তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা

সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস। 

প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি। 

তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি। 

বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)। 

এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;

তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। 

আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত। 

বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল। 

উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস) 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল। 

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল। 

সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে। 

সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। 

তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা। 

১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান। 

অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।” 

দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়। 

সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।” 

অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। 

উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র। 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) 

তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়। 

দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়। 

এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়। 

একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। 

বাতকস এর লক্ষ্য 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।” 

বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য 

নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর

বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।

বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। 

২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে। 

বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল

তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল। 

বাতকস এর সম্মেলন সমুহ  

১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। 

এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল। 

এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।

১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। 

উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন। 

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। 

বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী 

বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-

১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়। 
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। 
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। 
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে। 
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা, বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : বাঘ ও শূকরের মিতালী

লেখক : বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

বনে নানা প্রজাতির পশু-পাখি বাস করে। কোন পশু মাংসভোজী, আর কোন কোন পশু তৃণভোজী। পাখিরা সাধারণতঃ শস্য, ফল, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মাংসভোজী পশুরা খুব হিংস্র হয়ে থাকে।

অপর দিকে তৃণভোজী পশুরা নিরীহ প্রকৃতির হয়ে থাকে। তৃণভোজী পশুদের মাংস খেয়েই মাংসভোজী পশুরা জীবনধারণ করে। তাই তৃণভোজী পশুদের উপর তারা বরাবরই চড়াও হয়। তারা আবার স্বজাতীয় পশুদের মাংসও বাদ দেয়না।

একে অপরকে মেরে মনের সুখে মাংস ভক্ষণ করে উদর পূর্তি করে। তৃণভোজী পশুরা তাই সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে বিচরণ করে থাকে। কোথাও কোন হিংস্র পশু ওঁৎ পেতে আছে কি-না সে জন্য তাদের সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়।

তাই স্বভাবই তারা চঞ্চল। পাখিরা মাটিতে বিচরণ করলেও তাদের ডানা থাকাতে কোন হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে তারা সহজে আত্মরক্ষা করতে পারে।

সে জন্য তারা অনেকটা নির্ভয়ে বাস করে। গাছের ডালে উড়ে বেড়ায়, কলকাকলী করে। তাদের কল কাকলী শুনে মনে হয় তারা কতই সুখী।

শত শত প্রজাতির পশু-পাখিদের অরণ্যে আইন শৃঙ্খলাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ আলাদা। অরণ্যের আইন নিতান্তই বন্য। যেখানে তৃণভূমি আছে কিংবা তৃণভোজী হরিণ, চঙরা, (সম্বর) শূকর, খরগোশ প্রভৃতি বিচরণ করে, তার কাছাকাছিই চুপিসারে বিচরণ করে হিংস্র বাঘ, সিংহ।

গণ্ডার, হাতি, বুনোমহিষ প্রভৃতি বৃহৎ জন্তুরাও সমগ্র বনাঞ্চলে বিচরণ করে থাকে। বাঘ-সিংহরা তাদের যেমন কিছু করতে পারে না, তাদের ধারে কাছেও যায় না। এদের মধ্যে ধূর্ত বুদ্ধির অধিকারী পশু হল শিয়াল।

হরিণ, শূকর প্রভৃতি তৃণভোজী পশু শিকার করা তার সাধ্যের বাইরে। শিয়ালও মাংসভোজী প্রাণী। সে বাঘ আর সিংহের পিছনে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে খুব সতর্ক হয়ে বিচরণ করে। যখন কোন হরিণ, সম্বর, শূকর মারা যায়, তখন মৃত পশুর একাংশ বাগিয়ে নেবার তালে থাকে।

অনেক সময় বেকায়দার ফলে হিংস্র পশুর থাবার শিয়ালকে অহেতুক প্রাণ হারাতে হয়। এ হল বেচারা শিয়ালের অবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য ধূর্ত বুদ্ধির আশ্রয় নেয়া ছাড়া তার কোন গত্যন্তর নেই।

গভীর অরণ্য ছেড়ে শিয়াল লোকালয়ের কাছে থাকা অধিক পছন্দ করে। সে লোকালয়ে একটু চেষ্টা করলেই গৃহপালিত হাঁস, মুরগী শিকার করতে পারে। বন মোরগ কিংবা অন্য পাখি শিকার করা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

পাখিদের মধ্যে পেঁচার একটু বিশেষত্ব আছে। পেঁচার চোখের পাতা নেই। তার চোখে পলক পড়ে না। অপলক নেত্রে সে আলো সহ্য করতে পারে না। তাই দিনের বেলায় সূর্য্যর আলো থেকে বাঁচার জন্য পেঁচা ঝোপের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকে অথবা ঘুমায়।

রাতের বেলাতেই সে চরে বেড়ায়, খাদ্য আহরণ করে। সারা রাত কুল-কুলায়। কিন্তু সকাল হলে ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য একটি চাকমা প্রবাদ আছে, সারা রাত পেঁচায় কুল-কুলায় খুরোল্যা (কাঠ ঠোকরা) সনার তুন (সোনার মুকুট) পায়।

তবে পেঁচাও ধূর্ত কম নয় বরঞ্চ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। সে যখন জেগে থাকে তখন চুপ করে থাকে। রাতে যখন গাছের ঝোপে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন শব্দ করে।

“পুকজুক পেদরললত পুক জুক পেদরললত, পুক জুক পেদরললত” তখন শিকারী নিশাচর বনবিড়াল মনে করে, পেঁচা বেটা তার আহরণ করা পোকা আরাম করে খাচ্ছে। তাই বনবিড়াল সে দিকে যায় না আর পেঁচাও নিরাপদে ঘুমায়।

সমগ্র বনাঞ্চল সিংহই হল অঘোষিত সম্রাট। হাতি, গন্ডার, বুনোমহিষ প্রকান্ড শরীরের অধিকারী হলেও অন্য পশুদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রকান্ড শরীরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য অহরহ খাদ্য অন্বেষণ করতে হয় তাদের।

অন্য কিছু করার বা ভাববার সময় তাদের নেই। সিংহ হিংস্র এবং শক্তিশালী। একটি হরিণ বা শূকর মারতে পারলে তার বেশ ক’দিন চলে যায়। নানা চিন্তা ভাবনা করার সময় তার আছে।

তার মূর্তি ও শক্তিমত্তা দেখে অন্যান্য পশু-পাখিরা তাকে সমীহ করে এবং এ সুযোগে সে নিজেকে সমগ্র বনাঞ্চলের সম্রাট বলে জাহির করে।

বন্য পশু-পাখিদের একটি সার্বজনীন প্রকৃতির ভাষা আছে। এটি সকলেই বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী ধ্বনিও উচ্চারণ করতে পারে। এটি তাদের লিংগুয়াফ্রাংকাই। এ লিংগুয়াফ্রাংকাই অরণ্য অঞ্চলের ভাষা।

এ লিংগুয়াফ্রাংকা দিয়েই অরণ্য সম্রাট সিংহ তার শাসন পরিচালনা করে। মানব সমাজে যেমন অন্যায়-অবিচার, অঘটন ঘটে এবং সেসবের বিচার হয়ে অপরাধীর শাস্তি ধার্য করা হয়।

পশু–পাখিদের মধ্যেও সে রকম অন্যায়, অবিচার, অঘটন সংঘটিত হয় এবং সেসবেরও বিচার করার উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হয়। দুর্বলেরা সিংহের নিকট তাদের প্রতি কৃত অন্যায়-অবিচারের বিচার প্রার্থী হয়।

সিংহ তার সভাসদের পরামর্শে বিচার নিষ্পত্তি করে। সেরকম একটি ঘটনা এখনও অরণ্য অঞ্চলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ঘটনাটি বা ঘটনার কাহিনী এখন মানব সমাজে রূপ কাহিনী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

একদা কোন এক গভীর অরণ্যে এক শিকারির গুলির আঘাতে এক বাঘিনী তার শিশু শাবক রেখে মারা যায়। মাতৃহারা শাবকটি অসহায়ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করার সময় সদ্য প্রসূতি হওয়া এক শূকরীর নজরে পড়ে।

শূকরীর একটি মাত্র শাবক। অসহায় ব্যাঘ্র শাবকটির প্রতি করুণা পরবশ হয়ে শূকরী ব্যাঘ্র শাবককে আপন শাবকের ন্যায় স্নেহের সাথে নিজের দুধ পান করিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এবং লালন পালন করতে থাকে।

ব্যাঘ্র শাবকটি দু’এক মাস শূকরীর দুধ পান করলেও তার জাতিগত স্বভাব অনুযায়ী ধীরে ধীরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী শিকার করতে আরম্ভ করে। ইতোমধ্যে শুকরছানা আর ব্যাঘ্র শাবকটির মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

এভাবে তারা বড় হতে থাকে এবং স্ব স্ব জাতিগত স্বভাব লাভ করে। এক সময় শূকরছানাটি তার মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাঘ্র শাবকের সঙ্গে বন হতে বনান্তরে বিচরণ করে জীবনযাপন করতে লাগল। উভয়ের মধ্যে যে প্রগাঢ় হৃদ্যতা তা বলাই বাহুল্য।

ব্যাঘ্র মাংসভোজী হিংস্র পশু। বনাঞ্চলে সিংহের পরেই তার স্থান। ব্যাঘ্র শাবকটি সারাদিন বন্য পশু শিকার করে আর শূকর ছানাটি শস্য ক্ষেত এবং তৃণভূমিতে বিচরণ করে সন্ধ্যায় দুই বন্ধু একত্রিত হয়ে এক জায়গায় রাত কাটায়।

এভাবে উভয়ে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে পরিপূর্ণ বাঘ আর শূকরে পরিণত হল। বাঘটি শক্তিশালী হিংস্র শিকারি পশু এবং শুকরটি চর্বি জমে মোটাসোটা, নাদুস নুদুস হয়ে এক লোভনীয় জন্তুতে পরিণত হল। শূকর দুর্বল প্রাণী।

অন্ততঃ বাঘের কাছেতো বটেই। প্রথম প্রথম সে বাঘটিকে সমশ্রেণী বা সমগোত্রীয় মনে করত। কিন্তু একদিন যখন দেখল বাঘটি তার সামনেই তাদের সমগোত্রীয় একটা শূকরের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে ফেলল এবং উল্লাস সহকারে মাংস ভক্ষণ করল, তখনই সে বুঝতে পারলো বাঘ তাদের সমগোত্রীয় নয়। কিন্তু তখনও বোধহয় হয়নি যে, সেও বাঘের ভোগ্য জন্তুতে পতিত হতে পারে।

একদিন বাঘ সারাদিন কোন শিকার জোটাতে না পেরে সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শূকরটি এ অবস্থায় চিন্তিত হয়ে তার পাশে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করল। বাঘ আরো গম্ভীর হল এবং এক সময় হঠাৎ এক লাফ দিয়ে শূকরের গলায় কামড় বসিয়ে দিল।

কিন্তু না, জোরে নয় অতি হালকাভাবে বাঘ কেবল শূকরকে বধ করছে–এই ভাবে অভিনয় বা ভান করল মাত্র। শূকর ভয় পেল। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে তবু সাহস করে বলল, একি বন্ধু! তুমি আমাকে এভাবে আক্রমণ করছ কেন?

তুমি কি শেষ পর্যন্ত আমাকেও হত্যা করে ফেলবে? এ কথায় বাঘ শূকরকে ছেড়ে দিল এবং লজ্জার ভান করে বলল, ছিঃ ছিঃ বন্ধু, তুমি একি বলছ? আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে, তোমার মত অকৃত্রিম বন্ধুকে হত্যা করব?

