্তি রূপে ধনপতিকে বৃক্ষ দেবতা ভয় দেখাচ্ছে। এদিকে ধনপতির আকুল ক্রন্দনে এবং শোকে দেহ মন হয়ে গেছে মলিন কারণ তার জীবনের সাথী পড়ে আছে অচেতন হয়ে। তবু এ ঘোর বিপদে ধনপতি ভগবানকে ডাকে বারে বারে। ধনপতি বলে আমি যদি সতী নারী হয়ে থাকি তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। ধনপতি কথা শুনে বৃক্ষ দেবতা হাজির হয়ে সঞ্জিবনী মন্ত্র পাঠ করে রাধামন আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সে সুস্থ হয়ে দেখে ধনপতি কোলে তার মাথা। তখন রাধামন শুনতে পেল- আকাশ ও ভূমি বাসীদেব নাগ যক্ষ মহা ঋদ্ধি মান,রক্ষে সদা সতী নারী ধার্মিক সুজন পূন্যবান। 

প্রেম-ভালোবাসা আর রাগ-অনুরাগের এবং মান-অভিমানের মধ্যে দিয়ে রাধামন ধনপদির ভালোবাসা পূন্যতা পায় তাদের শুভ পরিনয়ের মধ্য দিয়ে। রাধামন ধনপদির বিয়ের সমস্ত কিছু আয়োজন করল রাজ পুরোহিত ছলারবাপ। যিনি রাজ দরবারে শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল এবং নানাবিধ পূজা-আর্চনা করে থাকেন। রাধামন-ধনপতি যাকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। ছলারবাপও তাদের নাতি-নাতনি বলে যথেষ্ট আদর স্নেহ করেন। একদিন রাধামন-ধনপদি ছলারবাপের কাছে গিয়ে বলে দাদু আমাদের বিয়ের চুমুলাঙ আপনাকে করে দিতে হবে। ছলারবাপ তখন বলে, দাদু-দিদি ভাই আমি বুড়ো মানুষ কিভাবে আমি তোমাদের চুমুলাঙ করে দিব আমিতো হাটতে তেমন পারি না। রাধামন-ধনপদি তবু ছলারবাপকে অনুরোধ করতে লাগল- তাদের বিয়ের চুমুলাঙ করে দিতে। অনেক অনুরোধের পর ছলারবাপ রাজী হয়ে গেল। তখন রাধামন-ধনপদি বলল, দাদু তাহলে তুমি আমাদের বিবাহ জীবন কেমন হবে রাত্রে নিশাদেবীকে স্বরণে বিজ্ঞেস করবে। ছলারবাপ বলল ঠিক আছে। পরদিন ছলারবাপ রাধামন ধনপদির বিয়ের চুমুলাঙ করে দিল। এখানে একটি বিষয় উলে­খ্য যে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এখনো বিয়ের পর চুমুলাঙ করে নতুন বউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ঘরে তোলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের চুমুলাঙ করে দেওয়ার পর ছলারবাপ তাদের মন ভরে আর্শীবাদ করল এবং বলল আর্শীবাদ করছি- তোমাদের দাম্পত্য জীবন মঙ্গলময়, সুখময় এবং মধুর হউক। তোমরা নিরাময় র্দীঘ জীবন এবং তোমাদের যথা ইচ্ছা পূর্ণ হউক আর তোমাদের ঘরে লাল টুকটুকে এক বীর সন্তান আসুক। চুমুলাঙ শেষে রাধামন তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল দাদু রাত্রে তুমি নিশাদেবী দর্শন করে কি দেখলে ? তখন ছলারবাপ বলল, না অমঙ্গল কিছুই দেখিনি, তবে। তবে মানে কি দাদু রাধামন জিজ্ঞেস করল। তাহলে মন দিয়ে শুন দাদা-দিদি আমার স্বপ্নের বিবরণ। আমি গতরাত্রে নিশাদেবী স্বরণ করে ঘুমিয়ে পড়ি, প্রথম প্রহরে স্বপ্ন দেখলাম- আমি চৌদ্দ ডিঙা সেজে নানাবিধ পন্যদ্রব্য নিয়ে উজান গাঙে পাল তোলে চলেছি। অনেকদুর এগিয়ে নানা ফুল-ফল ও পশু-পক্ষী পরিপূর্ণ এক সুবিশাল ছায়াশীতল বটবৃক্ষে নিচে বিশ্রাম করেতেছি। এমন সময় ঘুম ভেঙে যায়। তারপর দাদু কি হলো উভয়ে প্রশ্ন করলো। তারপর ছলারবাপ বলল- আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ে নিশাদেবী স্বপ্ন দর্শন দেওয়ার অনুরোধ করলে তখন দেখলাম- পূর্ব দিকে উঠেছে এক ধুমকেতু নক্ষত্র তারা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে দেখি পূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে। স্বপ্নের অর্থ কি হবে জিজ্ঞেস করলে ছলারবাপ বলল- উজান গাঙে অর্থ হচ্ছে- তোমাদের দাম্পত্য জীবন উজান দিকে চলবে মানে সুখের হবে। ছায়া শীতল বট বৃক্ষ অর্থ হচ্ছে তোমাদের একটা সুপুত্র জন্মাবে বৃদ্ধ বয়সে সেই পুত্রের আশ্রয়ে সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। আর দ্বিতীয় স্বপ্ন পূর্ব দিকে যে ধুমুকেতৃ তারা দেখেছিলাম তার অর্থ হচ্ছে- একসময় দেশে যুদ্ধের ধামাকা বেজে উঠবে। তারপর রাধামন প্রশ্ন করে তাই যদি হয় দাদু তাহলে কি আমায় যুদ্ধে যেতে হবে ? তার দাদু বলল- দেশে যদি যুদ্ধের ডাক এসে যায় তাহলে কি তুমি নীরব থাকতে পারবে ? এভাবে সুখ দুঃখের স্বপ্ন দর্শন নিয়ে তারা সংসার শুরু করতে লাগল। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, তন্চংগ্যা সমাজে অনেকে তাদের শুভ কাজ শুরু করার আগে এরকম শুভ-অশুভ স্বপ্ন দর্শন চাওয়া হয়। 

