লেখকঃ শ্রীমৎ ড. জিনবোধি ভিক্ষু
চৈত্যভূমি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে স্বল্প সংখ্যা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলার বৌদ্ধ সমাজ গঠিত। এই বৌদ্ধ সমাজের জন্যই বাংলায় তথা ভারত বৌদ্ধ ধর্মের শিখা নি:শেষের নির্বাপতি হই নাই, বৌদ্ধত্বের ধারা বিলুপ্ত হয় নাই। তা নির্বানোন্মুখ দীপ শিখার মত ক্ষীণ হয়েও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের বিজয় কেতন উড্ডীন রয়েছে। বঙ্গ দেশের চট্টগ্রাম জেলায় বাঙালি বৌদ্ধদের বসবাস কিন্তু পার্বত্য বৌদ্ধরাও এক সময়ে চট্টগ্রামের কয়েক এলাকায় দীর্ঘকাল ছিলেন। কালের বিবর্তনে তারা ক্রমান্বয়ে সমতল ভূমি ছেড়ে পাহাড়ী এলাকায় চলে যায়। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের মোট বারটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায়অ তাঁরা হলেন (১) চাকমা, (২) মারমা, (৩) ত্রিপুরা, (৪) তঞ্চঙ্গ্যা, (৫) ম্রো, (৬) বম, (৭) উচই, (৮) পাংখোয়া, (৯) খিয়াং, (১০) খুমী, (১১) লুসাই এবং (১২) চাক। এরা সবাই স্থানীয় বৌদ্ধ নামে পরিচয় হলেও কিছু কিছু হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচয় দিতে দেখা যায়। এত সব সত্ত্বেও পার্বত্য জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বারটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর প্রভাব প্রতিপত্তি তুলনামূলক একটু বেশি। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় চেতনায় এই দু’জনগোষ্ঠীর পরিচিতির ব্যাপকতা দেখা যায়। চাকমারা- তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়কে চাকমা জাতির একটি শাখা মনে করলেও তঞ্চঙ্গ্যাদিগকেই তারা মূল বা আসল চাকমা বলেও স্বীকার করেন। বর্তমানে দৈংনাক, তৈনটংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামধেয় একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীকেই উপরোক্ত তিন নামে নির্দেশ করা হয়েছে। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ এবং ভারতে তৈনচংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত এবং আরাকান তথা মায়ানমারে দৈংনাক নামে পরিচিত। বঙ্গ দেশে যে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে- তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানাধীন রইস্যাবিলি এলাকায়, কক্সবাজার জেলায় উখিয়া ও টেকনাফে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস। তাছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, অরুনাচল, মিজোরাম ও মুনিপুরের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস আছে। আরাকান তথা মায়ানমারেরই তঞ্চঙ্গ্যাদের সংখ্যা সমধিক। তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্বমোট জনসংখ্যা চারি লক্ষাধিক বলে জানা যায়।
আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য আদিবাসী মংগোলীয় জনগোষ্ঠীর ন্যায় তঞ্চঙ্গ্যাগণও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার (মংগোলীয়) জনগোষ্ঠীর দলভূক্ত। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা অন্তর্গত পালি, প্রাকৃত সম্ভুত, বাংলাভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, পোষাক পরিচ্ছদ, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির পার্থক্য হেতু একই জনগোষ্ঠীর লোককে পৃথক সত্ত্বার অধিকারী বলে বিবেচনা করা হয়।পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর অগ্রসর আদিবাসীর ন্যায় শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। পার্বত্য সমগোত্রীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় অআদিবাসী এমনকি বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যাগণ দীর্ঘকাল সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। বর্তমান অভিসন্দর্ভে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবদান সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস।
