Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

Hoisting the national flag and releasing balloons before commencing the General Conference and Council of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization

Wagga, Rangamati, April 26, 2024 – The Bangladesh Tanchangya Welfare Organization (BTWO) hosted its pivotal General Conference and Council yesterday at the Wagga High School Compound, Kaptai Upazila, Rangamati, marking a significant step towards enhancing community welfare and cultural preservation of the Tanchangya people. The event was graced by the presence of notable figures, including Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs, who attended as the chief guest, and Dipankar Talukdar, MP of Rangamati District, who served as the inaugurator.

Special guests at the event included Jarati Tanchangya, Reserved MP for Women of Chittagong Hill Tracts, and Mr. Aungsuipru Chaudhuri, Chairman of Rangamati Zila Parishad, among other dignitaries who have been instrumental in Tanchangya community affairs.

Mr. Kujendra Lal Tripura, MP of Chittagong Hill Tracts Affairs delivering the Chief Guest Speech

The conference commenced with the ceremonial hoisting of the Bangladesh national flag, followed by the enchanting rendition of a traditional Tanchangya song, setting a tone of unity and cultural reverence. The event was a gathering and vibrant celebration of Tanchangya heritage, with discussions centred around safeguarding their culture and consolidating efforts across various Tanchangya Kalyan Sangsta regional units.

Tanchangya singers singing song during the General Conference Council

The gathering was significant due to the elections to appoint new leadership within the BTWO. Mr. Diptimoy Talukdar was elected President, Mrinal Kanti Tanchangya was the General Secretary, and Najib Kumar Tanchangya was the Organizing Secretary. These leaders are poised to spearhead initiatives that will foster the development and growth of the Tanchangya community.

A section of the audience during the Conference and Council of BTWO

The Ad hoc Central Committee of BTWO appointed the Debtachhari Region of the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization to host the General Conference and Council. However, all 12 regional committees contributed to executing the Conference and Council of BTWO. The 12 regional committees are spread across Rangamati, Bandarban, and Cox’s Bazar districts. They are: (1) Rangamati Sadar Region (2) Debtachhari-Raisyabili Region (3) Kaptai Region (4) Bilaichhari Region (5) Farua Region (6) Rajasthali Region (7) Rajbila Region (8) Bandarban Region (9) Roangchhari Region (10) Alikadam Region (11) Nakhyongchhari Region (12) Cox’s Bazar Region.

Group photo of Chief Guest and Special Guests during the Bangladesh Tanchangya Welfare Organization’s General Conference and Council

The Ad hoc BTWO gave the responsibility to the Debtachhari-Raisyabili Regional Committee of the BTWO, which extended heartfelt thanks to all who supported the event physically, mentally, and financially. Special acknowledgement was given to the youth and students from local villages such as North Debatchari, Dakshin Debatchari, and others, whose tireless volunteer efforts were crucial in the smooth execution of the conference. As the event concluded, a vote of thanks was given, recognising the invaluable contributions of attendees from all 12 regions within the Rangamati and Bandarban districts. The BTWO expressed optimism that the solid foundation of cooperation during this conference will continue to strengthen in future endeavours, propelling the Tanchangya community towards greater heights of development and cultural preservation.

Note: Credit goes to the original owners of these photos, which the editors collected from Chandra Sen Tanchangya and Milinda Tanchangya.

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : বাঘ ও শূকরের মিতালী

লেখক : বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

বনে নানা প্রজাতির পশু-পাখি বাস করে। কোন পশু মাংসভোজী, আর কোন কোন পশু তৃণভোজী। পাখিরা সাধারণতঃ শস্য, ফল, কীটপতঙ্গ, ছোট ছোট মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মাংসভোজী পশুরা খুব হিংস্র হয়ে থাকে।

অপর দিকে তৃণভোজী পশুরা নিরীহ প্রকৃতির হয়ে থাকে। তৃণভোজী পশুদের মাংস খেয়েই মাংসভোজী পশুরা জীবনধারণ করে। তাই তৃণভোজী পশুদের উপর তারা বরাবরই চড়াও হয়। তারা আবার স্বজাতীয় পশুদের মাংসও বাদ দেয়না।

একে অপরকে মেরে মনের সুখে মাংস ভক্ষণ করে উদর পূর্তি করে। তৃণভোজী পশুরা তাই সবসময় সন্ত্রস্ত হয়ে বিচরণ করে থাকে। কোথাও কোন হিংস্র পশু ওঁৎ পেতে আছে কি-না সে জন্য তাদের সবসময় সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়।

