তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : বাঘ ও শূকরের মিতালী

লেখক : বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

বনে নানা প্রজাতির পশু-পাখি বাস করে। কোন পশু মাংসভোজী, আর কোন কোন পশু তৃণভোজী। পাখিরা সাধারণতঃ শস্য, ফল, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মাংসভোজী পশুরা খুব হিংস্র হয়ে থাকে।

অপর দিকে তৃণভোজী পশুরা নিরীহ প্রকৃতির হয়ে থাকে। তৃণভোজী পশুদের মাংস খেয়েই মাংসভোজী পশুরা জীবনধারণ করে। তাই তৃণভোজী পশুদের উপর তারা বরাবরই চড়াও হয়। তারা আবার স্বজাতীয় পশুদের মাংসও বাদ দেয়না।

একে অপরকে মেরে মনের সুখে মাংস ভক্ষণ করে উদর পূর্তি করে। তৃণভোজী পশুরা তাই সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে বিচরণ করে থাকে। কোথাও কোন হিংস্র পশু ওঁৎ পেতে আছে কি-না সে জন্য তাদের সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়।

তাই স্বভাবই তারা চঞ্চল। পাখিরা মাটিতে বিচরণ করলেও তাদের ডানা থাকাতে কোন হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে তারা সহজে আত্মরক্ষা করতে পারে।

সে জন্য তারা অনেকটা নির্ভয়ে বাস করে। গাছের ডালে উড়ে বেড়ায়, কলকাকলী করে। তাদের কল কাকলী শুনে মনে হয় তারা কতই সুখী।

শত শত প্রজাতির পশু-পাখিদের অরণ্যে আইন শৃঙ্খলাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ আলাদা। অরণ্যের আইন নিতান্তই বন্য। যেখানে তৃণভূমি আছে কিংবা তৃণভোজী হরিণ, চঙরা, (সম্বর) শূকর, খরগোশ প্রভৃতি বিচরণ করে, তার কাছাকাছিই চুপিসারে বিচরণ করে হিংস্র বাঘ, সিংহ।

গণ্ডার, হাতি, বুনোমহিষ প্রভৃতি বৃহৎ জন্তুরাও সমগ্র বনাঞ্চলে বিচরণ করে থাকে। বাঘ-সিংহরা তাদের যেমন কিছু করতে পারে না, তাদের ধারে কাছেও যায় না। এদের মধ্যে ধূর্ত বুদ্ধির অধিকারী পশু হল শিয়াল।

হরিণ, শূকর প্রভৃতি তৃণভোজী পশু শিকার করা তার সাধ্যের বাইরে। শিয়ালও মাংসভোজী প্রাণী। সে বাঘ আর সিংহের পিছনে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে খুব সতর্ক হয়ে বিচরণ করে। যখন কোন হরিণ, সম্বর, শূকর মারা যায়, তখন মৃত পশুর একাংশ বাগিয়ে নেবার তালে থাকে।

অনেক সময় বেকায়দার ফলে হিংস্র পশুর থাবার শিয়ালকে অহেতুক প্রাণ হারাতে হয়। এ হল বেচারা শিয়ালের অবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য ধূর্ত বুদ্ধির আশ্রয় নেয়া ছাড়া তার কোন গত্যন্তর নেই।

গভীর অরণ্য ছেড়ে শিয়াল লোকালয়ের কাছে থাকা অধিক পছন্দ করে। সে লোকালয়ে একটু চেষ্টা করলেই গৃহপালিত হাঁস, মুরগী শিকার করতে পারে। বন মোরগ কিংবা অন্য পাখি শিকার করা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

পাখিদের মধ্যে পেঁচার একটু বিশেষত্ব আছে। পেঁচার চোখের পাতা নেই। তার চোখে পলক পড়ে না। অপলক নেত্রে সে আলো সহ্য করতে পারে না। তাই দিনের বেলায় সূর্য্যর আলো থেকে বাঁচার জন্য পেঁচা ঝোপের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকে অথবা ঘুমায়।

রাতের বেলাতেই সে চরে বেড়ায়, খাদ্য আহরণ করে। সারা রাত কুল-কুলায়। কিন্তু সকাল হলে ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য একটি চাকমা প্রবাদ আছে, সারা রাত পেঁচায় কুল-কুলায় খুরোল্যা (কাঠ ঠোকরা) সনার তুন (সোনার মুকুট) পায়।

তবে পেঁচাও ধূর্ত কম নয় বরঞ্চ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। সে যখন জেগে থাকে তখন চুপ করে থাকে। রাতে যখন গাছের ঝোপে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন শব্দ করে।

“পুকজুক পেদরললত পুক জুক পেদরললত, পুক জুক পেদরললত” তখন শিকারী নিশাচর বনবিড়াল মনে করে, পেঁচা বেটা তার আহরণ করা পোকা আরাম করে খাচ্ছে। তাই বনবিড়াল সে দিকে যায় না আর পেঁচাও নিরাপদে ঘুমায়।

সমগ্র বনাঞ্চল সিংহই হল অঘোষিত সম্রাট। হাতি, গন্ডার, বুনোমহিষ প্রকান্ড শরীরের অধিকারী হলেও অন্য পশুদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রকান্ড শরীরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য অহরহ খাদ্য অন্বেষণ করতে হয় তাদের।

অন্য কিছু করার বা ভাববার সময় তাদের নেই। সিংহ হিংস্র এবং শক্তিশালী। একটি হরিণ বা শূকর মারতে পারলে তার বেশ ক’দিন চলে যায়। নানা চিন্তা ভাবনা করার সময় তার আছে।

তার মূর্তি ও শক্তিমত্তা দেখে অন্যান্য পশু-পাখিরা তাকে সমীহ করে এবং এ সুযোগে সে নিজেকে সমগ্র বনাঞ্চলের সম্রাট বলে জাহির করে।

বন্য পশু-পাখিদের একটি সার্বজনীন প্রকৃতির ভাষা আছে। এটি সকলেই বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী ধ্বনিও উচ্চারণ করতে পারে। এটি তাদের লিংগুয়াফ্রাংকাই। এ লিংগুয়াফ্রাংকাই অরণ্য অঞ্চলের ভাষা।

এ লিংগুয়াফ্রাংকা দিয়েই অরণ্য সম্রাট সিংহ তার শাসন পরিচালনা করে। মানব সমাজে যেমন অন্যায়-অবিচার, অঘটন ঘটে এবং সেসবের বিচার হয়ে অপরাধীর শাস্তি ধার্য করা হয়।

পশু–পাখিদের মধ্যেও সে রকম অন্যায়, অবিচার, অঘটন সংঘটিত হয় এবং সেসবেরও বিচার করার উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হয়। দুর্বলেরা সিংহের নিকট তাদের প্রতি কৃত অন্যায়-অবিচারের বিচার প্রার্থী হয়।

সিংহ তার সভাসদের পরামর্শে বিচার নিষ্পত্তি করে। সেরকম একটি ঘটনা এখনও অরণ্য অঞ্চলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ঘটনাটি বা ঘটনার কাহিনী এখন মানব সমাজে রূপ কাহিনী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

একদা কোন এক গভীর অরণ্যে এক শিকারির গুলির আঘাতে এক বাঘিনী তার শিশু শাবক রেখে মারা যায়। মাতৃহারা শাবকটি অসহায়ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করার সময় সদ্য প্রসূতি হওয়া এক শূকরীর নজরে পড়ে।

শূকরীর একটি মাত্র শাবক। অসহায় ব্যাঘ্র শাবকটির প্রতি করুণা পরবশ হয়ে শূকরী ব্যাঘ্র শাবককে আপন শাবকের ন্যায় স্নেহের সাথে নিজের দুধ পান করিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এবং লালন পালন করতে থাকে।

ব্যাঘ্র শাবকটি দু’এক মাস শূকরীর দুধ পান করলেও তার জাতিগত স্বভাব অনুযায়ী ধীরে ধীরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী শিকার করতে আরম্ভ করে। ইতোমধ্যে শুকরছানা আর ব্যাঘ্র শাবকটির মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

এভাবে তারা বড় হতে থাকে এবং স্ব স্ব জাতিগত স্বভাব লাভ করে। এক সময় শূকরছানাটি তার মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাঘ্র শাবকের সঙ্গে বন হতে বনান্তরে বিচরণ করে জীবনযাপন করতে লাগল। উভয়ের মধ্যে যে প্রগাঢ় হৃদ্যতা তা বলাই বাহুল্য।

ব্যাঘ্র মাংসভোজী হিংস্র পশু। বনাঞ্চলে সিংহের পরেই তার স্থান। ব্যাঘ্র শাবকটি সারাদিন বন্য পশু শিকার করে আর শূকর ছানাটি শস্য ক্ষেত এবং তৃণভূমিতে বিচরণ করে সন্ধ্যায় দুই বন্ধু একত্রিত হয়ে এক জায়গায় রাত কাটায়।

এভাবে উভয়ে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে পরিপূর্ণ বাঘ আর শূকরে পরিণত হল। বাঘটি শক্তিশালী হিংস্র শিকারি পশু এবং শুকরটি চর্বি জমে মোটাসোটা, নাদুস নুদুস হয়ে এক লোভনীয় জন্তুতে পরিণত হল। শূকর দুর্বল প্রাণী।

অন্ততঃ বাঘের কাছেতো বটেই। প্রথম প্রথম সে বাঘটিকে সমশ্রেণী বা সমগোত্রীয় মনে করত। কিন্তু একদিন যখন দেখল বাঘটি তার সামনেই তাদের সমগোত্রীয় একটা শূকরের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে ফেলল এবং উল্লাস সহকারে মাংস ভক্ষণ করল, তখনই সে বুঝতে পারলো বাঘ তাদের সমগোত্রীয় নয়। কিন্তু তখনও বোধহয় হয়নি যে, সেও বাঘের ভোগ্য জন্তুতে পতিত হতে পারে।

একদিন বাঘ সারাদিন কোন শিকার জোটাতে না পেরে সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শূকরটি এ অবস্থায় চিন্তিত হয়ে তার পাশে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করল। বাঘ আরো গম্ভীর হল এবং এক সময় হঠাৎ এক লাফ দিয়ে শূকরের গলায় কামড় বসিয়ে দিল।

কিন্তু না, জোরে নয় অতি হালকাভাবে বাঘ কেবল শূকরকে বধ করছে–এই ভাবে অভিনয় বা ভান করল মাত্র। শূকর ভয় পেল। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে তবু সাহস করে বলল, একি বন্ধু! তুমি আমাকে এভাবে আক্রমণ করছ কেন?

তুমি কি শেষ পর্যন্ত আমাকেও হত্যা করে ফেলবে? এ কথায় বাঘ শূকরকে ছেড়ে দিল এবং লজ্জার ভান করে বলল, ছিঃ ছিঃ বন্ধু, তুমি একি বলছ? আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে, তোমার মত অকৃত্রিম বন্ধুকে হত্যা করব?

তোমার মত নাদুস নুদুস পশু ধরলেই আমার হাত থেকে পালিয়ে যায়, তাই একটু তালিম দিয়ে দেখলাম ভবিষ্যৎতে কিভাবে ধরতে হবে। নির্বোধ শূকর বাঘের এ কথায় আশ্বস্ত হল।

বাঘটির কয়েক দিন ধরে শূকরের নাদুস নুদুস শরীর দেখতে দেখতে তাজা মাংসের লোভে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে এতদিন লোভ দমন করে আসছে।

কিন্তু শূকরের কণ্ঠনালীতে কামড় বসাতে গিয়ে বাঘটির লোভ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল এবং তার পক্ষে লোভ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ল।

একদিন সকালে শূকর যখন আহার অন্বেষণে আস্তানা থেকে রওনা দিচ্ছে, বাঘ এক গাছের আড়াল থেকে এক লাফ দিয়ে শূকরের পিঠে কন্ঠনালীর দিকে মুখ নিতে নিতে বলে, বন্ধু এতদিন তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আজ কিন্তু তোমার তাজা মাংস খাব।

শূকর ভীষণ ভয় পেল। সে বাঘের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে উচ্চ লাফ দিল। আচমকা এ লাফে বাঘ নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না, শূকরের গায়ে আঁচড় কেটে মাটিতে পড়ে গেল। শুকরের গা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।

শূকর সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। একটি গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বাঘের পুনরায় সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হল। বাঘ কিন্তু আক্রমণ করল না। শুকরের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধু তুমি জাননা তুমি আমার ভক্ষ্য।

তুমি কোন বিশ্বাসে এবং কোন সাহসে ভক্ষকের সঙ্গে মিতালী কর? আমি আর তোমাকে রেহাই দেব না। তোমার পিঠ থেকে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বোধহয় বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছ।

শূকর তার দেহে বাঘের নখের আঁচড় লাগা স্থান থেকে রক্ত ঝড়তে দেখে এবার উপলব্দি করল যে, বাঘ তার সমগোত্রীয় নয় এবং যে কোন মূহুর্তে বাঘ তাকে মেরে ফেলতে পারে।

শিশুকাল থেকে সখ্যতা আছে বলে শূকর বাঘকে বন্ধুতের দোহাই দিতে থাকে এবং নম্রসুরে বলল, বন্ধু আমার মায়ের দুধ একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হয়েছি।

আমার মা তোমাকে আপন সন্তানের মত আদরযত্ন করেছে, সে কথা কি ভুলে গেছ বন্ধু? বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, কি আজেবাজে বলছ! বাঘের বাচ্চা কখনও শুকরের দুধ খায় নাকি? যাক এতদিন আমি তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আর রেহাই দেব না।

আসল কথা কি জান? আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি তোমাকে ঘাড় মটকিয়ে হত্যা করে তোমার তাজা রক্ত মাংস খাচ্ছি। স্বপ্নে আরো দেখলাম, বনের রাজা সিংহও অতি আনন্দের সঙ্গে তোমার তাজা রক্ত মাংস খেয়ে লাফাতে শুরু করেছে।

অন্য কোন কথা বলে লাভ নেই, তুমি প্রস্তুত হও, আমি আমার দেখা স্বপ্ন অনুযায়ী তোমাকে এখনই মেরে ফেলব। শূকর বুঝতে পারল বাঘটির কথায় কোন কৃত্রিমতা নেই। রূঢ় অথচ সত্যি কথাই বলছে বাঘ।

শূকর অনুনয় বিনয় করে আমতা এবং ভয় জড়িত কন্ঠে বলল, এ বনে অনেক পশু-পাখি আছে যারা এ বনেরই অপর প্রাণীর ভক্ষ্য। তথাপি বনের রাজা সিংহের শাসনাধীনে একই বনে যার যার প্রাণ রক্ষা করে বেঁচে আছে।

আমাদের সকলের রাজা সিংহ মহাশয়ের সমীপে চল, তিনি যদি বলেন, তোমার স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী তুমি আমাকে ভক্ষণ করতে পারবে, তাহলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। বন্ধুর জন্য আমার এ দেহ হাসিমুখে বিসর্জন দেব।

বাঘ জানে যে, শূকর কোনদিন তার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। সে যখন ইচ্ছা করে তখনই শুকরকে হত্যা করতে পারবে।

এও জানে যে, মহাপরাক্রমশালী পশুরাজ সিংহ অবশ্যই তার পক্ষেই রায় দেবে, স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী শূকরকে হত্যা করার নির্দেশ অবশ্যই দেবে। এসব কথা ভেবে বলল, ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে এ সুযোগ দিলাম। চল, পশুরাজ সিংহের দরবারে।

যথাসময়ে পশুরাজ সিংহের দরবারে হাজির হল তারা। পশুরাজ সিংহ শূকরকে দেখে অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করল এবং শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে তাজা রক্ত পান করার প্রবল ইচ্ছা কোন রকমে চাপা দিয়ে রাখল।

শূকর বাঘকে দেখিয়ে তার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পশুরাজ সিংহের কাছে প্রার্থনা জানাল। বাঘ কেন শূকরকে আক্রমণ করতে চায়, তা পশুরাজ জানতে চাইলে বাঘ দৃঢ় কন্ঠে তার স্বপ্নের বিবরণ পশুরাজকে খুলে বলল।

উভয়ের আর্জি শুনে সিংহ তার স্বভাবজাত কায়দায় গর্জন করে বলল, এ অরণ্য রাজ্যের ছোট, বড় প্রায় সকল পশু-পাখিই আমার দরবারে হাজির হয়েছ। শূকরের আবেদন এবং বাঘের স্বপ্নের বিবরণ সবাই শুনেছ। স্বপ্ন হল স্বর্গীয় ব্যাপার।

এটি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। বাঘ শুকরের মাংস খাচ্ছে বলে যে স্বপ্ন দেখেছে তা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশই হয়েছে। কাজেই বাঘ শূকরকে এখন খেতে পারবে। বন্য কুকুর এবং শিয়াল ভয়ে ভয়ে চাপা কন্ঠে বলল, স্বপ্নে যাহা দেখে বাস্তবে তা হয় বা হওয়া প্রয়োজন এরকম কোন নজির নেই।

অতএব বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে শূকরকে কি করে ভক্ষণ করবে তা বুঝা যায় না। পশুরাজ সিংহ রাগান্বিত হয়ে বলল, শিয়াল, কুকুর তোমারও মাংস পেলে ছাড় না………… তোমাদের মুখে এ কথা সাজে না, চুপ কর।

সিংহের গর্জনে তারা গুটিশুটি মেরে বসে রইল। হাতি তার বড় বড় কান দুটি এবং লেজটি নেড়ে সিংহের গর্জন শুনে তার শুঁড়টি উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঘের এ স্বপ্নটি অতি অদ্ভুত।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন স্বর্গীয় হবে কেন? আর সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ হলে স্বপ্নের মধ্যে শূকর মরে যেত……….. সেতো এখনো বেঁচে আছে। কাজেই এ স্বপ্নটি মিথ্যা।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন কেউ কি দেখে? তার পাশে দাঁড়ানো পর্বতের মত বিশাল দেহধারী গন্ডার তার নাকের উপর অবস্থিত শিং সহ দুবার উপর নীচে সঞ্চালন করে গোঁ গোঁ শব্দে হাতিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি জঙ্গলের সবার চেয়ে প্রকান্ড জন্তু, বনের অন্যদের সাথে তোমার তেমন সংশ্রব নেই। কে কী রকম স্বপ্ন দেখে তুমি জানবে কিভাবে?

শুধু বাঘ নয় আর অন্য কেউ এর চেয়েও অদ্ভুত লোমহর্ষক স্বপ্ন দেখতে পারে। কারণ এটি স্বর্গীয় ব্যাপার। এবার সে পশু রাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মহারাজ, বাঘ যা স্বপ্ন দেখেছে তা আমি বিশ্বাস করি। এবার আপনার রায় ঘোষণা করুন।”

গন্ডারের কথায় সিংহ আহ্লাদিত হয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে রায় ঘোষণা করল। বাঘ তার স্বপ্নের বিবরণ মত শূকরকে ভক্ষণ করবে আমি অনুমতি দিলাম। চারদিকে গুঞ্জন হল।

বাঘ মুখ ব্যাদান করে হাসতে হাসতে শূকরকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হচ্ছে এমন সময় হাতি বাঘের সামনে গিয়ে তার গতিরোধ করে সিংহকে লক্ষ্য করে বলল, মহারাজ বাঘকে ক্ষান্ত দিয়ে শূকরকে কিছুদিনের অবকাশ দিন। শূকর মৃত্যু ভয়ে কাঁপতে থাকে।

হাতির কথায় একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে পশুরাজকে কাতর হয়ে নিবেদন করল; মহারাজ! আপনি ধর্মাবতার, আমাকে একমাস অবকাশ দিন, আমি আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে হাজির করব। সিংহ তার নিবেদন শুনে হাতির কথা মনে করল।

হাতি প্রথম থেকেই স্বপ্নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। শূকরের অবকাশ অনুযায়ী তাকে অবকাশ দিল। তবে মাত্র পনের দিন, এক মাস নয়। বাঘ বিস্মিত হয়ে সিংহের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সিংহ আবার গর্জন করে শূকরকে বলল, পনের দিনের শেষ দিন তোমার উকিল হাজির করবে, না পারলে আর কোন ক্ষমা নেই। তারপর দিনই বাঘ তোমাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে। অন্যান্য পশু-পাখিদের সে দিন যথা সময়ে হাজির থাকার আদেশ দিয়ে বিচার সভা ভেঙ্গে দিল পশুরাজ।

তৃণভোজী এবং সমগোত্রীয় পশু এবং পাখিদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার পক্ষে ওকালতি করার জন্য শূকর কোন পশু কিংবা পাখি পেল না। সে উকিলের সন্ধানে অনিশ্চতার পথে পা বাড়াল।

কোন দিকে চলছে নিজেরও খেয়াল নেই, দিন-রাত শুধু চলছেই। দু’চোখ ভরে তার পানি। কিছুই দেখতে পায় না। তবু হাঁটতে থাকে যদি ভাগ্যক্রমে কোন শুভাকাঙ্ক্ষী পায়। সাত দিন একটানা হাঁটার পর একরাতে ভোর হয় এ অবস্থায় ক্লান্ত শূকরটি একটি মাঝারি গাছের কান্ডে ঢুঁ মারল।

গাছটি লিকলিকে হলেও মাথায় ঘন ঝোপ। ঝোপসহ গাছটি কেঁপে উঠল। শূকর মাথায় মারাত্মক যন্ত্রণা পেয়ে থেমে গেল। গাছের ঝোপে ঝিমুচ্ছিল পেঁচা।

সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত করার পর ভোররাতে একটু ঘুমুতে চেষ্টা করছিল আরাম-আয়েশ করে। ঝাঁকুনি খেয়েই আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। আপন মনে নিচে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, কে গাছকে এমন নাড়া দিল?

