তনচংগ্যাদের সামাজিক বিবাহ আইন

————– ————— ————— ——
তনচংগ্যারা বিয়ে বা বিবাহকে “সাঁ” বা “সাঙা” বলে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সচরাচর দু’রকমের বিবাহ দেখা যায়।
(ক) সামাজিক বিবাহ /নিয়মিত বিবাহ ও
(খ) পলায়ন বিবাহ/ অনিয়মিত বিবাহ।

ক. সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ:

সামাজিক বিবাহ হলো যেটা পাত্র পাত্রীর অভিভাবক বা পিতা মাতার সম্মতিতে এবং সামাজিক রীতিতে বিবাহ সম্বন্ধ ধার্য করা হয় অথবা পাত্র পাত্রী পরস্পর পছন্দের মাধ্যমে অভিভাবক সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাকেই সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ বলা হয়। সামাজিক বিবাহ আবার দুধরণের হয়।

(১) প্রথাসিদ্ধ বিবাহ:

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সামাজিক বা প্রথাসিদ্ধ বিয়ে বহুবিদ আনুষ্ঠানিকতায় আড়ম্বরভাবে হয়ে থাকে। এ বিয়ের ধারাবাহিক কার্যাবলী এরকম হয়ে থাকে। তেম্মাঙ (শলাপরামর্শ), বউ পুছা গরানা (বৌ দেখতে যাওয়া, দাভা (নূন্যতম কিছু অর্থ ধরা হয়), সাজনী বা বোয়ালী সামগ্রী (সাজার জন্য অলংকার বা পোশাকাদি), বউ হছা যানা (বৌ আনতে যাওয়া), জামাই তুলানা (জামাই বরণ), ফংগুরি দেনা (স্বামী স্ত্রী বন্ধন), সেফ ফুদা লনা (আশীর্বাদ নেওয়া), খানা সিরানা (খাবারদাবার সম্পন্ন), বউ লামাই দেনা ও বউ তুলানা (বাপের বাড়ি হতে বউকে বিদায় এবং জামাই বাড়িতে বরণ। তবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে লক্ষণীয় যে স্বামীও নিজের স্ত্রী আনতে যায়। উক্ত অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন বাধ্য কারণ এগুলি রীতিসিদ্ধ এবং তনচংগ্যা সংস্কৃতির অংশও বটে।
(২) ঘরজামাই তুলে বিয়ে:
ঘরজামাই তুলে বিবাহ এরকম এখনো তনচংগ্যা সমাজে কম চোখে পড়ে। এটাও প্রথাসিদ্ধ ও নিয়মিত বিবাহ বলে ধরা হয়। তবে এ ধরনের বিয়ে এত্ত আড়ম্বরপূর্ণ হয়না, কনের পিতা বরের কাছে কোন ধরনের দাভা ও সাজনী সামগ্রী দাবি করে না। কনের বাপের বাড়িতে পাত্রকে ঘরজামাই তোলাত পর সামাজিক নিয়মানুযায়ী সাঙা বা সাঁ করা হয়।

খ. পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ দু’রকমের হয়ে থাকে, প্রথমত হল ছিলানী বিবাহ (সাঁঙ) আর দ্বিতীয়ত হল বউ ঘরে উঠে বিবাহ।
(ক) ছিলানী বিবাহ (সাঁ বা সাঙা)- যুবক যুবতী বা প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের মনোমিলনে এবং তাদেত অভিভাবকদের অসম্মতিতে অথবা এক পক্ষের সম্মতিতে প্রথাসিদ্ধ নিয়মের বাইরে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ (ছিলানী সাঁ) বলে। সাধারণত যুকব যুবতী পালিয়ে গিয়ে দূরে কোন এক আত্মীয় বাসায় আশ্রয় নিতে হয়। এরপরে আত্মীয়ের মারফতে পিতামাতাকে খবরটা জানানো হয় যে ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছে। এতে পরে গ্রাম্য শালিস হয়, গ্রামের যুবক যুবতীদের পক্ষে যুব প্রধান বা মুরব্বিরা মানে যুবতীর সমাজ যুবক (প্রেমিক) পরিবার বা তার কাছে কিছু অর্থ দাবি করে, যেটা অনেকটা অর্থদণ্ড হিসেবেও বলা যায়। তবে অর্থদণ্ড যেটা বলা হয় বেশি মোটা অংকের হয়না অনেক সময় গ্রামের মানুষেত মনোভাব ও সামর্থ্য বিবেচনায় রাখে।
(খ) বউ ঘরে উঠে বিবাহ:
অনেক সময় পরিবারের অজান্তে মেয়ে পালিয়ে যায় স্বামীর ঘরে। তবে এখানে কিছু কারণ আছে অনেক সময় পরিবারের সামর্থ্য অভাবে নিয়মিত বিবাহ পদ্ধিতে কার্যসাধন সম্ভব নয়, তাই পালিয়ে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে ফেলা হয়। এতে অল্প ক’জন গণ্যমান্য বা মুরব্বি ডেকে আশীর্বাদসহ খাবার পরিবেশন করলেই বিয়ের কার্য সমাপ্তি হয়।
তবে হ্যাঁ, প্রত্যেক বিয়ের কার্যসম্পাদনের মধ্যে ভান্তেদের মাধ্যমে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করা হয়। এতে সাংসারিক জীবন সুন্দর ও মঙ্গলময় হয় বলে তনচংগ্যারা বিশ্বাস করে।

উপরিউক্ত আলোচিত বিবাহের বাইরে আরো বেশ কিছু প্রচলিত অপ্রচলিত বিবাহ পদ্ধতি বিবাহ চোখে পড়ে। যেমনঃ
ক) কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ, খ) মিশ্র বিবাহ গ) অসাঙ্যা / নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ, ঘ) বিধবা বিবাহ।

ক. কোর্ট ম্যারেজ মূলত:

আদালতের কোন প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক তনচংগ্যা সমাজে ইদানীং কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত অভিভাকদের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্চুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে মিলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক -এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রাচীনকালের মনোমিলনের পলায়নের আধুনিক সংস্করণ “কোর্ট ম্যারেজ”। যদিও এটি মাত্র শপথনামা, কিন্তু আইনত এ বিবাহ অনলঙ্ঘনীয়ও নয়।

খ. মিশ্র বিবাহ:

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অন্যান্য জনগোষ্ঠী সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে মিশ্র বিবাহ বলে। মিশ্র বিবাহ বন্ধন সচরাচর তনচংগ্যা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে দৃশ্যমান। এই বিবাহের নেতিবাচক ইতিবাচক দুটো দিক আছে। বিশেষকরে পরবর্তী প্রজন্মে তার বেশ প্রভাব পড়ে এবং তুলনামূলক ভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকীস্বরূপ।

গ. অসাঙ্যা/নিষিদ্ধ বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজের প্রথা অনুসারে নিষিদ্ধসম্পর্কিত আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং তার শাস্তিস্বরূপ শুকর জরিমানা দিতে হয়। গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধে শাস্তি হচ্ছে অর্থদণ্ড। কাকে বিয়ে করা যাবে কাকে বিয়ে করা যাবেনা তার বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো।

ঘ. বিধবাবিবাহ:

তনচংগ্যা সামাজিক প্রথামতে বিধবাবিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা নারীও আবার বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারের বা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একত্রে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরণপোষণ পাবার অধিকার রাখে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামী ও শ্বশুর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে পূর্বস্বামীর সম্পত্তি পাবার অধিকার হারায়। তনচংগ্যা সমাজে একজন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ সামাজীকভাবে রীতিসিদ্ধ। তবে পূর্বেকার মতো দ্বিতীয় বিয়েটাও পিতা বা ভাইয়ের বাড়ি থেকে সম্পন্ন করতে হয়।

এবার আলোচনা করা যাক তনচংগ্যা সমাজে বৈধ অবৈধ বিবাহ কোনগুলিঃ
১. বৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
বিবাহের বেলায় ঘনিষ্ঠ কিংবা দূর সম্পর্কের কোন মামাতো, পিসতুতো, মেসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ হতে পারে। বড় ভাইয়ের শ্যালিকা, বড়বোনের ননদ কিংবা বড়ভাই মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে। শ্যালিকা বা সম্বন্ধীয় বিধবা বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে এবং একই পরিবারভুক্ত না হলে পিতামহ বা মাতামহ সম্পর্কিত নাতি নাতনি মধ্যে বিবাহ হতে পারে।

২. অবৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
সহোদরা ভাগ্নি, বিমাতা, ভাগ্নি, ভাইঝি, মাসি, মামী, পিসী, চাচী, জেঠি ইত্যাদি সম্পর্কীয় হলে বিবাহ করা চলেনা। সহোদর ভ্রাতাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে, একই পিতা মাতার ঔরসজাত ছেলেমেয়ের মধ্যে, স্ত্রী বড়বোন অথবা স্ত্রী বিমাতা, স্ত্রী ভাইঝি ইত্যাদি বিবাহ চলেনা এবং সামাজিকভাবে তা নিষিদ্ধ।

[তথ্য সহযোগিতায় এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা; সভাপতি, সদ্য নির্বাচিত জেলা আইনজীবী সমিতি রাঙামাটি]

The first Tanchangya artist Mr. Ratikata Tanchangya

Roti kanta

The most popular artist in Chittagong Hill Tracts is Mr. Rati Kanta Tanchangya. He is the son of Shikol Chand Tanchangya and a grandson of the richest man named Mr. Nikunja in Tanchangya community, born on 23rd of month Jesta in 1347 Bengali Year (June 6,1941) at the bank of Rainkyong,  Boradam village under the sub-district of Bilaichhury, Rangamati, Bangladesh. He is father of three sons namely, Dibyendo Tanchangya, Anupom Tanchangya, and Dipankar Tanchangya. During his service he worked in the department of agricultural expansion. 

Recognition 

Due to his dedicated service at Fine Art, he was awarded as Great Artist from the President of Bangladesh Ziaur Rahman on 1st January, 1981. Moreover, according to the examination of Bangladesh board, he has passed the examinations Sutta, Vinaya, and Abhidhamma. In 1978 he received the title of Visvakarma  from Venerable Sadhanananda (Vana Bhante). He is also recognized as a song composer of Bangladesh Radio Station in Rangamati  in Tanchangya, Chakma and Bengali.  In 1990 through Raja Devashis Rai, he was awarded as Artist and Writer in Gauhati, India. 

Contribution and Responsibilities 

Ratikanta Tanchangya introduces himself not as an artist rather as an art admirer. In 1979, he solely established the Charukola Akaedmy (Fine Art Academy), first academy in Chittagong Hill Tracts. This is the first Fine Art Academy in three Hill Districts that has established without any support  from government.  He has been supervising Rangamati Charukala Academy (Academy of Fine Arts) since 1979. Although in Chittagong Hill Tracts there were Jumma artists, practiced art before him but he was the first  person who took an initiative of teaching art to Jumma children. He not only practiced art but also had a vision of making like minded people in Jumma community. His success was indicated by many national and international prizes won by his students, while they were learning and practising art at his institute. His institution is not only changing and forwarding Jumma society, introducing art to Jumma culture but also bringing international fame for the country.  Besides his artist passion, he is also a prolific writer  and a regular columnist on Tanchangya history and culture in Bengali newspaper. 

On the one hand Mr. Ratikanta is an artist, on the other he is a song writer and poet. In 2007 during the caretaker government of Fakhruddin Ahmed, he chaired  a neutral person, member of Rangamati District Council. He is currently acting as the Chief and Principal of the Fine Arts Academy (Charu Kola Akademy) in Rangamati.

A writer being Artist

While painting arts, he also writes books. Every one of his books is well-acclaimed  and informative. His published books in Bengali are:

  1. Painting (চিত্রা) ( a book on fine art)- 1986.
  2. An Introduction to Tanchangya (original manuscript)- 1995.
  3. Tanchangya Tribe-2000
  4. Song Book (গীত পোই) in Tanchangya, Chakma and Bengali- 2008.
  5. Fine Art Practice- 2011
  6. Autobiography- 2012
  7. An Illuminated Tanchangya Buddhist Monk-2018.

He keeps writing time to time until now. He is not only a great person to Tanchangya tribe, but for the whole Chittagong Hill Tracts. His contributions towards Tanchangya tribe and the whole indigenous communities worth to be acknowledge.

