তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা

সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস। 

প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি। 

তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি। 

বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)। 

এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;

তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। 

আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত। 

বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল। 

উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস) 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল। 

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল। 

সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে। 

সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। 

তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা। 

১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান। 

অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।” 

দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়। 

সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।” 

অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। 

উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র। 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) 

তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়। 

দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়। 

এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়। 

একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। 

বাতকস এর লক্ষ্য 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।” 

বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য 

নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর

বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।

বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। 

২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে। 

বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল

তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল। 

বাতকস এর সম্মেলন সমুহ  

১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। 

এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল। 

এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।

১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। 

উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন। 

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। 

বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী 

বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-

১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়। 
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। 
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। 
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে। 
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা, বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ

পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা , কবিরত্ন (১৯২০- ২২শে মার্চ ১৯৯৭)


ড. মনিরুজ্জামান

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য-চর্চার ইতিহাস দুই ধরণের। এক. গেঙ্গুলি তথা চারণকবিদের গীত উভাগীত, ধনপুদির গীত, ‘পুরান কদা’ কিংবা শিবচরণের (অষ্টাদশ শতক) গােসাইনলামা অথবা রামায়ণ-মহাভারত ও জাতকাদির জনপ্রিয় কাহিনীর ব্যাখ্যামূলক নীতি বা গীতিকা রচনা। 

এসব গীত গেঙ্গুলিদের সংগৃহীত, হস্তলিখিত এবং প্রাচীন চাকমা (মনক্ষেমর) ও বার্মা লিপিতে চাকমা/তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। এর সবই অপ্রকাশিত (উভাগীতের কিছু অনুবাদ যথা সলিল রায় কৃত ইংরেজি অনুবাদ ও বঙ্গীয় সংস্করণ এর ব্যতিক্রম)। গেঙ্গুলি সংগ্রহের কিছু নমুনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারে ফটোকপি হিসাবে চয়িত আছে।

এই ধরণের রচনা ব্যতীত আর যা পাওয়া যায় তা বাংলা ভাষায় রচিত পার্বত্যবাসীদের নানা গ্রন্থ ও সম্পাদিত নানা পত্রিকা ও সাময়িকা, – যার প্রধান ভাষা বাংলা। অর্থাৎ এ গুলিকে চাকমা ও অন্যানা পার্বত্যজাতির বাংলা ভাষাপ্রীতির ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রকাশ। এবং সাহিত্যের নানা দিকে নিজেদের প্রতিভা স্ফুরণের প্রচেষ্টা। 

এখানে বাংলাভাষী লেখকদের সাথে প্রতিযােগিতার কোনও প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা যায় না যদিও বাংলা সাহিত্যের (বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির) সমালোচনার যােগ্যতা তারা রাখেন এবং সেসব রচনা বাস্তবিক উপভােগ্য। 

সাহিত্যের নানা বর্গে (genre) তাদের এই পদচারণার(নাটকে উপন্যাসে গল্পে আলােচনায়। অনুবাদে ও গানে এবং মৌলিক কবিতায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা তাদের এসব সৃষ্টির প্রয়াস যথেষ্ট উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়) কোন স্বতন্ত্রমূল্য আছে বা হবে কি না তা এখনও বলার সময় আসে নি। 

তবে এই সব সৃষ্টি বা প্রকাশনার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ভাষিক ও সাহিত্যিক মূল্য একদিন হয়তবা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আজ কাল ডায়াসপােরা ( Diaspora) বা অভিবাসিতের সাহিত্যের যে মূল্যায়ন হচ্ছে, সেই রকম এসব বিভাষীদের বাংলা চর্চার মূল্যও যে কালের দাবী হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে? এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় আমরা রাজস্থলী (কাপ্তাই) এক অস্ফুট কিন্তু অসাধারণ এক প্রতিভা কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার পরিচিতি প্রদানে প্রবৃত্ত হবাে।

পটভূমিঃ

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর পার্বত্যবাসীদের উল্লেখ করে প্রমথবিশী বলেছিলেন, বঙ্গভূমি কেবল পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলাই নয়, পার্বত্য বাংলাও। যাই হােক, বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় পার্বত্যবাসীরাও বাংলা চর্চায় আগ্রহী হন। 

যদিও নন্দলাল শর্মার ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের অবাধ বিচরণের সংবাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত’। যাই হােক তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস চাকমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের সাথে যুক্ত। 

একথা সত্য যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রথম আলিঙ্গন জানান চাকমা রাজবাড়ির প্রধান পুরুষগণ। তবে যতদূর জানা যায় এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়েরও একটি সক্রিয় ভূমিকা আছে। স্কুলটি বিশ শতকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘােষ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ত্রয়ােদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (কলিকাতা, ১৩১৪) ‘চাকমাদিগের ভাষা তথ্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। 

পরে তিনি (সম্ভবত রাজবাটির উৎসাহ ও প্রণােদনায়) ‘জ্যোতি’ পত্রিকার লেখক গগনচন্দ্র বড়ুয়ার সূত্র ব্যবহার করে ও বহু শ্রম স্বীকার করে ‘চাকমাজাতি’ ( ১৩১৬ সন) শীর্ষক একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। 

সিবিলিয়ানদের পরে ও বাংলাভাষাতে এটিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বঙ্গীয় অম্বেষণ। এক দশক পরে রাজা ভুবনমােহন রায়-এর ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এটিই চাকমাদের কর্তৃক বাংলা চর্চার আদি নির্দশন। 

তবে কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় (বিচিত্রা, দেশ প্রভৃতি) রাজ পরিবারেরই লেখা কিছু কিছু গল্প কবিতা এর আগেও প্রকাশিত হয়ে থাকবে। কুমার কোকনদক্ষ রায়ের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। 

যাই হােক, বাংলা ভাষা চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা দানে পরবর্তী কালেও রাজবাটির উৎসাহের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রানী কালিন্দী রায়, রানী বিনতা রায়, রাজা নলিনাক্ষ রায়, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, এঁরা সকলেই যেমন নিজেরা যােগ্যতার সাথে বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছেন, তেমনি অন্যদেরও সে সুযােগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা-চর্চার এই পরিবেশটি আসলে গড়ে ওঠে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকেরও মধ্যকালে এসে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্য- পটভূমিতেও নানা পরিবর্তন যােজিত হতে থাকে। 

নতুন পত্র পত্রিকার আবির্ভাব, উনিশ শতকের সাহিত্যের ভিন্ন মূল্যায়ন, মাক্সির্য় দর্শনের প্রভাব, লােকসংস্কৃতির পঠনপাঠন (কবি জসীম উদদীনেরও আবির্ভাব এই সময় : রাখালী ও কর’ ১৯২৭, নকশীকাঁথার মাঠ ১৯২৯, সােজন বাদিয়ার ঘাট ১৯৩৩ প্রভৃতি) এবং রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নৰ জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ‘কাল-চিহ্ন’ বহন করে চলছিল সময়ের নিম্নবাহী স্রোত। 

সমকালীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আধুনিকতার নামে এক ‘তিমির তীর্থ’ পরিক্রমণে উদ্যোগী তখন। এই পটভূমি বৃহত্তর দেশ ও তার সংস্কৃতিকে অন্যরকম প্রতিক্রিয়ার মুখােমুখি করে। অর্থাৎ একদিকে এক ধরেণর নম্রজাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে নাগরিক বােধ সৃষ্টি ও বিশ্বমুখিন চেতনা বিকাশের নামে শিকড়বিহীন যে আধুনিক সাহিত্য ও নব সংস্কৃতি সৃষ্টি, তার প্রতি অনীহা সংস্কৃতি- সচেতন মানুষকে তার অন্তবােধের প্রতি বিশ্বস্ত হতে প্রেরণা যােগায়। 

বৃত্তের মধ্যে যে কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির কথা বলা হয়। এখানে যেন তারই উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। এইভাবেই কেন্দ্র থেকে দূরে প্রান্তীয় অবস্থানে বাংলাভাষার লােকজ, আঞ্চলিক বা গ্রামীণ, এবং উপসীমান্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠতে থাকে। 

রেঙ্গুনে ‘বুদ্ধবাণী’ প্রকাশ ও পার্বত্য চট্টগ্রােম ছাত্র সমিতির মুখপত্র ‘প্রগতি’ প্রকাশনা (যদিও অস্থায়ী) এবং রাঙ্গামাটিতে গৈরিকা-গােষ্ঠীর উত্থান তারই প্রামাণ্য বহিঃপ্রকাশ। 

গৈরিকা’র প্রভাবে ও গৈরিকা’র অবর্তমানে পরে আরও কিছু পত্রিকার ও আবির্ভাব ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। ‘গৈরিকা’র প্রকাশ কাল (১৯৩৬- ১৯৫১), পরে বান্দরবানে ‘ঝরণা’ (১৯৬৬), এবং আরও পরে রাঙ্গামাটিতেই ‘বনভূমি’, ‘পার্বত্যবাণী’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ‘পার্বত্যবাণী’ সম্পাদনা করেন বিরাজমােহন দেওয়ান (১৯৬৭-১৯৭০;মােট সংখ্যা ২৬টি)। এতে আগরতারা ও উভাগীত এবং রাজ পরিবারের অনেকের রচনা ও স্মৃতি কথাও (রানী বিনীতা রায়ের জীবনস্মৃতি সহ) প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বিশেষ করে রাঙ্গামাটি থেকে পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশিত হলেও (বিস্তৃত তালিকার জন্য বর্তমান লেখকের গােষ্ঠী পত্রিকা ও সাময়িকী ২০০৬ দেখা যেতে পারে। এছাড়া নন্দলাল শর্মারও একটি সমীক্ষা রয়েছে)। ‘গৈরিকা’র ভূমিকা ঐতিহাসিক। ‘গৈরিকা’র নামকরণেরও ঐতিহ্য আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। রানী বিনীতা রায়ের পরিচালনায় রাঙ্গামাটি থেকেই এটি প্রকাশিত হয়। 

রাজা নলিনাক্ষ রায়ের প্রয়াণে তার স্মৃতি সংখ্যাটিই এর শেষ সংখ্যা ছিল (১৯৫১)। প্রভাতকুমার দেওয়ান ও পরে অরুণ রায় পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। অরুণ রায়ের প্রথম প্রকাশ ‘বুদ্ধবাণী’তে (রেঙ্গুন)। 

আরও অনেকের প্রাথমিক প্রস্তুতি বাইরের, তন্মধ্যে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ও রবীন্দ্রপ্রভাবিত গীতিকার চূণীলাল দেওয়ানের কথাও বলা যায়। কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের কথা আগেই বলা হয়েছে। 

কিন্তু নন্দলাল শর্মার উক্তিটি সমর্থন করে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালে চাকমা ভাষায় যে কবিতা চর্চা হচ্ছে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে ‘গৈরিকা’। নন্দলাল শর্মা গৈরিকা’র লেখকদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন এভাবে। 

প্রভাত কুমার দেওয়ান, অরুণ বা, কন্যার কোকনদাক্ষ রায়, বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ান, রানী বিনীতা রায়, অবিনাশচন্দ্র দেওয়ান, কালাঞ্জয় চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান, ভগবানচন্দ্র বর্মন, শেখর দেওয়ান, ও সােমেন দেওয়ান (আসলে বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ানের দুটি ছদ্মনাম), কুমার বিপাক্ষ রায়, গােপাল চন্দ্র গুর্খা, তনুৱাম খীসা, নীলা রায়, বিপুলেশ্বর দেওয়ান, রাজা নলিনাক্ষ রায়, চমীকাল দেওয়ান, শান্তি রায়, সুনীতিজীবন চাকমা, গিরীন্দ্র বিজয় দেওয়ান, নীরােদরঞ্জন দেওয়ান, কুমার রমণী মােহন রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, জগদীশ চন্দ্র বর্মন ও রাজেন্দ্রনাথ তালুকদার। 

এই তালিকায় হয়তাে আরও দু একটা নাম যুক্ত হতে পারে যেমন, কুমার কুবলয়াক্ষ রায়, সৌমেন্দ্র নারায়ণ দেওয়ান, নােয়ারাম চাকমা, বেণীমাধব বড়য়া প্রভৃতি। পরবর্তীতে আমরা এমন অনেককে পাই যাদের নাম এই তালিকায় পাই, যেমন- বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়কেতন চাকমা বা মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা প্রভৃতি। 

হতে পারে গৈরিকা-গােষ্ঠী ভুক্ত ছিলেন না তারা। সেই রকমই একটি নাম হল কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯২০-২২শে মার্চ ১৯৯৭)। 

তিনি কোনও দলভুক্ত হয়ে সাহিত্য চর্চার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি স্বাধীনভাবেই সাহিত্য চর্চা করেছেন, যদিও ‘পার্বত্যবাণী’তে তাঁর কিছু রচনা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। 

অন্য পত্রিকায়ও তার রচনা প্রকাশিত হয়ে থাকবে। বস্তুত কার্তিকচন্দ্রের আবির্ভাব কালের সময় ও পরিবেশ ছিল এটাই। অবশ্য তাঁর প্রথম আবির্ভাবের তথ্যটি অর্থাৎ প্রথম রচনা প্রকাশের তথ্য এখনও অস্পষ্ট। তাঁর অনেকগুলি পান্ডুলিপি পাওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা স্বীকার্য। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ভূমিকা ও অবস্থান 

কবি কার্ত্তিকচন্দ্র যা কিছু রচনা করেছেন তা মূলত বৌদ্ধ সাহিত্য এবং তাঁর সবই বাংলা ভাষায় রচিত। তিনি কি বৃহত্তর পাঠকের চিন্তা থেকেই তা করেছিলেন? তঞ্চঙ্গ্যা সমাজেই বা তার অবস্থান কোথায়? – এ প্রশ্নের উত্তরে ও বিশ শতকের তৃতীয় দশকেই যেতে হবে আমাদের, যখন পালিসাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন বিলাইছড়ি রাইংখ্যং-এর আশাছড়িমুখ নিবাসী এক লােক চিকিৎসক- কবি পমলাধন।

পমলাধনের সমকালে বা সামান্য আগে শরৎ রােয়াজার এবং চূনীলাল দেওয়ানের সংগীত ও কাব্যচর্চার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেন (দ্রষ্টব্য, নন্দলাল শর্মা, ঐ), কিন্তু। তাদের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। 

পলাধন ধর্ম- সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি। তারই যােগ্য উত্তর পুরুষ কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। পলাধনের সাহিত্যকে বিস্তৃত করেন তিনি। এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়েই তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থানকে উজ্জ্বল করেন এই দুই কৃতিমান পুরুষ। 

কার্তিকচন্দ্রের জন্ম হয় ১৯২০ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর । তিনি চাকমা জাতির ইতিকথা’র বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমকৃষ্ণা দেওয়ান এর সমবয়সী এবং বিরাজ মােহন দেওয়ান (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত), প্রভাতকুমার দেওয়ান (গৈরিকা-সম্পাদক), চূনীলাল দেওয়ান (চাকমা কবিতা, জুমিয়া গৃহিণী –লেখক), কবি অরুণ রায়, গল্পকার জগদীশ দেব বর্মন, প্রবন্ধকার ভগবানচন্দ্র বর্মন, ‘প্রগতি’ সম্পাদক শরৎচন্দ্র তালুকদার ও সুনীতিজীবন চাকমা, কবি-অনুবাদক সলিল রায়, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি’র লেখক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখের তিনি সমকালীন বা অগ্রজ। তাঁর “বৌদ্ধগল্পমালা’ (১৩৯৬) গ্রন্থের ভূমিকায় (আমার কথা) প্রদত্ত দুটি তথ্য নিম্নরূপ:

“… রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া শাক্যমনি বিহারের অধ্যক্ষ বৌদ্ধসাহিত্য সুসাহিত্যিক ও সুপন্ডিত শ্রীমৎ প্রিয়দর্শী মহাস্থবির মহােদয় আমার রচিত এই বৌদ্ধগল্পমালা পুস্তকের পান্ডুলিপিখানা আগাগােড়া পড়ে আমাকে ধর্ম প্রচারের জন্য বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেন। আমি মহাস্থবির মহােদয়ের নিকট চির কৃতজ্ঞ। 
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটী সরকারী কলেজের বাংলার অধ্যাপক বাবু নন্দলাল শৰ্মা তাঁহার লিথিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের (বাংলা) সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ পুস্তকে আমার রচিত পুস্তক সমূহ বিশেষভাবে সমালােচনা করে আমাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রেখেছেন।”…

দুটি মন্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য তাঁর অপরাপর গ্রন্থেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ কবি তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনও না কোনও ধর্মগুরু বা রাজগুরুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং ধর্মপ্রচার ও মানুষের মঙ্গলের বিবেচনাকেই সেখানে প্রধান্য দিতে দেখা গেছে। 

মহাস্থবির মহােদয়ের প্রভাবে তিনি এই গ্রন্থ শেষেও বলেছেন, ‘এই পুস্তকের দ্বারা ধর্মপ্রাণ নর-নারীগণের যৎসামান্য উপকারে আসলে আমার রচনা শ্রম সার্থক মনে করবাে।’ এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৩৯৪/১৯৮৭ ইং। অর্থাৎ এর আগেও তিনি যেসব ধর্মকেন্দ্রি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেমন- মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বুদ্ধ সালামী গাথা (১৯৮৫) কিংবা যেসব রচনার পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে যেমন – রাধামন ধনপতি প্রভৃতি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােক গাথা এবং “অশােক চরি” নামীয় একটি চরিত কাব্য ও অন্যান্য কিছু রচনা, – সেগুলিরও প্রত্যেকটি মধ্যেই কবির এই ধর্মপ্রীতি ও ধর্মপ্রচারের আকাঙ্খা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

আগেই উল্লেখিত হয়েছে, (১৯৩৬ সালে) পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘ধর্মজ জাতক’ গ্রন্থটি মূল পালি থেকে পদ্যানুবাদ করে বা পদ্যরীতিতে ভাবানুবাদ করে এবং তৎসহ ‘ধর্ম্ম হিত উপদেশ’ সংযােজন করে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সাহিত্য রচনার সূচনা করেছিলেন, কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাকেই আদর্শ হিসাবে নিয়েছেন। 

এই সাহিত্যের শাখাকে বিস্তৃত করাতেই মনােযােগী হয়েছেন তিনি। কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন, দুই ভাবে- মননী মেধা প্রয়ােগে (যেমন, তত্ত্ব- কাব্য ও ধর্মকাব্যের মাধ্যমে) ও সৃজনী মেধার মাধ্যমে বা মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ চরিত কাব্য, কাহিনী বা গাথা কাব্য ও কাব্য নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে। 

রচনার বিষয় ও তার সরস প্রকাশ, নাটকীয় গুণ ও কাব্যবােধ মিলিয়ে উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সকল সৃষ্টিতেই। উল্লেখ্য কার্ত্তিকচন্দ্র ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’র সাথে পমলাধনের ‘ধর্যধ্বজ জাতক’ গ্রন্থটিও সম্পাদিত ও সংশােধিত আকারে প্রকাশ করেন। 

এই কারণে তিনি রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক “পন্ডিত” ও ‘উদয়ন যন্ত্র’ রচনার জন্যে প্রিয়দর্শী মহাস্থবির কর্তৃক “কবিরত্ন” উপাধি লাভ করেন রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির আয়ােজনে। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা রচনা পরিচিতি 

কবি তাঁর একাধিক গ্রন্থে অধ্যাপক নন্দলাল শর্মার উল্লেখ করে বলেছেন তিনি তাঁর (কবির) গ্রন্থের মূল্যায়ন করেছেন, এজন্য তিনি তাঁর (অধ্যাপক শর্মার) কাছে কৃতজ্ঞ। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ (১৯৮১) পুস্তিকায় নন্দলাল শৰ্মা পাহাড়ী বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার কথাও এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। উক্ত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে কার্ত্তিকচন্দ্রের মূল্যায়ন সমূহ আমরা প্রথমে তুলে ধরতে চাই। তা নিম্নরূপ –

১. উদয়ন বস্তু:

১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘উদয়ন বস্তু’। পয়ার ছন্দে লিখিত এবং ছাব্বিশটি ছােট ছােট অধ্যায়ে বিভক্ত। এই কাব্য গ্রন্থে বর্ণিত শ্যামাবতীর কাহিনী যুদ্ধের সমকালীন ঘটনা হলেও অনেকটা বুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা সম্বলিত। 

বার্মায় ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vathu) অনুসরণে কাব্যটি রচিত। কর্মফলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কবি এ কাব্যের শেষাংশে বলেছেন- 

“দানশীল ভাবনাতে মন কর স্থির
কুশল কর্মেতে লিপ্ত থাক সদা ধীর।”

২. অনাগত বংশ : 

“অনাগতবংশ’ নামে তিনি একখানা কাব্য প্রণয়ন করেছেন। বর্মী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন চিনি অং মাষ্টার। সেখান থেকে কার্তিক বাবু সরল পয়ার ছন্দে বইটি রচনা করেন। এ কাব্যে আর্থমিত্র প্রমুখ অনাগত বৃদ্ধদের সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণিত হয়েছে।” (পৃ. এগার)

৩. বিজয়গিরি:

“মূলত কবি হলেও কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (জন্ম ১৯২০) দু’খানা নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকদ্বয় প্রকাশিত হয় নি। ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘বিজয়গিরি’ চার অঙ্কের নাটক। 

চম্পক নগরের রাজা উদয়গিরির পুত্র বিজয়গিরিকে রাজ্যভার অর্পন করে শ্রী বৌদ্ধ মন্দিরে গমন করতে চান। কিন্তু বিজয়গিরি বের হতে চান দিগ্বিজয়ে। এ সময় উদয়পুরের রাজা জংলী কুকীরাজ কালঞ্জয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁদের শরণাপন্ন হন। 

বিপুল বিক্রমে বিজয়গিরি মিত্ররাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোয়াং দেশের রাজা মঙ্গল উদয়পুর লুণ্ঠন করতে আসলে সেনাপতি তা প্রতিহত করেন। বিজয় অভিযানে বের হয়ে বিজয়গিরি রােয়াং রাজ্য জয় করেন। এই হল নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। 

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি অনুগত থেকেও নাট্যকার কতিপয় কাল্পনিক চরিত্র-নাগরিকগণ, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, গয়ারাম, গঙ্গরাম প্রভৃতি চরিত্র উপস্থাপন করে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। 

এ নাটকের সংলাপ কখনাে গদ্যে আবার কখনাে মিলহীন প্রবহমান। পয়ার ছন্দে রচিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কথনাে দৃশ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে। বিবেক চরিত্র ও সংগীতের সংযােজন নাটকটিকে যাত্রাভিনয়ের মর্যাদা দান করেছে।” 

৪. মানুষ দেব :

“ ভগবান গৌতম বুদ্ধের অতীত (জাতক) কাহিনী অবলম্বনে কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ‘মানুষ দেবতা’ নামে তিন অঙ্কের একখানা নাটক রচনা করেছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। 

মঘবা নামে বােধিসত্ত্ব মানুষকে পঞ্চশীল পালনে ও জনহিতকর কার্যে উধুদ্ধ করেন। মাতালদের বিচার করে উৎকোচ করত মন্ডল। মদ্যপান বন্ধ হয়ে গেলে সে মঘবাকে ডাকাত বলে রাজ সমীপে নালিশ করে। বিনা বিচারে মঘবার শাস্তি হয়। কিন্তু মহমী মঘবাকে পদলিত না করায় রাজা নিজের ভুল বুঝে মঘকে মুক্তি ও মন্ডলকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। 

জাতকের এ কাহিনীকে যাত্রাগানের মত নাট্যকার উপস্থাপিত করেছেন। আধুনিক নাট্যকলা শ্ৰী তঞ্চঙ্গ্যার নাটকে অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনাই তাঁকে নাট্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।” 

৫. রাধামন ধনপুদি গেঙ্গুলী গীত : 

“ বান্দরবান মহকুমার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হেডম্যান ও জনসাধারণের একমাত্র মুখপত্র ত্রৈমাসিক ‘ঝরণা’র প্রথম সংখ্যার ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয়। 

… চার সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ‘ঝরণা’ বন্ধ হয়ে যায়। ঝরণা’তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘রাধামােহন ধনবতী কাহিনী অবলম্বনে ‘গেঙ্গুলী গীত’ … ইত্যাদি।”

৬. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষাঃ

শ্রী নন্দলাল শর্মার বর্ণিত গ্রন্থে কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এই পাঁচটি গ্রন্থের বিবরণ ছাড়া আর একটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় গ্রন্থের পরিশিষ্টে ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের তালিকাংশে। উক্ত গ্রন্থের নাম ‘বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা’। 

গ্রন্থটির প্রকাশকাল দেওয়া নেই এবং প্রকাশের স্থানে উল্লেখ আছে (রাইংখ্যং মুখ?), অর্থাৎ প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যটি অনিশ্চিত বা অজ্ঞাত। এছাড়া ‘পার্বত্যবাণী’ পত্রিকায় বা অন্যত্র ও অন্যভাবে কবি যে ‘কালেভদ্রে’ দুএকটা কবিতা প্রকাশ করেছেন তার উল্লেখ আছে কিছুটা সমালােচনার ভঙ্গিতে-

“কবি অরুণ রায় ও কবি কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা সত্তরের দশকে নিজ নিজ কাব্য প্রতিভার অবক্ষয় অপরােক্ষ করলেও কালে ভদ্রে দু’চার চরণ। কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না।”

পাঁচ. কবির মাধ্যম, প্রকরণ ও মূল্যায়নঃ কবির পূর্ণ গ্রন্থতালিকা এটি নয়। বর্ণিত তালিকা ও বিবরণ থেকে কবির একটি সামান্য পরিচয় মাত্র লাভ করা যায় যা অধ্যাপক গবেষক নন্দলাল শর্মা পরিশ্রম সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 

আমার অপর ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তনচংগ্যার সহায়তায় আমি একটি শ্রেণীকৃত রচনা তালিকা তৈরীর প্রয়াস পেয়েছি, সেটি পরিশিষ্টে যােগ করা হল। 

কবির রচনাপঞ্জি (আংশিক নয়) নির্মিত না হলে এবং সমুদয় রচনা প্রকাশিত না হলে। তাঁর সম্পর্কে পূর্ণ মূল্যায়ন অপেক্ষিত থাকে। আমরাও এখানে কবির কর্মের সম্পূর্ণ মূল্যায়নে বিরত থাকলাম তার অধিকাংশ রচনাই অপ্রকাশিত থাকার কারণে।

কবির মূল রচনা সমূহ কাব্যাকারে রচিত, যদিও এসব রচনা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত, যথা রাধামন ( রাধামােহন)-ধনপুদি (ধনবতী) গাথা একটি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােকগাথা শ্রেণীর, অশােক চরিত একটি কাব্যনাট্য শ্রেণীর, অনাগত বংশ একটি মিশ্র রীতির রচনাগুচ্ছ, অধিকাংশ নাটক আবার পালা বা যাত্রা জাতীয় এবং কাব্য শ্রেণীর গ্রন্থগুলি ধর্মদেশনা ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক। কবির সব রচনাই আবার পয়ার ছন্দে বদ্ধ। 

তাঁর প্রবন্ধ সমূহ ও কিছু কিছু গীতি ও নীতি কবিতা এর ব্যতিক্রম মাত্র। অধিকাংশ বা প্রায় সমুদয় রচনা বাংলা ভাষায় রচিত হলেও ‘বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা’ (১৯৮৫) এই বার পৃষ্ঠার প্রার্থনামূলক গ্রন্থটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। তাঁর ভাষার নমুনা এই রূপ – 

বুদ্ধ ধৰ্ম্ম সংঘ গুণ 
ভাবনা গরং মনত্তুন। 
কায়ামনে কধায়ে,
ভজন গরং সদায়ে। 

এখানে ভাষাই পরিবর্তিত হয় নি, ছন্দরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। 

ছয়. পরিশিষ্ট – ১ 

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের প্রকাশনা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য

১. বৌদ্ধ শিক্ষা (১৩৪৬) ও ২. উদয়ন বন্ধ (১৩৬৮):

“মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪) গ্রন্থের ভূমিকায় (‘আমার কথা’) উল্লেখ আছে : “আমি ইতিপূর্বেও কয়েকখানা বই লিখেছিলাম। ১৩৪৬ সন বাংলাতে ‘বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামক একখানা বই লিখে প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করেছিলাম। 

আর ১৩৬৮ বাংলা সনে উদয়ন বস্তু” নামে একখানা বই লিখে, তাহা প্রেসে ছাপিয়ে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নর-নারীগণের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আরও কিছু বই লিখেছি। কিন্তু ছাপাকারে প্রকাশ হয়নি। …” 

৩. উদয়ন বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮/১৯৬১ ইং), গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১৩০ 

গ্রহারম্ভে ‘মূল গাথা’, ‘পরিচিতি’ ও ‘আমার কথা’ যুক্ত ‘পরিচিতি থেকে উদ্ধৃতি- 

“অপ্রমাদ মূল পাথা ভাষিত যখন 
মহারাজ উদয়ন সময়ে তখন। 
আরম্ভ করিব গল্প কাহিনী বিস্তার,
কার্তিক তঞ্চঙ্গ্যা রচে শ্বায় পার।” 

“আমার কথা” 

“বৌদ্ধধর্ম কর্মহী; লােকে যাহা কর্ম করে তাহাই কর্মের ফলরূপে ভােগ করিয়া থাকে। ‘উদয়ন বন্ত্র’ গল্প কাহিনী কর্মফলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ ।…

বার্মার ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma ( ধর্মের আলাে) নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vatlu) ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে ‘উদয়ন বন্ধু’ নামকরণে এই পুস্তক প্রণয়ন করিলাম ।…”

সূচিপত্র

বিষয় – দুইবন্ধু – উদয়ন- উদয়নের রাজ্যলাভ – অভিষেক উৎসব- তৃষ্ণালয়ে জন্ম দাসীর ভাগ্য- সাধু সঙ্গ লাভের ফল- কৰ্ম্মফল ভুগিতে হয়- কৰ্ম্ম রাখে যারে কে মারিতে পারে- ঘােষক শ্ৰেষ্ঠী- সুখ দুঃখ চক্রবৎ-শ্রেষ্ঠী কুমারী শ্যামাবতী- মহারাজ চন্দ্র প্রদ্যোতরাজকুমারী বসুল দত্তা- দ্বিজ নন্দিনী মাগন্দ্বিরা – অর্দ্ব উপোসথের ফল- কৌশাম্বীতে বুদ্ধের শুভাগমন- কুজোত্তরা- মাগন্দ্বিয়ার শক্রতা- শ্যামাবতীর বর লাভ কৰ্ম্মফলমাগন্দ্বিয়ার সাজা- ভিক্ষগণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশ- উপসংহার । 

৪. মহাৰােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); গ্রন্থ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮। প্রকাশকের (শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: ভিক্ষু) নিবেদন’… ভগবান বুদ্ধের অমৃতময় দেশবাণীকে প্রচার করা (র) … সংকল্প পােষণ করে আমার দায়ক শ্রদ্ধাবান উপাসক কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচিত ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ তৎসঙ্গে স্বর্গীয় কবিরাজ মশাধন তঞ্চঙ্গ্যা রচিত ‘ধৰ্ম্মধ্বজ জাতক’ বই খানা … প্রকাশ করতে কৃত সংকল্প… হলাম । এই পুস্তক প্রচারের দ্বারা ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নরনারী গণের যৎকিঞ্চিৎ উপকার হলে আমার আশা পূর্ণ হবে।’ 

আমার (গ্রন্থকার) কথা- 
‘মহাকারুণিক শান্তা তথাগত ভগবান গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে আমি বহুদিন ধরে আশা পােষণ করে আসছি।… বুদ্ধের… এসব বিষয়ে সর্বসাধারণের সহজে যাতে বােধগম্য হতে পারে মােটামুটি এক নজরে বুদ্ধকে জানবার জন্য আমি ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ নাম দিয়ে এই বইখানা… মহাবােধি পালঙ্কের আদি বিবরণ সরল বাংলা পয়ার ছন্দে লিখে… পাঠ করে শুনালে শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: স্থবির বইখানা প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি শ্রদ্ধেয় ভান্তের নিকট চির কৃতজ্ঞ।’ 

উৎসর্গ – 
‘স্বর্গীয় পিতৃদেব আন্তখা তঞ্চঙ্গ্যা (কালাবৈদ্য) স্বর্গীয় মাতৃদেবী মনপুরি তঞ্চঙ্গ্যা – তাঁহাদের পূণ্য স্মৃতি স্মরণে’ । (১০ ঢরণের কবিতা সহ)। 
বিষয়: বন্দনা – মাতাপিতা গুরু বন্দনা – মহাবােধি পালঙ্ক কথা – কুলপুত্র নন্দিয় কথা। 

৫. ধর্মধ্বজ জাতক : কবিরাজ পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রণীত, পন্ডিত শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবি রত্ন কর্তৃক সংশােধিত ও সম্পাদিত ১৩৯০: পৃ. ৩৯-৮০। সুচিপত্র। বন্দনা- সূচনা- বারমাসী পুরীর বর্ণনা- বিনিশ্চয় বিচার- ধর্থ ঋজকে পঞ্চকৰ্ম্ম আদেশ-বিশ্বকৰ্মাকর্তৃক গজদন্ডময় গৃহ নিৰ্মাণ- ছত্রপানি কর্তৃক চণ্ডুবিধ গুণ।

ব্যাখ্যা- রাজা যশাপানিকে পঞ্চজের উপদেশ দান- কবিরাজ পমপান তঞ্চঙ্গ্যা সংক্ষিপ্ত জীবনী।

৬. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (১৯৮৫/২৫২৯ বুদ্ধাব্দ) 
উৎসর্গপত্রঃ ‘আমার পিতামহ পরম উপাসক স্বর্গীয় শােভাধন তঞ্চঙ্গ্যা ও তাহার সহধর্শিনী উপাসিকা স্বর্গীয় কইবী তঞ্চঙ্গ্য-এর পূণ্যস্মৃতি স্মরণে’। (১২ চরণের কবিতা সহ)

সাত, পরিশিষ্ট -২

কবিরত্ন কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচনাসমূহ
(শ্রেণীকৃত তালিকা) 

১। প্রকাশিত গ্রন্থ (কাব্য বা ধৰ্মকাব্য)
ক. ভাষা: তঞ্চঙ্গ্যা- বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা (আগষ্ট ১৯৮৫)। 
খ. ভাষা: বাংলা – বৌদ্ধশিক্ষা (১৩৪৬); উদয়ন বস্তু বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮); মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); বৌদ্ধ গল্পমালা (১৯৮৭)। 
২। সম্পাদিত গ্রন্থ 
ক. ধৰ্ম্ম ঋজ জাতক – পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা মূলগ্রন্থের সংশােধন ও সম্পাদনা (১৩৯০)। 
৩। প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ-
ক. লােকগাথার কাব্যরূপ ঐতিহাসিক) : রাধামন ধনপুদি কাব্য। 
খ. চরিত কাব্য: অশােক চরিত (রচনা ১৯৮৩); অনাগতবংশ। 
গ. নাট্য কাব্য (ঐতিহাসিক) : বিজয়গিরি। 
ঘ. চরিত নাটক (ধর্মীয়); মানুষ দেবতা। 
ঙ. তপ কীর্তন ও যাত্রা পালা । বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা (রচনা ২৫/০৪/১৯৮৫) শ্রীবুদ্ধের বারােমাস স্মৃতি (রাজস্থলী মৈত্রী বিহার প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ, ২৬/০৩/১৯৭৮) 
চ. বিবিধ শ্রেণীর কল্পতরু দান ফল কথা; বন্দনা ও দান ফল কথা; অক্ষর গাথা। 
৪। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা – 
ক. ‘নববর্ষ’। রাজবলাকা (১৫ এপ্রিল ১৯৮৭ সংখ্যা)। 
খ. ‘আশ্বিনী পর্ণিমা’। নৈরঞ্জনা (সম্পা, সয় চাকমা, ২০ আশ্বিন ১৩৮৮ সংখ্যা)। 
গ. দেবৱিলােকন’। সম্বােধি (সম্পা. ভিক্ষু শদ্ধা প্রিয়, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ১৩৯০)। 
ঘ. ‘জীবন রহস্য’। পার্বত্যবাণী (সম্পা. বিরাজ মােহন দেওয়ান) ১ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।