শূকরকে দেখতে পেল সে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এমনিতেই রেগে গিয়েছে পেঁচা, আর শূকরের মত একটি জড় বুদ্ধি সম্পন্ন আবর্জনা প্রিয় জন্তু দেখে তার রাগ শতগুণ বেড়ে গেল। ঝোপ থেকে নীচে নেমে শূকরের মাথায় কয়েক লাথি মেরে আশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আরম্ভ করে দিল।

বেঁটা অন্ধ, বেকুব, গন্ড, মূর্খ সামনে কোথায় কি আছে দেখতে পাচ্ছিসনা। শূকর তার বিপদের কথা বলে বিলাপ করতে আরম্ভ করল। পেঁচার চোখের পাতা নেই বলে সূর্যালোতে সে বের হতে পারে না, অগত্যা ঝোপের আড়ালে বসে কিংবা ঘুমিয়ে সূর্যালোকিত দিনের বেলাটা কাটিয়ে দেয়। সারারাত আহারের সন্ধান করে।

এজন্য অন্যান্য পাখিরা এদিক ওদিক উড়তে দেখে পেঁচা দিনের বেলায় ঝোপের মধ্যে থাকে বলে সে নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে। শূকরের অবস্থা দেখে এবং তার বিলাপ শুনে বুঝতে পারল শূকর মহাবিপদে নিপাতিত হয়েছে।

সিংহ ও বাঘ চক্রান্ত করে শূকরকে ভক্ষণ করার মতলব করেছে। পেঁচা তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বুঝে নিল। একবার বনের মধ্যে পাখিদের মাঝে কী একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সংগীতের কিংবা সে ধরণের এক প্রতিযোগিতা।

ঐ প্রতিযোগিতায় পেঁচাই বিজয়ী হয়ে পুরস্কার পেত, কিন্তু সারারাত ডাকাডাকি করে সবার চাইতে অধিক যোগ্যতা দেখালেও ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে বনের রাজা সিংহের সামনে হাজির হতে পারে নি।

পেঁচার ডাকাডাকিতে কাঠঠোকরার ঘুম ভাঙ্গলে ভোর রাতে সিংহের দরবারে গিয়ে কিচির-মিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে। ফলে আর কাউকে না দেখে সিংহ কাঠঠোকরাকে সোনার মুকুট দিয়ে পুরস্কৃত করে।

সে সময় থেকে কাঠঠোকরার মাথায় সোনার মুকুট শোভা পাচ্ছে। এ কারণে পেঁচা পশুরাজ সিংহের প্রতি খুবই ক্ষুব্দ। সে সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত রাখে আর কাঠঠোকরা ভোররাতে কয়েকবার কিচিরমিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে সিংহের সামনে হাজির হতেই সিংহ তাকে সোনার মুকুট মাথায় পরিয়ে দিল।

এ সম্পর্কে বনের অন্য পশু-পাখিরা নির্বুদ্ধিতার জন্য কটাক্ষ করে থাকে। এজন্য পেঁচার দুঃখের অন্ত নেই। বাঘের স্বপ্ন দর্শন অনুসারে সিংহের প্রদত্ত নির্দেশ শুনে শূকরের প্রতি তার সহানুভুতি জাগল।

তাকে সমবেদনা জানাল এবং সিংহকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যভাবে বলল, বাঘের স্বপ্নকে স্বর্গীয় ব্যাপার বলে তদনুযায়ী বাঘ শূকরকে ভক্ষণ করবে, সিংহের কী রকম বিচার এটা! আচ্ছা দেখা যাবে তারপর শূকরকে বলল, বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে তোমার ঘাড় মটকাবে!

বাহঃ কী সুন্দর যুক্তি সিংহের। আর বাঘের স্বপ্ন কত স্বর্গীয়। স্বপ্ন স্বর্গীয় বটে, আমিও কত স্বপ্ন দেখি, সে সবই স্বর্গীয়। একটু আগেও আমি রাজ সিংহাসনে বসে এ বনে রাজত্ব করতে স্বপ্ন দেখলাম।

শূকরকে অভয় দিয়ে পেঁচা বলল, সে শূকরের পক্ষে ওকালতী করবে সিংহের নির্ধারিত দিবসে সে দরবারে হাজির হয়ে যথাযতভাবে তার পক্ষে ওকালতী করবে। এ বলে পেঁচা সেখান থেকে উড়াল দিয়ে গভীর বনে ঢুকে গেল।

পেঁচার কথা গুলো বাগাড়ম্বর মাত্র মনে করল শূকর। পেঁচা কি তাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে? তার আশংকা দূর হলনা। জীবনের আশা একদম ছেড়েই দিল শূকর।

তবে বিচারের নির্ধারিত দিনে রাজদরবারে হাজির হবে এবং তার পক্ষে ওকালতী করবে বলে পেঁচা যে বলে গেল, একথাকে সিংহকে জানালে ভাল হয় মনে করে শূকর সেদিনই সিংহকে তার উকিল পেঁচার কথা জানিয়ে আসল।

ইতিমধ্যে বাঘের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। বাঘটির উদ্দেশ্য কত জঘন্য তা ভাবতে ভাবতেই শূকর বুঝতে পারল সবলের সঙ্গে দুর্বলের বন্ধুত্ব কত ভঙ্গুর।

পশুরাজ সিংহ যে দিনটি বিচারের জন্য নির্ধারণ করেছিল সে দিনই ঠিক বিচার সভা বসল। বনের পশু-পাখি একে একে হাজির হচ্ছে। হরিণ, খরগোশ, সজারু, বানর প্রভৃতি তৃণভোজী পশুর দল শূকরের চারপাশ ঘিরে বসেছে।

তারাও যেন শূকরকে সমবেদনা জানাচ্ছে। এছাড়া তাদের কিছু করার নেই। শিয়াল, বন্য কুকুর, নেকড়ে বাঘের সামনে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তারা ঘন ঘন বাঘ আর সিংহের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। বুনো মহিষ, সম্বর, হরিণ, গয়াল, গন্ডার, হাতি সবাই পরস্পর সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ দরবারের পাশে ঘন ঝোপের বন ছিল।

পশুরাজ তার রাজকীয় আসনে এতক্ষণে এসে বসেছে। প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে শূকরের আগমন জানতে চাইল।

তখন শূকর ভীষণ ভাবে কাঁপতে কাঁপতে এক লাফ দিয়ে বেদনার্ত কন্ঠে জবাব দিল, আমি হাজির, ধর্মাবতার। সিংহ জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোর উকিল? দুবার, তিনবার জিজ্ঞেস করলেও শূকর কোন জবাব দিতে পারল না।

তার উকিল পেঁচার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। সিংহ গর্জন করে উঠল এবং শূকরকে লক্ষ্য করে বলল, তুই ছেলে খেলা পেয়েছিস, তোর উকিল হাজির করবে বলে অনর্থক সময় নষ্ট করেছিস, আমাকেও অপমান করলি। তারপর বাঘকে সিংহ বলল বাঘ তুমি তৈরি হও।

সভায় পশুদের গুঞ্জন উঠল। বাঘ শরীর একঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শূকরের মৃত্য সে যেকোন সময় ঘটাতে পারে। কেবল পশুরাজের হুকুমের জন্য অপেক্ষা। পশুরাজ তাকে তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছে।

হত্যা কর বললেই সে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবে না, প্রয়োজনও নেই। এক লাফেই সে শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে দেবে। সিংহ এবার তার শেষ নির্দেশ দেবার জন্য গলা পরিষ্কার করে নিল।

ঠিক তখনিই সিংহের মাথার উপ্রে অবস্থিত ঝোপের আড়াল হতে বের হয়ে পেঁচা পশু সভার মধ্যে মহা উল্লাসে নাচতে লাগল। নাচছে তো নাচছেই, নাচতে নাচতে এক পর্যায়ে উড়ে বাঘের মাথায় লাথি মারে, আবার শুন্য উঠে।

আবার নীচে নেমে সিংহের সামনে উল্লাসে নাচতে থাকে। শূকর খেয়াল করল তারই উকিল পেঁচা। কিন্তু এরকম করছে কেন তার উকিল? রাজ সভায় ওকালতী করতে এসে একি বেয়াদবি। এতে আরও বিপদ বেড়ে গেল, নয় কি? রাজা ভীষণ রেগে যাচ্ছে।

এখনি হুকুম করে সব শেষ করে দেবে। শিয়াল বাহাদুরী দেখাবার জন্য এক থাবা দিয়ে সিংহের সামনে নৃত্যরত পেঁচাকে ধরে ফেলল। পেঁচা তখন আর্তনাদ করে উঠল; আ-হা-হা, করলে কি! করলে কি!

রাজ সিংহাসনে বসতে না বসতেই তুমি আমাকে ধরে ফেললে! তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে! তারপর পেঁচা সিংহকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহারাজ আপনি ধর্মাবতার! আপনি বিচার করুন। আমার স্বর্গীয় স্বপ্ন শিয়াল ভেঙ্গে দিল।

সিংহ উম্মত হয়ে গর্জন করে উঠল। বেটা তোর আবার কি স্বপ্ন? যত সব আজগুবি ব্যাপার। তখন পেঁচা শিয়ালের হাত থেকে এক সুযোগে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে উঠে বসল। তারপর বলল, বনের পশু-পাখি ভাই বোনেরা, আপনারা কেউ কি স্বপ্ন দেখেন না?

কোন দিন কেউ স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখেছেন। শুধু এ বাঘই স্বপ্ন দেখে কি? স্বপ্ন দেখার কি তারি একচেটিয়া অধিকার? তখন গন্ডার তার মুখ উঁচু করে গোঁ গোঁ করে বলল, স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে এবং সবাই স্বপ্ন দেখে, কেন না স্বপ্ন হচ্ছে স্বর্গীয় ব্যাপার।

সিংহ একটু নরম হল। পেঁচাকে বলল, তোর স্বপ্নটা আবার কী? পেঁচা বলল, স্বপ্নটা বর্ণনা করতে আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ। আপনি যদি অভয় দেন আমি বলব। সিংহের মুখে একটু বিদ্রুপ ভ্রূকুটি দেখা গেল।

তাচ্ছিল্য ভরে বলল, দেখি, বল দেখি, তোর কেমন স্বর্গীয় স্বপ্ন! যার দর্শনে তুই উম্মাদ হয়ে গিয়েছিস! এবার পেঁচা খুব বিনয় সহকারে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল; মহারাজ ধর্মাবতার!

আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনি আপনার মেয়েকে মহা ধুমধামের সহিত আমার সাথে বিয়ে দিয়ে সুসজ্জিত রাজ সিংহাসন দান করছেন তারা সবারই আপনার আস্তানায় বিপুল খাদ্য ভোজ্য উদর পূর্তি করছে। আহা! কত আনন্দ! কী স্বর্গীয় আনন্দ মহারাজ!

সিংহের রাগ শতগুণ, সহস্রগুণ বেড়ে গেল। উম্মত আক্রোশে আসন ছেড়ে উঠে হুংকার ছাড়ল; বেটা কোন সাহসে তুই একথা উচ্চারণ করলি? তুই বেটা স্বপ্ন দেখলি কেন?

আহাম্মক কোথাকার! তখন হাতি তার দুইকান ও লেজ নেড়ে শুঁড় উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে বলল, কি অদ্ভুত স্বপ্নরে বাবা! বড় অদ্ভুত স্বপ্ন! বাঘের স্বপ্নের কথা আমি বিশ্বাস করতাম না। এবার কিন্তু বিশ্বাস করলাম।

পেঁচাকে আমাদের সবার সামনে রাজ সভায় উল্লাসে নৃত্য করতে দেখলাম। রাজার সামনে এরূপ নৃত্য করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু পেঁচা যে স্বপ্ন দেখেছে এটি স্বর্গীয় ব্যাপারই বটে, তা সত্য, অতি সত্য। গন্ডার গোঁ গোঁ করে বলল, আমিও বলেছিলাম শুধু বাঘ নয়, আরো অনেকেই নানা রঙের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং দেখেও থাকে।

তৃণভোজী প্রাণীরা এবার উল্লাসিত হয়ে উঠল। তারা বলল, রাজকন্যার সঙ্গে পেঁচার বিয়ে হতে হবে, এখনই বিয়ে হোক। পেঁচাকে সিংহাসন প্রদান করে বনের পশু-পাখিগণকে বিয়ের খানা ভুরি ভোজ দেয়া হোক। আমরা উদর পূর্তি করে খাব।

সিংহ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইল। বাঘ অম্লান মুখে সিংহের দিকে আর মাঝে মাঝে শুকরের দিকে তাকায়।

পেঁচা আবার খুব নম্র এবং বিনয়ের সাথে সিংহকে বলল, মহারাজ ধর্মাবতার, আপনি বনের অধিবাসী পশু-পাখিদের রাজা, সর্বময় কর্তা বাঘের স্বপ্নের শর্তপূরণ করার জন্য বাঘকে যদি শূকরকে মারতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি সে স্বপ্নের শর্ত অনুযায়ী রাজ কন্যা বিয়ে করতে এবং সিংহাসন লাভ করার জন্য আমাকেও নির্দেশ দেন।

পশুরাজ সিংহ নিজের ফাঁদে নিজে জড়িয়ে পড়ছে দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। উপস্থিত বনের পশু-পাখিরা কলরব করে উঠল।

বাঘ তখন ম্লান মুখে পশুরাজ সিংহের প্রতি চেয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর পশুরাজ সিংহ স্বপ্ন দর্শন অনুসারে শূকরকে ভক্ষণ করার বাঘকে যে অধিকার দিয়েছিল তা নাকচ করে দিল।

অধিকন্তু, শূকরটির কোন বিপদ হলে তাতে বাঘকেই দায়ী করা হবে। এই ফরমান জারি করে পশুরাজ নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস পেল।


তথ্যসূত্র : তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : তেন্দেরার পচ্ছন

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা

জালিম্বর একজন আঙু। “আঙু” হল সমাজপতি বা দলপতি। পরবর্তীতে কোন তালুকের অধিকারীকে আঙু বলা হয়।

জালিম্বর একদল লোক নিয়ে রোয়াঙ্গ (আরাকান) থেকে যখন আনকে (চট্টগ্রাম অঞ্চলকে রোয়াঙ্গারা আনক অর্থাৎ পশ্চিম দেশ বলে) আসে তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোগলদের প্রভাব ছিল।

তাই দলবল নিয়ে সে নাক্ষ্যংছড়ি ও রামু হয়ে উত্তর দিকে সরে ক্রমে ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে কোন সরকারী বনাঞ্চল ছিল না, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল মুক্ত বনাঞ্চল। জালিম্বর আঙুর দলবল তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের এক সুবিধাজনক স্থানে গ্রাম পত্তন করে জালিম্বর আঙু তাঁর দলবল নিয়ে বাস করতে থাকে। তাঁর দলের লোকেরা জালিম্বরকে আঙু বলে মেনে নেয়।

সে জালিম্বর-আঙু নামে পরিচিত হয়। বিয়ের সাত বছর পর তাঁর একমাত্র পুত্রের জন্ম হয়। জালিম্বর এবং তাঁর স্ত্রী বাদীমুই ছেলেটিকে কিভাবে আদর করবে তা নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হত।

তাঁরা অতি আদরের ছেলেটির নাম রাখল চিজিগুলা। কিন্তু পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ আদর করে কিংবা বিদ্রুপ করে ডাকে গুলা। চিজি বাদ দিয়ে শুধু গুলা। তাঁরা অতি আদর যত্ন নিয়ে ছেলেটিকে বড় করতে লাগল।

কিশোর বয়সে চিজিগুলার জন্য বৌ আনতে শখ জাগল জালিম্বর আঙুর। পাড়ার সবচাইতে সুন্দরী ফুলরেণুকে চিজিগুলার জন্য বৌ ঠিক করা হল।

ফুলরেণু বয়সে গুলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং পূর্ণ যুবতী না হলেও তার বিয়ের সাধ হয়েছে। বাগল্যার সঙ্গে তার আইপাই (মন দেয়া নেয়া) এবং ঘনিষ্টতার কথা কারোর অজানা ছিল না।

ফুলরেণু এ বিয়েতে কোন মতেই রাজি নয়। তার অভিযোগ হচ্ছে গুলা তার চেয়ে বয়সে ছোট, এখনো কিশোর এবং গুলা ভাল করে কথা বলতে পারে না, তার জিহ্বায় আড়ষ্টতার দোষ আছে।

ফুলরেণুর বাবা মা আঙুর একমাত্র সন্তান বিবেচনা করে গুলার সঙ্গে মেয়ে ফুলরেণুর বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে। বিয়ে যে দিন হবে, তার আগের রাতে ফুলরেণু বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে যায়।

সকাল হতে না হতেই ঐ খবরটি জালিম্বর জানতে পারে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একজন বিশ্বাসী লোক পাঠিয়ে দিল ভিনগ্রামের তাঁর মামাত ভাই নাগর্য্যার কাছে।

লোকটি গিয়ে নাগর্য্যাকে বলল, জালিম্বর তাঁর ছেলে চিজিগুলোকে বর সাজিয়ে নিয়ে আসছে, সে যেন তার মেয়ে মুগুলিকে কনে সাজিয়ে রাখে।

চিজিগুলা আর মুগুলির আজই বিয়ে হবে। সব ব্যবস্থা যেন নাগর্য্যা করে রাখে। নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী খবরটি পেয়ে বিস্মিত হলেও বরঞ্চ খুশি হল।

তার মেয়ে মুগুলির বয়স চিজিগুলার চেয়ে দু বছরের বড়। এমনিতে আত্মীয় আর জালিম্বর হচ্ছে আঙু বা দলপতি, কাজেই নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী জালিম্বরের কথায় বেরাজী হল না।

মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল নাগর্য্যা মহা ধুমধাম সহকারে না হলেও সে দিন ঠিক ঠিক চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ে হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভুরি ভোজন করে চিজিগুলা আর মুগুলিকে আশীবাদ করল।

জালিম্বর আঙু জুম চাষ করলেও তার কিছু ধান্যজমি আছে। গরু, ছাগল, মহিষ, শূকর, হাঁস-মুরগি গৃহপালিত পশু-পাখি তাঁর অঢেল আছে। তাঁর পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। একেবারে ধনী বলা না গেলেও দরিদ্র নয় জালিম্বর আঙু।

মুগুলির সঙ্গে বিয়ে হলেও চিজিগুলা ফুলরেণুকে ভুলতে পারেনি। তার কথা মাঝে মাঝে মুগুলিকে শোনায়।

উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটি হয়। চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ের তিন বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী মারা যায়।

এর চার বছর পর জালিম্বরও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চিজিগুলা আর মুগুলির জোড়া তালি দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা তাদের শেষাংশ উচ্চারণ করে ডাকে। যেমন – চিজিগুলাকে শুধু গুলি।

উভয়ের কথা বলতেই শুধু গুলাগুলি উচ্চারণ করে হাসে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। গুলাগুলির সংসারে বিয়ের দীর্ঘ ছয় বৎসরেও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি।

জালিম্বর আঙু স্বপ্নে দর্শন দিয়ে গুলাকে বলে, চিজিগুলা তোমরা বড় একা হয়ে গেছ, আমি আসছি। আমি তোমার ঘরে আসছি।

কিছুদিনের মধ্যে গুলা বুঝতে পারল গুলি গর্ভধারণ করেছে। সে তার স্বপ্নের কথা গুলিকে বলে ফেলল। তাদের বিশ্বাসমতে গুলার পিতা জালিম্বর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে।

এতে তারা খুশি হল। ঠিক দশ মাস দশদিন পর মুগুলি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাদের আনন্দ এখন দেখে কে!

সন্তানটি বড় হতে থাকে। যখন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, পাড়া মাতিয়ে রাখে ছেলেটি। তার বাবা-মাকে সে বাবা-মা ডাকে না।

বাবাকে ডাকে গুলা আর মাকে ডাকে গুলি। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে ছেলেটা। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচরণে চাতুর্য প্রকাশ পেতে থাকে।

পাড়ার লোকেরা তাকে তেন্দেরা নামে ডাকতে থাকল। একদিন গুলা এবং গুলিও ছেলেটিকে তেন্দেরা নামেই ডাকতে থাকে।

একদিন গুলা জঙ্গল থেকে একটি কচ্ছপ ধরে নিয়ে এল ঘরে। ডিমওয়ালা কচ্ছপ। কচ্ছপ কেটে রান্না করা হলে তেন্দেরা বলল যে, সে ডিমগুলোই খাবে, ডিম বাদে কিছুই খাবে না।

গুলা এবং গুলিও এতে খুশি। একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে খাবে কে? কিন্তু কচ্ছপের সেই হলদে রঙ্গের ডিমগুলো খাওয়া শেষ করে তার বাবা-মাকে বলতে লাগল, ইস!

তোমরা কী খাচ্ছ? আমাকে একটুও দিলে না। আমিও কচ্ছপের মাংস খাব। কচ্ছপের মাংস পেট ভরে খেল ডিমগুলো খাওয়ার পর।

খেয়ে বলতে লাগল, ইস এটা ডিমের চেয়ে সুস্বাদু। সে মুরগি বা মোরগের গিলা, কলিজা খায় না, শুধু খায় মাথা, ঠ্যাং ইত্যাদি। গুলাগুলি এই ডানপিটে ছেলে তেন্দেরার কান্ডে অবাক হয়ে থাকে।

বয়স বার, তের হতে না হতেই তেন্দেরার দেহে, মনে যৌবন এসে গেল। সে পাড়ার তরুণীদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়।

পাড়ার ছেলেরা তাকে চোখে চোখে রাখে, সাবধান করে। গুলাগুলি ছেলের এই আচরণ দেখে মর্মাহত হয় এবং তার জন্য বৌ আনার সিন্ধান্ত নেয়।

পাড়ায় অনেক তরুণী তাকে পছন্দ করলেও তেন্দেরা বিয়েতে রাজি হয়নি। তাই একদিন তারা তেন্দেরাকে ঘর থেকে নামিয়ে দেয়। তাকে বলে দেয় যে, সঙ্গে বৌ না নিয়ে আসলে ঘরে উঠতে পারবে না।

তেন্দেরা কোন কথা না বলে বেড়িয়ে পড়ল শূণ্য হাতে। পকেটে টাকা পয়সা নেই। কোন যুবতীর মন পেতে হলে নূন্যতম পক্ষে সুগন্ধি তৈল, আয়না, চিরুনি দিতে হয় একথা তেন্দেরার জানা আছে কিন্তু সে এগুলো পাবে কোথায়?

টাকা পয়সা থাকলে বাজার থেকে সে কিনে নিতে পারত। কিভাবে টাকা পাওয়া যায় একথা ভাবতে ভাবতে তেন্দেরা এক স্থানে গিয়ে দেখে একজন চাষী হাল চাষ করছে।

এক জোড়া মহিষের হাল। সে মিষ্টি কথা বলে চাষীর সঙ্গে সখ্যতা করে বলল, দাদা তুমি বিশ্রাম কর, আমি তোমার বদলে হাল চালাই। লোকটি তাতে রাজি হল এবং তেন্দেরা হাল চষতে লাগল।

বেশ খানিকক্ষণ চষার পর তেন্দেরা লোকটিকে বলল, দাদা মশা-মাছি মহিষ দুটোর গায়ে বসে বড় উৎপাত করে। এতে মহিষগুলো বিরক্ত হয়, লাঙ্গল টানতে চায় না।

বরঞ্চ মহিষ দুটোর গায়ে কাদা লেপে দিলে মশা-মাছি গায়ে বসে উৎপাত করবে না। মহিষ দুটো আরাম করে হাঁটবে, লাঙ্গল টানবে। দাদা, আমি তাই করি,  কী বল?