তাই স্বভাবই তারা চঞ্চল। পাখিরা মাটিতে বিচরণ করলেও তাদের ডানা থাকাতে কোন হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে তারা সহজে আত্মরক্ষা করতে পারে।

সে জন্য তারা অনেকটা নির্ভয়ে বাস করে। গাছের ডালে উড়ে বেড়ায়, কলকাকলী করে। তাদের কল কাকলী শুনে মনে হয় তারা কতই সুখী।

শত শত প্রজাতির পশু-পাখিদের অরণ্যে আইন শৃঙ্খলাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সে আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ আলাদা। অরণ্যের আইন নিতান্তই বন্য। যেখানে তৃণভূমি আছে কিংবা তৃণভোজী হরিণ, চঙরা, (সম্বর) শূকর, খরগোশ প্রভৃতি বিচরণ করে, তার কাছাকাছিই চুপিসারে বিচরণ করে হিংস্র বাঘ, সিংহ।

গণ্ডার, হাতি, বুনোমহিষ প্রভৃতি বৃহৎ জন্তুরাও সমগ্র বনাঞ্চলে বিচরণ করে থাকে। বাঘ-সিংহরা তাদের যেমন কিছু করতে পারে না, তাদের ধারে কাছেও যায় না। এদের মধ্যে ধূর্ত বুদ্ধির অধিকারী পশু হল শিয়াল।

হরিণ, শূকর প্রভৃতি তৃণভোজী পশু শিকার করা তার সাধ্যের বাইরে। শিয়ালও মাংসভোজী প্রাণী। সে বাঘ আর সিংহের পিছনে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে খুব সতর্ক হয়ে বিচরণ করে। যখন কোন হরিণ, সম্বর, শূকর মারা যায়, তখন মৃত পশুর একাংশ বাগিয়ে নেবার তালে থাকে।

অনেক সময় বেকায়দার ফলে হিংস্র পশুর থাবার শিয়ালকে অহেতুক প্রাণ হারাতে হয়। এ হল বেচারা শিয়ালের অবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য ধূর্ত বুদ্ধির আশ্রয় নেয়া ছাড়া তার কোন গত্যন্তর নেই।

গভীর অরণ্য ছেড়ে শিয়াল লোকালয়ের কাছে থাকা অধিক পছন্দ করে। সে লোকালয়ে একটু চেষ্টা করলেই গৃহপালিত হাঁস, মুরগী শিকার করতে পারে। বন মোরগ কিংবা অন্য পাখি শিকার করা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন।

পাখিদের মধ্যে পেঁচার একটু বিশেষত্ব আছে। পেঁচার চোখের পাতা নেই। তার চোখে পলক পড়ে না। অপলক নেত্রে সে আলো সহ্য করতে পারে না। তাই দিনের বেলায় সূর্য্যর আলো থেকে বাঁচার জন্য পেঁচা ঝোপের মধ্যে অন্ধকারে বসে থাকে অথবা ঘুমায়।

রাতের বেলাতেই সে চরে বেড়ায়, খাদ্য আহরণ করে। সারা রাত কুল-কুলায়। কিন্তু সকাল হলে ঘুমিয়ে পড়ে। এজন্য একটি চাকমা প্রবাদ আছে, সারা রাত পেঁচায় কুল-কুলায় খুরোল্যা (কাঠ ঠোকরা) সনার তুন (সোনার মুকুট) পায়।

তবে পেঁচাও ধূর্ত কম নয় বরঞ্চ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। সে যখন জেগে থাকে তখন চুপ করে থাকে। রাতে যখন গাছের ঝোপে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তখন শব্দ করে।

“পুকজুক পেদরললত পুক জুক পেদরললত, পুক জুক পেদরললত” তখন শিকারী নিশাচর বনবিড়াল মনে করে, পেঁচা বেটা তার আহরণ করা পোকা আরাম করে খাচ্ছে। তাই বনবিড়াল সে দিকে যায় না আর পেঁচাও নিরাপদে ঘুমায়।

সমগ্র বনাঞ্চল সিংহই হল অঘোষিত সম্রাট। হাতি, গন্ডার, বুনোমহিষ প্রকান্ড শরীরের অধিকারী হলেও অন্য পশুদের শাসন করার ক্ষমতা তাদের নেই। প্রকান্ড শরীরগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য অহরহ খাদ্য অন্বেষণ করতে হয় তাদের।

অন্য কিছু করার বা ভাববার সময় তাদের নেই। সিংহ হিংস্র এবং শক্তিশালী। একটি হরিণ বা শূকর মারতে পারলে তার বেশ ক’দিন চলে যায়। নানা চিন্তা ভাবনা করার সময় তার আছে।

