আমাকে স্বজাতির মা দাও, আমি স্বজাতির ভাষা রক্ষার মানুষ দেবো প্রারম্ভিক প্রসঙ্গ এবং কিছু প্রেক্ষাপটঃ

Tanchangya

লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা

ভাষা সভ্যতার মতোই জীবন্ত ও ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। ভাষার রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তাই কোনো ভাষার গুরুত্ব সাদামাটাভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
ভাষার আবিষ্কার বিজ্ঞানের অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য। গবেষকদের মতে, সভ্যতার ভিত গড়ার আগেই জন্ম হয়েছিলো ভাষার, ন্যূনতম ১ লক্ষ বছর আগে। হোমো সেপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষদের সময়কালে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আরো সুসংহত হয়। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে ঠিক কতটি ভাষার জন্ম হয়েছে ও হারিয়ে গেছে, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। বর্তমানে প্রচলিত বেশিরভাগ ভাষাই ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষা গোষ্ঠীর সদস্য। হিব্রু, তামিল, পার্সিয়ান, লিথুনিয়ান, চীনা, বাস্ক, অ্যারাবিক, আইরিশ, গ্রিক, ফিনিশ, মেসিডোনিয়ান ইত্যাদি ভাষাগুলো জনসংখ্যার হিসেব, বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রয়োজনের তাগিদেই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। ভাষা বিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট এথনোলগ (Ethnologue) এর মতে, বর্তমান পৃথিবীতে আনুমানিক ৭,০৯৭টি ভাষা জীবিত রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। এছাড়া, মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লিখিত প্রক্রিয়া। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো শুধু মৌখিকভাবেই প্রচলিত। পরিসংখ্যান অনুসারে, গোটা দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ ব্যবহার করে মাত্র ২৩টি ভাষা। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের ভাষাগুলো যথাক্রমে- চীনা ১.২ বিলিয়ন, স্প্যানিশ ৪০০ মিলিয়ন, ইংরেজি ৩৬০ মিলিয়ন, হিন্দি ২৬০ মিলিয়ন, আরবি ২৫০ মিলিয়ন, পর্তুগিজ ২১৫ মিলিয়ন, বাংলা ১৮০ মিলিয়ন, রাশিয়ান ১৬৬ মিলিয়ন, জাপানিজ ১৩০ মিলিয়ন, পাঞ্জাবি/লাহান্দা ১০০ মিলিয়ন প্রভৃতি।

অপরদিকে, ভাষা বৈচিত্র্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ওশেনিয়া অঞ্চলের পাপুয়া নিউগিনি। আয়তনে ৪৬২,৮৪০ বর্গ কিলোমিটার ও ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটির অধিবাসীরা কৃষি, বনায়ন ও মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির এই দেশটি, পৃথিবীর মোট ভাষার প্রায় ১২ শতাংশের মালিক, মোট ভাষার ৮৫৬টি। অর্থাৎ জনসংখ্যার হিসেব করলে প্রতি ৯,৩৪৫ জনের জন্য একটি করে ভিন্ন ভাষা রয়েছে দেশটিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৭,৮৪,০০০ জন বাস করে। বাংলাদেশের নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী ও আদিবাসী নেতাদের দেওয়া তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মোট ৪৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৪টি ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে ১২-১৮টি ভাষা বিভিন্ন মাত্রায় বিপন্ন। ঢাকায় অবস্থিত সরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) বাংলাসহ ৩৭টি ভাষা সংরক্ষণ ও সুসংবদ্ধ করার প্রকল্প হাতে নেয়। এদের মধ্যে আবার মাত্র কিছু জনগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি, বর্ণমালা রয়েছে- তন্মধ্যে তনচংগ্যা, মারমা, ম্রো, চাকমা, গারো, সাঁওতাল ও মণিপুরী ভাষা অন্যতম।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রামের বনভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসীদের বসবাস। এদের অর্ধেকের জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮% আদিবাসী শিশু প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাত্র ২% মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে, [উইকিপিডিয়া]। অধিকাংশ শিশু পাঠ্যপুস্তকের বাংলা লেখা ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পারে না। যথোপযুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতির অভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাড়ি , বনাই, ডলুই, রাজবংশী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষার বদলে বাংলার ব্যবহার শুরু করেছে।