৫। প্রকাশিত প্রবন্ধক- 
ক. ‘চাকমা পেঙ্গুলীগীত’ (লােক কাহিনী): 
ঝরণা ১ম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা মার্চ ১৯৬৭ (সম্পাদক, সৈয়দ খাজা আহমদ) 
ঝরণা ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জুন ১৯৬৭ (সম্পাদক, সুনীতি বিকাশ চাকমা)। 
ঝরণী ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ (সম্পাদক,সুনীতি বিকাশ চাকমা) 
খ. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি (জাতিতত্ত্ব) : সাপ্তাহিক বনভূমি, ২৬ মার্চ ১৯৮৪ (সম্পাদক : এম মকসুদ আহমদ)*

তথ্য নির্দেশ 
১। শ্রী নন্দলাল শর্মা (১৯৮১): পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক। 
রাঙ্গামাটি 
২। বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৯৫) : তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। 
৩। ‘গৈরিকা’র ফাইল 
৪। শ্রীমান কর্মধন তন্চংগ্যার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

* টিকা : কার্তিকচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থের নামপত্রেও অনেকগুলি গ্রন্থের নাম আছে। কিন্তু সব গ্ৰন্থই প্রকাশিত কিনা জানা যায় না। নন্দলাল শর্মার গ্রন্থে (১৯৮১) বৌদ্ধ ধর্ম। শিক্ষার উল্লেখ থাকলেও কবির ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ র আখ্যাপত্র প্রদত্ত পুস্তক তালিকার মধ্যে এবং উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা (আমার কথা”)-তেও বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামটিই পাওয়া যায়। নন্দলাল শর্মা ‘ধর্মপ্লজ জাতক’ এর প্রকাশ কাল ১৯৩৬ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি গ্রন্থটি সম্পাদিত রূপ (কবিরত্ন কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকর্তৃক ১৯৮৪ সংস্করণ)- টি সম্ভবত পান নি।

প্রসঙ্গঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রসঙ্গ

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা*

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রী: পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দিনটিও সুন্দর ছিল, বছরের শেষ দিন এবং অফিস ছুটিও ছিল তখন। তাছাড়া পরিবারকে নিয়ে বের হওয়া যায় না সহজে। সময়, সুযোগ, বাস্তবতা অনেকটা অনুকূলে থাকে না। আর পরিবারের সদস্যদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বিশেষ করে ছোটদের, বড়দের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ এটি নয়। তবে যৎসামান্য প্রসঙ্গও থাকবে বৈকি।

বহুদিন থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে যথেষ্ট আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক হচ্ছে। আলোচনাগুলো মূলত: তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক অন্যদের দ্বারা বিকৃতি, অসম্মান, অসুন্দর উপস্থাপন এবং ব্যবহার প্রসঙ্গ নিয়ে। “তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র” (অনলাইন)- গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রীঃ তারিখে একই প্রসঙ্গ একটি পোস্ট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় (facebook)। স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা – সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক শুরু হয় এবং নানা মতভেদ দেখা দেয়। মূলতঃ দুজন চাকমা যুবক-যুবতীর ‘খবং’ পরাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি তর্কের সূত্রপাত। তঞ্চঙ্গ্যাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংগুলো তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী “মাধা হাবং”( তঞ্চঙ্গ্যারা অনেক সময় খবং বা মাধা খবং’ও বলে। তবে গ্রামের মানুষজনকে ‘মাধা হাবং’ উচ্চারণ করতে শুনেছি । আমিও আমার লেখায় ‘মাধা হাবং’ শব্দটি ব্যবহার করছি) এবং চাকমা রমণীরা অতীতে কখনো এরকম খবং পরেনি এবং কেউ পরেছে সেরকমও চোখে পরেনি। পিনন, খাদি, ব্লাউজ এই থ্রী বস্ত্র চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান পোশাক। অন্যদিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকের মত- চাকমারা (পুরুষ-মহিলা) আগে থেকেই এই খবং ব্যবহার করতো। ব্যবহার না করার ফলে হারিয়ে ফেলেছে তবে বর্তমানে চেষ্টা করছে পুরনো ঐতিহ্যকে (খবং) ফিরিয়ে আনতে।

‘খবং’ কোন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বা করে না এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনস, যুক্তি-তর্কের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগটি এককভাবে আমার নেই, তাই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘কারা ঠিক বলছে?’ প্রশ্নটি সামনে রেখে একটু স্টাডি করতে শুরু করি। স্টাডি অংশ হিসেবে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি, চাকমা সমাজের কিছু গুণী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং সাথে কিছু পরিচিত চাকমা রমণীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি।

প্রথমে বই এর রেফারেন্স প্রসঙ্গে আছি- সুগত চাকমা তাঁর ‘বাংলাদেশের উপজাতি’ (পৃষ্ঠা-১২) গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫ খ্রী:, বাংলা একাডেমি, ঢাকা) চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে নিম্নাংগে ‘পিনোন’ এবং বক্ষবন্ধনী ‘খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরুষরা পোশাক হিসেবে কবোই, ধুতি, গামছা এবং খবং (এক জাতীয় পাগড়ি) ব্যবহার করেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন।

বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আর পুরুষদের পোশাক হিসেবে ধুতি, চাদর, উঞ্চীষ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে উক্ত গ্রন্থে।

ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন তাঁর ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ’ গ্রন্থে (প্রকাশ:১৮৬৯) যে ছবি (পৃষ্ঠা: ২৩৮ থেকে শুরু) তিনি ব্যবহার করেছেন সেখানে চাকমা রমণীদের (যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সকল মহিলার মধ্যে) পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় কোন খবং ছিল না। শুধু পিনন, খাদি, ব্লাউজ আর সাথে অলংকার ছিল।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ-১৯০৯ খ্রী:। পৃষ্ঠা-২২১) তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের পোশাক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- চাকমা পুরুষদিগের পোশাক ছিল সাধারণত হিন্দুগণের ন্যায়, দেখিতে বড়ুয়া অর্থাৎ বাঙ্গালী মঘ বলিয়াই মনে হয়। পৌঢ়সমাজ মস্তকে ‘খবং’ বাঁধিয়া থাকে। নানা পূজা, অনুষ্ঠানে সাধারণত তাঁরা এই খবংটি পরে থাকে। নারীরা খবং পরে বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেননি।

মুস্তফা মজিদ তাঁর ‘চাকমা জাতিসত্তা’ গ্রন্থে (প্রকাশ: ২০১৯ খ্রীঃ। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা -৮৮) তিনি চাকমা পৌঢ় বা বৃদ্ধরা খবং বাধঁতেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনোন এবং খাদি’র কথা উল্লেখ করেন। বস্ত্র হিসাবে খবং এর কথা তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৭। ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী'(৫) খন্ডে (এই খন্ডে মোট ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা আছে) ‘চাকমা’ পর্বে (লেখক: সুগত চাকমা) যে পোশাক-পরিচ্ছদ এর বর্ণনা আছে (পৃষ্ঠা:৭৪-৭৬) সেখানে লেখক চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম শুধু ‘পিনোন- খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাথায় সাদা কাপড় এবং মধ্যবয়সী মহিলারা অন্য রঙযুক্ত কাপড় সামান্য পেঁচিয়ে পরেন বলে মত দেন। এই পেচাঁনো কাপড়কে তিনি ‘খবং’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুল খোলা অবস্থায় খাবারে বা যত্রতত্র যাতে চুল না পড়ে (চুল দিয়ে অনেকে কালো যাদু করে এই আশঙ্কা থেকে), জুমে বা জমিতে খররৌদ্র, ঝুড়ি বহনে সহায়ক হিসেবে এই খবং এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও খবং চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যের একটি পোশাক সে কথাটি উল্লেখ করেননি। ৩১/১২/২০২২ খ্রি: পরিবার নিয়ে আগ্রাবাদস্থ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঘুরতে গেলাম আমরা, যে কথাটি শুরুতেই বলেছি আমি। জাদুঘরে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রদর্শন রয়েছে। সেখানে চাকমা রমণীদের ব্যবহার্য বস্ত্র হিসাবে ‘খবং’ ছিল এরকম কোন প্রদর্শনী আমার চোখে পড়েনি, সঙ্গে যারা ছিল তাদেরও চোখে পড়েনি।

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” (প্রকাশ:১৯৯৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে খবং বা মাধা হাবং এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ গ্রন্থেও একই কথা লিখেছেন। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি’ গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের খবং বা মাধা হাবং ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে করে আমার মনে হয়েছে ‘খবং’ চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী বা সংস্কৃতির অংশের পোশাক নয় বিধায় লেখকগন (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেনি বা এড়িয়ে গেছেন।

এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে আসি-

চাকমা ইতিহাস রচয়িতাদের (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) গ্রন্থে কোথাও ‘খবং’ হিসেবে চাকমা রমণীদের পোশাক ছিল এই কথাটি উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে চাকমা জাতির দু’জন বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষকের সাথে কথা হয় আমার । তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল উল্লেখিত ব্যক্তিদের লেখার মধ্যে তো চাকমা রমণীদের খবং ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উল্লেখ নেই। তাই আমি বা আমরা কি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি চাকমা রমণীদের ‘খবং’ এর ব্যবহার ছিল না অতীত থেকে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আশ্চর্য এবং অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন আমাকে। তিনি বললেন- বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা মহোদয়রা কখনো চাকমা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। কথাটি শুনে আমি বিষম অবাক হলাম এবং শক খেয়েছি। কারণ আমি যতটুকু জানি একজন লেখক যখন নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেন, তিনি কিন্তু প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অগোচরে নিজের এবং জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাথে এটাও সত্য আমরা সকলে কোন না কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করি। বিষয়টি নিয়ে আমি আরো পরিচিত কয়েকজন চাকমা জনগোষ্ঠীর রমণীর সাথে কথা বলি। সকলেই মত দেন চাকমাদের (পুরুষ মহিলা উভয়ে) মধ্যে অনেক আগে থেকে খবং ব্যবহার ছিল। তবে এখন ব্যবহার করে না আগের মতো। তাদের সকলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে- খবং তাঁরা (চাকমা) আত্মরক্ষার বস্ত্র (ধুলোবালি, রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা এবং কাঠ, পানি বহনের সময় নিরাপত্তা) হিসেবে ব্যবহার করতো। তাছাড়া কোন অনুষ্ঠান (যেমনঃ বৈদ্যরা তাদের পূজা অর্চনা) সময় এটি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে । আর বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বরণ, অভিষেক (রাজ্যাভিষেক) সময়ও এই খবং ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে। তবে সব তথ্যকে চাপিয়ে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন- চাকমারা ‘খবং’ ব্যবহার করলেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘পাঁচ কাপড়'(মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পাদুরি, পিনন) এর মতো অবিচ্ছেদ্য কোন বস্ত্র নয় এটি। তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বা কাঠামো নেই। এক টুকরো সাদা কাপড়,অনেক সময় ফুল তোলা কাপড় (আমি আমার দিদিকেও দেখেছি ফুল তুলে মাপলার বুনতে। বাবা এবং আমাদের জন্য), গামছা, তোয়ালে, মাপলারও এই খবং হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিনা আমরা? চাকমাদের ‘খবং’ ব্যবহার ছিল সিজনাল (Seasonal) আর তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘মাধা হাবং’ ব্যবহার ছিল ট্রেডিশনাল (Traditional)।

খবং’ বা পোশাক হিসেবে কে কি কাপড় ব্যবহার করবে এটি ব্যক্তির বা জাতির পছন্দ-অপছন্দ এবং রুচির ব্যাপার, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা -সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো কাউকে নিষেধ করেনি বা বলেনি যে, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ছাড়া কেউ এই ‘তঞ্চঙ্গ্যা পোশাক’ পরতে পারবে না, অবশ্যই পরতে পারবে। তবে পরার পেছনে কোন অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্য এবং বিকৃত উপস্থাপন যেন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যে পরে একে অন্যের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সন্মান করার। সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক, ছোট নৃ-গোষ্ঠীরা যেন সকল বিষয়ে আগ্রাসনের স্বীকার না হয়। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের “মাধা হাবং” কে চাকমা জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘খবং’ এর অংশ হিসেবে যদি দাবি বা উপস্থাপন করেন বা করতে চান তখন অবশ্যই যুক্তি-তর্ক, আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন আছে, সাথে প্রতিবাদও হবে। কারণ আমরা চাইলে চাকমা রমণীদের পিননকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পিনন হিসেবে দাবী করতে পারবো না। দাবির পিছনে ঐতিহাসিক, যৌক্তিক একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার থাকতে হবে। আমি মনে করি চাকমা জনগোষ্ঠীর সে সুযোগটি নেই, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবংকে তাদের ‘চাকমা খবং’ হিসেবে দাবি করার বা প্রতিষ্ঠা করার। অন্তত সেই প্রমাণ বা কথাটি বলছে বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা এর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ এবং অন্যান্য গবেষণাপত্র। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের কাছে মাধা হাবং মানে গামছা, তোয়ালে, মাপলার বা সাদা কাপড় নয়। তাদের কাছে খবং মানে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ের (মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি, পিনন) অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম, ঐতিহ্য, প্রতীক এর নাম। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ে একটা স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা রয়েছে। এই কাপড়গুলো বুনার সময় মেয়েরা নানা নকশা এবং ফুল তুলেন। এই ফুলগুলো তারা জুম এবং প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। সুতরাং মাধা হাবং সহ অন্য সকল পোশাকের ফুলের সাথে ঐতিহ, জুম এবং প্রকৃতির একটা হৃদতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা নিম্নে ফুলগুলো সাধারণত তাদের মাধা হাবং এ ব্যবহার করে- “দাঅর পদ্ম ফুল, চিয়ন পদ্ম ফুল, কর্ণধাদী ফুল, ক্যারাবক ফুল, উলু ফুল, বুলচুগ্ ফুল, তালুকতিজ্যা ফুল, বিসইন ফুল, চাবুরি ফুল, সাম্মাদোলি ফুল, কুরাচুগ্ ফুল, বেয়ুনবিচি ফুল, গাইত ফুল, কই ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কুমড়া বুক ফুল, দিইহরা ফুল, কা-রা বিচি ফুল, আলসুরি ফুল, পাইন্যাপোক ফুল, আয়ত্তলা ফুল (তুলতে ভুলে গেলে অমঙ্গল হয়), মাম্মাবিচি ফুল, কা-ড়া দার ফুল, পাইন্নাঙ ফুল, ছেরাবক ফুল, সুচ্ছাং ফুল, রোবক ফুল, ঘিলাটাক ফুল, রে ফুল” দিয়ে মাধা হাবং বুনা হয়। শুধু মাধা হাবং নয়, পিনন, জুম্ময়া খাদি, জুম্ময়া সালুম, পা-দুরির জন্যও আলাদা আলাদা ফুল রয়েছে। তবে প্রায় জুম্ময়া সালুম, মাধা হাবং, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি’র জন্য ঘুরেফিরে একই ফুল ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কে কোন ফুল কোথায় ব্যবহার করবে নিজের পছন্দ অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আর তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো ‘মাধা হাবং’কে আলাদা করে ‘খবং’ বা ‘হবং’ বলে না। শব্দটি ‘মাধা হাবং’ যুগল করে বলে। পুরনো দিনে এই পাঁচ কাপড় আমাদের রমণীরা সব সময় পরতো। বর্তমান সময়ে সব সময় না পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহারে দিন দিন সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা দলবেঁধে পাঁচ কাপড় পরে যাচ্ছে। এতে জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রচার হচ্ছে এবং পাশাপাশি জাতির প্রতি দায়িত্ব, গৌরব ও অহংবোধ তৈরি হচ্ছে। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা বর্তমানে বক্ষবন্ধনী হিসেবে যে খাদিটি ব্যবহার করে সেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম্ময়া খাদি’ নয়। সেটি চাকমা খাদি। তঞ্চঙ্গ্যা খাদি বৈচিত্র্যময়, ইউনিক এবং আভিজাত্য। আর বর্তমান বৈচিত্র্যতা এবং আধুনিক নামে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাককে ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলে নানা রকম বাহারী ডিজাইনে এত বিকৃত করা হচ্ছে কিছুদিন পর তঞ্চঙ্গ্যা পাঁচ পোশাক তার ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা হারাতে বসবে। তখন হয়তো তঞ্চঙ্গ্যা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে, বলতে হবে। এটি আমাদের জাতির জন্য অশনিসংকেত। এই পোশাক বিকৃতি আমাদের জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নষ্ট করছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যময় বৈচিত্র্যতাকে।

যে ছবি নিয়ে এত যুক্তি-তর্ক, আলোচনা -সমালোচনা, চাকমা লেখকদের খবং বর্ণনায় খবং এর অনুপস্থিতি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবং- তৈরিতে ফুলের যে ব্যবহার এই থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘মাধা হাবং’ ছিল(!!!) সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বিচারের ভারটি পাঠক গবেষক এবং সুধীমহলের জন্য তোলা রইল। আর বর্তমান সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অনেকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী হয়তো এসব কাপড়গুলো (খবং) পেয়েছে। এসব কাপড় বিক্রয়ে বিক্রেতা হয়তো সাময়িক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় কিন্তু সাথে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাদের নামে সাপ্তাহিক ক্রিয়া (সংঘদানে) এই পাঁচ কাপড় দান হিসেবে দেওয়ার একটা প্রচলন আছে। পুনর্জন্মে তাঁর (মৃত ব্যক্তিনীর) যেন কাপড়ের অভাব না হয় এই বিশ্বাস থেকে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) এই পাঁচ কাপড় দান করে। এগুলো অনেকে পুরো সেট (পাঁচ কাপড়) ভান্তে থেকে নামমাত্র ৩০০-৫০০ মূল্যে কিনে অন্যজনদের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে দেওয়ারও কথা প্রচলন রয়েছে সমাজে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে একটা সংস্কার প্রচলিত আছে এসব মরা-মৃত্যু এবং দানীয় বস্তু(কাপড়) বিধবা মহিলা ছাড়া কেউ পরতে পারে না, পরলে অমঙ্গল হয়। আরো অনেকে মত দেন যে, তঞ্চঙ্গ্যা ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ের মাধ্যমেও তাঁর আত্নীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড়ের প্রসার এবং অপব্যবহার ঘটছে। যে খবং নিয়ে এত বিতর্ক এবং আলোচনা চাকমাদের মধ্যে নতুন করে এর প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বয়স কিন্তু বেশিদিন নয়, বছর ৪/৫ হবে মাত্র।

আর নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক নিজের কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, সন্মান, শ্রদ্ধার। অন্যদের কাছে এটি শুধু একটি পরনের বস্ত্র। সুতরাং তাদের হাতে এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি। এই শঙ্কা তৈরি থেকে আজকে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে হচ্ছে। এই তঞ্চঙ্গ্যা পোশাককে বিকৃত উপস্থাপন (নৃত্যে) নিয়ে এর আগেও আমার বেশ কিছু লেখা, আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে।

খবং হিসেবে কে, কি কাপড় ব্যবহার করবে একজন ব্যক্তি বা জাতির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তবে অসঙ্গতি প্রশ্নে অবশ্যই তর্ক বির্তকের প্রয়োজন আছে। সময়ের ব্যবধানে তঞ্চঙ্গ্যারা মহামূল্যবান ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ/সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে মত দেন- চুরি হয়ে গেছে। সময়, সুযোগের অপব্যবহার করে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাধামন ধনপুদি পালা, গেঙ্গুলীর উবাগীত, শিবচরণ এর গোসাইনলামাসহ সকল উপাদানগুলো। এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমা জনগোষ্ঠী উভয় নিজেদের বলে দাবী করে। এখন তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের একটি অংশ “মাধা হাবং” এর উপর এত আলোচনা যুক্তি তর্ক মূলতঃ অতীতের অসুন্দর অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা থেকে। তাই তঞ্চঙ্গ্যারা আর চাই না নতুন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় এবং অন্য সকল সংস্কৃতি উপাদানগুলো চুরি বা বেহাত হয়ে যাক। তাই তারা চাই সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকুক তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি উপাদানগুলো।

এই আলোচনা যুক্তি তর্ক আসলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্ম, চিন্তা, মেধা এবং চেষ্টাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য নয়, আমাদের একে অপরের সংস্কৃতিকে সন্মান এবং ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ও সহযোগিতা মানস গড়ে তোলার লক্ষ্য এই আলোচনা। আর এই আলোচনায় আমি আমার জাতির অস্তিত্ব এবং সংকটের কথা বলছি, আমার অধিকারের কথা বলছি। কারো অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার কথা বলছি না। সময়ের দাবী হিসেবে হয়তো হয়তো আমরা অনেক কিছু গ্রহন করেছি আর অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। কিন্তু যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা সংরক্ষণের নিমিত্তে আর নিজেদের শেকড়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ও প্রশ্নে আমাদের সচেতন হওয়া এবং এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলকে নিতে হবে। হ্যাঁ অনেকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা লিখতে চান না, তাঁরা এর বদলে সম্প্রীতি ভ্রাতৃপ্রেমের কথা বলেন। আমরাও অবশ্যই সকলে চাই সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বপ্রেমের। কিন্তু আমাদের এটাও সাথে মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতের সংকটের সময় নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের কথা বলতে হবে জানান দিতে হবে। তাই আমি মনে করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যেখানে জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব হুমকি, সংকট তৈরি হবে সেখানে আওয়াজ তুলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐক্যে জাতি এগিয়ে যাবে। জাতি হবে সমৃদ্ধ উর্বর। প্রাণ ফিরে পাবে তার হারানো অতীত ঐতিহ্য গৌরব।

আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ককে সাথে নিয়ে সত্য, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অনুপ্রেরণা হোক আমাদের পথ চলা। আর আগ্রাসনের স্বীকার না হয়ে আমাদের সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক, সংরক্ষণ থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়।

———————

ছবি- বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া। তাই নির্দিষ্ট কাউকে ছবির ক্রেডিট দিতে পারছি না। তার জন্য সকলের কাছে সুন্দর ক্ষমা প্রার্থনা কামনা করছি।

———————

*সাবেক সম্পাদকঃ ‘পহর জাঙাল’, ‘রঁদেভু’ এবং ‘সিঙকাবা’ প্রকাশনা।

পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর ১ম ম্যাজিষ্ট্রেট প্রয়াত জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যার কর্মজীবন।

লেখক: বিশু তনচংগ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর প্রথম বি.কম. এল.এল.বি পাশ করা ম্যাজিষ্ট্রেট জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা । কবি কার্তিক চন্দ্র ে বড় ছেলে জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৪০ সালে ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজা রাঙামাটি সদর মহকুমায় জন্ম গ্রহণ করেন। 

তারা দুই মায়ের ৭ বোন এবং ৫ ভাই মোট ১২ ভাইবোন ছিলেন। 

রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি লাভকারী তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম ব্যাক্তি তিনি। তারপরে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা মঞ্জু। জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৯ সালে ইষ্ট পাকিস্তান সার্ভিস কমিশনের (ইপিসিএস- বর্তমানে বিসিএস) অধীনে চট্টগ্রামের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম সুনামগঞ্জ,পাবনা ও সিরাজগঞ্জে

 ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সদরে সাব ডিভিশনাল কর্মকর্তা, ৪ জানুয়ারি ১৯৮২ থেকে ২১ অক্টোবর ১৯৮২ রাজশাহীতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১ নভেম্বর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সারিয়াকান্দি বগুড়াতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক, ১৯৮৯-৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে মন্ত্রীর একান্ত সচিব, ১৯৯১ সালে মৌলভিবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভুমি মন্ত্রণালয়ের ভুমি জরিপ অধিদপ্তরের উপ মহা পরিচালক, ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং সর্বশেষ ১২ মে ১৯৯৯ সাল থেকে দুই বছর চুক্তি ভিত্তিক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলিক পরিষদের সর্বপ্রথম মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন এক ছেলে ও‌ দুই মেয়ে সন্তানের পিতা। তার একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী অনুপম তঞ্চঙ্গ্যা বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী। অনুপমের বড়বোন জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা স্বপরিবারে দুবাই ও ছোট বোন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জয়া তঞ্চঙ্গ্যা অষ্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেন। স্ত্রী নিরুপমা তঞ্চঙ্গ্যা ২০১৬ সালে পরলোক গমন করেন।

এবং জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা গত ৮ জানুয়ারী ২০১৯ সোমবার বিকাল ৩ টায় রাঙামাটি শহরের পূর্ব ট্রাইবেল আদামের নিজ বাস ভবনে বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি পরলোক গমন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। প্রয়াত জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা তিনি এক ছেলে দুই মেয়ে সহ আদিবাসীদের মধ্যে ১ম বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজনকে রেখে যান।

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাঃ একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে জন্ম

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সাহিত্যটা গড়ে উঠে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে বিশেষ করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যটা। জুম চাষের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাহিত্যের স্বপ্নগুলিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং জীবনের বীজ বুনতো। তঞ্চঙ্গ্যারা এই জুমকে ভালোবাসে এবং এই জুম সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা সেই স্বরণাতীতকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। স্বরণযোগ্য যে বর্তমানে যারা তন্চংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত, এককালে তারা দাইনাক বা দৈনাক পরিচয়ে আরাকান বা মায়ানমারের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য দান্যাওয়াদি থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। পরবর্তীতে তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে কক্সবাজার, টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী তৈনছড়ি-তৈনগাঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির অন্যান্য অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলার রইস্যাবিলি রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে। তবে কক্সবাজার এবং টেকনাফের তঞ্চঙ্গ্যারা এখনো অনেকে চাকমা পদবী ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন তঞ্চঙ্গ্যার ‘মো’ গছাদের মতো। আবার অনেকে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে আসল চাকমা বলেও মানেন, এটি অবশ্যই ইতিহাসের পাঠ্য। পরে অনেকে কাপ্তাই বাঁধের নতুন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী ও স্বীকার পরবর্তী বাসিন্দা ভারতের নানা প্রদেশ। সাধক কবি শিবচরণ, রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থির এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি আজ একটি  আলোকিত জাতি হিসেবে স্বকৃীত।   

আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকে একটি চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত, তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিয়ে। আমি যতটুকু জানি তঞ্চঙ্গ্যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলি তঞ্চঙ্গ্যাারা রক্ষা বা লালন-পালন করতে পারেনি এটি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ব্যর্থটা নয় এটি ঐতিহাসিকতার ব্যর্থটার ফল। 

তন্চংগ্যাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল শুধু এই কথা বলে বসে থাকলে আমাদের চলবে না,চর্চা এবং লালন-পালন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মুলতঃ এই আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্চংগ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রকাশনা বের করার চিন্তাটা প্রথমে আমার মাথায় আসে যখন আমি ২০০১-০২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্র্তি হই। তাছাড়া আমি যতদূর জানি তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়মিত কোন প্রকাশনা বের হয় না। পরে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকাশনা বের করার। অনেক নাম প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অজয় দা’র (অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা) দেওয়া নাম ‘পহ্ জাঙাল সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এরপর ১লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৩ ইংরেজী পহ্র জাঙাল প্রথম সংখ্যা সফলভাবে প্রকাশিত হয় এবং উদ্বোধনী সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন পলাশ তন্চংগ্যা। ১১ই এপ্রিল’০৩ ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এটির প্রথম সংখ্যা মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে অবশ্যই বলাকা, বিষু, ছিনা-মোইন(২০০২)এক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পহ্র জাঙাল এর হাত ধরে তৈনগাঙ, রাঙাফুল, ন-আ শমন প্রকাশ হয়। তৈনগাঙ এখনো নিয়মিত প্রকাশ হলেও বাকীগুলো কিছু সংখ্যার পর আর প্রকাশ হয়নি। তবে প্রতিটি সংখ্যায় এক ঝাক প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আগমনীর বার্তা আমাদের আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণীত করেছিল।তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- 

(ক)    প্রথম ভাগে– সাধক শিবচরণ এবং ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী

(খ)     দ্বিতীয় ভাগে– রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র 

তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির,ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির,যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর 

কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

(গ)     তৃতীয় ভাগে– লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যাড.দীন নাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, 

ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন),পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় 

বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা,উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা 

(মনিচান), দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা। আরো অনেকে। 

 ক. প্রথম ভাগের লেখকদের মধ্যে আমি তন্চংগ্যা সাহিত্যের পটভূমিকার সমৃদ্ধ বীজ লক্ষ্য করি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেও এই লক্ষণটি সম্প্রসারিত হয়। যদিও প্রথম ভাগটি শুরু হয় মধ্যযুগীও সাহিত্যের সাথে মিল রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে। এটি মূলতঃ লেখকের সাথে সময়ের একটি যোগসূত্র, আমরা এটাকে সময় বা সমাজের চাহিদাও বলতে পারি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভাগের রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের লেখার মধ্যেও এই লক্ষণটি স্পষ্ট। তবে এখানে ইতিহাসও যোগ হয়েছে। মূলত একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের জন্ম। যা জাতি হিসেবে যে কেউ গর্ববোধ করতে পারে। তারা সমাজ এবং ইতিহাসকে সাথে নিয়ে বাংলা, তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা ভাষায় এইসব রচনা করেন। 

খ. দ্বিতীয় ভাগের প্রত্যেকটি লেখক সমাজ সচেতন ও প্রগতিযশা ছিলেন। সমাজ ও জাতির জন্য তাদের অবদান অনেক। রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যার নিজস্ব হস্তচালিত প্রেস ছিল। সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রেস। এখানে উল্লেখ্য যে, বিংশ শতকের দিকে এসে ‘গৈরিকা’(১৯৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের একটা ধারা সৃষ্টি করলেও তার আগে কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’(১৯৩১),‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’(১৯৩৩) রচিত হয়। তার এই ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’পয়ার ছন্দে রচিত একটি মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। এই প্রেক্ষিতে তন্চংগ্যা সাহিত্যিকগণই গৈরিকার পথ প্রর্দশক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ধর্ম-সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি (ড.মনিরুজ্জামান, পহর জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা-২০০৮, পৃষ্ঠা-১০)। এই পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাাকে রাজা ভুবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে ছন্দ বাক্য রচনা করতে পারতেন(তথ্যঃ এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা)। ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’ সম্পাদনা ও সংশোধিত আকারে প্রকাশের জন্য রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক ‘পন্ডিত’ এবং রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রিয়দর্শী ভিক্ষু কর্তৃক ‘উদয়ন বস্তু’ রচনার জন্য তাকে ‘কবিরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট্য ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাকে ‘পাহাড়ী বাংলার কবি’ বলেছেন। তার কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক (কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) তাঁর পুত্র দিলিপ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার মাধ্যমে উদ্ধার করেন ১২ই জুন ২০০৮ সনে রাজস্থলী থেকে। তার এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক দায়িত্ব নিয়ে ‘পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ’ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে রাধামন ধনপতি কাব্য, বিজয়গিরি, মানুষ দেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সবার ক্ষেত্রেও পহ্র জাঙাল একই আগ্রহ পোষণ করে।  আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিস্তারে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রাজা ত্রিদিব রায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ‘রাজগুরু’ পদে বরণ করেন। এর আগে রাজা নলিনাক্ষ রায় কর্তৃক শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরকেও (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা) ‘রাজগুরু’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত‘ষষ্ঠ বিশ্ব বৌদ্ধ মহাসংগীতি’তে একজন সংগীতিকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। তারই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজক কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপন্ডিত উপাধিতে সম্মানিত করেন। এছাড়া ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক তাকে ‘অগ্গমহাসধম্মজোতিকাধ্বজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এর মাধ্যমে সম্ভবতঃ পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে তন্চংগ্যারাই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার সুবিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘রাউলী’ সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়। সেসময় রাউলী সম্প্রদায় চাকমা ও বড়ুয়াদের ধর্মীয় পুরোহিত হিসেবে ছিলেন। এই অগ্রবংশ মহাস্থবির ও ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের অপ্রকাশিত অনেক লেখা রয়ে গেছে। এই লেখাগুলি ছাপানোর ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন এবং বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কারণ এগুলি আমাদের জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। আমি যতটুকু শুনেছি এরই মধ্যে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুযোগে কেউ হয়তো নিজের নামে চালিয়ে বা ছাপিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যেটা হলে আমরা ঠিক আগের মতো ঐতিহাসিক ভাবে আবার ভুল করবো বা ভুল করতে যাচ্ছি।

 গ. তৃতীয় ভাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। তার লেখার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণাদায়কও তিনি। আমার জানা মতে ১৫-২০টি পসন এবং ৩৫০-৪০০টি প্রবাদ তার সংগ্রহে রয়েছে যা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ড.মনিরুজ্জামান স্যারকে তার ‘প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ’(৫ম সংখ্যা, ৯ই আগস্ট-২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) লেখার জন্য এই প্রবাদ সংগ্রহশালা থেকে লেখক রেফাসেন্স হিসেবে সংগ্রহ করে দেন। ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাসের পুরনো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত ‘আদামর ফুল’ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ যা পহ্র জাঙাল প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আর এ্যাড. দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ নামে একটি লেখা ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র ৫ম ভলিউমে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘বাংলা পিডিয়া’তেও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। নারী লেখিকাদের মধ্যে পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা অগ্রগামী, পুরো পার্বত্য অঞ্চলেও তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তার লেখা সাহিত্যগুলি জুম্ম জাতি ও নারী সমাজকে আলোড়িত করে। পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা নারী লেখকের প্রতিনিধি। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘পহ্র জাঙাল’ প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং উদ্যেগটা। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। তার মোট প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় ১৫-২০টি। তার লেখা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (বাতকস) এর মুখপত্র সিঙকাবা এর প্রধান সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত আদিবাসীদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রদেঁভু’ এর তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাস এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘খৈয়ুম’ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূপছায়া’ এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্ভবত তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক।   

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাটি এগিয়েছে কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান এবং সময়ের পটভূমিকে কেন্দ্র করে।