তোমার মত নাদুস নুদুস পশু ধরলেই আমার হাত থেকে পালিয়ে যায়, তাই একটু তালিম দিয়ে দেখলাম ভবিষ্যৎতে কিভাবে ধরতে হবে। নির্বোধ শূকর বাঘের এ কথায় আশ্বস্ত হল।

বাঘটির কয়েক দিন ধরে শূকরের নাদুস নুদুস শরীর দেখতে দেখতে তাজা মাংসের লোভে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে এতদিন লোভ দমন করে আসছে।

কিন্তু শূকরের কণ্ঠনালীতে কামড় বসাতে গিয়ে বাঘটির লোভ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল এবং তার পক্ষে লোভ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ল।

একদিন সকালে শূকর যখন আহার অন্বেষণে আস্তানা থেকে রওনা দিচ্ছে, বাঘ এক গাছের আড়াল থেকে এক লাফ দিয়ে শূকরের পিঠে কন্ঠনালীর দিকে মুখ নিতে নিতে বলে, বন্ধু এতদিন তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আজ কিন্তু তোমার তাজা মাংস খাব।

শূকর ভীষণ ভয় পেল। সে বাঘের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে উচ্চ লাফ দিল। আচমকা এ লাফে বাঘ নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না, শূকরের গায়ে আঁচড় কেটে মাটিতে পড়ে গেল। শুকরের গা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।

শূকর সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। একটি গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বাঘের পুনরায় সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হল। বাঘ কিন্তু আক্রমণ করল না। শুকরের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধু তুমি জাননা তুমি আমার ভক্ষ্য।

তুমি কোন বিশ্বাসে এবং কোন সাহসে ভক্ষকের সঙ্গে মিতালী কর? আমি আর তোমাকে রেহাই দেব না। তোমার পিঠ থেকে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বোধহয় বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছ।

শূকর তার দেহে বাঘের নখের আঁচড় লাগা স্থান থেকে রক্ত ঝড়তে দেখে এবার উপলব্দি করল যে, বাঘ তার সমগোত্রীয় নয় এবং যে কোন মূহুর্তে বাঘ তাকে মেরে ফেলতে পারে।

শিশুকাল থেকে সখ্যতা আছে বলে শূকর বাঘকে বন্ধুতের দোহাই দিতে থাকে এবং নম্রসুরে বলল, বন্ধু আমার মায়ের দুধ একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হয়েছি।

আমার মা তোমাকে আপন সন্তানের মত আদরযত্ন করেছে, সে কথা কি ভুলে গেছ বন্ধু? বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, কি আজেবাজে বলছ! বাঘের বাচ্চা কখনও শুকরের দুধ খায় নাকি? যাক এতদিন আমি তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আর রেহাই দেব না।

আসল কথা কি জান? আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি তোমাকে ঘাড় মটকিয়ে হত্যা করে তোমার তাজা রক্ত মাংস খাচ্ছি। স্বপ্নে আরো দেখলাম, বনের রাজা সিংহও অতি আনন্দের সঙ্গে তোমার তাজা রক্ত মাংস খেয়ে লাফাতে শুরু করেছে।

অন্য কোন কথা বলে লাভ নেই, তুমি প্রস্তুত হও, আমি আমার দেখা স্বপ্ন অনুযায়ী তোমাকে এখনই মেরে ফেলব। শূকর বুঝতে পারল বাঘটির কথায় কোন কৃত্রিমতা নেই। রূঢ় অথচ সত্যি কথাই বলছে বাঘ।

শূকর অনুনয় বিনয় করে আমতা এবং ভয় জড়িত কন্ঠে বলল, এ বনে অনেক পশু-পাখি আছে যারা এ বনেরই অপর প্রাণীর ভক্ষ্য। তথাপি বনের রাজা সিংহের শাসনাধীনে একই বনে যার যার প্রাণ রক্ষা করে বেঁচে আছে।

আমাদের সকলের রাজা সিংহ মহাশয়ের সমীপে চল, তিনি যদি বলেন, তোমার স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী তুমি আমাকে ভক্ষণ করতে পারবে, তাহলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। বন্ধুর জন্য আমার এ দেহ হাসিমুখে বিসর্জন দেব।

বাঘ জানে যে, শূকর কোনদিন তার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। সে যখন ইচ্ছা করে তখনই শুকরকে হত্যা করতে পারবে।

এও জানে যে, মহাপরাক্রমশালী পশুরাজ সিংহ অবশ্যই তার পক্ষেই রায় দেবে, স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী শূকরকে হত্যা করার নির্দেশ অবশ্যই দেবে। এসব কথা ভেবে বলল, ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে এ সুযোগ দিলাম। চল, পশুরাজ সিংহের দরবারে।

যথাসময়ে পশুরাজ সিংহের দরবারে হাজির হল তারা। পশুরাজ সিংহ শূকরকে দেখে অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করল এবং শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে তাজা রক্ত পান করার প্রবল ইচ্ছা কোন রকমে চাপা দিয়ে রাখল।

শূকর বাঘকে দেখিয়ে তার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পশুরাজ সিংহের কাছে প্রার্থনা জানাল। বাঘ কেন শূকরকে আক্রমণ করতে চায়, তা পশুরাজ জানতে চাইলে বাঘ দৃঢ় কন্ঠে তার স্বপ্নের বিবরণ পশুরাজকে খুলে বলল।

উভয়ের আর্জি শুনে সিংহ তার স্বভাবজাত কায়দায় গর্জন করে বলল, এ অরণ্য রাজ্যের ছোট, বড় প্রায় সকল পশু-পাখিই আমার দরবারে হাজির হয়েছ। শূকরের আবেদন এবং বাঘের স্বপ্নের বিবরণ সবাই শুনেছ। স্বপ্ন হল স্বর্গীয় ব্যাপার।

এটি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। বাঘ শুকরের মাংস খাচ্ছে বলে যে স্বপ্ন দেখেছে তা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশই হয়েছে। কাজেই বাঘ শূকরকে এখন খেতে পারবে। বন্য কুকুর এবং শিয়াল ভয়ে ভয়ে চাপা কন্ঠে বলল, স্বপ্নে যাহা দেখে বাস্তবে তা হয় বা হওয়া প্রয়োজন এরকম কোন নজির নেই।

অতএব বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে শূকরকে কি করে ভক্ষণ করবে তা বুঝা যায় না। পশুরাজ সিংহ রাগান্বিত হয়ে বলল, শিয়াল, কুকুর তোমারও মাংস পেলে ছাড় না………… তোমাদের মুখে এ কথা সাজে না, চুপ কর।

সিংহের গর্জনে তারা গুটিশুটি মেরে বসে রইল। হাতি তার বড় বড় কান দুটি এবং লেজটি নেড়ে সিংহের গর্জন শুনে তার শুঁড়টি উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঘের এ স্বপ্নটি অতি অদ্ভুত।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন স্বর্গীয় হবে কেন? আর সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ হলে স্বপ্নের মধ্যে শূকর মরে যেত……….. সেতো এখনো বেঁচে আছে। কাজেই এ স্বপ্নটি মিথ্যা।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন কেউ কি দেখে? তার পাশে দাঁড়ানো পর্বতের মত বিশাল দেহধারী গন্ডার তার নাকের উপর অবস্থিত শিং সহ দুবার উপর নীচে সঞ্চালন করে গোঁ গোঁ শব্দে হাতিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি জঙ্গলের সবার চেয়ে প্রকান্ড জন্তু, বনের অন্যদের সাথে তোমার তেমন সংশ্রব নেই। কে কী রকম স্বপ্ন দেখে তুমি জানবে কিভাবে?

শুধু বাঘ নয় আর অন্য কেউ এর চেয়েও অদ্ভুত লোমহর্ষক স্বপ্ন দেখতে পারে। কারণ এটি স্বর্গীয় ব্যাপার। এবার সে পশু রাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মহারাজ, বাঘ যা স্বপ্ন দেখেছে তা আমি বিশ্বাস করি। এবার আপনার রায় ঘোষণা করুন।”

গন্ডারের কথায় সিংহ আহ্লাদিত হয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে রায় ঘোষণা করল। বাঘ তার স্বপ্নের বিবরণ মত শূকরকে ভক্ষণ করবে আমি অনুমতি দিলাম। চারদিকে গুঞ্জন হল।

বাঘ মুখ ব্যাদান করে হাসতে হাসতে শূকরকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হচ্ছে এমন সময় হাতি বাঘের সামনে গিয়ে তার গতিরোধ করে সিংহকে লক্ষ্য করে বলল, মহারাজ বাঘকে ক্ষান্ত দিয়ে শূকরকে কিছুদিনের অবকাশ দিন। শূকর মৃত্যু ভয়ে কাঁপতে থাকে।

হাতির কথায় একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে পশুরাজকে কাতর হয়ে নিবেদন করল; মহারাজ! আপনি ধর্মাবতার, আমাকে একমাস অবকাশ দিন, আমি আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে হাজির করব। সিংহ তার নিবেদন শুনে হাতির কথা মনে করল।

হাতি প্রথম থেকেই স্বপ্নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। শূকরের অবকাশ অনুযায়ী তাকে অবকাশ দিল। তবে মাত্র পনের দিন, এক মাস নয়। বাঘ বিস্মিত হয়ে সিংহের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সিংহ আবার গর্জন করে শূকরকে বলল, পনের দিনের শেষ দিন তোমার উকিল হাজির করবে, না পারলে আর কোন ক্ষমা নেই। তারপর দিনই বাঘ তোমাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে। অন্যান্য পশু-পাখিদের সে দিন যথা সময়ে হাজির থাকার আদেশ দিয়ে বিচার সভা ভেঙ্গে দিল পশুরাজ।

তৃণভোজী এবং সমগোত্রীয় পশু এবং পাখিদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার পক্ষে ওকালতি করার জন্য শূকর কোন পশু কিংবা পাখি পেল না। সে উকিলের সন্ধানে অনিশ্চতার পথে পা বাড়াল।

কোন দিকে চলছে নিজেরও খেয়াল নেই, দিন-রাত শুধু চলছেই। দু’চোখ ভরে তার পানি। কিছুই দেখতে পায় না। তবু হাঁটতে থাকে যদি ভাগ্যক্রমে কোন শুভাকাঙ্ক্ষী পায়। সাত দিন একটানা হাঁটার পর একরাতে ভোর হয় এ অবস্থায় ক্লান্ত শূকরটি একটি মাঝারি গাছের কান্ডে ঢুঁ মারল।

গাছটি লিকলিকে হলেও মাথায় ঘন ঝোপ। ঝোপসহ গাছটি কেঁপে উঠল। শূকর মাথায় মারাত্মক যন্ত্রণা পেয়ে থেমে গেল। গাছের ঝোপে ঝিমুচ্ছিল পেঁচা।

সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত করার পর ভোররাতে একটু ঘুমুতে চেষ্টা করছিল আরাম-আয়েশ করে। ঝাঁকুনি খেয়েই আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। আপন মনে নিচে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, কে গাছকে এমন নাড়া দিল?

শূকরকে দেখতে পেল সে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এমনিতেই রেগে গিয়েছে পেঁচা, আর শূকরের মত একটি জড় বুদ্ধি সম্পন্ন আবর্জনা প্রিয় জন্তু দেখে তার রাগ শতগুণ বেড়ে গেল। ঝোপ থেকে নীচে নেমে শূকরের মাথায় কয়েক লাথি মেরে আশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আরম্ভ করে দিল।

বেঁটা অন্ধ, বেকুব, গন্ড, মূর্খ সামনে কোথায় কি আছে দেখতে পাচ্ছিসনা। শূকর তার বিপদের কথা বলে বিলাপ করতে আরম্ভ করল। পেঁচার চোখের পাতা নেই বলে সূর্যালোতে সে বের হতে পারে না, অগত্যা ঝোপের আড়ালে বসে কিংবা ঘুমিয়ে সূর্যালোকিত দিনের বেলাটা কাটিয়ে দেয়। সারারাত আহারের সন্ধান করে।

এজন্য অন্যান্য পাখিরা এদিক ওদিক উড়তে দেখে পেঁচা দিনের বেলায় ঝোপের মধ্যে থাকে বলে সে নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে। শূকরের অবস্থা দেখে এবং তার বিলাপ শুনে বুঝতে পারল শূকর মহাবিপদে নিপাতিত হয়েছে।

সিংহ ও বাঘ চক্রান্ত করে শূকরকে ভক্ষণ করার মতলব করেছে। পেঁচা তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বুঝে নিল। একবার বনের মধ্যে পাখিদের মাঝে কী একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সংগীতের কিংবা সে ধরণের এক প্রতিযোগিতা।

ঐ প্রতিযোগিতায় পেঁচাই বিজয়ী হয়ে পুরস্কার পেত, কিন্তু সারারাত ডাকাডাকি করে সবার চাইতে অধিক যোগ্যতা দেখালেও ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে বনের রাজা সিংহের সামনে হাজির হতে পারে নি।

পেঁচার ডাকাডাকিতে কাঠঠোকরার ঘুম ভাঙ্গলে ভোর রাতে সিংহের দরবারে গিয়ে কিচির-মিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে। ফলে আর কাউকে না দেখে সিংহ কাঠঠোকরাকে সোনার মুকুট দিয়ে পুরস্কৃত করে।

সে সময় থেকে কাঠঠোকরার মাথায় সোনার মুকুট শোভা পাচ্ছে। এ কারণে পেঁচা পশুরাজ সিংহের প্রতি খুবই ক্ষুব্দ। সে সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত রাখে আর কাঠঠোকরা ভোররাতে কয়েকবার কিচিরমিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে সিংহের সামনে হাজির হতেই সিংহ তাকে সোনার মুকুট মাথায় পরিয়ে দিল।

এ সম্পর্কে বনের অন্য পশু-পাখিরা নির্বুদ্ধিতার জন্য কটাক্ষ করে থাকে। এজন্য পেঁচার দুঃখের অন্ত নেই। বাঘের স্বপ্ন দর্শন অনুসারে সিংহের প্রদত্ত নির্দেশ শুনে শূকরের প্রতি তার সহানুভুতি জাগল।

তাকে সমবেদনা জানাল এবং সিংহকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যভাবে বলল, বাঘের স্বপ্নকে স্বর্গীয় ব্যাপার বলে তদনুযায়ী বাঘ শূকরকে ভক্ষণ করবে, সিংহের কী রকম বিচার এটা! আচ্ছা দেখা যাবে তারপর শূকরকে বলল, বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে তোমার ঘাড় মটকাবে!