তঞ্চঙ্গ্যা রমনীদের পাঁচ পোষাকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তার নৃতাত্ত্বিক দি

 


—-অজিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা
————————————————————————————————————————————–
ইতিপূর্বে পাক-ভারত উপমহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে যত মঙ্গোলিয় জনগোষ্ঠী লোক ছিল এবং বর্তমানে আছে তাদের মধ্যে চেহারাগত বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য খোঁজা খুব দুরুহ কাজ। সকলে কম বেশি মনে হয় এক ও অভিন্ন। ভুটানি, নেপালী, থাইল্যান্ডী, বার্মিজ, কম্বোডিয়ান, ভিয়েটনামী এবং অপেক্ষাকৃত কম জনগোষ্ঠীর লোক যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর লোকদের চেহারাগত তফাৎ খোঁজা খুবই কঠিন কাজ। এতো গেল এ অঞ্চলে বসবাসরত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর চেহারাগত মিল-অমিলের দিক।
বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার কিয়দাংশে বসবাসরত এগারটি বড় কিংবা ছোট দলভুক্ত পাহাড়িদের মধ্যে কমবেশী প্রত্যেকটি জাতিসত্ত্বার নিজস্ব ভাষা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, ধরণ-ধারণ তথা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারা স্ব-স্ব রীতিতে বহমান। তন্মমধ্যে কিছু সংখ্যক জাতিদের বাংলা ভাষা ও নিজ নিজ মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্ষার রীতি প্রাচীন ও অপেক্ষাকৃত উন্নত। কিছু কিছু জাতির জীবনাচার ঘোরাচ্ছন্ন ও অজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল বিধায় হয়তো পুরানো রীতি নীতি থাকলেও তা তারা ধরে রাখতে পারেনি। প্রত্যেকে কিছু না কিছু নিজেদের জাতিসত্ত্বার ইতিহাস ও ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি মৌখিক কিংবা লিখিত দলিলের মাধ্যেমে বংশ পরম্পরায় জিইয়ে রেখে চলেছে, কেহ হারিয়েও ফেলেছে। এ অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়িদের নিয়ে সেই পর্তুগীজ, বৃটিশ এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে গুটি কয়েক লেখক যেমন- জন হেমিল্টন বুকানন, ড. ফ্রান্সিস, ফেরী, হ্যার্সিসন, ওয়াজিবুল আজিজ, ডে-বোরোস, সতীশ ঘোষ, টি. এইচ. লুইন, আবদুল হক প্রমুখ লিখে গেছেন। কেহ শখের বশবর্তী হয়ে, কেহ রাজনৈতিক কারনে নিজ নিজ ইতিহাসের ধারাকে শ্রোতধার রূপে বজায় রেখে মূল বাস্তবতাকে এড়িয়ে ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাস্তবতা ধামাচাপা থেকেই গেছে বৈকি।
বেশি দিনের কথা নয়- বিগত ৬০ থেকে ৭০ বৎসরেরও আগে এখানকার মানুষের জীবনধারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণ বর্তমানের চেয়ে বহুলাংশে অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিল। অশিক্ষা-কুশিক্ষায় সমাজ জীবন ছিল ঘোরাচ্ছন্ন যুগের মতই। তদ্রুপ ১০০ থেকে ১৫০ বছর আগের অবস্থা হয়তো আরো অনেক অজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ও অঘোর ঘোরাচ্ছন্নে ছিল। এই অঞ্চলে বিভিন্ন লেখকের লিখনিতে ও প্রবীন ব্যক্তিবর্গের ভাষ্যমতে জানা যায় যে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীরাই মূল চাকমা জাতি ছিল- এ কথা প্রবীণ চাকমা সমাজে বহুল প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল এবং বর্তমানে ও চাকমাদের কাছে এ বদ্ধমূল ধারনাটি আছে। চাকমা জাতি সম্পর্কে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস রচনা করেছেন। বর্তমানে চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা একই জাতিসত্ত্বার উত্তরসূচী বলা হলেও আদৌ সত্য কিনা তার প্রকৃত তথ্য ও সাক্ষ্য প্রমাণ সঠিকভাবে কোথাও পায়নি। পর্তুগীজ, মোগল ও ইংরেজ আমলের বিভিন্ন অফিস আদালতের তথ্যাদি ও সমসাময়িক ইতিহাসবিদগণের বর্ণনায় বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এতে কেহ তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা জাতির ভিন্নতার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেহ কেহ এক ও অভিন্ন বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে ভাষা, ধর্ম, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অধিকাংশই মিল আছে বলেই অনুমান ভিত্তিতে বলা হয়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা একই জাতিভূক্ত।
বাবু বিরাজ মোহন দেওয়ান কতৃক রচিত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” বইটিতে বলা হয়েছে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেবল কালের গর্ভে ও কালক্রমে পৃথক অবস্থানের ফলে ভাষা, আচারণ, কথন ভঙ্গিতে পরিবর্তন হয়েছে। যেহেতু লোকসাহিত্যে বা লোকগীতি “গীংগুলি” গীতের সুর, ব্যক্তি, উপাত্ত-উপখ্যান, উপকরণাদি (যেমনঃ- চান্দবী বার মাস, চাদিগাং ছাড়া পালা, রাধামন পালা, গীলা পাড়া পালা, মিঙাবি বারমাস ইত্যাদি), উবাগীত প্রভৃতি উভয় সংস্কৃতিতে প্রবাহমান হয়ে এসেছে।
অপরদিকে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি পরিচিততে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রখ্যাত লেখক বাবু বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি আলাদা জাতি হিসেবে বিভিন্ন প্রমাণাদি প্রদর্শন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতেএ যেহেতু চাকমাদের ৪৬ট গোজা-গোষ্ঠির মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ১২টি গোজার একটিরও অন্তর্ভূক্তি নেই। সেই দৃষ্টিতে তাঁর যুক্তি অকাট্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে অনেক বাংলা শব্দ প্রয়োগ আছে বলে বিভিন্ন লেখক বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে জেনেছেন। বাংলা ভাষার শব্দ তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রচলিত হওয়ার কারণে যুক্তি এই পতুর্গীজ আমল, মোগল আমলও বৃটিশ আমল পর্যন্ত ভারতবর্ষের অমঙ্গোলিয়া সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে (বর্তমান চট্টগ্র্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে) দীর্ঘ প্রায় ৫শ থেকে পৌনে সাত’শ বছর ধরে তৎকালীন ভারতবর্ষীয় হিন্দু ও পরবর্তীতে মোগলীয় উত্তরসূরীর সংস্রবে (খাঁ বংশীয়)আসায় তাদের সংস্কৃতি কিছু কিছু ঢুকে পড়াটা বিচিত্র কিছু নয়। যেমন- ছোট বেলায় দেখেছি “ছিন্নী” করতে, বড়দের ভারত রামায়ন পড়তে, কারোর রোগমুক্তির জন্য কালী বাড়িতে মানত করতে বা “মা লক্ষীকে” পূজা দিতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যুগের পরির্বতনের ফলে সে সকল প্রথা আর নেই। বর্তমানে নিজেদের শাক্যবংশের অনুসারী রূপে তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বিশদভাবে বলতে গেলে বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলার মানচিত্রের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে তা পরিষ্কার বুঝা যাবে। দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার জেলা সদর, টেকনাফ উখিয়া ও বান্দরবান জেলা সদর, রুমা লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, আলীকদম, রোয়াংছড়ি উপজেলা সমূহের বিভিন্ন মৌজাগুলোতে এবং তদসংলগ্ন চট্টগ্রাম জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস।
পক্ষান্তরে অপেক্ষাকৃত উত্তর খাগড়াছড়ি জেলায় কোন তঞ্চঙ্গ্যা বসতি নেই। উত্তর-পূর্বে যেমনঃ- রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও নানিয়াচর্ উপজেলা গুলোতে তঞ্চঙ্গ্যা জনবসতি খুবই কম। থাকলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালীদের (হিন্দু ও মুসলিম) সংস্রবে থেকে থেকেই কিছু কিছু বাংলা শব্দ তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় ঢুকে পড়েছে।
প্রত্যেক জাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিজ নিজ রমনীদের স্বকীয় পোশাক পড়লে ঐ জাতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। যেমনঃ- শাড়ি পরা রমণী দেখলে বোঝা যায় বাঙ্গালী রমণী, স্কাট পরা রমণী কোন পশ্চিমা, থামি পরা কোন রমণী বার্মিজ বা থাইল্যান্ডিয় ইত্যাদি বোঝায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের এগারোটি আদিবাসী মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারা খাগড়াছড়ি জেলা ব্যাতিত উল্লেখিত চার জেলায় আনুমানিক ৭০ কি ৮০ হাজারের কম নয়। অবশ্য সরকারি তথ্য মতে তত নয়। তার প্রধান কারণ চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার সদর, উখিয়া উপজেলা ও টেকনাফ উপজেলা এবং পার্বত্য বান্দরবান জেলার রুমা, লামা নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম উপজেলার অধিকাংশ তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের জমি জমার দলিল পত্রের চাকমা বলে পরিচয় দেয় মূলত তারা “মো-গছা” ও “ধন্যা-গছাভূক্ত” তঞ্চঙ্গ্যা। শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসরতা ও উত্তরাঞ্চলের বর্তমান শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাথে বিচ্ছিন্নতার কারণেই নিজেরা এখনো চাকমা বলে পরিচয় দেয়। হয়তো বা চিরাচরিত জনশ্রুতি বজায় রেখে চাকমা বলে পরিচয় দেয়।
এ বিষয়ে বিশদভাবে বর্ণনা দিতে সুদূর অতীতের দিকে এগোতে হয়ঃ চাকমা জাতির ইতিহাস লেখকগণের মতে জানা যায়- কালা বাঘার রাজার দুই রাজপুত্র- বিজয়গীরি ও উদয়গীরি দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে উত্তর থেকে যখন দক্ষিণ দিকে দুই সেনাপতি রাধামন ও কুঞ্জধনকে নিয়ে অভিযানে বাহির হন তখন চাদিগাং (বর্তমান চট্টগ্রাম বিভাগের দক্ষিণাংশে) জয়ের পর রোয়াং (বর্তমান লোহাগড়া, উখিয়া ও কক্সবাজার অঞ্চল) বিজয় করে পরবর্তীতে আরাকান দখন করেন। তথায় মগদের পরাজয় করে বংশানুক্রমে রাজত্ব করতে থাকে চাকমা রাজবংশরা। ১৩৩৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা অরুন যুগের রাজত্বকালে পর্তুগীজ সহায়তায় মগ রাজা মিনধি বিদ্রোহ ঘোষণা করে চাকমা রাজা অরুণ যুগকে পরাজিত করে তিন রাজপুত্র ও দুই রাজ কণ্যাকে বন্দী করে। এই যুদ্ধো ১০,০০০ যোদ্ধা বন্দী হয় বলে কথিত আছে। যুদ্ধের পরাজিত যোদ্ধা বা সৈনিকরা (তথা চাকমা সমাজে সকল শক্ত- সামর্থ্য সকল পুরুষগণ) পলায়ন করে গভীর অরণ্যে অবস্থান নিতে হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা উত্তর দিকে সরে আসতে থাকে। যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষ হওয়ার পর পরবর্তীতে আরাকান রাজা চাকমা রাজার জ্যৈষ্ঠ রাজপুত্র সূর্যজিতকে (আরাকানি নাম “সাজুই”) নিজের অধীনে ক্যকডোজা প্রদেশের শাসক, দ্বিতীয় রাজপুত্র চন্দ্রজিতকে (আরাকানি নাম “চৌতা”) কংজা নামক স্থানে রেভিনিউ কালেক্টর হিসেবে নিয়োজিত করেন।
যুদ্ধ বিগ্রহের পর সকল নিরীহ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নারী শিশুদেরকে আরাকানের উত্তর অংশের পাহাড়িয়া এলাকায় বসবাসের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। মগেরা পাহাড়কে টং বলে।পাহাড়ে বসবাসের অনুমতি প্রাপ্ত চাকমা জাতির ঐ অংশকে তঞ্চঙ্গ্যা বা দৈনাক বলে। অনেকের ভাষ্যমতে তৈন গাং নামক স্থানে বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীকে তৈন গাঙিয়া নামকরণ হয়ে আসছে। যা পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যা উচ্চারিত হয়ে আসছে। এখনো চাকমা সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে তঞ্চঙ্গ্যারাই মূল বা আসল চাকমা এবং বর্তামানে শিক্ষিত চাকমাদের ইতিপূর্বে বলা হতো “আনক্যা চাকমা”।এর প্রধান কারণ হচ্ছে মূল চাকমা রমণীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রমণীর পাণি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফলে তাদের মধ্যে কিছু স্বকীয়তা হারিয়ে গিয়ে কেহ কেহ খাস মঙ্গোলীয় চেহারা বিবর্তন এসে অপেক্ষাকৃত সুঠামদেহী ও সুন্দর চেহারাধারী হয়না। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে- প্রকৃত মঙ্গোলীয়রা তত সুন্দর চেহারাধারী হয়না। যেমন -চীনা, থাইল্যান্ডি, ভিয়েৎনামী, কম্বোডিয়ান ইত্যাদি দেশের লোকেরা তত সুন্দর না। কি নারি কি পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই এমন লক্ষ্য করা যায়।মঙ্গোলীয়দের মুখাবয়ব বিশেষতঃ মুখের চোয়াল বেটে, নাক সুউচ্চ নয়, অপেক্ষাকৃত চেপ্টা, গাল ফোলা, বেটে ও প্রশন্ত হয়ে থাকে।তদ্রুপ গড় হিসাবে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চেহারাগত পার্থক্য সুস্পষ্ট বোঝা যাবে। তঞ্চঙ্গ্যা রমনীরা শারীরিক ভাবে স্থুল দেহী হয়, ব্যতিক্রমে শীর্ণ দেহী হয়। পক্ষান্তরে চাকমা রমনীরা বেশির ভাগ মাঝারী দেহী হয়, স্থুল দেহী অপেক্ষাকৃত কম হয়। অপরদিকে মূল চাকমা রমণীরা (দৈনাক রমণীরা) তাদের স্বভাব জাত আচরণ ও হাতে বোনা কাপড় পড়নের অভ্যস্থ বিধায় পোশাকের কোন পরিবর্তন না করে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে যুগের পর যুগ ব্যবহার করে এসেছে এবং আজও ঐ ঐতিহ্য বজায় রেখেছে বলেই গর্ব করে কথা প্রসংগে বলে থাকে “পাঁচ পোশাকধারী তঞ্চঙ্গ্যা” বা মূল চাকমা। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা ও চাকমাদের বর্ণমালার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কেবলমাত্র কয়েকটা বর্ণমালার তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। তাও অতি সম্প্রতি গবেষণায় জানা গেছে অধিকাংশ বর্ণমালার কেবল উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে।
১৩৩৩ খ্রীষ্টাব্দে যুদ্ধের পর আরাকানে পাহাড়িয়া অঞ্চলে বসবাস করতে দেয়া দৈনাকগণ বহু বৎসর ধরে সেখানে বসবাস করে। পরবর্তীত মগদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিতারিত চাকমাদের সাথে পুনঃ যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে কিছু সংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা আরাকান ত্যাগ করে উত্তর দিকে নিজেদের দলভূক্ত চাকমাদের সাহচর্য্যের আশায় টেকনাফ, উকিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিকদম, রুমা, লামা, বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। যুগের বিবর্তনে কিছু কিছু দৈনাক মগদের জনগোষ্ঠির মধ্যে মিশে যাওয়াটা অবাস্তব কিছু নয়। কারণ বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফে বসবাসরত চাকমাদের সাথে (মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যা) বর্তমান শিক্ষিত চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে আলাপ কালে দেখা যায় তারা এমন বিদঘুটে শব্দ ব্যবহার করে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হয়না।অধিকাংশ শব্দগুলো বর্মী টিউনে উচ্চারণ করে ও কথা বলে।
১৯৬০ সনের আগ পর্যন্ত সর্বশেষ উত্তরের মৌজা মানিকছড়ি ঝগড়াবিল, বড়াদম, ওয়াগ্গা ও ঘাগড়া মৌজার সীমা পর্যন্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতি ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশ্য কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে বহু তঞ্চঙ্গ্যার পরিবার ও পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যভাগে যথাক্রেমে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত উপজেলা সমূহে উদ্বাস্তু হয়েছিল।পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে- তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় কোন তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস নেই। কেবল ব্যবসা বাণিজ্যে বা চাকরির কারনে গুটি কয়েক পরিবার হয়তো বসবাস করে থাকতে পারে। এখনও জনশ্রুতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরাই চাকমা চাকমা জাতির রাজ পরিবারের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ পোশাক যথাক্রমেঃ- (১)সালুম (চাকমা-সিলুম, বাংলা-জামা), (২) খাদি(চাকমা-খাদী, বাংলা- বক্ষবন্ধনী), (৩)পিনৈন (চাকমা-পীনোন, বাংলা- পরনের কাপড়), (৪) ফাউদুরী (চাকমা- ফারদুরী, বাংলা- কোমর বন্ধনী), (৫) মাধাকবং (চাকমা-খবং, বাংলা-পাগড়ী)।
পার্বত্য অঞ্চলে জনগোষ্ঠি আছে ৫০/৬০ দশকের পূর্বে (বর্তমান পার্বত্য সভ্যতার পূর্বে) কোন জনগোষ্ঠির পোশাক-আশাকে এত দৃষ্টিনন্দন ও অপূর্ব কারু কার্য খচিত বাহারী পোশাক বুনন- শৈলীর রেওয়াজ দেখা যেতনা। তৎকালীন সময়ে অপরাপর জনগোষ্ঠির পোশাকের সাথে তুলনা করলে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত সম্ভ্রমশীল পোশাক দ্বিতীয় ছিলনা। প্রত্যেকটি পোশাক বিচর বিশ্লেষণ করলে তবেই বুঝা যাবে এর অতুলনীয় শৈল্পিক কাজ। অবশ্য বর্তমানে পাহাড়িদের মধ্যে সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আধুনিকতার চিন্তা-চেতনায় সুন্দর সুন্দর পোশাক বুননে কমবেশী সকলেই সচেষ্ট। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের গুণগত মান ও ঐতিহ্যের বিচারের কথা বলা হচ্ছে আজ থেকে ১০০ থেকে ১৫০ বছরের সময় কালের পোশাকের। অথচ সেই সময় থেকে পোশাকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ জনগোষ্ঠির নারীরা বুননে অনুন্নত ছিল। এ পাঁচ পোশাক বিচর বিশ্লেষণ করলে সুস্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে- এই পোশাগুলোই চাকমা রাজ পরিবারের হৃত গৌরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক যা অতীতে কোন কোন যাত্রা থিয়েটারে রাজা-বাদশার মাথায় পাগড়ি পরিধানের রেওয়াজ লক্ষ্যে করা যায়। এই পাগড়ি সম্মানের ও অভিজাত্যের প্রতীক। হয়তো কেহ কেহ বলবেন- কোন কোন আদিবাসী পুরুষ বা মহিলারা ও তো পাগড়ি ব্যবহার করে থাকেন। এ কথাটা শতঃসিদ্ধভাবে বলা যায় যে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের উল্লেখিত পাঁচ পোশাকের মত অন্যান্য কোন জনগোষ্ঠির রমণীদের মধ্যে এত সুচারু, সুনিপুন ও সমান মাপের এবং সুনির্দিষ্ট ডিজাইনের ছিল না।
নৃতাত্বিক, সাংস্কৃতিক, কৃষ্টি, ভাষা ও বর্ণমালা তথা সামগ্রিক বিচারে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা বলতে আদৌ কোন দ্বি-জাতি ছিলনা। একই জাতির হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও নির্মম পরিণতিতে সুদীর্ঘ সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় ও অন্য জাতির সংস্কৃতির ছোঁয়ায় কথায়, আচার- আচরণে যৎকিঞ্চিৎ বিবর্তনের ফলেই আজ তঞ্চঙ্গ্যা জাতির উদ্ভব।