তার মূর্তি ও শক্তিমত্তা দেখে অন্যান্য পশু-পাখিরা তাকে সমীহ করে এবং এ সুযোগে সে নিজেকে সমগ্র বনাঞ্চলের সম্রাট বলে জাহির করে।

বন্য পশু-পাখিদের একটি সার্বজনীন প্রকৃতির ভাষা আছে। এটি সকলেই বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী ধ্বনিও উচ্চারণ করতে পারে। এটি তাদের লিংগুয়াফ্রাংকাই। এ লিংগুয়াফ্রাংকাই অরণ্য অঞ্চলের ভাষা।

এ লিংগুয়াফ্রাংকা দিয়েই অরণ্য সম্রাট সিংহ তার শাসন পরিচালনা করে। মানব সমাজে যেমন অন্যায়-অবিচার, অঘটন ঘটে এবং সেসবের বিচার হয়ে অপরাধীর শাস্তি ধার্য করা হয়।

পশু–পাখিদের মধ্যেও সে রকম অন্যায়, অবিচার, অঘটন সংঘটিত হয় এবং সেসবেরও বিচার করার উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হয়। দুর্বলেরা সিংহের নিকট তাদের প্রতি কৃত অন্যায়-অবিচারের বিচার প্রার্থী হয়।

সিংহ তার সভাসদের পরামর্শে বিচার নিষ্পত্তি করে। সেরকম একটি ঘটনা এখনও অরণ্য অঞ্চলে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ঘটনাটি বা ঘটনার কাহিনী এখন মানব সমাজে রূপ কাহিনী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

একদা কোন এক গভীর অরণ্যে এক শিকারির গুলির আঘাতে এক বাঘিনী তার শিশু শাবক রেখে মারা যায়। মাতৃহারা শাবকটি অসহায়ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করার সময় সদ্য প্রসূতি হওয়া এক শূকরীর নজরে পড়ে।

শূকরীর একটি মাত্র শাবক। অসহায় ব্যাঘ্র শাবকটির প্রতি করুণা পরবশ হয়ে শূকরী ব্যাঘ্র শাবককে আপন শাবকের ন্যায় স্নেহের সাথে নিজের দুধ পান করিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এবং লালন পালন করতে থাকে।

ব্যাঘ্র শাবকটি দু’এক মাস শূকরীর দুধ পান করলেও তার জাতিগত স্বভাব অনুযায়ী ধীরে ধীরে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী শিকার করতে আরম্ভ করে। ইতোমধ্যে শুকরছানা আর ব্যাঘ্র শাবকটির মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

এভাবে তারা বড় হতে থাকে এবং স্ব স্ব জাতিগত স্বভাব লাভ করে। এক সময় শূকরছানাটি তার মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাঘ্র শাবকের সঙ্গে বন হতে বনান্তরে বিচরণ করে জীবনযাপন করতে লাগল। উভয়ের মধ্যে যে প্রগাঢ় হৃদ্যতা তা বলাই বাহুল্য।

ব্যাঘ্র মাংসভোজী হিংস্র পশু। বনাঞ্চলে সিংহের পরেই তার স্থান। ব্যাঘ্র শাবকটি সারাদিন বন্য পশু শিকার করে আর শূকর ছানাটি শস্য ক্ষেত এবং তৃণভূমিতে বিচরণ করে সন্ধ্যায় দুই বন্ধু একত্রিত হয়ে এক জায়গায় রাত কাটায়।

এভাবে উভয়ে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে পরিপূর্ণ বাঘ আর শূকরে পরিণত হল। বাঘটি শক্তিশালী হিংস্র শিকারি পশু এবং শুকরটি চর্বি জমে মোটাসোটা, নাদুস নুদুস হয়ে এক লোভনীয় জন্তুতে পরিণত হল। শূকর দুর্বল প্রাণী।

অন্ততঃ বাঘের কাছেতো বটেই। প্রথম প্রথম সে বাঘটিকে সমশ্রেণী বা সমগোত্রীয় মনে করত। কিন্তু একদিন যখন দেখল বাঘটি তার সামনেই তাদের সমগোত্রীয় একটা শূকরের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে মেরে ফেলল এবং উল্লাস সহকারে মাংস ভক্ষণ করল, তখনই সে বুঝতে পারলো বাঘ তাদের সমগোত্রীয় নয়। কিন্তু তখনও বোধহয় হয়নি যে, সেও বাঘের ভোগ্য জন্তুতে পতিত হতে পারে।

একদিন বাঘ সারাদিন কোন শিকার জোটাতে না পেরে সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। শূকরটি এ অবস্থায় চিন্তিত হয়ে তার পাশে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করল। বাঘ আরো গম্ভীর হল এবং এক সময় হঠাৎ এক লাফ দিয়ে শূকরের গলায় কামড় বসিয়ে দিল।

কিন্তু না, জোরে নয় অতি হালকাভাবে বাঘ কেবল শূকরকে বধ করছে–এই ভাবে অভিনয় বা ভান করল মাত্র। শূকর ভয় পেল। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে তবু সাহস করে বলল, একি বন্ধু! তুমি আমাকে এভাবে আক্রমণ করছ কেন?