চৈত্যভূমি চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। এরই প্রভাব পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত জন সাধারণকেও সমানভাবে প্রভাবিত করে ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ তারাও স্মরণাতীত কাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী ছিলেন। প্রাচীনকালে ভারতে এবং মায়ানমার অবস্থানকালীন সময়ে তাঁরা প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্বানুভব করতেন।
১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগলদের হাতে আরাকান রাজা পরাজিত হলে চট্টগামের রাজত্ব স্থায়ীভাবে মোগল সম্রাটদের হাতে চলে যায়। মুসলিম অধিকারের পর থেকে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্যবাসীদের বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শ সমূহ অনেক ধ্বংস হতে থাকে । এক সময় ভারতবর্ষ হতে বিতাড়িত হয়ে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধদের যে অংশ চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তা ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে একের পর এক বিভিন্ন আঘাতে বিলুপ্ত হতে বসেছিল। সেই অন্ধকার যুগে বৌদ্ধরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত ছিল। আত্মত্যাগী মহান ভিক্ষু সংঘ ও বৌদ্ধ বিহার বিলুপ্তিতে বৌদ্ধরা ভুলে যায় প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতি ও দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
ক্রমে এক সময় বৌদ্ধরা ভুলে যায় বুদ্ধের প্রকৃত ধর্ম ও বিষয় থের ধর্ম। ভুলে যায় মহাযান সহ যাবতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য বা সংস্কার। শুধুমাত্র রয়ে গিয়েছিল একটুকরো গেরুয়া বসন। তা দিয়েই তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম ও পূজা পার্বন সম্পাদন করত। তখন তাদের রাউলী নামে ডাকা হত। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শ্বাস্ত্রী তার লেখায় উল্লেখ করেছেন- “বাংলার অর্ধেক মুসলমান হয়ে গেল এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরণাগত হল আর বৌদ্ধদের মধ্যে যারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হতেই তাদের উপরে নির্যাতন উপস্থিত হল। মুসলমান অধিকারের পর নতুন সমাজে যারা অনাচারীয় হল, বৌদ্ধধর্ম তাদের মধ্যে নিবন্ধ হয়ে পড়ল এবং তারা ক্রমে প্রজ্ঞা, উপায় ও বৌধিসত্ব ভুলে গেলে শূণ্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ ও করুনাবাদ, তখনই রইল জনাকয়েক মুর্খ ভিক্ষু নামধারী বিবাহিত পুরোহিত। তারা অপরাপর মত করে বৌদ্ধধর্ম গড়ে নিল”। (বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম রচনা সংগ্রহ, ৩য় খন্ড পৃ:৩৯৪)
এ সময় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজে ‘মঘাখমুর্জা’ নামক এক প্রকার ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে রাউলীগণ ধর্মীয় কজ পরিচালনা করতেন (চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম- ভিক্ষু শীলা চার শাস্ত্রী, পৃ:২০)। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিয়ের ঘটকালি থেকে যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতেন এবং ভিক্ষাপাত্র। পিণ্ডাচরণ, পবিত্র ভিক্ষু পরিবাস প্রত ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিলনা (চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাগুপ্ত:পৃ২৫) অন্যদিকে বৌদ্ধ গৃহী সমাজে কালিপূজা, দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, কার্ত্তিকপূজা, শনিপূজা ইত্যাদি হিন্দু ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে প্রচলিত ছিল। আবার মুসলমানদের মানিকপুরের সিন্নি, সত্যপীরের সিন্নী, বদর সাহেবের সিন্নী, সিজির সিন্নী ইত্যাদি অনুষ্ঠানও বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ গৃহিরা তথন এরূপ অবৌদ্ধ সম্মত অবস্থার মধ্যে না হিন্দু না বৌদ্ধ না মুসলমান হয়ে জীবন যাপন করেছিলেন।
