তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন এবং সংস্কৃতি

কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সুপ্রচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তনচংগ্যাদের বসবাস রয়েছে। এই বসবাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বটে। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যারা দাইনাক নামে পরিচিত। এই দাইনাক/দৈনাক শব্দটি একটি ঐতিহাসিক শব্দ, যার অর্থ যোদ্ধা। ঐতিহাসিকভাবে তঞ্চঙ্গ্যারা যুদ্ধজাতি হিসেবে পরিচিত। ভারতে নানা প্রদেশে, অঞ্চল বিশেষে তারা তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা এবং চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত। তনচংগ্যারা তিবেতো-বর্মন-ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠীভুক্ত, যদিও বর্তমানে তাদের ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার অর্ন্তভুক্ত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান বসতি। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় রাঙ্গুনীয়া উপজেলার উত্তরা-পূর্বাংশে এবং কক্রবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের বসতি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ(সিএডিসি) অঞ্চলে তাদের প্রধান বসতি। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের মূল বসতি বর্তমানে আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কলদান নদীমুখ অবদি। তাছাড়া বসতি রয়েছে আরাকানের ভুসিডং,রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে, মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়। তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলা নববর্ষ বা বিষু হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এর পাশাপাশি ধর্মীয় নানা পূজা-পার্বনও তারা পালন করে থাকে। 

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সুদীর্ঘকালের যে ইতিহাস সেটি শুরু হয় মায়ানমারে আরাকান প্রদেশ/রাজ্য থেকে। যেখানে দান্যায়াদি নামে একটি ঐতিহাসিক স্বাধীন রাজ্যের গড়া পত্তন হয়। মূলতঃ দাইনাক বা দৈনাক থেকে দান্যায়াদি নামের ঊৎপত্তি। বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান বা দান্যায়াদিতে দাইনাক বা দৈনাক নামে বসবাস করে যা এখনো বর্তমান। ইতিহাস বলে তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে প্রথমে বান্দরবান জেলায় আলিকদম উপজেলায় তৈনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয় এই তৈনছড়ি থেকে তঞ্চঙ্গ্যা নামটি উৎপত্তি। এর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত হয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে যা এখনো বর্তমান। শ্রী মধাব চন্দ্র চাকমা তার রাজনামা গ্রন্থে চাকমাদের দুটি শাখার কথা বলেছেন। একটি হচ্ছে ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘আনক্যা চাকমা’। এই ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আর ‘আনক্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান চাকমারা। একদা ইতিহাসে আরাকান/দান্যায়াদি অংশকে বলা হতো ‘রোয়াঙ্গ্যা’ আর চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বলা হতো ‘আনক’। এই আনক্ থেকে ‘আনক্যা’ শব্দটি এসেছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস শুরু হয় মূলতঃ আরাকান-পার্বত্য চট্টগ্রাম-ভারত আর চাকমাদের ইতিহাস শুরু হয় ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাই ইতিহাসের সরল ভাষ্যমতে এই আনক্যা চাকমারা আদৌ আরাকানে বসতি স্থাপন করেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। ইতিহাস গবেষকদের মতে রাজনামা বা চাকমা রাজনবর্গে তাদের ধারাবাহিক ইহিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি) থেকে সাত্তুয়া (পাগলা রাজা) পর্যন্ত রাজারা ছিলেন রোয়াংগ্যা চাকমাদের(তঞ্চঙ্গ্যা) বংশধর আর ধাবানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজারা হচ্ছেন আনক্যা চাকমাদের(বর্তমান চাকমা) বংশধর। তাছাড়া চাকমা ইতিহাস লেখকদের লেখনীতে তাদের ইতিহাসের দোলাচলতা আমরা লক্ষ্য করি। ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে অশোক কুমার চাকমা বলেছেন- চাকমা জাতির ইতিহাসের একটি কাহিনী বা অংশ চাক জাতিও নিজেদের বলে দাবী করছে। তাহলে কি এই কাহিনী চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছে ? না আমরাই তাদের কাহিনীকে নিজেদের (চাকমাদের) বলে চালিয়ে দিচ্ছি। তাই অশোক কুমার চাকমা ‘চাক ও চাকমাদের মিলে যাওয়া ইতিহাসের’ অংশ নিয়েও এই রকম একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। আর জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যারা নাকি আসল চাকমা, এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। তাই আমরা লক্ষ্য করেছি তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস compromise এর ইতিহাস। 