তনচংগ্যা আমার মাতৃভাষাঃ

ভাষা মানুষের প্রথম পরিচয়, মানুষ তার মাতৃভাষায় নিজের মনের ভাব যতো না সহজে প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় এতটা সম্ভব নয়। আপনার মুখের ভাষা যেদিন হারিয়ে যাবে, সেদিন আপনার অস্তিত্ব নিভে যাবে। ভাষায় মানুষ প্রাণ এবং শ্বাসপ্রশ্বাস। জনসংখ্যায় বাংলাদেশে তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর অবস্থান চতুর্থ, যদিও সরকারি হিসাব মতে অনেক কম কিন্তু বেসরকারি ও এলাকাভিত্তিক তথ্যমতে বাংলাদেশের তনচংগ্যা প্রায় এক লাখের কম বা বেশি। তবে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে বলা যায় এখনো। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তনচংগ্যা জাতিরও নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালার লিপি আবিষ্কার হয়েছে খুব বেশি দিন হয় নি। তনচংগ্যা বর্ণমালার লিপির কথা যদি বলতে হয় তবে সর্বপ্রথম ড. রূপক দেবনাথের কাছে ঋণ স্বীকার কর�তে হবে। কেননা নতুন কোন কিছু আরম্ভ করতে গেলে অর্থ বিত্ত এবং শিক্ষা দরকার আছে, যেটা ড. রূপক দেবনাথ করতে পেরেছিলেন।

তনচংগ্যা বর্ণমালা কাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো বা কাদের প্রয়োজনীয়তা বেশী তা বোধগম্য ছিলো না। আর বর্ণমালা গুলি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বেশ গবেষণার। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। আর এ কঠিন কাজটি সহজ করে দিয়েছিলেন ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরেট অব ডিসটেন্স এডুকেশনের সহকারী পরিচালক গবেষক ও লেখক ড. রূপক দেবনাথ মহোদয়। যিনি তনচংগ্যা বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ চার্ট তৈরি করেছিলেন। যা এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার হাতে তিনি তুলে দেন। পরে আমেরিকা নাগরিক ড. জন কিফটন তনচংগ্যা বর্ণমালা কম্পিউটারে কাজ করার উপযোগী সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন।

তনচংগ্যা ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে অনেকে মনে করে থাকেন যে, তনচংগ্যা বর্ণমালার সাথে চাকমা বর্ণমালার নকল। সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে বলি, শুধু দুই জনগোষ্ঠী কেন? তনচংগ্যা, মারমা, চাকমার এ ত্রয়ী জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালার প্রায় অনেক লিপির মিল আছে দুই চারটা একটু এদিক ওদিক ছাড়া। তাছাড়া এক থাকারই কথা কারণ পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মঙ্গোলীয় এবং আরাকান হতে যাযাবরের মতো এ দেশ হতে অন্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, কিন্তু শেখড়ের জায়গা একটা আরাকান। আর সবকটি ভাষা ইন্দো-ইয়োরোপীয় শ্রেণীভুক্ত। অক্ষর মিল থাকলেও উচ্চারণগত বেশ তফাৎ আছে। এ বর্ণমালা মিলকরণের সাথে অনেকে আবার চাকমা ও তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। যা অযৌক্তিক এবং অবান্তর। ওদের যুক্তি ভাষা নাকি ৬০% মিলে বা এক। এখন রোহিঙ্গা (রোইয়াঙ্গা)দের অনেকে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করে কারণ তাদের ভাষাও বাংলা (চাঁটগাইয়া)। কিন্তু এটা একেবারেই খোঁড়া যুক্তি। কেননা ভাষা এক হলেই জাতি এক হয় না। এটা সত্য যে, ভাষা একটি জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম উপাদান কিন্তু একমাত্র ও প্রধান উপাদান নয়। এটার সাথে আরো একটা যুক্তি যায় কিনা, মারমা জনগোষ্ঠীর সাথে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু শব্দচয়ন বা কথার সুর মিলে যায় তবে কি আমি এই দুই জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলে আখ্যায়িত করবো? যুক্তির খাতিরে অনেক যুক্তি দাঁড় করানো যায়। এখন দরকার ভাষা রক্ষার এবং প্রচার ও প্রসারের। তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর সাথে চাকমা জনগোষ্ঠীর ভাষা ও বর্ণমালা প্রায় কাছাকাছি হওয়ার কিছু কারণ আছে তার ব্যাখ্যা এভাবে হতে পারে কিনা ভাবা যায় কী?