১. জুম সাহিত্যঃ 

পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুম চাষের জন্য প্রতি বছর উর্বর জায়গার সন্ধানে পাহাড়ের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরীত হয়। যার ফলে তাদের জীবনচক্রও গড়ে উঠেছে এই জুমকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের জীবন ধারণ এবং সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে জুম উঠে এসেছে খুব সহজে। যেটি আমরা লক্ষ্য করেছি তন্চংগ্যাদের আদি সাহিত্যের মধ্যেও। বারোমাস,উভাগীত,পসন্,ধাঁধা,কবিতা,ছড়ার মধ্যে আমরা এই জুমকে খুজে পাই। এই জুমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পালাও রচিত হয় তার মধ্যে ‘জুম কাবা, রাইন্যা বেড়ানা পালা’ অন্যতম। ইতিহাস বলে তৎসময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও চিত্ত বিলাসের অন্যতম স্থানও এই জুম। যেটি গিংগুলী গানের গায়কের কন্ঠে আমরা লক্ষ্য করি। বিষ’ুর সময় যে পাইসন রান্না হয় তার বেশী ভাগ সবজি কিন্তু পাওয়া যায় এই জুম থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড়(পিনউন, খাদি, মাদা কাবং, পা-দুরি, সালুম) বুননে যে ফুল গুলি ব্যবহার করা হয় তার বেশীর ভাগ নাম এই জুম সবজি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায়(এম.এল.ই) যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওখানেও জুম বিষয়ে গল্প, ছড়ার বই ও থিম পিকচার করা হয়েছে। বর্তমানের লেখকদের মধ্যেও এই জুম সংস্কৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

২. সাধক শিবচরণ এবং গসাইন্ লামাঃ

আমরা কম-বেশী সবাই শিবচরকে কবি হিসেবে চিনলেও কিন্তু কবি’র চেয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাধক বা ব্যাদি হিসেবে বড় ছিলেন। ব্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এই আছে এই নেই,তারা মুহুত্বের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তারা চারিযুগ অমর এবং যমসুরী। এই চারিযুগ হচ্ছে-সত্যযুগ,দ্বাপরযুগ,টেট্টাযুগ ও কলিযুগ। শিবচরণ শৈশব কাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। জগৎ সংসার থেকে মুক্তিই যেন তার একমাত্র নেশা। তার আধ্যাত্বিকটা মা,ভাই ও ভাবীকে ভাবনা এবং চিন্তার দোলাচলে ফেলে দিলেও মাঝে মধ্যে বৎসনা করতেন জগৎ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা দেখে। 

শিবচরণ ‘মানবজন্ম’ এবং ‘ফুইরা আলাম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেন। ‘মানবজন্ম’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের শরীরগত বিদ্যাকে নিয়ে। শরীর কি,শরীর কি দিয়ে তৈরী বা গঠিত হয়েছে,শরীরের কোথায় কি আছে,কার কি কাজ ইত্যাদি বিষয়কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘ফুইরা আলাম’ গ্রন্থে তন্চংগ্যাদের ৩৬(ছত্রিশ)টি অক্ষরের(বর্ণমালা)বর্ণনা আছে। যেগুলোকে  ‘আন্জী অক্ষর’ বলা হয়। আনজী অক্ষর হলো-একটি অক্ষরের ‘গভীরতম অর্থ’ যেখানে সৃষ্টির পেছনে কারণ বা রহস্য নিহিত থাকে। যেমন-‘অ’তে বুদ্ধ অনিত্য বুঝেছেন। এই অক্ষরগুলো মাধ্যমে পুরো শরীরের অবস্থান,অংশ বা গঠনকে বুঝা যায়। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার কোথায় অবস্থান এই আনজী অক্ষর দিয়ে নির্ধারণ এবং চিহ্নিত করা যায়। বৈদ্য বা কবিরাজ-রা এই আনজী অক্ষরের মাধ্যমে ‘নাড়ীবেদ’ পরীক্ষা করে রোগী চিকিস্যা করে। এই বিষয়ে প্রত্যেকটি বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। ‘মানবজন্ম ও ফুইরা আলাম’ দুটো গ্রন্থের ভূমিকা হচ্ছে মূলতঃ গসাইন বা গোসাইন লামা। শিবচরণ সাধক বা ব্যাদি ছিলেন। (তথ্যঃ বৈদ্য ফুলেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা,গর্জনীয়া পাড়া-ওয়া¹া,বয়স:৬৫,তারিখঃ১১/০৯/২০১০,রোজ শনিবার)। তিনি তার গসাইন্ বা গোসাইন্ লামায় উল্লেখ করেছেন যে,“সাকিন্ ছালাম য্যং মুই কাপ্তেই গাং,মানিয়া পুরীত্তুন্ তুরি যাং” অর্থাৎ সাকিন কাপ্তাই গাঙকে ছালাম জানিয়ে,আমি মনুষ্য ধরাধম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে,চাকমারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গোজেন বলে না। তারা বলে গোই(ঐ)। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গসাইন বা গোসাইন বলে। তাছাড়া আমি আরো লক্ষ্য করেছি যে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান কর্তৃক সংগৃহীত ‘চাকমা ভাষায় শব্দ কোষে’গ্রন্থে(সুগত চাকমা কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯৬ সনে প্রকাশিত) গোজেন শব্দটি অনুপস্থিত। গসাইন বা গোসাইন লামা গ্রন্থ থেকে জানা যায় শিবচরণের জন্ম ১১৮৪ মঘী বা মঘাব্দ আর ইংরেজী সন হচ্ছে ১৮২২ সাল। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)

এই সাধক বা ব্যাদি শিবচরণের জন্ম কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ে। আবার অনেকের মতে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত রাজস্থলী বাজারের নিকটবর্তী বাজার নাড়ামূখ পাড়া গ্রামে। লক্ষনীয় বিষয় দুটি নামের মধ্যে কিন্তু একটা শব্দগত মিল আছে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে এই পাড়ার পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নাম কাইত্তি গাঙ বা কাপ্তাই নদী। তাছাড়া আগে কাপ্তাই,বিলাইছড়ি,রাজস্থলীটি চন্দ্রঘোনার থানার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এই পাড়ার গ্রামবাসীরা এক সময় মাতামহুরীর তৈনগাঙে বসতি স্থাপন করেন। আমরা যদি ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখব তন্চংগ্যারা আরাকান থেকে এসে প্রথমে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা ছোট ছোট অংশে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে(রাইংখং,কাপ্তাই ওয়া¹া অঞ্চল)। আর তারা আরাকান থেকে আসার সময় কাল্লাঙের (ঝুড়ি) করে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে আসে।(রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)। পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণে তারা তাদের এত দিনের বাসস্থান(কাপ্তাই)ছেড়ে আবার তাদের আদি বাসস্থান মাতামুহুরি নদীর উপনদী তৈনছড়িতে চলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সবাই অবগত যে তৈনছড়ি বা তৈনগাঙ এর সাথে তন্চংগ্যাদের ইতিহাস অতোপ্রতোভাবে জড়িত আর এখানেই কিন্তু শিবচরণের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। এই ঐতিহাসিক যুক্তি বা তথ্য থেকেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় কিনা-কবি শিবচরণ তন্চংগ্যা জাতির গর্বিত সন্তান ছিলেন। তার রচিত গসাইন/গোসাইন লামা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এর সাথে গেঙ্গুলী বা উবাগীতের পালা,বারোমাস,গল্প,প্রবাদ-প্রবচনের মতো ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলিও দাবীর তালিকায় থেকে যাচ্ছে। কারণ শিবচরণের গসাইন লামার সাথে এইসব সৃষ্টির একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যদি উল্লেখিত বিষয় বা মতগুলি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয় তাহলে আমি বলবো পার্বত্য জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস বিশেষ করে চাকমা জাতির ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন করে ভাববার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বা সময় এসেছে।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা, বর্ণমালা ও ভাষার বই

 তন্চংগ্যাদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বর কোমল ও নরম। উচ্চস্বরে এবং গলা তুলে কথা বলা তাদের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাদের স্বরের মধ্যে সবসময় নরম ও কোমল টান লক্ষণীয়। বর্তমানে এসে ভাষার আদিরূপটা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন লক্ষনীয় হলেও বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা নিজ ভাষা ব্যবহার ও চর্চাকে অধিকারবোধ থেকে চিন্তা এবং বিচার করে। তারা সবসময় সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকে চর্চার অভাবে নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কিনা বা অন্যের ভাষার প্রভাবে নিজ ভাষা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষনীয়। জানিনা তারা নিজেদেরকে অভার র্স্মাট বা অতি বিশ্বায়নী হিসেবে ভাবেন কিনা। আমি ভাষা জানাকে প্রয়োজনীয় হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের সমৃদ্ধ ভাষাকে ছেড়ে অন্যের ভাষাকে নিজ মাতৃভাষার মতো ধারণ এবং চর্চাকে প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। ভাষার মধ্যে দিয়ে কিন্তু জাতির পরিচয় ফুটে উঠে বা বহন করে। ভাষার মাধ্যমেই জানা যায় কে কোন জাতির বা জনগোষ্ঠীর লোক। এই মাঝে ভাষা নিয়ে নিজের একটা চোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- একদিন অফিস থেকে বের হয়ে গরু দুধ কিনব বলে দোকানে গিয়ে দোকানিকে (দোকানি ৪০/৪৫ বছর বয়সের একজন চাকমা ভদ্র মহিলা) বললাম তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়- ‘ম-ই গোরু দোউত্ আহে’ ( মাসি গরু দুধ আছে)। আমার কথা শুনে দোকানি বলল- আছে। আমার কথা শুনে চাকমা ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- তুই কি তঞ্চঙ্গ্য নে ? আমি বললাম হ্যাঁ। পরবর্তীতে আমি চিন্তা করলাম শুধুমাত্র ভাষার জন্য হয়তো উনি আমাকে ‘বাবু আপনি তঞ্চঙ্গ্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন বা চিনতে পেরেছেন। না হলে হয়তো উনিও দশজনের  মতো চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে আমাকেও একজন চাকমা বলে জানতেন। সুতরাং শুধুমাত্র ভাষার কারণে উনি আমাকে তন্চংগ্যা হিসেবে চিনতে পেরেছেন, অন্যথায় নয়। হয়তো এই উপলদ্ধি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন আগে নিজ ভাষা গাথুনী পরে অন্য ভাষা। কারণ আমি বুঝি আমি যদি আমার ভাষা চর্চা বা ব্যবহার না করি অন্য কেউ এসে তা করে দিবে না। আর সেটি চর্চার অভাবে কোন একদিন হারিয়ে যাবে। আর আমরা সবাই অবগত প্রতিদিন পৃথিবী থেকে দুই/একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তন্চংগ্যাদের ভাষাও যে হারিয়ে যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তঞ্চঙ্গ্যাদর ভাষা ও বর্ণমালা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ১২টি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যেও নিজস্ব বর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা এবং বর্ণমালা নেই তাহলে তিনি আইনগত অপরাধী হিসেবে গন্য হবেন। এর আগে অবশ্যই বর্ণমালা ব্যবহার ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা বৈদ্যরা অগ্রগামী। তবে শুনে এসেছি তন্চংগ্যা বৈদ্যরা যে বর্ণমালা ব্যবহার করতেন সেগুলো নাকি চাকমা বর্ণমালা। পরে ইতিহাস পাঠে জেনেছি তঞ্চঙ্গ্যারা যদি আসল চাকমা হন তাহলেতো এই বর্ণমালাগুলি চাকমা বর্ণমালা পক্ষান্তরে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সাথে বর্তমান উভয়(তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা) বর্ণমালার একটা সাদৃশ্যের ঐক্যমান লক্ষণীয়। যেটি চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- তঞ্চঙ্গ্যারা অধিক মাত্রায় বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে (কিছিম্যা কা, গছিম্যা খা, চাইন্দ্যা গা- খাই, যাই, গাই ইত্যাদি) এবং কথা বলেও আ-কারান্ত দিয়ে। আর চাকমারা তাদের বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে কিন্তু কথা বলে অধিক মাত্রায় এ-কারান্ত দিয়ে(চুচাঙ্যা কা, গুজাঙ্যা খা, চান্দ্যা গা-খেই, যেই, গেই ইত্যাদি)। একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে এই বিষয়টি আলাপ করলে তিনিও গবেষণার যোগ্য এবং লক্ষণীয় বিষয় বলে মত দেন।

অনেক আগে থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা থাকলেও সেটি কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। পরে ভারতীয় এক গবেষক রূপক দেবনাথ বার্মা, ভারত ও বাংলােেদশ ঘুরে একটা সাজানো এবং গোছানো রূপ দাঁড় করান। একে সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যাকল্যাণ সংস্থা(বাতকস)। মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যারা ‘তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার একটি গোছানো রূপ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে  রূপক দেবনাথ ও এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার অবদান স্বরণীয়। আর সফ্ওয়ার উন্নয়নে জন্ ক্লিফটন্। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য স্ববর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানে গল্প বই(বিগ বুক),ছড়া বই(শুনার গল্প),বর্ণমালার বই,বর্ণমালা চার্ট,নাম্বার চার্ট,কার্ড এবং অংক বই প্রকাশিত হয়। সাথে আরো ছবি সম্বলিত সিরিজ পিকচার এবং থিম পিকচার প্রকাশিত হয়। এগুলি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাও কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা(মাল্টিলিংগুয়াল শিক্ষা অফিসার যখন ছিলেন)। এই শিক্ষা কার্যক্রমে গল্প ও ছড়া লেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন-সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা,লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, মিলন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা,বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা (কুতুবদিয়া)। আর বর্তমানে ক্লাস ওয়ানের উপযোগী ‘আমার বই আর গণিত বই’ তৈরী করার কাজ চলছে। আর এইসব বই বা উপকরণ তৈরীর জন্য ১৫(পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটিও আছে।

৪. লোকসাহিত্যঃ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অন্যতম অহংময় উপাদান হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য্যময় লোকসাহিত্যের ভান্ডার। সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আচার-আচরণের সাথে নিত্যদিনের কর্মকান্ডে এবং চিন্তা ভাবনা এই সাহিত্য ফুটে উঠছে। তার মধ্যে উবাগীত, প্রবাদ, ধাঁধা, গল্প, ছড়া ও বারোমাস উল্লেখযোগ্য।

উবাগীতঃ আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল গেঙ্গলী/উবাগীতের অনুষ্ঠান। নবান্ন উৎসবে এই গানের আসর বসত। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় কীত্তনের পাশাপাশি এই গেঙ্গলী গান হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানেও এই গানের আয়োজন হতো। যারা এই গানের রচয়িতা তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান অকল্পনীয়। তারা তাদের চিন্তাকে সুপ্রসারিত করেছে সে সময়ের জ্ঞানকে আশ্রয় করে। বিশেষ করে তারা রোমান্স ও ইতিহাসকে সাথে নিয়ে এই অমর সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছে। এই গানে একটা সুর থাকত যেটা আমরা পাহাড়ী বা আদিবাসী সুর বলি। এই সুরের সাথে প্রাকৃতি,ঝর্ণা,পাখির কূজন,বনভূমি একাকার হয়ে যেত। যেন স্বয়ং প্রকৃতি সুর দিচ্ছে, সুর তুলছে এবং সুর মিলাচ্ছে। এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি কাহিনী থাকে এবং পঙ্তির শেষে অন্ত মিল থাকবে। আর এটি গাইতে হয় বেহেলা দিয়ে। এই গেঙ্গুলীদের মধ্যে জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। যাকে সবাই কানাগেঙ্গুলী হিসেবে চিনে। স্বরস্বতীর অকৃপন কৃপায় তিনি অসাধারণ অনুভূতি শক্তি ,স্মৃতি ও মর্মাবধারণ সম্পন্ন সেকাল একাল শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ভূবন মোহন,নলিনাক্ষ ও ত্রিদিব রায় এই তিন রাজার অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষ রায় তাকে ‘রাজগেঙ্গুলী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। সেই অগনিত নাম না জানা ত্যাগী, গুণী ও জ্ঞানীদেরকে অসীম নমঃ নমঃ এবং জয়তু। এই রকম কিছু পালা বা রচিত সাহিত্য তন্চংগ্যা সমাজে খুবই পরিচিত। 

উবাগীতের পালাসমূহঃ জুম কাবা পালা,রাইন্যা বেড়ানা পালা,নাকসু ফুল পারা পালা,ঘিলা পারা পালা,রদংস পালা,বার্কী ধরা পালা,চাদিগাঙ ছড়া পালা,রাধামন ধনপতি পালা,লক্ষী পালা,ধর্ম পালা,রিজার্ভ পালা,অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা(রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা),লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা,মেদঙা-মেদঙী পালা,মিয়াধন-মিয়াবী,কুঞ্জধন-কুঞ্জবী,নিলংধন-নিলংবী,কামিতধন-কামিতবী,হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন তাদের মধ্যে অন্যতম।(পালাগুলি লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) নিম্মে একটি উবাগীতের পঙ্তি দেওয়া হলো-

             নানান-ভই-চর নানান রং,

             ধানে সুধায়  উ-ল সং।

             ধান ছরাত ধুল্ল রঙ,

             গাবুজ্যা গাবুরী উলাক সং।

             দেবংশী ফুলর গিলার তাক্,

             আদামত্ বেড়াইদন গাবুরী ঝাক।

             উদানত্ খেলিদন্ গুরালক্,

             পাল,পাল বেড়াইদন্ গাবুরলক।

             উরায় বইয়ারে তুলা-নি,

             আইছ্যা গাবুর লক্কুন কি গরন্ কি জানি।

             ই-চ-র মাদাত ধান তলই,

             জলা-জলি গাইততন্ গাবুরীলই।

             মিল্লা ধানতলই কুরায় খায়,

             কি জানি পরান বিরে আইছ্যা কন্না পায়।

             পশ্চিমে ডুবেল্লই পুব বেল,

             চুবে-চাবে গাবুজ্যা গাবুরীরে কই গেল।

             জুন পইজ্যা ভূই আদে,

             পরান দ ন জুড়ায় তুই বাদে।

             কদান কইনে লাঙ্যা দা গিয়ে গই,

             ঘর উবরে উইচ্ছে গই।

             ঝুবুক গাইছত্ পাইছ্ বাহ্,

             বাঁশি বা-ধল্লই লাঙ্যা দা।

             বাঁশী র শুনি মন কানে,

             ইন্দি লাঙ্যাবী চন রানে।

             চন তাবা চিদলে,

             লাঙ্যাবী মন দি ন পারের গমে দোলে।

             চনান উদুরাই পরেল্লই পেলাত্তুন,

             ঔল গুরি ভাত পেলা বাদ দি-লই নুন।

             জুরি পজ্যেই বু-য় খাদিয়ান ,

             মাদিত্ পজ্যেই কাদিয়ান।

             ধারা বা-ই-নে পরের ঘাম,

 লাঙ্যাবীত্তুন আদত ন উদের কন কাম।। (বি.এন তঞ্চঙ্গ্যা,আদামর ফুল। পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা)

প্রবাদ/ধাঁধা/গল্প/ছড়া

ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে অনেক গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধা শুনেছি। আবদার করতাম সময় সুযোগ পেলে। বিশেষ করে যখন অবসরে থাকতাম সবাই। আর সঙ্গী-সাথী ও ভাই-বোন মিললেতো কোন কথায় নেই। প্রবাদ ও ধাঁধা ধরাধরি করতাম কে কতটা বলতে পারে। মাঝে মধ্যেতো এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি হতো তবে সব কিছু সাময়িক পরে আবার ঠিক হতো। এভাবে অতিবাহিত ছোট বেলার প্রত্যেকটি দিন। মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেটাম মা-বাবারা যখন রাক্ষস বা ভূতের গল্প বলতেন। তবে রাজপুত্র যখন রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন রাক্ষসপুরী থেকে তখন আবার ভয় না পেয়ে খুশী বা মজাই পেতাম বেশী। 

তঞ্চঙ্গ্যাদের গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধার মধ্যে প্রকৃতির সাথে মানবিক ভারসাম্যতা বিদ্যমান। এখানে প্রতিটি বাক্য এবং চিন্তার সাথে প্রকৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সাথে আরো আশেপাশের প্রাণীকুল। তাদের নিত্য দিনের জ্ঞান,স্বভাব,অভ্যাস এবং আচরণগত নানা দিক। তন্চংগ্যারা প্রকৃতির সন্তান বলে তাই তাদের চিন্তার সাথে প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তারা প্রকৃতির মতো কোমল-নরম,বিনয়ী,নম্রভাষী এবং লাজুক। প্রকৃতির মতো তাদের হাত পাথার(ভিক্ষা)কোন অভ্যাস নেই। কাউকে সহজে বড় কথাও বলতে পারে না। কথাবার্তা সবসময় সংযত। তন্চংগ্যাদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে চিন্তার সাথে তাদের আচরণগত ভারসাম্যতা । তাই তাদের প্রত্যেকটি সাহিত্যবার্তা বা সৃষ্টিবার্তার মধ্যে এই আচরণ ও অভ্যাসগত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্মে সে রকম কিছু প্রবাদ,ধাঁধা ও গল্প তুলে ধরা হলো-

(ক) কিট্সা/ দা-অ কদা/প্রবাদঃ 

পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান, মুয়ত জয় মুয়ত খয়, পেদৎ বোক মুয়ত লাইত, এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কা(আ)ড়া, নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান, মরা বাই-স সমারে জেদা বাই-স পুরি জান, আক্কল বাধি অনা, ইচা শুউনি অনা, ইহিম কামত্ ফল পানা,উসুনা কুড়ায় ডাক কারা না, কুড়া লাইত্, চি-ল দরে কুড়া ছ ন পুছানা, সিনডালে-অ লো ন নিড়ানা, মুঅ গুনে ব্যাঙ মরা, ঠেঙ(অ) কোইত্ ঊরি দেনা, দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা,পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্, গুউত্তুন মুত্ গম্ অনা, রাঙা কালা মু অনা, ভুত্তোয়্যা কুউরে রোঙ কারা-না, আইদে আইদে ধদাডোদি টিক্ষ্যা কা(অ)রা গুরি, দা-শি দিলে নাচি খায় সবা-ইত্ ন পালে মা-ই খাই, ইসা-ব(হিসাব)গোরু(গরু) বায়ে(এ) খাই, খাঙ ন খাঙ ন খাঙ বালা যাঙ ন যাঙ ন যাঙ বালা, মুয়ত যউক পেদৎ ন যউক,বায়ু ফিরানা, নিমায়া নিতু,চিয়ন পআ কদা কুরা গু,সর্গ গু ন চিনা না,টাউ সুমা,ছাঅ-ল কানত্ মন্ত্র বরায় দেনা,আইছ কানত্ কুউরে বোউ না,সাপ্য়া উলে পুদাই দ ব্যাঙয়্যা উলে লাফাই দ,আগে গেলে বা-য় খায় পিছে তালে সোনা পাই । (ড. মনিরুজ্জামান,প্রবাদ ও তন্চংগ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ- পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত )

(খ) ধাঁধাঃ 

এক কা-য়া খালে এক কা-য়া তায়(শামুক), মাদি বিধিরে রোউত্ পুদি(হলুদ),ফিরের গুর গুর ফাদের মাদি(লাঙ্গল), মাদিত্তুন অচল ঘরততুন নিচল(মাচাং), মা-বা কানে ছ-বা দাঅর অই(নাদি সিরা/নাতাই ও সুতার টুম), ধুজ্যা সাগরত্ থালা ভাস্ন(তারা), আকাশত্ ঘর পাদালত্ দুয়ার কোই ন পাইলে খাবে চয়ার(বাবুই পাখির বাসা), ন পালে তয়ায় পালে ন আনে(পথ),গাইচ বুরে পানি কয়া(ডাব), এক বুজ্জ্যা খান দ্বি-বুজ্জ্যা চায় তান(মুখ ও দুটি হাটু), চিয়ন লক্কে কাদা বুড়া উলে পাদা(শন), বিল ছোয়ালে বয়া মরে(কেরোসিনের বাতি), বাঁ ঘরত্ বুজ্জ্যা দুদ্দুরায়(খই ভাঙ্গানো), ঘর আহে দুয়ার নাই মানু-অত্ আহন র নাই(উই পোকার বাসা), দুইল্লে এক মুঠ ইরি দিলে এক্ বেদেরাং(জাল), আখা আহে দুছা নাই দেল্লা আহে পাদা নাই(স্বর্ণলতা), বুক ডুব বিছি কালা কদা কয় মধুমালা(বেহেলা), কাইদে গুলা বুদুনী নাই(ডিম), এক বুজ্জ্যা কদা কয়(বই),শিরা নাই বুজ্জ্যা মানইত্ গিলে(শার্ট), একুল পানি ওকুলত্ যাই(মদ), আহা কাবিলে দুসা মরে(গাঙ), চাইত্ উবা খাইলত্ লেত্(দোলনা), রাজার আইত্ লেজত্ দোইলে কাইত্(ঢেঁঙি), লুদি টানিলে মোইন গুচুরে(কিংখরঙ), এরিং বিরিং তিরিং বাই চোক দ্বি-বা তার মাদা নাই(কাকঁড়া)। (লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) 

(গ) পস(গল্প)

কলাত্থুর কন্যা,বাঘ ও শূকরের মিতালী,তেন্দেরার পচ্ছন,দুলুক্কুঙী,পিত্তয়া চান,চিমুজ্যার লুক্ষীবর পানা,পুরীকন্যা মানোহারী,নিতাং সুতাং,রাঙকাইত্ বুলির সর্গ মারা না,মানিক পুদি কন্যা,বেঙ্গমা-বেঙ্গবী,টুনটুনি ও কুস্যা ব্যাঙ,ভূতের গল্প, কুজ্যা কুইনি পসন,বুজ্যা বুড়ির পিদা খানা,মিত্তিন্যা পসন,কবী-ধবী,বেঙ্যা,বান্দুরী,আল্চিয়া,ভলা গুরু,দুলোক কুনি,মিরা রাচা,সুবাত্তুরী আ পেত্তয়া ফিউং,আলচিয়া মিদি ঙ্যা,এক বিগৈইশ্যা,গুল চিনা,ভুলা-ভুলি,শেয়াল্যা আ হ্আইতস্যোয়া,বুজ্যা-বুড়ী আ বাঘ্যা,বুড়ী আ ভুত্তোয়া,বেলেই কন্যা,খুস্যোয়া বেঙ আ সুবাত্তুরী,শুগ মা,রাচা ভাগান্যা নাক্কোন্ চিলা,কাইত্ কন্যা,শুগবা বাঘ্যা আ পেচাবা,বুজ্যা বুড়ী,দাদু ঙ্যা দাদুঙী,মিরা আ পারান্ বন্,চানমুনি সূর্য মুনি,আল্চিয়া,ঊইঙোয়া আ কবাবা বন। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

(ঘ) ছরা/ছআ (ছড়া) ঃ 

ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের একটি উর্বর উপাদান। আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক ছড়া দেখেছি বিশেষ করে ঘুম পাড়ানী ছড়া। এই রকম ঘুম পাড়ানী ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করি। মা যখন জুমে যায় কাজ করতে তখন ছোট ভাই-বোনকে লালন পালন করতে বড় ভাই-বোনকে যে কি রকম বিড়ম্বনা সইতে হয় এই ছড়ার মধ্যে তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর সময়। এই ঘুম পাড়ানী ছড়া ছাড়াও আরো আছে খেলাধূলা(৬ নং ছড়া)আর রোমান্টিক টাইপের কিছু ছড়া(৪নং ছড়া)। 

    (১)   নাক্সো গাইছর রিয়াং জু,

               দোলউন্ বুনি কেরেং জু।

               কেরেং দোলাইত্ কেরেক চাক্,

               উয়াং দইত্তন ঝুইতগি থাক্ ।

       (২)    ডুলু বাইছর দোলইন্,কাই-জ্যা উদাল দুরি।

               ঘুম যাবদে ম লক্ষোবা,সোনা দোলইনত্ গুরি।

       (৩)   বেঙয়া দরের করক করক,ভাইজ্যা ডুবাত্ তলে।

               লক্ষোবিরে বৌ দিবং, রাঙা শুক্ষোর বারে।

       (৪)   জুম লেছাত্ উবা কইন, 

               সমারে বেরাইদন্ দ্বি-বা বইন্।

               দ্বি-বইনত্তুন কন্ন্যা লইন,

               দাঅর বইন্যা ন পালে, চিয়োন্যা লইন,

               কারে-য়-ন পালে , মৈন্ছাঙ অইন।

(৫)       আম পাদা তেল তেল,কাট্টল পাদা বেল।

  ম-হ(অ)াদত্ ভাত্ জরাবা , লক্ষো পেদত্ গেল।

  ভাততুন খাইনে দাঞর অইনে, কোন্ দেশত্ গেল ।

       (৬)   আম পাদা লক্ষণ, তরে মাইত্তে কদক্ষণ।

              আমত্ তলে সমালুং, বরই কাদা ফুদা লুং।

              বরই কাদা এদক বিদ, তিবিরিত তিবিরিত।

              শমই পাদা লরে চরে, তরে লড়াইদে বল্ পড়ে। (বি.এন তন্চংগ্যা থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

৫. পার্বত্য চুক্তি ও সাহিত্য চর্চা

১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সাথে প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একটা নবজাগরণ সূচিত হয়। এটি সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যারাও পিছিয়ে নেই। এর মধ্যে নবীন কিন্তু প্রতিভাবান একটা লেখক শ্রেণীর উদয় হয় যার সংখ্যা অনেক। এই ক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রকাশনা গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পহ্র জাঙাল এখানে অগ্রগামী। তারা দেশ, সমাজ ও জাতি নিয়ে চিন্তা করে এবং সাথে তারা আদিবাসী অধিকার নিয়েও সচেতন। সেজন্য আমি এই সময়কে  তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নবজাগরণের সময় বা যুগ বলি। তারা সব কিছু ভেদাভেদ ভুলে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সদয় প্রত্যয়ী। এই ক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা(এনজিও)গুলোর ভূমিকাও অনেক। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

৬. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর অবদান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’(পূর্বনাম উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট)আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বিশেষ একটা জায়গায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুটিকয়েক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে। উক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের(রাঙ্গামাটি) কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলে আমার এই সত্য উপলদ্ধিতা আরো গভীর এবং বদ্ধমূল হয়েছে। আমি মনে করি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামের যথার্থতা বা সার্থকতা মুল্যায়িত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ভবিষ্যতে এই দায়িত্বটা স্বরণে রাখবে আশা রাখি। 

৭. তঞ্চঙ্গ্যারা সম্মানিত ও গর্বিত জাতিঃ 

আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারাই সবচেয়ে সম্মানিত এবং গর্বিত জাতি। কারণ তাদের জাতির মধ্যে রয়েছেন এমনসব বিরল সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি যাদের কর্মকান্ড বা অবদান দেশ,কাল,সমাজ ও জাতির উর্ধে উঠে পুরো পৃথিবীকে করেছে আলোকিত আর জাতিকে করেছেন সম্মানিত। তারা হলেন সাধক কবি শিবচরণ,রাজগুরু প্রিয়রতœ মহাস্থবির(গৃহী নাম পালকধন তন্চংগ্যা), রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির(গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা),রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী বা রাজগেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা(কানা গেঙ্গুলী), শ্রেষ্ঠ বলি লাল মুনি তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। সবগুলি রাজকীয় মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ত্বের স্বীকৃতি। এত রাজকীয় মর্যাদা বা উপাধি এবং স্বীকৃতি প্রাপ্তি একটি জাতির জন্য আর কি চাওয়া থাকতে পারে।  

উপসংহার

এইভাবে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্য বিকশিত এবং প্রসারিত হয়। স্বরণযোগ্য বলে এই বাক্যটি শেষে এসে আবার বলছি। তঞ্চঙ্গ্যা জাতি যদি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আরো একটু সচেতন হয় তাহলে আমি আশা রাখতে পারি সামনে তাদের সুদিন আসছে। বর্তমানে প্রচুর তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়ে দেশে এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছে। তারা ভবিষ্যতে জাতির কান্ডারী হবে। যদি আমরা চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। সেটি হচ্ছে শিক্ষিত প্রজম্মের মধ্যে জাতিত্ত্ববোধের সচেতনতা। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রীধারীদের ক্ষেত্রে। তারা যদি নিজ জাতির প্রতি জাতিপ্রীতি হন তাহলে আমরা হয়তো এই সুফলটা পেতে পারি অন্যথায় নই। বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের(বিবাহ)ক্ষেত্রে। এই সময় তারা যদি একটু বেশী নিজ জাতিকে নিয়ে ভাবেন জাতি এতে উপকৃত হবে। এইক্ষেত্রে অবশ্যই জাতির অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখানে টার্গেট করা হচ্ছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্মকে। যাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক মর্যাদা অপেক্ষা করছে। দিনের আলোর মতো খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ লোক যারা অন্য সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করেছে তারা আত্বীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,সমাজ এবং সর্বোপুরী সামাজিক ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের অর্ধাঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এসে ‘তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের একজন’ হয়ে উঠতে পারেননি। সুখে দুঃখে এখনো সে তার মাতৃজাতির যাবর কাটছেন বা স্বপ্ন দেখছে। জানিনা এটি জাতির জন্য নতুন একটি ষড়যন্ত্র বা কূটকৌশল কিনা। কারণ অতীতে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমরা সেরকম অনেক ইতিহাস দেখেছি। তবে বেশীদূর যেতে হবে না ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তের দিকে তাকালে হবে। সেসময় পাকিস্তানীরা এবং তাদের সহযোগীরা যখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পেরে উঠছে না তারা বুদ্ধিজীবি এবং শিক্ষিত প্রজন্ম নিধনে পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং অনেকটা সফলও হয়। আমি এই কথাগুলি এই কারণে এখানে বলছি কারণ শিক্ষিত প্রজন্মই জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। তাদের চিন্তায় এবং সহচার্যে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হবে এবং টিকে থাকবে। একটি পত্রিকার ভাষ্য মতে-বৃটিশ পুরুষরা নাকি অন্য জাতি বা সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। কারণ তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস বা বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এতবড় সম্পত্তিশালী এবং শক্তিশালী জাতির যদি জাতি বা সংস্কৃতি ধ্বংসের চিন্তাটা মাথায় আসে তাহলে আমরা সাগরের এক কণা বালির মতো একটি জাতি হয়ে নিজ জাতির জন্য কি চিন্তা বা ভূমিকা রাখছি। আমি সব সময় আশঙ্কায় থাকি জাতি থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি নাতো। কারণ পৃথিবী থেকে নাকি প্রতিদিন কিছু না কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস ও বিলুপ্ত আশঙ্কা হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষিত এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এইক্ষেত্রে অভিভাবকদেরকেও ছাড় দিতে হবে জাতি ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে। নাই বা কম বলে আমি এই আশঙ্কাটুকু করি। এটি কিন্তু চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে নয়। তবে আমি আশাবাদী কারণ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা সমাজ বিকশিত হয়। তন্চংগ্যা সমাজও সেভাবে বিকশিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তঞ্চঙ্গ্যাদেরও সে সুদিন আসবে, সেই প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

পরিশেষে উল্লেখিত সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম ছাড়াও আরো অনেক সাহিত্যিক  এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম হয়তো আছে যেগুলো এখানে আসেনি বা আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি, পরবর্তীতে তথ্যপ্রাপ্তিতে সংযুক্তির সুযোগ রেখে তাদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

                                                         …………………………

তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক রচিত, প্রকাশিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের একটা তালিকা নিম্মে দেওয়া হলো-

১. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক রচিত সাহিত্যকর্ম

  ১।  সাধক শিবচরণ

       মানবজন্ম , ফুইরা আলাম,আর ‘গোসাইন লামা’ হচ্ছে (মানব জন্ম ফুইরা আলাম) এর ভূমিকা মাত্র।

  ২।  কবিরাজ পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা

 ক. ধর্ম্মধ্বজ জাতক(১৯৩১) – কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা।

 খ. চান্দোবী বারমাস, সত্য নারায়ণের পাঁচালী (সিন্নি পুঁথি), চাংমা লেখা শিক্ষা(১৯৩৮),

              রুত্তি বারমাস, আলস্যা মেলার কবিতা,বিয়াল্লিশর ভাত্রাদ(বারমাস)।

       ৩। কবি গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা  

            ক্যাঝুরী,মুলি,কলিযুর্গ ও দ্বিমুক্যা বারমাস নামে চারটি বারমাস রচনা করেন।

  ৪। শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা 

      ক. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (আগষ্ট-১৯৮৫)

      খ. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা (১৯৪৫),উদয়ন বস্তু বা কর্মফল(১৩৬৮),মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বৌদ্ধ গল্পমালা(১৯৮৭) 

       সম্পাদিত গ্রন্থ: ধর্ম্মধ্বজ জাতক(কবিরাজ পমলাধন তন্চংগ্যা মূলগ্রন্থের সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা)।

      প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ:

            ক. রাধামন ধনপুদি কাব্য (পহ্র জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা ২০০৮ প্রকাশিত)

            খ. অশোক চরিত(১৯৮৩); অনাগতবংশ।

            নাট্য কাব্য: 

            ক. বিজয়গিরি (পহ্র জাঙাল-৫ম সংখ্যা, ২০০৯ থেকে প্রকাশিত)

            খ. চরিত নাটক(ধর্মীয়): মানুষ দেবতা,মোহবসান এবং কুলধর্ম(কাব্য)

            গ. তপর্কীতন ও যাত্রাপালা : বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা(২৫/০৪/১৯৮৫)

            ঘ. শ্রী বুদ্ধের বারোমাস স্মৃতি(রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়-২৬/০৩/১৯৭৮)

            ঙ. কল্পতরু দান ফল কথা, বন্দনা ও দান ফল কথা, অক্ষর গাথা। 

এছাড়া রাজবলাকা,  নৈরঞ্জনা, সম্বোধি, পার্বত্য বাণী পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।

         ৫। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

–        তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি(গ্রন্থ)।

এছাড়া বান্দরবান থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘ঝর্ণা’,রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘পার্বত্য বাণী’ ও সাপ্তাহিক  ‘বনভূমি’ তার ভিবিন্ন সময় কবিতা প্রকাশিত হয়।তার মধ্যে- অবিস্মরণীয়া,নিশা,আমি একাকী,পথিক,বান্দরবন,মায়াময় পৃথিবীতে,পার্বত্য চট্টলার প্রতি,অব্যক্ত অনুভূতি,বরষা,বৈশাখী পূর্ণিমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

   ৬।  রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির

              প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

সমবায় বুদ্ধোপাসনা, বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বুদ্ধপাসনা (লোকত্তর বিভাগ), বুদ্ধপাসনা(লোক বিভাগ), চাঙ্মা গীদেন্দি মঙ্গল সূত্র, পরিণাম(নাটক), শ্রামণ কর্তব্য, মানব ধর্ম পঞ্চশীল, The Stop Genocide Hill Tracts of Bangladesh.