ইতিহাসে উলেখ আছে তঞ্চঙ্গ্যাদের আগে বর্তমান চাকমারা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেন, সেজন্য তারা তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে ‘পরঙী’ বা বসবাসের জন্য আগমনকারী হিসেবে অভিহিত করতেন। আর চাকমরা যদি কোন কারণে বা কালে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকেন তাহলে তারা আরাকানকে স্বদেশ বা মাতৃভূমি হিসেবে মেনে নেয়নি বা গ্রহন করেননি। তার কারণ মগ রাজার সাথে তাদের সর্ম্পক ভালো ছিলনা। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে আরাকান বা মগ রাজাদের সর্ম্পক ভালো ছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিজয়গিরি প্রচুর সৈন্য সামান্ত নিয়ে রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন। এই সৈন্য সামান্তরা যে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বংশধর ছিলেন সেটাও ইতিহাস বলে। কারণ তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে মারমা এবং রাখাইনরা সেসময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত “দৈনাক” বলে সম্বোধন করেন। ইতিহাসে আছে বিজয়গিরি যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু অংশ এখানে থেকে যায় আর কিছু অংশ স্বদেশে বা আরাকানে চলে যান (বিচগ্রী যুদ্ধ জয়ের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়া)। ইতিহাসের তথ্যমতে রোয়াংগ্যা চাকমা বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধনদের যোদ্ধাদের বংশধর এবং উত্তরসুরী। ইতিহাস আরো বলে তঞ্চঙ্গ্যারাই গৌতম বুদ্ধের বংশীয় শাক্য বংশের উত্তর পুরুষ। আরাকানে বসবাসরত তন্চংগ্যাদেরকে শাক্যবংশীয় উত্তরসুরী হিসাবে তদান্তিন জেনারেল উনু প্রতি বৎসর এ জাতির দম্পতিকে রেঙ্গুনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করতেন।

আবার অনেকে বলেন তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমারা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রদায় ছিল। উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজা ধাবানা তার শাসন থেকে ‘চাকমা’ নামে একটি জাতি বা সম্প্রাদয়ের সংস্কার গড়ে তুলেন। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমারা কি নামে সম্বোধন হতেন তা গবেষকগণ বলতে পারেননি। তবে লুইনের মতে চম্পক নগর থেকে আগত বলেই চাকমা নাম ধারণ করা হয়। কিন্তু চম্পক নগরের অস্থিত্ব নিয়ে ইতিহাসে নানা প্রশ্ন আছে। আর ত্রিপুরা রাজমালা’র মতে অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ের শব্দটি এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে চাকমা নামের উলেখ পাওয়া যায় এই রাজমালা গ্রন্থে। আবার অনেকের মতে পূর্ব পুরুষদের আচার,আচারণ, অভ্যাাস ও অবস্থান দেখে আরাকানীরা হেঁয়ালীভাবে তাদেরকে চাংমাং বা চামা এবং তংসা নামে ডাকত। পরবর্তীতে এই শব্দদ্বয় থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা শব্দদ্বয় রূপান্তরিত  হয়ে থাকতে পারে। 

আরাকানের ভুসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে,মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করে আসছে। তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু। আরাকান থেকে এসে তারা তৈনছড়ি কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় ক্রমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খৃীষ্টাব্দে দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলের এক রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছে স্থানীয় প্রবীনদের মত রয়েছে। ইতিহাস বলে পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরুপে বিবেচিত হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আর রাজা ধরমবক্স খাঁ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বজাতি হিসেবে গ্রহণ করেননি। ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে তার আমলে ৪,০০০(চার হাজার) তঞ্চঙ্গ্যা আগমন করেন। এদের রাজা ছিলেন ফাপ্র“। তারা পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুটির’ (বর্তমানে ডিসি বা নজরুল স্কয়ারের পাহাড়ের উপর বিল্ডিংটি) ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দেন।

ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যারা জাতিতে মঙ্গোলীয় এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা চর্চা অনেক দিনের। জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট্য ভাষাতাত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েষ্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (Linguistic Survey of India)’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষাকে পৃথক ভাষা বলে উলেখ্য করেছেন এবং উভয় ভাষাকেই আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অর্ন্তভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেন। তঞ্চঙ্গ্যাদর নিজস্ব লিপি আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের লিপি অনেকটা বার্মিজ লিপির কাছাকাছি। এর মূল উৎপত্তি হচ্ছে ‘মন’দের থেকে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা যে বর্ণমালাটা ব্যবহার করছে সেটি হচ্ছে দাইনাক বর্ণমালা। তাদের বর্তমান মোট বর্ণমালার সংখ্যা ৩৬টি। তার মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ হচ্ছে ৩১টি আর স্বরবর্ণ হচ্ছে ৫ টি। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সহজাত উচ্চারণ হচ্ছে ‘আকারান্ত’। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা শান্ত, নরম এবং কোমল। 

সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকারটা বিশেষ করে জমি-জমা, পাহাড়-পর্বত লাভ প্রথাগত। তারা এক পুরুষ ভোগ করার পর পরবর্তী পুরুষকে তার সম্পত্তিকে দেখভালে দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ছেলেরাই অগ্রাধিকার বেশী পায়। তবে পুত্র সন্তান যদি না থাকে মেয়ে সন্তান থাকলে মেয়েরাই সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর পুত্র মৃত্যু পর পুত্রবধু যদি দ্বিতীয় বিবাহ না করে সে ঘরে যদি কোন সন্তান থাকে সেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। নিঃসন্তান হয়ে তারা যদি পালক সন্তান পালন করেন বা কেউ তাদেরকে লালন-পালন করেন (ভাইয়ের বা বোনের সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ) তখন তারা সম্পত্তির ভাগ পান। যদি স্বামী-স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে তারা চাইলে তাদের সম্পত্তিগুলি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দানও করে দিতে পারেন। 

পোষাক-পরিচ্ছদ এবং আলঙ কানিঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা সরকারী ভাষায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রয়েছে তনচংগ্যাদের পোষাক তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ। মূলত এই বৈচিত্র্যময় পোষাক দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের আলাদা এবং স্বকীয়ভাবে সহজে চেনা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের ‘পাঁচ কাপড়ের’ পোষাকটা। মেয়েদের এই পাঁচ কাপড় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছে। এই পাঁচ কাপড় হচ্ছে- পিনন(পরনের কাপড়), খাদি (ওড়না), মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী), পা-দুরি(কোমড় বন্ধনি), সালুম(শার্ট) এগুলি হচ্ছে মেয়েদের জাতীয় পোষাক। আর ছেলেদের জাতীয় পোষাক হচ্ছে- ধুতি, হাফ হাটা সাদা ফুটুয়া এবং মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী)। মেয়েরা তাদের কাপড়গুলি নিজেরাই তৈরী করে, কোমড় তাঁত এর মাধ্যমে। ‘আলঙ কানি বা আলাম’ হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের নকশা পুথি। এটি মূলত একটি নকশা করা কাপড় যেখানে সমস্ত বুননের ডিজাইনগুলি নকশা করা থাকে। এই ডিজাইনের ফুলগুলি জুমে উৎপাদিত নানা ফুল,ফল এবং প্রকৃতি ও জীবজন্তুর নানা উপাদান থেকে নেওয়া। তাই এই বুনন উপাদনের সাথে জুমের একটা আত্মার সর্ম্পক রয়েছে। এই জুমের ফুল নিয়ে তনচংগ্যা সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছে গান, সাহিত্য। রয়েছে ঐতিহাসিক উবাগীত, রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যেও। রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যে রাধামন-ধনপুদি পোষাকের মধ্যে আমরা এই জুমফুল এবং আলঙ কানি ফুলগুলির বর্ননা পাই। যেমন- কুরা চোখ ফুল(মুরগী চোখ ফুল),বিঅন বিচি ফুল(বেগুন বীজের ফুল),রাধাচুলা ফুল(মোরগের ফুল),গাইত ফুল(বিশেষ করে শার্ট বোনা হয়), কুরাঙা কাবা ফুল,কাঙারা চোখ ফুল,প্রজাপতি ফুল(বিশেষ করে থলে তৈরী করা হয়),বিসন ফুল(এই ফুল দিয়ে শার্ট বোনা হয়),কুমুড়া বুক্ক্যা ফুল,মাম্মা বিচি ফুল,ধুদি পাল ফুল,আইদ ফুল, আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল,বুল চুক্ক্যা ফুল, কই ফুল(শার্ট বোনা হয়),কেরেঙ ফুল, জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড় (পোষাক) হচ্ছে রাজকীয় পোষাক। তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাক বিশেষ করে মেয়েদের পোষাক নিয়ে সমাজে আরো কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময় চাকমা শাসক ছিলেন রানী কালিন্দী। আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার সময় ব্রিটিশ লর্ড নাকি রানী কালিন্দীর সাথে দেখা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং তারা দূত মারফত সে খবরটি পৌঁছে দেন। আর অনুরোধ করেন আসার সময় চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নিয়ে আসার উপহার হিসেবে। সেগুলি উপহার স্বারক হিসেবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখবে। রানী কালিন্দী নিজে না গিয়ে তার কিছু হেডম্যানকে ব্রিটিশ লর্ডের সাথে সাক্ষাতের করার জন্য প্রেরণ করেন এবং চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক (পিনন, খাদি এবং ব্লাউজ) উপহার হিসেবে পাঠান। ব্রিটিশ লর্ড তাদের সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং রানী কালিন্দীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এক পর্যায়ে হেডম্যানরা রানীর দেওয়া চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকগুলি ব্রিটিশ লর্ডের হাতে তুলে দেন। ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি পেয়ে খুশী হন এবং রানীকে হেডম্যানদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান। পরে তাদের সামনে ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি খুলে দেখেন এবং অবাক হয়ে নাকি বললেন-“এগুলিতো চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নয়”। তখন এই হেডম্যানরা নাকি পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যাদের পাঁচ কাপড়(পিনন,খাদি,সালুম,পা-দুরি, মাদাকাবঙ) দিয়ে আসেন এবং ব্রিটিশ লর্ড বললেন- এগুলিই হচ্ছে চাকমাদের আসল পোষাক। তার জন্য আবারো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানান। জনশ্রুতিতে আরো আছে এই পাঁচ কাপড়গুলি নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে তখনকার স্বারক শাসনের স্বারক হিসেবে। 