বাহঃ কী সুন্দর যুক্তি সিংহের। আর বাঘের স্বপ্ন কত স্বর্গীয়। স্বপ্ন স্বর্গীয় বটে, আমিও কত স্বপ্ন দেখি, সে সবই স্বর্গীয়। একটু আগেও আমি রাজ সিংহাসনে বসে এ বনে রাজত্ব করতে স্বপ্ন দেখলাম।

শূকরকে অভয় দিয়ে পেঁচা বলল, সে শূকরের পক্ষে ওকালতী করবে সিংহের নির্ধারিত দিবসে সে দরবারে হাজির হয়ে যথাযতভাবে তার পক্ষে ওকালতী করবে। এ বলে পেঁচা সেখান থেকে উড়াল দিয়ে গভীর বনে ঢুকে গেল।

পেঁচার কথা গুলো বাগাড়ম্বর মাত্র মনে করল শূকর। পেঁচা কি তাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে? তার আশংকা দূর হলনা। জীবনের আশা একদম ছেড়েই দিল শূকর।

তবে বিচারের নির্ধারিত দিনে রাজদরবারে হাজির হবে এবং তার পক্ষে ওকালতী করবে বলে পেঁচা যে বলে গেল, একথাকে সিংহকে জানালে ভাল হয় মনে করে শূকর সেদিনই সিংহকে তার উকিল পেঁচার কথা জানিয়ে আসল।

ইতিমধ্যে বাঘের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। বাঘটির উদ্দেশ্য কত জঘন্য তা ভাবতে ভাবতেই শূকর বুঝতে পারল সবলের সঙ্গে দুর্বলের বন্ধুত্ব কত ভঙ্গুর।

পশুরাজ সিংহ যে দিনটি বিচারের জন্য নির্ধারণ করেছিল সে দিনই ঠিক বিচার সভা বসল। বনের পশু-পাখি একে একে হাজির হচ্ছে। হরিণ, খরগোশ, সজারু, বানর প্রভৃতি তৃণভোজী পশুর দল শূকরের চারপাশ ঘিরে বসেছে।

তারাও যেন শূকরকে সমবেদনা জানাচ্ছে। এছাড়া তাদের কিছু করার নেই। শিয়াল, বন্য কুকুর, নেকড়ে বাঘের সামনে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তারা ঘন ঘন বাঘ আর সিংহের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। বুনো মহিষ, সম্বর, হরিণ, গয়াল, গন্ডার, হাতি সবাই পরস্পর সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ দরবারের পাশে ঘন ঝোপের বন ছিল।

পশুরাজ তার রাজকীয় আসনে এতক্ষণে এসে বসেছে। প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে শূকরের আগমন জানতে চাইল।

তখন শূকর ভীষণ ভাবে কাঁপতে কাঁপতে এক লাফ দিয়ে বেদনার্ত কন্ঠে জবাব দিল, আমি হাজির, ধর্মাবতার। সিংহ জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোর উকিল? দুবার, তিনবার জিজ্ঞেস করলেও শূকর কোন জবাব দিতে পারল না।

তার উকিল পেঁচার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। সিংহ গর্জন করে উঠল এবং শূকরকে লক্ষ্য করে বলল, তুই ছেলে খেলা পেয়েছিস, তোর উকিল হাজির করবে বলে অনর্থক সময় নষ্ট করেছিস, আমাকেও অপমান করলি। তারপর বাঘকে সিংহ বলল বাঘ তুমি তৈরি হও।

সভায় পশুদের গুঞ্জন উঠল। বাঘ শরীর একঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শূকরের মৃত্য সে যেকোন সময় ঘটাতে পারে। কেবল পশুরাজের হুকুমের জন্য অপেক্ষা। পশুরাজ তাকে তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছে।

হত্যা কর বললেই সে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবে না, প্রয়োজনও নেই। এক লাফেই সে শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে দেবে। সিংহ এবার তার শেষ নির্দেশ দেবার জন্য গলা পরিষ্কার করে নিল।

ঠিক তখনিই সিংহের মাথার উপ্রে অবস্থিত ঝোপের আড়াল হতে বের হয়ে পেঁচা পশু সভার মধ্যে মহা উল্লাসে নাচতে লাগল। নাচছে তো নাচছেই, নাচতে নাচতে এক পর্যায়ে উড়ে বাঘের মাথায় লাথি মারে, আবার শুন্য উঠে।

আবার নীচে নেমে সিংহের সামনে উল্লাসে নাচতে থাকে। শূকর খেয়াল করল তারই উকিল পেঁচা। কিন্তু এরকম করছে কেন তার উকিল? রাজ সভায় ওকালতী করতে এসে একি বেয়াদবি। এতে আরও বিপদ বেড়ে গেল, নয় কি? রাজা ভীষণ রেগে যাচ্ছে।

এখনি হুকুম করে সব শেষ করে দেবে। শিয়াল বাহাদুরী দেখাবার জন্য এক থাবা দিয়ে সিংহের সামনে নৃত্যরত পেঁচাকে ধরে ফেলল। পেঁচা তখন আর্তনাদ করে উঠল; আ-হা-হা, করলে কি! করলে কি!

রাজ সিংহাসনে বসতে না বসতেই তুমি আমাকে ধরে ফেললে! তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে! তারপর পেঁচা সিংহকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহারাজ আপনি ধর্মাবতার! আপনি বিচার করুন। আমার স্বর্গীয় স্বপ্ন শিয়াল ভেঙ্গে দিল।

সিংহ উম্মত হয়ে গর্জন করে উঠল। বেটা তোর আবার কি স্বপ্ন? যত সব আজগুবি ব্যাপার। তখন পেঁচা শিয়ালের হাত থেকে এক সুযোগে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে উঠে বসল। তারপর বলল, বনের পশু-পাখি ভাই বোনেরা, আপনারা কেউ কি স্বপ্ন দেখেন না?

কোন দিন কেউ স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখেছেন। শুধু এ বাঘই স্বপ্ন দেখে কি? স্বপ্ন দেখার কি তারি একচেটিয়া অধিকার? তখন গন্ডার তার মুখ উঁচু করে গোঁ গোঁ করে বলল, স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে এবং সবাই স্বপ্ন দেখে, কেন না স্বপ্ন হচ্ছে স্বর্গীয় ব্যাপার।

সিংহ একটু নরম হল। পেঁচাকে বলল, তোর স্বপ্নটা আবার কী? পেঁচা বলল, স্বপ্নটা বর্ণনা করতে আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ। আপনি যদি অভয় দেন আমি বলব। সিংহের মুখে একটু বিদ্রুপ ভ্রূকুটি দেখা গেল।

তাচ্ছিল্য ভরে বলল, দেখি, বল দেখি, তোর কেমন স্বর্গীয় স্বপ্ন! যার দর্শনে তুই উম্মাদ হয়ে গিয়েছিস! এবার পেঁচা খুব বিনয় সহকারে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল; মহারাজ ধর্মাবতার!

আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনি আপনার মেয়েকে মহা ধুমধামের সহিত আমার সাথে বিয়ে দিয়ে সুসজ্জিত রাজ সিংহাসন দান করছেন তারা সবারই আপনার আস্তানায় বিপুল খাদ্য ভোজ্য উদর পূর্তি করছে। আহা! কত আনন্দ! কী স্বর্গীয় আনন্দ মহারাজ!

সিংহের রাগ শতগুণ, সহস্রগুণ বেড়ে গেল। উম্মত আক্রোশে আসন ছেড়ে উঠে হুংকার ছাড়ল; বেটা কোন সাহসে তুই একথা উচ্চারণ করলি? তুই বেটা স্বপ্ন দেখলি কেন?

আহাম্মক কোথাকার! তখন হাতি তার দুইকান ও লেজ নেড়ে শুঁড় উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে বলল, কি অদ্ভুত স্বপ্নরে বাবা! বড় অদ্ভুত স্বপ্ন! বাঘের স্বপ্নের কথা আমি বিশ্বাস করতাম না। এবার কিন্তু বিশ্বাস করলাম।

পেঁচাকে আমাদের সবার সামনে রাজ সভায় উল্লাসে নৃত্য করতে দেখলাম। রাজার সামনে এরূপ নৃত্য করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু পেঁচা যে স্বপ্ন দেখেছে এটি স্বর্গীয় ব্যাপারই বটে, তা সত্য, অতি সত্য। গন্ডার গোঁ গোঁ করে বলল, আমিও বলেছিলাম শুধু বাঘ নয়, আরো অনেকেই নানা রঙের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং দেখেও থাকে।

তৃণভোজী প্রাণীরা এবার উল্লাসিত হয়ে উঠল। তারা বলল, রাজকন্যার সঙ্গে পেঁচার বিয়ে হতে হবে, এখনই বিয়ে হোক। পেঁচাকে সিংহাসন প্রদান করে বনের পশু-পাখিগণকে বিয়ের খানা ভুরি ভোজ দেয়া হোক। আমরা উদর পূর্তি করে খাব।

সিংহ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইল। বাঘ অম্লান মুখে সিংহের দিকে আর মাঝে মাঝে শুকরের দিকে তাকায়।

পেঁচা আবার খুব নম্র এবং বিনয়ের সাথে সিংহকে বলল, মহারাজ ধর্মাবতার, আপনি বনের অধিবাসী পশু-পাখিদের রাজা, সর্বময় কর্তা বাঘের স্বপ্নের শর্তপূরণ করার জন্য বাঘকে যদি শূকরকে মারতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি সে স্বপ্নের শর্ত অনুযায়ী রাজ কন্যা বিয়ে করতে এবং সিংহাসন লাভ করার জন্য আমাকেও নির্দেশ দেন।

পশুরাজ সিংহ নিজের ফাঁদে নিজে জড়িয়ে পড়ছে দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। উপস্থিত বনের পশু-পাখিরা কলরব করে উঠল।

বাঘ তখন ম্লান মুখে পশুরাজ সিংহের প্রতি চেয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর পশুরাজ সিংহ স্বপ্ন দর্শন অনুসারে শূকরকে ভক্ষণ করার বাঘকে যে অধিকার দিয়েছিল তা নাকচ করে দিল।

অধিকন্তু, শূকরটির কোন বিপদ হলে তাতে বাঘকেই দায়ী করা হবে। এই ফরমান জারি করে পশুরাজ নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস পেল।


তথ্যসূত্র : তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : তেন্দেরার পচ্ছন

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা

জালিম্বর একজন আঙু। “আঙু” হল সমাজপতি বা দলপতি। পরবর্তীতে কোন তালুকের অধিকারীকে আঙু বলা হয়।

জালিম্বর একদল লোক নিয়ে রোয়াঙ্গ (আরাকান) থেকে যখন আনকে (চট্টগ্রাম অঞ্চলকে রোয়াঙ্গারা আনক অর্থাৎ পশ্চিম দেশ বলে) আসে তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোগলদের প্রভাব ছিল।