একদিন রাজ সভা থেকে খবর এল যুদ্ধে যেতে হবে। পার্শ্ববর্তী রাজা উদয়রাজ তার রাজ্যে পূর্ব দিকের জংলী কুকীরাজ কালাঞ্জয়, দক্ষিণ দিকের রোয়াঙ্গের মঙ্গলরাজা আর সমুদ্র কুলের জল দস্যুরা দিবালোকে এসে নরহত্যা নারী নির্যাতন করছে। আজ তার রাজ্যবাসীরা গৃহহারা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিত্র চম্পক রাজার (উদয় গিরি) থেকে সাহায্য চেয়েছেন। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, এরই মধ্যে রাধামন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যুবরাজ বিজয়গিরির সেনাপতি হিসেবে যোগদান করেছেন। একদিন বিজয়গিরি রাধামনকে ডেকে বলল- শুন, প্রিয়সখা- উদয়পুর রাজ্য আজ দস্যু কবলিত, পিতা আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, তুমিও যাবে আমার সাথে সেনাপতি হিসেবে। প্রতি উত্তরে রাধামন বলল- যুবরাজ, তুমি মম সখা, তুমি যা আদেশ করবে আমি তা পালন করতে বাধ্য। তিনি আরো বললেন- বীরধর্ম্মো হলো বিপনকে প্রাণপনে রক্ষা করতে হবে যুদ্ধ করে। এইদিকে যুদ্ধের কথা শুনে ধনপদির মন অস্থির এবং চঞ্চল হয়ে উঠল, তবু সে কিন্তু তার স্বামীকে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল না। এখানে দেশপ্রেম এবং পতিভক্ত সমতালে। তবু স্বামী বলে কথা, এই চিন্তা থেকে সে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে,বলে- 

“শুন ওগো স্বামী ! গভীর নিশীতে দেখেছি স্বপন,

অতীব ভীষণ- কাঁপে ভয়ে মম প্রাণ,

সে স্বপ্ন স্মরি। ভাগ্যে মোর কিবা আছে জানি না।”

রাধামন বলল কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি আমাকে খুলে বলো না, কি ভীষণ স্বপ্ন করিলে দর্শন কেন ভয় পেলে মনে। ধনপতি বলল তাহলে শুন মোর প্রাণনাথ !

“গেরিয়া স্বপন ভীত মম প্রাণ, রহে যেন প্রলয় পবন,

কাপায়ে ধরণীতল,কক্ষচ্যুত তারকা মন্ডল, 

রাজদন্ড উড়ে মহাশূন্যে, তুমি নাই পাশে মম, 

তাই একাকিনী আমি, চেয়ে থাকি শূন্য পানে, বসে একা শূণ্য ঘরে।”