কবি ও সাহিত্যিক বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

Tanchangya porichiti.jpg

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যে যেসকল মানুষের বিচরণ ছিল বা আছে তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা একজন অন্যতম। তাঁর পরিচয় ঘটে বিশেষত তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথার লেখনীতে। তিনি গ্রন্থ ছাড়াও আমৃত্যু লিখে গেছেন বিভিন্ন সাময়িকীর প্রকাশনায়। তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লেখকের পরিচয় জানা যাক-

লেখকে জন্মকথাঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৩৭ সালে ১৩ এপ্রিল তৎকালীন রাঙামাটি থানায় অন্তর্গত ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজ্যমণি তঞ্চঙ্গ্যা মাতার নাম রতিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা। পিতামাতার দুইপুত্র, এক কন্যার মধ্যে বীরকুমার সর্বকনিষ্ঠ। শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ ১৯৫৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ওই বছর কানুনগো পাড়া আশুতোষ কলেজেপড়ার সুযোগ পান। সেই কলেজ থেকেই তিনি আই.এ পাস করেন। এরপরে আর আর্থিক অভাবে পড়ার সম্ভব হয়ে উঠেনি তবে পরবর্তী তে ত্রিপিটকের “সুত্ত ও বিনয়” উপাধি পালি ও সংস্কৃত বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথমে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে চাকরি করেন, পরে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা প্রশাসনে অফিস সুপার পদে থেকে চাকরি অবসর নেন।

লেখকের সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী ছিলেন। আর পরবর্তীতে তার চাকরি কর্মস্থল রাঙামাটি হওয়ায় সাহিত্যচর্চাটা বেশ ভালো ভাবে কাজে লাগান। ১৯৮৬ সালের দিকে শ্রী মদন মোহন দেওয়ান কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক “পার্বত্য বাণী” তে প্রথম সংখ্যায় “কালিন্দী” নামক ইতিবৃত্তমূলক একটা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশ পায়। এটায় শ্রী বীরকুমারের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ বলা যায়। এভাবে পরে রাঙামাটি পাবলিক লাইব্রেরি হতে তৎকালীন প্রকাশিত “অঙ্কুর” রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বনভূমি” খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত “পার্বতী”তে তাঁর বহু গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত নাটক “রুনুখাঁর উপাখ্যান” মঞ্চস্থ নাটক “অমিতাভ” যেটা গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্বলিত এবং ১৯৬৭ সালে রাঙামাটি মৈত্রী বিহারের মাঠ প্রাঙ্গণে সাফল্যের সাথে মঞ্চায়ন হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর রচিত চাকমা নাটক “মুড়া যেক্কেনে কানে” নামক নাটকটি নানিয়ারচর উপজেলায় কৃষ্ণমাছড়া গ্রামে মঞ্চস্থ হয়। “রক্ত তিলক” (জুমল্যান্ডের রাজকন্যা) নামক একটা নাটক রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট (তখন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট) গিরিনির্ঝর-এ প্রকাশিত হয়েছে। স্বদেশ ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বোধিভারতী” সাময়িকীতে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা বেতার কেন্দ্রের রাঙামাটি আঞ্চলিক শাখার গানের লেখক ও কথিকা ছিলেন। “ঢোলক/একতারা” শীর্ষক স্থানীয় আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বেতারে প্রতি মাসে প্রথম ও চতুর্থ সপ্তাহে প্রচারিত হতো। এখন আর প্রচারিত হয়না।

অবদান স্বীকৃতিঃ

সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য রাঙামাটি জেলাপরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য অঞ্চল ২০০১ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২৭ চৈত্র ১৪১৩ সালে “উপজাতীয় সামাজিক ফোরাম” শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠন “অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” সাহিত্য অবদানের জন্য এ গুণী লেখককে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।

সাহিত্যিকের লেখা বই ও নাটকঃ

১. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (গ্রন্থনা)

২. তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা।

৩. রক্ততিলক (নাটক)

৪. ভাগ্যরত্ন।

পরলোকগমনঃ

তঞ্চঙ্গ্যা ও আদিবাসী সমাজে সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণকারী ১২ নভেম্বর ২০১৪ সালে নিজ বাসায় রাঙামাটি দক্ষিণ কালিন্দীপুরে এ গুণী লেখক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর এ মৃত্যুতে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী তথা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ একজন গুণী ও প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিককে হারায়। যা খুব কম সময়ে তাঁর শূণ্যস্থান পূরণ হবার নয়। গোটা পার্বত্য অঞ্চলে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা ও লেখনীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