চাকমা জনগোষ্ঠী ভাষার সাথে তনচংগ্যা ভাষার তফাৎঃ

চাকমা ভাষা আর তনচংগ্যা ভাষা ইন্দো- আর্য ভাষা থেকে উদ্ভুত। [পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট- রাঙামাটি। সম্পাদনায় শুভ্রজ্যোতি চাকমা]
কিন্তু কিঞ্চিত পার্থক্য হয় এ জায়গায় “তনচংগ্যাদের ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা সম্ভূত বাংলার আদিরূপ। বহুপালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা পরিপূর্ণ। তবে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেছেন তনচংগ্যা ভাষা আর চাকমা ভাষার মিল বা ঘনিষ্ঠতা সমধিক। সংস্কৃতরূপ অপেক্ষা পালিরূপ তনচংগ্যা ভাষা নিকটতর।
[পহর জাঙাল, সম্পাদনায়- পলাশ তনচংগ্যা, চবি/২০০৩। “তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা রূপ প্রসঙ্গ- ড. মনিরুজ্জামান”, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ]
তনচংগ্যা ভাষা আর চাকমা ভাষার তুলনা বিশ্লেষণ-
চাকমা:—-তনচংগ্যা:—-মন্তব্য
– কুদু—-কুদি/কুরি—-উ/ই; দ/র।
– হিয়্যচ–খাইয়ৎ/খিয়ৎ—-ই/আই।
– বেই—-বা’ই/ভাই—-এ/আ; ব/ভ।
-বোন—-বইন/বোঞ—-ও/অই; ন/ ঞ।
– আগ—-আহ/ আয়—-গ/হ, য়।
– জিয়্যে—গিয়্যে——জ/গ।
এ পার্থক্য থেকে অনুমান করা যায়, তনচংগ্যা ভাষা ও চাকমা ভাষা একিশ্রেণী ভুক্ত ভাষার আদিরূপ হতে পারে; উচ্চারণ, শব্দতত্ত্বগত, ধ্বনিতত্ত্বগত তার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
তনচংগ্যাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে। মোট অক্ষর/বর্ণমালা আছে ৩৬ টি। তন্মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আর স্বরবর্ণ ৫ টি। এই বর্ণমালাতে নিজস্ব কার ফলা চিহ্ন আছে।
[চালৈন, রাঙামাটি/২০১৪ খ্রীঃ- সম্পাদনায় মিলিন্দ তনচংগ্যা। “তনচংগ্যা ভাষা, বর্ণমালা এবং ব্যাকরণ প্রসঙ্গ- লিখেছেন শ্রী: কর্মধন তনচংগ্যা,”]

অপরদিকে ভাষা বিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট এথনোলগ (Ethnologue) এর মতে, তনচংগ্যা ভাষা হলো ” ইন্দো-ইয়োরোপীয়, ইন্দো-ইরানীয়, ইন্দো-আরায়ান, ইয়েস্টার্ন আসামের শ্রেণীভুক্ত ভাষায় অন্তর্ভুক্ত।” যেটার তাদের কোড নাম্বার ISO:639-3 tnv. দেওয়া আছে। এই ওয়েবসাইট বলছে তনচংগ্যা ভাষায় প্রায় লাখের কাছাকাছি লোক কথা বলে এবং লোকেশন হিসেবে “রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উল্লেখ করেছিল। এথনোলগ এটাও উল্লেখ করেছে যে, চাকমা ভাষার সাথে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার (৫৮%-৬৭%) মিল আছে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখিত শ্রেণীর কথায় বলছে, উভয়ই একি পরিবারের শ্রেণীভুক্ত ভাষা কিন্তু সংস্কৃত রূপে সামান্য তারতম্য ঘটেছে।

আমার ভাষা কিভাবে সুরক্ষা পেতে পারে?