লোকটি আপত্তি করল না। তেন্দেরা মহিষ দুটোর গায়ে ভালভাবে কাদা লেপে দিল। সূর্যের তাপে কাদা শুকালে মহিষ দুটোর কালো রং সাদা হয়ে গেল এবং দুটো সম্পূর্ণ নতুন মহিষ বলে মনে হতে লাগল।

তেন্দেরা একটু পর লোকটিকে বলল, দাদা আমার পানির তৃঞ্চা পেয়েছে, তোমার ঘরে গেলে কি পানি খেতে পারব? লোকটি বলল, “সে কি কথা? পানি কেন পাবে না?

যাও ঐ যে টিলার ওপর ঘর, ওখানে গিয়ে স্ত্রীকে বললে পানি দেবে। তেন্দেরা সন্দেহের ভান করে বলল, দাদা যদি পানি না দেয়, তখন আমি তোমাকে বলব, দিচ্ছে না তাহলে তুমি তাকে দাও, দাও বলবে তো?” লোকটি স্বাচ্ছন্দে রাজি হল।

তেন্দেরা ধীর পায়ে টিলার ওপর লোকটির ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিনয় সহকারে কুশল জিজ্ঞেস করে, খুশি করল।

তারপর বলল, বৌদি দেখ, দাদা মানে তোমার স্বামী একটু আগে আমার কাছ থেকে এক জোড়া হালের মহিষ কিনেছে ঐ দেখ সাদা মহিষগুলি।

তোমার নিকট থেকে মহিষ দুটোর দাম দু’শো টাকা নেবার জন্য দাদা পাঠিয়েছে, তুমি আমাকে দু’শো টাকা দাও। তখন স্ত্রী লোকটি উত্তরে বলল, কি যাতা বলছ, আন্দাজে কেন টাকা দেব?

তেন্দেরা বলল, তাহলে আমি তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছি, দেখ সে কি বলে। তেন্দেরা ডাক দিয়ে লোকটিকে বলল, দাদা কথামত তোমার স্ত্রী দিচ্ছে না। এই কথা শুনে লোকটি রাগত স্বরে জোরে জোরে বলল, আরে দাও, দাও।

অগত্যা স্ত্রী লোকটি বাক্স থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দুশো টাকা দিয়ে দিল। তেন্দেরা টাকা পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে চম্পট দিল দূরে অনেক দূরে।

হাঁটতে হাঁটতে সাত গাঙ সাত পাড়া পার হয়ে এক বাজার থেকে সুগন্ধি তেলের বোতল, আয়না, চিরুনি এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী কিনে থলে ভর্তি করে নিল।

একদিন সাঁঝের বেলা শামুকছড়ি পাড়ে এক পাড়ায় এসে পৌঁছাল তেন্দেরা। পাড়ার এক প্রৌঢ়া ও একজন তরুণী। মা ও মেয়ে। মা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি আনতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি সাঁঝের বেলায় একা পানি আনার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে।

তেন্দেরা তরুণীকে দেখে পছন্দ করল। প্রৌঢ়া মহিলাকে মাসী সম্বোধন করে কুশল জিজ্ঞাসা করল। প্রৌঢ়া মহিলা বিস্মিত হয়ে তেন্দেরাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো! আমাকে কেন মাসী ডাকছ, আমার তো এ জম্মে কোন বোন নেই।

তুমি কোথেকে এলে? তেন্দেরা বিনীতভাবে বলল, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই দেখছি। আমার মায়ের চেহারা ঠিক তোমার মত। যা হোক আমি তোমাকে মাসি বলে ডাকব।

মাসী আমাকে কলসিটা দাও, আমি পানি এনে দিচ্ছি। মা ও মেয়ে উভয়ে খুশি হল। তরুণীটি কলসিটি তেন্দেরার হাতে দেওয়ার সময় তেন্দেরা তার থলেটি তরুণীর হাতে দিয়ে বলল, বোন এই থলেতে যা আছে সব তোমার জন্য এনেছি, তুমি রেখে দাও।

তেন্দেরা কলসিটি ভরে পানি নিয়ে উঠানে পৌঁছার আগে থেকে প্রৌঢ়া বকবক করছিল। তেন্দেরার কানে গেল প্রৌঢ়ার কথা গুলো, কোথা থেকে কে আসল এই সাঁঝের বেলা।

তাকে রাত্রে থাকতে দেব কিভাবে? তেন্দেরা মনে মনে ভাবল তাহলে তাকে কি এখানে থাকতে দেবে না? সে ফন্দি আঁটতে লাগল কিভাবে এই ঘরে থাকা যায়?

পানির কলসি ঘরে তুলে দিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, মাসীমা কী কী কাজ আমাকে দাও আমি করে ফেলি। আমাকে অন্য ঘর খুঁজতে হবে থাকার জন্য। মহিলা বুঝল তেন্দেরার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, অথচ কাজ করে দিতে বলছে।

তখন তেন্দেরাকে জিজ্ঞস করল, তুমি কোথা থেকে আসছ? কে তুমি? তেন্দেরা জবাব দিল সে আঙু জালিম্বরের নাতি। তখন মাহিলার মনে আগের কথা স্মরণ হল, ভাবতে লাগল সে।

জালিম্বর আঙু তার ছেলে চিজিগুলার জন্য তাকে বৌ ঠিক করেছিল। কিন্তু যে দিন বিয়ে হবে তার আগের রাতে বাগল্যার সঙ্গে সে পালিয়ে গিয়েছিল।

ছয়/ সাত বছর সুখে ঘর করে একমাত্র কন্যা কুকলিকমালা জম্ম গ্রহণ করে এবং তার জম্মের এক বছর পর বাগল্যা মারা যায়।

প্রৌঢ়া ফুলরেণু তেন্দেরার বাপের নাম জিজ্ঞেস করতেই তেন্দেরা জবাব দিল, তার বাপের নাম গুলা। এবার ফুলরেণু বলল, তুমি চিজিগুলার ছেলে তাহলে?

তেন্দেরা হ্যাঁ বলল, এই সাঁঝের বেলা আর কোথায় যাবে, এখানেই থাক। এর আগে কোনদিন কোন ছেলে বা পুরুষকে আমাদের ঘরে থাকতে দেইনি, আমার মেয়ে কুকলিকমালা।

মেয়ে কুকলিকমালাকে তেন্দেরাসহ তিনজনের ভাত রাঁধতে বলল ফুলরেণু। কুকলিকমালা ইতোমধ্যে তেন্দেরার দেওয়া থলে থেকে সুগন্ধি তেল মাথায় দিয়ে আয়না দেখে চুল আঁচড়িয়ে মনের মত সেজেছে।

সে কোন কথা না বলে ভাত রাঁধতে শুরু করে। তেন্দেরার আগমনে সে খুশি হয়েছে!

একদিন দুদিন থেকেও তেন্দেরা ঘর থেকে চলে যাওয়ার নাম করল না। মা আর মেয়েও উচ্চবাচ্য করেনি।

তেন্দেরা ফন্দি আঁটে কিভাবে কুকলিকমালাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবে। ফুলরেণু মাঝে মাঝে ভাবে, চিজিগুলা ভালভাবে কথা বলতে পারে না।

জিব্বায় যেমন জড়তা আছে তেমনি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তার ছেলে তেন্দেরার বুদ্ধিইবা কত হবে, আর এই তেন্দেরা তার মেয়ে কুকলিকমালার জামাই হবে কিভাবে?

ফুলরেণু একদিন রাত্রে তেন্দেরাকে বলল, তুমি দেখছি এখানে থেকে চলে যাবার নামও করছ না, এভাবে থাকলে লোকে বদনাম করবে।

তুমি আমার জন্য তিনটা জিনিস নিয়ে আস, যদি নিয়ে আসতে পার তবে এখানে থাকতে পারবে এবং আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করলে তার সাথে বিয়ে দেব।

আর যদি তিন দিনের মধ্যে এ জিনিস গুলি আনতে না পার তবে এখান থেকে চলে যাবে বুঝলে? সেই তিনটি জিনিস হল – (১) বোঁটাহীন ফল, (২) যে ফলের বিচি বাইরে এবং (৩) যে জিনিস এক বাটি খেলেও সেই বাটি পূর্ণ থাকে সেই জিনিসে।

এই তিন দ্রব্যের নাম শুনে তেন্দেরা বোকা বনে গেল। আসলে সে ঐগুলি চিনে না। সে হতাশ হয়ে গেল।

তেন্দেরা ম্লান মুখে কুকলিকমালাকে বলল যে, সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। কুকলিকমালা তেন্দেরাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই তেন্দেরাকে এই তিনটি দ্রব্য কী কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তার সন্ধান দিল।

সে বলল, তুমি চিন্তা কর কেন? এগুলো নিয়ে আস যাও। সে বলল, আমাদের ঘরের পাশে যে ছড়া তার নাম শামুকছড়ি।

এই ছড়ার উজানে যেতে যেতে ডানে একটা ছড়া দেখবে তার নাম তামছড়ি। সেই ছড়ার দু’ধারে অনেক ফল গাছ। ওগুলো তাম গাছ। দেখবে তাম (কাগু বাদাম) ধরে আছে গাছে। ফলগুলোর বাইরে বিচি।

এখান থেকে তাম পেড়ে নিয়ে আসার সময় দেখবে ছড়াতে অনেক শামুক। সেই শামুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। যাও দেরি করোনা।

তেন্দেরা তার কথামত গিয়ে দেখে সত্যই গাছে তাম ফল ঝুলতেছে। সে পাকা তাম ফল এক থলে নিয়ে আসার সময় এক থলে শামুকও কুড়িয়ে নিল ছড়া থেকে।

তখন দুপুর হয়ে গেছে। ঠিক তখন কুকলিকমালার মুরগিটা কক কক কতাক কক কক কতাক করে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো খোপ থেকে নেমে গেল।

তেন্দেরা সেখানে পৌঁছলে কুকলিকমালা তাকে ঐ খোপ থেকে মুরগির পাড়া ডিম নিয়ে আসতে বললে তেন্দেরা ঠিক ডিমটা নিয়ে এল।

এবার কুকলিকমালা তেন্দেরাকে ঐ তিনটা জিনিস সহ তার মার কাছে নিয়ে গেল। ইশারায় ঐসব জিনিস তার মাকে দিতে বলল কুকলিকমালা।

ফুলরেণু তিনটা জিনিস পেয়ে খুশি হল। তখন কুকলিকমালা তেন্দেরাকে বলল ডিম হচ্ছে বোঁটাহীন ফল, তার কোন বোটা নেই। তামের বিচি ফলের বাইরে। ফলের নিচে ঝুলে থাকে।

আর শামুক একবাটি খেলেও (তার সাঁশ খাওয়া যায়) খোলসগুলো পড়ে থাকে কাজেই একবাটি খেলেও এক বাটিই অবশিষ্ট থাকে।

তেন্দেরা কুকলিকমালার কথা মত বুঝিয়ে বলল। ফুলরেণু খুশি হল। কিন্তু তা স্বত্বেও তার মেয়ে কুকলিকমালাকে চিজিগুলার ছেলে তেন্দেরার জন্য বৌ দিতে রাজি নয় ফুলরেণু।

কুকলিকমালা জানে তার মা ফুলরেণু তার বাবা বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কাজেই তার মা যদি পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে পারে, সে কেন তেন্দেরার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না, ভাবে কুকলিকমালা।

এক রাত্রে সত্যি সত্যি তেন্দেরার হাত ধরে পালিয়ে গেল কুকলিকমালা। তেন্দেরা কুকলিকমালাকে নিয়ে সোজা ঘরে ফিরে এল। গুলাগুলি ছেলে আর ছেলের বৌ দেখে মহা খুশি হল।

কিছুদিন পর গুলা তেন্দেরাকে নিয়ে পাড়ালিয়াদের সঙ্গে কাট্টনে গেল। নৌকার কাট্টন। তারা এক মাসের খোরাকি নিয়ে দেড় দিনের হাঁটা পথের গভীর বনে চলে গেল।

ঘরে রইল গুলি আর তেন্দেরার নববধূ কুকলিকমালা। একমাসের প্রায় শেষ, কিন্তু নৌকার কাজ এখনো অনেক বাকি এদিকে খোরাকিও প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

তাই তেন্দেরা বাড়ি ফিরল খোরাকি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল তার মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কুকলিকমালা কী করবে দিশেহারা হয়ে আছে।

তেন্দেরা বৈদ্য এনে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাল। কিন্তু কয়েকদিন পর তার মা গুলি মারা গেল। তেন্দেরা তার বাবা গুলাকে খবর দিতে পারল না – তার মা শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করল।

এদিকে খোরাকি নিয়ে না গেলে তার বাবা উপোসে মরবে, আর খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবার কাছে গেলেও ঘরে কুকলিকমালা একা থাকতে পারবে না।

তাই একদিন সে ফুলরেণুকে তেন্দেরার নিজেদের ঘরে আনতে গেল। তেন্দেরা অবশ্য ভেবে নিয়েছে- ফুলরেণু তাদের ঘরে কোনদিন যাবে না।

তাই ফুলরেণুর কাছে  পৌঁছামাত্র হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমরা বাপবেটা নৌকার কাট্টনে গিয়েছিলাম- সেখানে নৌকার কাজ অর্ধেক করে বাবা গুলা মারা গেছে আর সেদিন মা গুলিও মারা গেল।

এখন নৌকাটার কাজ সম্পন্ন করে নিয়ে আসতে হবে। বিক্রি করলে টাকা পাবে। তাই আমি কাট্টনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে কুকলিকমালা একা থাকবে কিভাবে?

আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তেন্দেরার কথা ফুলরেণু ভেবে দেখল।অমনি সে একা থাকা পছন্দ করেনা – এখন তার মেয়ের সঙ্গে তাদের ওখানে থাকলে খারাপ কিছু নয়, তাই তেন্দেরার কথায় সে সহজেই রাজি হয়ে গেল।

ঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারে তেন্দেরা নিয়ে নিল। ফুলরেণুও তার কাপড় চোপড় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যা পারল সঙ্গে নিয়ে তেন্দেরার ঘরে এসে পৌঁছল।

দুদিন পর তেন্দেরা কিছু দিনের খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবা গুলার কাছে চলে গেল। সে তার মা গুলির মৃত্যুর কথা তার বাবা গুলার কাছে গোপন রাখল।

সে বরঞ্চ বলল যে, তার মা গুলি ভয়ানক অভিমান করে আছে। এত দীর্ঘ সময় যে কোনদিন প্রবাসে কাটায়নি। এবার দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে গুলা।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর প্রতি দিওয়ানা হয়ে আছে।ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আফসোস করল। মনে মনে ভাবল এতদিন প্রবাসে থাকা কী ঠিক হল ?

তেন্দেরা আবার বলল, তুমি ঘরে গেলে মা কামরাতেই পড়ে থাকবে দেখো। গুলা মনে মনে ঠিক করল তাতে কী আছে যায়, ঘরে গিয়ে সোজা কামরার ভিতরে গুলিকে জড়িয়ে ধরলে সব অভিমান ভেঙ্গে যাবে গুলির। তাই সে জড়িয়ে ধরবে। মনে মনে ঠিক করল গুলা।

কয়েকদিন পরিশ্রম করে বাপ-বেটা অসস্পূর্ণ নৌকাটি সম্পূর্ণ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। দেড় দিন নদীর পথে নৌকাটি ভাসিয়ে এনে একদিন সন্ধ্যায় বাজার ঘাটে ভিড়াল তারা।

তেন্দেরা তার পিতাকে বলল, তুমি নৌকাটি বাজারে বিক্রি কর আর আমি আমাদের কুড়াল, দা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ঘরে নিয়ে যাই।

মাকে তুমি এসেছ বলে সংবাদ দিব-তাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। এই কথা বলে সে ঘরে এল আর গুলা নৌকাটি বিক্রির জন্য বাজারে থেকে গেল।

ঘরে এসে তেন্দেরা ফুলরেণুকে বলল, আমরা নৌকাটা নিয়ে এসেছি, আমি একা পারিনা বলে আমার এক মামাও সঙ্গে এসেছে।

তাকে নৌকা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠিয়েছি। সে নৌকা বিক্রি করে রূপার টাকা নিয়ে ঘরে আসবে। সে হয়ত ফিরতে রাত হবে।

তোমার খওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে পার ,আমি আমার মামার জন্য জেগে থাকব।গ্রামে সন্ধ্যা হতে না হতেই লোকজন খাওয়া–দাওয়া করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তেন্দেরার কথামতে তারা সাঁঝের আঁধার হতে না হতে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তেন্দেরা যতদিন কাট্টনে ছিল, ততদিন ফুলরেণু আর তার মেয়ে কুকলিকমালা ঘরের বারান্দাতে ঘুমাত।

আজ তেন্দেরা ঘরে আসাতে কুকলিকমালা আর তেন্দেরা ঘরের পিছনের কক্ষ অজলেঙে ঘুমাবে। তেন্দেরা গুলরেণুকে বলল, আমার মামা এলে খাওয়া দাওয়া, করে এখানে থাকবে। সে বারান্দাতে ঘুমাবে, কাজেই তুমি ভিতরের কামরাতে ঘুমাও।

ফুলরেণু ঘরের ভিতরে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কুকলিকমালা তাদের জন্য অজলেঙে বিছানা প্রস্তুত করে তেন্দেরার কথিত মামার জন্য বারান্দাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুলা বাজারে নৌকাটি বিক্রি করে রাত হলে রূপার টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে এল। গুলার মনে আছে, তেন্দেরা বলেছে গুলি তার প্রতি অভিমান করে আছে।

গুলা ঘরে ফিরে তেন্দেরা আর কুকলিকমালাকে দেখল কিন্তু গুলিকে দেখলনা। গুলি নিশ্চয়ই অভিমান করে ভিতরে শুয়ে আছে মনে করে গুলা সোজা ভিতরে চলে গেল।

তখন সেখানে অন্ধকার। গুলা হাতড়িয়ে ধরতে পেল কে একজন শুয়ে আছে। সে জড়িয়ে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ঘুম থেকে জেগে হতভম্ব হয়ে হাত–পা ছঁড়তে লাগল।

গুলা ততোধিক জোরে চেপে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ভূত ভূত বলে চিৎকার করলে গুলা বলতে লাগল–না–না আমি ভূত নই।  ফুলরেণু ভয়ে গুলাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।

তাদের এই হৈ চৈ কালে তেন্দেরা আর কুকলিকমালা বাতি নিয়ে সেখানে হাজির হল। বাতির আলোতে ফুলরেণু দেখল গুলাকে আর গুলা দেখল ফুলরেণুকে উভয়েই হতভম্ব। লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে গেল।

তাদের এ অবস্থা দেখে তেন্দেরা বলল, তোমরা এভাবে জড়াজড়ি করেছ একথা লোকে জানতে পারবে। কলঙ্কের একশেষ হবে। তার চেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাল।

গুলা আর ফুলরেণু কিছুই বলতে পারল না। তাদের স্মরণ হল – কৈশরেই তো তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন হয় নি এখন শেষ বয়সে হলে ক্ষতি কী?


[পচ্ছন – রূপকথা। চিজি – (তুলনীয়) খোকা, গুলা- ফল/fruit.]