চিত্রশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার সংক্ষিপ্ত জীবনী”

Roti kanta

জন্মকথাঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্রশিল্প জগতে এক অতি পরিচিত নাম শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। তাঁর পিতার নাম – শিকল চান তঞ্চঙ্গ্যা। তঞ্চঙ্গ্যা জাতির শ্রেষ্ঠ বিত্তশালী নিকুঞ্জ মহাজনের নাতী। জন্ম শুক্রবার ২৩ শে জৈষ্ঠ্যমাস ১৩৪৭ বাংলা, ১৯৪১ ইংরেজী। বর্তমান রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানাধীন ১২২ নং কুদুবদিয়া মৌজার রাইংখ্যং নদীর তীরে বড়াদম নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের দিকে চাকুরী জীবনে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর রাঙ্গামাটির অধিনে আমিন। তিনি তিন পুত্রের জনক, তাঁর পুত্রত্রয়- দিব্যেন্দো তঞ্চঙ্গ্যা, অনুপম তঞ্চঙ্গ্যা, দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা।

স্বীকৃতিঃ

চিত্রশিল্পে কৃতিত্বের জন্য ১৯৮১ ইং সনের ০১ জানুয়ারী তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গুণী শিল্পী হিসেবে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন। তাছাড়া তিনি ত্রিপিটকের সূত্র বিনয় ও অভিধর্ম উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাকে “বিশ্বকর্মা” হিসেবে উপাধি দেন। বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কর্তৃক তিনি তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গানের গীতিকার হিসেবেও স্বীকৃত। লেখক ও চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁকে ১৯৯০ সালে চাকমা রাজ দেবাশীষ রায় কর্তৃক ২০১৪ সালে ভারতের আসামে গৌহাটি শহরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

অবদান ও দায়িত্বঃ

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটি ‘চারুকলা একাডেমি’ একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী আর্থিক সহযোগীতা ব্যতিরেকে তিন পার্বত্য জেলায় এটি সর্বপ্রথম ও একমাত্র চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র-ছাত্রী জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং জাতিসংঘ পুরস্কার লাভ করতে সমর্থ হয়। শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা একাধারে যেমন চিত্রশিল্পী আবার অপরদিকে গীতিকার ও কবিও। তিনি ২০০৭ সালের এক এগারোর সময়ে ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে রাঙামাটি জেলা পরিষদের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে তাঁর হাতে গড়া চারুকলা একাডেমির নির্বাহী প্রধান ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চিত্রশিল্পী যখন লেখকঃ

এ চিত্রশিল্পী যেমন আঁকিয়েছেন তেমনি লিখেছেন। তার প্রত্যেকটা গ্রন্থ আলোচনার দাবিদার এবং তথ্যমূলক। তার প্রকাশিত গ্রন্থ গুলো হলো-

১. চিত্রা (চারুকলা বিষয়ক পুস্তক)- ১৯৮৬।

২. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (মূল পান্ডুলিপি) ১৯৯৫।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- ২০০০ সালা।

৪. গীত পোই (তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গানের বই)- ২০০৪ সাল।

৫. চারুকলা অনুশীলন- ২০১১।

৬. আত্ম চরিতাবলী (জীবনী)- ২০১২।

৭. আলোকিত তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু (২০১৮)।

এ গুণী ব্যক্তি বিভিন্ন সাময়িকীতে নিয়মিত লিখছেন এখনো। তিনি শুধু তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নয়, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা দেশের গুণীব্যক্তি। স্বজাতি ও আদিবাসী সমাজে তাঁর অবদান অবশ্য স্বীকার্য।

———– ————- ————–

তথ্য সংগ্রহকারী এবং লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক “চালৈন প্রকাশনা পর্ষদ, রাঙামাটি” -সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।