জুম চাষের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাকের একটা মিল আমরা দেখতে পাই। আর এই মিলটা হচ্ছে ফুলের। এই ফুলগুলি তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাককে বৈচিত্র্যভাবে এবং নানা রঙে ফুটিয়ে তোলার ভূমিকা পালন করেন। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যেসব পোষাক হাতে এবং বুননের মাধ্যমে তৈরী করে তার মধ্যে যেসব ফুলের কারুকাজ ব্যবহার করা হয় সে ফুলের নামগুলিও জুমে উৎপাদিত নানা ফল বা ফলের বীজ এবং ফুল থেকে নেওয়া। যেমন- বেউন বিচি ফুল, কুরা চোখ ফুল, গাইত ফুল, বিসইন ফুল, সুইচ্ছাং ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কাঙারা বিচি ফুল, কুমুড়া বুক্কয়া ফুল, মাম্মা বিচি ফুল, ধুদি পাল ফুল, আই-দ ফুল,আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল, বুল চোক্কয়্যা ফুল, কই ফুল, বিঞ্চ ফুল, হাদি চ ফুল, প্রজাপতি ফুল,মাইত ফুল। রাধামন-ধনপদি পালার পোষাকের মধ্যে আমরা তঞ্চঙ্গ্যাদের এই জুম ফুলগুলির বর্ণনা পাই।

সামাজিক সংগঠন বা গছা/গোত্রঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের বংশ পরিচয় পিতৃসূত্রীয়। তাদের সর্বমোট বারটি গোত্র আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় গোত্রকে গছা বলে। তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার সংখ্যা হচ্ছে ১২(বার)টি। এই গছাগুলি হচ্ছে -র্কারআ গছা, মুঅ গছা, ধন্যা গছা, লাং গছা,মংলা গছা, মেলং গছা, অঙ্যা গছ, রাঙ্যা গছা, লাপ্যোসা গছা, ওয়াহ গছা, মুলিমা গছা,তাসসি গছা। এই গছাগুলির আবার রয়েছে উপগছা। তঞ্চঙ্গ্যাদের মৌজা প্রধানের নাম হেডম্যান এবং গ্রাম/পাড়া প্রধান হচ্ছেন কার্বারী। তারা সামাজিক নানা বিচার-আচার পরিচালনা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