               অপ্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

 বিশুদ্ধিমার্গ(৩য় খন্ড), বিদর্শন ভাবনা নীতি(৫ম খন্ড),বুদ্ধোসামন্তিকা (৫ম খন্ড), অভিধম্মার্থ সংগ্রহ, ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ, জন্ম মৃত্যুর কথা, সাম্য বীথিকা, চন্দ্রগুপ্ত (নাটক), বাসবের পথে(নাটক), রূপনন্দা(নাটক), সঞ্চয়িতা, বাংলাদেশ বড়–য়া জাতি, মহা কঠিন চীবর বর্ণনা,বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ, অগ্নিমশাল(গীতি মঞ্জুরী),চাঙ্মা কধাদি ধর্মপদ,পথ তগেয়ে মন(চাক্মা ভাষায় নাটক), মহামানব গৌতম বুদ্ধ, আবিলাস্যা সংসার(চাক্মা ভাষায় নাটক), সিদ্ধার্থ চরিত, মহাস্বপ্ন (চাকমা ভাষায় নাটক), বেসান্তর কীর্ত্তন, মহাযাত্রী(গীতিনাট্য), দর্শন ও বিদর্র্শন, ধর্ম ও সমাজ, বুদ্ধের অবদান (৩য় খন্ড)।(তথ্যঃ মানব ধর্ম পঞ্চশীল,রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির)।

    ৭। ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির

             প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহঃ

শাতিকাধাতু কথা স্বরূপিনী, অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরূপিনী, যমক স্বরূপিনী, অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গ প্রকরণ, বুদ্ধ প্রকাশনী, পথ প্রদর্শন, চলার পথে।

     ৮। শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

  • ১৯৭৬ সালে বিরাজ মোহন কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘পার্বত্য বাণী’র প্রথম সংখ্যায় ‘কালিন্দী’ নামক ইতিবৃত্তমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কলিকাতা ‘বোধিভারতী’ পত্রিকায় তার কয়েকটি গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  •  রাঙ্গামাটি পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ‘অঙ্কুর’ প্রকাশিত হয়।
  • রাঙ্গামাটি সাপ্তাহিক বনভূমি থেকে ‘সীমান্তের শান্তি’ চার সংখ্যা পর্যন্ত বের হয়।
  • ‘রুনুখাঁর উপাখ্যান’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস কয়েকটি অধ্যায় বের হয়েছে।
  • বুদ্ধের জীবনের উপর রচিত ‘অমিতাভ’ ১৯৬৭ সালে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়।
  • ১৯৭০ সালে চাকমা নাটক ‘মূড়া যেক্কেনে’ নানিয়াচর উপজেলায় কৃঞ্চমাছড়া গ্রামে অভিনীত হয়। 
  • গিরি নির্ঝর পত্রিকায়  ‘রক্ততিলক’ প্রকাশিত হয়। 
  • তিনি রাঙ্গামাটি বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত ‘গান ও কথিকা’ লেখক।
  • ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করে। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ফোরামও ২৭শে চৈত্র ১৪১০ বাংলা সম্মাননা প্রদান করে। 
  • চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ২৫ বৎসর পূর্তি’ উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান করে। 
  • তার প্রণীত গ্রন্থ সমূহ- ‘তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, ভাগ্যরতœ’ । 
  • ছ. বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে ২০০৮ সালে সাহিত্যে সম্মাননা দেওয়া হয়।

      ৯।  অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান 

  • ক. তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা-রূপ প্রসঙ্গ (১ম সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৩, সম্পাদকঃ পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • খ. ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়ন: তন্চংগ্যার উত্তরাধিকার প্রশ্ন (২য় সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৪ সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • গ. পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন (৪র্থ সংখ্যা, ১৪ই আগস্ট-২০০৮, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • পার্বত্য কথাসম্ভার তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ (৫ম সংখ্যা, ৯আগষ্ট,২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)

      ১০।  রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

            তঞ্চঙ্গ্যা জাতি, গীত পোই, চিত্রা (আর্ট বই)। এছাড়া স্থানীয়,জাতীয় অনেক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তার বহু মূল্যবান গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি একজন প্রতিবাদী লেখক এবং সমাজ চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে আতœস্বীকৃত। 

      ১১।  রূপক দেবনাথ (ভারত)

     Rupak, Debnath, Ethnograpic Study of the Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South Tripura Kolkata: Kreativmind, 2008.

.

      ১২।  কর্মধন তন্চংগ্যা

      প্রবন্ধ সমূহঃ 

  • আচ্ছ্যা বিষু-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১১ই এপ্রিল’০৫।
  • লুউই-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৯শে মে’০৫।
  • তন্চংগ্যা সমাজে বিষু উৎসব-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৮ই এপ্রিল’০৬।
  • আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরাই বাচিঁয়ে রাখবো-রঁদেভূ,৬ষ্ঠ সংখ্যা,০৬।
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও মিডিয়া- রঁদেভূ ,৫ম সংখ্যা,০৫।
  • বিপন্ন আদিবাসী ভাষা-সমুজ্জ্বল সুবাতাস,ফেব্রয়ারী’০৫।
  • তন্চংগ্যাদের জুম চাষ,মিথলজি- পহ্র জাঙাল,৫ম সংখ্যা’০৯।
  • চাকমা কবিতায় তন্চংগ্যা ধনপুদি- পহ্র জাঙাল,৪র্থ সংখ্যা’০৮।
  • তন্চংগ্যাদের রাষ্ট্রভাষা চর্চা ও একটি প্রস্তাবনা- পহ্র জাঙাল,১ম সংখ্যা’০৩।
  • আদিবাসীরা বেঁচে থাকবে চিরদিন-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা),৮ম সংখ্যা, ২০০৬।
  • ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এর মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম-যেন প্রকৃতির ভাষার মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলো, 

     সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট,সাস,ডিসেম্বর-২০০৯।

           ছোট গল্পঃ 

  • সাঙা -দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,৫ই জানুয়ারী’০৭।
  • নীলাকাশ- রদেঁভূ ,৭ম সংখ্যা’০৮।
  • পু-কাল্লাঙ-তৈনগাঙ,আদিবাসী দিবস সংখ্যা-২০০৬।

কবিতাঃ

  • জুমফুল পথ খোঁজার সাথী হয় না; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৪ নভেম্বর’০৬।
  • জুম দেশের বৃষ্টি; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৯জানুয়ারী’০৭। 
  • বয়স ৩; পহর জাঙাল,৩য় সংখ্যা’০৫।
  • জীবনের গদ্যকবিতা,ধূপছায়া,২য় সংখ্যা,২০০৩।
  • স্বপ্ন,নব সভ্যতার-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা), ২০০৪।

           গুচ্ছ কবিতাঃ

  • রুমালের ফুলে মুখ লুকাতে, তুমি যাবে আমাদের গ্রামে, বনে আলো প্রবেশ করে না;

      দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১৬ই ফেব্রয়ারী’০৭। 

  • নূপুরবিহীন জুমনৃত্য, প্রকৃতির লজ্জা; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২রা ফেব্রয়ারী’০৭।
  • তিনটা জীবন, ওপর-নিচ সমান্তরাল; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৪ জুলাই’০৫।
  • আজ কবিতা লিখব না চিঠি লিখব, শুধু ভালোবাসে না তারা আমাকে; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৮শে আগষ্ট’০৫।
  • জুম পরানীর আত্মা, স্যারের কবিতা বাতাসে উড়ে যায়; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৩মে’০৫।
  • অনন্ত কাল ধরে বহুদিন, আমরাও জেগে আছি ধরিত্রীর মাঝে, যদি তোমায় একটি বার দেখা পাই; 

           দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৮শে এপ্রিল’০৫।

           অনুবাদ কবিতাঃ (তন্চংগ্যা ভাষায়) 

           ন-য়া ব-সর; (শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড.মনিরুজ্জামান স্যারের ‘ইদানিং বিপন্ন বড়ো’র পঞ্চতপার গান এর ‘নববর্ষ’ কবিতার অবলম্বনে)।

           সম্পাদনা করেন : 

  • পহ্র জাঙাল (একটি তন্চংগ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা)। ২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা, প্রকাশনায়ঃ পহ্র জাঙাল  প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  •  রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক), ৬ষ্ঠ, ৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহ:সম্পাদক। 

২. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন সমূহ

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা, রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদনায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তন্চংগ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তন্চংগ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তন্চংগ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তন্চংগ্যা-৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তন্চংগ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তন্চংগ্যা-৩য় সংখ্যা,অমিত তন্চংগ্যা-৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা, সুতিল কুমার তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক: সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক: আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক),৬ষ্ঠ,৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক- কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহঃসম্পাদক: কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা । 

     ৩. তন্চংগ্যাদের সম্পাদিত নিজস্ব প্রকাশনা:

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা,রাংগামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদরায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তঞ্চঙ্গ্যা -৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা,অমিত তঞ্চঙ্গ্যা -৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,সুতিল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক:সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক:আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 

                                                ……………………………

তথ্য সূত্রঃ 

১. পহ্র জাঙাল (একটি তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা-সব সংখ্যা)।

২. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা।

৩. গোজেনের লামা বা গোঁসাই পালা- বিরাজ মোহন দেওয়ান। পার্বত্য বাণী, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ফেব্রয়ারী-১৯৬৮।

৪. সাধক শিবচরণ-যামিনী রঞ্জন চাকমা। গিরি নির্ঝর, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা,মে-১৯৮২।

৫. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। 

৬. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি-শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

৭. তৈনগাঙ, ন-আ শমন, রাঙাফুল প্রকাশনা।

৮. সাধক কবি শিবচরণ জীবনালেখ্য-আশীষ চাকমা,রঁদেভূ,আগষ্ট-২০০৫।

১০. প্রয়াত সুবাস তঞ্চঙ্গ্যা, বারঘোনীয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, রেশম বাগান-কাপ্তাই।

তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন এবং সংস্কৃতি

কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সুপ্রচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তনচংগ্যাদের বসবাস রয়েছে। এই বসবাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বটে। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যারা দাইনাক নামে পরিচিত। এই দাইনাক/দৈনাক শব্দটি একটি ঐতিহাসিক শব্দ, যার অর্থ যোদ্ধা। ঐতিহাসিকভাবে তঞ্চঙ্গ্যারা যুদ্ধজাতি হিসেবে পরিচিত। ভারতে নানা প্রদেশে, অঞ্চল বিশেষে তারা তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা এবং চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত। তনচংগ্যারা তিবেতো-বর্মন-ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠীভুক্ত, যদিও বর্তমানে তাদের ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার অর্ন্তভুক্ত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান বসতি। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় রাঙ্গুনীয়া উপজেলার উত্তরা-পূর্বাংশে এবং কক্রবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের বসতি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ(সিএডিসি) অঞ্চলে তাদের প্রধান বসতি। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের মূল বসতি বর্তমানে আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কলদান নদীমুখ অবদি। তাছাড়া বসতি রয়েছে আরাকানের ভুসিডং,রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে, মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়। তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলা নববর্ষ বা বিষু হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এর পাশাপাশি ধর্মীয় নানা পূজা-পার্বনও তারা পালন করে থাকে। 

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সুদীর্ঘকালের যে ইতিহাস সেটি শুরু হয় মায়ানমারে আরাকান প্রদেশ/রাজ্য থেকে। যেখানে দান্যায়াদি নামে একটি ঐতিহাসিক স্বাধীন রাজ্যের গড়া পত্তন হয়। মূলতঃ দাইনাক বা দৈনাক থেকে দান্যায়াদি নামের ঊৎপত্তি। বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান বা দান্যায়াদিতে দাইনাক বা দৈনাক নামে বসবাস করে যা এখনো বর্তমান। ইতিহাস বলে তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে প্রথমে বান্দরবান জেলায় আলিকদম উপজেলায় তৈনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয় এই তৈনছড়ি থেকে তঞ্চঙ্গ্যা নামটি উৎপত্তি। এর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত হয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে যা এখনো বর্তমান। শ্রী মধাব চন্দ্র চাকমা তার রাজনামা গ্রন্থে চাকমাদের দুটি শাখার কথা বলেছেন। একটি হচ্ছে ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘আনক্যা চাকমা’। এই ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আর ‘আনক্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান চাকমারা। একদা ইতিহাসে আরাকান/দান্যায়াদি অংশকে বলা হতো ‘রোয়াঙ্গ্যা’ আর চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বলা হতো ‘আনক’। এই আনক্ থেকে ‘আনক্যা’ শব্দটি এসেছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস শুরু হয় মূলতঃ আরাকান-পার্বত্য চট্টগ্রাম-ভারত আর চাকমাদের ইতিহাস শুরু হয় ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাই ইতিহাসের সরল ভাষ্যমতে এই আনক্যা চাকমারা আদৌ আরাকানে বসতি স্থাপন করেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। ইতিহাস গবেষকদের মতে রাজনামা বা চাকমা রাজনবর্গে তাদের ধারাবাহিক ইহিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি) থেকে সাত্তুয়া (পাগলা রাজা) পর্যন্ত রাজারা ছিলেন রোয়াংগ্যা চাকমাদের(তঞ্চঙ্গ্যা) বংশধর আর ধাবানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজারা হচ্ছেন আনক্যা চাকমাদের(বর্তমান চাকমা) বংশধর। তাছাড়া চাকমা ইতিহাস লেখকদের লেখনীতে তাদের ইতিহাসের দোলাচলতা আমরা লক্ষ্য করি। ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে অশোক কুমার চাকমা বলেছেন- চাকমা জাতির ইতিহাসের একটি কাহিনী বা অংশ চাক জাতিও নিজেদের বলে দাবী করছে। তাহলে কি এই কাহিনী চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছে ? না আমরাই তাদের কাহিনীকে নিজেদের (চাকমাদের) বলে চালিয়ে দিচ্ছি। তাই অশোক কুমার চাকমা ‘চাক ও চাকমাদের মিলে যাওয়া ইতিহাসের’ অংশ নিয়েও এই রকম একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। আর জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যারা নাকি আসল চাকমা, এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। তাই আমরা লক্ষ্য করেছি তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস compromise এর ইতিহাস। 

ইতিহাসে উলেখ আছে তঞ্চঙ্গ্যাদের আগে বর্তমান চাকমারা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেন, সেজন্য তারা তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে ‘পরঙী’ বা বসবাসের জন্য আগমনকারী হিসেবে অভিহিত করতেন। আর চাকমরা যদি কোন কারণে বা কালে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকেন তাহলে তারা আরাকানকে স্বদেশ বা মাতৃভূমি হিসেবে মেনে নেয়নি বা গ্রহন করেননি। তার কারণ মগ রাজার সাথে তাদের সর্ম্পক ভালো ছিলনা। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে আরাকান বা মগ রাজাদের সর্ম্পক ভালো ছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিজয়গিরি প্রচুর সৈন্য সামান্ত নিয়ে রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন। এই সৈন্য সামান্তরা যে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বংশধর ছিলেন সেটাও ইতিহাস বলে। কারণ তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে মারমা এবং রাখাইনরা সেসময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত “দৈনাক” বলে সম্বোধন করেন। ইতিহাসে আছে বিজয়গিরি যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু অংশ এখানে থেকে যায় আর কিছু অংশ স্বদেশে বা আরাকানে চলে যান (বিচগ্রী যুদ্ধ জয়ের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়া)। ইতিহাসের তথ্যমতে রোয়াংগ্যা চাকমা বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধনদের যোদ্ধাদের বংশধর এবং উত্তরসুরী। ইতিহাস আরো বলে তঞ্চঙ্গ্যারাই গৌতম বুদ্ধের বংশীয় শাক্য বংশের উত্তর পুরুষ। আরাকানে বসবাসরত তন্চংগ্যাদেরকে শাক্যবংশীয় উত্তরসুরী হিসাবে তদান্তিন জেনারেল উনু প্রতি বৎসর এ জাতির দম্পতিকে রেঙ্গুনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করতেন।

আবার অনেকে বলেন তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমারা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রদায় ছিল। উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজা ধাবানা তার শাসন থেকে ‘চাকমা’ নামে একটি জাতি বা সম্প্রাদয়ের সংস্কার গড়ে তুলেন। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমারা কি নামে সম্বোধন হতেন তা গবেষকগণ বলতে পারেননি। তবে লুইনের মতে চম্পক নগর থেকে আগত বলেই চাকমা নাম ধারণ করা হয়। কিন্তু চম্পক নগরের অস্থিত্ব নিয়ে ইতিহাসে নানা প্রশ্ন আছে। আর ত্রিপুরা রাজমালা’র মতে অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ের শব্দটি এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে চাকমা নামের উলেখ পাওয়া যায় এই রাজমালা গ্রন্থে। আবার অনেকের মতে পূর্ব পুরুষদের আচার,আচারণ, অভ্যাাস ও অবস্থান দেখে আরাকানীরা হেঁয়ালীভাবে তাদেরকে চাংমাং বা চামা এবং তংসা নামে ডাকত। পরবর্তীতে এই শব্দদ্বয় থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা শব্দদ্বয় রূপান্তরিত  হয়ে থাকতে পারে। 

আরাকানের ভুসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে,মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করে আসছে। তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু। আরাকান থেকে এসে তারা তৈনছড়ি কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় ক্রমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খৃীষ্টাব্দে দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলের এক রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছে স্থানীয় প্রবীনদের মত রয়েছে। ইতিহাস বলে পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরুপে বিবেচিত হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আর রাজা ধরমবক্স খাঁ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বজাতি হিসেবে গ্রহণ করেননি। ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে তার আমলে ৪,০০০(চার হাজার) তঞ্চঙ্গ্যা আগমন করেন। এদের রাজা ছিলেন ফাপ্র“। তারা পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুটির’ (বর্তমানে ডিসি বা নজরুল স্কয়ারের পাহাড়ের উপর বিল্ডিংটি) ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দেন।

ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যারা জাতিতে মঙ্গোলীয় এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা চর্চা অনেক দিনের। জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট্য ভাষাতাত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েষ্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (Linguistic Survey of India)’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষাকে পৃথক ভাষা বলে উলেখ্য করেছেন এবং উভয় ভাষাকেই আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অর্ন্তভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেন। তঞ্চঙ্গ্যাদর নিজস্ব লিপি আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের লিপি অনেকটা বার্মিজ লিপির কাছাকাছি। এর মূল উৎপত্তি হচ্ছে ‘মন’দের থেকে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা যে বর্ণমালাটা ব্যবহার করছে সেটি হচ্ছে দাইনাক বর্ণমালা। তাদের বর্তমান মোট বর্ণমালার সংখ্যা ৩৬টি। তার মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ হচ্ছে ৩১টি আর স্বরবর্ণ হচ্ছে ৫ টি। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সহজাত উচ্চারণ হচ্ছে ‘আকারান্ত’। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা শান্ত, নরম এবং কোমল। 

সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকারটা বিশেষ করে জমি-জমা, পাহাড়-পর্বত লাভ প্রথাগত। তারা এক পুরুষ ভোগ করার পর পরবর্তী পুরুষকে তার সম্পত্তিকে দেখভালে দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ছেলেরাই অগ্রাধিকার বেশী পায়। তবে পুত্র সন্তান যদি না থাকে মেয়ে সন্তান থাকলে মেয়েরাই সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর পুত্র মৃত্যু পর পুত্রবধু যদি দ্বিতীয় বিবাহ না করে সে ঘরে যদি কোন সন্তান থাকে সেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। নিঃসন্তান হয়ে তারা যদি পালক সন্তান পালন করেন বা কেউ তাদেরকে লালন-পালন করেন (ভাইয়ের বা বোনের সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ) তখন তারা সম্পত্তির ভাগ পান। যদি স্বামী-স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে তারা চাইলে তাদের সম্পত্তিগুলি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দানও করে দিতে পারেন। 

পোষাক-পরিচ্ছদ এবং আলঙ কানিঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা সরকারী ভাষায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রয়েছে তনচংগ্যাদের পোষাক তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ। মূলত এই বৈচিত্র্যময় পোষাক দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের আলাদা এবং স্বকীয়ভাবে সহজে চেনা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের ‘পাঁচ কাপড়ের’ পোষাকটা। মেয়েদের এই পাঁচ কাপড় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছে। এই পাঁচ কাপড় হচ্ছে- পিনন(পরনের কাপড়), খাদি (ওড়না), মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী), পা-দুরি(কোমড় বন্ধনি), সালুম(শার্ট) এগুলি হচ্ছে মেয়েদের জাতীয় পোষাক। আর ছেলেদের জাতীয় পোষাক হচ্ছে- ধুতি, হাফ হাটা সাদা ফুটুয়া এবং মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী)। মেয়েরা তাদের কাপড়গুলি নিজেরাই তৈরী করে, কোমড় তাঁত এর মাধ্যমে। ‘আলঙ কানি বা আলাম’ হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের নকশা পুথি। এটি মূলত একটি নকশা করা কাপড় যেখানে সমস্ত বুননের ডিজাইনগুলি নকশা করা থাকে। এই ডিজাইনের ফুলগুলি জুমে উৎপাদিত নানা ফুল,ফল এবং প্রকৃতি ও জীবজন্তুর নানা উপাদান থেকে নেওয়া। তাই এই বুনন উপাদনের সাথে জুমের একটা আত্মার সর্ম্পক রয়েছে। এই জুমের ফুল নিয়ে তনচংগ্যা সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছে গান, সাহিত্য। রয়েছে ঐতিহাসিক উবাগীত, রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যেও। রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যে রাধামন-ধনপুদি পোষাকের মধ্যে আমরা এই জুমফুল এবং আলঙ কানি ফুলগুলির বর্ননা পাই। যেমন- কুরা চোখ ফুল(মুরগী চোখ ফুল),বিঅন বিচি ফুল(বেগুন বীজের ফুল),রাধাচুলা ফুল(মোরগের ফুল),গাইত ফুল(বিশেষ করে শার্ট বোনা হয়), কুরাঙা কাবা ফুল,কাঙারা চোখ ফুল,প্রজাপতি ফুল(বিশেষ করে থলে তৈরী করা হয়),বিসন ফুল(এই ফুল দিয়ে শার্ট বোনা হয়),কুমুড়া বুক্ক্যা ফুল,মাম্মা বিচি ফুল,ধুদি পাল ফুল,আইদ ফুল, আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল,বুল চুক্ক্যা ফুল, কই ফুল(শার্ট বোনা হয়),কেরেঙ ফুল, জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড় (পোষাক) হচ্ছে রাজকীয় পোষাক। তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাক বিশেষ করে মেয়েদের পোষাক নিয়ে সমাজে আরো কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময় চাকমা শাসক ছিলেন রানী কালিন্দী। আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার সময় ব্রিটিশ লর্ড নাকি রানী কালিন্দীর সাথে দেখা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং তারা দূত মারফত সে খবরটি পৌঁছে দেন। আর অনুরোধ করেন আসার সময় চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নিয়ে আসার উপহার হিসেবে। সেগুলি উপহার স্বারক হিসেবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখবে। রানী কালিন্দী নিজে না গিয়ে তার কিছু হেডম্যানকে ব্রিটিশ লর্ডের সাথে সাক্ষাতের করার জন্য প্রেরণ করেন এবং চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক (পিনন, খাদি এবং ব্লাউজ) উপহার হিসেবে পাঠান। ব্রিটিশ লর্ড তাদের সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং রানী কালিন্দীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এক পর্যায়ে হেডম্যানরা রানীর দেওয়া চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকগুলি ব্রিটিশ লর্ডের হাতে তুলে দেন। ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি পেয়ে খুশী হন এবং রানীকে হেডম্যানদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান। পরে তাদের সামনে ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি খুলে দেখেন এবং অবাক হয়ে নাকি বললেন-“এগুলিতো চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নয়”। তখন এই হেডম্যানরা নাকি পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যাদের পাঁচ কাপড়(পিনন,খাদি,সালুম,পা-দুরি, মাদাকাবঙ) দিয়ে আসেন এবং ব্রিটিশ লর্ড বললেন- এগুলিই হচ্ছে চাকমাদের আসল পোষাক। তার জন্য আবারো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানান। জনশ্রুতিতে আরো আছে এই পাঁচ কাপড়গুলি নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে তখনকার স্বারক শাসনের স্বারক হিসেবে। 

জুম চাষের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাকের একটা মিল আমরা দেখতে পাই। আর এই মিলটা হচ্ছে ফুলের। এই ফুলগুলি তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাককে বৈচিত্র্যভাবে এবং নানা রঙে ফুটিয়ে তোলার ভূমিকা পালন করেন। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যেসব পোষাক হাতে এবং বুননের মাধ্যমে তৈরী করে তার মধ্যে যেসব ফুলের কারুকাজ ব্যবহার করা হয় সে ফুলের নামগুলিও জুমে উৎপাদিত নানা ফল বা ফলের বীজ এবং ফুল থেকে নেওয়া। যেমন- বেউন বিচি ফুল, কুরা চোখ ফুল, গাইত ফুল, বিসইন ফুল, সুইচ্ছাং ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কাঙারা বিচি ফুল, কুমুড়া বুক্কয়া ফুল, মাম্মা বিচি ফুল, ধুদি পাল ফুল, আই-দ ফুল,আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল, বুল চোক্কয়্যা ফুল, কই ফুল, বিঞ্চ ফুল, হাদি চ ফুল, প্রজাপতি ফুল,মাইত ফুল। রাধামন-ধনপদি পালার পোষাকের মধ্যে আমরা তঞ্চঙ্গ্যাদের এই জুম ফুলগুলির বর্ণনা পাই।

সামাজিক সংগঠন বা গছা/গোত্রঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের বংশ পরিচয় পিতৃসূত্রীয়। তাদের সর্বমোট বারটি গোত্র আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় গোত্রকে গছা বলে। তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার সংখ্যা হচ্ছে ১২(বার)টি। এই গছাগুলি হচ্ছে -র্কারআ গছা, মুঅ গছা, ধন্যা গছা, লাং গছা,মংলা গছা, মেলং গছা, অঙ্যা গছ, রাঙ্যা গছা, লাপ্যোসা গছা, ওয়াহ গছা, মুলিমা গছা,তাসসি গছা। এই গছাগুলির আবার রয়েছে উপগছা। তঞ্চঙ্গ্যাদের মৌজা প্রধানের নাম হেডম্যান এবং গ্রাম/পাড়া প্রধান হচ্ছেন কার্বারী। তারা সামাজিক নানা বিচার-আচার পরিচালনা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

জীবন জীবিকা এবং চাষাবাদঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তাদের জুম চাষের মুল পর্বটা শুরু হয় বৈশাখের পরে। তবে বৈশাখের পূর্ববর্তীতে তারা জুমকে অনেকাংশে চাষের উপযোগী করে তৈরী করে রাখে। জুমকে কেন্দ্র তারা করে তাদের জীবন পুঞ্জিকা তৈরী করে। এই জুমে ধান, হলুদ, আদা, কলা, কচু, মরিচসহ নানা রকম সবজি উৎপাদন করে। জুম থেকে তারা সারা বছরের জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ পেয়ে থাকে। এই জুমকে কেন্দ্র করে তাদের ঐতিহাসিক নানা সাহিত্য এবং কাহিনী বা পালা রচিত হয়েছে। তার মধ্যে জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা। আর আছে নানা পৌরানিক উপখ্যান। তার মধ্যে লক্ষী মা ও মিত্তিন্যা পসন। বিষু সময় গ্রামের যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে জুমে তরকারী খুজতে যেত। 

ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসঃ

 তঞ্চঙ্গ্যারা জন্মগতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তারা গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনে অনুসারী। তাদের প্রত্যেকের গ্রামে একটি করে বিহার/প্যাগোডা রয়েছে। সকাল বিকাল তারা বিহারে গিয়ে পূজা-আর্চনা করে, বুদ্ধ এবং ভান্তেকে বন্দনা করে। সাথে প্রার্থনা করে জগতে সকল প্রাণী সুখী হওয়ার জন্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের একটা রীতি আছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত একবার হলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে শ্রামন্য দীক্ষা গ্রহন হরতে হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর পাশাপাশি মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমাও তারা যথাযত ধর্মীয় অনুশাসনে পালন করে থাকে। 

পরিবারের ধরণঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একক এবং যৌথ পরিবার লক্ষ্য করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যারা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান। তবে পিতার অবর্তমানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠই পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবার নেই বললে চলে।  

সঙ্গীত ও সাহিত্য

সাধক কবি শিবচরণ, রাজ কবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে আলোকিত করেছে। সাধক কবি শিবচরণ তার গোসাইন লামা সাহিত্য তঞ্চঙ্গ্যাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তেমনি ভাবে সাদিগাঙছড়া, জুম কাবা, রাইন্যা বেড়া, ফুল ফারা, রাধামন ধনপুদি পালা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যকে সমৃদ্ধ শিখরে নিয়ে গেছে। সে সময় চারণ কবি গেঙ্গুলীরা গানের আসর জমিয়ে তুলতো এই পালাগুলি গেয়ে বেহেলার সুরে। তঞ্চঙ্গ্যাদের চারণ কবি বা শিল্পীদের গেঙ্গুলী বলা হয়। ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এবং রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার। দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনিলা তঞ্চঙ্গ্যা, মিনা তঞ্চঙ্গ্যা, শোভা তঞ্চঙ্গ্যারা তঞ্চঙ্গ্যা গান এবং নৃত্যকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সমকালীন আধুনিক লেখকদের মধ্যে বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা(পরলোকগত), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। ‘পহর জাঙাল’(তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রকাশনা সাহিত্যে অন্যতম পথ প্রদর্শক। এটির স্বপ্নদ্রষ্টা হচ্ছেন কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি যখন ২০০১-০২ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে বিষু উপলক্ষে। আর এটির উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় ওয়াগ্গা হাই স্কুলের হল রুমে। পরবর্তীতে পহ্ র জাঙাল এর পথ ধরে সিঙহাবা, চালৈন, তৈনগাঙ প্রকাশনাগুলি তঞ্চঙ্গ্যা আধুনিক সাহিত্য চর্চাকে অনেক দুর নিয়ে গেছে। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক। 

বিবাহ

 তঞ্চঙ্গ্যাদের বিয়ে সাধারণত দুই রকেমের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ‘দাবারা’ বিয়ে মানে পালিয়ে বিয়ে করা আর অন্যটি হচ্ছে ‘সাঙা’ করে বিয়ে করা মানে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা। এই দাবারা বা সাঙা বিয়ে অনেকটা পরিবারের আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। বর্তমান সময়ে সাঙা করে বিয়ে হলেও আগেকার দিনে বেশীর ভাগ বিয়ে হতো দাবারা করে। তখন এই বিয়েটা পালিয়ে এমনভাবে হতো পরিবারের কোন সদস্য জানতো না। শুধুমাত্র মেয়ের কিছু সঙ্গী-সাথী ছাড়া। পরের দিন জামাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু মুরুব্বী এসে বলতো আমরা তোমাদের মেয়েকে বিয়ে নিয়ে গেছি তোমরা কোন চিন্তা করো না। তখন জামাইয়ের পক্ষ থেকে চুরি করে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে ক্ষতিপূরণ হিসেবে শুকর দিতে হতো। বিয়ের এক সপ্তাহ পর জামাই তার নতুন বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো মিষ্টি-জিলাপী, বিনি পিঠা, সাইন্যা পিঠা, নারিকেলসহ নানা খাদ্য উপকরণ। এই ভাবে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে দুইবার বেড়াতে আসতে হতো। প্রথম বেড়াকে বলা হতো ‘জোড় পুরায় দে-না’ বা জোড় বেঁধে দেওয়া আর দ্বিতীয় বেড়ানকে বলে দ্বিতীয় বেড়া। তঞ্চঙ্গ্যারা মামাতো বোন, মাসিতো বোন এবং দুর-সম্পর্কের ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে। তবে ‘বড় কুদুম’ বা মাতৃতুল্য(মাসি, ফিসি) বিয়ে করা যায় না এবং এটি সামাজিক এবং নীতি বিরোধী। আর আপন ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে সামাজিক নীতি বিরোধী। 