তাই দলবল নিয়ে সে নাক্ষ্যংছড়ি ও রামু হয়ে উত্তর দিকে সরে ক্রমে ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে কোন সরকারী বনাঞ্চল ছিল না, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল মুক্ত বনাঞ্চল। জালিম্বর আঙুর দলবল তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের এক সুবিধাজনক স্থানে গ্রাম পত্তন করে জালিম্বর আঙু তাঁর দলবল নিয়ে বাস করতে থাকে। তাঁর দলের লোকেরা জালিম্বরকে আঙু বলে মেনে নেয়।

সে জালিম্বর-আঙু নামে পরিচিত হয়। বিয়ের সাত বছর পর তাঁর একমাত্র পুত্রের জন্ম হয়। জালিম্বর এবং তাঁর স্ত্রী বাদীমুই ছেলেটিকে কিভাবে আদর করবে তা নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হত।

তাঁরা অতি আদরের ছেলেটির নাম রাখল চিজিগুলা। কিন্তু পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ আদর করে কিংবা বিদ্রুপ করে ডাকে গুলা। চিজি বাদ দিয়ে শুধু গুলা। তাঁরা অতি আদর যত্ন নিয়ে ছেলেটিকে বড় করতে লাগল।

কিশোর বয়সে চিজিগুলার জন্য বৌ আনতে শখ জাগল জালিম্বর আঙুর। পাড়ার সবচাইতে সুন্দরী ফুলরেণুকে চিজিগুলার জন্য বৌ ঠিক করা হল।

ফুলরেণু বয়সে গুলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং পূর্ণ যুবতী না হলেও তার বিয়ের সাধ হয়েছে। বাগল্যার সঙ্গে তার আইপাই (মন দেয়া নেয়া) এবং ঘনিষ্টতার কথা কারোর অজানা ছিল না।

ফুলরেণু এ বিয়েতে কোন মতেই রাজি নয়। তার অভিযোগ হচ্ছে গুলা তার চেয়ে বয়সে ছোট, এখনো কিশোর এবং গুলা ভাল করে কথা বলতে পারে না, তার জিহ্বায় আড়ষ্টতার দোষ আছে।

ফুলরেণুর বাবা মা আঙুর একমাত্র সন্তান বিবেচনা করে গুলার সঙ্গে মেয়ে ফুলরেণুর বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে। বিয়ে যে দিন হবে, তার আগের রাতে ফুলরেণু বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে যায়।

সকাল হতে না হতেই ঐ খবরটি জালিম্বর জানতে পারে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একজন বিশ্বাসী লোক পাঠিয়ে দিল ভিনগ্রামের তাঁর মামাত ভাই নাগর্য্যার কাছে।

লোকটি গিয়ে নাগর্য্যাকে বলল, জালিম্বর তাঁর ছেলে চিজিগুলোকে বর সাজিয়ে নিয়ে আসছে, সে যেন তার মেয়ে মুগুলিকে কনে সাজিয়ে রাখে।

চিজিগুলা আর মুগুলির আজই বিয়ে হবে। সব ব্যবস্থা যেন নাগর্য্যা করে রাখে। নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী খবরটি পেয়ে বিস্মিত হলেও বরঞ্চ খুশি হল।

তার মেয়ে মুগুলির বয়স চিজিগুলার চেয়ে দু বছরের বড়। এমনিতে আত্মীয় আর জালিম্বর হচ্ছে আঙু বা দলপতি, কাজেই নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী জালিম্বরের কথায় বেরাজী হল না।

মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল নাগর্য্যা মহা ধুমধাম সহকারে না হলেও সে দিন ঠিক ঠিক চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ে হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভুরি ভোজন করে চিজিগুলা আর মুগুলিকে আশীবাদ করল।

জালিম্বর আঙু জুম চাষ করলেও তার কিছু ধান্যজমি আছে। গরু, ছাগল, মহিষ, শূকর, হাঁস-মুরগি গৃহপালিত পশু-পাখি তাঁর অঢেল আছে। তাঁর পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। একেবারে ধনী বলা না গেলেও দরিদ্র নয় জালিম্বর আঙু।

মুগুলির সঙ্গে বিয়ে হলেও চিজিগুলা ফুলরেণুকে ভুলতে পারেনি। তার কথা মাঝে মাঝে মুগুলিকে শোনায়।

উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটি হয়। চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ের তিন বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী মারা যায়।

এর চার বছর পর জালিম্বরও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চিজিগুলা আর মুগুলির জোড়া তালি দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা তাদের শেষাংশ উচ্চারণ করে ডাকে। যেমন – চিজিগুলাকে শুধু গুলি।

উভয়ের কথা বলতেই শুধু গুলাগুলি উচ্চারণ করে হাসে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। গুলাগুলির সংসারে বিয়ের দীর্ঘ ছয় বৎসরেও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি।

জালিম্বর আঙু স্বপ্নে দর্শন দিয়ে গুলাকে বলে, চিজিগুলা তোমরা বড় একা হয়ে গেছ, আমি আসছি। আমি তোমার ঘরে আসছি।

কিছুদিনের মধ্যে গুলা বুঝতে পারল গুলি গর্ভধারণ করেছে। সে তার স্বপ্নের কথা গুলিকে বলে ফেলল। তাদের বিশ্বাসমতে গুলার পিতা জালিম্বর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে।

এতে তারা খুশি হল। ঠিক দশ মাস দশদিন পর মুগুলি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাদের আনন্দ এখন দেখে কে!

সন্তানটি বড় হতে থাকে। যখন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, পাড়া মাতিয়ে রাখে ছেলেটি। তার বাবা-মাকে সে বাবা-মা ডাকে না।

বাবাকে ডাকে গুলা আর মাকে ডাকে গুলি। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে ছেলেটা। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচরণে চাতুর্য প্রকাশ পেতে থাকে।

পাড়ার লোকেরা তাকে তেন্দেরা নামে ডাকতে থাকল। একদিন গুলা এবং গুলিও ছেলেটিকে তেন্দেরা নামেই ডাকতে থাকে।

একদিন গুলা জঙ্গল থেকে একটি কচ্ছপ ধরে নিয়ে এল ঘরে। ডিমওয়ালা কচ্ছপ। কচ্ছপ কেটে রান্না করা হলে তেন্দেরা বলল যে, সে ডিমগুলোই খাবে, ডিম বাদে কিছুই খাবে না।

গুলা এবং গুলিও এতে খুশি। একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে খাবে কে? কিন্তু কচ্ছপের সেই হলদে রঙ্গের ডিমগুলো খাওয়া শেষ করে তার বাবা-মাকে বলতে লাগল, ইস!

তোমরা কী খাচ্ছ? আমাকে একটুও দিলে না। আমিও কচ্ছপের মাংস খাব। কচ্ছপের মাংস পেট ভরে খেল ডিমগুলো খাওয়ার পর।

খেয়ে বলতে লাগল, ইস এটা ডিমের চেয়ে সুস্বাদু। সে মুরগি বা মোরগের গিলা, কলিজা খায় না, শুধু খায় মাথা, ঠ্যাং ইত্যাদি। গুলাগুলি এই ডানপিটে ছেলে তেন্দেরার কান্ডে অবাক হয়ে থাকে।

বয়স বার, তের হতে না হতেই তেন্দেরার দেহে, মনে যৌবন এসে গেল। সে পাড়ার তরুণীদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়।

পাড়ার ছেলেরা তাকে চোখে চোখে রাখে, সাবধান করে। গুলাগুলি ছেলের এই আচরণ দেখে মর্মাহত হয় এবং তার জন্য বৌ আনার সিন্ধান্ত নেয়।

পাড়ায় অনেক তরুণী তাকে পছন্দ করলেও তেন্দেরা বিয়েতে রাজি হয়নি। তাই একদিন তারা তেন্দেরাকে ঘর থেকে নামিয়ে দেয়। তাকে বলে দেয় যে, সঙ্গে বৌ না নিয়ে আসলে ঘরে উঠতে পারবে না।

তেন্দেরা কোন কথা না বলে বেড়িয়ে পড়ল শূণ্য হাতে। পকেটে টাকা পয়সা নেই। কোন যুবতীর মন পেতে হলে নূন্যতম পক্ষে সুগন্ধি তৈল, আয়না, চিরুনি দিতে হয় একথা তেন্দেরার জানা আছে কিন্তু সে এগুলো পাবে কোথায়?

টাকা পয়সা থাকলে বাজার থেকে সে কিনে নিতে পারত। কিভাবে টাকা পাওয়া যায় একথা ভাবতে ভাবতে তেন্দেরা এক স্থানে গিয়ে দেখে একজন চাষী হাল চাষ করছে।

এক জোড়া মহিষের হাল। সে মিষ্টি কথা বলে চাষীর সঙ্গে সখ্যতা করে বলল, দাদা তুমি বিশ্রাম কর, আমি তোমার বদলে হাল চালাই। লোকটি তাতে রাজি হল এবং তেন্দেরা হাল চষতে লাগল।

বেশ খানিকক্ষণ চষার পর তেন্দেরা লোকটিকে বলল, দাদা মশা-মাছি মহিষ দুটোর গায়ে বসে বড় উৎপাত করে। এতে মহিষগুলো বিরক্ত হয়, লাঙ্গল টানতে চায় না।

বরঞ্চ মহিষ দুটোর গায়ে কাদা লেপে দিলে মশা-মাছি গায়ে বসে উৎপাত করবে না। মহিষ দুটো আরাম করে হাঁটবে, লাঙ্গল টানবে। দাদা, আমি তাই করি,  কী বল?

লোকটি আপত্তি করল না। তেন্দেরা মহিষ দুটোর গায়ে ভালভাবে কাদা লেপে দিল। সূর্যের তাপে কাদা শুকালে মহিষ দুটোর কালো রং সাদা হয়ে গেল এবং দুটো সম্পূর্ণ নতুন মহিষ বলে মনে হতে লাগল।

তেন্দেরা একটু পর লোকটিকে বলল, দাদা আমার পানির তৃঞ্চা পেয়েছে, তোমার ঘরে গেলে কি পানি খেতে পারব? লোকটি বলল, “সে কি কথা? পানি কেন পাবে না?

যাও ঐ যে টিলার ওপর ঘর, ওখানে গিয়ে স্ত্রীকে বললে পানি দেবে। তেন্দেরা সন্দেহের ভান করে বলল, দাদা যদি পানি না দেয়, তখন আমি তোমাকে বলব, দিচ্ছে না তাহলে তুমি তাকে দাও, দাও বলবে তো?” লোকটি স্বাচ্ছন্দে রাজি হল।

তেন্দেরা ধীর পায়ে টিলার ওপর লোকটির ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিনয় সহকারে কুশল জিজ্ঞেস করে, খুশি করল।

তারপর বলল, বৌদি দেখ, দাদা মানে তোমার স্বামী একটু আগে আমার কাছ থেকে এক জোড়া হালের মহিষ কিনেছে ঐ দেখ সাদা মহিষগুলি।

তোমার নিকট থেকে মহিষ দুটোর দাম দু’শো টাকা নেবার জন্য দাদা পাঠিয়েছে, তুমি আমাকে দু’শো টাকা দাও। তখন স্ত্রী লোকটি উত্তরে বলল, কি যাতা বলছ, আন্দাজে কেন টাকা দেব?