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা- রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী


তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি: পাহাড় কোলে নক্ষত্ররাজি

লিখেছেনঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাগুনিয়া উপজেলা, কক্সবাজার, টেকনাফ এবং উখিয়া অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি নাম দাইনাক, অনেকে দৈনাক নামেও ডেকে থাকেন। যার অর্থ যোদ্ধা। ইতিহাসের তথ্য মতে- তাঁরা শৌর্য, বীর্যে এবং বীরত্বে জগৎ খ্যাত ছিলেন। আরাকানে স্বাধীন দান্যাওয়াদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকাল ঐ অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন এবং বসবাস করে এসেছেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার তৈনছড়ি নদীর তীরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই তৈনছড়ি থেকে তাঁরা অন্য অঞ্চলে বা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তৈনছড়ি নদীটি তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এখনো ঐতিহাসিক এবং আবেদনের একটি জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে, সাথে ভালোবাসার একটি নামও। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান পঞ্চম এবং শিক্ষার হার দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তাদের আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১.০০ (এক) লাখের কাছাকাছি এবং শিক্ষার হার ৮০% এর উপরে। পরিসংখ্যান তথ্যমতে  ৪৭% তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরাম সিএডিসি ও এর বাইরে ৩.৩% শতাংশ লোক বসবাস করে, অবশিষ্ট ৫০% শতাংশ তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর- ২০১০ খ্রি)

গছা বা গোত্র

তঞ্চঙ্গ্যারা মোট ১২ টি গছা বা দলে বিভক্ত। গছাগুলো হলো- কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসা গছা, অঙ্যা গছা, মুলিমা গছা, রাঙী গছা, ওয়া গছা, তাশী গছা। কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা এই সাতটি গছা বাংলাদেশে বসবাস করে বর্তমানে। বাকিগুলো মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জানা যায়। আবার প্রতিটি গছায় রয়েছে উপগছা বা উপশাখা। যেমন: কারবআ গছার কয়েকটি উপগছা হলো- বউ গোত্তি, বলা গোত্তি, বাঅ-ল গোত্তি, আরয়া গোত্তি, ফারাঙচা গোত্তি ইত্যাদি। এভাবে অন্য গছায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে উপগছা রয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। তাদের মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তঞ্চঙ্গ্যাদের মাতৃভাষার নাম “তঞ্চঙ্গ্যা” ভাষা। জনগোষ্ঠীর নামের সাথে মিল রেখে ভাষার নামটি নির্ধারণ করা হয়।

জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন ১৯০৩ সনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে  তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারাবিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত দেন। তিনি আরো মত দেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক ভাষার (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) সাথে একই অন্তর্ভুক্ত হলেও তিবেতো-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করেছে। অনেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত বাংলা ভাষা বলে মত দেন। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে প্রচুর আরাকান বা মারমা শব্দের উপস্থিতি, প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ব্যবহ্ত বর্ণমালাগুলো বার্মিজ বর্ণমালার সাথে মিল রয়েছে এই মূল উৎপত্তি “মনখমের” দের থেকে। ব্রাহ্মী লিপি থেকে এই বর্ণমালার উৎপত্তি বলে অনেকে মত দেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার নাম দাইনাক বর্ণমালা এবং বর্তমানে ব্যবহ্ত বর্ণমালার নাম ছালাম্যা বর্ণ বা ছালামী পাঠ যার অর্থ গোলাকার। বর্ণমালার সংখ্যা সর্বমোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ ০৫ আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আরো আছে নিজস্ব সংখ্যা বা গননা পদ্ধতি।  

তাদের বর্ণমালার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কথ্য এবং লিখিত রূপ আ-কারান্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত হচ্ছে এর উচ্চারণ এবং কথ্যরীতি ¯স্বর কোমল, নরম এবং কর্কশ নয় শ্রবণে মধুর। শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রকৃতির একটা সরলতা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ গছা বা শাখাভেদে তাদের ভাষা অভিন্ন।

পোশাক ও অলংকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার রয়েছে। গছাভেদে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য রয়েছে। তবে কারবআ গছা রমণীদের রাজকীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় সবাইকে আকর্ষণ করে। রঙে, ঢঙে এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। এই পাঁচ কাপড়গুলো হলো- পিনৈন (নির্মাঙ্গ বস্ত্র), জুম্ময়া সালুম (লম্বা হাঁটা শার্ট), মাদা কাবঙ (পাগড়ি), পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) এবং জুম্ময়া খাদি (ওড়না বিশেষ)। প্রতিটি পোশাকে রয়েছে নিজস্ব এবং ¯স্বতন্ত্র নকশা, ফুল এবং ডিজাইন। এসকল নকশা এবং ফুলগুলো জুম এবং প্রকৃতি থেকে নেওয়া, পাওয়া। আর ছেলেদের পোশাক সাদা ধূতি এবং লম্বাহাটা সাদা শার্ট। অলংকার হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যারা প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব স্টাইল এবং ডিজাইনে অলংকার পড়ে থাকে। এক সময় রৌপ্য অলংকার ব্যবহারে প্রচলন ছিল বেশ। এখন রৌপ্য পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতুর অলংকার ব্যবহার করে তাঁরা। যেমন- কানে রাইজ্জু ও জংগা, কব্জিতে বাঘোর, কুসই খারু, কিয়াইংশিক, বাহুতে তাজ্জুর, গলায় চন্দ্রহার, আলচুরি, জামছড়া, পিসিছড়া ইত্যাদি। তবে আধুনিককালে গলায় স্বর্ণ, রুপোর চেইন, আংটি, নুপুর, নেকলেস পড়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা। পুরুষরাও চেইন, আংটি পড়ে থাকে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জুনু তঞ্চঙ্গ্যা (হিল এক্সপ্রেস)

ঘর-বাড়ি ধরণ এবং বসতঘর

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এই পাহাড় এক সময় প্রচুর বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। চারিদিকে গহীন বন। তখন এই বনে প্রচুর পরিমাণে হিংস্র বন্য পশু-পাখি বসবাস করতো। আদিবাসীরা যেহেতু পাহাড়ে এবং বনের মধ্যে বসবাস করে তাই বন্য হিংস্র পশু-পাখির সাথে এক প্রকার সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। মূলতঃ বন্য পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘরগুলো মাচাং আকারে মাটি থেকে একটু উচুতে তৈরি করতো। মূল ঘরের সাথে একটি ইচরও থাকতো। ইচর মূলতঃ খোলা হাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা। একটি মূলঘরের সাথে কয়েকটি অংশ থাকে। অংশগুলো হলো- সিঙকাবা, পিনা, গুদি, বারান্দা এবং রান্না ঘর। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঘর থাকে তঞ্চঙ্গ্যাদের। ঘরগুলো হলো-জুমঘর (জুম চাষের সময় তৈরি করা হয়। একে প্রভাস্যা ঘরও বলা হয়), ডেইরি ঘর (যেখানে ঘরের নানা জিনিসপত্র যেমনঃ চাষের নানা যন্ত্রপাতি, উপকরণ রাখা হয়), গোয়াল ঘর, ছাগল ঘর, হাসঁ-মুরগী ঘর, দারবআ ঘর (জ্বালানি কাঠ রাখার ঘর)। তবে বর্তমানে তাদের মূল ঘর তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা আর মাচাঙ ঘর তৈরি করে না। কারণ আগের মতো পাহাড়ে আর গভীর বন নেই, সাথে নেই হিংস্র পশুপাখিও। বাঁশ এবং শনের পরিবর্তে এখন ইট, কংক্রিট, টিন, রড, সিমেন্টের ঘর তৈরি করে তাঁরা। বর্তমান বসতগুলো মজবুত এবং দীর্ঘাস্থায়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরগুলো তার ঐতিহ্য এবং নিজস্বটা হারিয়ে  ফেলেছে।

ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান

তঞ্চঙ্গ্যারা মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাদের প্রতিটি পাড়া বা গ্রামে একটি করে  বৌদ্ধ বিহার আছে। ওখানে ভিক্ষু সংঘ আছে। তাদেরকে সকলে মিলে ভরণপোষণ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। এছাড়া আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা বা ফানুস উত্তোলন পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার পর একমাস ব্যাপি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম দান শ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িতেও তাঁরা সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করে।

রাজগুরু শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাথেরো (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা), ষষ্ঠ সংগীতিকারক রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা), ত্রিপিটক বিশারদ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, আর্যানন্দ মহাস্থবির, শ্রীমৎ অজিতা মহাথেরো (ধ্যান ভান্তে), ধর্মানন্দ মহাস্থবির, সুমেধানন্দ মহাস্থবির প্রমূখ বৌদ্ধ ধর্মের সাধক পুরুষ। তাঁরা হলেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সূর্য সন্তান এবং ধর্মীয় পন্ডিত। 

সামাজিক উৎসব

বিষু (বাংলা নববর্ষ) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান এবং অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব। বিষু উৎসবকে তাঁরা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে। ফুল বিষু, মূল বিষু এবং বিষু।

ফুল বিষু মূলত চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন। মূল বিষু হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আর বিষু হলো পহেলা বৈশাখ। ফুল বিষু দিনে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় এবং নদীতে ফুল পূজা দেওয়া হয় (অনেকে ফুল ভাসানোও বলে থাকেন) এই দিনে ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

মূল বিষুতে প্রায় শতপদের সবজি দিয়ে পাইচন রান্না করা হয়। এই পাইচন বিষু’র অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ। বহুপদের সবজি দিয়ে এই পাইচন রান্না হয় বলে এর ঔষধিগুনও বেড়ে যায় বহুগুণ। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মুল বিষু’র দিনে পাইচন খেলে শরীরে যত রোগব্যাধি আছে সব চলে যায়। মূল বিষুর দিনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়োবৃদ্ধদের গোসল করানো হয়।

বিষু দিন সকলে নতুন কাপড় -চোপড় পড়ে, বুদ্ধ এবং ভিক্ষুদের জন্য আহার্য নিয়ে বিহারে যায়। প্রার্থনা করে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সমাজ, জাতি, দেশ এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল এবং সুখ-শান্তির, সমৃদ্ধির জন্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুয়ে আর্শীবাদ নেয়। বিষু দিনে সকলে সকলের বাড়িতে বেড়াতে ঘুরতে যায়। সকলে যে যার সাধ্যমতো খাবার এবং নাস্তা-পানির আয়োজন করে থাকে। সে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা- সাইন্ন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, মালি পিঠা, আলসী পিঠা, তেলের পিঠা, কলা পিঠা, কাঁকন চালের পায়েস  আয়োজন করে থাকে। সাথে মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকে। বিষু’র মূল আনুষ্ঠানিকতা তিন দিন হলেও পুরো সপ্তাহ দশদিন এর আমেজ থাকে গ্রামে এবং পাড়ায়।

এই অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ভাত খাওয়া, আর্শীবাদ অনুষ্ঠান, আহলপালানী উৎসবও হয়ে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য চর্চা

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। সাধক, ব্যাধি এবং আদি কবি শিবচরণ তাদের অনুপ্রেরণা। শিবচরণের রচিত “গোসাইন লামা” তাদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম ভিত্তি। পরবর্তীতে রাজকবি শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা যিনি তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যকে নতুন একটি মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর রচিত “ধর্ম্মধ্বজ জাতক” (১৯৩১) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গ্রন্থ। এছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার দিক থেকেও প্রথম।  ‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’ (১৯৩৩) তাঁর অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ। তিনি “চান্দোবী বারমাস, রুত্তি বারমাস,আলস্যা মেলার কবিতা এবং বিয়াল্লিশর ভাতরাদ” বারমাস রচনা করেন। তিনিই প্রথম হস্তচালিত প্রেস স্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা রাজ সভার সভাকবি বা রাজকবি ছিলেন তিনি।

লোকসাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোকসাহিত্যর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব রূপকথার গল্প আছে, আছে প্রবাদ-প্রবচন। ঘুমপাড়ানি ছড়াও আছে। সাথে আছে কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক অনেক পালাও। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, জুমকাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা ইত্যাদি।

পূজা-অর্চনা

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তাঁরা প্রকৃতিকে সেবা-যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা সরূপ নানা পূজা অর্চনা করে থাকে। তাঁরা মনে করে প্রকৃতির ভালোবাসা, আর্শীবাদ এবং আনুগত্য ছাড়া কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাস এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি করলে প্রকৃতি মাথা খুশি, সন্তুষ্ট হয় এবং আর্শীবাদ করে। এজন্য গাঙ পূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, মিত্তিনি পূজা,লক্ষ্মী পূজা, কে- পূজা এবং বুল পারা পূজাসহ বেশ কিছু পূজা-অর্চনা তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকে।

জুমচাষ, জীবন এবং জীবিকা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে জুমচাষ। জুমচাষ মূলতঃ মাল্টি এগ্রিকালচার। একই জায়গায় বহু ফসলের চাষ করা হয় এবং একটির পর একটি ফসল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই চাষের একটি বছরের সমাপ্তি হয়। জুমচাষ মূলতঃ বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত সময়। তবে এর দুই তিন মাস আগে থেকে জুম প্রস্তুতি অংশ হিসেবে জুমের জায়গা নির্বাচন, জুম কাটা, কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়া এবং পরিস্কার করতে হয়। এই জুম চাষে পুরুষ মহিলা সকলে একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।

এক সময় এই জুমচাষই তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র উপার্জন এবং জীবন- জীবিকার অবলম্বন ছিল। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের সাথে এই জুম প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা লেখাপড়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যও করছে অনেকে। আবার অনেকে ফলজ বাগান করে আয়-রোজগার করছে। আধুনিক কৃষির সাথেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া অনেকে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শুকর পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

জুমচাষ করতে হলে জুম কাটার স্থানে একটি জুমঘর তৈরি করতে হয়। জুমঘর মূলতঃ বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা আর কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে রাতে থাকা, জুমের নতুন ফসল মজুদ করণের উদ্দেশ্য এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। আর একজন জুম চাষীর তাঁর গ্রামের ঘর থেকে জুমের দুরত্ব যদি বেশি হয় সময় কমিয়ে আনা, কাজের সুবিধার্থেও এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। এই জুমঘর শুধু শস্য উঠা পর্যন্ত— মানে একবছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা জুমঘরকে ‘প্রবাস্যা ঘর’ও বলে থাকে।

বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা উচ্চ শিক্ষিত

কৃষকের পাশাপাশি, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, এমবিবিএস ডাক্তার, ডেন্টাল, হোমিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী জজ, সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন এবং নন-কমিশন অফিসার, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি সদস্য, যুগ্ম সচিব (অবঃ), ইউএনও, উপ-সচিব, দূতাবাসের ১ম কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (অবঃ), সাংবাদিকতাসহ নানা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে থেকে এযাবত মহান জাতীয় সংসদে দুজন প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমজন ছিলেন মালতি প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা (এরশাদ সময়কার), আর অন্যজন হলেন জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা ৩৪৮ আসনের সংসদ হিসেবে শপথ নেন। উভয়ের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়েরা দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে স্কলারশিপ নিয়েও বাইরে লেখাপড়া করছে। দেশের বাইরেও অনেকে চাকরি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

সম্পত্তি উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেরা পেয়ে থাকে। তবে ছেলে সন্তান না থাকলে মেয়েরা এর অধিকার পায়। স্বামী মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী যদি পূনরায় বিয়ে না করে তাহলে স্বামী সকল সম্পত্তি সে পাবে।

সামাজিক প্রথা

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধভাবে এবং গ্রামে বসবাস করে। তাদের গ্রামের প্রধান হলেন কার্বারী। তিনি গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচার এবং যেকোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তিনি মৌজা প্রধান হেডম্যান এর অধীন এবং হেডম্যান সার্কেল চীপ বা রাজার অধিনে কাজ করেন। গ্রামে বা সমাজে যেকোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা

ঘিলা খেলা, নাদেঙ খেলা, ধুধু খেলা, কুমির কুমির খেলা, গোল মরিচ খেলা, গাত্তয়া খেলা, গাইত খেলা, তেদোই বিচি খেলা, গোয়াং খেলা, পুত্তি খেলা, আংগী খেলা, তিং খেলা,লুআলুই খেলা, গুদু খেলা,বুলি খেলা,কক্কেমা বা খাবামা খেলা, শামুক খেলা এবং তুম্বুর খেলা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসকল খেলা বিশেষ করে ঘিলা এবং নাদেঙ খেলা অন্য সময় খেলা হলেও বিষু দিনে এর আকর্ষণ এবং আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন যুবক-যুবতীরা এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের এই খেলায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁরা অনেক আনন্দ মজা করে। বিবাহিত  পুরুষ এবং মহিলারাও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে।

সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, নাট্য সাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে সংগীত প্রিয়। এই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেক ঐতিহাসিক পালা পর্ব রয়েছে। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসকল পালাগুলো যারা সুর, তাল এবং সুকণ্ঠ দিয়ে পরিবেশন করতেন তারা হলেন চারণ কবি গিঙ্গিলি।

জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন গিঙ্গিলি আছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। তাঁর সময়কাল এবং আজ পর্যন্ত তাঁর সমমান কোন গিঙ্গিলি কোন আদিবাসী সমাজে বা জাতিতে জন্ম হয়নি। তিনি অন্ধ ছিলেন, এজন্য তিনি কানা গিঙ্গিলি নামেও সবার কাছে পরিচিত। তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল তিনি রাজগিঙ্গিলি ছিলেন। পরবর্তীতে ভাগ্যধন গিঙ্গিলি, দুলামন গিঙ্গিলি অনেক সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, আদি চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে নামডাক পরিচিতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা এবং আদিবাসী সমাজে। তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে দেশাত্মবোধক, রোমান্টিকসহ নানা ধাঁচের গান উপহার দিয়েছেন। তঞ্চঙ্গ্যা সংগীত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের ছোঁয়ায়।

গুনী শিল্পী হিসেবে দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনীলা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সুচন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যানি তঞ্চঙ্গ্যা, রিনি তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। পরবর্তীতে চম্পা তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যাকলিন তঞ্চঙ্গ্যা, সূর্যসেন তঞ্চঙ্গ্যা, অমিত তঞ্চঙ্গ্যা, সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রক শিল্পী হিসেবে বুলু তঞ্চঙ্গ্যা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে অনেক নৃত্য শিল্পী রয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। বাঁশি,ধুরূক, খিংকরং, শিঙা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নাট্য সাহিত্যে তঞ্চঙ্গ্যারা বহুদূর এগিয়েছে। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা নাটকের পুরোধা। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার হাত ধরে আধুনিক তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাঁর হাত ধরেই- “বর পরঙ, মন উকুলে, রত্নমালা” নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। “চানপুদি” নামে তাঁর একটি শিশু চলচ্চিত্রও ঢাকা শিশু চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করে দর্শক এবং সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বিবাহ পদ্ধতি

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিয়ে সাধারণত দুইভাবে হয়। অনুষ্ঠান করে বিয়ে এবং পলায়ন করে বিয়ে। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাকে ‘সাঙা’ বিয়ে বলে আর পালিয়ে করাকে ‘ধাবারা’ বিয়ে বলে।

সাঙা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবশীকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। আর ধাবারা বিয়েটে এসব কোন কিছুই হয় না। এই ধাবারা বিয়েটে অনেক সময় ঘরের সকল সদস্যদের (মা, বোন জানলেও) জানার সুযোগ থাকে না। তবে কনে এবং বর বিষয়টি অবগত থাকে, সাথে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।

ধাবারা বিয়ের জরিমানা হিসেবে বর পক্ষ কনে পক্ষকে শুকর বা সামান্য কিছু টাকা দিতে হয় যুব সমাজ এবং সামাজিক দাবী হিসেবে। বিয়ে নিয়ে কিছু ধরাবাঁধা এবং সামাজিক নিয়ম রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে। যেমন: নিজের আপন ভাই-বোনের মধ্যে, মাসি-পিসি, চাচা-চাচিকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অবৈধ একটি কাজ। আপন চাচাত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে অবৈধ। মামা, পিসি, মাসিত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ করা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি আছে।

এই একই সম্পর্কে বিধবা মেয়ে বা বিপত্নীকেও বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে বর কনে উভয়ে উভয়কে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী কিছু অলংকার দিতে হয়। তবে কি পরিমাণ দিতে হবে তার কোন নিয়ম নেই, দাবীও নেই। আর এর বাইরে বর কনে উভয়ে উভয় পক্ষ থেকে কোন কিছু দাবী করার পারিবারিক, সামাজিকভাবে দাবি করার কোন সুযোগ এবং নিয়ম নেই। দাবি করা ন্যায় এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিষয় যা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ এবং জাতিতে ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করে এতে জাতি, সমাজ এবং পরিবারের শৃক্সখলা নষ্ট হয়। জাতির অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়ার একটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তৈরি হয়।

অবস্থান ও বসতি

তঞ্চঙ্গ্যারা রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, জুরাছড়ি, কাউখালী উপজেলায় বসবাস করে। বান্দরবান জেলার মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, নাক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে রাঙ্গুনিয়া আর কক্সবাজার জেলার মধ্যে টেকনাফ, উকিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা, আগরতলা আর মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বসবাস রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তঞ্চঙ্গ্যারা স্থায়ী বা চাকরিসূত্রে বসবাস করছে।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি

এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র বা পদ্ধতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। বৈদ্য, কবিরাজ এবং কালেভদ্রে ভান্তেরা একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। বনজ গাছ-গাছড়া, বাকল, শেকড়, লতাপাতা, ফলমূল দিয়ে বানানো বনৌষধি নানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। বৈদ্য, কবিরাজগণ ঔষধের সমস্ত তালিক বা তালিকা নিজস্ব খাতায় বা নোটে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বৈদ্যরা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বান-টনা, আঙ ডালি, পূজা কর্ম দিয়েও নানা রকম চিকিৎসা করতো। তাছাড়া তখনকার সময়ে চিকিৎসায় একমাত্র সম্বল ছিল এই বৈদ্য এবং কবিরাজরা। বর্তমান সময়ে এসেও আদিবাসী সমাজে বৈদ্য, কবিরাজের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।

নারীর অবস্থান

আদিবাসী জনগোষ্ঠী মতো তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও অনেকটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে থাকেন।

তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে মিলেমিশে জুম, ক্ষেতে খামারে কাজ করে থাকেন। তবে গৃহস্থালি কাজগুলো মেয়েরা বেশির ভাগ সময় করে থাকে, পুরুষরাও সহযোগিতা করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমমর্যাদা ভোগ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পরেই তাদের অবস্থান।

নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর সকল প্রকার ভরণপোষণ স্বামীর নিকট থেকে সে পেয়ে থাকে। যদি স্বামী দিতে অপারগ করে বা অস্বীকৃতি জানাই তাহলে সে চাইলে গ্রাম প্রধান বা কার্বারী নিকট আইনগত আশ্রয় চাইতে পারে। স্ত্রীর অমতে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করলে প্রথম স্ত্রী সতীনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মতি জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী ভিটায় বা বাবার বাড়িতে অবস্থান কালীন সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব সে স্বামী থেকে পাবে। যদি সেও দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করে সেটি আর পাবে না।

বর্তমানে এসে সময় এবং যুগ পাল্টে গেছে অনেক। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে এবং তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তাঁরাও এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতায়। তাঁরা নিজের পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাঁরাও পরিবারকে সুন্দরভাবে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে এবং রাখছে। এটি সৃষ্টি মানবজাতির জন্য সুন্দর একটি দিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি এবং সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে তঞ্চঙ্গ্যারাও অংশগ্রহণ করে। দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাঁরা। সমতল থেকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নির্যাতনে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে আসা শত শত বাঙালি পরিবারকে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অসুস্থ রোগীকে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। নাম না জানা অনেক তঞ্চঙ্গ্যা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন সরকারি গেজেটেড এবং ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি কাপ্তাই কাপ্তাইয়ের উপজেলার ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার আগুনিয়াছড়া গ্রামে। তিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য  যুদ্ধ করেছেন।

শ্রীমতি গনমালা তঞ্চঙ্গ্যা, স্বামী- ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা, বাড়ি রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ইউনিয়নের তাইতং পাড়া যৌথ খামার গ্রামে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

স্বভাব এবং সামাজিক মূল্যবোধ

তঞ্চঙ্গ্যারা স্বভাবে শান্ত, নম্র এবং ভদ্র। তাঁরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ, পালন ও আচরণ করে। অপরের সাথে রাগ, বদমেজাজ স্বরে কথা বলে না। কথা বলার মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে চলে। স্বভাবে একঘেয়েমিতা নেই। কথায় কথায় মুখে অসুন্দর শব্দ, বাক্য প্রয়োগ করে না এবং করা থেকে বিরত থাকে। চেহেরার মধ্যেও একটা প্রকৃতিকতার আবেদন আছে।

সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে অন্যান্য চিকিৎসার মতো নবজাতক জন্মদান এখন নিরাপদ এবং সহজ হয়ে উঠেছে।

একসময় তঞ্চঙ্গ্যা তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সন্তান জন্মদান ভগবানের কৃপা এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল সকলে। তখন গ্রামে “অসা বুড়ি”(ধাত্রী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়ার সাথে থাকতেন। তখন সাবান, ব্লেড বা ছুরি কাঁচি পরিবর্তে বাঁশের ধারালো কঞ্চি দিয়ে কাটাছেঁড়া কাজটি সম্পূর্ণ করা হতো এবং ভুত্তোয়া লতা নামক একধরনের লতার কান্ড দিয়ে সাবান বা পরিস্কারের কাজটি ছাড়তে হতো। নিমপাতা সিদ্ধ করে সন্তান প্রস্রবের স্থানটি পরিস্কার করা হতো।