সামাজিক অনুষ্ঠান এবং পূজা-পার্বন

তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিষু। তার পাশাপাশি নবান্ন উৎসব, আল পালনী, চুমুলাঙ, মিত্তিনি পূজা ইত্যাদি। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষে বিষু উৎসব খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়।  তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বিষুর আনুষ্ঠানিকতা মোট তিনদিন। ফুল বিষু, মুল বিষু এবং বিষু। ফুল বিষু সময় তারা ফুল তোলে এবং ঘর সাজায়। মুল বিষু দিন তারা পাইসন রান্নার জন্য জুম থেকে সবজি খুজে নিয়ে আসে আর খাবার পানি তোলে রাখে।  বিষুর দিনে সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঘুরতে বের হয়, বড় জনকে পায়ে ধরে প্রণাম করে। গ্রামে বড়োবুড়ি থাকলে তাদের গোসলের ব্যবস্থা করে। এই বিষু দিনে প্রত্যেক বাড়িতে নানা পিঠা-পুটুলি আর নাস্তা পানি আয়োজন করা হয় এবং আপ্যায়ন করা অতিথিদেরকে। বিষু উপলক্ষে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতী মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। এবং গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় গেঙ্গুলী গানের আসর। 

বাসস্থানের ধরণ

তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐত্যিগত বাসগৃহ হচ্ছে বাঁশ এবং শন দিয়ে তৈরী মাচাংঘর। তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের একটা নিদিষ্ট ডিজাইন আছে যা প্রত্যেক গৃহস্থ অনুসরণ করে। যা সহজে দেখলে চেনা যায়। ১. মূল ঘর, ২. বারান্দা, ৩.ইচর, ৪. টংঘর। 

খেলা-ধুলা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম খেলা হচ্ছে ঘিলা খেলা এবং নাদেং খেলা। ঘিলা খেলা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের জাতীয় খেলা। বিষু উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলার আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতীরা মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। তাছাড়া টুম্বুল খেলা, দু-দু খেলা, তেদই বিচি খেলা, গয়াঙ খেলা, শামুক খেলা, গাত খেলা, সই খেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, ইচিবিচি খেলা, গাইত খেলা,কুত্তা খেলা,লু-আ লুই খেলা,কাইন বা কঞ্চি খেলা, ঢাঙগুলি খেলা, গুলিক খেলা, চি কুতকুত খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি। 

শিক্ষার হার এবং জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকদুর এগিয়েছে। তাদের শিক্ষার হার প্রায় ৭৫-৮০% এর মতো। তারা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে যোগ্যতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। আর বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এর মতো। আর সারা পৃতিবীতে ৩-৪ লক্ষ এর কাছাকাছি।  

পিঠা-পুটুলি

তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের বাড়িতে নানা পিঠা তৈরী করে। অনেক সময় নানা উৎসবকে কেন্দ্র এই পিঠা তৈরী করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা যেসব পিঠা তৈরী করে সেগুলি হল- সাইন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, আইলসি পিঠা, তেল পিঠা,মালি পিঠা(গুলিক/গাইস্যা পিঠা),কলা পিঠা, পাতি সাপ্তা ইত্যাদি পিঠা তৈরী করা হয়। তাছাড়া কইন ভাত, বিনি ভাত,মিষ্ঠান্নও তৈরী করা হয় নানা উপলক্ষ উপলক্ষে।

খাদ্যাভাসঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান খাবার হচ্ছে ভাত। এই ভাতের সাথে মাছ, মাংস (মুরগী, ছাগল, হাঁস, শুকর) তাদের প্রিয় খাবার। এর পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে ‘নাপ্পি/ছিদল’ এবং সিদ্ধ যেকোন তরকারী বা শাক-সবজি। শুটকিও তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের জঙ্গল প্রাপ্ত নানা শাক-সবজিও তাদের খুব প্রিয়। 

জন্ম এবং মৃত্যুঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে শিশু জন্মের পর সাতদিন পর্যন্ত মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরের কোন কাজ করতে দেয় না রান্না-বান্নাসহ। এটি মূলত একটি নিষেধাজ্ঞা যেখানে পরোক্ষভাবে অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সবার সহযোগিতা করা। সন্তান প্রসবের পরবর্তী কয়েকটা দিন সে যেন নিজেকে সুস্থ করে তোলার সুযোগ পায়। সাতদিন পর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাকে তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘পেলা আরি ধরানা’ বা ‘কসই পানি লনা’। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মূলত বাচ্চাকে ঘরের একজন সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া এব্ং সামাজিকভাবে স্বকৃীতি প্রদান করা হয়। 

মৃত্যুর পর তঞ্চঙ্গ্যাদের আগুনে দাহ করা হয়। এই দাহ করার স্থানকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘ছিদাখলা’ বলা হয়। আর দাহ করতে যাওয়াকে ‘মগদায় যাওয়া’ বলে। তবে দুধের বাচ্চা হলে কবর দেওয়া হয়। ছোট বাচ্চাদের কবরকে ‘পআ কবা’ বলে। মৃত্যুর পর সাতদিনের মধ্যে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করে দেওয়ার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করতে তার যেন কোন সমস্যা না হয়। তবে অনেক জায়গায় সমাজের ঘর প্রতি এক কেজি চাল এবং কিছু টাকা দেওয়ার নিয়ম প্রচলন আছে। একে তঞ্চঙ্গ্যা ‘সাত দিন্যা’ বলে। এই সময় ভিক্ষুদের আপ্যায়নসহ নানা ব্যবহার্য সামগ্রি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করে দেওয়া হয় তার স্বর্গ লাভের হেতুর জন্য। সাথে আপ্যায়ন করা হয় পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতী গোষ্ঠী এবং আত্মীয়-স্বজনকে।  

উপসংহার

অন্য দশটা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতিসত্বার মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও দেশ, সমাজ এবং জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা দেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হয়ে সবার সাথে এগিয়ে যেতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ তাদের গর্ব এবং অনুপ্রেরণা। কেননা এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক তঞ্চঙ্গ্যাও সরাসরি এবং প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহন করে দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তঞ্চঙ্গ্যারা বেঁচে থাকতে চায় অন্য দশটা সাধারণ মানুষের মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে। বেঁচে থাকতে চায় তার নিজের সংস্কৃতির স্বকীয়টাকে সাথে নিয়ে। সাথে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় সামনে দিকে মায়ের মতো ভালোবেসে।  

রাধামন-ধনপদি পালাঃ প্রেম এবং প্রকৃতি

কর্মধন তন্চংগ্যা

ভূমিকাঃ

রাধামন ধনপদির পালাতে ব্যক্তির প্রনয়-বিরহ এর পাশাপাশি সমন্ধয় ঘটেছে দেশপ্রেম, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের। আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য একই উপাদনে সংমিশ্রণ রয়েছে এই সৃষ্টি কর্মে। তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা পৌরানিক ইতিহাসে বেশ কিছু পালা (উপাখ্যান) আছে। যে উপখ্যানগুলি দেশ,কাল, সামাজিক জীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। এই উপখ্যানগুলির রচয়িতাদের সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এর কাহিনী এবং বিষয়বস্তু কালে কালে ছুয়ে গেছে দেশ,কাল,জাতি ও সমাজকে। বিশেষ করে গেঙগুলীদের কন্ঠে বেহেলার সুরে এই পালাগুলি যখন পরিবেশিত হয় তখন ব্যক্তি আর তার মধ্যে থাকে না সে ফিরে যায় শত বছর আগে আপন জনের ফেলে আসা স্মৃতির মধ্যে। চাদিগাঙ, জুম কাবা, রান্যা বেড়া, ফুল পারা ও রাধামন-ধনপদি পালাগুলি হচ্ছে অন্যতম। আমরা ইতিহাসে দেখি রাজা বিজয়গিরির সেনাপতি হচ্ছেন রাধামন আর রাধামনের সহধর্মিনী হচ্ছেন ধনপদি। 

রাধামন-ধনপদি পালা পৌরানিক সাহিত্য ইতিহাসে তেমনি একটি ঐতিহাসিক প্রনয়োখ্যান। উক্ত উপাখ্যানে তারা নায়ক-নায়িকা, পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা দেখতে পাই। রাধামন এখানে বীর যোদ্ধা, সেনাপতি, বলবান, বীর্যবান, রূপবান এবং আর্দশবান একজন পতি। স্ত্রীর আকুল ভালোসাকেও যত্নে পাশে রেখে দেন,স্বযত্নে মাতৃভূমিকে রক্ষা এবং বিপদে প্রতিবেশী বা বন্ধুকে সাহায্য করাই যেন তার ব্রত নিয়ে। আর ধনপতি পতিভুক্তি একজন সতী  নারী, যেখানে স্বামীর মঙ্গলই তার একমাত্র কামনা। তারা চম্পক নগরের নরপতি সাদেংগিরির কন্যাদ্বয় মেনকা এবং কপতি’র পুত্র এবং কন্যা সন্তান। মেনকার-জয়মঙ্গলের গর্ভে জন্ম নিল রাধামন আর কপতি-নিলগিরির গর্ভে জন্ম নিল ধনপতি। রাধামন এবং ধনপতির শৈশব কৈশোর কেটেছে হেলেদুলে হাসি আনন্দে, রাঙাপুতুল খেলে, সুশীতল স্নীন্ধ ঘন ছায়াতল। জুমের ফুলপথে ঘুরে ফিরে আর দল বেঁধে জুম ঘরে বসে হাসি খেলে দিনগুলি অতিবাহিত হতো। তারা যুবক যুবতীরা মিলে জুমে নানা তরকারী খুজঁতে যেতো। বিষু দিন হলেতো কথাই নেই। পাইসনের জন্য যুবক-যুবতীরা দল বেধেঁ জুমে যেত তরকারী খুজঁতে। জুম থেকে নিয়ে আসতো মা শমোই, কুরাঙা শমই,মারফা, জুম্ম্যা বেগুন, জুম কুমড়াসহ নানা তরকারী। আর বাড়িতে ফিরার সময় নিয়ে আসতো জু-ম ফুলের গাছ। তারা এসে এটি রোপন করতো ছড়ার কোন বড় মরঙের (প্রকৃতি সৃষ্ট বড় কোয়া) পাশে। আর প্রার্থনা করতো তারা যেমন জীবন এইভাবে হেসেখেলে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। আর সাথে ছিল সবুজ গাছের সারি ও জঙ্গল আর নানা রকম ফল-ফলালি, পাখির কলকাকলী এবং আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । 

রাধামন এবং ধনপদির যৌবনের প্রথম বসন্ত কেটেছে সৌরভিত ফুল বনে। তাদের প্রেম-ভালোবাসা দেখে বসুন্ধরা হেসে উঠে আপন মনে। বসন্তের কোকিলও গেয়ে উঠেছে গান আপন মনে। ফাগুনের নব হিলোলে তাদের প্রাণে জাগে নব শিহরণ। ধনপতি শুরু থেকে নানাভাবে রাধামনকে ভালোবাসার কথা জানান দিলেও রাধামন ধনপতির ভালোবাসাকে সেভাবে গ্রহন করতে চাইনি প্রকৃতির নিয়মে। সে রাধামনকে পাওয়ার জন্য কুমারী বয়সে শ্রীবুদ্ধ চরণে পূজা দিবে মানস করে রেখেছে। ধনপদি রাধামনকে যখন তার ভালোবাসার কথা জানায় তখন প্রকৃতিও যেন খুশীতে ভরে উঠেছে তবু রাধামন বিনয়ের সাথে বলেছে সমাজের নানা বাধাঁধরা নিয়ম আছে। রাধামনের কথা শুনে ধনপতি বলেছেন- আমি মানিনা এইসব বাধাঁধরা নিয়ম কানুন। তিনি রাধামনকে মিনতি করে বলেছেন- 

                “তব পায়ে এ মিনতি মম, 

                  আশা তুমি করহে পূরণ, 

                  দাসী হয়ে চিরদিন সেবিব জীবনে তব দু’চরণ”। 

ধনপদি- চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাদের ধর্ম সাক্ষী রেখে আরো বলে- 

                 ‘তুমি বিনে পতি নাই নিজে আমিত্য জীব জীবন, 

                  তোমায় চরণ বিনে কিছুই নাই মম’। 

ধনপদির কথা শুনে রাধামনের মন গলে যায়। তখন রাধামন বলে- 

                 ‘ধর্ম সাক্ষী করে আজ হতে তুমি মম ধর্ম পত্নী হলে,

                  মানবের সত্যধর্ম বিনা নাই কিছু এই মহীতলে, 

                  সত্যের মহিমা সতী নারী নাম ভবে রবে চিরদিন”। 

শেষ পর্যন্ত রাধামন ধনপদির পবিত্র প্রেমে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। এরপর তারা প্রেমের সাগরে ভাসতে থাকে। একে অপরকে দাদা এবং বোন হিসেবে সম্বোধন করলেও রাধামন আদর করে ধনপদিকে ডাকেন ‘প্রাণেশ্বরী, ওগো সতি, সুব দনি’ হিসেবে আর ধনপদি স্বামীকে আদর করে ডাকে ‘প্রাণ নাথ, প্রাণেশ্বর’ হিসেবে। সে স্বামীকে খুব বেশী ভালোবাসে এবং স্বামীর মঙ্গল কামনা করে শয়নে স্বপনে সাথে স্বামীর আপদে বিপদে সবসময় মঙ্গল কামনা করেছে। 

এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে ধনপদি মাঝে মধ্যে রাধামন কাছে নানা কিছু আবদার করে বসত। সেরকম একদিন ধনপদি নদীতে গোসল করতে গিয়ে দেখল সুন্দর একটি ফুল নদীর পানিতে ভেসে আসছে। সে ফুলের গন্ধ কি মনোরম। এই পর্যন্ত যতগুলো ফুল সে দেখেছে এবং গন্ধ নিয়েছে এই ফুলটির কাছাকাছি কোনটি নয়। ফুলটি তুলে নিয়ে তার মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল- মা এটি কিসের ফুল। মা বলল এটি ‘দেব নাগেশ্বর ফুল’। ধনপতি আরো জিজ্ঞেস করল এই ফুল কোথায় পাওয়া যায় ? মা বলল- উজানে গাঙে ইরাবতী নদীর (এটি মায়ানমারের একটি নদী) তীরে শৈলগিরি কাননে এই ফুল ফোটে। মা আরো বলল- অলি মধু খেয়ে এই ফুল নদীতে ফেলে দিয়েছে। ধনপদি তখন মনে মনে ভাবতে থাকল সদ্য ফোটা এই ফুল যে কি সুন্দর হবে। তখন তার মনে বাসনা জাগে সদ্য ফোটা এই দেব নাগেশ্বর ফুলটি একদিন দেখবে এবং দাদা রাধামনকে সে তার মনের বাসনা কথা জানাবে। একদিন বাসন্তী পূর্ণিমার শুভ্র রাতে সে তার মনের কথা রাধামনকে বলছে, ধনপতি ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্নগুলি দেখছে। একটু একটু শীতল আমেজতা আলোর ছলকানি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে দিনমনি পূর্বাকাশে জ্বল জ্বল করে উঠেছে। 

বছর শেষ বাসন্তী পূর্ণিমা তিথি। ধনপতি ঠিক করল বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামনকে তার বাসনার কথা জানিয়ে দেবে। এই বাসন্তী উৎসবে সবাই নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা নিয়ে। সেসময় রাধামন-ধনপতির মতো প্রেমিক যুগল; কুঞ্জবী-কুঞ্জুধন, নিলংবী-নিলংধন, মেয়াবী-মেয়াধন, কানেকবী-কানেকধন সবাই মিলে ঘিলা খেলা খেলবে বলে ঠিক করল। বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামন আর ধনপদি দেব নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইরাবতী নদীতে চলে যায়। তারা বনে গিয়ে দেখে অতি উচ্চ ডালে এই ফুলগুলি ফুটে আছে। সে মনে মনে ভাবে এই ফুল নিতে হলে অবশ্যই বৃক্ষ দেবতার আর্শীবাদ লাগবে। এই দিকে রাধামন যখন দেব নাগেশ্বর ফুল নেওয়ার জন্য লতাগুলিকে বাশেঁর মতো করে বেঁধে তৈরী করতে লাগল তখন ধনপদি বলল যে, আমি এই অন্ধকারে কিভাবে নিচে একা থাকব। তাছাড়া তখন এই ইরাবতী নদীর বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্য হাতি, ভলুক, বাঘ, নেকড়ে আরো অনেক বন্যপ্রাণী। ধনপদির বিপদের কথা ভেবে রাধামন জলের উপর এটা জলটংগি মাচাং তৈরী করে দেয় এবং ধনপতিকে নিজের কাঁধেতুলে সে জলটংগীতে তুলে দেয়। যেন ধনপতি নির্ভয়ে থাকতে পারে। সে যখন ফুলের জন্য বৃক্ষ শাখায় উঠে হঠাৎ আগে দেখা ফুলগুলি অদৃশ্য হয়ে গেল, দুরের শাখায় মাত্র একজোড়া ফুল দেখা যাচ্ছে। রাধামন বুঝতে পারে বৃক্ষ দেবতা ফুলগুলি অদৃশ্য করে রেখেছে। পরক্ষণে রাধামন লক্ষ্য করেছে বৃক্ষ দেবতা তাকে বাঘের ছায়া হয়ে ভয় দেখাচ্ছে। এতে রাধামন ভয় পেয়ে গাছ থেকে ভূতলে পড়ে গিয়ে মূর্ছা গেল। ধনপতি হঠাৎ লক্ষ্য করল কি যেন একটা নিচে পড়ে গেল এবং শব্দ হল। চেয়ে দেখল রাধামন নিচে পড়ে গিয়ে মূর্ছা যায়। মূর্ছা পাওয়া রাধামনকে ধনপতি কোলে তুলে নিয়ে খাদির আচল দিয়ে মুখ মুছে দেয় এবং রাধামনকে ডাকতে থোকে প্রাণেশ্বর, প্রাণেশ্বর বলে। রাধামনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ধনপতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শোকাকুল হয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্বরণ করে বলে- প্রভু দাও হে আমায় কুল। তখনও বৃক্ষ দেবতা নানাভাবে ধনপতিকে ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাঘের গর্জনে, মাঝে কালান্তর সাপ হয়ে, আর মাঝে মধ্যে বৃহৎ হস্তি রূপে ধনপতিকে বৃক্ষ দেবতা ভয় দেখাচ্ছে। এদিকে ধনপতির আকুল ক্রন্দনে এবং শোকে দেহ মন হয়ে গেছে মলিন কারণ তার জীবনের সাথী পড়ে আছে অচেতন হয়ে। তবু এ ঘোর বিপদে ধনপতি ভগবানকে ডাকে বারে বারে। ধনপতি বলে আমি যদি সতী নারী হয়ে থাকি তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। ধনপতি কথা শুনে বৃক্ষ দেবতা হাজির হয়ে সঞ্জিবনী মন্ত্র পাঠ করে রাধামন আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সে সুস্থ হয়ে দেখে ধনপতি কোলে তার মাথা। তখন রাধামন শুনতে পেল- আকাশ ও ভূমি বাসীদেব নাগ যক্ষ মহা ঋদ্ধি মান,রক্ষে সদা সতী নারী ধার্মিক সুজন পূন্যবান। 

প্রেম-ভালোবাসা আর রাগ-অনুরাগের এবং মান-অভিমানের মধ্যে দিয়ে রাধামন ধনপদির ভালোবাসা পূন্যতা পায় তাদের শুভ পরিনয়ের মধ্য দিয়ে। রাধামন ধনপদির বিয়ের সমস্ত কিছু আয়োজন করল রাজ পুরোহিত ছলারবাপ। যিনি রাজ দরবারে শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল এবং নানাবিধ পূজা-আর্চনা করে থাকেন। রাধামন-ধনপতি যাকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। ছলারবাপও তাদের নাতি-নাতনি বলে যথেষ্ট আদর স্নেহ করেন। একদিন রাধামন-ধনপদি ছলারবাপের কাছে গিয়ে বলে দাদু আমাদের বিয়ের চুমুলাঙ আপনাকে করে দিতে হবে। ছলারবাপ তখন বলে, দাদু-দিদি ভাই আমি বুড়ো মানুষ কিভাবে আমি তোমাদের চুমুলাঙ করে দিব আমিতো হাটতে তেমন পারি না। রাধামন-ধনপদি তবু ছলারবাপকে অনুরোধ করতে লাগল- তাদের বিয়ের চুমুলাঙ করে দিতে। অনেক অনুরোধের পর ছলারবাপ রাজী হয়ে গেল। তখন রাধামন-ধনপদি বলল, দাদু তাহলে তুমি আমাদের বিবাহ জীবন কেমন হবে রাত্রে নিশাদেবীকে স্বরণে বিজ্ঞেস করবে। ছলারবাপ বলল ঠিক আছে। পরদিন ছলারবাপ রাধামন ধনপদির বিয়ের চুমুলাঙ করে দিল। এখানে একটি বিষয় উলে­খ্য যে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এখনো বিয়ের পর চুমুলাঙ করে নতুন বউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ঘরে তোলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের চুমুলাঙ করে দেওয়ার পর ছলারবাপ তাদের মন ভরে আর্শীবাদ করল এবং বলল আর্শীবাদ করছি- তোমাদের দাম্পত্য জীবন মঙ্গলময়, সুখময় এবং মধুর হউক। তোমরা নিরাময় র্দীঘ জীবন এবং তোমাদের যথা ইচ্ছা পূর্ণ হউক আর তোমাদের ঘরে লাল টুকটুকে এক বীর সন্তান আসুক। চুমুলাঙ শেষে রাধামন তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল দাদু রাত্রে তুমি নিশাদেবী দর্শন করে কি দেখলে ? তখন ছলারবাপ বলল, না অমঙ্গল কিছুই দেখিনি, তবে। তবে মানে কি দাদু রাধামন জিজ্ঞেস করল। তাহলে মন দিয়ে শুন দাদা-দিদি আমার স্বপ্নের বিবরণ। আমি গতরাত্রে নিশাদেবী স্বরণ করে ঘুমিয়ে পড়ি, প্রথম প্রহরে স্বপ্ন দেখলাম- আমি চৌদ্দ ডিঙা সেজে নানাবিধ পন্যদ্রব্য নিয়ে উজান গাঙে পাল তোলে চলেছি। অনেকদুর এগিয়ে নানা ফুল-ফল ও পশু-পক্ষী পরিপূর্ণ এক সুবিশাল ছায়াশীতল বটবৃক্ষে নিচে বিশ্রাম করেতেছি। এমন সময় ঘুম ভেঙে যায়। তারপর দাদু কি হলো উভয়ে প্রশ্ন করলো। তারপর ছলারবাপ বলল- আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ে নিশাদেবী স্বপ্ন দর্শন দেওয়ার অনুরোধ করলে তখন দেখলাম- পূর্ব দিকে উঠেছে এক ধুমকেতু নক্ষত্র তারা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে দেখি পূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে। স্বপ্নের অর্থ কি হবে জিজ্ঞেস করলে ছলারবাপ বলল- উজান গাঙে অর্থ হচ্ছে- তোমাদের দাম্পত্য জীবন উজান দিকে চলবে মানে সুখের হবে। ছায়া শীতল বট বৃক্ষ অর্থ হচ্ছে তোমাদের একটা সুপুত্র জন্মাবে বৃদ্ধ বয়সে সেই পুত্রের আশ্রয়ে সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। আর দ্বিতীয় স্বপ্ন পূর্ব দিকে যে ধুমুকেতৃ তারা দেখেছিলাম তার অর্থ হচ্ছে- একসময় দেশে যুদ্ধের ধামাকা বেজে উঠবে। তারপর রাধামন প্রশ্ন করে তাই যদি হয় দাদু তাহলে কি আমায় যুদ্ধে যেতে হবে ? তার দাদু বলল- দেশে যদি যুদ্ধের ডাক এসে যায় তাহলে কি তুমি নীরব থাকতে পারবে ? এভাবে সুখ দুঃখের স্বপ্ন দর্শন নিয়ে তারা সংসার শুরু করতে লাগল। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, তন্চংগ্যা সমাজে অনেকে তাদের শুভ কাজ শুরু করার আগে এরকম শুভ-অশুভ স্বপ্ন দর্শন চাওয়া হয়। 

একদিন রাজ সভা থেকে খবর এল যুদ্ধে যেতে হবে। পার্শ্ববর্তী রাজা উদয়রাজ তার রাজ্যে পূর্ব দিকের জংলী কুকীরাজ কালাঞ্জয়, দক্ষিণ দিকের রোয়াঙ্গের মঙ্গলরাজা আর সমুদ্র কুলের জল দস্যুরা দিবালোকে এসে নরহত্যা নারী নির্যাতন করছে। আজ তার রাজ্যবাসীরা গৃহহারা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিত্র চম্পক রাজার (উদয় গিরি) থেকে সাহায্য চেয়েছেন। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, এরই মধ্যে রাধামন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যুবরাজ বিজয়গিরির সেনাপতি হিসেবে যোগদান করেছেন। একদিন বিজয়গিরি রাধামনকে ডেকে বলল- শুন, প্রিয়সখা- উদয়পুর রাজ্য আজ দস্যু কবলিত, পিতা আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, তুমিও যাবে আমার সাথে সেনাপতি হিসেবে। প্রতি উত্তরে রাধামন বলল- যুবরাজ, তুমি মম সখা, তুমি যা আদেশ করবে আমি তা পালন করতে বাধ্য। তিনি আরো বললেন- বীরধর্ম্মো হলো বিপনকে প্রাণপনে রক্ষা করতে হবে যুদ্ধ করে। এইদিকে যুদ্ধের কথা শুনে ধনপদির মন অস্থির এবং চঞ্চল হয়ে উঠল, তবু সে কিন্তু তার স্বামীকে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল না। এখানে দেশপ্রেম এবং পতিভক্ত সমতালে। তবু স্বামী বলে কথা, এই চিন্তা থেকে সে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে,বলে- 

“শুন ওগো স্বামী ! গভীর নিশীতে দেখেছি স্বপন,

অতীব ভীষণ- কাঁপে ভয়ে মম প্রাণ,

সে স্বপ্ন স্মরি। ভাগ্যে মোর কিবা আছে জানি না।”

রাধামন বলল কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি আমাকে খুলে বলো না, কি ভীষণ স্বপ্ন করিলে দর্শন কেন ভয় পেলে মনে। ধনপতি বলল তাহলে শুন মোর প্রাণনাথ !

“গেরিয়া স্বপন ভীত মম প্রাণ, রহে যেন প্রলয় পবন,

কাপায়ে ধরণীতল,কক্ষচ্যুত তারকা মন্ডল, 

রাজদন্ড উড়ে মহাশূন্যে, তুমি নাই পাশে মম, 

তাই একাকিনী আমি, চেয়ে থাকি শূন্য পানে, বসে একা শূণ্য ঘরে।”

ধনপদি আরো বলে স্বপ্ন দেখে রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল তখন শুনলাম- নানা পশু-পাখি ডাকিতেছে। পাখি ভীমরাজ ডাকছে গগন বিদারী করুন স্বরে। আরো শুনলাম টিয়া পাখি ঝাক উড়ে যাচ্ছে, বিকট শব্দে বানর-বানরী ডাকছে, স্বশব্দে পালিয়ে যায় হরিণ-হরিণী। ঘুঘু ডাকছে আম ডালে বসে। এমন নিশীথ রাতে পশু-পক্ষী দিশেহারা হয়ে কেন আর্তনাদ করছে। জিজ্ঞেস করে ধনপদি তার স্বামী রাধামন থেকে। রাধামন বলে দুর কর মনের গতি। রাধামন বলে ত্রেতা যুগে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাবন এবং রামের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় আর দ্বাপর যুগে কুরু ও পান্ডবে যখন যুদ্ধ হয় তখনও নিশীথে লোকে পশু-পক্ষীর ডাক শুনেছে। কই তখনতো কোন অধর্মের জয় হয়নি, ন্যায় ধর্মের এবং সত্যের জয় হয়েছে। তুমি জেনে রাখো কোন অমঙ্গল হবে না আমাদের। বীরের রমনী তুমি, হাসি-মুখে আমাকে বিদায় দিতে হবে তোমাকে। তুমি মনে রাখবে সতীর পতি হয় না পরাজয় কখনো। রাধামন আরো বলে কোন চিন্তা তুমি করো না দেব ধর্ম থাকিবে সহায় আমাদের সাথে। সত্য যদি হয় তুমি সতী নারী তাহলে শক্রর সাথে রণে আমি অবশ্যই জয়ী হবো। ধনপদি বললো- তুমি অবশ্যই যুদ্ধে জয়ী হবে, আমি এই প্রার্থনা করি শ্রী ভগবান বুদ্ধের কাছে। ধনপদি আরো বলল-তুমি যেদিন জয়ী হয়ে ফিরবে সেদিন দুজনে মিলে বুদ্ধের চরণ তলে পূজা দেব, তা আমি মানস করে রাখবো। ধনপদি স্বামীকে বলে- মিনতি তোমার চরণে তুমি দিগি¦জয় হয়ে ফিরে আসবে, আমি তৃষিত হরিণীর মতো তোমার পথের পানে চেয়ে থাকব। রাধামন বলে প্রাণেশ্বরী তুমি চিন্তা করো না- রণে স্থলে সর্ব ক্ষেত্রে তোমার চাঁদ মুখখানি আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে। 

রাধামন একদিকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অন্যদিকে ধনপদির মন চঞ্চল হয়ে উঠছে তার স্বামীর জন্য। স্বামীর মঙ্গল কামনার জন্য তার কত না মানস, কত না নানা আয়োজন। তারই অংশ হিসেবে- সে তার স্বামীকে যুদ্ধে যাত্রার আগে সতীত্ব নির্দশন হিসেবে নিজ হাতে বুনা একটি কোমড় বন্ধনী স্বামীকে উপহার দেয়। যে কাপড়টি সে একদিনে সুতা কেটে একদিনের মধ্যে তৈরী করেছে। ধনপদি তার স্বামীকে বলে- এই কোমড় বন্ধনি পড়ে যুদ্ধ করলে তুমি অবশ্যই জয়ী হবে। রণ সম্মুখে শত্র“ পরাজিত হবে। ইতিহাসে জনশ্রুতি আছে রাধামন এই কোমড় বন্ধনী পড়ে যুদ্ধে জয়ী হয়। এখানে ইতিহাসের একটি বিষয় উলেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যে পাঁচটি কাপড় পরিধান করেন (পিনন, খাদি, সালুম, মাদা কাবং,পা-দুরি) তার মধ্যে পা-দুরি (কোমড় বন্ধনি) অন্যতম। এই পা-দুরিই হচ্ছে ধনপতির সতীত্ব নির্দশন কোমড় বন্ধনি। এই কোমড় বন্ধনির বিশেষত হচ্ছে পরনের কাপড়কে শক্ত করে আটকে রাখা যেন কোন ভাবে বা কর্মে খুলে না যায়। এই পা-দুরি বা কোমড় বন্ধনী তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যখন কাপড় পরেন বিশেষ করে পিনন পরেন তখন একে  গায়ের বা কোমড়ের সাথে শক্ত ভাবে আটকে রাখার একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যেন কাপড় শরীর থেকে কাপড়টি খসে না পড়ে। যেটি অন্য আদিবাসী মেয়েরা পড়ে না। ধনপদির কোমড় বন্ধনীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্র পা-দুরি‘র কোন ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে কিনা। তাছাড়া ব্যক্তি রাধামন-ধনপতির মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি তাদের ইতিহাসের সুখ স্মৃতি অনুভব করে। যেটি ইতিহাসের পাঠ্য বা গবেষণার বিষয় হতে পারে। 

উপসংহারঃ আদিবাসী সাহিত্যে রাধামন-ধনপতির মতো আরো অনেক পৌরানিক সাহিত্য বা পালা রয়েছে যেগুলি সাহিত্য প্রেমিদের আন্দোলিত করে তুলে। এই উপকরণগুলি ‘সাহিত্য রস’ আস্বাদনে এখনো অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে সবার অগোচরে। এগুলিকে তুলে এনে যত্ন করতে হবে রত্ন পাওয়ার জন্য। তখন আদিবাসী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও নতুন মাত্রা বা প্রাণ পাবে। 

তথ্যসূত্রঃ

১.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাধামন ধনপদি কাব্য। 

২.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়গিরি(নাটক)

ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়নঃ তঞ্চঙ্গ্যা উত্তরাধিকার প্রশ্ন  

ড. মনিরুজ্জামান (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

 ১। ভূমিকাঃ ভাষার আন্তঃসম্পর্ক, বিভিন্নতা আকস্মিক মিল

রবীন্দ্রনাথের একটা বাণী আছে যে,  জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা ‘। এটা ভাষাতত্ত্বেও প্রযোজ্য। বিশেষত তুলনার ক্ষেত্রে। বিষয়টা তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা ভাষার আলোচনার ক্ষেত্রে বিচারযোগ্য কিনা আমরা এখানে তা দেখার চেষ্টা করব। তার আগে আলোচনার একটা মডেল অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সকলেই জানেন ভাষা বড় নিরঙ্কুশ। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় অপরিচিত ধ্বনিপুঞ্জ মাত্র। তথাপি অবাক হবারও কিছু নেই যদি দেখি ইন্দোনেশিয়া মালেশিয়া ভাষায় ‘ পণ্ড ‘ শব্দ বাংলা ভাষার ‘ পণ্ডিত – এর কাছাকাছি কিংবা ঐ সব ভাষায়ও বাংলার মতো ‘ মাতা ‘ বলে শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এইসব শব্দের অর্থ একেবারেই ভিন্ন। আবার একই অর্থেও অভিন্ন শব্দ বা সমানুরূপ শব্দ দুই ভাষায় থাকা সম্ভব। যেমন পার্শি ‘বদ’ ইংরেজি ‘ bad ‘ (দুয়েরই অর্থ ‘ খারাপ ‘)। কিংবা পেরুর আন্তঃপাতি দেশীয় কোন ভাষায় ‘ইন্তি’ আর বলিভিয়ার কোন উপজাতীয় ভাষায় * ‘নৃতি’ – দুয়েরই অর্থ ‘দিন’। এইভাবে দেখা যায় সঠিক কোন ধারাবাহিকতা ছাড়াই বা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ক্রম ব্যতিরেকেই আপাত মিল প্রদর্শনকারী ভাষার উদাহারণ অবিদ্যমান নয়। এইসব আকস্মিক মিল শব্দ ভাষা আলোচনায় ও ভাষাবর্গ নির্মাণে কতটুকু সহায়ক এসব নিয়ে ইদানীং আলোচনা শুরু হয়েছে। ডেভিড পনি ও রবার্ট ক্রুসি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আরাওয়াক ও মাপুচেদের ভাষা তুলনা করতে গিয়ে দেখেন দুই ভাষার আকস্মিক মিলগুলি বিরহিত করা গেলে দুয়ের সম্পর্ক নৈকট্য বিচার সহজ হয়। এজন্য তাঁরা উপায় নিরূপণ করেন ও তার একটি মডেল উদ্ভাবন করেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে তাঁরা বংশগতিধারা নির্মাণের পূর্ববর্তী মডেলগুলি একেবারে বাদ দেন নি এবং নিত্য সম্বন্ধযুক্ত প্রায়ানুরূপ গঠনগুলির মিল পুনঃপরীক্ষার বিষয় বলেই মেনে নেন। আসলে তুলনামূলক পদ্ধতিতে অনুমান নির্ভরতার যে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি একসময় ধ্বনি পরিবর্তনের ধারা পুনর্গঠনে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতো , বর্তমানে তার স্থলে তথ্য বা উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিকতা ও ঐ তথ্যের যাবৎ জ্ঞান সঞ্চারণ, সংগঠন ( organisation ) ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন ( modify ) আনয়ন করেন। তাঁদের এই প্রত্যয় ইদানীং আমেরিকার বহু ভাষারই সম্পর্ক উদ্ঘাটনে আদর্শ নমুনা হিসেবে আজ পরিগণিত। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রজাতির ভাষা বিষয়ে আমরা যখন ভাবি তখন সে সব ভাষার আন্তঃসম্পর্ক আমাদেরও ভাবিত করে। আমরা কখনো অস্পষ্ট সনাতন ধারণা থেকে কথা বলি অথবা জাতীয়তাবাদের ধারণা মিশ্রিত করে কোন না কোন রাজনৈতিক ভাষ্য দেবার প্রয়াস পাই। এসবের কোনটাই ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে গ্রহণীয় নয়। সম্প্রতি ইউজিন ই . লুস – এর একটি আলোচনা পড়ে আমার এ প্রত্যয় আরো দৃঢ় হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় আমার প্রয়াস হবে লুসের চিন্তার খানিকটা অংশ এখানে যোজনা করার।