সাপ্রে বা দৈনাক টং-চং-য়্যা বিবরণ

Tongলেখকঃ- শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, প্রতিষ্ঠাতা- রাঙ্গামাটি চারুকলা একাডেমি।
লেখা- ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ বই হতে নেয়া।
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে উত্তর দক্ষিণে প্রলম্বিত ৫০৯৩ বর্গ মাইল আয়তন বিশিষ্ট এক বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বলা হয়। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল গভীর অরণ্য, হিংস্র প্রাণীকুল এবং দুর্গম পাহাড়ঞ্চল। এখানে পাহাড়িদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের আগমন, নির্গমন এবং অবস্থান অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত।এ সর্ম্পকে ইংরেজরা কেন, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি বাঙালীরাও কিছুই জানতো না। এমনকি বর্তমানে ও এ অঞ্চলের ইতিহাস সবার কাছে অনুঘটিত রয়ে গেছে। অতীতে উত্তর-পূর্ব ভারতের সমগ্র অঞ্চলটি কিরাট ভূমি নামে পরিচিত। পরবর্তী কালে আরাকান সীমানা পর্যন্ত কুকিল্যান্ড হিসেবে পরিচিতি ছিলো। এর পর ইংরেজ শাসনামলে চট্টগ্রামের এই পার্বত্য জেলাকে কার্পাস হল বলা হতো।
ভারতের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু রাজ্য ছিলো।এসব রাজ্যে পশ্চিমাঞ্চলের বিদেশীদের আগমন শুরু হয় ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজগণের রাজ্যে সমুহের কোন সার্বভৌম শাসন ক্ষমতার অস্তিত্ব না থাকায় তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা ও শত্রুতা বিরাজমান ছিল। এই অনৈক্য আত্মকলহ এবং তাদের মধ্যে বংশ, গোত্র, উঁচু নিচু বর্ণের ভেদাভেদ থাকার কারণে ভারতের উপর বিদেশীর বিজয়কে সহজতর করে তোল। ফলে বহু রাজা বশ্যতা স্বীকার করিছিলেন আর ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এসব কারণে উত্তর পূর্ব ভারতে বসবাসরত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী দক্ষিণ পূর্ব দিকে ক্রমে অগ্রসর হতে শুরু করে।
এভাবে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা এক একটি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শক্তি গড়ে তোলে স্বাধীন জীবন যাপনের উদ্দেশ্য সাদেংগীর ধার্মিক ও তার আলোকিত ছিলো বলে গেংখুলীদের গীতের ভাষায় শোনা যায়। রাজা সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করে কালাবাঘা(বর্তমানে কুমিল্লা জেলা) রাজ্যের জালি পাগজ্যা (১)নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন বলে জানা যায়।
সাদেংগীর মূত্যুর বহু বছর পর এই বংশে বিচগ্রী নামে উত্তরসূরী রাজা চেৎ-তো গৌং (চট্টগ্রাম) শাসন করেছিলেন বলে চট্টগ্রামের ইতিহাস (প্রাচীন আমল) মাহবুব রহমান এর পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে। অনেকের মতে চাদেংগীর জৈষ্ঠ পুত্রের নাম বিচগ্রী (২)। যাইহোক বয়প্রাপ্ত হবার সাথে সাথে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন কুমার বিচগ্রী। উক্ত সময়ে চট্টগ্রাম দক্ষিনাঞ্চল সহ রোয়াং (আরাকান) অবধি শাসন করতেন অক্সারাজা। পার্শবর্তী দেশের রাজাগণের কাছে অজানা ছিলোনা তাঁর সৈন্য শক্তি ও পরাক্রমের কথা। এদিকে বিচগ্রী সৈন্য সংগ্রহ করে কোন এক শুভদিনে তিনি বেড়িয়ে পড়লেন অক্সারাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে। সেনাপতি হিসেবে রাধামন ও জয়রাম দুই বিচক্ষণ যোদ্ধা। যুদ্ধের উভয় পক্ষের বহু লোকের হতাহতের পর অবশেষে অক্সারাজা পরাজিত হয়ে বার্মায় পলায়ন করেন।
যুদ্ধ বহু বৎসর অবতীর্ণ হবার পর বিচগ্রী তার পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি ও প্রতিবেশীর কথা মনে পড়ে প্রাণ কেঁদে ওঠে। তাই তিনি বিজয় আনন্দ উল্লাসে একদিন স্বদেশের দিকে রওনা দিলেন। স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তনের আগে পথে শুনতে পেলেন তার বৃদ্ধ পিতার মৃত্যু হয়েছে, ছোট ভাই উদগ্রী স্বঘোষিত রাজা হয়ে তাঁকে স্বদেশ ফেরার পথে বাধা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সংবাদ পেয়ে বিচগ্রী খুবই মর্মাহত হন এবং অনুজের দুরভিসন্ধি ও বিশ্বাস ঘাটকতায় তিনি স্বদেশের স্বজাতির মুখ দর্শন করতে না পেরে পুনঃরায় তাঁর অধিকৃত রোয়াং রাজ্যে অর্থাৎ আরাকানে ফিরে যান। ১১০০ খ্রীষ্টাব্দে সেখানে স্থায়ী বসবাস, রাজ্য শাসন ও বংশ রক্ষার জন্য সৈন্যদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ন জাতীয় রমনী বিবাহ করেন। আবার অনেকেই স্বদেশে গিয়ে স্বজাতি রমনী বিবাহ করেন। এভাবে রোয়াং রাজ্যে এজাতির বসতি স্থাপন গড়ে ওঠে।
রাজা বিচগ্রী অপুত্রক ছিলেন। সম্ভবতঃ সম্রাট অশোকের মতো কলিঙ্গ বিজয়ের যে রক্তপাত হয়েছিলো তেমনি বিচগ্রীর শেষ জীবনে ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন রক্তপাত দেখে এবং তার অনুসারীগণ, সবাই বৌদ্ধ ধর্মে পুরোপুরি দীক্ষিত হন। বিচগ্রীর মৃত্যুর পর বহু বছর পর্যন্ত আরাকান আরাকানের কিছু অংশ তাদের অধীনে ছিলো। উত্থান পতনের মধ্যে পরবর্তীতে চাপ্রে নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যাই হোক চাপ্রে এই পরিব্যাপ্ত শব্দটি শত শত বছরে স্মৃতি এবং আরাকানী ইতিহাস গ্রন্থেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সা-প্রে অর্থ চাকমা রাজ্য। তবে চাপ্রে বা সাপ্রে বলতে শুধুমাত্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে বুঝায়। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাতটি গছা বা গোত্রের মধ্যে দৈন্যাগছা, মংলা গছা ও ম্মেলংগছার লোকদের এখনো সবাই চাপ্রে নামে অভিহিত করে আসছে এবং নিজেরাও চাপ্রে কুল্যা বলে দাবি করে আসছে।
[গবেষকদের মতে বিচগ্রী, উদগ্রী ও সমগ্রী নামে তিন ভাই। চাকমাদের ভাষায় বিজয়গিরি, উদয়গিরি ও সমরগিরি। আবার ত্রিপুরাদের রাজঁমালা ইতিহাসের মতে দেখা যায় বিজয় মানিক্য, উদয়মানিক্য ও অমর মাণিক্য নামে ত্রিপুরা রাজা ছিলেন। ত্রিপুরা জাতির সেনাপতির নাম, কালানজির, রণগণ ও নারায়নের সংগে আমাদের সেনাপতি কালাবাগা, রাধামন ও জয়রামের অদ্ভুদ মিল দেখা যায়।]
চাকমা ইতিহাস মতে ১৩৩৩-১৩৩৪ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানে বার্মা শাসকের সাথে চাপ্রে জাতির রাজা অরুণ যুগের ভীষণ যু্দ্ধ হয়। উক্ত সনে ১৩ই মাঘ ১০,০০০ সৈন্য এংখ্যং ও ইয়াংখ্যং নামক এলাকায় বসবাস করেন এবং আরাকান রাজা তাদের কে দৈনাক বা দৈংনাক অর্থাৎ অস্ত্রধারী যোদ্ধা নামে আখ্যায়িত করেন।
অক্সারাজার সাথে চাপ্রেদের একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। বার্মারাজ মেঙ্গদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চাপ্রেরাজ যে ফন্দি করেছিলেন তা লোক প্রবাদ নিম্নরূপঃ-
চাপ্রেরাজের তুলনায় মেঙ্গদি রাজের শক্তি বহু বেশী। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন বন্ধুত্ব ভাব দেখানোর ছাড়া কোন উপায় নেই।তাই বন্ধুত্ব ভাব দেখিয়ে অতর্কিত আক্রমনের উদ্দেশ্য চাপ্রে রাজ একটি চুনমাখা হস্তী মেংদিরাজকে উপহার পাঠালেন। এতে মেঙ্গদিরাজ খুবই সন্তুষ্ট হন। কিছুদিন পর হস্তীর শরীর প্রলেপ দেয়া চুনের সাদা আবরণ ধরে যেতে শুরু করলো তখন মেঙ্গদিরাজ বুঝতে পারলেন এটা আসল নয় , নকল শ্বেহস্তী। তিনি আর দেরী না করে চাপ্রেগণের উপর নির্যাতন শুরু করেন।
কথিত আছে,- উক্ত সময়ে মেঙ্গদির লোকেরা খাজানা উশুল করার নামে চাপ্রেদের গ্রামে গিয়ে পুরুষদেরকে পিছ মোড়া বেঁধে গৃহের আঙ্গিনায় ফেলে সারা রাত নির্যাতন করা হতো। আর স্ত্রীলোকদের দিয়ে মদ তৈরী করিয়ে সেই মদ পান করতঃ তাদের কে যথেচ্ছা পাশবিক অত্যাচার চালাতো। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে গভীর অরণ্যপথে চাপ্রের অধিকাংশ লোক চট্টগ্রামে আলিকদম নামক স্থানে পালিয়ে আসেন। উক্ত সময়ে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা জামাল উদ্দীন এর অনুমতি ক্রমে ১২ খানি গ্রামের সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করেন। উক্ত ১২ খানি গ্রামকে বলা হয়েছিল বারতালুক। এই বারটি গ্রামের ১২টি তালুক বা দলের নাম তাদের বৈশিষ্ট্য ও আচারনের উপর রাখা হয়। যথাঃ- ১. দৈন্যাগছা, ২. মোগছা. ৩. কারবুয়া গছা, ৪. মংলাগছা, ৫. ম্মেলাংগছা, ৬. লাংগছা, ৭. অঙ্যগছা এবং অবশিষ্ট পাচঁটি তালুক বা গছা উল্লিখত গছার সাথে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলো বা পরবর্তীতে চট্টগ্রামে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা জাতিতে অন্তর্ভূক্ত হন। কিংবা পুনঃরায় আরাকানে চলে যান বলে মনে হয়।
মেঙ্গদিরাজ চাপ্রে রাজার পরমা সুন্দরী কন্যা চমিখাকে বিবাহ করেন। চমিখার চৌজু চৌপ্রু ও চৌতু নামে তিন জৈষ্ঠ ভ্রাতা ছিলো।তাদের মধ্যে চৌপ্রু শাসন করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে কখন কোথায় তা সঠিক জানা নেই। যাই হোক কনিষ্ঠ ভ্রাতা চৌতুর পুত্র ক্যাংঘরে মৈসাং (শ্রমণ) হন। যখন মেঙ্গদির অত্যাচারে স্বজন নিয়ে পালাতে শুরু করতে লাগলেন তখন মৈসাংকে গোচরীভূত করা হয়েছিলঃ-
যেই যেই বাপ ভাই যেই যেই
চম্পক নগরত ফিরি যেই
এল মৈসাং লালস নাই
ন-এলে মৈসাং কেলেস নাই।।
ঘরত থেলে মগে পায়
ঝাড়ত্ গেলে বাঘে খায়
মগে নপেলে বাঘে পায়
বাঘে ন পেলে মগে পায়।।
অতঃপর আরাকানে বসবাসরত দৈনাক নামে জাতিরা প্রাণের ভয়ে চট্টগ্রামে দিকে পালিয়ে আসেন। উক্ত সময়ে উত্তর চট্টগ্রামে স্বজাতীয় লোকের বসবাস ছিলো। তাদের মধ্যে দলপতি মোগলের অনুকুলে খাঁ উপাধি ধারণ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় শাসন করতেন। মোগলের অধীনে সেই সব শাসনকর্তাকে রাজাও বলা হতো। যাইহোক, আরাকান থেকে পালিয়ে আসার সময় অনেকে লাল বা খয়ের বর্ণ একটুকরা কাপড় খন্ড শরীরে পেছিয়ে মৈচাং অর্থাৎ বৌদ্ধ শ্রমণ সেজে ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং দীর্ঘপথ অতিক্রম করেন। কেননা, অক্সানামে লোকেরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। সুতরাং লাল খয়েরী বর্ণের পোশাক ও মুণ্ডিত মস্তক দেখলে তারা আক্রমণ করতো না। আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে আসা ও সব মৈসাং বেশধারী অনেকেই এভাবে থেকে যাই। চট্টগ্রামে বাঙ্গালীরা তাদের কে ডাকতো ‘রোলী’ (১)। পরবর্তীতে এঁরা চাকমা জাতীর একমাত্র ধর্মীয় পুরোহিত লাউরী নামে সমাদৃত হন বলে মহাপন্ডিত কৃপাচরণ মহাস্থবির কর্তৃক সম্পাদিত ও কলিকাতা থেকে প্রকাশিত ‘জগৎজ্যোতি’ (১৯১৭) পত্রিকায় উল্লেখ্য করেছেন। চাকমা রাজন্যবর্গ ও তাদের ধারাবাহিক ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে সহজে প্র্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী থেকে শুরু করে সাত্তুয়া (পাগলারাজা) পর্যন্ত যে সব রাজা ছিলেন তারা ‘রোয়াঙ্যা’ চাংমা আর ধাবানা থেকে বর্তমান সময়ে রাজা পর্যন্ত আনক্যা চাংমা নামে পরিচিত। তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি লেখক শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার মতে চন্দ্র ঘোনার দক্ষিণ পূর্ব বা চট্টগ্রামে শঙ্খ নদীর দক্ষিণে রোয়াং বা আরাকান পর্যন্ত বসবাসকারী গণেরা ‘টংসা’ (আরাকানের ভাষায় টং অর্থ দক্ষিণ বা পাহাড়, সা অর্থ সন্তান, সা অর্থ চাংমা)। এর অর্থ এই হতে পারে পূর্বদিকে পাহাড়ি সন্তান বা পূর্ব দিকে পাহাড়ী চাংমা। আবার চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের কে বলা হতো ‘আনক-সা’। আনক্ অর্থ আরাকানিদের ভাষায় পশ্চিম। আনক-সা অর্থ পশ্চিম কুলের চাংমা। এ ব্যাপারে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান মহোদয়ের পুরোপুরি একমত রয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছিলেন চৌদ্দ শতকের আগে আমাদের পূর্ব পুরুষের পরিচয় ছিলো ওভাবে। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয়ে নয়। তিনি ইহা ও মন্তব্য করেন, ধাবানা রাজা হয়ে চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলের স্বজাতিদের কে নিয়ে চাংমা জাতির সমাজ সংস্কার করতে গিয়ে চাকমা নামে স্বতন্ত্র করার প্রবিষ্ট হয়েছিলেন।
যতই অস্বীকার করিনা কেন, আমাদের ইতিহাসে ও ঐতিহ্য সৃষ্টি হয় আরাকান থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। আমাদের পূর্বপুরুষের আগমন ও অবস্থান দেখে আরাকানিরা হেঁয়ালিভাবে বলতে শুরু করে ছিলো চাংমাং বা চামা এবং তংসা। পরবর্তীতে বিভক্ত শব্দ দুটির মধ্যে একটি চাংমা/চাকমা, অপরটি তংচংয়্যা/তনচঙ্যা/তঞ্চঙ্গ্যা রুপান্তরিত হয়। অনেকে দাবির মতে শাক্য থেকে চাকমা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছিল। লুইনের মতে, চেইং পেংগো অর্থাৎ চম্পক নগর থেকে আগত বলে চাকমা নাম ধারণ করা হয়। বাবু সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা উপজাতি গবেষণা পত্রিকায় উদ্বৃতি মতে,- এ বিশ্বাস বংশ পরম্পরায় চলে আসলেও এ ধারণা কেবল মাত্র অনুমান। ত্রিপুড়া জাতি ‘রাজমালা’ পুস্তকের কতে “অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ে শব্দটি এখন ও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ‘চাকমা’ নামে উল্লেখ পাওয়া যায়। ত্রিপুরাদের প্রাচীন রাজমালা পুস্তকে”। রাজমালার প্রথম লহড়, ৩২ পৃষ্ঠা- কৈলাস চন্দ্র সিংহ।
ক্যাপ্টেন টি, এইচ লুইনের ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর লিখিত তথ্য মতে দেখা যায়, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে যে সব উপজাতি বসবাস করে তাদের নিম্ন লিখিত নামে শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। যথাঃ-
১. “খ্যংথা” বা নদীর সন্তান। এরা নদীর তীর বর্তী স্থানে বসবাস করে বলে থ্যাংথা নামে পরিচিত। তারা নিঃসন্দেহে আরাকানি বংশ উদ্ভুত, প্রাচীন আরাকানি উপভাষায় কথা বলে এবং সর্বক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে।