জীবন জীবিকা এবং চাষাবাদঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তাদের জুম চাষের মুল পর্বটা শুরু হয় বৈশাখের পরে। তবে বৈশাখের পূর্ববর্তীতে তারা জুমকে অনেকাংশে চাষের উপযোগী করে তৈরী করে রাখে। জুমকে কেন্দ্র তারা করে তাদের জীবন পুঞ্জিকা তৈরী করে। এই জুমে ধান, হলুদ, আদা, কলা, কচু, মরিচসহ নানা রকম সবজি উৎপাদন করে। জুম থেকে তারা সারা বছরের জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ পেয়ে থাকে। এই জুমকে কেন্দ্র করে তাদের ঐতিহাসিক নানা সাহিত্য এবং কাহিনী বা পালা রচিত হয়েছে। তার মধ্যে জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা। আর আছে নানা পৌরানিক উপখ্যান। তার মধ্যে লক্ষী মা ও মিত্তিন্যা পসন। বিষু সময় গ্রামের যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে জুমে তরকারী খুজতে যেত। 

ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসঃ

 তঞ্চঙ্গ্যারা জন্মগতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তারা গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনে অনুসারী। তাদের প্রত্যেকের গ্রামে একটি করে বিহার/প্যাগোডা রয়েছে। সকাল বিকাল তারা বিহারে গিয়ে পূজা-আর্চনা করে, বুদ্ধ এবং ভান্তেকে বন্দনা করে। সাথে প্রার্থনা করে জগতে সকল প্রাণী সুখী হওয়ার জন্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের একটা রীতি আছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত একবার হলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে শ্রামন্য দীক্ষা গ্রহন হরতে হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর পাশাপাশি মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমাও তারা যথাযত ধর্মীয় অনুশাসনে পালন করে থাকে। 

পরিবারের ধরণঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একক এবং যৌথ পরিবার লক্ষ্য করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যারা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান। তবে পিতার অবর্তমানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠই পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবার নেই বললে চলে।  

সঙ্গীত ও সাহিত্য

সাধক কবি শিবচরণ, রাজ কবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে আলোকিত করেছে। সাধক কবি শিবচরণ তার গোসাইন লামা সাহিত্য তঞ্চঙ্গ্যাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তেমনি ভাবে সাদিগাঙছড়া, জুম কাবা, রাইন্যা বেড়া, ফুল ফারা, রাধামন ধনপুদি পালা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যকে সমৃদ্ধ শিখরে নিয়ে গেছে। সে সময় চারণ কবি গেঙ্গুলীরা গানের আসর জমিয়ে তুলতো এই পালাগুলি গেয়ে বেহেলার সুরে। তঞ্চঙ্গ্যাদের চারণ কবি বা শিল্পীদের গেঙ্গুলী বলা হয়। ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এবং রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার। দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনিলা তঞ্চঙ্গ্যা, মিনা তঞ্চঙ্গ্যা, শোভা তঞ্চঙ্গ্যারা তঞ্চঙ্গ্যা গান এবং নৃত্যকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সমকালীন আধুনিক লেখকদের মধ্যে বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা(পরলোকগত), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। ‘পহর জাঙাল’(তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রকাশনা সাহিত্যে অন্যতম পথ প্রদর্শক। এটির স্বপ্নদ্রষ্টা হচ্ছেন কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি যখন ২০০১-০২ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে বিষু উপলক্ষে। আর এটির উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় ওয়াগ্গা হাই স্কুলের হল রুমে। পরবর্তীতে পহ্ র জাঙাল এর পথ ধরে সিঙহাবা, চালৈন, তৈনগাঙ প্রকাশনাগুলি তঞ্চঙ্গ্যা আধুনিক সাহিত্য চর্চাকে অনেক দুর নিয়ে গেছে। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক। 