সন্তান জন্মদানের সাত দিনের মাথায় একটি অনুষ্ঠান করা হয়, যা ‘কসুই পানি লনা’ নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠান না হওয়া আগ পর্যন্ত নতুন মাকে ঘরের সকল কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়। মূলতঃ এসময় নতুন মা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘরের কাজ পুনরায় করার অনুমতি পান। এই সময় অসাবুড়িকে  কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ স্বরূপ কিছু নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়া হয়। তাঁকে যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। গ্রাম প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করা হয় এসময়। তাঁরাও নতুন অতিথি এবং মায়ের জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেন। পরবর্তী ঘরের সদস্য সকলে মিলে জন্মবার এবং পঞ্জিকা দেখে সন্তানের জন্য সুন্দর একটি নাম রাখেন।

ছয় মাস পর বিহারের বড় ভান্তের হাত দিয়ে এবং আর্শীবাদ নিয়ে বা ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তাঁকে মুখে প্রথম ভাত খাওয়ানো হয়।

মৃত্যু, সৎকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা

মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। দাহ করার আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো হয়। এরপর “বিয়াঘর” তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে ঐ ঘরে রাখা হয় (বিয়াঘর মূলতঃ শ্মশান যাত্রার আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে রাখার অস্থায়ী ঘর)

পরবর্তীতে বাঁশ, তার, দড়ি বা রশি এবং নানা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা মন্দির সাদৃশ্য ‘প্যারাসাইট’ নামক একটি প্যাটিকায় আবদ্ধ করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকে অশ্রুজলে বিদায় নিয়ে জগত সংসারের সকল আনুষ্ঠানিকতা মেনে এবং ছেড়ে কাঁধে বহন করে চিদাকলায় (শ্মশান) নিয়ে যাওয়া হয়।

ছেলেদের শ্মশান সাজানো হয় পাঁচ ধাপ/টাক দিয়ে আর মেয়েদের সাত ধাপ বা টাক গাছ দিয়ে। নদীর গতিপথ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির মাথা এবং পা কোন দিকে হবে সেটি নির্ণয় করা হয়। নদী বা ছড়া যদি উত্তর থেকে দ¶িণ দিকে নেমে যায় তাহলে মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে শুয়ানো হবে মাথা উত্তর দিকে করে আর পা দক্ষিণ দিক করে। দাহ করার পরদিন পরিবারের এবং আত্মীয় -স্বজন গিয়ে মৃত ব্যক্তির ধাতুগুলো(হাড়) খুঁজে নিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নদীতে বিসর্জন বা ভাসিয়ে  দেওয়া হয়। নদীতে গিয়ে ঘাটের উভয় পারের টাকা-পয়সাও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তি যেন বিনা বাঁধায় তাঁর সুপথে গমন করতে পারে।

দাহ করার সাত দিনের মধ্যে ভালো একটি দিন দেখে সাপ্তাহিক সংঘদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ শান্তি এবং সদ্গতি কামনা করে। সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানকে তঞ্চঙ্গ্যারা ‘সাতদিন্যা’ বলে। এই দিনে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য “চেরাগঘর” নামে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের পরম আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্য গৃহহীন যেন না থাকে এই উদ্দেশ্য ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাথে মৃত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার জন্য তৈরি করে দওয়া হয় “তামাঙ-ত ঘর”।

সংঘদানে ভিক্ষু সংঘকে ফাঙ বা দাওয়াত করা হয় সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া- প্রতিবেশীকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য আয়জন করা সকল খাবার রাত বারোটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয়। যদি থেকে থাকে এগুলো নদীতে পেলে দিতে হয়। কাউকে দেওয়া যায় না। ছোট বাচ্চাদের উক্ত সংঘদানে অংশগ্রহনে নিরুৎসাহিত করা হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের ছোট সদস্য ছাড়া।

সংঘদান অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তোলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক এবং বস্তুগত উপাদান দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে। এই সহযোগিতা তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সামাজিক এবং নৈতিক একটি দায়িত্ব বলে মনে করে। মৃত দুধের শিশুকে দাহ করা হয় না, তাঁকে কবর বা দাফন করা হয়। এই কবরকে ‘পআকাবা’ বলে।

উপসংহার

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নিজেদের সংস্কৃতিকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা আরো বিশ্বাস করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষায় নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

জুম, পাহাড়, ছড়া, ঝিরি -ঝর্ণার মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃপ্রেমে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির উপাদানসূহ সকলের সাথে বিনিময়ের পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিনগুলো। দেশ, জাতির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে এবং সংকট প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে চাই সকলের সাথে মিলেমিশে হাতে হাত রেখে।

লেখকঃ “পহর জাঙাল” প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা, সম্পাদক, প্রকাশক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, নাট্যকার ও ভাষা গবেষক”

তনচংগ্যাদের সামাজিক বিবাহ আইন

————– ————— ————— ——
তনচংগ্যারা বিয়ে বা বিবাহকে “সাঁ” বা “সাঙা” বলে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সচরাচর দু’রকমের বিবাহ দেখা যায়।
(ক) সামাজিক বিবাহ /নিয়মিত বিবাহ ও
(খ) পলায়ন বিবাহ/ অনিয়মিত বিবাহ।

ক. সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ:

সামাজিক বিবাহ হলো যেটা পাত্র পাত্রীর অভিভাবক বা পিতা মাতার সম্মতিতে এবং সামাজিক রীতিতে বিবাহ সম্বন্ধ ধার্য করা হয় অথবা পাত্র পাত্রী পরস্পর পছন্দের মাধ্যমে অভিভাবক সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাকেই সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ বলা হয়। সামাজিক বিবাহ আবার দুধরণের হয়।

(১) প্রথাসিদ্ধ বিবাহ:

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সামাজিক বা প্রথাসিদ্ধ বিয়ে বহুবিদ আনুষ্ঠানিকতায় আড়ম্বরভাবে হয়ে থাকে। এ বিয়ের ধারাবাহিক কার্যাবলী এরকম হয়ে থাকে। তেম্মাঙ (শলাপরামর্শ), বউ পুছা গরানা (বৌ দেখতে যাওয়া, দাভা (নূন্যতম কিছু অর্থ ধরা হয়), সাজনী বা বোয়ালী সামগ্রী (সাজার জন্য অলংকার বা পোশাকাদি), বউ হছা যানা (বৌ আনতে যাওয়া), জামাই তুলানা (জামাই বরণ), ফংগুরি দেনা (স্বামী স্ত্রী বন্ধন), সেফ ফুদা লনা (আশীর্বাদ নেওয়া), খানা সিরানা (খাবারদাবার সম্পন্ন), বউ লামাই দেনা ও বউ তুলানা (বাপের বাড়ি হতে বউকে বিদায় এবং জামাই বাড়িতে বরণ। তবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে লক্ষণীয় যে স্বামীও নিজের স্ত্রী আনতে যায়। উক্ত অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন বাধ্য কারণ এগুলি রীতিসিদ্ধ এবং তনচংগ্যা সংস্কৃতির অংশও বটে।
(২) ঘরজামাই তুলে বিয়ে:
ঘরজামাই তুলে বিবাহ এরকম এখনো তনচংগ্যা সমাজে কম চোখে পড়ে। এটাও প্রথাসিদ্ধ ও নিয়মিত বিবাহ বলে ধরা হয়। তবে এ ধরনের বিয়ে এত্ত আড়ম্বরপূর্ণ হয়না, কনের পিতা বরের কাছে কোন ধরনের দাভা ও সাজনী সামগ্রী দাবি করে না। কনের বাপের বাড়িতে পাত্রকে ঘরজামাই তোলাত পর সামাজিক নিয়মানুযায়ী সাঙা বা সাঁ করা হয়।

খ. পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ দু’রকমের হয়ে থাকে, প্রথমত হল ছিলানী বিবাহ (সাঁঙ) আর দ্বিতীয়ত হল বউ ঘরে উঠে বিবাহ।
(ক) ছিলানী বিবাহ (সাঁ বা সাঙা)- যুবক যুবতী বা প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের মনোমিলনে এবং তাদেত অভিভাবকদের অসম্মতিতে অথবা এক পক্ষের সম্মতিতে প্রথাসিদ্ধ নিয়মের বাইরে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ (ছিলানী সাঁ) বলে। সাধারণত যুকব যুবতী পালিয়ে গিয়ে দূরে কোন এক আত্মীয় বাসায় আশ্রয় নিতে হয়। এরপরে আত্মীয়ের মারফতে পিতামাতাকে খবরটা জানানো হয় যে ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছে। এতে পরে গ্রাম্য শালিস হয়, গ্রামের যুবক যুবতীদের পক্ষে যুব প্রধান বা মুরব্বিরা মানে যুবতীর সমাজ যুবক (প্রেমিক) পরিবার বা তার কাছে কিছু অর্থ দাবি করে, যেটা অনেকটা অর্থদণ্ড হিসেবেও বলা যায়। তবে অর্থদণ্ড যেটা বলা হয় বেশি মোটা অংকের হয়না অনেক সময় গ্রামের মানুষেত মনোভাব ও সামর্থ্য বিবেচনায় রাখে।
(খ) বউ ঘরে উঠে বিবাহ:
অনেক সময় পরিবারের অজান্তে মেয়ে পালিয়ে যায় স্বামীর ঘরে। তবে এখানে কিছু কারণ আছে অনেক সময় পরিবারের সামর্থ্য অভাবে নিয়মিত বিবাহ পদ্ধিতে কার্যসাধন সম্ভব নয়, তাই পালিয়ে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে ফেলা হয়। এতে অল্প ক’জন গণ্যমান্য বা মুরব্বি ডেকে আশীর্বাদসহ খাবার পরিবেশন করলেই বিয়ের কার্য সমাপ্তি হয়।
তবে হ্যাঁ, প্রত্যেক বিয়ের কার্যসম্পাদনের মধ্যে ভান্তেদের মাধ্যমে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করা হয়। এতে সাংসারিক জীবন সুন্দর ও মঙ্গলময় হয় বলে তনচংগ্যারা বিশ্বাস করে।

উপরিউক্ত আলোচিত বিবাহের বাইরে আরো বেশ কিছু প্রচলিত অপ্রচলিত বিবাহ পদ্ধতি বিবাহ চোখে পড়ে। যেমনঃ
ক) কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ, খ) মিশ্র বিবাহ গ) অসাঙ্যা / নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ, ঘ) বিধবা বিবাহ।

ক. কোর্ট ম্যারেজ মূলত:

আদালতের কোন প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক তনচংগ্যা সমাজে ইদানীং কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত অভিভাকদের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্চুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে মিলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক -এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রাচীনকালের মনোমিলনের পলায়নের আধুনিক সংস্করণ “কোর্ট ম্যারেজ”। যদিও এটি মাত্র শপথনামা, কিন্তু আইনত এ বিবাহ অনলঙ্ঘনীয়ও নয়।

খ. মিশ্র বিবাহ:

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অন্যান্য জনগোষ্ঠী সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে মিশ্র বিবাহ বলে। মিশ্র বিবাহ বন্ধন সচরাচর তনচংগ্যা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে দৃশ্যমান। এই বিবাহের নেতিবাচক ইতিবাচক দুটো দিক আছে। বিশেষকরে পরবর্তী প্রজন্মে তার বেশ প্রভাব পড়ে এবং তুলনামূলক ভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকীস্বরূপ।

গ. অসাঙ্যা/নিষিদ্ধ বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজের প্রথা অনুসারে নিষিদ্ধসম্পর্কিত আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং তার শাস্তিস্বরূপ শুকর জরিমানা দিতে হয়। গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধে শাস্তি হচ্ছে অর্থদণ্ড। কাকে বিয়ে করা যাবে কাকে বিয়ে করা যাবেনা তার বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো।

ঘ. বিধবাবিবাহ:

তনচংগ্যা সামাজিক প্রথামতে বিধবাবিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা নারীও আবার বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারের বা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একত্রে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরণপোষণ পাবার অধিকার রাখে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামী ও শ্বশুর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে পূর্বস্বামীর সম্পত্তি পাবার অধিকার হারায়। তনচংগ্যা সমাজে একজন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ সামাজীকভাবে রীতিসিদ্ধ। তবে পূর্বেকার মতো দ্বিতীয় বিয়েটাও পিতা বা ভাইয়ের বাড়ি থেকে সম্পন্ন করতে হয়।

এবার আলোচনা করা যাক তনচংগ্যা সমাজে বৈধ অবৈধ বিবাহ কোনগুলিঃ
১. বৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
বিবাহের বেলায় ঘনিষ্ঠ কিংবা দূর সম্পর্কের কোন মামাতো, পিসতুতো, মেসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ হতে পারে। বড় ভাইয়ের শ্যালিকা, বড়বোনের ননদ কিংবা বড়ভাই মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে। শ্যালিকা বা সম্বন্ধীয় বিধবা বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে এবং একই পরিবারভুক্ত না হলে পিতামহ বা মাতামহ সম্পর্কিত নাতি নাতনি মধ্যে বিবাহ হতে পারে।

২. অবৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
সহোদরা ভাগ্নি, বিমাতা, ভাগ্নি, ভাইঝি, মাসি, মামী, পিসী, চাচী, জেঠি ইত্যাদি সম্পর্কীয় হলে বিবাহ করা চলেনা। সহোদর ভ্রাতাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে, একই পিতা মাতার ঔরসজাত ছেলেমেয়ের মধ্যে, স্ত্রী বড়বোন অথবা স্ত্রী বিমাতা, স্ত্রী ভাইঝি ইত্যাদি বিবাহ চলেনা এবং সামাজিকভাবে তা নিষিদ্ধ।

[তথ্য সহযোগিতায় এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা; সভাপতি, সদ্য নির্বাচিত জেলা আইনজীবী সমিতি রাঙামাটি]

The first Tanchangya artist Mr. Ratikata Tanchangya

Roti kanta

The most popular artist in Chittagong Hill Tracts is Mr. Rati Kanta Tanchangya. He is the son of Shikol Chand Tanchangya and a grandson of the richest man named Mr. Nikunja in Tanchangya community, born on 23rd of month Jesta in 1347 Bengali Year (June 6,1941) at the bank of Rainkyong,  Boradam village under the sub-district of Bilaichhury, Rangamati, Bangladesh. He is father of three sons namely, Dibyendo Tanchangya, Anupom Tanchangya, and Dipankar Tanchangya. During his service he worked in the department of agricultural expansion. 

Recognition 

Due to his dedicated service at Fine Art, he was awarded as Great Artist from the President of Bangladesh Ziaur Rahman on 1st January, 1981. Moreover, according to the examination of Bangladesh board, he has passed the examinations Sutta, Vinaya, and Abhidhamma. In 1978 he received the title of Visvakarma  from Venerable Sadhanananda (Vana Bhante). He is also recognized as a song composer of Bangladesh Radio Station in Rangamati  in Tanchangya, Chakma and Bengali.  In 1990 through Raja Devashis Rai, he was awarded as Artist and Writer in Gauhati, India. 

Contribution and Responsibilities 

Ratikanta Tanchangya introduces himself not as an artist rather as an art admirer. In 1979, he solely established the Charukola Akaedmy (Fine Art Academy), first academy in Chittagong Hill Tracts. This is the first Fine Art Academy in three Hill Districts that has established without any support  from government.  He has been supervising Rangamati Charukala Academy (Academy of Fine Arts) since 1979. Although in Chittagong Hill Tracts there were Jumma artists, practiced art before him but he was the first  person who took an initiative of teaching art to Jumma children. He not only practiced art but also had a vision of making like minded people in Jumma community. His success was indicated by many national and international prizes won by his students, while they were learning and practising art at his institute. His institution is not only changing and forwarding Jumma society, introducing art to Jumma culture but also bringing international fame for the country.  Besides his artist passion, he is also a prolific writer  and a regular columnist on Tanchangya history and culture in Bengali newspaper. 

On the one hand Mr. Ratikanta is an artist, on the other he is a song writer and poet. In 2007 during the caretaker government of Fakhruddin Ahmed, he chaired  a neutral person, member of Rangamati District Council. He is currently acting as the Chief and Principal of the Fine Arts Academy (Charu Kola Akademy) in Rangamati.

A writer being Artist

While painting arts, he also writes books. Every one of his books is well-acclaimed  and informative. His published books in Bengali are:

  1. Painting (চিত্রা) ( a book on fine art)- 1986.
  2. An Introduction to Tanchangya (original manuscript)- 1995.
  3. Tanchangya Tribe-2000
  4. Song Book (গীত পোই) in Tanchangya, Chakma and Bengali- 2008.
  5. Fine Art Practice- 2011
  6. Autobiography- 2012
  7. An Illuminated Tanchangya Buddhist Monk-2018.

He keeps writing time to time until now. He is not only a great person to Tanchangya tribe, but for the whole Chittagong Hill Tracts. His contributions towards Tanchangya tribe and the whole indigenous communities worth to be acknowledge.

কবি ও সাহিত্যিক বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

Tanchangya porichiti.jpg

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যে যেসকল মানুষের বিচরণ ছিল বা আছে তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা একজন অন্যতম। তাঁর পরিচয় ঘটে বিশেষত তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথার লেখনীতে। তিনি গ্রন্থ ছাড়াও আমৃত্যু লিখে গেছেন বিভিন্ন সাময়িকীর প্রকাশনায়। তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লেখকের পরিচয় জানা যাক-

লেখকে জন্মকথাঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৩৭ সালে ১৩ এপ্রিল তৎকালীন রাঙামাটি থানায় অন্তর্গত ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজ্যমণি তঞ্চঙ্গ্যা মাতার নাম রতিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা। পিতামাতার দুইপুত্র, এক কন্যার মধ্যে বীরকুমার সর্বকনিষ্ঠ। শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ ১৯৫৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ওই বছর কানুনগো পাড়া আশুতোষ কলেজেপড়ার সুযোগ পান। সেই কলেজ থেকেই তিনি আই.এ পাস করেন। এরপরে আর আর্থিক অভাবে পড়ার সম্ভব হয়ে উঠেনি তবে পরবর্তী তে ত্রিপিটকের “সুত্ত ও বিনয়” উপাধি পালি ও সংস্কৃত বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথমে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে চাকরি করেন, পরে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা প্রশাসনে অফিস সুপার পদে থেকে চাকরি অবসর নেন।

লেখকের সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী ছিলেন। আর পরবর্তীতে তার চাকরি কর্মস্থল রাঙামাটি হওয়ায় সাহিত্যচর্চাটা বেশ ভালো ভাবে কাজে লাগান। ১৯৮৬ সালের দিকে শ্রী মদন মোহন দেওয়ান কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক “পার্বত্য বাণী” তে প্রথম সংখ্যায় “কালিন্দী” নামক ইতিবৃত্তমূলক একটা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশ পায়। এটায় শ্রী বীরকুমারের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ বলা যায়। এভাবে পরে রাঙামাটি পাবলিক লাইব্রেরি হতে তৎকালীন প্রকাশিত “অঙ্কুর” রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বনভূমি” খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত “পার্বতী”তে তাঁর বহু গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত নাটক “রুনুখাঁর উপাখ্যান” মঞ্চস্থ নাটক “অমিতাভ” যেটা গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্বলিত এবং ১৯৬৭ সালে রাঙামাটি মৈত্রী বিহারের মাঠ প্রাঙ্গণে সাফল্যের সাথে মঞ্চায়ন হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর রচিত চাকমা নাটক “মুড়া যেক্কেনে কানে” নামক নাটকটি নানিয়ারচর উপজেলায় কৃষ্ণমাছড়া গ্রামে মঞ্চস্থ হয়। “রক্ত তিলক” (জুমল্যান্ডের রাজকন্যা) নামক একটা নাটক রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট (তখন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট) গিরিনির্ঝর-এ প্রকাশিত হয়েছে। স্বদেশ ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বোধিভারতী” সাময়িকীতে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা বেতার কেন্দ্রের রাঙামাটি আঞ্চলিক শাখার গানের লেখক ও কথিকা ছিলেন। “ঢোলক/একতারা” শীর্ষক স্থানীয় আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বেতারে প্রতি মাসে প্রথম ও চতুর্থ সপ্তাহে প্রচারিত হতো। এখন আর প্রচারিত হয়না।

অবদান স্বীকৃতিঃ

সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য রাঙামাটি জেলাপরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য অঞ্চল ২০০১ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২৭ চৈত্র ১৪১৩ সালে “উপজাতীয় সামাজিক ফোরাম” শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠন “অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” সাহিত্য অবদানের জন্য এ গুণী লেখককে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।

সাহিত্যিকের লেখা বই ও নাটকঃ

১. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (গ্রন্থনা)

২. তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা।

৩. রক্ততিলক (নাটক)

৪. ভাগ্যরত্ন।

পরলোকগমনঃ

তঞ্চঙ্গ্যা ও আদিবাসী সমাজে সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণকারী ১২ নভেম্বর ২০১৪ সালে নিজ বাসায় রাঙামাটি দক্ষিণ কালিন্দীপুরে এ গুণী লেখক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর এ মৃত্যুতে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী তথা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ একজন গুণী ও প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিককে হারায়। যা খুব কম সময়ে তাঁর শূণ্যস্থান পূরণ হবার নয়। গোটা পার্বত্য অঞ্চলে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা ও লেখনীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সাপ্রে বা দৈনাক টং-চং-য়্যা বিবরণ