২. “টং থা” বা পাহাড়ের সন্তান। এরা মিশ্র জাতি উদ্ভুত। এদের মাতৃভাষা বাংলা, তবে নানা ধরণের উপভাষায় কথা বলে সন্দেহাতীতভাবে খ্যাংথাদের চাইতে অশিক্ষিত। এই শ্রেণীর মধ্যে ত্রিপুরা, চাক, খ্যাং ও মার্মা তাদের গোষ্ঠীর অর্ন্তগত। খ্যাংথাদের পাশাপাশি এরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসরন করে। খ্যাংথা ও টং থা শব্দ দুটি আরাকানি ভাষার শব্দ খ্যং অর্থ নদী, টং অর্থ পাহাড় এবং “ থা” বা “সা” (Tsa)অর্থ সন্তান বা পূত্র। পাহাড়ের উপজাতীয়দের চিহ্নিত করার জন্যে এইসব জাতিগত নাম কেবল আরাকানি উপভাষা। উপজাতিরাই এভাবে ব্যবহার করে। অন্যান্য উপজাতিরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নিজেদের বা প্রতিবেশীদের পরিচয় দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ী উপজাতিয়দের বৃহত্তর অংশ নিঃসন্দেহে পায় দুই প্রজন্ম পূর্বে আরাকান থেকে এখানে আসে। চট্টগ্রাম কালেক্টরেটে রক্ষিত দলিত পত্রাদি ও ইতিহাস ঐতিহ্য একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। ১৮২৪ খৃঃ বার্মা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ওসময় পর্যন্ত উপজাতিয় বহু শরণার্থী আরাকান থেকে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রবেশ করে। উক্ত সময়ের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরা, মগ, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খ্যাং, মুরুং, চাক, খুমি ছাড়া অন্য কোন জাতি ছিলনা।
তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা এই উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু হয়। প্রতীয়মান হয় যে, আরাকানে অবস্থানরত বহু চাপ্রে অর্থাৎ চাংমা নামের লোকেরা এককালে তৈনছড়ী কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দের দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলে রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ী থেকে একটি নদীর নাম হয়েছিলো বলে স্থানীয় প্রবীনদের মতামত রয়েছে। আবার ত্রিপুরা জাতির ভাষায় গাং, নদীকে তৈ বলা হয়। সুতরাং রাজা তৈন সুরেশ্বরী ত্রিপুরা ছিলেন। ত্রিপুরাদের মধ্যে এখনো রোয়াংগ্যা ত্রিপুরা ও আনক ত্রিপুরা নামে শব্দটি প্রচলন রয়েছে। যাইহোক, তৈ হতে তৈনচংয্যা দুটি উৎপত্তি একথাও পুরোপুরিভাবে ভূল নয়। কেননা, ত্রিপুরা জাতির গাবিছা সম্প্রাদায়ের মহিলাগণের পড়নের পিন্ধন ও বুক কাপড় আর তঞ্চঙ্গ্যা মহিলাগণের পড়নের পিন্ধনও বুক কাপড় সম্পূর্ণরূপে মিল রয়েছে। শ্রী মাধব চন্দ্র চাকমা রচিত “শ্রী শ্রী রাজনামা বা চাকমা রাজন্যবর্গ (১) পুস্তিকায় আংশিক উদ্বৃত মতে জানা যায়, চাকমারা দুটি অংশে বিভক্ত। একটি রোয়াংগ্যা চাকমা ও অপরটি আনক্যা চাকমা।
তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রাদায় ছিলো। রাজা হিসাবে ধাবানা শাসনকালে চাকমা নামে পৃথক একটি জাতির সংস্কার গড়ে তোলেন বলে উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা নামের শব্দটি কি নামে সম্বোধন ছিলো তা গবেষণায় ব্যক্ত করতে পারেননি। আমাদের এই জাতিরা পূর্বে কথা-বার্তা, গঠন প্রণালী, পূজা অর্চনা, বিষু উৎসব, জন্ম, বিবাহের চুমলাং পোষাক পরিচ্ছেদ, সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি আসামের অহমীয়াদের প্রাচীন সস্কারের সাথে অনেকাংশে মিল ছিলো একথা প্রমানিত করেছিলেন। তঞ্চঙ্গ্যাগণ শত শত বছর আরাকানে অতিবাহিত করেছিলেন এবং তথাকার কৃষ্টি সংস্কৃতি অনুসরণ ও অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু তাদের পূর্ব পুরুষের অতীত বৈশিষ্ট্যতা হারিয়ে ফেলেননি। বার্মা সরকার বর্তমান সময়ে তাদের কে চাকমা জাতি স্বৃতি দিয়ে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে আসছে বলে প্রত্যক্ষভাবে জানা যায়।
মোগলের অধীনে চট্টগ্রামের উপর খণ্ড খণ্ড শাসন কর্তা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চাকমা রাজা নামে কথিত এমন শাসক হিসাবে যাঁরা পার্বত্য জাতির উপর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা সবাই ভাগ্যদেবতা বলা যায়। তাঁরা মোগলের সাথে হৃদবন্ধনের ফলে অনুকম্পা লাভ করেন এবং খাঁ পদবী ধারণ করে ইংরেজ আমল পর্যন্ত তাদের প্রভূত্ব বিকাশ পায়। যার কারণে ক্ষমতায়, সুযোগে, শিক্ষায় এমনকি দর্পেও বিস্তার পায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরূপে বিবেচিত হয়। এরপর তাদের অভিযাত্রী জীবন প্রবাহ নিভে যেতে শুরু করে, এ জাতির ইতিহাস বিহিন করুণ আর্তনাদ নিরবে নিভৃত্বে মিলিয়ে যায় দূর বন পাহাড়ে।
আরাকানে ভূসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যকত, তানদুয়ে, মাম্রা সহ আর কয়েকটি এলাকায় চাকমা নামের তঞ্চঙ্গ্যাদের গোষ্ঠী গোজার লোক প্রাচীনকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। চট্টগ্রামে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে কক্সবাজার জেলাধীন রামু, উখিয়াও টেকনাফ থানায় এবং বান্দরবান জেলার নাক্ষ্যংছড়ী ও আলিকদমে এখনো তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্ব পুরুষগণ বসবাস করে রয়েছেন। ইতিহাসের তথ্যমতে তারাই দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গ্রী), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধন নামের উত্তরসুরি বংশধর বা যোদ্ধার বংশধর ছিলেন। যুদ্ধভিযানে অগ্রসর হয়ে তারা আরাকানে ও তার আশে-পাশে বসবাস শুরু করেছিলেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা নামে ক্যাত ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিলো।
ধরমবক্স খাঁ ওসব আগমনকারীদেরকে স্বজাতি বলে গ্রহণ না করার পেছনে উক্ত সময়ে কিছু কিছু প্রভাবশালীগণের কঠিন বাধা ছিলো বলে জানা যায়। আগমণকারীদের উপর যথেচ্ছা চুরি ডাকাতি ও জুলুম করা হয়েছিলো বলে শোনা গিয়েছে। যার কারণে তারা দলবদ্ধভাবে রাইংখ্যং, কাপ্তাই, সুবলঙের উজানে, ঠেগা, শঙ্খ শেষ প্রান্তে, ত্রিপুরায়, লুসাই হিলৈ এমনকি পুনঃ মাতামুহুরী ও আরাকানে চলে যেতে বাধ্য হন। চাকমাগণ উক্ত সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কে অভিহিত করতেন পরঙী অর্থাৎ বসবাসের জন্য আগমণকারী।
ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইন কতৃক লিখিত পুস্তক THE HILL TRACTS OF CHITTAGONG AND DWELLERS THEREIN (1869) এর মতে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে এ জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যায় ছিলো ২৮০০ জন। এদের মধ্যে অনেক বয়স্ব ব্যক্তি আরাকানি ভাষায় কথা বলতে পারে কিন্তু নতুন প্রজন্ম বৃহৎ অংশের সাথে মিশে যাচ্ছে আর এক বিকৃত ধরণের বাংলা ভাষা তাদের যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে প্রাধান্য লাভ করেছে। এরা কিন্তু সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, ধর্ম চুৎ হয়নি, তবে প্রকৃত পূজারী একথাও নিঃসন্দেহে বলা চলে। তিনি আরো উদ্বৃতি দিয়েছেন ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমলে ৪,০০০ জন তঞ্চঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন। এ দলের রাজা ছিলেন ফাপ্রু। স্থায়ী বসবাসের জন্য তিনি তার দলের প্রত্যেকের কাচে চাঁদা উঠিয়ে পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুঠির ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দিয়েছিলেন বলে এখনো কথিত রয়েছে।
আরাকানে ভুসিডং এলাকা থেকে আগত ধল্যা চাকমা [১] অভিমত ব্যক্ত করেন, চাকমা রাজা হিসাবে ধরমবক্স খাঁন যখন রাজা হলেন এই সংবাদে খুশি হয়ে সংথাইং আমু নামে জনৈক বিত্তশালী ও দলের নেতা হিসাবে আরাকান থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাজা ধরমবক্স খাঁনের সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানান। কিন্তু ধরমবক্স খাঁন তার আবেদন প্রত্যাখান করেন। নিজের ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হবার মনোভাবে তিনি আর দেরী না করে পুনঃ আরাকানের উদ্দেশ্য গমন করেছিলেন। যাত্রার সময় বীরবেশে সিঙাল (গয়ালের কিংবা মহিষের শিং এর ধ্বনি) ও ঢোলক বাজিয়ে এ অঞ্চল ত্যাগ করেছিলেন বলে কথিত রয়েয়ে।
একইভাবে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নেতা শ্রীধন আমুর নেতৃত্বে ৩০০ শত তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেন। রাজা ধরমবক্স খাঁ কে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য উপঢৌকন দিয়ে বসবাসের সম্মতি লাভ করেন। পরঙী নামে এই তিনশত পরিবার সবাই সচ্ছল ছিলেন এবং তারা রাইংখ্যং নদীর তীরবর্তীতে পুনঃবসতি স্থাপন করেছিলেন। সচ্ছলতার কারনে তাদের উপর বার বার ডাকাতি লুটপাট করা হতো বলে বুড়া-বুড়িদের মুখে শোনা গিয়েছে।
চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর আমলে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু সংখ্যক লোক অন্যত্র চলে যাবার পেছনে আরো একটি ঘটনা রয়েছে। অগ্রাহায়ন মাসের কোন একদিন তঞ্চঙ্গ্যাদের ধৈন্যা গছা আর কারবুয়াগছার লাপাস্যা দলের মধ্যে ঊয়্যা পৈ নামে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান কে কেন্দ্র করে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ফলে উভয় পক্ষের বহু লোক হতাহত হয় এবং রাজ দরবারে বিচারের সম্মূখীন হন। এই ঘটনার পর অনেকেই অন্যত্র চলে যান। তাদের মধ্যে গছা ভিত্তিক দ্বন্ধের জন্য বিবাহ সাদি বন্ধ হয়ে যায়।
তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকানের অধিবাসী, আরাকান থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলো এ কথা পুরোপুরি সত্য নয়। তারা চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের দিকে কিছু অংশ চলে গিয়ে দৈনাক সম্বোধিত হন। অন্যদিকে চট্টগ্রামে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বদিকে অধিকাংশ স্থানে তাদের স্বাধীনভাবে বসবাস ছিলো। অন্যান্য উপজাতীয়দের মতো নিজস্ব আইন শাসনের মধ্যে গভীর বনাঞ্চলে জুম চাষই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা।[ধল্যা চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা) ৩রা জানুয়ারী ১৯৯৯ ইং রাঙ্গামাটি আসেন।বাড়ি আরাকানে ভূসিডং ইউনিয়নের মিজং গং চো এ। বয়স ৫৫ বৎসর।ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে সুপন্ডিত। বার্মা ভাষায় শিক্ষিত। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা বিষয়ে গবেষণার জন্য রাঙ্গামাটিতে আসেন। ধল্যার মতে আরাকানে তাদের বসবাস প্রায় ৭ শত বছর। রাঙ্গামাটিতে এসে চাকমাদের পোষাক, চেহারা, আচরণ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।]
তাই তঞ্চঙ্গ্যাগণ মোগলধর্মী রাজার কিছু কিছু সামাজিক আইন মানতে রাজী ছিলোনা। যেমনঃ (ক) কোন তঞ্চঙ্গ্যা রমনীর মৃত্যু হলে তাকে পশ্চিম দিকে মাথা রেখে পুড়িয়ে ফেলা। (খ) লুরী বা লাইরী নামের ধর্মগুরু দিয়ে অন্তোষ্টিক্রিয়া কিংবা সামাজিক কর্মাদি করা। (গ)মহিলাগণের এককানে পাঁচটি করে দুই কানে দশটি ছিদ্র করা, পড়নের পিনুইনে চাবুগী রাখার পার্থক্য ইত্যাদি। সম্ভবতঃ ওসব সামাজিক কিছু কিছু নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলো বলে চাকমা রাজা উক্ত সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে স্বজাতি বলে স্বীকৃতি না দেয়ার অন্যতম কারন বলা যেতে পারে।
আরাকানে অবস্থানরত চাকমাগণ(তঞ্চঙ্গ্যাগণ) শাক্য বংশের উত্তরসূরী হিসেবে তদানিন্তত জেনারেল উনু প্রতিবৎসর এ জাতির দম্পতি রেঙ্গুনে আমন্ত্রন জানিয়ে সম্বর্ধনা দিতেন। বর্তমান সময়েও আদিবাসী জাতি হিসাবে সরকার তাদের কে প্রতিবছর আমন্ত্রন জানিয়ে রেঙ্গুনে শাক্যজাতির সম্মানে সম্বর্ধনা দিয়ে আসছে বলে জানা যায়। ধল্যা চাকমা বলেন, আরাকানে অবস্থানরত চাকমা নামে পরিচিত মুগছা, ধৈন্যাগছা, কারবুয়াগছা, ল্লাংগছা, মগলাগছা এবং অঙ্যগছা ছাড়া কোন চাকমা গছা নেই। ১৯৮৫ ইং সনে লোকগণনায় দেখা গিয়েছিলো আরাকানে ৯২,৩০০ জন চাকমা(তঞ্চঙ্গ্যা) রয়েছে। ইহা ছাড়া ত্রিশ হাজারের মতো বার্মায় বসবাসের ফলে বর্তমানে তারা বার্মীজ সম্প্রাদায়ের সাথে মিশে যান। তাদের মধ্যে বুড়াবুড়িরা কিছু কিছু তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় কথা বলতে পারে, ভুসিডং নিবাসী ধল্যা এ কথা বলেন।
চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ খুবই প্রতিপত্তি সম্পন্ন রাজা ছিলেন। তাঁর শাসনামলে পরবর্তী কালের রাজাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামের তঞ্চঙ্গ্যাগণের উপর অভিন্নতা মনোভাব ও সদাচারণ এমন কি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেননি বলে জানা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন মৌজা নির্ধারন ও বন্টন করা হয় তখন পাঁচ জন তঞ্চঙ্গ্যা কে মৌজার হেডম্যান পদ দেয়া হয়েছিলো।
নিরহংকার, অসাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী রাজা ভূবণ মোহন রায় শ্রেষ্ঠ করি হিসাবে শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে ‘রাজকবি’ এবং শ্রেষ্ঠ উবাগীতের ধারক বাহক শ্রী জয় চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (কানাগিংখুলী) কে ‘রাজগীংখুলী’ উপাধিতে ভূষিত করে প্রতি বছর রাজপূণ্যাহের উপলক্ষে রাজসভায় যোগ্যতার আসনে উপবিস্থ করে রাখতেন। তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐসময় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শ্রী কুঞ্জ মহাজন ও শ্রী খোক্কেয়া বৈদ্যের সাথে রাজা ভূবন মোহন রায় গভীর সর্ম্পক ছিলো বলে জানা যায়। রাজকুমার নলিনাক্ষ রায় স্বজাতির মেয়ে বিবাহ না করে জটিলাদেবী নামে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির রমনীকে বিবাহ করা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আংটি পরিয়ে দেন। এ ব্যাপারে পাত্রপাত্রি ও অন্যান্য স্বজনদের সাথে রাজা পরামর্শ করেন। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে চাকমাগণের বৈবাহিক সম্পর্ক অসম্ভব ও অস্বাভাবিক বিধায় রাজবংশের মান সম্ভ্রম বিষয়েও বিবেচনা করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে যায়। নলিনাক্ষ রায়ের পর কুমার ত্রিদিপ রায় রাজা হয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভিক্ষু শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবিরকে ‘রাজগুরু’ পদে অধিষ্ঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্ম উদিত হয় এবং ধর্ম বিস্তার এক অকল্পিত স্বাক্ষর বহন করে।
———————————————————–