১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মরাজ বগিড় ও ব্রিটিশ পক্ষের মধ্যে ‘য্যান্ডেরো সন্ধির’ ফলে আরাকান ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সরকারের অধীনস্থ হয়। তখন এ সময় আরাকান ও বাংলাদেশ একই সরকার শাসিত হওয়ার এবং যাতায়াতের সুবিধা থাকায় আরাকানীরা ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে আগমন করতেন। এ সময় আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মাঝে মধ্যে চট্টগ্রামে আগমন করতেন। এ সময় আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মাঝে মধ্যে চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও উত্তরে আরাকানী বংশোদ্ভুত বোমাং ও মান সম্প্রদায়ভূক্ত বৌদ্ধদের নিকট উপস্থিত হয়ে ধর্ম প্রচার করতেন। তখন বড়ুয়া ও চাকমা সমাজের ধর্মগুরু ছিলেন তখনকার তান্ত্রিক রাউলী সম্প্রদায়। আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংস্পর্শে এসে রাউলী পুরোহিত পোশাক পরিচ্ছদ ও আচার অনুষ্ঠানের কিছু পরিবর্তন হলেও উপসম্পদায় বয়স ও ধর্ম বিনয় সম্পর্কে তখনও তাদের কোন ধারণা ছিলনা। তার বিকেলে ভাত ব্যতীত অন্য পানাহার করতেন।
বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধদের যখন এ অবস্থা চলছিল এমন সময় এদেশে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হারাবাং এলাকায় বরেণ্য পূণ্য পুরুষ থেরবাদী মূল ধারার প্রাপ্ত ভিক্ষু সারমেধ মহাস্থবিরের আগমন ঘটে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। বঙ্গীয় বৌদ্ধ ও পার্বত্য বৌদ্ধদের মোহ মুক্তির শতাব্দী হিসেবে প্রতিভাত হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের চৈত্র মাসে জ্ঞান তাপস সারমেধ মহাস্থবির সশিষ্য তীর্থ ভ্রমণ উপলক্ষ্যে ঐতিহাসিক সিতাকুণ্ড আগমন করেন। তখন বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের পূণ্যপুরুষ প্রখ্যাত সংঘমনীষী শ্রীমৎ রাধাচরণ মহাস্থবিরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, মহা পণ্ডিত শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবির সদলবলে রাধাচরণ মহাস্থবিরের সাথে সীতাকুণ্ড হতে চক্রসালা হয়ে, বৈদ্যপাড়া শাক্যমুনি বিহার, ঠেগরপুনি বুড়াগোঁসাই মন্দির হয়ে রাউজান মহামুনি মন্দির তখন মেলায় উপনীত হন। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তীতে মহামুনি মেলা ও মহামুনি মন্দির তখন থেকে বাঙ্গালি বড়ুয়া, পার্বত্য এলাকার চাকমা, বোমাং, মগ তঞ্চঙ্গ্যাসহ সকল বৌদ্ধদের একটি মিলন তীর্থ ছিল। এ মহাসমাবেশে তিনি বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন ও ধর্ম বিনয় বিষয়ে আলোচনা করতেন। অসংখ্য ধর্মানুরাগী ভক্ত পূজারীবৃন্দ তাঁর অমৃতময় ধর্মবাণী শ্রবনে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাউলী পুরোহিত নামে পরিচিত ধর্মীয় গুরুরা তাঁর সান্নিধ্যে বুদ্ধের প্রকৃত ধর্ম বিনয় সম্পর্কে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনেকটা সংশোধানের পথটা বেছে নেন। তখন থেকে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বাসীদের মধ্যে নতুন করে ধর্মীয় জাগরণ দেখা দেয়। তিনি ক্রমাগত দু’বছর অবস্থান করে তৎকালীন বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধ ভক্তি, বিশেষতঃ মহাযান পন্থী তান্ত্রিক মতের অসারতা, দেবদেবীর পূজা, পশুবলি, মিথ্যা দৃষ্টি ইত্যাদি যে অবৌদ্ধ উচিত কার্যকলাপ তা সরল ভাষায় বুঝিয়ে দেন এবং থেরবাদী বৌদ্ধের্র্মের মৌলিক রীতিনীতি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা তুলে ধরেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে রাঙ্গুনীয়া রাজবাড়ী রাজানগরে রাজকীয় পূন্যাহ উপলক্ষে চাকমা সার্কেলের রাজামাতা রানী কালিন্দী মহামন্ডিত শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবিরের চট্টগ্রামে আগমন, বুদ্ধের ও সধর্মবাণীর প্রচারের শুভ সংবাদ শুনে তাকে আমন্ত্রণ পূর্বক রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন রাজ পরিবারের সকল সদস্য ও জনগণ তাঁর মুখ নিঃশ্রিত ধর্ম বাণী শ্রবণে মুগ্ধ হন। তাঁর সম্মানে রাণী আরাকানী ভাষায় উপাধিযুক্ত সীলমোহর প্রদান করেন। তার নিকট বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে আরেক নব ইতিহাসের শুভ সূচনা করে সমগ্র পার্বত্য বাসীদের মধ্যে বিরাট সাড়া জাগায়। আরো উল্লেখ্য যে, ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সাতজন