তেন্দেরা বলল, তাহলে আমি তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছি, দেখ সে কি বলে। তেন্দেরা ডাক দিয়ে লোকটিকে বলল, দাদা কথামত তোমার স্ত্রী দিচ্ছে না। এই কথা শুনে লোকটি রাগত স্বরে জোরে জোরে বলল, আরে দাও, দাও।

অগত্যা স্ত্রী লোকটি বাক্স থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দুশো টাকা দিয়ে দিল। তেন্দেরা টাকা পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে চম্পট দিল দূরে অনেক দূরে।

হাঁটতে হাঁটতে সাত গাঙ সাত পাড়া পার হয়ে এক বাজার থেকে সুগন্ধি তেলের বোতল, আয়না, চিরুনি এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী কিনে থলে ভর্তি করে নিল।

একদিন সাঁঝের বেলা শামুকছড়ি পাড়ে এক পাড়ায় এসে পৌঁছাল তেন্দেরা। পাড়ার এক প্রৌঢ়া ও একজন তরুণী। মা ও মেয়ে। মা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি আনতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি সাঁঝের বেলায় একা পানি আনার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে।

তেন্দেরা তরুণীকে দেখে পছন্দ করল। প্রৌঢ়া মহিলাকে মাসী সম্বোধন করে কুশল জিজ্ঞাসা করল। প্রৌঢ়া মহিলা বিস্মিত হয়ে তেন্দেরাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো! আমাকে কেন মাসী ডাকছ, আমার তো এ জম্মে কোন বোন নেই।

তুমি কোথেকে এলে? তেন্দেরা বিনীতভাবে বলল, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই দেখছি। আমার মায়ের চেহারা ঠিক তোমার মত। যা হোক আমি তোমাকে মাসি বলে ডাকব।

মাসী আমাকে কলসিটা দাও, আমি পানি এনে দিচ্ছি। মা ও মেয়ে উভয়ে খুশি হল। তরুণীটি কলসিটি তেন্দেরার হাতে দেওয়ার সময় তেন্দেরা তার থলেটি তরুণীর হাতে দিয়ে বলল, বোন এই থলেতে যা আছে সব তোমার জন্য এনেছি, তুমি রেখে দাও।

তেন্দেরা কলসিটি ভরে পানি নিয়ে উঠানে পৌঁছার আগে থেকে প্রৌঢ়া বকবক করছিল। তেন্দেরার কানে গেল প্রৌঢ়ার কথা গুলো, কোথা থেকে কে আসল এই সাঁঝের বেলা।

তাকে রাত্রে থাকতে দেব কিভাবে? তেন্দেরা মনে মনে ভাবল তাহলে তাকে কি এখানে থাকতে দেবে না? সে ফন্দি আঁটতে লাগল কিভাবে এই ঘরে থাকা যায়?

পানির কলসি ঘরে তুলে দিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, মাসীমা কী কী কাজ আমাকে দাও আমি করে ফেলি। আমাকে অন্য ঘর খুঁজতে হবে থাকার জন্য। মহিলা বুঝল তেন্দেরার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, অথচ কাজ করে দিতে বলছে।

তখন তেন্দেরাকে জিজ্ঞস করল, তুমি কোথা থেকে আসছ? কে তুমি? তেন্দেরা জবাব দিল সে আঙু জালিম্বরের নাতি। তখন মাহিলার মনে আগের কথা স্মরণ হল, ভাবতে লাগল সে।

জালিম্বর আঙু তার ছেলে চিজিগুলার জন্য তাকে বৌ ঠিক করেছিল। কিন্তু যে দিন বিয়ে হবে তার আগের রাতে বাগল্যার সঙ্গে সে পালিয়ে গিয়েছিল।

ছয়/ সাত বছর সুখে ঘর করে একমাত্র কন্যা কুকলিকমালা জম্ম গ্রহণ করে এবং তার জম্মের এক বছর পর বাগল্যা মারা যায়।

প্রৌঢ়া ফুলরেণু তেন্দেরার বাপের নাম জিজ্ঞেস করতেই তেন্দেরা জবাব দিল, তার বাপের নাম গুলা। এবার ফুলরেণু বলল, তুমি চিজিগুলার ছেলে তাহলে?

তেন্দেরা হ্যাঁ বলল, এই সাঁঝের বেলা আর কোথায় যাবে, এখানেই থাক। এর আগে কোনদিন কোন ছেলে বা পুরুষকে আমাদের ঘরে থাকতে দেইনি, আমার মেয়ে কুকলিকমালা।

মেয়ে কুকলিকমালাকে তেন্দেরাসহ তিনজনের ভাত রাঁধতে বলল ফুলরেণু। কুকলিকমালা ইতোমধ্যে তেন্দেরার দেওয়া থলে থেকে সুগন্ধি তেল মাথায় দিয়ে আয়না দেখে চুল আঁচড়িয়ে মনের মত সেজেছে।

সে কোন কথা না বলে ভাত রাঁধতে শুরু করে। তেন্দেরার আগমনে সে খুশি হয়েছে!

একদিন দুদিন থেকেও তেন্দেরা ঘর থেকে চলে যাওয়ার নাম করল না। মা আর মেয়েও উচ্চবাচ্য করেনি।

তেন্দেরা ফন্দি আঁটে কিভাবে কুকলিকমালাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবে। ফুলরেণু মাঝে মাঝে ভাবে, চিজিগুলা ভালভাবে কথা বলতে পারে না।

জিব্বায় যেমন জড়তা আছে তেমনি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তার ছেলে তেন্দেরার বুদ্ধিইবা কত হবে, আর এই তেন্দেরা তার মেয়ে কুকলিকমালার জামাই হবে কিভাবে?

ফুলরেণু একদিন রাত্রে তেন্দেরাকে বলল, তুমি দেখছি এখানে থেকে চলে যাবার নামও করছ না, এভাবে থাকলে লোকে বদনাম করবে।

তুমি আমার জন্য তিনটা জিনিস নিয়ে আস, যদি নিয়ে আসতে পার তবে এখানে থাকতে পারবে এবং আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করলে তার সাথে বিয়ে দেব।

আর যদি তিন দিনের মধ্যে এ জিনিস গুলি আনতে না পার তবে এখান থেকে চলে যাবে বুঝলে? সেই তিনটি জিনিস হল – (১) বোঁটাহীন ফল, (২) যে ফলের বিচি বাইরে এবং (৩) যে জিনিস এক বাটি খেলেও সেই বাটি পূর্ণ থাকে সেই জিনিসে।

এই তিন দ্রব্যের নাম শুনে তেন্দেরা বোকা বনে গেল। আসলে সে ঐগুলি চিনে না। সে হতাশ হয়ে গেল।

তেন্দেরা ম্লান মুখে কুকলিকমালাকে বলল যে, সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। কুকলিকমালা তেন্দেরাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই তেন্দেরাকে এই তিনটি দ্রব্য কী কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তার সন্ধান দিল।

সে বলল, তুমি চিন্তা কর কেন? এগুলো নিয়ে আস যাও। সে বলল, আমাদের ঘরের পাশে যে ছড়া তার নাম শামুকছড়ি।

এই ছড়ার উজানে যেতে যেতে ডানে একটা ছড়া দেখবে তার নাম তামছড়ি। সেই ছড়ার দু’ধারে অনেক ফল গাছ। ওগুলো তাম গাছ। দেখবে তাম (কাগু বাদাম) ধরে আছে গাছে। ফলগুলোর বাইরে বিচি।

এখান থেকে তাম পেড়ে নিয়ে আসার সময় দেখবে ছড়াতে অনেক শামুক। সেই শামুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। যাও দেরি করোনা।

তেন্দেরা তার কথামত গিয়ে দেখে সত্যই গাছে তাম ফল ঝুলতেছে। সে পাকা তাম ফল এক থলে নিয়ে আসার সময় এক থলে শামুকও কুড়িয়ে নিল ছড়া থেকে।

তখন দুপুর হয়ে গেছে। ঠিক তখন কুকলিকমালার মুরগিটা কক কক কতাক কক কক কতাক করে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো খোপ থেকে নেমে গেল।

তেন্দেরা সেখানে পৌঁছলে কুকলিকমালা তাকে ঐ খোপ থেকে মুরগির পাড়া ডিম নিয়ে আসতে বললে তেন্দেরা ঠিক ডিমটা নিয়ে এল।

এবার কুকলিকমালা তেন্দেরাকে ঐ তিনটা জিনিস সহ তার মার কাছে নিয়ে গেল। ইশারায় ঐসব জিনিস তার মাকে দিতে বলল কুকলিকমালা।

ফুলরেণু তিনটা জিনিস পেয়ে খুশি হল। তখন কুকলিকমালা তেন্দেরাকে বলল ডিম হচ্ছে বোঁটাহীন ফল, তার কোন বোটা নেই। তামের বিচি ফলের বাইরে। ফলের নিচে ঝুলে থাকে।

আর শামুক একবাটি খেলেও (তার সাঁশ খাওয়া যায়) খোলসগুলো পড়ে থাকে কাজেই একবাটি খেলেও এক বাটিই অবশিষ্ট থাকে।

তেন্দেরা কুকলিকমালার কথা মত বুঝিয়ে বলল। ফুলরেণু খুশি হল। কিন্তু তা স্বত্বেও তার মেয়ে কুকলিকমালাকে চিজিগুলার ছেলে তেন্দেরার জন্য বৌ দিতে রাজি নয় ফুলরেণু।

কুকলিকমালা জানে তার মা ফুলরেণু তার বাবা বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কাজেই তার মা যদি পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে পারে, সে কেন তেন্দেরার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না, ভাবে কুকলিকমালা।

এক রাত্রে সত্যি সত্যি তেন্দেরার হাত ধরে পালিয়ে গেল কুকলিকমালা। তেন্দেরা কুকলিকমালাকে নিয়ে সোজা ঘরে ফিরে এল। গুলাগুলি ছেলে আর ছেলের বৌ দেখে মহা খুশি হল।

কিছুদিন পর গুলা তেন্দেরাকে নিয়ে পাড়ালিয়াদের সঙ্গে কাট্টনে গেল। নৌকার কাট্টন। তারা এক মাসের খোরাকি নিয়ে দেড় দিনের হাঁটা পথের গভীর বনে চলে গেল।

ঘরে রইল গুলি আর তেন্দেরার নববধূ কুকলিকমালা। একমাসের প্রায় শেষ, কিন্তু নৌকার কাজ এখনো অনেক বাকি এদিকে খোরাকিও প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

তাই তেন্দেরা বাড়ি ফিরল খোরাকি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল তার মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কুকলিকমালা কী করবে দিশেহারা হয়ে আছে।

তেন্দেরা বৈদ্য এনে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাল। কিন্তু কয়েকদিন পর তার মা গুলি মারা গেল। তেন্দেরা তার বাবা গুলাকে খবর দিতে পারল না – তার মা শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করল।

এদিকে খোরাকি নিয়ে না গেলে তার বাবা উপোসে মরবে, আর খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবার কাছে গেলেও ঘরে কুকলিকমালা একা থাকতে পারবে না।

তাই একদিন সে ফুলরেণুকে তেন্দেরার নিজেদের ঘরে আনতে গেল। তেন্দেরা অবশ্য ভেবে নিয়েছে- ফুলরেণু তাদের ঘরে কোনদিন যাবে না।

তাই ফুলরেণুর কাছে  পৌঁছামাত্র হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমরা বাপবেটা নৌকার কাট্টনে গিয়েছিলাম- সেখানে নৌকার কাজ অর্ধেক করে বাবা গুলা মারা গেছে আর সেদিন মা গুলিও মারা গেল।

এখন নৌকাটার কাজ সম্পন্ন করে নিয়ে আসতে হবে। বিক্রি করলে টাকা পাবে। তাই আমি কাট্টনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে কুকলিকমালা একা থাকবে কিভাবে?

আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তেন্দেরার কথা ফুলরেণু ভেবে দেখল।অমনি সে একা থাকা পছন্দ করেনা – এখন তার মেয়ের সঙ্গে তাদের ওখানে থাকলে খারাপ কিছু নয়, তাই তেন্দেরার কথায় সে সহজেই রাজি হয়ে গেল।

ঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারে তেন্দেরা নিয়ে নিল। ফুলরেণুও তার কাপড় চোপড় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যা পারল সঙ্গে নিয়ে তেন্দেরার ঘরে এসে পৌঁছল।

দুদিন পর তেন্দেরা কিছু দিনের খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবা গুলার কাছে চলে গেল। সে তার মা গুলির মৃত্যুর কথা তার বাবা গুলার কাছে গোপন রাখল।

সে বরঞ্চ বলল যে, তার মা গুলি ভয়ানক অভিমান করে আছে। এত দীর্ঘ সময় যে কোনদিন প্রবাসে কাটায়নি। এবার দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে গুলা।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর প্রতি দিওয়ানা হয়ে আছে।ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আফসোস করল। মনে মনে ভাবল এতদিন প্রবাসে থাকা কী ঠিক হল ?