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির আদ্যেপান্ত

তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বর্তমান সম্পর্কে কোনো তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস রচনাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কেবলমাত্র চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। তাও অনুমান নির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে চাকমা জাতির একটি শাখা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যাদের পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে। চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমার একটি শাখা হিসেবে স্বীকার করে। এমনকি আসল বা মূল চাকমাও বলে থাকে। কিন্তু আশ্চার্য্যের বিষয় এই যে, চাকমাদের যে গোজা গোষ্ঠী রয়েছে সেসব গোজা গোষ্ঠীর সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের বারোটি গোজা বা গোষ্ঠীর নামের সঙ্গে কোনো মিল নেই। চাকমা জাতির ইতিহাস রচয়িতারা তাদের রচিত ইতিহাসে এমনকি আধুনিক চাকমা লেখকরা তাদের চাকমাজাতি বিষয়ক রচনায় তঞ্চঙ্গ্যাদের গোজা গোষ্ঠী বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানাদির নাম চাকমাদের গোজা গোষ্ঠী বা আচার অনুষ্ঠান বলে উল্লেখ করেন না। যদি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা একই জাতিভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়। হিন্দুরা বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্ম বা সনাতন ধর্ম বলে দাবি করেন, তাই তথাগত বুদ্ধকে হিন্দুদের অবতার (দশম অবতার) রূপে পূজা করেন। যদিও হিন্দুধর্ম আর বৌদ্ধধর্ম দুইটা দুই মেরুতে অবস্থান করছে। চাকমা জাতির উত্থান পতন, জয় পরাজয়, আশা আকাঙ্খা, সুখ দুঃখ, ব্যথা বেদনা, অভিযান অগ্রগতি বা সমবৃদ্ধির বিবরণীর সঙ্গে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। কেবলমাত্র ইতিহাসের শো’কেসে তঞ্চঙ্গ্যাদের পুতুল বানিয়ে আবদ্ধ করেই রাখা হয়েছে।

ইতিহাস ও অবস্থান

তঞ্চঙ্গ্যা নামের দৈংনাকেরা বৌদ্ধ এবং তারা মায়া নদীর (মায়ু) উর্ধ্বভাগে বসবাস করেন। তাদের ভাষা বিকৃত বাংলা। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চাকমা এবং দৈংনাকদের একসঙ্গে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়। ধর্ম এবং ভাষার সাদৃশ্য থাকাতে উভয় জাতিসত্ত্বার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মৈত্রী থাকার কথা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। আরাকানবাসীদের সঙ্গেও দৈংনাকদের কোনোরূপ দ্বন্দ ও সংঘাত ছিল না। অন্ততঃ ইতিহাসে কোনো দ্বন্দের উল্লেখ নেই। আরাকান ও উচ্চব্রহ্মে অপরাপর মঙ্গোলীয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর দৈংনাকরা অন্যতম তা প্রাচীন আরাকান ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন- ‘প্রাচীন আরাকান রাজ্য ছিল মোঙ্গল, তিব্বত ব্রহ্ম জনগোষ্ঠী ও মুরুং, খুমী, চাক, সিন, সেন্দুজ, ম্রো, খ্যাং, ডইনাক, মারুমিউ প্রভৃতি কিরাত উপজাতি অধ্যুষিত দেশ।’

ধর্ম

দৈংনাকরা যে বৌদ্ধ তা ‘হিসটোরি অব বার্মা’ রচয়িতা তৎকালীন আরাকান বিভাগের কমিশনার ফেইরী উল্লেখ করেছেন। তাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্র ত্রিপিটক ছিল। চাকমারাও বৌদ্ধ। শত অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হলেও তারা আরাকান ত্যাগের সময় বৌদ্ধ ধর্মকে ত্যাগ করেনি। তাদের পরবর্তী ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা আরাকান ত্যাগ করার প্রাক্ক্বালে ধর্ম‌শাস্ত্র সঙ্গে বহন করেছিল। কিন্তু মূল ত্রিপিটক দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অথবা তাদের কাছে না থাকাতে তারা মূল ত্রিপিটক সঙ্গে নিতে পারেনি। দৈনন্দিন কাজে বা মৃত্যু, বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহারোপযোগী প্রয়োজনীয় সূত্র মূল ত্রিপিটক হতে লিপিবদ্ধ করে নেয়।

বসবাস

কথিত আছে চাকমারা চট্টগ্রাম, রাঙ্গুনিয়া ও রাঙ্গামাটি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করলে আলীকদম ও আরাকানের বহু দৈংনাক স্ব-জাতীয় বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাকমাদের সান্নিধ্যে বসবাস করার উদ্দেশ্য তত্র অঞ্চলে চলে আসে। আলীকদম থেকে কিছু দৈংনাক নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও বর্তমান কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, উখিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। অদ্যাবধি সেই সব জায়গায় তারা বসবাস করছে। উত্তরদিকে আসার পথে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, হোয়াকক্ষ্যং, রাজবিলা, শুকবিলাস, বাঙ্গালহালিয়া, নারানগ্রী, কাপ্তাই উপত্যকা অঞ্চল, নোয়াপতং, রাইংখ্যাং উপত্যকা সম্পূর্ণ অঞ্চল, হোয়াগ্গা, বড়াদম, ঘাগড়া, রইস্যাবিলি এসব অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।

চাষাবাদ

তখন সমতল জমিতে কৃষি পদ্ধতি সবেমাত্র আরম্ভ হয়। অধিকাংশ প্রজারাই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। দৈংনাকরাও জুমচাষী ছিল। চাকমা রাজ সরকারের জুম তৌজিতে তাদেরকে চাকমা উল্লেখ না করে তৈনটংগ্যা (অধিকাংশ আলীকদমের তৈনছড়ি থেকে আগত বলে) নামে উল্লেখ বা তৌজিভুজ করা হল। তৈনটংগ্যা শব্দটি ক্রমে ক্রমে ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ এই লিখিত রুপ লাভ করে।

 

লিপিকা রানী বড়ুয়া 
ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম

ডেইলি বাংলাদেশ/জেএমএস

https://www.daily-bangladesh.com/%E0%A6%A4%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4/76473

Relations (luk kurum) in Tongchangya community

family-tree

 

Relation plays an important role in Tongchangya community. The relation can be by blood or by marriage. Some relation are by adaptation even. This relation is very important to trace one’s ancestors through a  family tree. The seniority is also recognised by tracing the family tree. This is not only relevant for close- affinity among Tongchangya but also in terms of  getting marriage as well. Relative could be a hindrance to get  marriage when they are not in the same generation. Like a niece and her uncle are not permitted to get marry. Similarly, Aunt and nephew are never allowed as a custom that has been handing down for centuries.

Respecting the seniors by younger generation (pawla/পলা) is a wonderful culture found in Tongchangya culture. These  are the relations found in Tongchangya society either by blood or by marriage.

  • Lisu=লিসু -Great Great grand father
  • Pisu-পিসু-Great grand father
  • Bua-Da/Achu বুআ-দা/ আসু- Grand Father
  • Bua-Bei/Nu- বুআ-বেই/নু- Grand Mother
  • Ma-মা/মামা/নুMother
  • Ba/Bo/- Father
  • Bei- বেই- Elder/older sister
  • Boin-বইন Younger-sister
  • Da- দা- Elder/older brother
  • Bai-বাই-Younger brother
  • Hukhu- হুক্কু-Uncle
  • Hui-হুই- Aunt
  • Jiru-জিরু-Father elder/older brother/ Great uncle
  • Jerei- জেরেই-Father elder/older brother’s wife/ Great Aunt
  • Mosya-মোস্যা-  Uncle (Husband of one’s mother sister)
  • Moi- মৈ-One’s mother’ sister/cousin sister
  • Pisya-পিস্যা- Husband of father’s sister
  • Pi-পি-Father sister/ cousin sister
  • Mamu- মামু-Uncle
  • Mami-মামি-Aunty
  • Nek-নেক-Husband
  • Muk-মুক- Wife
  • Purobo-পুরবো- Daughter-in-law
  • Jamei- জামেই- Son-in-law
  • Pawa- পয়া-Son
  • Jhi-ঝি- Daughter
  • Naring- নারিং-Grand child/son/daughter
  • Puring- পুরিং-Great grand child/son/ daughter
  • Suring-সুরিং- Great great grand child/son/ daughter
  • Uring- উরিং- Great Great great grand child/son/ daughter

A concise information of Dainak, Tongchangya/Tanchangya history

Best Thayet.jpg

(1) Tagaung Kingdom, Thayet, and Pyay. (2) Tayet (Earlier name was Micchagiri)

1. First Sakyan group arrived in Northern Myanmar at 850 BCE in Tagaung (Myanmar) from central India as Sakya. ( U Pe Maung Tin & G.C Luce, The Glass Palace of the Kings of Myanmar, Yangon: Unity Publication. 2008: 1. (http://www.shanyoma.org/yoma/the-glass-palace-chronicles.pdf)

2. Second Sakyan group arrived in Northern Myanmar called Tagaung around 6th Century BCE as Sakya from Northern India). (Ibid. 3)

3. Due to Chinese attack in 600 BCE the Sakyan moved from Tagaung to Micchagiri (Present Thayet, Magwe, Myanmar) at the bank of Iravati (Ayyawaddy River) from Tagaung. (Ibid:, 309)

4. In 443 BCE Sakyan founded Prome (Present Pye, Bago, Myanmar) (G. E. Harvey, History of Burma, London: Longmans Green and Co, 1926: 307)

5. In 1333-34 CE Arakan king defeated the (Thek) Sakyan king at Micchagiri (present Thayet, Magwe, Myanmar) and took them to Arakan, Western Myanmar and our Sakyan (Thek) become Dainak ( Myanmar Min Aredawbung, Danyawaddy Aredaw Bung: 14)

6. From Arakan or Sa Prye( Pye) around 1364 (it is an estimate date) CE (Common Era) went to the border of Burma and Bangladesh called Toin Gang as Dainak. (Heard from our ancestor)

Prome.gif

7. From Toin River Pha Phru led 4000 Dainak with him to Chittagong Hill Tract during Dharam Bux Khan ( Chakma King) and gave them as Toin- Gangya since they went from Toin River ( a tributary of Matamuri), in Burma-Bangladesh border. The king did not list them as Chakma but took care them as his subjects. ( Biro Kumar Tanchangya, Tanchangya Parichiti (Bandarban: Tanchangya Maha Sommilon, 1995: 21)

bandarban-map

8. The  name of “Toin-Gangya” to Tounjynyas has changed during British India in 19th Century CE. (Lewin, Thomas Herbert, The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein: with comparative vocabularies of the Hill Dialects, Calcutta: Bengal Printing Company Limited, 1869: 62.(https://ia800205.us.archive.org/15/items/cu31924023625936/cu31924023625936.pdf)

9. In 1989, Bangladesh government identified Tanchangya as one of the indigenous communities in Bangladesh. (Rupayan Dewan; Jhum, Dhaka University)

10. Tounjynyas to Tanchangya/ Tongchangya.

Sakya> Dainak> Toin-Gangya> Tounjynyas> Tanchangya/ Tongchangya.

This is the brief history Tanchangya from Sakya to Tanchangya/Tongchangya. We trace this history as our due to our Dainak who has been living in Myanmar since immemorial time. Hope all of you will find interesting. If you find interesting share with others.