ধনপদি আরো বলে স্বপ্ন দেখে রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল তখন শুনলাম- নানা পশু-পাখি ডাকিতেছে। পাখি ভীমরাজ ডাকছে গগন বিদারী করুন স্বরে। আরো শুনলাম টিয়া পাখি ঝাক উড়ে যাচ্ছে, বিকট শব্দে বানর-বানরী ডাকছে, স্বশব্দে পালিয়ে যায় হরিণ-হরিণী। ঘুঘু ডাকছে আম ডালে বসে। এমন নিশীথ রাতে পশু-পক্ষী দিশেহারা হয়ে কেন আর্তনাদ করছে। জিজ্ঞেস করে ধনপদি তার স্বামী রাধামন থেকে। রাধামন বলে দুর কর মনের গতি। রাধামন বলে ত্রেতা যুগে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাবন এবং রামের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় আর দ্বাপর যুগে কুরু ও পান্ডবে যখন যুদ্ধ হয় তখনও নিশীথে লোকে পশু-পক্ষীর ডাক শুনেছে। কই তখনতো কোন অধর্মের জয় হয়নি, ন্যায় ধর্মের এবং সত্যের জয় হয়েছে। তুমি জেনে রাখো কোন অমঙ্গল হবে না আমাদের। বীরের রমনী তুমি, হাসি-মুখে আমাকে বিদায় দিতে হবে তোমাকে। তুমি মনে রাখবে সতীর পতি হয় না পরাজয় কখনো। রাধামন আরো বলে কোন চিন্তা তুমি করো না দেব ধর্ম থাকিবে সহায় আমাদের সাথে। সত্য যদি হয় তুমি সতী নারী তাহলে শক্রর সাথে রণে আমি অবশ্যই জয়ী হবো। ধনপদি বললো- তুমি অবশ্যই যুদ্ধে জয়ী হবে, আমি এই প্রার্থনা করি শ্রী ভগবান বুদ্ধের কাছে। ধনপদি আরো বলল-তুমি যেদিন জয়ী হয়ে ফিরবে সেদিন দুজনে মিলে বুদ্ধের চরণ তলে পূজা দেব, তা আমি মানস করে রাখবো। ধনপদি স্বামীকে বলে- মিনতি তোমার চরণে তুমি দিগি¦জয় হয়ে ফিরে আসবে, আমি তৃষিত হরিণীর মতো তোমার পথের পানে চেয়ে থাকব। রাধামন বলে প্রাণেশ্বরী তুমি চিন্তা করো না- রণে স্থলে সর্ব ক্ষেত্রে তোমার চাঁদ মুখখানি আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে। 

রাধামন একদিকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অন্যদিকে ধনপদির মন চঞ্চল হয়ে উঠছে তার স্বামীর জন্য। স্বামীর মঙ্গল কামনার জন্য তার কত না মানস, কত না নানা আয়োজন। তারই অংশ হিসেবে- সে তার স্বামীকে যুদ্ধে যাত্রার আগে সতীত্ব নির্দশন হিসেবে নিজ হাতে বুনা একটি কোমড় বন্ধনী স্বামীকে উপহার দেয়। যে কাপড়টি সে একদিনে সুতা কেটে একদিনের মধ্যে তৈরী করেছে। ধনপদি তার স্বামীকে বলে- এই কোমড় বন্ধনি পড়ে যুদ্ধ করলে তুমি অবশ্যই জয়ী হবে। রণ সম্মুখে শত্র“ পরাজিত হবে। ইতিহাসে জনশ্রুতি আছে রাধামন এই কোমড় বন্ধনী পড়ে যুদ্ধে জয়ী হয়। এখানে ইতিহাসের একটি বিষয় উলেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যে পাঁচটি কাপড় পরিধান করেন (পিনন, খাদি, সালুম, মাদা কাবং,পা-দুরি) তার মধ্যে পা-দুরি (কোমড় বন্ধনি) অন্যতম। এই পা-দুরিই হচ্ছে ধনপতির সতীত্ব নির্দশন কোমড় বন্ধনি। এই কোমড় বন্ধনির বিশেষত হচ্ছে পরনের কাপড়কে শক্ত করে আটকে রাখা যেন কোন ভাবে বা কর্মে খুলে না যায়। এই পা-দুরি বা কোমড় বন্ধনী তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যখন কাপড় পরেন বিশেষ করে পিনন পরেন তখন একে  গায়ের বা কোমড়ের সাথে শক্ত ভাবে আটকে রাখার একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যেন কাপড় শরীর থেকে কাপড়টি খসে না পড়ে। যেটি অন্য আদিবাসী মেয়েরা পড়ে না। ধনপদির কোমড় বন্ধনীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্র পা-দুরি‘র কোন ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে কিনা। তাছাড়া ব্যক্তি রাধামন-ধনপতির মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি তাদের ইতিহাসের সুখ স্মৃতি অনুভব করে। যেটি ইতিহাসের পাঠ্য বা গবেষণার বিষয় হতে পারে। 

উপসংহারঃ আদিবাসী সাহিত্যে রাধামন-ধনপতির মতো আরো অনেক পৌরানিক সাহিত্য বা পালা রয়েছে যেগুলি সাহিত্য প্রেমিদের আন্দোলিত করে তুলে। এই উপকরণগুলি ‘সাহিত্য রস’ আস্বাদনে এখনো অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে সবার অগোচরে। এগুলিকে তুলে এনে যত্ন করতে হবে রত্ন পাওয়ার জন্য। তখন আদিবাসী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও নতুন মাত্রা বা প্রাণ পাবে। 

তথ্যসূত্রঃ

১.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাধামন ধনপদি কাব্য। 

২.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়গিরি(নাটক)