Tongলেখকঃ- শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, প্রতিষ্ঠাতা- রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমি।
লেখা- ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ বই হতে নেয়া।
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে উত্তর দক্ষিণে প্রলম্বিত ৫০৯৩ বর্গ মাইল আয়তন বিশিষ্ট এক বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল গভীর অরণ্য, হিংস্র প্রাণীকুল এবং দুর্গম পাহাড়ঞ্চল। এখানে পাহাড়িদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের আগমন, নির্গমন এবং অবস্থান অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত।এ সর্ম্পকে ইংরেজরা কেন, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি বাঙালীরাও কিছুই জানতো না। এমনকি বর্তমানে ও এ অঞ্চলের ইতিহাস সবার কাছে অনুঘটিত রয়ে গেছে। অতীতে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমগ্র অঞ্চলটি কিরাট ভূমি নামে পরিচিত। পরবর্তী কালে আরাকান সীমানা পর্যন্ত কুকিল্যান্ড হিসেবে পরিচিতি ছিলো। এর পর ইংরেজ শাসনামলে চট্টগ্রামের এই পার্বত্য জেলাকে কার্পাস হল বলা হতো।
ভারতের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু রাজ্য ছিলো।এসব রাজ্যে পশ্চিমাঞ্চলের বিদেশীদের আগমন শুরু হয় ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজগণের রাজ্যে সমুহের কোন সার্বভৌম শাসন ক্ষমতার অস্তিত্ব না থাকায় তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা ও শত্রুতা বিরাজমান ছিল। এই অনৈক্য আত্মকলহ এবং তাদের মধ্যে বংশ, গোত্র, উঁচু নিচু বর্ণের ভেদাভেদ থাকার কারণে ভারতের উপর বিদেশীর বিজয়কে সহজতর করে তোল। ফলে বহু রাজা বশ্যতা স্বীকার করিছিলেন আর ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এসব কারণে উত্তর পূর্ব ভারতে বসবাসরত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী দক্ষিণ পূর্ব দিকে ক্রমে অগ্রসর হতে শুরু করে।
এভাবে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা এক একটি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে তোলে স্বাধীন জীবন যাপনের উদ্দেশ্য সাদেংগীর ধার্মিক ও তার আলোকিত ছিলো বলে গেংখুলীদের গীতের ভাষায় শোনা যায়। রাজা সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করে কালাবাঘা(বর্তমানে কুমিল্লা জেলা) রাজ্যের জালি পাগজ্যা (১)নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়।
সাদেংগীর মূত্যুর বহু বছর পর এই বংশে বিচগ্রী নামে উত্তরসূরী রাজা চেৎ-তো গৌং (চট্টগ্রাম) শাসন করেছিলেন বলে চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীন আমল) মাহবুব রহমান এর পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে। অনেকের মতে চাদেংগীর জৈষ্ঠ পুত্রের নাম বিচগ্রী (২)। যাইহোক বয়প্রাপ্ত হবার সাথে সাথে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন কুমার বিচগ্রী। উক্ত সময়ে চট্টগ্রাম দক্ষিনাঞ্চল সহ রোয়াং (আরাকান) অবধি শাসন করতেন অক্সারাজা। পার্শবর্তী দেশের রাজাগণের কাছে অজানা ছিলোনা তাঁর সৈন্য শক্তি ও পরাক্রমের কথা। এদিকে বিচগ্রী সৈন্য সংগ্রহ করে কোন এক শুভদিনে তিনি বেড়িয়ে পড়লেন অক্সারাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে। সেনাপতি হিসেবে রাধামন ও জয়রাম দুই বিচক্ষণ যোদ্ধা। যুদ্ধের উভয় পক্ষের বহু লোকের হতাহতের পর অবশেষে অক্সারাজা পরাজিত হয়ে বার্মায় পলায়ন করেন।
যুদ্ধ বহু বৎসর অবতীর্ণ হবার পর বিচগ্রী তার পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি ও প্রতিবেশীর কথা মনে পড়ে প্রাণ কেঁদে ওঠে। তাই তিনি বিজয় আনন্দ উল্লাসে একদিন স্বদেশের দিকে রওনা দিলেন। স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তনের আগে পথে শুনতে পেলেন তার বৃদ্ধ পিতার মৃত্যু হয়েছে, ছোট ভাই উদগ্রী স্বঘোষিত রাজা হয়ে তাঁকে স্বদেশ ফেরার পথে বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সংবাদ পেয়ে বিচগ্রী খুবই মর্মাহত হন এবং অনুজের দুরভিসন্ধি ও বিশ্বাস ঘাটকতায় তিনি স্বদেশের স্বজাতির মুখ দর্শন করতে না পেরে পুনঃরায় তাঁর অধিকৃত রোয়াং রাজ্যে অর্থাৎ আরাকানে ফিরে যান। ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে সেখানে স্থায়ী বসবাস, রাজ্য শাসন ও বংশ রক্ষার জন্য সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ন জাতীয় রমনী বিবাহ করেন। আবার অনেকেই স্বদেশে গিয়ে স্বজাতি রমনী বিবাহ করেন। এভাবে রোয়াং রাজ্যে এজাতির বসতি স্থাপন গড়ে ওঠে।
রাজা বিচগ্রী অপুত্রক ছিলেন। সম্ভবতঃ সম্রাট অশোকের মতো কলিঙ্গ বিজয়ের যে রক্তপাত হয়েছিলো তেমনি বিচগ্রীর শেষ জীবনে ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন রক্তপাত দেখে এবং তার অনুসারীগণ, সবাই বৌদ্ধ ধর্মে পুরোপুরি দীক্ষিত হন। বিচগ্রীর মৃত্যুর পর বহু বছর পর্যন্ত আরাকান আরাকানের কিছু অংশ তাদের অধীনে ছিলো। উত্থান পতনের মধ্যে পরবর্তীতে চাপ্রে নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যাই হোক চাপ্রে এই পরিব্যাপ্ত শব্দটি শত শত বছরে স্মৃতি এবং আরাকানী ইতিহাস গ্রন্থেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সা-প্রে অর্থ চাকমা রাজ্য। তবে চাপ্রে বা সাপ্রে বলতে শুধুমাত্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে বুঝায়। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাতটি গছা বা গোত্রের মধ্যে দৈন্যাগছা, মংলা গছা ও ম্মেলংগছার লোকদের এখনো সবাই চাপ্রে নামে অভিহিত করে আসছে এবং নিজেরাও চাপ্রে কুল্যা বলে দাবি করে আসছে।
[গবেষকদের মতে বিচগ্রী, উদগ্রী ও সমগ্রী নামে তিন ভাই। চাকমাদের ভাষায় বিজয়গিরি, উদয়গিরি ও সমরগিরি। আবার ত্রিপুরাদের রাজঁমালা ইতিহাসের মতে দেখা যায় বিজয় মানিক্য, উদয়মানিক্য ও অমর মাণিক্য নামে ত্রিপুরা রাজা ছিলেন। ত্রিপুরা জাতির সেনাপতির নাম, কালানজির, রণগণ ও নারায়নের সংগে আমাদের সেনাপতি কালাবাগা, রাধামন ও জয়রামের অদ্ভুদ মিল দেখা যায়।]
চাকমা ইতিহাস মতে ১৩৩৩-১৩৩৪ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানে বার্মা শাসকের সাথে চাপ্রে জাতির রাজা অরুণ যুগের ভীষণ যু্দ্ধ হয়। উক্ত সনে ১৩ই মাঘ ১০,০০০ সৈন্য এংখ্যং ও ইয়াংখ্যং নামক এলাকায় বসবাস করেন এবং আরাকান রাজা তাদের কে দৈনাক বা দৈংনাক অর্থাৎ অস্ত্রধারী যোদ্ধা নামে আখ্যায়িত করেন।
অক্সারাজার সাথে চাপ্রেদের একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। বার্মারাজ মেঙ্গদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চাপ্রেরাজ যে ফন্দি করেছিলেন তা লোক প্রবাদ নিম্নরূপঃ-
চাপ্রেরাজের তুলনায় মেঙ্গদি রাজের শক্তি বহু বেশী। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন বন্ধুত্ব ভাব দেখানোর ছাড়া কোন উপায় নেই।তাই বন্ধুত্ব ভাব দেখিয়ে অতর্কিত আক্রমনের উদ্দেশ্য চাপ্রে রাজ একটি চুনমাখা হস্তী মেংদিরাজকে উপহার পাঠালেন। এতে মেঙ্গদিরাজ খুবই সন্তুষ্ট হন। কিছুদিন পর হস্তীর শরীর প্রলেপ দেয়া চুনের সাদা আবরণ ধরে যেতে শুরু করলো তখন মেঙ্গদিরাজ বুঝতে পারলেন এটা আসল নয় , নকল শ্বেহস্তী। তিনি আর দেরী না করে চাপ্রেগণের উপর নির্যাতন শুরু করেন।
কথিত আছে,- উক্ত সময়ে মেঙ্গদির লোকেরা খাজানা উশুল করার নামে চাপ্রেদের গ্রামে গিয়ে পুরুষদেরকে পিছ মোড়া বেঁধে গৃহের আঙ্গিনায় ফেলে সারা রাত নির্যাতন করা হতো। আর স্ত্রীলোকদের দিয়ে মদ তৈরী করিয়ে সেই মদ পান করতঃ তাদের কে যথেচ্ছা পাশবিক অত্যাচার চালাতো। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে গভীর অরণ্যপথে চাপ্রের অধিকাংশ লোক চট্টগ্রামে আলিকদম নামক স্থানে পালিয়ে আসেন। উক্ত সময়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা জামাল উদ্দীন এর অনুমতি ক্রমে ১২ খানি গ্রামের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করেন। উক্ত ১২ খানি গ্রামকে বলা হয়েছিল বারতালুক। এই বারটি গ্রামের ১২টি তালুক বা দলের নাম তাদের বৈশিষ্ট্য ও আচারনের উপর রাখা হয়। যথাঃ- ১. দৈন্যাগছা, ২. মোগছা. ৩. কারবুয়া গছা, ৪. মংলাগছা, ৫. ম্মেলাংগছা, ৬. লাংগছা, ৭. অঙ্যগছা এবং অবশিষ্ট পাচঁটি তালুক বা গছা উল্লিখত গছার সাথে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো বা পরবর্তীতে চট্টগ্রামে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা জাতিতে অন্তর্ভূক্ত হন। কিংবা পুনঃরায় আরাকানে চলে যান বলে মনে হয়।
মেঙ্গদিরাজ চাপ্রে রাজার পরমা সুন্দরী কন্যা চমিখাকে বিবাহ করেন। চমিখার চৌজু চৌপ্রু ও চৌতু নামে তিন জৈষ্ঠ ভ্রাতা ছিলো।তাদের মধ্যে চৌপ্রু শাসন করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে কখন কোথায় তা সঠিক জানা নেই। যাই হোক কনিষ্ঠ ভ্রাতা চৌতুর পুত্র ক্যাংঘরে মৈসাং (শ্রমণ) হন। যখন মেঙ্গদির অত্যাচারে স্বজন নিয়ে পালাতে শুরু করতে লাগলেন তখন মৈসাংকে গোচরীভূত করা হয়েছিলঃ-
যেই যেই বাপ ভাই যেই যেই
চম্পক নগরত ফিরি যেই
এল মৈসাং লালস নাই
ন-এলে মৈসাং কেলেস নাই।।
ঘরত থেলে মগে পায়
ঝাড়ত্ গেলে বাঘে খায়
মগে নপেলে বাঘে পায়
বাঘে ন পেলে মগে পায়।।
অতঃপর আরাকানে বসবাসরত দৈনাক নামে জাতিরা প্রাণের ভয়ে চট্টগ্রামে দিকে পালিয়ে আসেন। উক্ত সময়ে উত্তর চট্টগ্রামে স্বজাতীয় লোকের বসবাস ছিলো। তাদের মধ্যে দলপতি মোগলের অনুকুলে খাঁ উপাধি ধারণ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় শাসন করতেন। মোগলের অধীনে সেই সব শাসনকর্তাকে রাজাও বলা হতো। যাইহোক, আরাকান থেকে পালিয়ে আসার সময় অনেকে লাল বা খয়ের বর্ণ একটুকরা কাপড় খন্ড শরীরে পেছিয়ে মৈচাং অর্থাৎ বৌদ্ধ শ্রমণ সেজে ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং দীর্ঘপথ অতিক্রম করেন। কেননা, অক্সানামে লোকেরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। সুতরাং লাল খয়েরী বর্ণের পোশাক ও মুণ্ডিত মস্তক দেখলে তারা আক্রমণ করতো না। আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে আসা ও সব মৈসাং বেশধারী অনেকেই এভাবে থেকে যাই। চট্টগ্রামে বাঙ্গালীরা তাদের কে ডাকতো ‘রোলী’ (১)। পরবর্তীতে এঁরা চাকমা জাতীর একমাত্র ধর্মীয় পুরোহিত লাউরী নামে সমাদৃত হন বলে মহাপন্ডিত কৃপাচরণ মহাস্থবির কর্তৃক সম্পাদিত ও কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘জগৎজ্যোতি’ (১৯১৭) পত্রিকায় উল্লেখ্য করেছেন। চাকমা রাজন্যবর্গ ও তাদের ধারাবাহিক ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে সহজে প্র্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী থেকে শুরু করে সাত্তুয়া (পাগলারাজা) পর্যন্ত যে সব রাজা ছিলেন তারা ‘রোয়াঙ্যা’ চাংমা আর ধাবানা থেকে বর্তমান সময়ে রাজা পর্যন্ত আনক্যা চাংমা নামে পরিচিত। তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি লেখক শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার মতে চন্দ্র ঘোনার দক্ষিণ পূর্ব বা চট্টগ্রামে শঙ্খ নদীর দক্ষিণে রোয়াং বা আরাকান পর্যন্ত বসবাসকারী গণেরা ‘টংসা’ (আরাকানের ভাষায় টং অর্থ দক্ষিণ বা পাহাড়, সা অর্থ সন্তান, সা অর্থ চাংমা)। এর অর্থ এই হতে পারে পূর্বদিকে পাহাড়ি সন্তান বা পূর্ব দিকে পাহাড়ী চাংমা। আবার চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের কে বলা হতো ‘আনক-সা’। আনক্ অর্থ আরাকানিদের ভাষায় পশ্চিম। আনক-সা অর্থ পশ্চিম কুলের চাংমা। এ ব্যাপারে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান মহোদয়ের পুরোপুরি একমত রয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছিলেন চৌদ্দ শতকের আগে আমাদের পূর্ব পুরুষের পরিচয় ছিলো ওভাবে। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয়ে নয়। তিনি ইহা ও মন্তব্য করেন, ধাবানা রাজা হয়ে চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের স্বজাতিদের কে নিয়ে চাংমা জাতির সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে চাকমা নামে স্বতন্ত্র করার প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।
যতই অস্বীকার করিনা কেন, আমাদের ইতিহাসে ও ঐতিহ্য সৃষ্টি হয় আরাকান থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। আমাদের পূর্বপুরুষের আগমন ও অবস্থান দেখে আরাকানিরা হেঁয়ালিভাবে বলতে শুরু করে ছিলো চাংমাং বা চামা এবং তংসা। পরবর্তীতে বিভক্ত শব্দ দুটির মধ্যে একটি চাংমা/চাকমা, অপরটি তংচংয়্যা/তনচঙ্যা/তঞ্চঙ্গ্যা রুপান্তরিত হয়। অনেকে দাবির মতে শাক্য থেকে চাকমা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছিল। লুইনের মতে, চেইং পেংগো অর্থাৎ চম্পক নগর থেকে আগত বলে চাকমা নাম ধারণ করা হয়। বাবু সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা উপজাতি গবেষণা পত্রিকায় উদ্বৃতি মতে,- এ বিশ্বাস বংশ পরম্পরায় চলে আসলেও এ ধারণা কেবল মাত্র অনুমান। ত্রিপুড়া জাতি ‘রাজমালা’ পুস্তকের কতে “অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ে শব্দটি এখন ও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ‘চাকমা’ নামে উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিপুরাদের প্রাচীন রাজমালা পুস্তকে”। রাজমালার প্রথম লহড়, ৩২ পৃষ্ঠা- কৈলাস চন্দ্র সিংহ।
ক্যাপ্টেন টি, এইচ লুইনের ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর লিখিত তথ্য মতে দেখা যায়, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যে সব উপজাতি বসবাস করে তাদের নিম্ন লিখিত নামে শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথাঃ-
১. “খ্যংথা” বা নদীর সন্তান। এরা নদীর তীর বর্তী স্থানে বসবাস করে বলে থ্যাংথা নামে পরিচিত। তারা নিঃসন্দেহে আরাকানি বংশ উদ্ভুত, প্রাচীন আরাকানি উপভাষায় কথা বলে এবং সর্বক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে।
২. “টং থা” বা পাহাড়ের সন্তান। এরা মিশ্র জাতি উদ্ভুত। এদের মাতৃভাষা বাংলা, তবে নানা ধরণের উপভাষায় কথা বলে সন্দেহাতীতভাবে খ্যাংথাদের চাইতে অশিক্ষিত। এই শ্রেণীর মধ্যে ত্রিপুরা, চাক, খ্যাং ও মার্মা তাদের গোষ্ঠীর অর্ন্তগত। খ্যাংথাদের পাশাপাশি এরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরন করে। খ্যাংথা ও টং থা শব্দ দুটি আরাকানি ভাষার শব্দ খ্যং অর্থ নদী, টং অর্থ পাহাড় এবং “ থা” বা “সা” (Tsa)অর্থ সন্তান বা পূত্র। পাহাড়ের উপজাতীয়দের চিহ্নিত করার জন্যে এইসব জাতিগত নাম কেবল আরাকানি উপভাষা। উপজাতিরাই এভাবে ব্যবহার করে। অন্যান্য উপজাতিরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজেদের বা প্রতিবেশীদের পরিচয় দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ী উপজাতিয়দের বৃহত্তর অংশ নিঃসন্দেহে পায় দুই প্রজন্ম পূর্বে আরাকান থেকে এখানে আসে। চট্টগ্রাম কালেক্টরেটে রক্ষিত দলিত পত্রাদি ও ইতিহাস ঐতিহ্য একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। ১৮২৪ খৃঃ বার্মা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওসময় পর্যন্ত উপজাতিয় বহু শরণার্থী আরাকান থেকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে। উক্ত সময়ের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরা, মগ, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খ্যাং, মুরুং, চাক, খুমি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিলনা।
তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা এই উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু হয়। প্রতীয়মান হয় যে, আরাকানে অবস্থানরত বহু চাপ্রে অর্থাৎ চাংমা নামের লোকেরা এককালে তৈনছড়ী কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দের দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলে রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ী থেকে একটি নদীর নাম হয়েছিলো বলে স্থানীয় প্রবীনদের মতামত রয়েছে। আবার ত্রিপুরা জাতির ভাষায় গাং, নদীকে তৈ বলা হয়। সুতরাং রাজা তৈন সুরেশ্বরী ত্রিপুরা ছিলেন। ত্রিপুরাদের মধ্যে এখনো রোয়াংগ্যা ত্রিপুরা ও আনক ত্রিপুরা নামে শব্দটি প্রচলন রয়েছে। যাইহোক, তৈ হতে তৈনচংয্যা দুটি উৎপত্তি একথাও পুরোপুরিভাবে ভূল নয়। কেননা, ত্রিপুরা জাতির গাবিছা সম্প্রাদায়ের মহিলাগণের পড়নের পিন্ধন ও বুক কাপড় আর তঞ্চঙ্গ্যা মহিলাগণের পড়নের পিন্ধনও বুক কাপড় সম্পূর্ণরূপে মিল রয়েছে। শ্রী মাধব চন্দ্র চাকমা রচিত “শ্রী শ্রী রাজনামা বা চাকমা রাজন্যবর্গ (১) পুস্তিকায় আংশিক উদ্বৃত মতে জানা যায়, চাকমারা দুটি অংশে বিভক্ত। একটি রোয়াংগ্যা চাকমা ও অপরটি আনক্যা চাকমা।
তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রাদায় ছিলো। রাজা হিসাবে ধাবানা শাসনকালে চাকমা নামে পৃথক একটি জাতির সংস্কার গড়ে তোলেন বলে উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা নামের শব্দটি কি নামে সম্বোধন ছিলো তা গবেষণায় ব্যক্ত করতে পারেননি। আমাদের এই জাতিরা পূর্বে কথা-বার্তা, গঠন প্রণালী, পূজা অর্চনা, বিষু উৎসব, জন্ম, বিবাহের চুমলাং পোষাক পরিচ্ছেদ, সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি আসামের অহমীয়াদের প্রাচীন সস্কারের সাথে অনেকাংশে মিল ছিলো একথা প্রমানিত করেছিলেন। তঞ্চঙ্গ্যাগণ শত শত বছর আরাকানে অতিবাহিত করেছিলেন এবং তথাকার কৃষ্টি সংস্কৃতি অনুসরণ ও অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের পূর্ব পুরুষের অতীত বৈশিষ্ট্যতা হারিয়ে ফেলেননি। বার্মা সরকার বর্তমান সময়ে তাদের কে চাকমা জাতি স্বৃতি দিয়ে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে আসছে বলে প্রত্যক্ষভাবে জানা যায়।
মোগলের অধীনে চট্টগ্রামের উপর খণ্ড খণ্ড শাসন কর্তা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চাকমা রাজা নামে কথিত এমন শাসক হিসাবে যাঁরা পার্বত্য জাতির উপর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই ভাগ্যদেবতা বলা যায়। তাঁরা মোগলের সাথে হৃদবন্ধনের ফলে অনুকম্পা লাভ করেন এবং খাঁ পদবী ধারণ করে ইংরেজ আমল পর্যন্ত তাদের প্রভূত্ব বিকাশ পায়। যার কারণে ক্ষমতায়, সুযোগে, শিক্ষায় এমনকি দর্পেও বিস্তার পায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরূপে বিবেচিত হয়। এরপর তাদের অভিযাত্রী জীবন প্রবাহ নিভে যেতে শুরু করে, এ জাতির ইতিহাস বিহিন করুণ আর্তনাদ নিরবে নিভৃত্বে মিলিয়ে যায় দূর বন পাহাড়ে।
আরাকানে ভূসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যকত, তানদুয়ে, মাম্রা সহ আর কয়েকটি এলাকায় চাকমা নামের তঞ্চঙ্গ্যাদের গোষ্ঠী গোজার লোক প্রাচীনকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। চট্টগ্রামে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে কক্সবাজার জেলাধীন রামু, উখিয়াও টেকনাফ থানায় এবং বান্দরবান জেলার নাক্ষ্যংছড়ী ও আলিকদমে এখনো তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্ব পুরুষগণ বসবাস করে রয়েছেন। ইতিহাসের তথ্যমতে তারাই দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গ্রী), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধন নামের উত্তরসুরি বংশধর বা যোদ্ধার বংশধর ছিলেন। যুদ্ধভিযানে অগ্রসর হয়ে তারা আরাকানে ও তার আশে-পাশে বসবাস শুরু করেছিলেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা নামে ক্যাত ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিলো।
ধরমবক্স খাঁ ওসব আগমনকারীদেরকে স্বজাতি বলে গ্রহণ না করার পেছনে উক্ত সময়ে কিছু কিছু প্রভাবশালীগণের কঠিন বাধা ছিলো বলে জানা যায়। আগমণকারীদের উপর যথেচ্ছা চুরি ডাকাতি ও জুলুম করা হয়েছিলো বলে শোনা গিয়েছে। যার কারণে তারা দলবদ্ধভাবে রাইংখ্যং, কাপ্তাই, সুবলঙের উজানে, ঠেগা, শঙ্খ শেষ প্রান্তে, ত্রিপুরায়, লুসাই হিলৈ এমনকি পুনঃ মাতামুহুরী ও আরাকানে চলে যেতে বাধ্য হন। চাকমাগণ উক্ত সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কে অভিহিত করতেন পরঙী অর্থাৎ বসবাসের জন্য আগমণকারী।
ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন কতৃক লিখিত পুস্তক THE HILL TRACTS OF CHITTAGONG AND DWELLERS THEREIN (1869) এর মতে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে এ জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যায় ছিলো ২৮০০ জন। এদের মধ্যে অনেক বয়স্ব ব্যক্তি আরাকানি ভাষায় কথা বলতে পারে কিন্তু নতুন প্রজন্ম বৃহৎ অংশের সাথে মিশে যাচ্ছে আর এক বিকৃত ধরণের বাংলা ভাষা তাদের যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে প্রাধান্য লাভ করেছে। এরা কিন্তু সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ধর্ম চুৎ হয়নি, তবে প্রকৃত পূজারী একথাও নিঃসন্দেহে বলা চলে। তিনি আরো উদ্বৃতি দিয়েছেন ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমলে ৪,০০০ জন তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন। এ দলের রাজা ছিলেন ফাপ্রু। স্থায়ী বসবাসের জন্য তিনি তার দলের প্রত্যেকের কাচে চাঁদা উঠিয়ে পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুঠির ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দিয়েছিলেন বলে এখনো কথিত রয়েছে।
আরাকানে ভুসিডং এলাকা থেকে আগত ধল্যা চাকমা [১] অভিমত ব্যক্ত করেন, চাকমা রাজা হিসাবে ধরমবক্স খাঁন যখন রাজা হলেন এই সংবাদে খুশি হয়ে সংথাইং আমু নামে জনৈক বিত্তশালী ও দলের নেতা হিসাবে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাজা ধরমবক্স খাঁনের সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানান। কিন্তু ধরমবক্স খাঁন তার আবেদন প্রত্যাখান করেন। নিজের ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হবার মনোভাবে তিনি আর দেরী না করে পুনঃ আরাকানের উদ্দেশ্য গমন করেছিলেন। যাত্রার সময় বীরবেশে সিঙাল (গয়ালের কিংবা মহিষের শিং এর ধ্বনি) ও ঢোলক বাজিয়ে এ অঞ্চল ত্যাগ করেছিলেন বলে কথিত রয়েয়ে।
একইভাবে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নেতা শ্রীধন আমুর নেতৃত্বে ৩০০ শত তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন। রাজা ধরমবক্স খাঁ কে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য উপঢৌকন দিয়ে বসবাসের সম্মতি লাভ করেন। পরঙী নামে এই তিনশত পরিবার সবাই সচ্ছল ছিলেন এবং তারা রাইংখ্যং নদীর তীরবর্তীতে পুনঃবসতি স্থাপন করেছিলেন। সচ্ছলতার কারনে তাদের উপর বার বার ডাকাতি লুটপাট করা হতো বলে বুড়া-বুড়িদের মুখে শোনা গিয়েছে।
চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর আমলে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু সংখ্যক লোক অন্যত্র চলে যাবার পেছনে আরো একটি ঘটনা রয়েছে। অগ্রাহায়ন মাসের কোন একদিন তঞ্চঙ্গ্যাদের ধৈন্যা গছা আর কারবুয়াগছার লাপাস্যা দলের মধ্যে ঊয়্যা পৈ নামে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান কে কেন্দ্র করে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ফলে উভয় পক্ষের বহু লোক হতাহত হয় এবং রাজ দরবারে বিচারের সম্মূখীন হন। এই ঘটনার পর অনেকেই অন্যত্র চলে যান। তাদের মধ্যে গছা ভিত্তিক দ্বন্ধের জন্য বিবাহ সাদি বন্ধ হয়ে যায়।
তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকানের অধিবাসী, আরাকান থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলো এ কথা পুরোপুরি সত্য নয়। তারা চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের দিকে কিছু অংশ চলে গিয়ে দৈনাক সম্বোধিত হন। অন্যদিকে চট্টগ্রামে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বদিকে অধিকাংশ স্থানে তাদের স্বাধীনভাবে বসবাস ছিলো। অন্যান্য উপজাতীয়দের মতো নিজস্ব আইন শাসনের মধ্যে গভীর বনাঞ্চলে জুম চাষই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা।[ধল্যা চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা) ৩রা জানুয়ারী ১৯৯৯ ইং রাঙ্গামাটি আসেন।বাড়ি আরাকানে ভূসিডং ইউনিয়নের মিজং গং চো এ। বয়স ৫৫ বৎসর।ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে সুপন্ডিত। বার্মা ভাষায় শিক্ষিত। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা বিষয়ে গবেষণার জন্য রাঙ্গামাটিতে আসেন। ধল্যার মতে আরাকানে তাদের বসবাস প্রায় ৭ শত বছর। রাঙ্গামাটিতে এসে চাকমাদের পোষাক, চেহারা, আচরণ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।]
তাই তঞ্চঙ্গ্যাগণ মোগলধর্মী রাজার কিছু কিছু সামাজিক আইন মানতে রাজী ছিলোনা। যেমনঃ (ক) কোন তঞ্চঙ্গ্যা রমনীর মৃত্যু হলে তাকে পশ্চিম দিকে মাথা রেখে পুড়িয়ে ফেলা। (খ) লুরী বা লাইরী নামের ধর্মগুরু দিয়ে অন্তোষ্টিক্রিয়া কিংবা সামাজিক কর্মাদি করা। (গ)মহিলাগণের এককানে পাঁচটি করে দুই কানে দশটি ছিদ্র করা, পড়নের পিনুইনে চাবুগী রাখার পার্থক্য ইত্যাদি। সম্ভবতঃ ওসব সামাজিক কিছু কিছু নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলো বলে চাকমা রাজা উক্ত সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে স্বজাতি বলে স্বীকৃতি না দেয়ার অন্যতম কারন বলা যেতে পারে।
আরাকানে অবস্থানরত চাকমাগণ(তঞ্চঙ্গ্যাগণ) শাক্য বংশের উত্তরসূরী হিসেবে তদানিন্তত জেনারেল উনু প্রতিবৎসর এ জাতির দম্পতি রেঙ্গুনে আমন্ত্রন জানিয়ে সম্বর্ধনা দিতেন। বর্তমান সময়েও আদিবাসী জাতি হিসাবে সরকার তাদের কে প্রতিবছর আমন্ত্রন জানিয়ে রেঙ্গুনে শাক্যজাতির সম্মানে সম্বর্ধনা দিয়ে আসছে বলে জানা যায়। ধল্যা চাকমা বলেন, আরাকানে অবস্থানরত চাকমা নামে পরিচিত মুগছা, ধৈন্যাগছা, কারবুয়াগছা, ল্লাংগছা, মগলাগছা এবং অঙ্যগছা ছাড়া কোন চাকমা গছা নেই। ১৯৮৫ ইং সনে লোকগণনায় দেখা গিয়েছিলো আরাকানে ৯২,৩০০ জন চাকমা(তঞ্চঙ্গ্যা) রয়েছে। ইহা ছাড়া ত্রিশ হাজারের মতো বার্মায় বসবাসের ফলে বর্তমানে তারা বার্মীজ সম্প্রাদায়ের সাথে মিশে যান। তাদের মধ্যে বুড়াবুড়িরা কিছু কিছু তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় কথা বলতে পারে, ভুসিডং নিবাসী ধল্যা এ কথা বলেন।
চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ খুবই প্রতিপত্তি সম্পন্ন রাজা ছিলেন। তাঁর শাসনামলে পরবর্তী কালের রাজাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের তঞ্চঙ্গ্যাগণের উপর অভিন্নতা মনোভাব ও সদাচারণ এমন কি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেননি বলে জানা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন মৌজা নির্ধারন ও বন্টন করা হয় তখন পাঁচ জন তঞ্চঙ্গ্যা কে মৌজার হেডম্যান পদ দেয়া হয়েছিলো।
নিরহংকার, অসাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাজা ভূবণ মোহন রায় শ্রেষ্ঠ করি হিসাবে শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে ‘রাজকবি’ এবং শ্রেষ্ঠ উবাগীতের ধারক বাহক শ্রী জয় চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (কানাগিংখুলী) কে ‘রাজগীংখুলী’ উপাধিতে ভূষিত করে প্রতি বছর রাজপূণ্যাহের উপলক্ষে রাজসভায় যোগ্যতার আসনে উপবিস্থ করে রাখতেন। তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐসময় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শ্রী কুঞ্জ মহাজন ও শ্রী খোক্কেয়া বৈদ্যের সাথে রাজা ভূবন মোহন রায় গভীর সর্ম্পক ছিলো বলে জানা যায়। রাজকুমার নলিনাক্ষ রায় স্বজাতির মেয়ে বিবাহ না করে জটিলাদেবী নামে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির রমনীকে বিবাহ করা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আংটি পরিয়ে দেন। এ ব্যাপারে পাত্রপাত্রি ও অন্যান্য স্বজনদের সাথে রাজা পরামর্শ করেন। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে চাকমাগণের বৈবাহিক সম্পর্ক অসম্ভব ও অস্বাভাবিক বিধায় রাজবংশের মান সম্ভ্রম বিষয়েও বিবেচনা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে যায়। নলিনাক্ষ রায়ের পর কুমার ত্রিদিপ রায় রাজা হয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভিক্ষু শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে ‘রাজগুরু’ পদে অধিষ্ঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম উদিত হয় এবং ধর্ম বিস্তার এক অকল্পিত স্বাক্ষর বহন করে।
———————————————————–