তেন্দেরা আবার বলল, তুমি ঘরে গেলে মা কামরাতেই পড়ে থাকবে দেখো। গুলা মনে মনে ঠিক করল তাতে কী আছে যায়, ঘরে গিয়ে সোজা কামরার ভিতরে গুলিকে জড়িয়ে ধরলে সব অভিমান ভেঙ্গে যাবে গুলির। তাই সে জড়িয়ে ধরবে। মনে মনে ঠিক করল গুলা।

কয়েকদিন পরিশ্রম করে বাপ-বেটা অসস্পূর্ণ নৌকাটি সম্পূর্ণ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। দেড় দিন নদীর পথে নৌকাটি ভাসিয়ে এনে একদিন সন্ধ্যায় বাজার ঘাটে ভিড়াল তারা।

তেন্দেরা তার পিতাকে বলল, তুমি নৌকাটি বাজারে বিক্রি কর আর আমি আমাদের কুড়াল, দা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ঘরে নিয়ে যাই।

মাকে তুমি এসেছ বলে সংবাদ দিব-তাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। এই কথা বলে সে ঘরে এল আর গুলা নৌকাটি বিক্রির জন্য বাজারে থেকে গেল।

ঘরে এসে তেন্দেরা ফুলরেণুকে বলল, আমরা নৌকাটা নিয়ে এসেছি, আমি একা পারিনা বলে আমার এক মামাও সঙ্গে এসেছে।

তাকে নৌকা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠিয়েছি। সে নৌকা বিক্রি করে রূপার টাকা নিয়ে ঘরে আসবে। সে হয়ত ফিরতে রাত হবে।

তোমার খওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে পার ,আমি আমার মামার জন্য জেগে থাকব।গ্রামে সন্ধ্যা হতে না হতেই লোকজন খাওয়া–দাওয়া করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তেন্দেরার কথামতে তারা সাঁঝের আঁধার হতে না হতে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তেন্দেরা যতদিন কাট্টনে ছিল, ততদিন ফুলরেণু আর তার মেয়ে কুকলিকমালা ঘরের বারান্দাতে ঘুমাত।

আজ তেন্দেরা ঘরে আসাতে কুকলিকমালা আর তেন্দেরা ঘরের পিছনের কক্ষ অজলেঙে ঘুমাবে। তেন্দেরা গুলরেণুকে বলল, আমার মামা এলে খাওয়া দাওয়া, করে এখানে থাকবে। সে বারান্দাতে ঘুমাবে, কাজেই তুমি ভিতরের কামরাতে ঘুমাও।

ফুলরেণু ঘরের ভিতরে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কুকলিকমালা তাদের জন্য অজলেঙে বিছানা প্রস্তুত করে তেন্দেরার কথিত মামার জন্য বারান্দাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুলা বাজারে নৌকাটি বিক্রি করে রাত হলে রূপার টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে এল। গুলার মনে আছে, তেন্দেরা বলেছে গুলি তার প্রতি অভিমান করে আছে।

গুলা ঘরে ফিরে তেন্দেরা আর কুকলিকমালাকে দেখল কিন্তু গুলিকে দেখলনা। গুলি নিশ্চয়ই অভিমান করে ভিতরে শুয়ে আছে মনে করে গুলা সোজা ভিতরে চলে গেল।

তখন সেখানে অন্ধকার। গুলা হাতড়িয়ে ধরতে পেল কে একজন শুয়ে আছে। সে জড়িয়ে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ঘুম থেকে জেগে হতভম্ব হয়ে হাত–পা ছঁড়তে লাগল।

গুলা ততোধিক জোরে চেপে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ভূত ভূত বলে চিৎকার করলে গুলা বলতে লাগল–না–না আমি ভূত নই।  ফুলরেণু ভয়ে গুলাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।

তাদের এই হৈ চৈ কালে তেন্দেরা আর কুকলিকমালা বাতি নিয়ে সেখানে হাজির হল। বাতির আলোতে ফুলরেণু দেখল গুলাকে আর গুলা দেখল ফুলরেণুকে উভয়েই হতভম্ব। লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে গেল।

তাদের এ অবস্থা দেখে তেন্দেরা বলল, তোমরা এভাবে জড়াজড়ি করেছ একথা লোকে জানতে পারবে। কলঙ্কের একশেষ হবে। তার চেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাল।

গুলা আর ফুলরেণু কিছুই বলতে পারল না। তাদের স্মরণ হল – কৈশরেই তো তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন হয় নি এখন শেষ বয়সে হলে ক্ষতি কী?


[পচ্ছন – রূপকথা। চিজি – (তুলনীয়) খোকা, গুলা- ফল/fruit.]

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা- রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী


তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (সা-চি)

তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘সা-চি’ বলা হয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্নি পদ্ধতি: স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সামাজিক রীতি ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘সা-চি’ হতে পারেঃ-

ক) স্বামী/স্ত্রী/যে কেউ সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের আওতায় ‘সা-চি’ করা যায়।

গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট/নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন করে ‘সা-চি’ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে (যদিও তা সামাজিক প্রথাসিদ্ধ নয়)।

কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘সাচি’ দাবী করে থাকে: নিম্নোক্ত কারণে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘সা-চি’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ

ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় বা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন যদি তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে অপরজন ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ একজন নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ তাদের সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘সা-ছি’ সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।

ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে।

চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ জঘন্য অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন সাজা ভোগ করে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘সা-চি’ দাবী করতে পারে।

ছ) যদি স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বৌদ্ধ পুরোহিত বা সাধুমা (হ্লুদমা) হয়, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহ প্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ সম্পাদন করতে পারে।

ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হতে পারে। তবে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথমবারের মতো সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।

বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল:

ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘সা-চি’ হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।

খ) ‘সা-চি’ হবার পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ হিসেবে গণ্য হয়।

গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক পূনঃ সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য লাসং/ফং গয়ানা, খানা সিয়ানা’ এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।

ঘ) ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।

ঙ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।

চ) ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ওপর স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘সা-চি’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।

ছ)‘সা-চি’ সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের | দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে কনেপণ সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।

সাচি’ সম্পাদনকালে স্ত্রীর গর্ভবতী অবস্থা :

ক) ‘সা-চি’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘সা-চি’ হওয়ার পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের দায় মেনে নিতে হয়।

উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। বিচ্ছেদকালে গর্ভবতী স্ত্রীকে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ হতে ৩ বছর পর্যন্ত ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবকালীন যাবতীয় খরচ স্বামীকে দিতে হয়।

তবে সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে। বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে এবং সন্তান যদি তখন মাতৃদুগ্ধ পান না করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।

খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘সা-চি’ এর তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে ধারণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় এবং বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য। তবে ‘সা-চি’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে তখন গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়টি ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।

গ) তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের রীতি অনুসারে স্বামী নিজে তার স্ত্রীর সাথে ‘সা-চি’ করলে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বামীর সম্পত্তির অংশ এবং স্বামীর দেয়া জরিমানার অর্থ পায় । ঐ স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ না হলে বিচ্ছেদদাতা স্বামীর নিকট হতে খোরপোষ পায় ।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি: পাহাড় কোলে নক্ষত্ররাজি

লিখেছেনঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাগুনিয়া উপজেলা, কক্সবাজার, টেকনাফ এবং উখিয়া অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি নাম দাইনাক, অনেকে দৈনাক নামেও ডেকে থাকেন। যার অর্থ যোদ্ধা। ইতিহাসের তথ্য মতে- তাঁরা শৌর্য, বীর্যে এবং বীরত্বে জগৎ খ্যাত ছিলেন। আরাকানে স্বাধীন দান্যাওয়াদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকাল ঐ অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন এবং বসবাস করে এসেছেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার তৈনছড়ি নদীর তীরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই তৈনছড়ি থেকে তাঁরা অন্য অঞ্চলে বা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তৈনছড়ি নদীটি তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এখনো ঐতিহাসিক এবং আবেদনের একটি জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে, সাথে ভালোবাসার একটি নামও। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান পঞ্চম এবং শিক্ষার হার দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তাদের আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১.০০ (এক) লাখের কাছাকাছি এবং শিক্ষার হার ৮০% এর উপরে। পরিসংখ্যান তথ্যমতে  ৪৭% তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরাম সিএডিসি ও এর বাইরে ৩.৩% শতাংশ লোক বসবাস করে, অবশিষ্ট ৫০% শতাংশ তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর- ২০১০ খ্রি)

গছা বা গোত্র

তঞ্চঙ্গ্যারা মোট ১২ টি গছা বা দলে বিভক্ত। গছাগুলো হলো- কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসা গছা, অঙ্যা গছা, মুলিমা গছা, রাঙী গছা, ওয়া গছা, তাশী গছা। কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা এই সাতটি গছা বাংলাদেশে বসবাস করে বর্তমানে। বাকিগুলো মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জানা যায়। আবার প্রতিটি গছায় রয়েছে উপগছা বা উপশাখা। যেমন: কারবআ গছার কয়েকটি উপগছা হলো- বউ গোত্তি, বলা গোত্তি, বাঅ-ল গোত্তি, আরয়া গোত্তি, ফারাঙচা গোত্তি ইত্যাদি। এভাবে অন্য গছায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে উপগছা রয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। তাদের মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তঞ্চঙ্গ্যাদের মাতৃভাষার নাম “তঞ্চঙ্গ্যা” ভাষা। জনগোষ্ঠীর নামের সাথে মিল রেখে ভাষার নামটি নির্ধারণ করা হয়।

জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন ১৯০৩ সনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে  তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারাবিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত দেন। তিনি আরো মত দেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক ভাষার (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) সাথে একই অন্তর্ভুক্ত হলেও তিবেতো-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করেছে। অনেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত বাংলা ভাষা বলে মত দেন। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে প্রচুর আরাকান বা মারমা শব্দের উপস্থিতি, প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ব্যবহ্ত বর্ণমালাগুলো বার্মিজ বর্ণমালার সাথে মিল রয়েছে এই মূল উৎপত্তি “মনখমের” দের থেকে। ব্রাহ্মী লিপি থেকে এই বর্ণমালার উৎপত্তি বলে অনেকে মত দেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার নাম দাইনাক বর্ণমালা এবং বর্তমানে ব্যবহ্ত বর্ণমালার নাম ছালাম্যা বর্ণ বা ছালামী পাঠ যার অর্থ গোলাকার। বর্ণমালার সংখ্যা সর্বমোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ ০৫ আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আরো আছে নিজস্ব সংখ্যা বা গননা পদ্ধতি।  

তাদের বর্ণমালার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কথ্য এবং লিখিত রূপ আ-কারান্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত হচ্ছে এর উচ্চারণ এবং কথ্যরীতি ¯স্বর কোমল, নরম এবং কর্কশ নয় শ্রবণে মধুর। শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রকৃতির একটা সরলতা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ গছা বা শাখাভেদে তাদের ভাষা অভিন্ন।

পোশাক ও অলংকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার রয়েছে। গছাভেদে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য রয়েছে। তবে কারবআ গছা রমণীদের রাজকীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় সবাইকে আকর্ষণ করে। রঙে, ঢঙে এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। এই পাঁচ কাপড়গুলো হলো- পিনৈন (নির্মাঙ্গ বস্ত্র), জুম্ময়া সালুম (লম্বা হাঁটা শার্ট), মাদা কাবঙ (পাগড়ি), পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) এবং জুম্ময়া খাদি (ওড়না বিশেষ)। প্রতিটি পোশাকে রয়েছে নিজস্ব এবং ¯স্বতন্ত্র নকশা, ফুল এবং ডিজাইন। এসকল নকশা এবং ফুলগুলো জুম এবং প্রকৃতি থেকে নেওয়া, পাওয়া। আর ছেলেদের পোশাক সাদা ধূতি এবং লম্বাহাটা সাদা শার্ট। অলংকার হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যারা প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব স্টাইল এবং ডিজাইনে অলংকার পড়ে থাকে। এক সময় রৌপ্য অলংকার ব্যবহারে প্রচলন ছিল বেশ। এখন রৌপ্য পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতুর অলংকার ব্যবহার করে তাঁরা। যেমন- কানে রাইজ্জু ও জংগা, কব্জিতে বাঘোর, কুসই খারু, কিয়াইংশিক, বাহুতে তাজ্জুর, গলায় চন্দ্রহার, আলচুরি, জামছড়া, পিসিছড়া ইত্যাদি। তবে আধুনিককালে গলায় স্বর্ণ, রুপোর চেইন, আংটি, নুপুর, নেকলেস পড়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা। পুরুষরাও চেইন, আংটি পড়ে থাকে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জুনু তঞ্চঙ্গ্যা (হিল এক্সপ্রেস)