“আ” উপসর্গযোগে গঠিত ১০০+ তঞ্চঙ্গ্যা শব্দ।

tongchn1
লেখকঃ চন্দ্রসেন তঞ্চঙ্গ্যা
# মূল শব্দের বিপরীত অর্থ প্রকাশক শব্দসমূহ:
 
১.আউচ্ছ্যা-অনুত্থিত [আ+উচ্ছ্যা]
২.আকাচায়্যা-অপরিষ্কৃত [আ+কাচায়্যা]
৩.আকাইন্ন্যা-অক্রন্দিত [আ+কাইন্ন্যা]
৪.আকাপ্প্যা-অকর্তিত [আ+কাপ্প্যা]
৫.আকাবা-অকর্তিত [আ+কাবা]
৬.আকামাজ্জ্যা-কামড়ানো হয়নি এমন [আ+কামাজ্জ্যা]
৭.আকিচ্চ্যা-মাজা হয়নি এমন [আ+কিচ্চ্যা]
৮.আকিন্ন্যা-অক্রীত [আ+কিন্ন্যা]
৯.আকুইচ্চ্যা-অরোপিত [আ+কুইচ্চ্যা]
১০.আকুবায়্যা-পোতা হয়নি এমন [আ+কুবায়্যা]
১১.আকুয়্যা-অকথিত [আ+কুয়্যা]
১২.আখঁআয়্যা-বের করা হয়নি এমন [আ+খঁআয়্যা]
১৩.আখচরায়্যা-হাতড়ানো হয়নি এমন [আ+খচরায়্যা]
১৪.আখচাজ্যা-হাতড়ানো হয়নি এমন [আ+খচাজ্যা]
১৫.আখাইচ্চ্যা-অমুদিত [আ+খাইচ্চ্যা]
১৬.আখায়্যা-অভুক্ত [আ+খায়্যা]
১৭.আখিলায়্যা-খিলানো হয়নি এমন [আ+খিলায়্যা]
১৮.আখিল্যা-খিলানো হয়নি এমন [আ+খিল্যা]
১৯.আগনা-অগনিত [আ+গনা]
২০.আগাইচ্ছ্যা-অস্নাত [আ+গাইচ্ছ্যা]
২১.আগাধায়্যা-স্নান করানো হয়নি এমন [আ+গাধায়্যা]
২২.আগায়্যা-অগীত [আ+গায়্যা]
২৩.আগারায়্যা-পোতা হয়নি এমন [আ+গারায়্যা]
২৪.আগিয়ায়্যা-যার উপর দিয়ে যাওয়া হয়নি [আ+গিয়ায়্যা]
২৫.আগিল্যা-গেলা হয়নি এমন [আ+গিল্যা]
২৬.আগুইচ্ছ্যা-অগৃহীত [আ+গুইচ্ছ্যা]
২৭.আগুজ্যা-অকৃত [আ+গুজ্যা]
২৮.আগুন্যা-অগনিত [আ+গুন্যা]
২৯.আগুল্যা-গলেনি এমন [আ+গুল্যা]
৩০.আগেচায়্যা-যা অঙ্কুরিত নয় [আ+গেচায়্যা]
৩১.আঘাইচ্যা-ঘাঁটা হয়নি এমন [আ+ঘাইচ্যা]
৩২.আঘিজ্যা-ঘেরা হয়নি এমন [আ+ঘিজ্যা]
৩৩.আঘুজ্যা-ঘোরা হয়নি এমন [আ+ঘুজ্যা]
৩৪.আচাবায়্যা-চিবানো হয়নি এমন [আ+চাবায়্যা]
৩৫.আচায়্যা-অদর্শিত [আ+চায়্যা]
৩৬.আচালায়্যা-অচালিত [আ+চালায়্যা]
৩৭.আচিমায়্যা-ওজন বা ফোলা কমেনি এমন [আ+চিমায়্যা]
৩৮.আচুক্ক্যা-অশোষিত [আ+চুক্ক্যা]
৩৯.আছাক্ক্যা-ছাঁকা হয়নি এমন [আ+ছাক্ক্যা]
৪০.আছায়্যা-অনাচ্ছাদিত [আ+ছায়্যা]
৪১.আছিনা-অছিন্ন [আ+ছিনা]
৪২.আছিন্যা-অছিন্ন [আ+ছিন্যা]
৪৩.আছুল্যা-আবরণ তোলা হয়নি এমন [আ+ছুল্যা]
৪৪.আজরায়্যা-জোড়া দেওয়া হয়নি এমন [আ+জরায়্যা]
৪৫.আজাক্ক্যা-অজাগ্রত [আ+জাক্ক্যা]
৪৬.আজায়্যা-জাগানো হয়নি এমন [আ+জায়্যা]
৪৭.আজায়্যা-অগমিত [আ+জায়্যা]
৪৮.আজিক্ক্যা-অজ্যান্ত [আ+জিক্ক্যা]
৪৯.আটাঁয়্যা-টাঙানো হয়নি এমন [আ+টাঁয়্যা]
৫০.আটিক্ক্যা-টিকেনি এমন [আ+টিক্ক্যা]
৫১.আঠিল্যা-ঠেলা হয়নি এমন [আ+ঠিল্যা]
৫২.আডাক্ক্যা-ডাকা হয়নি এমন [আ+ডাক্ক্যা]
৫৩.আডূজ্যা-শব্দ করেনি এমন [আ+ডূজ্যা]
৫৪.আঢাক্ক্যা-ঢাকা হয়নি এমন [আ+ঢাক্ক্যা]
৫৫.আতআয়্যা-খোঁজা হয়নি এমন [আ+তআয়্যা]
৫৬.আতাক্ক্যা-তাক করা হয়নি এমন [আ+তাক্ক্যা]
৫৭.আতুল্যা-তোলা হয়নি এমন [আ+তুল্যা]
৫৮.আদিক্খ্যা-অদর্শিত [আ+দিক্খ্যা]
৫৯.আদিয়্যা-অপ্রদত্ত [আ+দিয়্যা]
৬০.আদুক্ক্যা-পিষে ফেলা হয়নি এমন [আ+দুক্ক্যা]
৬১.আদুমুজ্যা-দৌঁড়ানো হয়নি এমন [আ+দুমুজ্যা]
৬২.আদুল্যা-পিষা হয়নি এমন [আ+দুল্যা]
৬৩.আঘুইচ্চ্যা-অঘর্ষিত [আ+ঘুইচ্চ্যা]
৬৪.আদেহায়্যা-অপ্রদর্শিত [আ+দেহায়্যা]
৬৫.আধারায়্যা-ধার দেওয়া হয়নি এমন [আ+ধারায়্যা]
৬৬.আধুজ্জ্যা-অধৃত [আ+ধুজ্যা]
৬৭.আধুয়্যা-অধৌত [আ+ধুয়্যা]
৬৮.আধুল্যা-দোলা হয়নি এমন [আ+ধুল্যা]
৬৯.আনাচ্চ্যা-নাচা হয়নি এমন [আ+নাচ্চ্যা]
৭০.আনিক্ক্যা-বের হয়নি এমন [আ+নিক্ক্যা]
৭১.আনিচায়্যা-নেওয়া হয়নি এমন [আ+নিচায়্যা]
৭২.আপরা-লেখাপড়া করেনি এমন [আ+পরা]
৭৩.আপিক্ক্যা-পান করা হয়নি এমন [আ+পিক্ক্যা]
৭৪.আপিন্যা-পরিধান করা হয়নি এমন [আ+পিন্যা]
৭৫.আপুইজ্যা-পোড়া হয়নি এমন [আ+পুইজ্যা]
৭৬.আপুইজ্ঝ্যা-অপঠিত [আ+পুইজ্ঝ্যা]
৭৭.আপুরা-অপূর্ণ [আ+পুরা]
৭৮.আফিল্যা-ফেলা হয়নি এমন [আ+ফিল্যা]
৭৯.আফুলায়্যা-ফোলানো হয়নি এমন [আ+ফুলায়্যা]
৮০.আফেলায়্যা-ফেলানো হয়নি এমন [আ+ফেলায়্যা]
৮১.আবলায়্যা-অনিমন্ত্রিত [আ+বলায়্যা]
৮২.আবাইচ্চ্যা-অস্পর্শিত [আ+বাইচ্চ্যা]
৮৩.আবাইচ্ছ্যা-অবাছাইকৃত [আ+বাইচ্ছ্যা]
৮৪.আবাইজ্যা-বাড়েনি এমন [আ+বাইজ্যা]
৮৫.আবাইজ্জায়্যা-মারা বা আঘাত করা হয়নি এমন [আ+বাইজ্জায়্যা]
৮৬.আবাইজ্ঝ্যা-বাড়া হয়নি এমন [আ+বাইজ্ঝ্যা]
৮৭.আবাইন্যা-বাঁধা হয়নি এমন [আ+বাইন্যা]
৮৮.আবিচাজ্জ্যা-হাতড়ানো হয়নি এমন [আ+বিচাজ্জ্যা]
৮৯.আবিচিরায়্যা-হাতড়ানো হয়নি এমন [আ+বিচিরায়্যা]
৯০.আবিচ্চ্যা-অবিক্রীত [আ+বিচ্চ্যা]
৯১.আবিলায়্যা-বিলানো হয়নি এমন [আ+বিলায়্যা]
৯২.আবুন্যা-বোনা হয়নি এমন [আ+বুন্যা]
৯৩.আবেরায়্যা-বেড়ানো বা ভ্রমণ করা হয়নি এমন। [আ+বেরায়্যা]
৯৪.আভরা-অভর্তি [আ+ভরা]
৯৫.আভরায়্যা-অভর্তিকৃত [আ+ভরায়্যা]
৯৬.আভুজ্যা-ভরেনি এমন [আ+ভুজ্যা]
৯৭.আমরায়্যা-মরানো হয়নি এমন [আ+মরায়্যা]
৯৮.আমাচ্চ্যা-মাজা হয়নি এমন [আ+মাচ্চ্যা]
৯৯.আমাজ্জ্যা-মাড়াই করা হয়নি এমন [আ+মাজ্জ্যা]
১০০.আমাডায়্যা-ডাকা হয়নি এমন [আ+মাডায়্যা]
১০১.আমিলায়্যা-মিলানো হয়নি এমন [আ+মিলায়্যা]
১০২.আমিল্যা-অমিল [আ+মিল্যা]
১০৩.আমুচুজ্যা-মোচড়ানো হয়নি এমন [আ+মুচুজ্যা]
১০৪.আমুইজ্জ্যা-মরেনি এমন [আ+মুইজ্জ্যা]
১০৫.আরান্ন্যা-অরন্ধিত [আ+রান্ন্যা]
১০৬.আরুক্ক্যা-অরোপিত [আ+রুক্ক্যা]
১০৭.আলাক্ক্যা-লাগেনি এমন [আ+লাক্ক্যা]
১০৮.আলাজ্জ্যা-নাড়েনি বা ব্যবহার করেনি এমন [আ+লাজ্জ্যা]
১০৯.আলাহায়্যা-অরোপিত [আ+লাহায়্যা]
১১০.আলিক্খ্যা-অলিখিত [আ+লিক্খ্যা]
১১১.আলিপ্প্যা-লেপন করা হয়নি এমন [আ+লিপ্প্যা]
১১২.আলুআয়্যা-লুকানো হয়নি এমন [আ+লুআয়্যা]
১১৩.আলুজ্যা-নড়েনি এমন [আ+লুজ্যা]
১১৪.আসরায়্যা-সরানো হয়নি এমন [আ+সরায়্যা]
১১৫.আসিক্ক্যা-সেঁকা হয়নি এমন [আ+সিক্ক্যা]
১১৬.আসিয়ায়্যা-শেখানো হয়নি এমন [আ+সিয়ায়্যা]
১১৭.আসিরায়্যা-সারানো হয়নি এমন [আ+সিরায়্যা]
১১৮.আসীক্ক্যা-সেলাই করা হয়নি এমন [আ+সীক্ক্যা]
১১৯.আসুআয়্যা-অশুষ্ক [আ+সুআয়্যা]
১২০.আসুইজ্জ্যা-ঝাড় দেওয়া হয়নি এমন [আ+সুইজ্জ্যা]
১২১.আসুগুজ্যা-সামলানো হয়নি এমন [আ+সুগুজ্যা]
১২২.আসুম্ম্যা-ঢুকেনি এমন [আ+সুম্ম্যা]
১২৩.আহাগ্গুজ্যা-পোঁদ মলমুক্ত করা হয়নি এমন [আ+হাগ্গুজ্যা]