হাতিয়ার যেহেতু নিজের হাতে সেহেতু সেটা রক্ষা করার দায়িত্বটাও নিজের ওপর বর্তায়। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। অনেকেই বলে তনচংগ্যা ভাষা বাংলা ভাষার বিকৃতি রূপ। স্বাভাবিক, কারণ তনচংগ্যা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার বেশ মিল পাওয়া যায়। যেমন বাংলায় যা ভাত, তনচংগ্যারাও ভাত বলে। তদ্রুপ কলা, আলু, মুলা, নুন প্রভৃতি শব্দ। হয়তো নিশ্চয় এসব শব্দগুলির তনচংগ্যা শব্দ আছে অজানা কারণে আমাদের অগোচরে থেকেই গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন তনচংগ্যা পাড়ায় গেলে হয়তো তার সন্ধান মিলতে পারে। যদিও সেটা সময় সাপেক্ষ তবে অসম্ভব কিছুই নয়। ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বজাতের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ভূমিকাও রয়েছে। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে। এখানে রাষ্ট্র বলতে ভাষা ও সস্কৃতি রক্ষার্থে যেসব ইট পাথরের ভবন ও ব্যক্তি আছে তাদের বুঝানো হচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংবিধানের বিধান আছে, পাশাপাশি চুক্তির আইন আছে। কিংবা বৈশ্বিক পর্যায়ে কিছু পলিসি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ- এর ৩৩ নং ক্রমিকের খ(২) নং উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
তাই  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মাতৃভাষা সুরক্ষার জন্য অন্তত দুটি কাজ অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন। একটি হলো, প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত- প্রতিটি ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষণ ও চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
অপরদিকে আদিবাসী ভাষা সুরক্ষার তাগিদে ২০১৯ আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষ ঘোষণা করা হয় যার  উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীব্যাপী আদিবাসীদের ভাষা, বিশেষত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়ন, সমঝোতা, সুশাসন ও শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষা সংরক্ষণ ও ভাষাগুলোর উপর আসন্ন বিপদ ও ঝুঁকি মোকাবেলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দৃশ্যমান ও শক্তিশালী আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ আয়োজন করা আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষের উদ্দেশ্য।
বর্ষটি উদযাপনের জন্য নিম্নোক্ত তিনটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের ২০১০ সালের টেকসই উন্নয়ন আলোচ্যসূচি ও ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়ক হবে। বর্ষটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন আয়োজন আদিবাসী জনগণ, জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারী জনগণ এবং গণমাধ্যমের জন্য সহজলভ্য হবে।
ক. ভাষাগুলোর পুনরুজ্জীবন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও উপকরণ সৃষ্টি, বিস্তৃত ক্ষেত্রে সেবা প্রদান, ভাষার ব্যবহার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে সহায়তা করা। (সহায়তা)
খ. ভাষাগুলো সংরক্ষণ, আদিবাসী শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধদের জন্য তাদের ভাষায় তথ্য, জ্ঞান ও শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি, আহরিত তথ্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং তথ্য বিনিময়ের সুযোগ সহজলভ্য করা। (অবাধ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি)
গ. আদিবাসীদের আহরিত জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে এবং সেই সাথে তাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও ক্রীড়াকে বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্তৃত করা। (উন্নতি)

একইভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কিছু কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করলেও তা চলছে ঢিমেতালে। প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা হয়—প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো—এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাওঁ (কুড়ুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষায়ও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে এমনটা কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম এখনো আলোর মুখ দেখছে না।
সে অনুযায়ী আবার প্রথম পর্যায়ের পাঁচটি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। এ বছর ২০১৯ সালেও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ একই দেশে বাঙালি শিশুরা পড়াশোনা করছে চিরচেনা মায়ের ভাষায়। তাই সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকছে। বিষয়টা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, হাতিয়ার দিলাম কিন্তু হাতিয়ার চালনার জন্য যে নূন্যতম জ্ঞান দরকার সেটা দেওয়া হয় নি। মোদ্দা কথা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে আইন পলিসি আছে তা যথাযথ ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা পেতে পারে।
এতদঃ কিছুর পরেও নিজের ভাষা রক্ষার কাজে নিজেদেরকে সবার আগেই এগিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে পাড়ার ছোট ছোট শিশু কিশোর কিশোরীদের নিজের ভাষার বর্ণমালাগুলি পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেটা হতে পারে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক পর্যায়ে।