ঘর-বাড়ি ধরণ এবং বসতঘর

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এই পাহাড় এক সময় প্রচুর বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। চারিদিকে গহীন বন। তখন এই বনে প্রচুর পরিমাণে হিংস্র বন্য পশু-পাখি বসবাস করতো। আদিবাসীরা যেহেতু পাহাড়ে এবং বনের মধ্যে বসবাস করে তাই বন্য হিংস্র পশু-পাখির সাথে এক প্রকার সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। মূলতঃ বন্য পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘরগুলো মাচাং আকারে মাটি থেকে একটু উচুতে তৈরি করতো। মূল ঘরের সাথে একটি ইচরও থাকতো। ইচর মূলতঃ খোলা হাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা। একটি মূলঘরের সাথে কয়েকটি অংশ থাকে। অংশগুলো হলো- সিঙকাবা, পিনা, গুদি, বারান্দা এবং রান্না ঘর। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঘর থাকে তঞ্চঙ্গ্যাদের। ঘরগুলো হলো-জুমঘর (জুম চাষের সময় তৈরি করা হয়। একে প্রভাস্যা ঘরও বলা হয়), ডেইরি ঘর (যেখানে ঘরের নানা জিনিসপত্র যেমনঃ চাষের নানা যন্ত্রপাতি, উপকরণ রাখা হয়), গোয়াল ঘর, ছাগল ঘর, হাসঁ-মুরগী ঘর, দারবআ ঘর (জ্বালানি কাঠ রাখার ঘর)। তবে বর্তমানে তাদের মূল ঘর তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা আর মাচাঙ ঘর তৈরি করে না। কারণ আগের মতো পাহাড়ে আর গভীর বন নেই, সাথে নেই হিংস্র পশুপাখিও। বাঁশ এবং শনের পরিবর্তে এখন ইট, কংক্রিট, টিন, রড, সিমেন্টের ঘর তৈরি করে তাঁরা। বর্তমান বসতগুলো মজবুত এবং দীর্ঘাস্থায়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরগুলো তার ঐতিহ্য এবং নিজস্বটা হারিয়ে  ফেলেছে।

ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান

তঞ্চঙ্গ্যারা মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাদের প্রতিটি পাড়া বা গ্রামে একটি করে  বৌদ্ধ বিহার আছে। ওখানে ভিক্ষু সংঘ আছে। তাদেরকে সকলে মিলে ভরণপোষণ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। এছাড়া আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা বা ফানুস উত্তোলন পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার পর একমাস ব্যাপি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম দান শ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িতেও তাঁরা সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করে।

রাজগুরু শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাথেরো (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা), ষষ্ঠ সংগীতিকারক রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা), ত্রিপিটক বিশারদ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, আর্যানন্দ মহাস্থবির, শ্রীমৎ অজিতা মহাথেরো (ধ্যান ভান্তে), ধর্মানন্দ মহাস্থবির, সুমেধানন্দ মহাস্থবির প্রমূখ বৌদ্ধ ধর্মের সাধক পুরুষ। তাঁরা হলেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সূর্য সন্তান এবং ধর্মীয় পন্ডিত। 

সামাজিক উৎসব

বিষু (বাংলা নববর্ষ) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান এবং অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব। বিষু উৎসবকে তাঁরা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে। ফুল বিষু, মূল বিষু এবং বিষু।

ফুল বিষু মূলত চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন। মূল বিষু হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আর বিষু হলো পহেলা বৈশাখ। ফুল বিষু দিনে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় এবং নদীতে ফুল পূজা দেওয়া হয় (অনেকে ফুল ভাসানোও বলে থাকেন) এই দিনে ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

মূল বিষুতে প্রায় শতপদের সবজি দিয়ে পাইচন রান্না করা হয়। এই পাইচন বিষু’র অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ। বহুপদের সবজি দিয়ে এই পাইচন রান্না হয় বলে এর ঔষধিগুনও বেড়ে যায় বহুগুণ। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মুল বিষু’র দিনে পাইচন খেলে শরীরে যত রোগব্যাধি আছে সব চলে যায়। মূল বিষুর দিনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়োবৃদ্ধদের গোসল করানো হয়।

বিষু দিন সকলে নতুন কাপড় -চোপড় পড়ে, বুদ্ধ এবং ভিক্ষুদের জন্য আহার্য নিয়ে বিহারে যায়। প্রার্থনা করে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সমাজ, জাতি, দেশ এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল এবং সুখ-শান্তির, সমৃদ্ধির জন্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুয়ে আর্শীবাদ নেয়। বিষু দিনে সকলে সকলের বাড়িতে বেড়াতে ঘুরতে যায়। সকলে যে যার সাধ্যমতো খাবার এবং নাস্তা-পানির আয়োজন করে থাকে। সে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা- সাইন্ন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, মালি পিঠা, আলসী পিঠা, তেলের পিঠা, কলা পিঠা, কাঁকন চালের পায়েস  আয়োজন করে থাকে। সাথে মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকে। বিষু’র মূল আনুষ্ঠানিকতা তিন দিন হলেও পুরো সপ্তাহ দশদিন এর আমেজ থাকে গ্রামে এবং পাড়ায়।

এই অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ভাত খাওয়া, আর্শীবাদ অনুষ্ঠান, আহলপালানী উৎসবও হয়ে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য চর্চা

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। সাধক, ব্যাধি এবং আদি কবি শিবচরণ তাদের অনুপ্রেরণা। শিবচরণের রচিত “গোসাইন লামা” তাদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম ভিত্তি। পরবর্তীতে রাজকবি শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা যিনি তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যকে নতুন একটি মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর রচিত “ধর্ম্মধ্বজ জাতক” (১৯৩১) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গ্রন্থ। এছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার দিক থেকেও প্রথম।  ‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’ (১৯৩৩) তাঁর অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ। তিনি “চান্দোবী বারমাস, রুত্তি বারমাস,আলস্যা মেলার কবিতা এবং বিয়াল্লিশর ভাতরাদ” বারমাস রচনা করেন। তিনিই প্রথম হস্তচালিত প্রেস স্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা রাজ সভার সভাকবি বা রাজকবি ছিলেন তিনি।

লোকসাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোকসাহিত্যর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব রূপকথার গল্প আছে, আছে প্রবাদ-প্রবচন। ঘুমপাড়ানি ছড়াও আছে। সাথে আছে কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক অনেক পালাও। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, জুমকাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা ইত্যাদি।

পূজা-অর্চনা

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তাঁরা প্রকৃতিকে সেবা-যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা সরূপ নানা পূজা অর্চনা করে থাকে। তাঁরা মনে করে প্রকৃতির ভালোবাসা, আর্শীবাদ এবং আনুগত্য ছাড়া কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাস এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি করলে প্রকৃতি মাথা খুশি, সন্তুষ্ট হয় এবং আর্শীবাদ করে। এজন্য গাঙ পূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, মিত্তিনি পূজা,লক্ষ্মী পূজা, কে- পূজা এবং বুল পারা পূজাসহ বেশ কিছু পূজা-অর্চনা তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকে।

জুমচাষ, জীবন এবং জীবিকা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে জুমচাষ। জুমচাষ মূলতঃ মাল্টি এগ্রিকালচার। একই জায়গায় বহু ফসলের চাষ করা হয় এবং একটির পর একটি ফসল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই চাষের একটি বছরের সমাপ্তি হয়। জুমচাষ মূলতঃ বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত সময়। তবে এর দুই তিন মাস আগে থেকে জুম প্রস্তুতি অংশ হিসেবে জুমের জায়গা নির্বাচন, জুম কাটা, কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়া এবং পরিস্কার করতে হয়। এই জুম চাষে পুরুষ মহিলা সকলে একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।

এক সময় এই জুমচাষই তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র উপার্জন এবং জীবন- জীবিকার অবলম্বন ছিল। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের সাথে এই জুম প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা লেখাপড়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যও করছে অনেকে। আবার অনেকে ফলজ বাগান করে আয়-রোজগার করছে। আধুনিক কৃষির সাথেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া অনেকে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শুকর পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

জুমচাষ করতে হলে জুম কাটার স্থানে একটি জুমঘর তৈরি করতে হয়। জুমঘর মূলতঃ বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা আর কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে রাতে থাকা, জুমের নতুন ফসল মজুদ করণের উদ্দেশ্য এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। আর একজন জুম চাষীর তাঁর গ্রামের ঘর থেকে জুমের দুরত্ব যদি বেশি হয় সময় কমিয়ে আনা, কাজের সুবিধার্থেও এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। এই জুমঘর শুধু শস্য উঠা পর্যন্ত— মানে একবছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা জুমঘরকে ‘প্রবাস্যা ঘর’ও বলে থাকে।

বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা উচ্চ শিক্ষিত

কৃষকের পাশাপাশি, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, এমবিবিএস ডাক্তার, ডেন্টাল, হোমিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী জজ, সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন এবং নন-কমিশন অফিসার, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি সদস্য, যুগ্ম সচিব (অবঃ), ইউএনও, উপ-সচিব, দূতাবাসের ১ম কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (অবঃ), সাংবাদিকতাসহ নানা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে থেকে এযাবত মহান জাতীয় সংসদে দুজন প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমজন ছিলেন মালতি প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা (এরশাদ সময়কার), আর অন্যজন হলেন জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা ৩৪৮ আসনের সংসদ হিসেবে শপথ নেন। উভয়ের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়েরা দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে স্কলারশিপ নিয়েও বাইরে লেখাপড়া করছে। দেশের বাইরেও অনেকে চাকরি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

সম্পত্তি উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেরা পেয়ে থাকে। তবে ছেলে সন্তান না থাকলে মেয়েরা এর অধিকার পায়। স্বামী মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী যদি পূনরায় বিয়ে না করে তাহলে স্বামী সকল সম্পত্তি সে পাবে।

সামাজিক প্রথা

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধভাবে এবং গ্রামে বসবাস করে। তাদের গ্রামের প্রধান হলেন কার্বারী। তিনি গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচার এবং যেকোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তিনি মৌজা প্রধান হেডম্যান এর অধীন এবং হেডম্যান সার্কেল চীপ বা রাজার অধিনে কাজ করেন। গ্রামে বা সমাজে যেকোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা

ঘিলা খেলা, নাদেঙ খেলা, ধুধু খেলা, কুমির কুমির খেলা, গোল মরিচ খেলা, গাত্তয়া খেলা, গাইত খেলা, তেদোই বিচি খেলা, গোয়াং খেলা, পুত্তি খেলা, আংগী খেলা, তিং খেলা,লুআলুই খেলা, গুদু খেলা,বুলি খেলা,কক্কেমা বা খাবামা খেলা, শামুক খেলা এবং তুম্বুর খেলা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসকল খেলা বিশেষ করে ঘিলা এবং নাদেঙ খেলা অন্য সময় খেলা হলেও বিষু দিনে এর আকর্ষণ এবং আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন যুবক-যুবতীরা এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের এই খেলায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁরা অনেক আনন্দ মজা করে। বিবাহিত  পুরুষ এবং মহিলারাও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে।

সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, নাট্য সাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে সংগীত প্রিয়। এই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেক ঐতিহাসিক পালা পর্ব রয়েছে। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসকল পালাগুলো যারা সুর, তাল এবং সুকণ্ঠ দিয়ে পরিবেশন করতেন তারা হলেন চারণ কবি গিঙ্গিলি।

জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন গিঙ্গিলি আছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। তাঁর সময়কাল এবং আজ পর্যন্ত তাঁর সমমান কোন গিঙ্গিলি কোন আদিবাসী সমাজে বা জাতিতে জন্ম হয়নি। তিনি অন্ধ ছিলেন, এজন্য তিনি কানা গিঙ্গিলি নামেও সবার কাছে পরিচিত। তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল তিনি রাজগিঙ্গিলি ছিলেন। পরবর্তীতে ভাগ্যধন গিঙ্গিলি, দুলামন গিঙ্গিলি অনেক সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, আদি চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে নামডাক পরিচিতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা এবং আদিবাসী সমাজে। তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে দেশাত্মবোধক, রোমান্টিকসহ নানা ধাঁচের গান উপহার দিয়েছেন। তঞ্চঙ্গ্যা সংগীত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের ছোঁয়ায়।