বিবাহ

 তঞ্চঙ্গ্যাদের বিয়ে সাধারণত দুই রকেমের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ‘দাবারা’ বিয়ে মানে পালিয়ে বিয়ে করা আর অন্যটি হচ্ছে ‘সাঙা’ করে বিয়ে করা মানে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা। এই দাবারা বা সাঙা বিয়ে অনেকটা পরিবারের আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। বর্তমান সময়ে সাঙা করে বিয়ে হলেও আগেকার দিনে বেশীর ভাগ বিয়ে হতো দাবারা করে। তখন এই বিয়েটা পালিয়ে এমনভাবে হতো পরিবারের কোন সদস্য জানতো না। শুধুমাত্র মেয়ের কিছু সঙ্গী-সাথী ছাড়া। পরের দিন জামাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু মুরুব্বী এসে বলতো আমরা তোমাদের মেয়েকে বিয়ে নিয়ে গেছি তোমরা কোন চিন্তা করো না। তখন জামাইয়ের পক্ষ থেকে চুরি করে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে ক্ষতিপূরণ হিসেবে শুকর দিতে হতো। বিয়ের এক সপ্তাহ পর জামাই তার নতুন বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো মিষ্টি-জিলাপী, বিনি পিঠা, সাইন্যা পিঠা, নারিকেলসহ নানা খাদ্য উপকরণ। এই ভাবে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে দুইবার বেড়াতে আসতে হতো। প্রথম বেড়াকে বলা হতো ‘জোড় পুরায় দে-না’ বা জোড় বেঁধে দেওয়া আর দ্বিতীয় বেড়ানকে বলে দ্বিতীয় বেড়া। তঞ্চঙ্গ্যারা মামাতো বোন, মাসিতো বোন এবং দুর-সম্পর্কের ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে। তবে ‘বড় কুদুম’ বা মাতৃতুল্য(মাসি, ফিসি) বিয়ে করা যায় না এবং এটি সামাজিক এবং নীতি বিরোধী। আর আপন ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে সামাজিক নীতি বিরোধী। 

সামাজিক অনুষ্ঠান এবং পূজা-পার্বন

তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিষু। তার পাশাপাশি নবান্ন উৎসব, আল পালনী, চুমুলাঙ, মিত্তিনি পূজা ইত্যাদি। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষে বিষু উৎসব খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়।  তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বিষুর আনুষ্ঠানিকতা মোট তিনদিন। ফুল বিষু, মুল বিষু এবং বিষু। ফুল বিষু সময় তারা ফুল তোলে এবং ঘর সাজায়। মুল বিষু দিন তারা পাইসন রান্নার জন্য জুম থেকে সবজি খুজে নিয়ে আসে আর খাবার পানি তোলে রাখে।  বিষুর দিনে সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঘুরতে বের হয়, বড় জনকে পায়ে ধরে প্রণাম করে। গ্রামে বড়োবুড়ি থাকলে তাদের গোসলের ব্যবস্থা করে। এই বিষু দিনে প্রত্যেক বাড়িতে নানা পিঠা-পুটুলি আর নাস্তা পানি আয়োজন করা হয় এবং আপ্যায়ন করা অতিথিদেরকে। বিষু উপলক্ষে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতী মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। এবং গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় গেঙ্গুলী গানের আসর। 

বাসস্থানের ধরণ

তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐত্যিগত বাসগৃহ হচ্ছে বাঁশ এবং শন দিয়ে তৈরী মাচাংঘর। তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের একটা নিদিষ্ট ডিজাইন আছে যা প্রত্যেক গৃহস্থ অনুসরণ করে। যা সহজে দেখলে চেনা যায়। ১. মূল ঘর, ২. বারান্দা, ৩.ইচর, ৪. টংঘর। 

খেলা-ধুলা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম খেলা হচ্ছে ঘিলা খেলা এবং নাদেং খেলা। ঘিলা খেলা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের জাতীয় খেলা। বিষু উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলার আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতীরা মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। তাছাড়া টুম্বুল খেলা, দু-দু খেলা, তেদই বিচি খেলা, গয়াঙ খেলা, শামুক খেলা, গাত খেলা, সই খেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, ইচিবিচি খেলা, গাইত খেলা,কুত্তা খেলা,লু-আ লুই খেলা,কাইন বা কঞ্চি খেলা, ঢাঙগুলি খেলা, গুলিক খেলা, চি কুতকুত খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি। 