শেষের আগেঃ

জন্মের সময় আমি আমরা সবাই মায়ের মুখ থেকে মাতৃভাষায় সবকিছু শিখি, প্রকৃতির সাথে পরিচয় হই, ভূমির সাথে নিবিড় সম্পর্কে বড় হই। যখন শিক্ষালয়ে যায় তখন পরিচয় ঘটে দ্বিতীয় কোন রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে, সম্পূর্ণ নতুন চেহারায় নতুন ঢংয়ে। প্রয়োজনের তাগিদে তার দরকার আছে, শিখতে হয়। আর সেই প্রয়োজন ও শেখাটা যদি দৈনিক রুটিন কাজে রুটিরুজি হয়ে যায় তবেই গলদটা আরম্ভ হয়। ভাষা জানাটা অন্যায় কিছুই নয়, বরঞ্চ অহংকারের। তবে সেই অহংকার যেন নিজের মাতৃভাষার অপমানের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। মাতৃভাষার মধ্যে কথায় কথায় “বাংলা/ইংরেজি /চায়নিজ” প্রবেশ করার মধ্যে বুক ফুলানোর মতো কিছুই নেই।
একটা কঠিন কথা বলে লেখাটা ইতি টানবো, রাঙামাটিতে থাকা কালিন বহু তনচংগ্যা ব্যক্তিকে দেখেছি কথায় কথায় চাকমা ভাষার কথার টিউন টানে এমনকি স্বজাতি লোক কিংবা ঘরের লোকের সাথেও চাকমা ভাষায় কথা বলে। জানি সেটা লোকাল এবং কমন ভাষা, সেখানকার প্রেক্ষাপটে। তার মানে এ না যে, নিজের ভাষায় বিকৃতি আনবো, অসম্মান করব। হ্যাঁ স্পষ্টত অসম্মানই বলবো। কারণ নিজের ভাষা থাকতে তবে নিজের ঘরের বাচ্চার সাথে কেন অন্যের কমন ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করব? এটার মাধ্যমে নিজের ভাষা যেমন প্রকাশ পায় নি তেমনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাতৃভাষাটাকে বিকৃতি করা হয়েছে। এখন এরকম চর্চা যদি নিজের ঘরেই করা হয় তাহলে ঘরের বাচ্চা কী শিখছে সেটা কি কখনোই ভেবে দেখেছি? তবে কী নিরদ্বিধায় বলা যায় নিজের ঘর থেকেই মাতৃভাষার মৃত্যুর ঘন্টা বাজা আরম্ভ হয়েছে।
জানা আছে, নেপোলিয়ন বলেছিলেন – “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটা শিক্ষিত জাতি দেবো”। তাঁর উক্তির সম্মান রেখে যদি বলি “আমাকে একটা নিজের স্বজাতের মা দাও, আমি স্বজাতের মাতৃভাষা রক্ষা করার মানুষ দেবো”। যেখানে ১৬ কোটি বাংলা ভাষাভাষী লোকেরা বাংলা ভাষা হারানোর ভয়ে থাকে সেখানে লাখের মতো তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর মামুলি ব্যাপার মাত্র। ভাষা হারিয়ে যাওয়ার পিছনে রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অযত্ন যেমন আছে তেমনি আমাদের নিজেদের অবহেলা আছে। সেক্ষেত্রে বিজাতি বিবাহ করণকে আমি নিরুৎসাহিত করব। বৈচিত্র�্যটার নামে আমি ভাষা, সংস্কৃতির আগ্রাসন চাই না।

©মিলিন্দ তনচংগ্যা।
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক “চালৈন প্রকাশনা পর্ষদ, রাঙামাটি”
-সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।