গুনী শিল্পী হিসেবে দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনীলা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সুচন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যানি তঞ্চঙ্গ্যা, রিনি তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। পরবর্তীতে চম্পা তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যাকলিন তঞ্চঙ্গ্যা, সূর্যসেন তঞ্চঙ্গ্যা, অমিত তঞ্চঙ্গ্যা, সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রক শিল্পী হিসেবে বুলু তঞ্চঙ্গ্যা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে অনেক নৃত্য শিল্পী রয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। বাঁশি,ধুরূক, খিংকরং, শিঙা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নাট্য সাহিত্যে তঞ্চঙ্গ্যারা বহুদূর এগিয়েছে। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা নাটকের পুরোধা। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার হাত ধরে আধুনিক তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাঁর হাত ধরেই- “বর পরঙ, মন উকুলে, রত্নমালা” নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। “চানপুদি” নামে তাঁর একটি শিশু চলচ্চিত্রও ঢাকা শিশু চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করে দর্শক এবং সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বিবাহ পদ্ধতি

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিয়ে সাধারণত দুইভাবে হয়। অনুষ্ঠান করে বিয়ে এবং পলায়ন করে বিয়ে। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাকে ‘সাঙা’ বিয়ে বলে আর পালিয়ে করাকে ‘ধাবারা’ বিয়ে বলে।

সাঙা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবশীকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। আর ধাবারা বিয়েটে এসব কোন কিছুই হয় না। এই ধাবারা বিয়েটে অনেক সময় ঘরের সকল সদস্যদের (মা, বোন জানলেও) জানার সুযোগ থাকে না। তবে কনে এবং বর বিষয়টি অবগত থাকে, সাথে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।

ধাবারা বিয়ের জরিমানা হিসেবে বর পক্ষ কনে পক্ষকে শুকর বা সামান্য কিছু টাকা দিতে হয় যুব সমাজ এবং সামাজিক দাবী হিসেবে। বিয়ে নিয়ে কিছু ধরাবাঁধা এবং সামাজিক নিয়ম রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে। যেমন: নিজের আপন ভাই-বোনের মধ্যে, মাসি-পিসি, চাচা-চাচিকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অবৈধ একটি কাজ। আপন চাচাত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে অবৈধ। মামা, পিসি, মাসিত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ করা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি আছে।

এই একই সম্পর্কে বিধবা মেয়ে বা বিপত্নীকেও বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে বর কনে উভয়ে উভয়কে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী কিছু অলংকার দিতে হয়। তবে কি পরিমাণ দিতে হবে তার কোন নিয়ম নেই, দাবীও নেই। আর এর বাইরে বর কনে উভয়ে উভয় পক্ষ থেকে কোন কিছু দাবী করার পারিবারিক, সামাজিকভাবে দাবি করার কোন সুযোগ এবং নিয়ম নেই। দাবি করা ন্যায় এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিষয় যা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ এবং জাতিতে ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করে এতে জাতি, সমাজ এবং পরিবারের শৃক্সখলা নষ্ট হয়। জাতির অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়ার একটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তৈরি হয়।

অবস্থান ও বসতি

তঞ্চঙ্গ্যারা রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, জুরাছড়ি, কাউখালী উপজেলায় বসবাস করে। বান্দরবান জেলার মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, নাক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে রাঙ্গুনিয়া আর কক্সবাজার জেলার মধ্যে টেকনাফ, উকিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা, আগরতলা আর মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বসবাস রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তঞ্চঙ্গ্যারা স্থায়ী বা চাকরিসূত্রে বসবাস করছে।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি

এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র বা পদ্ধতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। বৈদ্য, কবিরাজ এবং কালেভদ্রে ভান্তেরা একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। বনজ গাছ-গাছড়া, বাকল, শেকড়, লতাপাতা, ফলমূল দিয়ে বানানো বনৌষধি নানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। বৈদ্য, কবিরাজগণ ঔষধের সমস্ত তালিক বা তালিকা নিজস্ব খাতায় বা নোটে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বৈদ্যরা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বান-টনা, আঙ ডালি, পূজা কর্ম দিয়েও নানা রকম চিকিৎসা করতো। তাছাড়া তখনকার সময়ে চিকিৎসায় একমাত্র সম্বল ছিল এই বৈদ্য এবং কবিরাজরা। বর্তমান সময়ে এসেও আদিবাসী সমাজে বৈদ্য, কবিরাজের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।

নারীর অবস্থান

আদিবাসী জনগোষ্ঠী মতো তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও অনেকটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে থাকেন।

তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে মিলেমিশে জুম, ক্ষেতে খামারে কাজ করে থাকেন। তবে গৃহস্থালি কাজগুলো মেয়েরা বেশির ভাগ সময় করে থাকে, পুরুষরাও সহযোগিতা করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমমর্যাদা ভোগ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পরেই তাদের অবস্থান।

নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর সকল প্রকার ভরণপোষণ স্বামীর নিকট থেকে সে পেয়ে থাকে। যদি স্বামী দিতে অপারগ করে বা অস্বীকৃতি জানাই তাহলে সে চাইলে গ্রাম প্রধান বা কার্বারী নিকট আইনগত আশ্রয় চাইতে পারে। স্ত্রীর অমতে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করলে প্রথম স্ত্রী সতীনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মতি জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী ভিটায় বা বাবার বাড়িতে অবস্থান কালীন সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব সে স্বামী থেকে পাবে। যদি সেও দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করে সেটি আর পাবে না।

বর্তমানে এসে সময় এবং যুগ পাল্টে গেছে অনেক। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে এবং তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তাঁরাও এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতায়। তাঁরা নিজের পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাঁরাও পরিবারকে সুন্দরভাবে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে এবং রাখছে। এটি সৃষ্টি মানবজাতির জন্য সুন্দর একটি দিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি এবং সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে তঞ্চঙ্গ্যারাও অংশগ্রহণ করে। দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাঁরা। সমতল থেকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নির্যাতনে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে আসা শত শত বাঙালি পরিবারকে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অসুস্থ রোগীকে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। নাম না জানা অনেক তঞ্চঙ্গ্যা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন সরকারি গেজেটেড এবং ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি কাপ্তাই কাপ্তাইয়ের উপজেলার ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার আগুনিয়াছড়া গ্রামে। তিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য  যুদ্ধ করেছেন।

শ্রীমতি গনমালা তঞ্চঙ্গ্যা, স্বামী- ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা, বাড়ি রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ইউনিয়নের তাইতং পাড়া যৌথ খামার গ্রামে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

স্বভাব এবং সামাজিক মূল্যবোধ

তঞ্চঙ্গ্যারা স্বভাবে শান্ত, নম্র এবং ভদ্র। তাঁরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ, পালন ও আচরণ করে। অপরের সাথে রাগ, বদমেজাজ স্বরে কথা বলে না। কথা বলার মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে চলে। স্বভাবে একঘেয়েমিতা নেই। কথায় কথায় মুখে অসুন্দর শব্দ, বাক্য প্রয়োগ করে না এবং করা থেকে বিরত থাকে। চেহেরার মধ্যেও একটা প্রকৃতিকতার আবেদন আছে।

সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে অন্যান্য চিকিৎসার মতো নবজাতক জন্মদান এখন নিরাপদ এবং সহজ হয়ে উঠেছে।

একসময় তঞ্চঙ্গ্যা তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সন্তান জন্মদান ভগবানের কৃপা এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল সকলে। তখন গ্রামে “অসা বুড়ি”(ধাত্রী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়ার সাথে থাকতেন। তখন সাবান, ব্লেড বা ছুরি কাঁচি পরিবর্তে বাঁশের ধারালো কঞ্চি দিয়ে কাটাছেঁড়া কাজটি সম্পূর্ণ করা হতো এবং ভুত্তোয়া লতা নামক একধরনের লতার কান্ড দিয়ে সাবান বা পরিস্কারের কাজটি ছাড়তে হতো। নিমপাতা সিদ্ধ করে সন্তান প্রস্রবের স্থানটি পরিস্কার করা হতো।

সন্তান জন্মদানের সাত দিনের মাথায় একটি অনুষ্ঠান করা হয়, যা ‘কসুই পানি লনা’ নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠান না হওয়া আগ পর্যন্ত নতুন মাকে ঘরের সকল কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়। মূলতঃ এসময় নতুন মা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘরের কাজ পুনরায় করার অনুমতি পান। এই সময় অসাবুড়িকে  কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ স্বরূপ কিছু নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়া হয়। তাঁকে যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। গ্রাম প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করা হয় এসময়। তাঁরাও নতুন অতিথি এবং মায়ের জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেন। পরবর্তী ঘরের সদস্য সকলে মিলে জন্মবার এবং পঞ্জিকা দেখে সন্তানের জন্য সুন্দর একটি নাম রাখেন।

ছয় মাস পর বিহারের বড় ভান্তের হাত দিয়ে এবং আর্শীবাদ নিয়ে বা ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তাঁকে মুখে প্রথম ভাত খাওয়ানো হয়।

মৃত্যু, সৎকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা

মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। দাহ করার আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো হয়। এরপর “বিয়াঘর” তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে ঐ ঘরে রাখা হয় (বিয়াঘর মূলতঃ শ্মশান যাত্রার আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে রাখার অস্থায়ী ঘর)

পরবর্তীতে বাঁশ, তার, দড়ি বা রশি এবং নানা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা মন্দির সাদৃশ্য ‘প্যারাসাইট’ নামক একটি প্যাটিকায় আবদ্ধ করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকে অশ্রুজলে বিদায় নিয়ে জগত সংসারের সকল আনুষ্ঠানিকতা মেনে এবং ছেড়ে কাঁধে বহন করে চিদাকলায় (শ্মশান) নিয়ে যাওয়া হয়।

ছেলেদের শ্মশান সাজানো হয় পাঁচ ধাপ/টাক দিয়ে আর মেয়েদের সাত ধাপ বা টাক গাছ দিয়ে। নদীর গতিপথ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির মাথা এবং পা কোন দিকে হবে সেটি নির্ণয় করা হয়। নদী বা ছড়া যদি উত্তর থেকে দ¶িণ দিকে নেমে যায় তাহলে মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে শুয়ানো হবে মাথা উত্তর দিকে করে আর পা দক্ষিণ দিক করে। দাহ করার পরদিন পরিবারের এবং আত্মীয় -স্বজন গিয়ে মৃত ব্যক্তির ধাতুগুলো(হাড়) খুঁজে নিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নদীতে বিসর্জন বা ভাসিয়ে  দেওয়া হয়। নদীতে গিয়ে ঘাটের উভয় পারের টাকা-পয়সাও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তি যেন বিনা বাঁধায় তাঁর সুপথে গমন করতে পারে।

দাহ করার সাত দিনের মধ্যে ভালো একটি দিন দেখে সাপ্তাহিক সংঘদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ শান্তি এবং সদ্গতি কামনা করে। সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানকে তঞ্চঙ্গ্যারা ‘সাতদিন্যা’ বলে। এই দিনে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য “চেরাগঘর” নামে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের পরম আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্য গৃহহীন যেন না থাকে এই উদ্দেশ্য ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাথে মৃত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার জন্য তৈরি করে দওয়া হয় “তামাঙ-ত ঘর”।

সংঘদানে ভিক্ষু সংঘকে ফাঙ বা দাওয়াত করা হয় সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া- প্রতিবেশীকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য আয়জন করা সকল খাবার রাত বারোটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয়। যদি থেকে থাকে এগুলো নদীতে পেলে দিতে হয়। কাউকে দেওয়া যায় না। ছোট বাচ্চাদের উক্ত সংঘদানে অংশগ্রহনে নিরুৎসাহিত করা হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের ছোট সদস্য ছাড়া।

সংঘদান অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তোলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক এবং বস্তুগত উপাদান দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে। এই সহযোগিতা তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সামাজিক এবং নৈতিক একটি দায়িত্ব বলে মনে করে। মৃত দুধের শিশুকে দাহ করা হয় না, তাঁকে কবর বা দাফন করা হয়। এই কবরকে ‘পআকাবা’ বলে।

উপসংহার

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নিজেদের সংস্কৃতিকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা আরো বিশ্বাস করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষায় নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

জুম, পাহাড়, ছড়া, ঝিরি -ঝর্ণার মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃপ্রেমে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির উপাদানসূহ সকলের সাথে বিনিময়ের পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিনগুলো। দেশ, জাতির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে এবং সংকট প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে চাই সকলের সাথে মিলেমিশে হাতে হাত রেখে।

লেখকঃ “পহর জাঙাল” প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা, সম্পাদক, প্রকাশক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, নাট্যকার ও ভাষা গবেষক”