বর্তমান প্রবন্ধে উপজাতীয় ভাষার কিছু অপ্রকাশিত তথ্য থেকে দু’একটি প্রাক – গবেষণা মন্তব্য উপস্থিত করার চেষ্টা করা হবে উপরিল্লিখিত আদর্শের সামান্য প্রভাবের আলোতেই। তবে এই আলোচনা কোন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা – কর্ম নয়।

২। ভাষার বিকাশেউত্তরাধিকারসঙ্কট ভাষাঅনুগমন

আধুনিক ভাষাতত্ত্বে অনুসন্ধানের একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে বংশগত ধারানুক্রমের সমস্যা। তামিল ও জাপানী ভাষার মধ্যে যেমন বংশগত সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় না, তেমনি জাপানের বহু উপভাষা রয়েছে যাদের আন্তঃ সম্পর্ক নির্ণয় ও বংশগত সম্পর্ক ভিত্তিতে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব। পোল্যান্ডের এক ঐতিহাসিক – ভাষাতত্ত্ব সেমিনারে (১৯৮৩) উপস্থাপিত প্রবন্ধে এক ভাষাবিদ দেখান ভাষার প্রত্নস্তরে একাধিক রূপ থাকাটা বিচিত্র নয়, ফলে ধরা যাক, মূলে যদি থাকে

* নদ > সেখানে পরবর্তী স্তরে (Reflex) নদ থাকতে পারে, আবার পূর্ব স্তরের অন্যবিধ রূপগুলোও আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। যেমন * নদ-

দ (সরলীকরণ) নদ (সংরক্ষণ) ত (বিনাসিক্যীকরণ)

সুতরাং উত্তরাধিকার প্রশ্ন এখানে উপভাষার ব্যবহারিকতার মাত্রার (যদি না পার্শ্ববর্তী বা চাপানো ভাষা শক্তিশালী হয়) ওপর নির্ভর করে। নবায়ন প্রক্রিয়ায় বিশেষ ধারানুসরণও এখানে বিশেষ বিচার্য এরূপ ক্ষেত্রে নদ > ত এই নবায়ন প্রক্রিয়া সরাসরি উত্তারাধিকার সংকটের পরিপন্থী।

সম্ভবত এখানে ত = ত + < দ । এবং দ = ত + দ শুধু তাই প্রত্নরূপ অর্বাচীন রূপ নতাকি আধুনিক রূপ মুদাখী / মুদা (অনুসর্গ যোগ ) (একীভূতি : k – i > ki এবং স্বরাঘাতে পরিবর্তন) (পুনর্গঠন অনুসর্গ লোপ ও অক্ষর গঠনে নব্য ব্যাকরণীকরন) এই রূপ বিবর্তনের কথাও ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। এই ব্যাখ্যা থেকে অঘোষ দীর্ঘীভবন এই সহজেই বুঝা যায় এইসব সমজ শব্দে কালের প্রবাহে ঘোষ ঘোষ রূপের বৃত্ত , এবং অল্পপ্রাণ- > মহাপ্রাণ হ্রস্বস্বর নিয়মগুলি ও তাৎপর্য পেয়েছে সরল আবর্তনের মধ্যেই ভাষায় এইরূপ পরিবর্তনকে দ্বিরাপরিবর্তন বা দ্বিমুখ ধারা পরিবর্তন বলা হয়। আভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনের সূত্রে এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের ব্যাখ্যা ও পথরেখা ক্রমসম্পর্ক (CR: Chronological Relation) আমরা পেতে পারি। ই . লুস এবং তার অনুসরণে আরো কেউ কেউ এই মতটাকে সাধারণ বলে মনে করেন। আভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন সূত্র ধরে পরিবর্ধন করে বংশগত সম্পর্ক বা ভাষার আস্ত সম্পর্ক বিচারেও প্রয়োগ করা সম্ভব। জাপানী ভাষাবিদ সুসম্মু ওনো এইভাবেই সক বিচ 1224 তামিল ও জাপানীর আন্তঃসম্পর্ক ও বংশগতির ধারা পুনর্নির্মাণে দুঃসাহসিকতা SEMIN www দেখিয়েছেন। এই দুই ভাষার সাথে তৃতীয় কোন ভাষায় বহু অতীতের কোন A ‘মিসিং লিংক’ আবিষ্কারের এটাই হয়ত এখন গ্রহণীয় ধারা হয়ে উঠবে, বিচিত্র WRIST KEH GOLS, D কি! অথবা এখানে হয়ত ভাষা অনুগমনের (Succession) কোন ইঙ্গিতও থাকা সম্ভব, কে জানে? বিষয়টাকে আমরাও গুরুত্ব সহকারে বিচারের বিষয় রূপে দেখতে পারি, বিশেষত বাংলাদেশের আন্তঃউপজাতীয় ভাষায় বিশেষতঃ চাকমা-তনচংগ্যার সম্পর্ক নির্ণয় ক্ষেত্রে। চাকমা ভাষাকে ‘ ভাষা অনুগমনে’রই একটি উদাহারণ বা রূপ বলা যাবে কি? আমরা সাহিত্যিক চুরির (Plagia rism) কথা জানি, কিন্তু অতীতে বহু ভাষাভাষী ও প্রাচীন যুদ্ধ বাহিনী গুলিতে বা যুদ্ধযাত্রার সামরিক পরিবেষ্টনে ‘ মেলে ‘ পরিণত হয়ে দেশ ছাড়া, সংস্কৃতি ছাড়া, এবং আত্নপ্রকাশের অধিকার ছাড়া হয়ে পরবাসী হয়েছে । ভারতের ‘ সৌরা ‘, DEL মধ্যপ্রাচ্যের ‘ হিট্টি ‘ এবং তুরস্ক প্রান্তের বহু প্রাচীন জাতি পরিচয়ের দিক থেকে আজ এভাবেই যেমন পরভাষা গ্রহণ করেছে তেমনি অপর প্রধান ভাষা বা নব্যজাত ভাষা ( জায়মান স্তরে) এইসব ভাষাভাষীকে স্বভাষায় অপহরণ ও উত্তরাধিকার দান করেছে। উর্দু ভাষার প্রকৃত ভাষাভাষী এখন যেমন অপহৃত , ঠিক তেমনি।

৩। ভাষাপরিচয় চুরি আয়তন তত্ত্ব

বিশেষ বিশেষ এলাকায় বিশেষ ভাষাগুলি কিভাবে বিস্তার পায় ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করে এবং সে ক্ষেত্রে কিসের ভিত্তিতে আয়তনের তারতম্য নির্দিষ্ট হয়, এইসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একবার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে । এই মাঠকর্মের রিপোর্টটির প্রতি লক্ষ্য রাখেন SIL (ভাষা তাত্ত্বিক সামার স্কুল) রিপোর্টে দুটো জিনিস বোঝা যায়।

যথা –

১। কোন মহাদেশের কোন এলাকায় কোন ভাষায় কত জনসংখ্যা কি আকার লাভ করবে এটা একেবারেই পারিবেশিক বিষয় । পরিবেশের আনুকুল্য কিসে নির্ভর করে তার উপরই এর উত্তর নির্ভরশীল। (এরও বহু তত্ত্বীয় প্রসঙ্গ আছে এবং সমাজ – ভাষাতাত্ত্বিক আদর্শ (norm) ও পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের Log norm সংক্রান্ত ধারণাও এর সাথে প্রযুক্ত)

২। ভাষা এখানে নিশ্চল নয় , পারস্পরিক লেনদেন সাপেক্ষ। তবে যারা বিশেষ অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে পরস্পরকে অর্থাৎ পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারে না তাদের মধ্যে দ্বিভাষিকতা বৃদ্ধি পায় অথবা তাদেরই ভাষা ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন মনে করা হয়। যেমন ৫৪৪৫ টি ভাষার মধ্যে প্রতি ৪ টি ভাষার মধ্যে একটি ভাষার জনসংখ্যা বাস্তবিক সৌভাগ্যসূচক। কিছু কিছু ভাষা তো রীতিমতই ঈর্ষণীয় , কিছু ভাষা মোটামুটি মানানসই যদিও তাতেও অতিরঞ্জন থাকা অস্বাভাবিক নয়। আবার একইভাবে কিছু ভাষার ভাগ্য অপহত ; এগুলি অবমূল্যায়নকৃত ও হৃতমূল্যক। SIL কৃত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে এতে সামগ্রিক বিচারের ওপর কোন প্রভাব পড়ে নি। সম্ভাব্যতা বা সম্ভাবনা তত্ত্ব মেনে নিলে বলতে পারি এটা দ্বিভাজক ও দ্বিপদী বিন্যাস ও স্বাভাবিক বিন্যাসে সঠিকতা নির্দেশের ক্ষেত্রে একটি প্রয়াস বা প্রক্রিয়া। সঠিক সত্য সবসময়ই সম্ভাব্য সত্য, কারণ তার ভিত্তি আপাত প্রাপ্ত তথ্য নির্ভর । কিন্তু আসলে এরূপ আপাত প্রাপ্ত তথ্য নির্মিত লগ – নর্মের ছক রেখা (lognormal curve) থেকে সত্যের দূরত্ব ঘটা সম্ভব। এই দূরত্ব হতাশা ও বঞ্চনা বোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিরুত্তাপ ও ক্ষণিকতার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না বা তারও বেশি এমনকি কোন ভাষা সংঘাত বা অন্দোলনের উৎস মুখ গড়ে তুলবে না এটাই বা কি করে মনে করা যায়? এছাড়া একপার্শ্বিক তথ্যপ্রাপ্তির কারণে বা পক্ষপাতিত্বের ফলে এই কার্ভ রেখা যে যথার্থ ও সামগ্রমানক নয় (total population), তার নিশ্চয়তাই বা কি? এখানে আরো একটি গুণনীয়ক বিষয় যোগ করা আবশ্যক। উপরোক্ত রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে উত্তর আমেরিকায় কিছু ভাষা মরে যাচ্ছে, বা ম্রিয়মান হচ্ছে আর বাকীগুলি এখনো বিপদাক্রান্ত হয়নি। গ্রস্ত না হওয়ার কারণ পারিবারিক ভাবে টিকে থাকার ব্যাপারটাকেই তুলে ধরা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে তাদের বলা হচ্ছে ‘ উপভাষা ’। বহু ক্ষেত্রে এগুলোর পরিচয় ‘ বিকৃত ‘ (dis torted)। বহু ক্ষেত্রে এগুলি শ্রুতিভাষা মাত্র (কথ্য ভাষার বিপরীত) , যদিও একই বা প্রতিযোগিতামূলক (আংশিক বা পূর্ণ) পরিবেশে ভাষা কথকের সংখ্যাও যথেষ্ট বিদ্যমান। এরা পাশাপাশিই বাস করছে। দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব, শিল্পায়ন, দ্রুতনগরায়ণ, যুদ্ধ, সংঘাত, সাম্প্রদায়িক আঘাত সবকিছু নিয়েই মানুষের এই অবস্থান। কিন্তু ভাষা তাতে মরে না। ভাষা মরে উপনিবেশি অধিকার আরোপে এবং দুর্বলতার সুযোগে মান্য ভাষার বিস্তারে। এছাড়াও আশ্চর্য নয় যে অবস্থাভেদে ‘ রাক্ষুসী ভাষা’র কথাও জানা যায়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে এক ভাষা অন্য ভাষাকে আত্নসাৎ করে নেয় বা তার ভাষাভাষীকে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নেয়। Some language occasionally gobble up others , or steal speakers from them , in what is known as ‘ language succcesion ‘ ( J.E. Grimes )। এ ক্ষেত্রে ভাষা অনুগমনের কথা আগে বলেছি।

৪। তনচংগ্যাদের অবস্থান

তঞ্চগ্যা, তংচঙ্গা, তংচৈংগা, টংচঙ্গা, তনচংগ্যা – এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন বানানে যাদের পরিচয় সেই তাদের প্রকৃত অবস্থানের কথা আগে বলে নেওয়া আবশ্যক।

১৯৯১ সালের জনসংখ্যা পরিগণনায় চাকমা ও তনচংগা ভাষাভাষীর সংখ্যা যথাক্রমে ২৫২৯৮৬ এবং ২১০৫৭ জন। চাকমাদের অবস্থান বরিশাল (১০৪৯), খুলনা (৬১৪), চট্টগ্রাম (২৪৮৩২১) , ঢাকা (২৯৯৯), রাজশাহী (৩) বিভাগের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু তনচংগাদের অবস্থান শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামেই দেখা যায়। বাংলাদেশে হরিজন বাদে জনসংখ্যায় নিম্নতম জনবাসী হিসেবে অর্থাৎ দুই হাজার বা তার নিচে যাদের অবস্থান তাদের মধ্যে রয়েছে বংশী, চাক, খ্যাং, খমই, লুসাই, মুণ্ডিয়া, টিপরা, উরুয়া এবং অনামা পাহাড়ী (?) প্রভৃতি এবং ‘বিবিধ’ শ্রেণীর আরো কিছু জাতি বা উপজাতির লোকেরা।

তবে লুসাইদের অবস্থানই সাধারণ পাহাড়ীদের মধ্যে সর্বনিম্ন (৬৬২)। জনসংখ্যা তত্ত্বের বড় দুর্বলতা এখানে যে তাদের হাতে তথ্য সম্পূর্ণভাবে আসেনা , এলেও শ্রেণীবিভাজনের সনাতন রীতিই সেক্ষেত্রে কার্যকর থাকে। কারা লোহারু, কারা কামার, কিংবা কারা পাহাড়ী এসব তথ্য যাচাই করা যেমন অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব নয়, বিভিন্ন পাহাড়ীদের চিহ্নিত করাও তেমনি কষ্টকর। দক্ষ লোকবলের অভাবই নয়, জনতত্ত্ব, নৃ – বিজ্ঞান ও ভাষাতত্ত্বের জ্ঞানের সংমিশ্রণে যে পরিচিতি বা বিবরণ প্রদান সম্ভব সেটা সরকারী কর্মী বা কর্মচারীদের আয়ত্তের বাইরে। এছাড়া জনসংখ্যা গণনার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কোন দেশেই এক নয়, এমনকি বিভিন্ন সরকারের আমলেও বিভিন্ন হয়। তথাপি বিচিত্র কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন রাজবংশীদের ক্ষেত্রে। এরা নিজেদের কোচ জাতির বংশধর বলে দাবী করেন। সম্ভবত এরা বোরোদেরই অংশ। লোকগণনা – প্রতিবেদনে ‘বংশী’রা ঢাকাবাসী একটি বর্ণ (caste) আর ‘রাজবংশী’গণ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জনবাসী জাতি। কিন্তু রাজবংশী মুসলমানও হয়, বৈষ্ণবও হয়। জনসংখ্যা গণনা মতে (১৯৯১ সন) এদের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার (৫৪৪৪ জন) হলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কারণ এদের অন্তঃপাতি গোত্র সংখ্যাই ১২ টি । এরা রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের প্রতিটি জেলা ছাড়া ময়মনসিংহেও এদের বহু বসবাস। ঠাকুর গাঁ অঞ্চলে তাদেরই একটি বিশেষ গোত্র বা উপ – বর্ণ হচ্ছে পলিয়্যা ; তদেরই সংখ্যা রাজবংশীদের মোট জনসংখ্যারই প্রায় অর্ধেক। (উল্লেখ্য রাজবংশীরা এখন নেপাল, ভূটান, আসাম, তিব্বত ও হিমালয়ের নানা উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে , যাদের পরিচয় সন্ধান নৃ – বিজ্ঞানী ও ভাষাবিজ্ঞানিদের একটি বিশেষ প্রিয় এলাকা। তনচংগ্যাদেরও অবস্থান ভারত ও ব্রহ্মদেশের আরাকানে থাকা সম্ভব।

এই উদাহারণ থেকে বুঝাতে চাইছি, তনচংগ্যাদের অবস্থান নিয়ে ইদানীং যে সব লেখালেখি হচ্ছে (যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা এবং আরো অনেকে), তাতে করে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে তাদের নাম ও অবস্থান নিয়ে সমস্যা খুব সামান্য নয়। যথা-

১) নাম সম্পর্কে সঠিক শব্দ কোনটি বা তার যথার্থ উচ্চারণ, বানান ও ব্যবহার নিয়ে যথেষ্ট গোল রয়েছে;

২) সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান (সরকারি সংখ্যা মেনে নিয়েও);

৩) গছা (গোজা) সংখ্যা নির্ণয় সম্পর্কে তথ্য অপর্যাপ্ত;

৪) ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে ভিতরে ও বাইরে পরস্পর বিপরীত মত আছে;

৫) চাকমাদের সাথে তনচংগাদের সম্পর্ক ও সামাজিকতার নানা বিতর্ক রয়েছে।

আমাদের বর্তমান লক্ষ্য এই শেষোক্ত বিতর্কটির দিকে । নানা প্রমাণে আমি অন্যত্র এদেরকে একটি চাকমাদের প্রাচীন অপরিবর্তিত অংশ রূপে (তুলনীয়: পালিয়্যা ও রাজবংশী- যার উল্লেখ একটু আগেই করা হয়েছে) ভেবেছি। এখন এই দুয়ের সম্পর্কের বিষয়টি জটিল হয়ে উঠছে বিধায় এ বিষয়ে আলোচনা আবশ্যক।

তনচংগ্যাদের মধ্যে ইদানিং সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে শিক্ষারও বিস্তার ঘটছে। বান্দরবানে রোয়াংছড়িতে মারম, বম ও ত্রিপুরাদের পাশাপাশি এদের অবস্থান প্রতিযোগিতামূলক । বান্দরবান সদরেও তাই। এই ভাবে রাঙ্গামাটি সার্কেলেও রাজস্থলী ও বাঘাইছড়িতে (সম্ভবত কিছুটা খাগড়াছড়িতেও) এদের অবস্থান অনুল্লেখ্য নয়।

“আরণ্য জনপদে ” -র লেখক আবদুস্ সাত্তার লেখেন ( ১৯৭৫ : ১২০ ) তংচঙ্গ্যা এবং দৈংনাক একই জনগোষ্ঠি , উপাধির ভিন্নতা মাত্র। দ্বিতীয়ত : এই তংচঙ্গ্যাগণ আবার “ মূলত চাকমা ” , পার্থক্য শুধু এই যে , তাদের মধ্যে “ ধর্মীয় ব্যাপারে অনেক পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ” আবার ‘ অঞ্জলি ‘ পত্রিকার ১/৫ সংখ্যায় ( পৃ .১১৫ ) গগনচন্দ্র বড়ুয়া উল্লেখ করেন যে , তংচঙ্গ্যাদের মূল পরিচয় তারা আরাকানের এক পাহাড়ী জাতি ; তারে সাথে অপর কোন পাহাড়ী জাতির মিশ্রণ ঘটে । এই মিশ্র জাতিটির ভাষা বা লেনদেনের ভাষা ছিল চাকমা । কিন্তু “ চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভুক্ত করিয়া লয় নাই । এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোন রূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ নাই । চাকমারা সাধারণত ইহাদিগকে একটু ঘৃণার চোখে দেখিয়া থাকে । ” ( উদ্ধৃতি , আবদুস্ সাত্তার , ঐ ) এই পরিচিতি মোটামুটি বা কমবেশী সকলেই মেনে নিয়েছেন , অর্থাৎ এর মধ্যে অতিরঞ্জনের কিছু নেই । কিন্তু উৎস ও দল নিয়ে যে মতগুলি বিদ্যমান সেগুলি হচ্ছে

ক। দৈংনাক প্রসঙ্গঃ

১. কর্নেল ফেইরীর মত: (১৮৪১: ১১৭)

ক) চাকমা ও তঞ্চগ্যা বা দৈংনাকেরা ভিন্ন জাতি।

খ) দৈংনাকেরা সিম বা নাগো ‘ নামে পরিচিত।

গ) দৈংনাকেরা খুব সম্ভবত বাঙ্গালী সংমিশ্রণের সন্তান সন্ততি।

ঘ) আরাকানের সান্নিধ্যে থাকায় এবং আবহাওয়ার ক্রম পরিবর্তনে তাদের চেহারাগত বৈশিষ্ট্যে সামান্য পার্থক্য লক্ষিত হয়।

ঙ) এরা গৌতম বুদ্ধের অনুসারী।

২. ক্যাপটেন লুইনের মত: (১৮৬৯: ৬৪)-

ক) দৈংনাকেরা চাকমাদেরই অন্যতম শাখা ।

খ) রাজআদেশে বিজাতীয়দের সংগে এদের সম্পর্ক হয়।

গ) আরাকান প্রভাবে “তাদের কথাবার্তায় অনেক মগী শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে; এমনকি বিকৃত বাংলা ব্যবহারের প্রচলনও লক্ষ্যযোগ্য।”

খ। তনচংগ্যা প্ৰসঙ্গঃ

৩. স্যার রিজলির (১৮৯১: ১৭০) মত

ক) তনচংগ্যারা চেহারাগত বৈশিষ্ট্যে আদি মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতি।

খ) তারা বৌদ্ধধর্মের পুরোপুরি অনুসারী নয়।

৪. ক্যাপ্টেন লুইনের মতে (ঐ ৭৬-৭৭)

ক) তনচংগ্যাদের ধর্মভাবে জড়োপাসনা (religion of na । ture) ছাড় বা প্রকৃতি উপসনা ধারা সম্পৃক্ত। এবং: They have vague and undefined ideas of some divine power which over as shadows all?

খ) এদের মধ্যে প্রাচীন প্রবীণরা আরাকানি ভাষায় কথাবার্তা বলে আর নবীনরা চাকমাদের অনুকরণে বিকৃত বাংলা ব্যবহার করে থাকে। (ঐ, পৃ ৬৮)

উপরোক্ত মতবাদগুলিতে তংচংগ্যাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় বোঝা যায়। উদ্ধৃত উক্তিগুলিতে তনচংগ্যাদের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই জন্মে। যেমন-

১. এরা জাতিগত ও ধর্মগতভাবে এবং ভাষাগতভাবেও আরাকান মূলক্রমী।

২. দৈংনাক এদেরই অপর মিশ্রগোষ্ঠী এবং ধর্মে বৌদ্ধ (গৌতমবুদ্ধ অনুসারি)

৩. চাকমা, দৈংনাক ও তনচংগ্যারা ধর্ম ও সংস্কৃতিতে পৃথক পৃথক কিন্তু সমউৎসক, মঙ্গোলীয় জাতি। (‘যোগেশচন্দ্ৰ’)

. চাকমা প্রসঙ্গ:

ক) সতীশচন্দ্র ঘোষের মতে চাকমারা মোঘলদের বংশধর তবে একবার উৎপত্তি মগদের থেকে স্থানীয় ধারণা, মুগল সৈন্য ও আরাকানী নারীদের মিলনে সেকদের উৎপত্তি হয় । এরা সাক নামে পরিচিত ।

খ) জে. পি. মিলস- এর মতে, চাকমারা মগনারী ও মুগলসৈন্যদের সমন্বয়জাত। (উদ্ধৃতি যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৮৫: ৩৫।

গ ) বিরাজ মোহন দেওয়ান , সতীশ চন্দ্র ঘোষ , কামিনী মোহন দেওয়ান প্রমুখ গবেষকগণ চাকমাদের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তথ্য দেন । এঁদের মতে চাকমারা শাক্যবংশীয়। তারা চম্পক নগরের কথা উল্লেখ করেন এবং এই মত প্রতিষ্ঠা করেন যে প্রাচীন রাজা সাদেংগ্রীর বংশধর বিজয়গিরি (বিজগ্রী , ৫৯৫ খ্রী:) আরাকান অভিযানে বিজয়ী হয়ে সা: প্রে: নগরী স্থাপন করেন ও বিজাতীয় রমণী বিবাহ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তনচংগ্যাদের অনেকেই এখনো নিজেদের ‘ সা: প্রে: কূল্যা ‘ পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালবাসেন।

ঘ) যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা উল্লেখ করেন, চাকমা ও তনচংগ্যারা এক কালে একই সম্প্রদায় ভুক্ত ছিল। (১৯৮৫: ভূমিকা) ঙ) শ্রী মাধব চন্দ্র চাকমা (শ্রী শ্রী রাজনামা বা চাকমা রাজন্যবর্গ ‘) উল্লেখ করেন, চাকমারা দ্বিধা বিভক্ত, এবং তার এক অংশ “রোয়াঙ্গ্যা” চাকমা (তঞ্চঙ্গ্যা), আর অপর অংশ “আনক্যা” চাকমা। (অর্থাৎ আরাকান থেকে রোয়াইং > রোয়াঙ্গ্যা এবং তার বাইরে চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অর্থে ‘ আনক ‘ থেকে ‘ আনক্যা ‘।

তনচংগ্যাদের অন্যান্য তথ্য:

তনচংগাদের সম্পর্কে ১৯ শতকের পূর্বার্ধকাল থেকেই সিবিলিয়ানদের দ্বারা অনুসন্ধানের কথা জানা গেলেও বাংলা ভাষায় এবং স্বজাতিদের মধ্যে সম্ভবত শ্রী পমলা ধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রথম (১৯৩৭-৩৮) সনাতন ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে সচেতনতার পরিচয় দেন। মাঠ তথ্য ভিত্তিতে “আরণ্য জনপদে” -র লেখক আবদুস সাত্তার প্রায় ৩০ বছর পরে (১৯৬৬) কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন এবং গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে তনচংগাদের পরিচয় সহ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি চিত্র উপস্থাপন করেন। পরবর্তী কালে যোগেশচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৮৫), বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ও অন্যান্য (১৯৯৫), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (২০০০) প্রমুখের আলোচনা পাওয়া যায়। এইসব আলোচনার বাইরে কিছু সাংস্কৃতিক- ধর্মীয় প্রসংগ ও সৃষ্টিমূলক রচনা সম্বলিত ম্যাগাজিন ও গ্রন্থিকার কথা জানা গেলেও ( যথা- “ পহর জাঙাল ” -এর পূর্ববর্তী সংখ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ‘বিষু’ -প্রকাশনা প্রভৃতি) এগুলিকে আমরা সনাতন ধর্মী বা ট্রাডিশনাল রচনা বলতে পারি।

জগৎ ও জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন চাহিদা মেটানোর উপযোগী রচনা এখনও অপেক্ষিত। যাই হোক, এই সব রচনায় তনচংগ্যাদের ভাষা সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট বলা হয়নি, যদিও আবদুস সাত্তারই প্রথম উল্লেখ করেন যে এদের প্রবীণ প্রজন্ম এখনো আরাকানী বা মগ দ্বিভাষী। এই বিষয়ে এর অধিক তথ্য জানা যায় না। চাকমাদের সাথে এদের পার্থক্যের মৌলিক কয়েকটি ব্যাকরণী ভেদের কথা জানান শ্রী যোগেশচন্দ্ৰ ৷ এছাড়া এদের গোজা ভাগ নিয়েও সংশয়াত্মক উক্তি ও পরস্পর বিরোধী ধারণা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আবদুস সাত্তার উল্লেখ করেন এদের মধ্যে ৬ টি গছা (গোজা) ভাগ আছে , এরা পরস্পরকে প্রীতি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে জাতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে থাকে। রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (২০০০) উল্লেখ করেন, এই গোজা (গছা) সংখ্যা ৬টি নয়, ৭টি। তবে বলেন যে , চাকমা ইতিহাসে তঞ্চঙ্গ্যা নামের উল্লেখ মাত্র পাওয়া যায় না। অথচ “ শোনা যায় তঞ্চঙ্গ্যা গণই আসল চাকমা। ” তবে ইদানীন্তন রাঙ্গামাটির কোন এক সাময়িকী মতে চাকমা জাতি থেকে অপভ্রংশ বা চাকমা জাতির গোজা থেকে রূপান্তরিত রূপে বিকাশ পায় তঞ্চঙ্গ্যা গছা । যেমন- টোন্যা গোঝা থেকে নাকি তঞ্চঙ্গ্যা গছা; ধর্মেই গোঝা থেকে ধৈন্যা গছা মুলিমা গোঝা থেকে মু’গছা; কাম্বেই গোঝা থেকে কারবোয়া গছা এবং এভাবে লার্মা থেকে প্লাং, আঙু থেকে অঙ্য ও অপর কোন গোঝা থেকে মগলা গছার বিকাশ। রতিকান্ত এই ‘ ভ্রান্তি ‘ যুক্তি বা তথ্য দ্বারা খন্ডন না করে বলেছেন ‘ বিষয়টি সম্পূর্ণ কাল্পনিক । ‘ রতিকান্ত আবদুস সাত্তার এর মতও গ্রহণীয় নয় বলেছেন, বিশেষত চাকমা – তঞ্চঙ্গ্যা সম্পর্কের কথা (‘ঘৃণা’ সূচক মনোভাবের কথা আগে উল্লেখিত হয়েছে। তিনি আবদুস সাত্তার উল্লেখিত গছার ( ৬ টি ) সাথে একটি অতিরিক্ত গছা নাম (মেলং গছা) উল্লেখ করেন ও যোগেশ চন্দ্রের ন্যায় তাদের অন্তর্গত ডেল বা দলের পরিচিতি দেন। যোগেশচন্দ্র ১২ টি গছার কথা জানালেও ৬ টিরই নাম উল্লেখ করেন ও বলেন অন্যান্য গছার গুত্তির বিবরণ অদ্যাবধি পাওয়া যায় নি।

তনচংগ্যা কি চাকমা থেকে পৃথক?

ভাষা পৃথক হয় কেন এই বিষয়ে প্রবন্ধের গোড়ায় কিছু তত্ত্বীয় উদাহারণ দিতে চেষ্টা করেছি । তারই আলোকে এখানে আমার ধারণাটা স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো । প্রসংগত উল্লেখ্য এখানে তনচংগ্যা চাকমা ভাষার গঠন অর্থাৎ ভাষাতাত্বিক যে বিশ্লেষণ আবশ্যক অন্যত্র আমি তা দেখিয়েছি।

আলোচনা আমার ‘ উপভাষা চর্চার ভূমিকা ‘ (১৯৯৪) ও Studies in the Bangla Language (1991) গ্রন্থদ্বয়ে এবং কিছু প্রবন্ধ যথা- “ পহর জাঙাল ” প্রথম সংখ্যা (২০০৩) প্রভৃতি সম্পাদিত গ্রন্থ ও পত্রিকায় দেখে থাকবেন। উভয় ভাষার সম্পর্ক বা নৈকট্য / দূরত্ব অন্যান্য সমালোচক যে উদাহারণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন তার দুটি নমুনা দেখা যাক । সদানন্দ চাকমা সুহৃদ ( ২০০৩ : ১৩০-৩১ ) ৬২ টি শব্দ দিয়ে দেখিয়েছেন তাতে শুধু যে বাংলা প্রভাবই আছে তা নয় এতে বিকৃতি সাধনও ঘটেছে প্রচুর । এইসব অপ্রকৃত শব্দের কারণে চাকমা – বাংলার সমাকৃতি বা সদৃশতা বেশী করে মনে হয় । আমরা উদাহারণগুলি এভাবে সাজাতে পারি –

চাকমা – বাংলা > joda / juta, bodol / botol, kenjan / ken, doar / dorja, goloch / glass, kaboj / kagoj, bigol / pichol – etc. চাকমা – চট্টগ্রামী > no mattye (reserved), boyer (wind), lobadasya (shaky), koroli (sand), kuluk (dark), El (green), dhub (white), bijon (hand fan), pujor gorana (asking), oiran (tired), phuni (comb), boi thana (sit) etc.

বাংলা / চট্টগ্রামী মাধ্যমে বিদেশী শব্দ > door (door), tojje (trouble), goloch (glass), kadire (chair), kabil (expert), mattol (mad), boda (egg) -etc.

প্রভাবিত চাকমা শব্দ > khamakkai (ofcourse), kojoli (request), chhatrosan (ransacked), sidhe (gentle), oma (Oh God), Ejo (still), tip batti (torch) – etc.

বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা সম্পাদিত (১৯৯৫) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা পালি, প্রকৃত ও সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার ‘পরিপূর্ণ ‘ বলে

উল্লেখ করেছেন (পৃ .৫) যথা- আক্থ (সময়), গরবা (অতিথি), মুক্যা (ভুট্টা), অভিচ (অফিস), স্কুল (বিদ্যালয়)

প্রভৃতি বিদেশী শব্দ এই ভাষায় ব্যবহার হয় এবং ব্যবহৃত মানাই, মানেই/মানাই (মানুষ), মেলা (স্ত্রী লোক), কদা

(কথা), উসু (সোজা), চিত (চিত্ত) প্রভৃতি শব্দ আর্য মূল। অনার্য শব্দের তালিকা দেন নিম্নরূপ। যথা- তাগল (দা), কালাং

/ কাল্লং (বেতের ঝুরি), কুরুম (ঐ, ছোট আকার), পুল্লাহ্ (বোতল), কিচিং (পাহাড়ের মধ্যবর্তী নিম্ন অংশ), তারেং /

তাং / তারাং (পাহাড়ের খাড়া ভাগ), ক্যাং (মন্দির), স্যং / সোয়াইন (ভিক্ষুদের আহার্য), মংচাং/মৈসাং (শ্রামণ), খবং

(পাগড়ী), কী/কাহ (বাটি বিশেষ), পোই (থালাবাসন বা যেমন কলাপাতার পোই যা পেতে পাওয়া যায়) ধহ (চাল

মাপুনি বাঁশের টুকরো বিশেষ), এবং ধুদুক (বাঁশের মাঝে ফাঁক করা বাদ্যযন্ত্র) লক্ষণীয় বিভিন্ন প্রভাবের

কারণে এইগুলি বর্তমানে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মাঝে ব্যবহৃত হচ্ছে, কম বা বেশি বৈচিত্র্য ও বিকৃতির মাধ্যমে। যদি

পরিসংখ্যানিক logarithm এ রেখাংকন নির্মাণ করা যেত, তাহলে বুঝা যেত ভাষা অধিগ্রহণে পার্থক্যসূচকগুলির

কোনটি বঙ্কিমতা বা তীর্যকতা লাভ করেছে। কোনটির গতিধারা, পর্যায় ও পরিণতি কোন মুখী। এখানে “রেখাঙ্কন”

প্রশ্নে বলে রাখা ভালো যে, পরিসংখ্যান নির্মাণে অনুভূমিক ও আলম্বিক মাত্রাদুটির সূচক হতে পারে সময় এবং স্থান।

সময় বলে দেয় ভাষা ব্যবহারের রূপ, ব্যবহারিক, মাত্রা, গতি ও বেগধারা বা বিস্তার। স্থান নির্দেশ করে বৈচিত্র্য ও

অবস্থান বা গতিক। কোন কোন ক্ষেত্রে ছোট ভাষাও বলশালী হয় এবং তা মর্যাদা প্রাপ্ত সাধারণ ভাষা হয়েও উঠে

আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। ইউরোপ ভূখণ্ডে গল ভাষা দূর দূরান্তরেও ছড়িয়েছে, আবার জার্মান ভাষায় বহু

ভাষা একীভূত হয়ে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। রাশিয়াতেও তাই। তুরস্কে, এলমে বহুভাষা মৃত হয়ে গেছে বা অন্য ভাষাভাষীর

মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। বহুভাষী দেশ ছাড়াও উদাহরণ দেখানো যায় যেখানে কোন ছোট ভাষাভাষী পার্শ্ববর্তী দুর্বল

ভাষাভাষীদের দলভূক্ত করার জন্য তাদেরকে বা তাদের অংশকে কেড়ে নিয়ে আসতে পারে। এটাকে বলে “gobble

up” করা। উত্তরবঙ্গে সৈয়দপুরে, লালমনির হাটে ভাষা অবস্থা যেরকম অর্থাৎ আভিবাসী উর্দু ভাষীরা অন্যদের ওপর

আধিপত্যই বিস্তার করেনি, বঙ্গভাষীদেরকে নিজদের লুকিয়েও নিয়েছে। জোসেফ গ্রাইমস এরকম অবস্থায়

“ভাষাভাষী চুরিকরণ” (steel speakers) বলেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও নিম্নবঙ্গের অবস্থান নিয়েও দেখা যায় সেখানে

মার্মা-রাখাইন অবস্থান (distribution) প্রাকৃতিক ধর্মী হয় নি, অবস্থান ধর্মী হয়েছে। এজন্য রামু- কক্সবাজার বান্দরবান

(সামান্য) মানিকছড়ি-তিনটেহরি ও বরগুনা-আমতলী প্রভৃতিতে যে “সমভাষাভাষী” জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে জানা যায়,

তাদের মধ্যে ভূগৌলিক পার্থক্যকে সীমিত করেছে তাদের আন্তঃসাংস্কৃতিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক (যথা মায়ানমার

সংস্কৃতির আগমণ) অথচ চাকমা-তনচংগ্যাদের ক্ষেত্রে পাই ভিন্ন চিত্র। এখানেই একভাষী ও দ্বিভাষীদের স্বাতন্ত্র্য এবং

সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভেদ ও বৈচিত্র্যের কথা আসে। রাখাইনদের একভাষী বলা যাবে না, চাকমাদের তা বলা যাবে ।

দ্বিতীয়ত চাকমা, তনচংগ্যা ও রাখাইন সবাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও তনচংগ্যাদের ধর্ম – সমাজ – সংস্কৃতির বিষয়গুলির

মধ্যে তারা নিজেরাই একটা রক্ষণশীলতার বাতাবরণ নির্মাণ করে রেখেছে (দ্রষ্টব্য, ক্যাপ্টেন লুইনের মত) যেমন

উখিয়ার (রামু – কক্সবাজার) তনচংগা ও বড়ুয়াদের মধ্যে ধর্ম উৎসব ও সাংস্কৃতিক আচারে যে পার্থক্য তা সমভূমিক

বৌদ্ধ বড়ুয়াদেরও বিস্মিত করে । চাকমাদের সাথে তনচংগাদের পার্থক্য এখানেও প্রবল । তনচংগারা অন্ত তঃ তাদের

প্রবীণ প্রজন্ম মগ (আরাকান) ভাষী – যদিও তা তিন টেহরীর মগদের থেকে ভিন্ন। এই বিষয়টি এই ছোট প্রবন্ধে বিস্তারিত

আলোচনার সুযোগ অল্প। সংক্ষেপে তাই শুধু বলা যায় তনচংগা ও চাকমা জনগোষ্ঠির দিক থেকে (ethnically) এক

এটা বড় কথা নয়। ওরা আচারে ভাষায় ও ধর্ম – সংস্কৃতিতে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অভিসারী। এরই ফলে উদ্ভব ঘটেছে

মনস্তাত্ত্বিক কলহ, কে বড়, কে জাতে সম্মানে ও আত্মগরিমায় শ্রেষ্ঠ, কে আদি, কে আগত বা পরাগত, কে গোজাধর,

অথবা কার গছা সংখ্যা বেশী বা কম, গছায় গছায় ভাষা পার্থক্য। সীমা কার মধ্যে হ্রাসবদ্ধ বা নিরপেক্ষ, কে প্রকৃতিতে

অরণ্যচারী ও নিষ্ঠুর স্বভাবী কে শীলাচারী, ভদ্রতা প্রকাশের গরীয়ান … ইত্যাদি । এই প্রশ্নের সমাধান সমাজতত্ত্ব ও

ইতিহাসের গভীরে । ভবিষ্যত গবেষকগণের উৎসাহ উদ্রেক করে বর্তমান আলোচনার ইতি হবে এখানেই । পরিশেষে

শুধু বলতে। চাই ভাষাগত প্রমাণে এদের মিল আকস্মিক বা ব্যবহারক্রমী · ধ্বনি পরিবর্তনের পুনর্গঠন, সম্পর্ক নির্ণায়ক

ভাষাকাল নির্ণয় ও ক্রম নির্ধারণ যাকে ভাষাতত্ত্বে বলা হয় RC পদ্ধতি বা Relative cronology. ঐতিহাসিক শাখায়ন

নির্মাণ ইত্যাদিও সম্ভব।

একটি সম্ভাব্য ঐতিহাসিক বিচার পদ্ধতিতে এদের মূল ভাষা পুনর্গঠন ও শাখা – উপশাখা নির্দেশের একটি নমুনা (মডেল) এখানে তৈরী করা হয়েছে। এর অর্থ এভাবে একটা পরীক্ষামূলক শাখায়ন (পৃথকায়ন বা reflex ঘটিতরূপ প্রতিষ্ঠা) ও গোষ্ঠিবদ্ধকরণ (ঐকায়ন রূপ) এইভাবে নির্মাণ করা যায়, যা অবশ্যই পূর্ন বা পূরক তথ্য ভিত্তিতে সম্পূর্ন করা সম্ভব।

*আদি চাকমা-    ক) রোইয়াঙ্গা খ) আনক্যা (ধৃত চাকমা)

ক) সেখ বা সাক (?)

রোইয়াঙ্গা-          ক) চাকমা (৬৫ গছা/গজা) খ) আদি তঞ্চঙ্গ্যা ((১২ গছা)

আনক্যা (ধৃত চাকমা) — দৈংনাক (চেইম্পানগো — বাংলাদেশী দৈংনাক।

সেখ বা সাক- বর্তমানে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী চাক নামে পরিচিত।

চাকমা (৬৫ গছা/গজা) — বাংলাদেশী চাকমা।

আদি তঞ্চঙ্গ্যা ((১২ গছা) অর্বাচিন তঞ্চঙ্গ্যা (মগভাষীসহ) — ৭ গছাসহ তঞ্চঙ্গ্যা — দৈংনাক মিশ্রিত গোষ্ঠী (ব্রহ্মদেশ ত্যাগী)

প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ

ড. মনিরুজ্জামান (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

বাংলা ভাষা ও পার্বত্যজাতির ভাষার মধ্যে গোত্রগত বা নৃতাত্ত্বিক সূত্রের ব্যবধান যোগাযোগসূত্রকে কখনও খন্ডিত বা ব্যাহত করে নি। তার একটি প্রমাণ প্রবাদে ব্যবহার-সমতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তুলনামূলক পঠন পাঠন প্রক্রিয়ায় বিচার করে ধারণা দিতে চেষ্টা করেছিলেন যে বাংলাদেশের ‘হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁও’ জার্মান শিশুদের কাছেও নিজস্ব জিনিষ হয়ে আছে এবং কখন কিভাবে এই নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল তা অনুসন্ধানের বিষয় মাত্র। কিছুদিন আগে তুলনামূলক সংখ্যা বিচার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গণিত ভাষাবিজ্ঞানীগণ অবাক হয়ে দেখেছেন যে সংখ্যাশব্দ ভ্রমণশীল (এ বিষয়ে ‘ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন’ গ্রন্থে আমার বিস্তারিত আলোচনা আছে।)

একইভাবে পূর্ব ইউরোপে যাঁরা লোকসাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক কাজ করেছেন তাঁরা এই বিষয়টা আরও বিস্তৃতভা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং সে সব তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমুলক আলোচনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে Broken down myth theory, Historical- geographical contact theory বা ফিনিশিয়ান তত্ত্ব প্রভৃতির মধ্যে। এসব তাত্ত্বিক ধারণা এখন আরও প্রসার লাভ করেছে এবং আমেরিকা ও বিশেষত ফিনল্যান্ডে অনেক অগ্রসরতা ঘটেছে। Tribal Culture  নিয়েও দক্ষিণ ভারতে এবং Red Indian  দের বিষয় গাম্পার্জের বিষয় অনুসৃত ধারায় নৃ-ভাষাতত্ত্বে এবং এলার্ন ডান্ডি, লী উটশী প্রমুখ লোকবিদগণের হাতে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ অজস্র ও বৈচিত্রশালী লোকউপাদানের দেশ। কিন্ত এদেশের সম্পদ নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির জগত এখনও নিশ্চুপ। একদা রামোঁলার কথায় আমাদের প্রত্যয়ের কিছুটা প্রসার ঘটেছিল। মূলভূখণ্ডের বিষয় নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করা গেলেও (যথা-বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘লোকসাহিত্য’ সিরিজ, ইত্যাদি) আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের লোকগত প্রথা ও জ্ঞান নিয়ে কখনও কেউ কোন কৌতুহল বোধ করেন নি। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ- এর ‘কর্ণফুলি’-র পথ নিয়ে এই তথ্য উন্মোচনের শুরুটা ঘটেছিল, পরবর্তীকালে সে পথর খননী কাজ আর বেশীদূর অগ্রসর হয়নি। পার্বত্য সংস্কৃতিকে মূল সাংস্কৃতিক ধারা থেকে সব সময় দূরে রাখা হয়েছে। নৈকট্য সৃষ্টির পরিবেশ গড়ে ওঠেনি কখনও। এই চিত্র কেবল বাংলাদেশেরই নয়; রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ সহ সর্বত্রই একই চিত্র; কেবল মাত্রা ভেদ।

সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও অন্যান্য সমতলীয়তা মিশ্র সমতলী ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর সাথে বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকার নৃ-গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন -যাপনের পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। একসময় আরাকান-ব্রহ্মদেশের সাথে এদের একটা সংযোগ ছিল এবং তারও আগে।

দক্ষিণ চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সাথেও যোগসূত্রটি গভীর ছিল এই সব জনগোষ্ঠীর। তাদের মধ্যে যারা স্থায়ীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে (বৃটিশ আমলে ও পরেও যাকে CHT বলা হত প্রশাসনিক সুবিধার্থে) বসতি স্থাপন করে অদ্যাবধি স্থায়ী হয়ে আছে, অর্থাৎ লুসাই কুকি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর অংশ বিশেষ যারা সিলেট ও আসামের দিকে বসতান্তরিত হয়েছে তদের কথা বাদ দিয়ে,- অন্যদের সাথে স্থানীয় অধিবাসী ও মূল ভূখণ্ডের প্রশাসকদের রাজনৈতিক ছাড়াও আর্থ (বাণিজ্য ঘটিত)- সামাজিক সম্পর্কটি ছিল হার্দ্য এবং দীর্ঘ দিনের। রানীর হাত, মহামুনি, কাপ্তাই বা রাজস্থলী এমনকি বান্দরবান অদ্যাবধি পাহাড়ী ও সমুদ্রতীরের বাসিন্দাদের মিলনস্থান হয়ে আছে এই ভাবেই। এই স্থানের বার্ষিক মেলাগুলি উভয় জনগোষ্ঠীর জন্যই আজও আকাঙ্ক্ষিত। তথাপিও ওপর ও নীচের বাসিন্দাদের মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে সেই নৈকট্য সূচিত হয়নি- ভাষাতত্ত্বে যাকে বলা হয় Linguistic Convergence এবং নৃতত্ত্বে Acculturation; এর কোনটাই সৃষ্টি হয়নি দীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থানের পরেও। সে কি কেবল উভয় জাতির অন্তর্গত রক্ষণশীলতা না অন্য কিছু?

অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায় পার্বত্য জাতির অনেকেই একটি মধ্যবর্তী ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন, অথবা সেই রকম কোনও মিশ্র বুলি বললে তারা তা বোঝেন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এটাই স্থানীয়ভাবে ‘ফাংশনাল’ বা বঙ্কিমচন্দ্রের পরিভাষায় বলা যায় ‘কার্যকারিনী’ ভাষা বা প্রকাশ। ভাষা হিসেবে তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য তা মোটামোটি কার্যকরী। তুলনা দিয়ে বলা যায়, আলতামিরা গুহায় যে চিত্রলিপি বা রেখাবয়ব পাওয়া যায় তা যেমন লিপিও নয় চিত্রকর্মও নয়, কেবলমাত্র টোটেমের নিদর্শন ও যাদুধর্মের বিকাশ,- ভাষার ক্ষেত্রে আদি মানুষের অভিব্যক্তিও সেই রূপ অর্থাৎ অন্যের কাছে নিজেকে উপস্থিত করারই একটা চেষ্টা। ‘ইন্দ্রধ্বজ’ দেখিয়ে অসুর বা সাধারণ মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা বিশুদ্ধ নাটকে থাকলেও ‘নাটগীতে’ তা থাকেনা। সে রকম সাধু বা শিষ্ট ভাষার শিক্ষণ বা ব্যবহার যাদের নেই তার গড়ে তুলে ‘লোকভাষা’? এখানে বুঝাতে চেয়েছি ভাষা সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু মুখে বলা আর মুখের কথাকে স্থায়ী করার মধ্যে প্রভেদ আছে। সেই প্রভেদ সূত্রই ভাষাকে সীমিত করে আর ভাষিক উপাদানকে অন্যের অংশীদারিত্বে নিয়ে যায় আরো দূর। তখন বাংলার রাক্ষস জার্মানেও হাঁউ মাঁউ করে, প্রকাশ ভঙ্গী যেমনই হোক। India Theory-তে এভাবেই জার্মানী লোক উপাদান আর ভারতীয় লোক উপাদানে সমতা দৃষ্ট হয়। লোক সাহিত্যের অনেক শাখা, অনেক তার বিস্তার। কিন্তু সব শাখাই ভ্রমণশীল নয়। আবার Cosmic Theory অনুযায়ী অনেক বস্তুই স্বতোঃস্ফূর্ত কিংবা ‘সাধারণ’ হিসাবে জাত। ‘শাদীর রাতে বিড়াল মারা’ রেড ইন্ডিয়ানদের জীবনেও That’s for once’ গল্পে পাওয়া যায়, কেবল ‘বিড়াল’ এর স্থলে সেখানে এসেছে ‘ঘোড়া’। আবার অনেকের মতে এবং এই মত সর্বজন স্বীকৃত যে লোক-সাহিত্য বা সংস্কৃতি জিনিষটা খুবই স্থানিক- Insularity তত্বে সে কথা প্রমাণিত। পাশাপাশি থেকেও দুই গোত্র বা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জগৎ ভিন্ন থাকে। এটা নদী-পর্বতের মত প্রাকৃতিক বাধা বা Sibolethistic পরিবেশের কারণেও হয় বা হতে পারে, তেমনি আবার স্বতন্ত্র ‘Cultural Area’ (তুলনীয়: ‘India is a cultural Area’- E.B Emenw) বা ‘Sub-Area’-র কারণেও হতে পারে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বা সীতাকুণ্ড, নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থানগুলি এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে দূরত্বের মাঝে নৃতাত্ত্বিক প্রসঙ্গটিও বিদ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে চাকমাদের বা তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে সেই দূরত্বা প্রকৃত প্রস্তাবে কোন বাধা হয়ে থাকে নি। অথচ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সাথে সেটাই কম বেশি প্রধান বাধা হয়ে আছে। Comearative Folk Studies আমাদের সে তথ্য বিচারে সহায়ক হতে পারে। আইরিশ লোকবিদ পাদরী জেমস লঙ্ বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ ও আলোচনার যেমন অন্যতম অগ্রপথিক, রাশিয়ায় অবস্থান কালে তেমনি তিনি রুশ প্রবাদ নিয়ে তিনি তেমনি শ্রেণীকৃত ও তুলনামূলক আলোচনা করেন। দুষ্প্রাপ্য হলেও মহাদেব প্রসাদ সাহা ঠিকই বলেন, তাঁর আলোচনা এখনও আমাদের জন্য আদর্শ বিশেষ।

বলা হয় প্রবাদ আদি সমাজের সৃষ্টি। প্রাক-সভ্য সমাজে মানুষ কি জ্ঞান-বৃত্তির চর্চা করতো? যেহেতু প্রবাদ Folk wisdom-এর ভান্ডার তাই সে কথা মেনে নিতে হয় এবং বিশ্বাস করতেই হয়। যেমন কৃষি জীবনের বিষয়গুলো যা আসলে যাদু নির্ভরতার শিকারী জীবন (গুহাবাস) এবং আরও পরে পশু পালনের জীবন ও পশুচারণ ক্ষেত্রে সন্ধানে যাযাবর জীবন যাত্রার পরবর্তী জীবনেরই কে বাস্তবতা। তবে শুরুতে সম্ভবত সে জীবনও ছিল অধিক সংগ্রাম মূখর ও অনিশ্চিত এবং তাতে প্রাপ্তি ছিল কম। মানুষ স্থায়ী, অধিকতর নিশ্চিত ও সঞ্চয়ী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় যখন পশু মড়ক ও অতিরিক্ত পশু নিধনের ফলে অবিকল্প কৃষিজীবন তর কাছে সত্য হয়ে ওঠে। সূর্যদেব, মেঘদেবতা, জননী ধরিত্রী-চিন্তা এবং ক্রমে পুরাণ-তত্ত্বের(মিথলজি) কল্প-বাস্তবতায় প্রবেশ ঘটলো তার। দলবদ্ধতা আগেই ছিল, এখন বহু দলের সমাজ গঠন, আত্মরক্ষার্থ ও সঞ্চিত সম্পদ রক্ষার্থ প্রভৃতি পূজা, কৌম সমাজ রক্ষার ব্যবস্থায় নতুন করে এলে যাদু-মন্ত্র ও দলপতির মাধ্যমে দৈব বাণী। একেই বলি আমরা আদিম ধর্ম এবং তার আচরিত কথাসূত্রগুলিকে বলতে পারি আদি মহাজন বাক্য। ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘(আদিম) সমাজে যিনি ছিলেন বয়স্ক এবং অপেক্ষাকৃত বিচক্ষণ, বিভিন্ন যাদুবিদ্যার অধিকারী, তিনিই সাধারণত হতে দলপতি, তাঁর বাণী বা নির্দেশই ছিল আদিম প্রবাদ বাক্য। পরবর্তীকালে আর্যদের আগমনের পর যাকে বলা হয় জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা এবং পরিবেশবিদ্যা, যা তার চারপাশের দর্শনীয় বস্তু-তা নিয়েই  প্রবাদের প্রাচুর্য গড়ে উঠেছে। লিখিত উপকরণের অভাবে এই মৌখিক দৃষ্টান্ত, উপদেশ বা অনুকরণীয় বিষয়গুলি অতি সহজেই শ্রুতিধর ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশেও পৌছেঁ যায়‍’।

সমাজপ্রিয় মানুষ উন্নত ও শক্তিধর সমাজের অনুকরণেও আসক্ত। তার সমাজ জিজ্ঞাসা ও আন্তসামাজিক কৌতুহল তাকে এই আচরণে লিপ্ত করে। আকাশ-সংস্কৃতির যুগে আজ মানুষ সমানাধিকারের চিন্তা করতে শিখেছে সেও এই ভাবেই। নারীবাদ, ধরিত্রী সম্মেলন, মানবাধিকার প্রভৃতি ধারণা ও কার্যক্রম যে প্রসারতা পেয়েছে তাও যে ক্রমেই প্রসারমাম হচ্ছে তার মূলেও সেই একই লোকজীবনের সত্যের তাড়না। ‘সিবোলেথের’ বাধা সত্ত্বেও অন্যে সংস্কৃতি জগতে আপনার কৌতুহল প্রবেশ সাধারণ-সেখানে সে আপনার অন্তর্সত্যকে যেমন প্রকটিত করতে চায় তেমনি অন্যের সত্যকূলকেও সে স্পর্শ করতে চায়। এ যেন সেই রবীন্দ্র বারতা- ‘দিবে আর নিবে মিলাবে আর মিলিবে, যাবেনা ফিরে’। ‘ভাষা’ যদিও সীমিত ‘কোড’, সংস্কৃতি সেক্ষেত্রে অনেক তরল ও প্রবাহমূলক ‘ফ্লুইড’ স্বরূপ। প্রবাদ, ধাধাঁ প্রভৃতি লোকসৃষ্টি এমন কি যা ‘লোকভাষা’ তারও বহু উপাদানকে তাই আমরা ভ্রমণশীল রূপে দেখতে পাই। অনুকূল ও প্রতিকূল সমাজ নির্বিশেষে ‘এক-সংস্বৃতি’ এলাকা (One Cultural Area) গড়ে ওঠে, যেভাবে গোটা ভারতবর্ষে ৪০০-এর অধিক ভাষা থাকা সত্ত্বেও ইমেন্যূ সাহেব তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন যে, ‘India is a linguistic area’.

এভাবে একটা কথা যোগ করা আবশ্যক যে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটাই স্থানিক লোকসংস্কৃতি ততটাই অসংকীর্ণ ও বিস্তৃত। গ্রামজীবনের অনেক জিনিষ লোকসংস্কৃতির ধারক বা পরিচায়ক নয়, যেমন গ্রামেও আজকাল ‘বিউটি পারলার’ দেখা যাচ্ছে এবং পাল্কীর পরিবর্তে নতুন বর বধূ রিক্সায় শ্বশুরালয় বা পিত্রালয়ে যাচ্ছে। একইভাবে গ্রামীণ যে কোনও অনুষ্ঠানে সামাজিক হোক বা ব্যবসায়িক হোক তাতে সারাদিন-রাত মাইকে গান বাজানো হয় এবং সে সব গান সিনেমার গান, এমন কি হিন্দি গান ও। মানুষ গ্রামেও লোকস্বভাবের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এগুলি গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষদের প্রদর্শনী মনোভাব বা রুচির একটি দিক। গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরাও বিশেষত মহিলার মোবাইলে অহরহ প্রবাসী স্বামী বা পুত্রের সাথে কথা বলে। এসবই গ্রামীণ বাস্তবতা, কিন্তু লোক সংস্কৃতির সৃজনশীল কর্মের সঞ্চারণ রহিত।

অন্যদিকে শহুরে সংস্কৃতিতে লোকসংস্কৃতির অনাযাস বিস্তার বা প্রভাবও অগ্রামীণ, কিন্তু লোকজ। যথা বৈশাখী মেলা ব রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন এং স্বাধীনভাবে সৃষ্ট শহীদ দিবস, বিজয় মেলা, চিকামারা বা দেওয়াল লিখন, প্রভাতফেরী, মিছিল এমন কি গ্রন্থমেলাও। এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘কাবাডি খেলা’ ও অন্যান্য লোকজ খেলা (লাঠি খেলা ইত্যাদি) প্রভৃতির প্রদর্শণী হতে শুরু করেছে। সবগুলিতে লোকজ জীবনের পরিচয় শতভাগ না থাকুক এগুলিও যে আধুনিক প্রসারিত ধারণায় ফোকলোরের উপাদান সম্বলিত তা মানতেই হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে তা ‘পরম্পরাগত’ (ঐতিহ্যবাহিত) কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পরম্পরাভাবই ফোকলোরে মৌল বিষয় নয়, লোক গ্রাহ্যতাই তার মূল পরিচয়কে সনাক্ত করে। তাই কখনও যদি গ্রামে মোবাইল ব্যবহার, মাইকিং (ওয়াজ মাহফিল বা জানাজার সময় ঘোষণীয় ইত্যাদি) ইত্যাদিতে লোকরূপ লক্ষ্য করা যায় এবং লোকজ শৈল্পিকতা বা সৃজনশীলতার রূপ প্রকাশ পায় তখন তা ‘ফোকলোর’ বা লোকসংস্কৃতির রূপেই গ্রহীত হবে তা যত আধুনিক হোক। লোক সংস্কৃতির উপাদান সমভূমিতেও যা, দ্বীপাঞ্চল বা পার্বত্য এলাকাতেও তাই। যা ফোকলোর তার ভিন্নতা নেই কোথাও, স্থানভেদে তার বৈচিত্র্য ঘটতে পারে মাত্র। কিন্তু তর ‘উপাদন’ সর্বত্র সমরূপী। সাধারণ বা লোক মনুষের স্বভাবের জন্যই তার এই সমরূপিতা বা সমমৃদ্ধিতা এবং বৈচিত্র্যও। যেমন, প্রাক ইসলামী যুগে আরববাসীরা কবিতা ভালবাসতো, হাটেবাজারে গিয়ে একজন কবিতা পড়ে শোনাতো, লোকেও তা শুনতে পছন্দ করতো। প্রাচীন কা’বার মেলায় ইমরুল কায়েসের কবিতা বিনোদনের অন্যতম বিষয় ছিল। ভারত উপমহাদেশে আজ যে মুখায়রা হয়, সেটা তারই স্থানীয় রূপ মাত্র। ভূত প্রেত ডাইনী নিয়েও বিভিন্ন দেশের ধারণার সমিলতা আমাদের এইভাবে অবাক করে। আমাদের দেশে বাচ্চাদেরকে জুজু-র ভয় দেখানো হয়। এই ‘জুজু’র উৎপত্তি ও তার বিভিন্ন ধরণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন ‘লোককৃতি কথাগুচ্ছে’র গ্রন্থাকার লোক ও শিশু সাহিত্য গবেষক আতোয়ার রহমান। ‘পরী’ এবং সমরূপী অন্যান্য জীব নিয়েও অনেক তথ্য উপস্থিত করেছেন তিনি। ধারণাগুলি আদি লোকজীবনের নানা রহস্যগুণাত্মক।

এইবার পার্বত্য ও সমভূমিজ প্রবাদের কথায় আসি। আমি অন্যত্র বলেছি বাংলাভাষার ‘প্রবাদ’ এক সময় ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতো। যেমন, প্রবাদ আছে মানুষ অপকর্ম করে মারা গেলে বা অতৃপ্ত আশা রেখে অপমৃত্যু ঘটলে তার আত্মা গাছে বেতালের মত ঝুলে থাকে। অর্থাৎ জনশ্রুতি, সুভাষণ, মহাজন উক্তি, মিনতি শিলুক প্রভৃতি অর্থে বা ভাবার্থে ‘প্রবাদ’ -এর ব্যবহার ছিল। লঙম্যান চৎড়াবৎন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন উইলিয়াম মর্টন বা নীলরত্ন হালদার প্রমূখ তাঁর পূর্বসুরীরা ‘কবিতারত্ন’, ‘দৃষ্টান্ত বাক্য’ প্রভৃতি শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহৃত করেছেন। (দ্রষ্টব্য মৎ প্রণীত ‘লোকসাহিত্যের ভিতর ও বাহির’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০২: পৃষ্ঠা. ১০১-১০৩) ইংরেজী শব্দের সাথে ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকায় তিনি ‘প্রবদা’ কথাটি ব্যবহার করেন এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রচলিত হয়ে অভিধানেও স্থান পায়। প্রবাদের বৈশিষ্ট্য বা গুণ তার চিরত্ব, শব্দ প্রকৃতির বৈচিত্র্য (বাঘ/বাঘা; জুতা/জুতুয়া ই:) ও যদৃচ্ছাকৃত বাক্যরূপ।

এই ধরণের প্রবাদের কথা আমি আমার পার্বত্য এলাকার বন্ধু ছাত্রদের মুখে বিশেষ শুনতে পাই নি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সভাপতি থাকা কালে ছাত্রদের নিয়ে মনিকছড়িতে (খাগড়াছড়ি) ফিল্ড ওয়ার্ক করার সময়ও তেমন তথ্য লাভ করতে পারিনি। ১৯৮০-০৩ ড. দুলাল চৌধুরী ‘চাকমা প্রবাদ’ প্রকাশ করেন। কিন্তু সংকলনটি মিশ্র বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া গ্রন্থটি প্রচারও লাভ করেনি তেমন। এই সব কারণে বর্তমান উদ্যোগতে আমি মনোযোগী হই। এক্ষেত্রে আমার সহায়ক হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কৃতি ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তার এবং তার বন্ধুদের সংগ্রহ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা তথা পার্বত্য এলাকার প্রবাদের মধ্যে নিম্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে পারি-

১. গঠন ও ভাবগত দিক থেকে চাকমা প্রবাদের সাথে এর অনেকাংশে মিল বিদ্যমান, যদিও তঞ্চঙ্গ্যা গঠনে কিছুটা তীব্রতা ও প্রাচীনতাও লক্ষ্য করা যায় যা চাকমার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যেমন, ‘সর্গ (স্বর্গ) গু খাই দিককনে’? বা ‘সাপপয়া উলে পুদাই-দ, ব্যাঙয়া উলে ফালাই-দ’ ইত্যাদি।

২. বাংলা ভাষার (চট্টগ্রামসহ) সাথেও এর মিল দূরাগত নয়, যথা-

ক. ‘পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান’

(বাংলায়= ‘পাতিলে পাতিলে ঠোক্কর লাগেই’)

খ. ‘পয়ায় ন কানিলে দুধ খায় ন পান/ পায়’

(বাংলায়= ‘পুতে না কান্দলে মাও দুধ দেয় না’)

গ. ‘মুয়ত জয় মুয়ত খয় (ক্ষয়)’

বাংলায়= ‘যেই মুহে (মুখে) জয় হেই মুহেঐ (মুখেই) ক্ষয় অয়”)

ঘ. ‘পেদৎ বোক মুয়ত লাইত’

(ঢাকা= ‘পেডে ভূখ থুইয়া মুহে শরম’

(চট্টগ্রাম= “প্যেডৎ বোক মুগোৎ/ মুয়ৎ লাজ”)

ঙ. ‘এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কাঁড়া’

(বাংলায়= “নানা মুনির নানা মত/ যার ঘরে সে রাজা”)

৩. কিছু কিছু প্রবাদে ভাবগত মিলটা খুবই সাধারণ ও নৈকট্যসূচক-

ক. ‘খাং খাং মাইনসত্তুন গেয়াহ্ নাই,

দাং দাং মাইনসত্তুন বউত্ নাই’

(বাংলা= “অতি গেরস্থ না পায় ঘর, অতি ঘরণী ন পায় বর”)

এখানে তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদটির আক্ষরিক অর্থ হল- ‘খাই-খাই মানুষর শরীর থাকেনা, পালাই-পালাই মানুষের কোন বস্তুই থাকেনা’। ইংরেজীতে সম্ভবত এটাকেই বলে- ‘rolling stone, gathers no moss,’। এর সমার্থকতার বাংলা প্রবাদটি ভিন্ন গঠনের, যথা- ‘যে রহে সে সহে’। কিংবা ‘যে চলে সে রহে’।

৪. তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদ এক বাক্যিক গঠন, দ্বিচরণিক গঠন, ছড়ার গঠন ছাড়ও কখনও কখনও সদর্থক বাক্য ও নঞর্থক বাক্য মিলেও একটি রূপ পায়, যথা- ‘যে গাছৎ উদি জানে তারে টেলি ন দিলেও উদি পারে, আর যে ন পারে তরে ঠেলি দিলেও ন পারে’।

এই সব প্রবাদ- উক্তিতে ভাষার বৈচিত্র ও ভিন্নতা থাকলেও সাংস্কৃতিক অবিচ্ছেদ্যতাই প্রমাণিত হয়।

৫. ‘ছায়-ল কানত্ (কান) মন্ত্র বড়ায় দেনা’।

(বাংলা= ‘কথায় কান না দেওয়া’)

৬. ‘নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান’

(বাংলায়= ‘নরম বা দুর্বলকে সবাই ঠকাতে চায়’)

৭. ‘এক্কয়া কুউরে (কুকুর) ভাত খালে আর এক্কয়া কুউরে চাই থাই ন পারে’

(বাংলা= ‘একজনের সুখ অন্য জন সহ্য করতে পারে না’)

৮. ‘মরা বাই-স (বাঁশ) সমারে জেদা (জীবিত) বাই-স পুরি যান’

(বাংলা= ‘দোষীর সাথে নির্দোষীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়’

৯. ‘আদে দুরি দুখ টা (আ) না’

(বাংলা= ‘জেনে শুনে কষ্ট/দুঃখ পাওয়া’)

১০. ‘আওই ন কুড়ে ঘি গনানা’

(বাংলা= নারীর সংস্পর্শে পুরুষের মন নরম হওয়া’)

১১. ‘আই-স (হাতি) পুনত কুউরে ভুয়ানা’

(বাংলা= (শক্তিধরের কাছে দুর্বলের নিষ্ফল আকুতি)

১২. ‘আউইনত্ (আগুন) পানি দেনা’

(বাংলা= চরম সমস্যার সমাধান করা)

১৩. ‘আক্কল বাধি অনা’

(বাংলা= স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া)

১৪. ‘আলু কুইল্যে গাত্তয়া (গর্ত) থাই’

(বাংলা= ঘটনা ঘটলে প্রমাণও থাকে)

১৫. ‘ইচা শুউনি (শুটকি) অনা’

(বাংলা= মিশুক হওয়া)

১৬. ‘ইহিম কামত্ ফল পানা’

(বাংলা= মনোযোগের কাজে সুফল পাওয়া)

১৭. ‘ইচা (চিংড়ি) কবালত্ গু’

(বাংলা= ‘অতি চালাকির বোকামি প্রকাশ)

১৮. ‘উসুনা কুড়ায় ডাক কারানা’

(বাংলা= অসম্ভব ব্যাপার)

১৯. ‘কুড়া (মুরগী) লাইত’

(বাংলা= প্রথম অবস্থায় লজ্জা পাওয়া)

২০. ‘চিল দরে কুড়া ছ ন পুছানা’

(বাংলা= ক্ষতির আশঙ্কায় ভাল কাজ না করা)

২১. ‘সিনডালে ও লো (রক্ত) ন নিগানা’

(বাংলা= অতি কৃপনতা)

২২. ‘মুঅ গুনে ব্যাঙ ময়ে/মরে’

(বাংলা= নিজের দোষে নিজের বিপদ ডেকে আনা)

২৩. ‘ঠেঙ (অ) কোইত্ উরি দেনা’

(বাংলা= অসৌজজন্যতা)

২৪. ‘দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা’

(বাংলা= সুসম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে দেওয়া)

২৫. ‘পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্’