রাউলী পুরোহিতদেরকে ভিত্তি করে সর্ব প্রথম বিনয় সম্মত থেরবাদী আদর্শে হাঞ্চার ঘোনার উপক সীমায় মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের নেতৃত্বে পুনরায় শুভ উপম্পাদা প্রদান করা হয় যা বঙ্গীয় বৌদ্ধসমাজের ইতিহাসে নতুন করে আবার বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া পত্তন করা হয় । তারা হলেন (১) পাহাড়তলী গ্রামের শ্রদ্ধেয় জ্ঞানলঙ্কার মহাস্থবির, (২) ধর্ম পুরের হরি মহাস্থবির, (৩) মির্জাপুরের সুবর্ণ মহাস্থবির, (৪) গুমান-মর্দনের দুর্রাজ মহাস্থবির, (৫) বিনাজুরীর হরি মহাস্থবির, (৬) পাহাড়তলীর কমল ঠাকুর এবং (৭) দমদমার অভয়াচরণ মহাস্থবির। এদের আত্মত্যাগ এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শে সমগ্র চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশেষত উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজের প্রতিথ যখা মহান ভিক্ষু সংঘের প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মীয় জাগরণটা তড়ান্বিত হয়।
পার্বত্য এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীরা ধর্মীয় দিক দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও সনাতন প্রথা মতে এদের অনেকে গাঙপূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, বিত্তিনী পূজা, লক্ষীপূজা, কে পূজা, বুর পাড়া ইত্যাদির দেব-দেবীর পূজা করতে দেখা যায়। অবশ্য উপরোক্ত পূজা সমূহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে করা হয় না। ঐসব পূজা কেবলমাত্র দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধান করে অনুষ্ঠিত হয় উক্ত পূজা সমূহ সম্পাদনের জন্য সমাজের এক শ্রেণীর লোক আছে তাদেরকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বৈদ্য বলা হয় (তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। ১৯৯৫ পৃ:৫২)।
ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান এক নহে।কারণ সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বৈষায়িক বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল অপর দিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় চেতনায় ধীরে ধীরে গাঢ় হলে সেই চেতনাকে লালন করে প্রাচীন সামাজিক অনুষ্ঠানাদির সংস্কার সাধিত হয় এমন কি কুসংস্কার বলে সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিদায় দেয়া হয়। যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করে, সমাজকে ধারণ করে সুন্দর ও মহান করে তোলে, আদি মধ্যে ও অন্তে কল্যাণ এনে দেয় সেই বৌদ্ধধর্মই তঞ্চঙ্গ্যাদের ধর্ম। কাজেই বুদ্ধপূজা, সংঘদান, সূত্রশ্রবণ, অষ্ট পরিষ্কার দান, প্রবারণা পূর্ণিমা, কঠিন চীবরদান, মাঘী পূণিমায় বহুচক্র মেলা ফালগুনী পূর্ণিমায় জ্ঞাতি সম্মেলন প্রভৃতি প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে উৎসব করা হয়ে থাকে। অধুনা লাভী শ্রেষ্ঠ অরহত সীবলী মহাস্থবিরের পূজাও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সম্পন্ন করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রত্যেক গ্রামে মনোরম ক্যাং বা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত দেখা যায় (তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি: প্রাপ্ত পৃ:৫৫)
তঞ্চঙ্গ্যারা প্রধানত কৃষি নির্ভর হলোও ইদানিং শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতিতে অনেকটা অগ্রগতি লাভ করেছে। ধর্মীয় চেতনার দিক থেকে তারা বর্তমান অনেকটা উন্নত এবং অতীতের অনেক কুসংস্কার মুক্ত বলা যায়। তারা পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়, কষ্টসহিষ্ণু, আত্মশক্তির উপর নির্ভরশীল, ধৈর্যশীল, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বন্ধুবৎসল এবং কর্মে একনিষ্ঠ বলেই দ্রুত অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মূলে ভিক্ষু সংঘ এবং গৃহীসংঘের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল অতুলনীয়। বর্তমান তঞ্ঙ্গ্যাগণ আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি, বৃত্তি মূলক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইন, প্রশাসন, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভৃতি সর্ব বিষয়ে শিক্ষা লাভের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন এটা জাতির জন্য শুভ সংবাদ বলা যায়।