শিক্ষার হার এবং জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকদুর এগিয়েছে। তাদের শিক্ষার হার প্রায় ৭৫-৮০% এর মতো। তারা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে যোগ্যতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। আর বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এর মতো। আর সারা পৃতিবীতে ৩-৪ লক্ষ এর কাছাকাছি।  

পিঠা-পুটুলি

তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের বাড়িতে নানা পিঠা তৈরী করে। অনেক সময় নানা উৎসবকে কেন্দ্র এই পিঠা তৈরী করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা যেসব পিঠা তৈরী করে সেগুলি হল- সাইন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, আইলসি পিঠা, তেল পিঠা,মালি পিঠা(গুলিক/গাইস্যা পিঠা),কলা পিঠা, পাতি সাপ্তা ইত্যাদি পিঠা তৈরী করা হয়। তাছাড়া কইন ভাত, বিনি ভাত,মিষ্ঠান্নও তৈরী করা হয় নানা উপলক্ষ উপলক্ষে।

খাদ্যাভাসঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান খাবার হচ্ছে ভাত। এই ভাতের সাথে মাছ, মাংস (মুরগী, ছাগল, হাঁস, শুকর) তাদের প্রিয় খাবার। এর পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে ‘নাপ্পি/ছিদল’ এবং সিদ্ধ যেকোন তরকারী বা শাক-সবজি। শুটকিও তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের জঙ্গল প্রাপ্ত নানা শাক-সবজিও তাদের খুব প্রিয়। 

জন্ম এবং মৃত্যুঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে শিশু জন্মের পর সাতদিন পর্যন্ত মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরের কোন কাজ করতে দেয় না রান্না-বান্নাসহ। এটি মূলত একটি নিষেধাজ্ঞা যেখানে পরোক্ষভাবে অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সবার সহযোগিতা করা। সন্তান প্রসবের পরবর্তী কয়েকটা দিন সে যেন নিজেকে সুস্থ করে তোলার সুযোগ পায়। সাতদিন পর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাকে তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘পেলা আরি ধরানা’ বা ‘কসই পানি লনা’। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মূলত বাচ্চাকে ঘরের একজন সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া এব্ং সামাজিকভাবে স্বকৃীতি প্রদান করা হয়। 

মৃত্যুর পর তঞ্চঙ্গ্যাদের আগুনে দাহ করা হয়। এই দাহ করার স্থানকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘ছিদাখলা’ বলা হয়। আর দাহ করতে যাওয়াকে ‘মগদায় যাওয়া’ বলে। তবে দুধের বাচ্চা হলে কবর দেওয়া হয়। ছোট বাচ্চাদের কবরকে ‘পআ কবা’ বলে। মৃত্যুর পর সাতদিনের মধ্যে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করে দেওয়ার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করতে তার যেন কোন সমস্যা না হয়। তবে অনেক জায়গায় সমাজের ঘর প্রতি এক কেজি চাল এবং কিছু টাকা দেওয়ার নিয়ম প্রচলন আছে। একে তঞ্চঙ্গ্যা ‘সাত দিন্যা’ বলে। এই সময় ভিক্ষুদের আপ্যায়নসহ নানা ব্যবহার্য সামগ্রি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করে দেওয়া হয় তার স্বর্গ লাভের হেতুর জন্য। সাথে আপ্যায়ন করা হয় পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতী গোষ্ঠী এবং আত্মীয়-স্বজনকে।  

উপসংহার

অন্য দশটা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতিসত্বার মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও দেশ, সমাজ এবং জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা দেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হয়ে সবার সাথে এগিয়ে যেতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ তাদের গর্ব এবং অনুপ্রেরণা। কেননা এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক তঞ্চঙ্গ্যাও সরাসরি এবং প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহন করে দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তঞ্চঙ্গ্যারা বেঁচে থাকতে চায় অন্য দশটা সাধারণ মানুষের মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে। বেঁচে থাকতে চায় তার নিজের সংস্কৃতির স্বকীয়টাকে সাথে নিয়ে। সাথে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় সামনে দিকে মায়ের মতো ভালোবেসে।  

Leave a comment