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির আদ্যেপান্ত

তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বর্তমান সম্পর্কে কোনো তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস রচনাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কেবলমাত্র চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। তাও অনুমান নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে চাকমা জাতির একটি শাখা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যাদের পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে। চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমার একটি শাখা হিসেবে স্বীকার করে। এমনকি আসল বা মূল চাকমাও বলে থাকে। কিন্তু আশ্চার্য্যের বিষয় এই যে, চাকমাদের যে গোজা গোষ্ঠী রয়েছে সেসব গোজা গোষ্ঠীর সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের বারোটি গোজা বা গোষ্ঠীর নামের সঙ্গে কোনো মিল নেই। চাকমা জাতির ইতিহাস রচয়িতারা তাদের রচিত ইতিহাসে এমনকি আধুনিক চাকমা লেখকরা তাদের চাকমাজাতি বিষয়ক রচনায় তঞ্চঙ্গ্যাদের গোজা গোষ্ঠী বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির নাম চাকমাদের গোজা গোষ্ঠী বা আচার অনুষ্ঠান বলে উল্লেখ করেন না। যদি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা একই জাতিভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়। হিন্দুরা বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্ম বা সনাতন ধর্ম বলে দাবি করেন, তাই তথাগত বুদ্ধকে হিন্দুদের অবতার (দশম অবতার) রূপে পূজা করেন। যদিও হিন্দুধর্ম আর বৌদ্ধধর্ম দুইটা দুই মেরুতে অবস্থান করছে। চাকমা জাতির উত্থান পতন, জয় পরাজয়, আশা আকাঙ্খা, সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা, অভিযান অগ্রগতি বা সমবৃদ্ধির বিবরণীর সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। কেবলমাত্র ইতিহাসের শো’কেসে তঞ্চঙ্গ্যাদের পুতুল বানিয়ে আবদ্ধ করেই রাখা হয়েছে।

ইতিহাস ও অবস্থান

তঞ্চঙ্গ্যা নামের দৈংনাকেরা বৌদ্ধ এবং তারা মায়া নদীর (মায়ু) উর্ধ্বভাগে বসবাস করেন। তাদের ভাষা বিকৃত বাংলা। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চাকমা এবং দৈংনাকদের একসঙ্গে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়। ধর্ম এবং ভাষার সাদৃশ্য থাকাতে উভয় জাতিসত্ত্বার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মৈত্রী থাকার কথা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। আরাকানবাসীদের সঙ্গেও দৈংনাকদের কোনোরূপ দ্বন্দ ও সংঘাত ছিল না। অন্ততঃ ইতিহাসে কোনো দ্বন্দের উল্লেখ নেই। আরাকান ও উচ্চব্রহ্মে অপরাপর মঙ্গোলীয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর দৈংনাকরা অন্যতম তা প্রাচীন আরাকান ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন- ‘প্রাচীন আরাকান রাজ্য ছিল মোঙ্গল, তিব্বত ব্রহ্ম জনগোষ্ঠী ও মুরুং, খুমী, চাক, সিন, সেন্দুজ, ম্রো, খ্যাং, ডইনাক, মারুমিউ প্রভৃতি কিরাত উপজাতি অধ্যুষিত দেশ।’

ধর্ম

দৈংনাকরা যে বৌদ্ধ তা ‘হিসটোরি অব বার্মা’ রচয়িতা তৎকালীন আরাকান বিভাগের কমিশনার ফেইরী উল্লেখ করেছেন। তাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র ত্রিপিটক ছিল। চাকমারাও বৌদ্ধ। শত অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হলেও তারা আরাকান ত্যাগের সময় বৌদ্ধ ধর্মকে ত্যাগ করেনি। তাদের পরবর্তী ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা আরাকান ত্যাগ করার প্রাক্ক্বালে ধর্ম‌শাস্ত্র সঙ্গে বহন করেছিল। কিন্তু মূল ত্রিপিটক দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অথবা তাদের কাছে না থাকাতে তারা মূল ত্রিপিটক সঙ্গে নিতে পারেনি। দৈনন্দিন কাজে বা মৃত্যু, বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারোপযোগী প্রয়োজনীয় সূত্র মূল ত্রিপিটক হতে লিপিবদ্ধ করে নেয়।

বসবাস

কথিত আছে চাকমারা চট্টগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করলে আলীকদম ও আরাকানের বহু দৈংনাক স্ব-জাতীয় বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকমাদের সান্নিধ্যে বসবাস করার উদ্দেশ্য তত্র অঞ্চলে চলে আসে। আলীকদম থেকে কিছু দৈংনাক নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও বর্তমান কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। অদ্যাবধি সেই সব জায়গায় তারা বসবাস করছে। উত্তরদিকে আসার পথে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, হোয়াকক্ষ্যং, রাজবিলা, শুকবিলাস, বাঙ্গালহালিয়া, নারানগ্রী, কাপ্তাই উপত্যকা অঞ্চল, নোয়াপতং, রাইংখ্যাং উপত্যকা সম্পূর্ণ অঞ্চল, হোয়াগ্গা, বড়াদম, ঘাগড়া, রইস্যাবিলি এসব অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।

চাষাবাদ

তখন সমতল জমিতে কৃষি পদ্ধতি সবেমাত্র আরম্ভ হয়। অধিকাংশ প্রজারাই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। দৈংনাকরাও জুমচাষী ছিল। চাকমা রাজ সরকারের জুম তৌজিতে তাদেরকে চাকমা উল্লেখ না করে তৈনটংগ্যা (অধিকাংশ আলীকদমের তৈনছড়ি থেকে আগত বলে) নামে উল্লেখ বা তৌজিভুজ করা হল। তৈনটংগ্যা শব্দটি ক্রমে ক্রমে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ এই লিখিত রুপ লাভ করে।

 

লিপিকা রানী বড়ুয়া 
ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম

ডেইলি বাংলাদেশ/জেএমএস

https://www.daily-bangladesh.com/%E0%A6%A4%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4/76473

ভাগ্যের সন্তান তঞ্চঙ্গ্যাগণ

লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে চতুর্থ স্থানের অধিকারী তঞ্চঙ্গ্যাগণ সর্বাধিক ভাগ্যবান বলে মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর জনগোষ্ঠী সমূহের শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম ও আর্থসামাজিক যে অগ্রগতি সাধন হয়েছে, জনসংখ্যায় কম হলেও তঞ্চঙ্গ্যাগণ সে অগ্রগতির মানদণ্ড অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের কতিপয় ব্যক্তিত্ব ধর্মীয় ও সাহিত্য ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
কোন ব্যক্তি বা জাতি যখন নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে, সমগ্র বিশ্বের আলোকে নিজেকে দেখতে আরম্ভ করে তখনই তার অন্তরে জাগরণ শুরু হয়। জাগরণের উজ্জ্বল রেখা বেয়ে সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল উৎসব তার মাঝে সমাবিষ্ট হয়। সেই ব্যক্তি বা জাতি সার্থক হয়। পরম ভাগ্যবান।

তঞ্চঙ্গ্যার সুযোগ্য সন্তান শ্রী ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু জীবনে উপসম্পদা গ্রহণ করতঃ শীমৎ অগ্রবংশ ভিক্ষু (বর্তমানে মহাস্থবির) নামে বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) বৌদ্ধ দর্শন ও ত্রিপিটকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। বার্মায় ১৯৫৪ সাল হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতি (আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ধর্ম মহাসম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয় এবং শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির অন্যতম সংগীতিকারক (ধর্ম বিশ্লেষক) হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময় স্বধর্মপ্রাণ চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তাঁকে চাকমা রাজগুরু রূপে বরণ করার জন্যে স্বদেশে আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেন। তিনি বিদর্শন ও পালি ত্রিপিটকে এম. এ. ডিগ্রি গ্রহণ করে ত্রিপিটকাচার্য্য অভিষিক্ত হন।
উল্লেখ্য যে, তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিন মাস পরে তাঁর ধর্ম বিনয় রাজগৃহে সপ্তাপর্নী গুহায় অরহৎ মহাকাশ্যপ স্থবিরের নেতৃত্বে পাঁচশত অরহৎ কর্তৃক সংকলিত বা সংগৃহীত হয়। ইহা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে প্রথম সংগীতি নামে অভিহিত হয়েছে। এভাবে মাঝে মাঝে সম্মেলনী বা সংগায়নের মাধ্যমে তথাগত বুদ্ধের ধর্ম ও বিনয় পরিশুদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। এযাবৎ ছয়বার এরূপ ধর্মসংগীতি বা ধর্ম সংগায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এই ধর্ম মহা সম্মেলনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এরকম গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম মহাসম্মেলনীর অন্যতম সংগীতিকারক হিসেবে যোগদান করে শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির তঞ্চঙ্গ্যাগণকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করেছেন। তাঁকে ঐ সম্মেলনে তৎকালীন পাকিস্তানী বৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সদ্ধর্মপ্রাণ চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় সর্বাত্মক সহয়তা প্রদান করেন। বিশ্বের ক্ষুদ্রতর বৌদ্ধ সম্প্রদায় চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা এই গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম সংগীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সমগ্র বিশ্বে নিজেদের মর্যাদা সুমন্নত করেছে। দ্রষ্টব্য: The Chattha Sangayana Souvenir Album. পৃষ্ঠা – ৮৫।
বিংশ শতাব্দী তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য প্রথম সৌভাগ্য বহন করে এনেছে। তঞ্চঙ্গ্যাগণ ভাগ্যের সন্তান। কেননা, এত ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী অতিস্বল্প সময়ে সমগ্র বিশ্বের সদ্ধর্ম পুজারীর শুভেচ্ছা ও মৈত্রী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরের জন্য আত্বনিয়োগ করেন এবং অচিরেই অনেক চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা যুবক উপসম্পদা গ্রহণ করেন এবং চাকমা গ্রামে ক্যং বা বিহার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
উল্লেখ্য যে, তৎপূর্বে চাকমা সমাজে আগরতারা অবলম্বন করে লুরীগণ বিবাহ অনুষ্ঠান, মৃতদেহের সৎকার ও অন্ত্যেষ্টী ক্রিয়া, ভাতদ্যা প্রভৃতি সামাজিক ও ধর্মীয় অনষ্ঠানাদিতে পৌরহিত্য করত। বৌদ্ধধর্মের মূল আদর্শ অনুসারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির বিষয় লোকে একদম বিস্মৃত ছিল।
চাকমা রাণী কালিন্দী ১৮৫৬ সালে থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের সংঘনায়ক শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবিরকে রাজগুরু পদে বরণ করে এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের পূনর্জাগরন এনেছিলেন। পরবর্তীকালে একশত বৎসরের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম পরিহীন হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে সদ্ধর্ম প্রবর্ধক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে রাজগুরু পদে বরণ করে পুনরায় এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম পূনর্জাগরণের মহতী উদ্যোগ নেন। ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে মহাস্থবির পদে বরণ করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং নেপালের রাষ্ট্রদূত শ্রী কিস্তিনিধি কিস্তা (পরবর্তীকালে নেপালের প্রধানমন্ত্রী) সস্ত্রীক যোগদান করেন। রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবিরের প্রচেষ্টায় এতদঅঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পূনর্জাগরণ কি আশ্চার্য্যজনকভাবে সম্পন্ন হয় চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় তাঁর Buddhist Revival in the Chittagong Hill Tracts শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রবন্ধে চিত্তাকর্ষকভাবে সুন্দর বর্ণনা প্রদান করেছেন: Kalindi’s reforms had far reaching effects not only on the Chakmas but also on the Marmas and Buruas. Since her time, Buddhism has gradually advanced at the expense of animist and other non-Buddhist practices. However, the number of Chakma monks and monasteries in the Chakma country were still far-smaller than in the case of the Barua and the Marma. The great change in the Buddhist practices of the Chakmas came in the 1950’s almost exactly a hundred years after Rani Kalindi and Sangharaja Saramedha. In 1958, at the invitation of the Chakma Raja Tridiv Roy, the venerable Agravamsa Thera (now Mahathera) came to Rangamati to be appointed the Chakma Raj Guru. In 1959, “The Parbatya Chattagram Bhikkhu Samiti”, was established under the Rajgurus leadership and the number of monasteries. These effects were felt even among the smaller peoples such as Mro and Khyang. The Rajguru remained in Rangamati upto 1976 and the Buddhists of Chittagong Hill Tracts recall the venerable Agravamsa’s name with much gratitude. The learned Pali scholar and exponent of the Tripitaka who studied in Burma for more than ten years has left behind a rich legacy. (দ্রষ্টব্য: বিংশতিতম কঠিন চীবর দান স্বরণিকা ’৯৩। রাজবন বিহার, রাজবন, রাঙ্গামাটি পৃ: ৪৬, ৪৭) রাজা দেবাশীষ রায় মহোদয়ের এই বক্তব্যে রাজগুরু শ্রীমৎ অংগ্রবংশ মহাস্থবিরের অবদানের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি এবং তাঁর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়ছে।