ধর্মীয় সামাজিক ও আধুনিক শিক্ষার অগ্রগতিতে তাদের অবদান ছিল সর্বাগ্রে। তাদের সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করি। পার্বত্য এলাকায় সদ্ধর্মের পুনরুদ্ধাত্থান শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দির মাঝা-মাঝি কাল হতে। প্রথমত: রাজকীয় প্রভাব, দ্বিতীয়ত: আত্মত্যাগী ধর্মীয় গুরুদের প্রভাব এবং সাধারণ গৃহীদের আত্মসচেতনতা। বিশেষত: আধুনিক শিক্ষ ও ধর্মীয় অনুরাগ আজ অতটুকু অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি বলা যায়।
ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়- শ্রীমৎ বরমিত্র ভিক্ষু চাকমা সমাজ হতে চাকমা রাজা হরিল চন্দ্র’র (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে) রাজগুরুর আসন অলংকৃত করেন। এরপর শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু, শ্রীমৎ কালাচোখা ঠাকুর (জ্ঞানরত্ন ভিক্ষু), শ্রীমৎ পালক ধন ভিক্ষু এবং শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরের (পালকধন তনচংগ্যা একজন বৌদ্ধ সাধক ও ধর্মপ্রচারক। ১৮৭৯ সালে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ/রাঙামাটি) কোন এক তনচংগ্যা পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। উইকিপিডিয়ায়য় ও চিত্রশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার লেখা “তঞ্চঙ্গ্যা জাতি” বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে সে তনচংগ্যা ১২ টি গছার মধ্যে “কার’অয়া” গছার অন্তর্ভুক্ত। খুব ছোটকালে পালকধনের মা মারা যাওয়ায় তিনি এক চাকমা পরিবারে কৈশোরকাল বেড়ে ওঠেন। সেই পরিবারই তাঁর নাম পালকধন তনচংগ্যা রেখে দেয়। তিনি তনচংগ্যা সমাজের প্রথম বৌদ্ধসাধক (Monk)। উনিশ শতকে বৌদ্ধশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনার জন্য শ্রীলংকা পাড়ি জমান। তিনি থেরবাদী বুড্ডিজম নিয়ে পড়াশুনা করেন। পরে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নব্য বৌদ্ধ সাধক হয়ে উঠেন। পালকধন বৌদ্ধশাস্ত্র পাশাপাশি, সাধারণ বিদ্যাশিক্ষা নিয়েও বেশ মেধাবী ছিলেন। বৌদ্ধসাধক হিসেবে তাঁর নাম হয় “প্রিয়রত্ন মহাথের”। যা পরে এ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত হন।
১৯৩৫ সালে চাকমা রাজা ভূবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর রাজপুত্র নলিনাক্ষ রায় রাজা হন এবং প্রিয়রত্নকে রাজকীয় কুলপতি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এবং পরে চাকমা রাজগুরু উপাধিতে ভূষিত হন। যখন তিনি রাজা ছিলেন, হিন্দু নিয়মগুলো চলমান থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে লুরির চেয়ে সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের সংখ্যা কম ছিল। লুরিরা মূলত ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে আসা ধর্ম প্রচারক। তাদের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ মানুষের মতোই, স্ত্রী–সন্তানসহ বাস করতো। অ–বৌদ্ধীয় শাসকের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তারা সন্ন্যাসীতে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের আচার–নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতিত রূপ সম্ভবত তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করত। তাদের বক্তব্য বা লেখ্যগুলো মূল বৌদ্ধ ধর্মের বক্তব্য বা লেখ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্যহীন ছিল। চাকমা রানী বিনতা রায় হিন্দু ছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের আচার–অনুষ্ঠান পালন করতেন। সমগ্র রাজবাড়িতে সনাতন ধর্মের পূজা করা হত। হিন্দু ধর্মের আচার শক্তভাবে পালন করার কারণে শ্রদ্ধেয় ভান্তে এখানে ভালোমতো বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ করতে পারেননি।) প্রমূখ সাংঘিক ব্যক্তিত্বদের প্রচুর খ্যাতি রেখেছিলেন। তাদের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে যাদের অবদান ছিল তাঁরা হলেন রাজগুরু অধ্যাপক শ্রীমৎ ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির রাজগুরু, শ্রীমৎ ধর্মরত্ন মহাস্থবির এবং দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, উপ-সংঘরাজ শ্রীমৎ সুগতবংশ মহাস্থবির, ভদন্ত চিত্তানন্দ মহাথেরো (১৯১১-১৯৯৩) অন্যতম (গৃহীর নাম যতীন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগেংখুলী শ্রী জয় চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, উপসম্পদার নাম: চিত্তানন্দ ভিক্ষু ।