(বাংলা= কান কাজ করতে করতে অভ্যাস হওয়া)

২৬. ‘বিচ্যা গরুর দাঁত চাইনে লাভ নাই’

(বাংলা= গৃহিত সিদ্ধান্তের পরে পর্যালোচনা নিষ্প্রয়োজন)

২৭. ‘গুইত্তুন মু্ত্ গম অনা’

(বাংলা= আগে খারাপ থেকে বর্তমানে এসে ভালো সাজা)

২৮. ‘ঘ-র উন্দুরে বেড়া কামারান’

(বাংলা= ঘরের শত্রু দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া)

২৯. ‘রাঙা কালা মু অনা’

(বাংলা= কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া)

৩০. ‘ভুত্তোয়া কুউরে/কুগে রোঙ কারা-না’

(বাংলা= খালি কলসি বাজে বেশি)

৩১. ‘গরু-ছাঅল ডরে ক্ষেত গিরাদি রাখানা/রাগানা’

(বাংলা= নিজের সম্পদ নিজে যত্ন নেওয়া)

৩২. ‘আইডে আইডে ধদাডোদি/দলাডুলি টিক্ষ্যা (নলখাগড়া) কা(অ)রা গুরি’

(বাংলা= দুই পক্ষ সবলের শক্তি প্রদর্শনের ফলে দুর্বলের ক্ষতি হওয়া)

৩৩. ‘দা-শি দিলে নাচি খায়, সবা-ইত ন পালে মা-ই খাই’

(বাংলা= প্রথমে দিলে খাই না পরে নিজে খুজেঁ খাই)

“পার্বত্য অঞ্চলে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবদান”

লেখকঃ শ্রীমৎ ড. জিনবোধি ভিক্ষু

চৈত্যভূমি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চলে স্বল্প সংখ্যা বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীদের নিয়ে অবিভক্ত বাংলার বৌদ্ধ সমাজ গঠিত। এই বৌদ্ধ সমাজের জন্যই বাংলায় তথা ভারত বৌদ্ধ ধর্মের শিখা নি:শেষের নির্বাপতি হই নাই, বৌদ্ধত্বের  ধারা বিলুপ্ত হয় নাই। তা নির্বানোন্মুখ দীপ শিখার মত ক্ষীণ হয়েও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের বৌদ্ধ ধর্মের বিজয় কেতন উড্ডীন রয়েছে। বঙ্গ দেশের চট্টগ্রাম জেলায় বাঙালি বৌদ্ধদের বসবাস কিন্তু পার্বত্য বৌদ্ধরাও এক সময়ে চট্টগ্রামের কয়েক এলাকায় দীর্ঘকাল ছিলেন। কালের বিবর্তনে তারা ক্রমান্বয়ে সমতল ভূমি ছেড়ে পাহাড়ী এলাকায় চলে যায়। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের মোট বারটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায়অ তাঁরা হলেন (১) চাকমা, (২) মারমা, (৩) ত্রিপুরা, (৪) তঞ্চঙ্গ্যা, (৫) ম্রো, (৬) বম, (৭) উচই, (৮) পাংখোয়া, (৯) খিয়াং, (১০) খুমী, (১১) লুসাই এবং (১২) চাক। এরা সবাই স্থানীয় বৌদ্ধ নামে পরিচয় হলেও কিছু কিছু হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হিসেবে পরিচয় দিতে দেখা যায়। এত সব সত্ত্বেও পার্বত্য জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বলে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বারটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর প্রভাব প্রতিপত্তি তুলনামূলক একটু বেশি। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় চেতনায় এই দু’জনগোষ্ঠীর পরিচিতির ব্যাপকতা দেখা যায়। চাকমারা- তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়কে চাকমা জাতির একটি শাখা মনে করলেও তঞ্চঙ্গ্যাদিগকেই তারা মূল বা আসল চাকমা বলেও স্বীকার করেন। বর্তমানে দৈংনাক, তৈনটংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামধেয় একটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীকেই উপরোক্ত তিন নামে নির্দেশ করা হয়েছে। যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ এবং ভারতে তৈনচংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত এবং আরাকান তথা মায়ানমারে দৈংনাক নামে পরিচিত। বঙ্গ দেশে যে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে- তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানাধীন রইস্যাবিলি এলাকায়, কক্সবাজার জেলায়  উখিয়া ও টেকনাফে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস। তাছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, অরুনাচল, মিজোরাম ও মুনিপুরের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস আছে। আরাকান তথা মায়ানমারেরই তঞ্চঙ্গ্যাদের সংখ্যা সমধিক। তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্বমোট জনসংখ্যা চারি লক্ষাধিক বলে জানা যায়।

আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য আদিবাসী মংগোলীয় জনগোষ্ঠীর ন্যায় তঞ্চঙ্গ্যাগণও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার (মংগোলীয়) জনগোষ্ঠীর দলভূক্ত। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা অন্তর্গত পালি, প্রাকৃত সম্ভুত, বাংলাভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, পোষাক পরিচ্ছদ, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির পার্থক্য হেতু একই জনগোষ্ঠীর লোককে পৃথক সত্ত্বার অধিকারী বলে বিবেচনা করা হয়।পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর অগ্রসর আদিবাসীর ন্যায় শিক্ষা-দীক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। পার্বত্য সমগোত্রীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় অআদিবাসী এমনকি বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যাগণ দীর্ঘকাল সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। বর্তমান অভিসন্দর্ভে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিকাশে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবদান সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রয়াস।

চৈত্যভূমি চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। এরই প্রভাব পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত জন সাধারণকেও সমানভাবে প্রভাবিত করে ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ তারাও স্মরণাতীত কাল থেকে বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী ছিলেন। প্রাচীনকালে ভারতে এবং মায়ানমার অবস্থানকালীন সময়ে তাঁরা প্রকৃত বৌদ্ধধর্ম অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্বানুভব করতেন।

১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগলদের হাতে আরাকান রাজা পরাজিত হলে চট্টগামের রাজত্ব স্থায়ীভাবে মোগল সম্রাটদের হাতে চলে যায়। মুসলিম অধিকারের পর থেকে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্যবাসীদের বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শ সমূহ অনেক ধ্বংস হতে থাকে । এক সময় ভারতবর্ষ হতে বিতাড়িত হয়ে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধদের যে অংশ চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল তা ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে একের পর এক বিভিন্ন আঘাতে বিলুপ্ত হতে বসেছিল। সেই অন্ধকার যুগে বৌদ্ধরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত ছিল। আত্মত্যাগী মহান ভিক্ষু সংঘ ও বৌদ্ধ বিহার বিলুপ্তিতে বৌদ্ধরা ভুলে যায় প্রাচীন ধর্মীয় রীতিনীতি ও দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

ক্রমে এক সময় বৌদ্ধরা ভুলে যায় বুদ্ধের প্রকৃত ধর্ম ও বিষয় থের ধর্ম। ভুলে যায় মহাযান সহ যাবতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য বা সংস্কার। শুধুমাত্র রয়ে গিয়েছিল একটুকরো গেরুয়া বসন। তা দিয়েই তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম ও পূজা পার্বন সম্পাদন করত। তখন তাদের রাউলী নামে ডাকা হত। এ প্রসঙ্গে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শ্বাস্ত্রী তার লেখায় উল্লেখ করেছেন- “বাংলার অর্ধেক মুসলমান হয়ে গেল এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরণাগত হল আর বৌদ্ধদের মধ্যে যারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হতেই তাদের উপরে নির্যাতন উপস্থিত হল। মুসলমান অধিকারের পর নতুন সমাজে যারা অনাচারীয় হল, বৌদ্ধধর্ম তাদের মধ্যে নিবন্ধ হয়ে পড়ল এবং তারা ক্রমে প্রজ্ঞা, উপায় ও বৌধিসত্ব ভুলে গেলে শূণ্যবাদ, বিজ্ঞানবাদ ও করুনাবাদ, তখনই রইল জনাকয়েক মুর্খ ভিক্ষু নামধারী বিবাহিত পুরোহিত। তারা অপরাপর মত করে বৌদ্ধধর্ম গড়ে নিল”। (বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম রচনা সংগ্রহ, ৩য় খন্ড পৃ:৩৯৪)

এ সময় বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজে ‘মঘাখমুর্জা’ নামক এক প্রকার ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে রাউলীগণ ধর্মীয় কজ পরিচালনা করতেন (চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম- ভিক্ষু শীলা চার শাস্ত্রী, পৃ:২০)। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিয়ের ঘটকালি থেকে যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতেন এবং ভিক্ষাপাত্র। পিণ্ডাচরণ, পবিত্র ভিক্ষু পরিবাস প্রত ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিলনা (চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম প্রাগুপ্ত:পৃ২৫) অন্যদিকে বৌদ্ধ গৃহী সমাজে কালিপূজা, দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, কার্ত্তিকপূজা, শনিপূজা ইত্যাদি হিন্দু ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজে প্রচলিত ছিল। আবার মুসলমানদের মানিকপুরের সিন্নি, সত্যপীরের সিন্নী, বদর সাহেবের সিন্নী, সিজির সিন্নী ইত্যাদি অনুষ্ঠানও বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ গৃহিরা তথন এরূপ অবৌদ্ধ সম্মত অবস্থার মধ্যে না হিন্দু না বৌদ্ধ না মুসলমান হয়ে জীবন যাপন করেছিলেন।

১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মরাজ বগিড় ও ব্রিটিশ পক্ষের মধ্যে ‘য্যান্ডেরো সন্ধির’ ফলে আরাকান ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সরকারের অধীনস্থ হয়। তখন এ সময় আরাকান ও বাংলাদেশ একই সরকার শাসিত হওয়ার এবং যাতায়াতের সুবিধা থাকায় আরাকানীরা ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে আগমন করতেন। এ সময় আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মাঝে মধ্যে চট্টগ্রামে আগমন করতেন। এ সময় আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ মাঝে মধ্যে চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও উত্তরে আরাকানী বংশোদ্ভুত বোমাং ও মান সম্প্রদায়ভূক্ত বৌদ্ধদের নিকট উপস্থিত হয়ে ধর্ম প্রচার করতেন। তখন বড়ুয়া ও চাকমা সমাজের ধর্মগুরু ছিলেন তখনকার তান্ত্রিক রাউলী সম্প্রদায়। আরাকানী থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংস্পর্শে এসে রাউলী পুরোহিত পোশাক পরিচ্ছদ ও আচার অনুষ্ঠানের কিছু পরিবর্তন হলেও উপসম্পদায় বয়স ও ধর্ম বিনয় সম্পর্কে তখনও তাদের কোন ধারণা ছিলনা। তার বিকেলে ভাত ব্যতীত অন্য পানাহার করতেন।

বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধদের যখন এ অবস্থা চলছিল এমন সময় এদেশে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হারাবাং এলাকায় বরেণ্য পূণ্য পুরুষ থেরবাদী মূল ধারার প্রাপ্ত ভিক্ষু সারমেধ মহাস্থবিরের আগমন ঘটে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। বঙ্গীয় বৌদ্ধ ও পার্বত্য বৌদ্ধদের মোহ মুক্তির শতাব্দী হিসেবে প্রতিভাত হয়। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের চৈত্র মাসে জ্ঞান তাপস সারমেধ মহাস্থবির সশিষ্য তীর্থ ভ্রমণ উপলক্ষ্যে ঐতিহাসিক সিতাকুণ্ড আগমন করেন। তখন বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের পূণ্যপুরুষ প্রখ্যাত সংঘমনীষী শ্রীমৎ রাধাচরণ মহাস্থবিরের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, মহা পণ্ডিত শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবির সদলবলে রাধাচরণ মহাস্থবিরের সাথে সীতাকুণ্ড হতে চক্রসালা হয়ে, বৈদ্যপাড়া শাক্যমুনি বিহার, ঠেগরপুনি বুড়াগোঁসাই মন্দির হয়ে রাউজান মহামুনি মন্দির তখন মেলায় উপনীত হন। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তীতে মহামুনি মেলা ও মহামুনি মন্দির তখন থেকে বাঙ্গালি বড়ুয়া, পার্বত্য এলাকার চাকমা, বোমাং, মগ তঞ্চঙ্গ্যাসহ সকল বৌদ্ধদের একটি মিলন তীর্থ ছিল। এ মহাসমাবেশে তিনি বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন ও ধর্ম বিনয় বিষয়ে আলোচনা করতেন। অসংখ্য ধর্মানুরাগী ভক্ত পূজারীবৃন্দ তাঁর অমৃতময় ধর্মবাণী শ্রবনে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রাউলী পুরোহিত নামে পরিচিত ধর্মীয় গুরুরা তাঁর সান্নিধ্যে বুদ্ধের প্রকৃত ধর্ম বিনয় সম্পর্কে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অনেকটা সংশোধানের পথটা বেছে নেন। তখন থেকে চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বাসীদের মধ্যে নতুন করে ধর্মীয় জাগরণ দেখা দেয়। তিনি ক্রমাগত দু’বছর অবস্থান করে তৎকালীন বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধ ভক্তি, বিশেষতঃ মহাযান পন্থী তান্ত্রিক মতের অসারতা, দেবদেবীর পূজা, পশুবলি, মিথ্যা দৃষ্টি ইত্যাদি যে অবৌদ্ধ উচিত কার্যকলাপ তা সরল ভাষায় বুঝিয়ে দেন এবং থেরবাদী বৌদ্ধের্র্মের মৌলিক রীতিনীতি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা তুলে ধরেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে রাঙ্গুনীয়া রাজবাড়ী রাজানগরে রাজকীয় পূন্যাহ উপলক্ষে চাকমা সার্কেলের রাজামাতা রানী কালিন্দী মহামন্ডিত শ্রীমৎ সারমেধ মহাস্থবিরের চট্টগ্রামে আগমন, বুদ্ধের ও সধর্মবাণীর প্রচারের শুভ সংবাদ শুনে তাকে আমন্ত্রণ পূর্বক রাজবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন রাজ পরিবারের সকল সদস্য ও জনগণ তাঁর মুখ নিঃশ্রিত ধর্ম বাণী শ্রবণে মুগ্ধ হন। তাঁর সম্মানে রাণী আরাকানী ভাষায় উপাধিযুক্ত সীলমোহর প্রদান করেন। তার নিকট বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে আরেক নব ইতিহাসের শুভ সূচনা করে সমগ্র পার্বত্য বাসীদের মধ্যে বিরাট সাড়া জাগায়। আরো উল্লেখ্য যে, ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সাতজন রাউলী পুরোহিতদেরকে ভিত্তি করে সর্ব প্রথম বিনয় সম্মত থেরবাদী আদর্শে হাঞ্চার ঘোনার উপক সীমায় মহামান্য সংঘরাজ সারমেধ মহাস্থবিরের নেতৃত্বে পুনরায় শুভ উপম্পাদা প্রদান করা হয় যা বঙ্গীয় বৌদ্ধসমাজের ইতিহাসে নতুন করে আবার বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া পত্তন করা হয় । তারা হলেন (১) পাহাড়তলী গ্রামের শ্রদ্ধেয় জ্ঞানলঙ্কার মহাস্থবির, (২) ধর্ম পুরের হরি মহাস্থবির, (৩) মির্জাপুরের সুবর্ণ মহাস্থবির, (৪) গুমান-মর্দনের দুর্রাজ মহাস্থবির, (৫) বিনাজুরীর হরি মহাস্থবির, (৬) পাহাড়তলীর কমল ঠাকুর এবং (৭) দমদমার অভয়াচরণ মহাস্থবির। এদের আত্মত্যাগ এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শে সমগ্র চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশেষত উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজের প্রতিথ যখা মহান ভিক্ষু সংঘের প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মীয় জাগরণটা তড়ান্বিত হয়।

পার্বত্য এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীরা ধর্মীয় দিক দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও সনাতন প্রথা মতে এদের অনেকে গাঙপূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, বিত্তিনী পূজা, লক্ষীপূজা, কে পূজা, বুর পাড়া ইত্যাদির দেব-দেবীর পূজা করতে দেখা যায়। অবশ্য উপরোক্ত পূজা সমূহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে করা হয় না। ঐসব পূজা কেবলমাত্র দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধান করে অনুষ্ঠিত হয় উক্ত পূজা সমূহ সম্পাদনের জন্য সমাজের এক শ্রেণীর লোক আছে তাদেরকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বৈদ্য বলা হয় (তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। ১৯৯৫ পৃ:৫২)।

ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান এক নহে।কারণ সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বৈষায়িক বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল অপর দিকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় চেতনায় ধীরে ধীরে গাঢ় হলে সেই চেতনাকে লালন করে প্রাচীন সামাজিক অনুষ্ঠানাদির সংস্কার সাধিত হয় এমন কি কুসংস্কার বলে সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিদায় দেয়া হয়। যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করে, সমাজকে ধারণ করে সুন্দর ও মহান করে তোলে, আদি মধ্যে ও অন্তে কল্যাণ এনে দেয় সেই বৌদ্ধধর্মই তঞ্চঙ্গ্যাদের ধর্ম। কাজেই বুদ্ধপূজা, সংঘদান, সূত্রশ্রবণ, অষ্ট পরিষ্কার দান, প্রবারণা পূর্ণিমা, কঠিন চীবরদান, মাঘী পূণিমায় বহুচক্র মেলা ফালগুনী পূর্ণিমায় জ্ঞাতি সম্মেলন প্রভৃতি প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে উৎসব করা হয়ে থাকে। অধুনা লাভী শ্রেষ্ঠ অরহত সীবলী মহাস্থবিরের পূজাও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সম্পন্ন করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রত্যেক গ্রামে মনোরম ক্যাং বা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠিত দেখা যায় (তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি: প্রাপ্ত পৃ:৫৫)

তঞ্চঙ্গ্যারা প্রধানত কৃষি নির্ভর হলোও ইদানিং শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতিতে অনেকটা অগ্রগতি লাভ করেছে। ধর্মীয় চেতনার দিক থেকে তারা বর্তমান অনেকটা উন্নত এবং অতীতের অনেক কুসংস্কার মুক্ত বলা যায়। তারা পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়, কষ্টসহিষ্ণু, আত্মশক্তির উপর নির্ভরশীল, ধৈর্যশীল, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বন্ধুবৎসল এবং কর্মে একনিষ্ঠ বলেই দ্রুত অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মূলে ভিক্ষু সংঘ এবং গৃহীসংঘের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল অতুলনীয়। বর্তমান তঞ্ঙ্গ্যাগণ আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি, বৃত্তি মূলক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আইন, প্রশাসন, ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভৃতি সর্ব বিষয়ে শিক্ষা লাভের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন এটা জাতির জন্য শুভ সংবাদ বলা যায়।

ধর্মীয় সামাজিক ও আধুনিক শিক্ষার অগ্রগতিতে তাদের অবদান ছিল সর্বাগ্রে। তাদের সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা তুলে ধরার প্রয়োজন মনে করি। পার্বত্য এলাকায় সদ্ধর্মের পুনরুদ্ধাত্থান শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দির মাঝা-মাঝি কাল হতে। প্রথমত: রাজকীয় প্রভাব, দ্বিতীয়ত: আত্মত্যাগী ধর্মীয় গুরুদের প্রভাব এবং সাধারণ গৃহীদের আত্মসচেতনতা। বিশেষত: আধুনিক শিক্ষ ও ধর্মীয় অনুরাগ আজ অতটুকু অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি বলা যায়।

ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়- শ্রীমৎ বরমিত্র ভিক্ষু চাকমা সমাজ হতে চাকমা রাজা হরিল চন্দ্র’র (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে) রাজগুরুর আসন অলংকৃত করেন। এরপর শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ ভিক্ষু, শ্রীমৎ কালাচোখা ঠাকুর (জ্ঞানরত্ন ভিক্ষু), শ্রীমৎ পালক ধন ভিক্ষু এবং শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরের (পালকধন তনচংগ্যা একজন বৌদ্ধ সাধক ও ধর্মপ্রচারক। ১৮৭৯ সালে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ/রাঙামাটি) কোন এক তনচংগ্যা পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। উইকিপিডিয়ায়য় ও চিত্রশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার লেখা “তঞ্চঙ্গ্যা জাতি” বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে সে তনচংগ্যা ১২ টি গছার মধ্যে “কার’অয়া” গছার অন্তর্ভুক্ত। খুব ছোটকালে পালকধনের মা মারা যাওয়ায় তিনি এক চাকমা পরিবারে কৈশোরকাল বেড়ে ওঠেন। সেই পরিবারই তাঁর নাম পালকধন তনচংগ্যা রেখে দেয়। তিনি তনচংগ্যা সমাজের প্রথম বৌদ্ধসাধক (Monk)। উনিশ শতকে বৌদ্ধশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনার জন্য শ্রীলংকা পাড়ি জমান। তিনি থেরবাদী বুড্ডিজম নিয়ে পড়াশুনা করেন। পরে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নব্য বৌদ্ধ সাধক হয়ে উঠেন। পালকধন বৌদ্ধশাস্ত্র পাশাপাশি, সাধারণ বিদ্যাশিক্ষা নিয়েও বেশ মেধাবী ছিলেন। বৌদ্ধসাধক হিসেবে তাঁর নাম হয় “প্রিয়রত্ন মহাথের”। যা পরে এ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত হন।

১৯৩৫ সালে চাকমা রাজা ভূবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর রাজপুত্র নলিনাক্ষ রায় রাজা হন এবং প্রিয়রত্নকে রাজকীয় কুলপতি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এবং পরে চাকমা রাজগুরু উপাধিতে ভূষিত হন। যখন তিনি রাজা ছিলেন, হিন্দু নিয়মগুলো চলমান থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে লুরির চেয়ে সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুদের সংখ্যা কম ছিল। লুরিরা মূলত ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ছেড়ে আসা ধর্ম প্রচারক। তাদের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ মানুষের মতোই, স্ত্রীসন্তানসহ বাস করতো। বৌদ্ধীয় শাসকের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তারা সন্ন্যাসীতে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে তাদের আচারনিয়ম হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। তারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অধঃপতিত রূপ সম্ভবত তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করত। তাদের বক্তব্য বা লেখ্যগুলো মূল বৌদ্ধ ধর্মের বক্তব্য বা লেখ্যগুলোর সাথে সামঞ্জস্যহীন ছিল। চাকমা রানী বিনতা রায় হিন্দু ছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের আচারঅনুষ্ঠান পালন করতেন। সমগ্র রাজবাড়িতে সনাতন ধর্মের পূজা করা হত। হিন্দু ধর্মের আচার শক্তভাবে পালন করার কারণে শ্রদ্ধেয় ভান্তে এখানে ভালোমতো বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ করতে পারেননি।) প্রমূখ সাংঘিক ব্যক্তিত্বদের প্রচুর খ্যাতি রেখেছিলেন। তাদের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে যাদের অবদান ছিল তাঁরা হলেন রাজগুরু অধ্যাপক শ্রীমৎ ভগবান চন্দ্র মহাস্থবির রাজগুরু, শ্রীমৎ ধর্মরত্ন মহাস্থবির এবং দার্শনিক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, উপ-সংঘরাজ শ্রীমৎ সুগতবংশ মহাস্থবির, ভদন্ত চিত্তানন্দ মহাথেরো (১৯১১-১৯৯৩) অন্যতম (গৃহীর নাম যতীন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগেংখুলী শ্রী জয় চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, উপসম্পদার নাম: চিত্তানন্দ ভিক্ষু তিনি প্রত্যক্ষভাবে নিজগ্রাম মানিকছড়ি অগোইয়াছড়ি নামক দুটো স্থানে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা অগ্রনী ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন পার্বত্য ভিক্ষু সমিতি (বর্তমান পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এবং অর্থ সম্পাদক পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। চিত্তানন্দ মহোদয় রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের জিনবংশ মহাথের কর্তৃক লিখিত গ্রন্থের প্রকাশক ছিলেন। উল্লেখ্য যে, পরম শ্রদ্ধেয় ভান্তের নামকরণে জগনাতলী চিত্তানন্দ পালি কলেজ, নানিয়াচর চিত্তানন্দ পালি কলেজ, ঝগড়াবিল রাঙ্গামাটি রয়েছে। তিনি রাঙ্গামাটি সদরস্থ ত্রিরত্নাঙ্কুর বৌদ্ধ বিহারে ১৯৯৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)

বিংশ শতাব্দির শ্রীমৎ বিমলানন্দ মহাস্থবির আগরতারা অনুবাদ করার কঠিন কাজে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু আশানুরূপ সফল হতে না পারলেও ঐ সময়ে কালে তার অবদান কোন অংশে কম ছিলনা। এরই মধ্যে তাদের অর্ধকর্ষিত ভূমিতে জ্ঞানের মশাল এবং ধর্মীয় ধ্বজা নিয়ে নামলেন পার্বত্য এলাকার প্রবাদ প্রতীম সংঘ মনীষী রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, ১৯১৩-২০০৮)। তিনি ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দশ বৎসর যাবৎ বার্মা দেশে বুদ্ধের ধর্ম বিনয় এবং ত্রিপিটক বৌদ্ধ সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করে ষষ্ঠ বৌদ্ধ মহাসঙ্গতির করণীয় দায়িত্ব শেষ করে জন্মভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনিই একমাত্র  বৌদ্ধ মনীষী যিনি মহাসংগীতিকারকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্থান থেকে এই মহতি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার গৌরব অর্জন করেন। তাঁর এই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজন কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপণ্ডিত’ উপাধিতে সমানিত করেন। ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক ‘অগ্গামহাসধোম্মজ্যোতিকাধ্বজ’ উপাধি ভূষিত হন। এই সব উপাধি আমাদের বৌদ্ধ সমাজের জন্য বিরল। ত্রিদিব রায় তাকেঁ রাজগুরু পদে বরণ করে নেন। আর তিনি পার্বত্য জাতির মধ্যে সদ্ধর্মের আলো তুলে দিতে আত্মোৎসর্গ করলেন নিজেকে। তাঁর বাল্য জীবনের পথ পরিবর্তনে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে ছিলেন তাঁরা রাঙ্গুনীয় ঘাটচেক গ্রামের সাংঘিক পুরোধা শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবির এবং সাধক পুরুষ শ্রীমৎ আনন্দিত মিত্র মহাস্থবির। তৎকালীন বার্মাদেশ থেকে ত্রিপিটক শাস্ত্রে এম. এ. ডিগ্রী অর্জন করা কম গৌরবের বিষয় নয়। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বরেণ্যে এবং আলোকিত গর্বিত রত্ন সন্তান। তারই পাশাপাশি ছিলেন উপ-সংঘরাজ শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির। যার আন্তরিক সহযোগীতায় অনেক ভিক্ষু শ্রামণ আধুনিক শিক্ষায় আলো পেয়ে সমাজ ও ধর্মের উন্নয়নে অনেক কাজ করে চলেছেন। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির প্রথম কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিক্ষু সমিতি এবং পার্বত্য চট্টল ভিক্ষু সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ভিক্ষু এবং গৃহী সমাজকে একত্রিত করে স্বজাতির সামগ্রিক কল্যাণে হাত দিয়ে আজ সমগ্র জাতি এর সুফল ভোগ করে চলেছে। তিনি প্রায় ৬টির অধিক বাংলা, চাকমা ও ইংরেজী ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে সমাজকে উপহার দিয়েছেন। সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় জাগরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে অগ্রনী। তাঁরই পাশাপাশি তাদেঁর আগে পূণ্য পুরুষ শ্রীমৎ তিষ্য মহাস্থবিরের নাম জানা যায়। যিনি রাজগুরু অগ্রবংশে গুরু ছিলেন। অত্র এলাকায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি তিনি পরিচালনা করতেন। তিনি প্রাচীন ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে অন্যতম ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন। বুদ্ধশাসনে আরেক পুণ্য পুরুষ শ্রদ্ধেয় শীমৎ সাধনা নন্দ মহাস্থবিরকে উপাসম্পদা দীক্ষা দেন শ্রীমৎ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর সংঘপুরোধাদের মধ্যে যাদেঁর অবদান চিরস্মরনীয় তাঁরা হলেন ভদন্ত আচারনন্দ মহাস্থবির (১৯৩৭-২০০৫), যিনি বৌদ্ধ দেশ- শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘকাল ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে সমাজ ও স্বধর্ম সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। ধুতাঙ্গ ব্রতধারী শাস্ত্র পণ্ডিত শ্রীমৎ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির- গৃহিনাম তেজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা প্রতিরূপ দেশ বার্মঅয় গিয়ে ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন পূর্বক স্বদেশে এসে সদ্ধর্মের উন্নয়নে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে কীর্তিময় কাজ হলো ত্রিপিটক শাস্ত্রের অভিধর্ম পিটকের গভীরত্ব বিষয়ক কয়েক গ্রন্থ অনুবাদ করেন যা অত্যন্ত জতিল বিসয়। তন্মধ্যে (১) শাতিকাধাতু-কথা স্বরূপিনী (১৯৯৯) (২) অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরুপিনী(১৯৯৩)- (৩) যমক স্বরুপিনী(২০০০), (৪) অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গঁ প্রকরণ (২০০৩) (৫) বুদ্ধ প্র্রকাশনী (২০০১), (৬) পথ প্রদর্শন (১৯৯৮), (৭) চলার পথে(২০০০) তাছাড়াও তিনি বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠা সংস্কার ও সংরক্ষণ করে সামাজিকভাবে অনেক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ওয়াগ্গান জন কল্যাণ বৌদ্ধ বিহারের পরলোকগত আগ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন।

শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি মহাস্থবির ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা ভিক্ষু শ্রীমৎ জিতানন্দ মহাস্থবিরের নিকট প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষিত হয়ে সেই বছরই পাঁচ মাস পরে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের সান্নিধ্যে শুভ উপসম্পাদা গ্রহণ করেন। সেই থেকে দীর্ঘ একুশ বছর রাজস্থলী মৈত্রী বিহারের অধ্যক্ষ পদের নিষ্ঠার সাথে যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি পরিচালনা করে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তাছাড়া ভিক্ষু সমিতি ও অনাথালয়ের দায়িত্ব ও নিষ্ঠার সাথ পালন করেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যাদের একজন বরেণ্যে ভিক্ষু ছিলেন।

শ্রীমৎ আর্যানন্দ মহাস্থবির একজন কর্মবীর এবং তঞ্চঙ্গ্যা বংশের কৃতি ভিক্ষু ছিলেন, তিনি অত্র সমাজ ও সদ্ধর্মের কল্যাণে বহু সেবামূলক সংস্থার জন্ম দেন। যথাক্রমে (১)আর্যানন্দ পালি কলেজ (স্থাপিত ১৯৯২), (২) রাঙ্গুনীয় অগ্রবংশ শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, (৩) ত্রিরত্ন ভিক্ষু এসাসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাছাড়াও তিনি অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত থেকে শাসন সদ্ধর্মের অগ্রগতিতে যথেষ্ঠ কাজ করে গেছেন। তিনি শ্রীমৎ হেমাঙ্কর মহাস্থবিরের শিষ্য ছিলেন। শ্রীমৎ জ্যোতি প্রিয় অত্র এলাকার উদীয়মান ভিক্ষু হিসেবে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি পার্বত্য কিষু সংঘের থানা শাখার সভাপতি এবং রাজগুরু অগ্রবংশ শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিলাইছড়ি থানা সদরে প্রতিষ্ঠিত ধুপ্যাচড় বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। প্রয়াত শ্রীমৎ অনুরুদ্ধ স্থবির দীর্ঘকাল নারইখ্যা পাড়া সদ্ধর্মদ্ধয় বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান করে অত্র এলাকার জন সাধারণের মধ্যে ধর্মীয় পরিবেশ ও শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেন। তিনি অত্র বিহারেই দেহত্যাগ করেন। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরে জনপদের  কুতুবদিয়া  বিহারের শ্রীমৎ অজিতা স্থবির অল্প বয়স থেকে ধ্যান ভান্তে নামে পরিচিত। বর্তমানে তিনি গভীর জঙ্গলে অবস্থান করছেন। শ্রীমৎ নন্দীয় স্থবির কাউখালী  খোয়াপাড়া বিহারে অধ্যক্ষ এবং খোয়াপাড়া চন্দ্রবংশ শিশু সদনের পরিচালক হিসেবে শিশু কিশোরদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার সুব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ধর্মানন্দ মহাস্থবির তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বরেণ্যে ভিক্ষু। তিনি ত্রিরত্ন ভিক্ষু সমিতিরি প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এবং বর্তমানে সভাপতির এবং রাজস্থলী বৌদ্ধ শিশু সদনের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। এবং আর্যনন্দ পালি কলেজের সভাপতির ও দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীমৎ অগগ্রশ্রী ভিক্ষু অধ্যক্ষ পাগলাছড়ি সর্বজনীন বৌদ্ধ বিহার রোয়াংছড়ি, বান্দরবান। তিনি সাধারণ সম্পাদক ও পরিচালক অনাথ বন্ধু অনুরুদ্ধ শিশু সদনের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সুমেধানন্দ ভিক্ষু-ভিক্ষু সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ধর্ম দেশনার ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট পাণ্ডিত্য স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। তিনি রমতিয়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ্য। তরুণ ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ রাজগুরু অগ্রবংম মহাস্থবিরের প্রিয়তম শিষ্য। তিনিও অধুনা থাইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় রত।

তাছাড়াও আরো বহু শ্রামণ শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে অধ্যয়নরত আছেন। আশাকরি ভবিষ্যতে অত্র এলাকার শিক্ষা সাংস্কৃতির পাশাপাশি প্রচার ও প্রসারের বিশেষ বৌদ্ধের থেরবাদী মূল ধারাকে উজ্জীবিত করতে এগিয়ে আসবেন। আর কিছু দায়ক দায়িকা আছেন বিশেষ করে বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য প্রসন্নকান্তি তঞ্চঙ্গ্যা, এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা ও ওয়াগ্গার হেডম্যান পরিবার তাঁরা সদ্ধর্ম পালনে ও প্রচারে সমাজ ও জাতিকে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। বলা যায় তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ইদানিং শিক্ষা-দীক্ষায় আশানুরূপ উন্নতি দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে সমাজ ও সদ্ধর্মের ক্ষেত্রে আরো অনেক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে, তাঁরা অত্যন্ত পরিশ্রমী কষ্টসহিষ্ণু, অধ্যবসায়ী, আত্মশক্তির উপর নির্ভরশীল ধৈর্যশীল, পরস্পরের প্রতি আত্মবিশ্বাস, শ্রদ্ধাশীল ও বন্ধুবৎসল এবং কর্মে একনিষ্ঠ। বিশেষত তরুণ-তরুণী এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটি সুমধুর সম্পর্ক পরিপক্ষিত এগুলো এক জাতির সার্বিক উন্নয়নের শুভ লক্ষণ মনে হয়। উপরোক্ত বিষয়াবলী প্রকৃত বুদ্ধের শিক্ষা। এই চেতনায় অটুট থাকলে যে কোন জাতির অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী।

(সংক্ষেপিত এবং সম্পাদিত)

সহায়ক গ্রন্থঃ

১. শ্রীমৎ রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবীর জীবন ও ধর্ম-শ্রীমৎ ড. জিনবোধি ভিক্ষু

২. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি-শ্রীমান বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা

৩. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- শ্রীমান রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

৪. পহর জাঙাল- তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক বিষয়ক প্রকাশনা।