চাকমা সমাজে স্বদ্ধর্মের পূনর্জাগরণের মূলে শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবিরের মহান অবদানের জন্য চাকমাগণ তাঁর কাছে ঋণী একথা অকপটে স্বীকার করা হয়ে থাকে। লক্ষণীয়; – সত্যকথা বলতে হলে ২০/২৫ বৎসর পূর্বে চাকমা সমাজে কঠিন চীবর দানের নানা বিধি বিধান জানা ছিলনা। অন্যান্য ধর্মাচরণ বিধিও খুব যে জানা ছিল তাও নয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (তখন স্থবির) বার্মায় শিক্ষা সমাপন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখনকার চাকমা প্রধান স্বনামধন্য মেজর ত্রিদিব রায় সঙ্গে সঙ্গে তখন তাঁকে রাজগুরু পদে বরণ করে নেন। ইহা সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে, সর্ব প্রথম তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই চাকমা সমাজে ধর্মের জাগরণ আসে। শীল পালন, উপসথ গ্রহণ, চীবর দান, সংঘদান ইত্যাদি বিষয়ে আমরা তাঁর কাছেই প্রথম পাঠ নিই। তখনকার দিনে অবশ্য পূর্বে বর্ণিত তৃতীয় প্রণালী মতে পূর্বে প্রস্তুত চীবর দিয়েই কঠিন চীবর দান করা হত। কিন্তু সেই যুগে তাও কম ছিলনা। আর এভাবে তাঁর কাছে হাতেখড়ি না নিলে পরবর্তীকালে বনভান্তের মত মহাসাধকে বুঝার মত, গ্রহণ করার মত আমাদের সামর্থ হতনা। এযেন অনেকটা মহাসাধক মুক্ত পুরুষ বনভান্তের কল্যানময় আবির্ভাবের জন্যই আগে ভাগে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখা। (দ্রষ্টব্য: “বুদ্ধ প্রশংসিত কঠিন চীবর দান ও আধুনিক বৌদ্ধ সমাজ, শ্রী বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, প্রাক্তন সম্পাদক, রাজবন বিহার পরিচালনা কমিটি; বৃহতের সন্ধানে। শ্রীলঙ্কা সরকার কর্তৃক উপহার প্রদত্ত বোধি বৃক্ষ চারা রোপণ ও শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ ভিক্ষু (বনভান্তে) মহাস্থবির বরণোৎসব ’৮১ স্বরণিকা”) প্রবন্ধে লেখক বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ডি.সি. অফিসের হেডক্লার্ক ছিলেন। তিনি চাকমা উত্তরাধিকার আইন ও চাকমা প্রবাদবাক্য গ্রন্থের রচয়িতা এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক।
কালিন্দী রাণীর আমলে তঞ্চঙ্গ্যাগণ ব্রিটিশদের কুকি দমন অভিযানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল। রাইংখ্যং কুতুবদিয়া অধিবাসী (তৎকালীন সুবলং বরকলের বাসিন্দা) শুভধন তঞ্চঙ্গ্যা, কুণ্ড মহাজন, হিচাধন আমু বিভিন্নভাবে ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিলেন বলে জানা যায়।

পাকিস্তান আমলেই তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা দীক্ষা, আর্থসামাজিক উন্নয়নে যাত্রা শুরু হয়। চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী কাগজকল প্রতিষ্ঠিত হলে এতদ এলাকার তঞ্চঙ্গ্যাগণ অনেকেই চাকুরী এবং বাঁশ সরবরাহের ঠিকাদারী গ্রহণ করে। এই প্রথম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তাদের ব্যাপক যোগাযোগ ঘটে। কাপ্তাইতে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ ১৯৬০ সালে সম্পন্ন হয়। জমিজমা, ঘরবাড়ী জলমগ্ন হলে রাইংখ্যং অঞ্চলের বহু তঞ্চঙ্গ্যা বান্দরবান, রেজা, আলীকদম, রোয়াংছড়ি, নোয়াপতং এলাকায় চলে যায়। ঐ প্রকল্পের অধীনে শ্রী ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (তিনি তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্ব প্রথম বি.এ. ডিগ্রিধারী) কানুনগো হিসেবে এবং শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা এসিস্ট্যান্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার হিসেবে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। পূর্বে জেলা প্রশাসক কার্যলয়ে শ্রী যোগেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও শ্রী রবিকুমার তঞ্চঙ্গ্যা এম.এল.এস.এস. চাকুরীতে নিযুক্ত ছিলেন।
তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সুযোগ্য সন্তান শ্রী যতীন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৬ সালে এল. এল. বি. ডিগ্রী অর্জন করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অপর কেউ তৎপূর্বে ঐ ডিগ্রী লাভ করেছিলেন বলে জানা যায় না যদিও তৎকিয়ৎ পরবর্তীকালে চাকমা ও মারমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এল. এল. বি. ও এল. এল. এম. ডিগ্রী অর্জন করেছেন। শ্রী যতীন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৯ সালে ই. পি. সি. এস. পাশ করে ১৯৭০ সালে ডেপুটি ম্যজিষ্টেট পদ লাভ করেন এবং ১৯৯০ সালে মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক পদে ২রা জুলাই যোগদান করেন।
ষাট ও সত্তরের দশকের দিকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অনেকেই সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কয়জন তারা হলেন – শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (আমিন); তিনি পরে রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমীর অধ্যক্ষ হন। তদানীন্তন জেলা প্রশাসক জনাব শফিকুল ইসলাম মহোদয় (পরবর্তী চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার) এই একাডেমী স্থাপন করে দেন। ১৯৮১ ইং ১লা জানুয়ারী বঙ্গভবনে যুব সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সেরা শিল্পী (চারু) হিসেবে সম্বর্ধিত হন। অন্যান্যদের মধ্যে শ্রী চিত্র কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড), শ্রী নতুন চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রজনী কান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (ব্লক সুপারভাইজার), শ্রী অজিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও শ্রী মতি শাসনা তঞ্চঙ্গ্যা (অফিস সহকারী, জেলা প্রশাসক অফিস) এবং শ্রী নবকুমার তঞ্চঙ্গ্যা (এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পরবর্তীতে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী), শ্রী সুভাষ তঞ্চঙ্গ্যা (ফার্মাসিস্ট), শ্রী মনোজ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী মোহন লাল তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), শ্রী রবি মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (রাঙ্গামাটি পৌরসভা), শ্রী হীরাবালা তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী রাবন তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী বাল্মীকি তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী নেত্র (লত্র) তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রীমতী পুষ্প তাকুকদার (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী ভুবন মোহন তঞ্চঙ্গ্যা (সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক), শ্রী অতুল তঞ্চঙ্গ্যা (ফরেস্টার), শ্রী যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (ফার্মাসিস্ট) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে বহু তঞ্চঙ্গ্যা পুরুষ মহিলা সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন বা করেছেন।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের অধ্যয়ন সত্তরের দশক হতে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। প্রকৌশল, চিকিৎসা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থী পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তঞ্চঙ্গ্যাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে যখন পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন আরম্ভ হয় তখন চট্টগ্রাম জেলার লোক, দলে দলে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় গ্রহণের জন্য ধাবিত হয়। রাজবিলা, নোয়াপতং, তাছারা (বান্দরবান), রাজস্থলী, রাইংখ্যং এর দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ও দুর্ভেদ্য জংগল অতিক্রমকালে তাদেরকে ঐ এলাকার তঞ্চঙ্গ্যাগণ আহার পানীয় দিয়ে সহায়তা করে এবং নিরাপদ পথে সীমান্ত পাড় করে দেয়। রাজস্থলীর ভাইস চেয়ারম্যান জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, নূতন চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (শিক্ষক), মুনু তঞ্চঙ্গ্যা, আরো অনেকে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। ঐসব এলাকাতে এবং হোয়াগ্গা, বারঘোনিয়া অঞ্চলে পাঠান পাঞ্জাবীদের হাত থেকে বাঁচাতে বহু বাঙ্গালী পরিবারকে আশ্রয় প্রদান করা হয়। হোয়াগ্গার অধিবাসী বর্তমানে ১নং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী অনিল তঞ্চঙ্গ্যা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। বান্দরবানের বালাঘাটা নিবাসী উদয়সেন তঞ্চঙ্গ্যা ও লাল মোহন তঞ্চঙ্গ্যা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। বান্দরবানে অদ্যাবধি তাঁদের নাম বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
তঞ্চঙ্গ্যাদের রাজনৈতিকভাবে পৃথক জাতিসত্ত্বা হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পর স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ সালের ১৯ নং আইন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ সালের ২১ নং আইন পাশ ও বলবতের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতিনিধিত্ত্বের জন্য যথাক্রমে দুইটি ও একটি পৃথক পৃথক আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের উল্লেখযোগ্য বসতি না থাকায় ঐ জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য পৃথক আসন সংরক্ষণ করা হয়নি। ১৯৮৯ সালের ২৫শে জুন প্রথম স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার হেডম্যান বিশিষ্ট সমাজকর্মী শ্রী পরিমল তালুকদার এবং ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজার স্বনামধন্য মেঘনাদ কার্বারীর সুযোগ্য পুত্র শ্রী রূপময় তঞ্চঙ্গ্যা (বাবুল) রাঙ্গামাটি স্থানীয় সরকার পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। বান্দরবান জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদে ১৩১ নং বল্লালছড়া মৌজার প্রাক্তন হেডম্যান শ্রী সাতকমল আমু বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী প্রসন্নকান্তি তঞ্চঙ্গ্যা (দুর্জয়) সদস্য পদে নির্বাচিত হন।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকার পরিষদ প্রবর্তনে সরকারের সহায়তা করে শ্রী পরিমল তালুকদার উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।
এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যাগণ স্বীকৃতি লাভ করে এবং প্রশাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার সুযোগ লাভ করেছে।
=======================
লেখাটির পুরো রেফারেন্স ও কৃতিত্ব
[তঞ্চঙ্গ্যা বীর কুমার: তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি]
তঞ্চঙ্গ্যা মহা সম্মেলন ১৯৯৫ ইং
[বিঃদ্রঃ পেইজের নিয়মানুযায়ী *উপজাতি শব্দের বদলে *আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এডমিন বিভাগ মনে করে আমরা আদিবাসী উপজাতি নয়]

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা – কলাত্থুর কন্যা (কলাবতী কন্যা)

Sketch-of-a-Tanchangya-Woman

লেখকঃ প্রয়াত- বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

এই কাহিনীটি হলো সেই সময়ের যে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়ে জুম করত। চক্রধন আঙুর আত্মীয় স্বজন সীতা মোইন বা সীতা পাহাড়েই বসতি স্থাপন করে। তার মেঝো মেয়ে সনামালা বিধবা। সে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। রোয়াঙে কলাডেন নদীর পাড়ে কুমুখ্যাং পাড়ায় তাদের ঘর ছিল। তার বাবা চক্রধন আঙু ও কার দল যখন এতদঞ্চলে আসে, বিধবা সনামালা তার একমাত্র সন্তান পাঁচ বছর বয়সী রাঙাধনকে নিয়ে এখানে আসে। সে তার বাপের পরিবারে থাকে না, রাঙাধনকে নিয়ে পৃথক ঘরে থাকে। তার ভাইয়েরা তার জুমের জন্য গভীর বন-জঙ্গল কেটে দেয়, শুকনো জঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সনামালা আধমরা গাছের ডাল-পালা সাফ করে জুমের ক্ষেত তৈরি করে। তার ভাইয়েরাও এতে সাহায্য করে। ক্ষেত তৈরি হলে ধান, তিল, কার্পাস এবং নানান ফসলের বীজ বুনে। ক্ষেতের আগাছা বাছে, ধান পাকলে ধান কেটে ঘরে তোলে। রাঙাধন এখন চৌদ্দ/পনের বছরের তরুণ। সে তার মামাদের সঙ্গে জুমের জঙ্গল কাটা এবং তার মাকে জুমের কাজে একটু আধটু সাহায্য করে। বেশির ভাগ সময় তার খেয়াল খুশি মত এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে সময় কাটায়।
.
তখন রাম মোইন-সীতা মোইনে বিশাল বিশাল বৃক্ষাদির ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর ‘তেল্যাকলার’ (একপ্রকার জংলী কদলী) থোর (মোচা) হতো। এসব দেখতে বেগুনী রঙের, তেলতেলে ও মসৃণ হয়ে থাকে।
.
সেই সময় রাঙাধনের বয়স চৌদ্দ/পনের বছর। তার তরুণ মনের আকাশে সবে মাত্র রঙধনুর রঙ্গিন আল্পনার আবির্ভাব হচ্ছে। সে তার মামাদের সাথে জুমের জঙ্গল কাটতে যায় এবং অন্যান্য কাজেও যায়। কিন্তু মন দিয়ে কাজ করেনা, করতে চায় না। খেয়াল খুশি মত চলে। কাজ করতে করতে প্রায় সে ‘ছড়া’ বা ঝিরির পাড়ে গিয়ে তেল্যাকলার বনে গিয়ে তেল্যাকলার থোরগুলি চেয়ে দেখে, আর কলা গাছের আগায় পাতায় যে রৌদ্রের ঝলক পড়ে, সেইসব চেয়ে চেয়ে দেখে। কচি কলাপাতা মৃদু সমীরণে দোলে, সূর্যের আলো তাতে আছড়ে পড়ে, ঝিলিক তুলে। রাঙাধন সেই ঝিলিকে মোহিত হয়, আনমনে হেসে ওঠে। মনে মনে বলে, তেল্যাকলার থোর এত সুন্দর কী করে হয়! তার মামতুতো বোন ধংমালা তার চেয়ে দু’বছরের ‍বড়। রাঙাধন তাকে মনে মনে বলে তুলনা করে তেল্যা কলার থোরের সঙ্গে। পিছল বেগুনী রঙের তেলতেলে কলার থোরের যে মায়াময় লাবণ্য, তা ধংমালার মাঝে সে দেখতে পায়। মনে মনে ধংমালাকে তার বৌ কল্পনা করে আনে সে ঘরে। তার মাকে মাঝে মাঝে হঠাৎ জিজ্ঞাস করে – মা, ধংমালা কবে আমাদের ঘরে আসবে? তার মা সনামালা বুঝতে পারে রাঙাধনের মনের বনে যৌবনের ভ্রমর পাখা মেলতে শুরু করেছে। কিন্তু কিছু বলে না, কারণ, ধংমালার সঙ্গে চক্রধন আঙুর আর এক নাতির ‘আইফাই’ (ভালবাসা) চলছে।
.
এক বছর তরুণ যুবক রাঙাধন তার মামাদের সঙ্গে জঙ্গল কাটতে গেছে। সেদিন সে একটা ঝোপ কাটার পর তার মামাদের থেকে সরে গিয়ে জুমের প্রান্তে ঝিরির পাড়ে চলে এল। এখানে ঘন তেল্যাকলার বন। তখন ফাল্গুন মাস। মনোরম তেল্যাকলার থোরগুলো বাতাসে দোলছে আর সোনালী রোদের ঝিলিক কচি কোমল মোলায়েম মসৃণ কলা পাতায় পড়ে ঝিকমিক করছে। রাঙাধনের চোখ সে দিকে গিয়ে আটকে গেল। থোরের অপরূপ লাবণ্য এবং কচি পাতায় রোদ্রের ঝলকে রাঙাধন পুলকিত হয়ে খিল খিল করে হাসতে লাগল। তখন তার চোখে ধংমালার রূপ লাবণ্য স্পষ্ট প্রতিভাত হতে লাগল। লোভনীয় এই থোর আহরণের জন্য গাছ কাটতে শুরু করে দিল রাঙাধন। চারটা কলা গাছ কাটার পর পঞ্চম কলা গাছে কোপ দিতেই ‍রাঙাধনের কানে এল কোমল নারী কণ্ঠের আবেদন, রাঙাধন, তুমি কলা গাছ কেটে শেষ করলে, আমার থাকবার স্থান নষ্ট করে দিয়েছ। রাঙাধন বিস্ময়াপন্ন হয়ে চকিতে চারদিকে তাকায়, কাউকেও না দেখে প্রশ্ন করল, – “তুমি কোন অচেনা নারী আমার নাম ধরে কথা বললে?” এবার কলাগাছের আগা থেকে রাঙাধন স্পষ্ট শুনতে পেল, – “আমি কলাত্থুর কন্যা”। রাঙাধন সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময় বিস্ফোরিত দু’নয়নে দেখতে পেল – থোরের রঙে এক পরমা সুন্দরী ললনা। তার পোশাক পরিচ্ছদ ‘পিনন’ আর ‘খাদি’ কচি কলা পাতার রঙে সাজানো; মোলায়েম, কোমল এবং মসৃণ। রাঙাধন তাকে দেখে যেমন বিস্মিত হল, তেমনি যারপরনাই হল খুশি। এক মুহূর্ত ভেবে মৃদু হেসে বলল, – “আমি তোমাকে চিনি না অথচ তুমি আমাকে চেন, আমার নাম ধরে ডাকলে। তুমি কে বলতো?” কলাত্থুর কন্যা উত্তর দিল – “আমি কলাত্থুর কন্যা। আমি তোমাকে চিনি। কালাডেন গাঙের পাড়ে আমার ঘর। তোমরা এখানে আসার সময় আমার ঘরের সম্মুখ ‍দিয়ে এসেছিলে। আমার এখনো মনে আছে। তুমি আমার থাকার জায়গা নষ্ট করে দিয়েছ। তাই এখন আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও”।
.
রাঙাধন অতীব আশ্চর্যান্বিত হলেও কলাত্থুর কন্যার এই অনুরোধে দারুণ খুশি হল। কেননা, কলাত্থুর কন্যাকে দেখে সে মোহিত হয়ে গেছে। সিঁড়ি বানিয়ে সে উপরে উঠে কলাত্থুর কন্যাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে নীচে নামিয়ে আনল। তারপর তার এক হাত ধরে তাকে এনে ঘরের উঠানে নিয়ে এসে তার মাকে ডেকে বলল, “মা, মা, দেখ, আমি কলাত্থুর কন্যাকে বৌ করে এনেছি।”
.
তখন রাঙাধনের বড় মামা বিষুরাম আর কনিষ্ঠ মামা খুলারাম কাজ করতে করতে দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য ঘরে ওঠে ঘরের ‘চানায়’ (বারান্দায়) বসে আছে। রাঙাধনের মা সনামালা ভাত বেড়ে দিচ্ছে। তারা এক পলক দেখল কলাত্থুর কন্যাকে। দেখে চমকিত হল। কলাত্থুর কন্যা তাদেরকে দেখে ঘরে উঠল না। দৌড়ে কিয়ুদ্দুর গিয়ে বনে আত্মগোপন করল। রাঙাধনের কনিষ্ঠ মামা খুলারাম এখন পূর্ণ যৌবনের অধিকারী। এখনো সে বিয়ে করেনি। রাঙাধনের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। তার বয়োকনিষ্ঠ ভাগিনা রাঙাধন কলাত্থুর কন্যাকে বৌ নিয়ে এসেছে জেনে তার মনে খুব দুঃখ হলো। সে মনের দুঃখে অভিমান করে ভাত খেল না। তার দিদি সনামালা তাকে অনেক বোঝাল। খুলারাম জেদ করে থাকে; না সে ভাত খাবে না। সনামালা বার বার তাকে ভাত খেতে অনুরোধ করল। তবুও ভাত না খেয়ে খুলারাম অভিমান করে বসে রইল।
.
এইদিকে কলাত্থুর কন্যা সেই যে কলার বনে ঢুকেছে সেই কলার বন থেকে আর বের হচ্ছে না। ভাত খাবার পর খুলারামের বড় ভাই বিষুরাম আরার কাজ করতে জুমে গেল। খুলারাম অনাহারে ঘরে শুয়ে রইল, কাজ করতে গেল না। তার দিদি সনামালা তাকে বুঝিয়ে বলল, “তোমার ভাগিনা বৌকে দেখে তুমি রাগে অভিমানে ভাত খেলে না, লোকে তোমাকে দেখে হাসবে, তোমাকে পাগল বলবে। এসো ভাত খাও।” খুলারাম উত্তর দিল – “দিদি আমি পাগল নই। যারা যুবক অবিবাহিত তারাই আমার দুঃখ বুঝবে। তুমি আমার দুঃখ বুঝবে না। আমি ভাত খেতে পারি, যদি আমার ভাগিনা বৌ কলাত্থুর কন্যা আমাকে ভাত বেড়ে দেয়।” সনামালা বলল, “আচ্ছা।”
.
এদিকে রাঙাধন সারাক্ষণ ঘরের আশেপাশে, বনে কলাত্থুর কন্যার সন্ধান করল। কিন্তু ব্যর্থ হল। কোনখানে কলাত্থুর কন্যার সন্ধান পেল না। খুলারাম ভাবছে, আহা সে যদি রাঙাধন হত!
.
দিন শেষ হয়ে গেল। সূর্য অস্তমিত হলে সাঁঝের আঁধার নেমে এল। ফাল্গুনের নির্মল সুনীল আকাশে একটা করে অসংখ্য তারকা মিট মিট করে জ্বলে উঠল। তখন সে আলোয় ঘরের অদূরে বনে বলা গাছের উপরিভাগে কলাত্থুর কন্যাকে দেখা গেল। সনামালা, খুলারাম, রাঙাধন কলাত্থুর কন্যাকে দেখতে লাগল। রাঙাধন চট জলদি দৌঁড়ে গেল কলা গাছের গোড়ায়। কলা গাছের সিঁড়ি বানাতে বানাতে কলাত্থুর কন্যা তাকে বলল, “রাঙাধন, তুমি বদ্ধ ছেলে মানুষ, কলা গাছ কাটছ কেবল। এখন ঘরে যাও আমি আপনা আপনিই আসবো।” এদিকে খুলারাম তার দু’কানে যেন শুনতে পেল কলাত্থুর কন্যা তাকে বলছে, – “খুলারাম, তুমি কেন মনে দুঃখ পেলে। মনের দুঃখে অভিমান করে ভাত খেলে না কেন? তুমি আমাকে কলা গাছের উপর থেকে পেড়ে নিয়ে যাও – আমি তোমাকে ভাত বেড়ে দেব।” বলা বাহুল্য এই কথা শুধু খুলারামই নিজের কানে শুনল। অন্য কেউ শুনতে পেলনা। শুনে খুলারাম খুব খুশি হল। খুলারাম কাউকে কিছু না বলে বনের দিকে অগ্রসর হল।
.
সে সময় থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবিবাহিত পুরুষেরা ভাগিনার নবপরিণীতা বধূকে প্রথম যেদিন দেখে বা সাক্ষাৎ হয়, আকাশে তারকা দেখা না যাওয়া পর্যন্ত তাদের সে দিন ভাত খাওয়ার বিধান নেই। অবিবাহিত যুবকদের সঙ্গে বিবাহিত পুরুষেরাও ভাগিনার নববধূকে প্রথম যেদিন দেখে সেদিন আকাশে তারা দেখা না যাওয়া পর্যন্ত ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই।

– বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা
তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী
( Collected from jumjournal blog )