তিনি প্রত্যক্ষভাবে নিজগ্রাম মানিকছড়ি ও অগোইয়াছড়ি নামক দুটো স্থানে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা ও অগ্রনী ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন ‘পার্বত্য ভিক্ষু সমিতি’ (বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এবং অর্থ সম্পাদক পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চিত্তানন্দ মহোদয় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের ও জিনবংশ মহাথের কর্তৃক লিখিত গ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, পরম শ্রদ্ধেয় ভান্তের নামকরণে জগনাতলী চিত্তানন্দ পালি কলেজ, নানিয়াচর চিত্তানন্দ পালি কলেজ, ঝগড়াবিল রাঙ্গামাটি রয়েছে। তিনি রাঙ্গামাটি সদরস্থ ত্রিরত্নাঙ্কুর বৌদ্ধ বিহারে ১৯৯৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)
বিংশ শতাব্দির শ্রীমৎ বিমলানন্দ মহাস্থবির আগরতারা অনুবাদ করার কঠিন কাজে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু আশানুরূপ সফল হতে না পারলেও ঐ সময়ে কালে তার অবদান কোন অংশে কম ছিলনা। এরই মধ্যে তাদের অর্ধকর্ষিত ভূমিতে জ্ঞানের মশাল এবং ধর্মীয় ধ্বজা নিয়ে নামলেন পার্বত্য এলাকার প্রবাদ প্রতীম সংঘ মনীষী রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, ১৯১৩-২০০৮)। তিনি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দশ বৎসর যাবৎ বার্মা দেশে বুদ্ধের ধর্ম বিনয় এবং ত্রিপিটক বৌদ্ধ সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করে ষষ্ঠ বৌদ্ধ মহাসঙ্গতির করণীয় দায়িত্ব শেষ করে জন্মভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনিই একমাত্র বৌদ্ধ মনীষী যিনি মহাসংগীতিকারকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থান থেকে এই মহতি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর এই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজন কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপণ্ডিত’ উপাধিতে সমানিত করেন। ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক ‘অগ্গামহাসধোম্মজ্যোতিকাধ্বজ’ উপাধি ভূষিত হন। এই সব উপাধি আমাদের বৌদ্ধ সমাজের জন্য বিরল। ত্রিদিব রায় তাকেঁ রাজগুরু পদে বরণ করে নেন। আর তিনি পার্বত্য জাতির মধ্যে সদ্ধর্মের আলো তুলে দিতে আত্মোৎসর্গ করলেন নিজেকে। তাঁর বাল্য জীবনের পথ পরিবর্তনে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ছিলেন তাঁরা রাঙ্গুনীয় ঘাটচেক গ্রামের সাংঘিক পুরোধা শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবির এবং সাধক পুরুষ শ্রীমৎ আনন্দিত মিত্র মহাস্থবির। তৎকালীন বার্মাদেশ থেকে ত্রিপিটক শাস্ত্রে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করা কম গৌরবের বিষয় নয়। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বরেণ্যে এবং আলোকিত গর্বিত রত্ন সন্তান। তারই পাশাপাশি ছিলেন উপ-সংঘরাজ শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির। যার আন্তরিক সহযোগীতায় অনেক ভিক্ষু শ্রামণ আধুনিক শিক্ষায় আলো পেয়ে সমাজ ও ধর্মের উন্নয়নে অনেক কাজ করে চলেছেন। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির প্রথম কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিতি এবং পার্বত্য চট্টল ভিক্ষু সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ভিক্ষু এবং গৃহী সমাজকে একত্রিত করে স্বজাতির সামগ্রিক কল্যাণে হাত দিয়ে আজ সমগ্র জাতি এর সুফল ভোগ করে চলেছে। তিনি প্রায় ৬টির অধিক বাংলা, চাকমা ও ইংরেজী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে সমাজকে উপহার দিয়েছেন। সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় জাগরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে অগ্রনী। তাঁরই পাশাপাশি তাদেঁর আগে পূণ্য পুরুষ শ্রীমৎ তিষ্য মহাস্থবিরের নাম জানা যায়। যিনি রাজগুরু অগ্রবংশে গুরু ছিলেন। অত্র এলাকায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি তিনি পরিচালনা করতেন। তিনি প্রাচীন ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে অন্যতম ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। বুদ্ধশাসনে আরেক পুণ্য পুরুষ শ্রদ্ধেয় শীমৎ সাধনা নন্দ মহাস্থবিরকে উপাসম্পদা দীক্ষা দেন শ্রীমৎ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর সংঘপুরোধাদের মধ্যে যাদেঁর অবদান চিরস্মরনীয় তাঁরা হলেন ভদন্ত আচারনন্দ মহাস্থবির (১৯৩৭-২০০৫), যিনি বৌদ্ধ দেশ- শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘকাল ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে সমাজ ও স্বধর্ম সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ধুতাঙ্গ ব্রতধারী শাস্ত্র পণ্ডিত শ্রীমৎ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির- গৃহিনাম তেজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা প্রতিরূপ দেশ বার্মঅয় গিয়ে ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন পূর্বক স্বদেশে এসে সদ্ধর্মের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে কীর্তিময় কাজ হলো ত্রিপিটক শাস্ত্রের অভিধর্ম পিটকের গভীরত্ব বিষয়ক কয়েক গ্রন্থ অনুবাদ করেন যা অত্যন্ত জতিল বিসয়। তন্মধ্যে (১) শাতিকাধাতু-কথা স্বরূপিনী (১৯৯৯) (২) অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরুপিনী(১৯৯৩)- (৩) যমক স্বরুপিনী(২০০০), (৪) অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গঁ প্রকরণ (২০০৩) (৫) বুদ্ধ প্র্রকাশনী (২০০১), (৬) পথ প্রদর্শন (১৯৯৮), (৭) চলার পথে(২০০০) তাছাড়াও তিনি বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠা সংস্কার ও সংরক্ষণ করে সামাজিকভাবে অনেক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ওয়াগ্গান জন কল্যাণ বৌদ্ধ বিহারের পরলোকগত আগ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন।
শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি মহাস্থবির ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা ভিক্ষু শ্রীমৎ জিতানন্দ মহাস্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত হয়ে সেই বছরই পাঁচ মাস পরে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের সান্নিধ্যে শুভ উপসম্পাদা গ্রহণ করেন। সেই থেকে দীর্ঘ একুশ বছর রাজস্থলী মৈত্রী বিহারের অধ্যক্ষ পদের নিষ্ঠার সাথে যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি পরিচালনা করে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তাছাড়া ভিক্ষু সমিতি ও অনাথালয়ের দায়িত্ব ও নিষ্ঠার সাথ পালন করেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যাদের একজন বরেণ্যে ভিক্ষু ছিলেন।
শ্রীমৎ আর্যানন্দ মহাস্থবির একজন কর্মবীর এবং তঞ্চঙ্গ্যা বংশের কৃতি ভিক্ষু ছিলেন, তিনি অত্র সমাজ ও সদ্ধর্মের কল্যাণে বহু সেবামূলক সংস্থার জন্ম দেন। যথাক্রমে (১)আর্যানন্দ পালি কলেজ (স্থাপিত ১৯৯২), (২) রাঙ্গুনীয় অগ্রবংশ শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, (৩) ত্রিরত্ন ভিক্ষু এসাসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাছাড়াও তিনি অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত থেকে শাসন সদ্ধর্মের অগ্রগতিতে যথেষ্ঠ কাজ করে গেছেন। তিনি শ্রীমৎ হেমাঙ্কর মহাস্থবিরের শিষ্য ছিলেন। শ্রীমৎ জ্যোতি প্রিয় অত্র এলাকার উদীয়মান ভিক্ষু হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি পার্বত্য কিষু সংঘের থানা শাখার সভাপতি এবং রাজগুরু অগ্রবংশ শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিলাইছড়ি থানা সদরে প্রতিষ্ঠিত ধুপ্যাচড় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। প্রয়াত শ্রীমৎ অনুরুদ্ধ স্থবির দীর্ঘকাল নারইখ্যা পাড়া সদ্ধর্মদ্ধয় বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান করে অত্র এলাকার জন সাধারণের মধ্যে ধর্মীয় পরিবেশ ও শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেন। তিনি অত্র বিহারেই দেহত্যাগ করেন। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরে জনপদের কুতুবদিয়া বিহারের শ্রীমৎ অজিতা স্থবির অল্প বয়স থেকে ধ্যান ভান্তে নামে পরিচিত। বর্তমানে তিনি গভীর জঙ্গলে অবস্থান করছেন। শ্রীমৎ নন্দীয় স্থবির কাউখালী খোয়াপাড়া বিহারে অধ্যক্ষ এবং খোয়াপাড়া চন্দ্রবংশ শিশু সদনের পরিচালক হিসেবে শিশু কিশোরদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার সুব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবির তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বরেণ্যে ভিক্ষু। তিনি ত্রিরত্ন ভিক্ষু সমিতিরি প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এবং বর্তমানে সভাপতির এবং রাজস্থলী বৌদ্ধ শিশু সদনের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এবং আর্যনন্দ পালি কলেজের সভাপতির ও দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীমৎ অগগ্রশ্রী ভিক্ষু অধ্যক্ষ পাগলাছড়ি সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার রোয়াংছড়ি, বান্দরবান। তিনি সাধারণ সম্পাদক ও পরিচালক অনাথ বন্ধু অনুরুদ্ধ শিশু সদনের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সুমেধানন্দ ভিক্ষু-ভিক্ষু সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ধর্ম দেশনার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট পাণ্ডিত্য স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। তিনি রমতিয়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ্য। তরুণ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ রাজগুরু অগ্রবংম মহাস্থবিরের প্রিয়তম শিষ্য। তিনিও অধুনা থাইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় রত।
তাছাড়াও আরো বহু শ্রামণ শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে অধ্যয়নরত আছেন। আশাকরি ভবিষ্যতে অত্র এলাকার শিক্ষা সাংস্কৃতির পাশাপাশি প্রচার ও প্রসারের বিশেষ বৌদ্ধের থেরবাদী মূল ধারাকে উজ্জীবিত করতে এগিয়ে আসবেন। আর কিছু দায়ক দায়িকা আছেন বিশেষ করে বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য প্রসন্নকান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা ও ওয়াগ্গার হেডম্যান পরিবার তাঁরা সদ্ধর্ম পালনে ও প্রচারে সমাজ ও জাতিকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। বলা যায় তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ইদানিং শিক্ষা-দীক্ষায় আশানুরূপ উন্নতি দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে সমাজ ও সদ্ধর্মের ক্ষেত্রে আরো অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে, তাঁরা অত্যন্ত পরিশ্রমী কষ্টসহিষ্ণু, অধ্যবসায়ী, আত্মশক্তির উপর নির্ভরশীল ধৈর্যশীল, পরস্পরের প্রতি আত্মবিশ্বাস, শ্রদ্ধাশীল ও বন্ধুবৎসল এবং কর্মে একনিষ্ঠ। বিশেষত তরুণ-তরুণী এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটি সুমধুর সম্পর্ক পরিপক্ষিত এগুলো এক জাতির সার্বিক উন্নয়নের শুভ লক্ষণ মনে হয়। উপরোক্ত বিষয়াবলী প্রকৃত বুদ্ধের শিক্ষা। এই চেতনায় অটুট থাকলে যে কোন জাতির অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী।
(সংক্ষেপিত এবং সম্পাদিত)
সহায়ক গ্রন্থঃ
১. শ্রীমৎ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবীর জীবন ও ধর্ম-শ্রীমৎ ড. জিনবোধি ভিক্ষু
২. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি-শ্রীমান বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা
৩. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- শ্রীমান রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা
৪. পহর জাঙাল- তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক বিষয়ক প্রকাশনা।