তুমি কি শেষ পর্যন্ত আমাকেও হত্যা করে ফেলবে? এ কথায় বাঘ শূকরকে ছেড়ে দিল এবং লজ্জার ভান করে বলল, ছিঃ ছিঃ বন্ধু, তুমি একি বলছ? আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে, তোমার মত অকৃত্রিম বন্ধুকে হত্যা করব?

তোমার মত নাদুস নুদুস পশু ধরলেই আমার হাত থেকে পালিয়ে যায়, তাই একটু তালিম দিয়ে দেখলাম ভবিষ্যৎতে কিভাবে ধরতে হবে। নির্বোধ শূকর বাঘের এ কথায় আশ্বস্ত হল।

বাঘটির কয়েক দিন ধরে শূকরের নাদুস নুদুস শরীর দেখতে দেখতে তাজা মাংসের লোভে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের সখ্যতার কারণে এতদিন লোভ দমন করে আসছে।

কিন্তু শূকরের কণ্ঠনালীতে কামড় বসাতে গিয়ে বাঘটির লোভ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল এবং তার পক্ষে লোভ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ল।

একদিন সকালে শূকর যখন আহার অন্বেষণে আস্তানা থেকে রওনা দিচ্ছে, বাঘ এক গাছের আড়াল থেকে এক লাফ দিয়ে শূকরের পিঠে কন্ঠনালীর দিকে মুখ নিতে নিতে বলে, বন্ধু এতদিন তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আজ কিন্তু তোমার তাজা মাংস খাব।

শূকর ভীষণ ভয় পেল। সে বাঘের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে উচ্চ লাফ দিল। আচমকা এ লাফে বাঘ নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না, শূকরের গায়ে আঁচড় কেটে মাটিতে পড়ে গেল। শুকরের গা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে।

শূকর সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। একটি গাছের গুঁড়িতে পিঠ রেখে বাঘের পুনরায় সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হল। বাঘ কিন্তু আক্রমণ করল না। শুকরের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধু তুমি জাননা তুমি আমার ভক্ষ্য।

তুমি কোন বিশ্বাসে এবং কোন সাহসে ভক্ষকের সঙ্গে মিতালী কর? আমি আর তোমাকে রেহাই দেব না। তোমার পিঠ থেকে আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বোধহয় বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছ।

শূকর তার দেহে বাঘের নখের আঁচড় লাগা স্থান থেকে রক্ত ঝড়তে দেখে এবার উপলব্দি করল যে, বাঘ তার সমগোত্রীয় নয় এবং যে কোন মূহুর্তে বাঘ তাকে মেরে ফেলতে পারে।

শিশুকাল থেকে সখ্যতা আছে বলে শূকর বাঘকে বন্ধুতের দোহাই দিতে থাকে এবং নম্রসুরে বলল, বন্ধু আমার মায়ের দুধ একসঙ্গে ভাগাভাগি করে খেয়ে বড় হয়েছি।

আমার মা তোমাকে আপন সন্তানের মত আদরযত্ন করেছে, সে কথা কি ভুলে গেছ বন্ধু? বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, কি আজেবাজে বলছ! বাঘের বাচ্চা কখনও শুকরের দুধ খায় নাকি? যাক এতদিন আমি তোমাকে রেহাই দিয়েছি, আর রেহাই দেব না।

আসল কথা কি জান? আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম যে, আমি তোমাকে ঘাড় মটকিয়ে হত্যা করে তোমার তাজা রক্ত মাংস খাচ্ছি। স্বপ্নে আরো দেখলাম, বনের রাজা সিংহও অতি আনন্দের সঙ্গে তোমার তাজা রক্ত মাংস খেয়ে লাফাতে শুরু করেছে।

অন্য কোন কথা বলে লাভ নেই, তুমি প্রস্তুত হও, আমি আমার দেখা স্বপ্ন অনুযায়ী তোমাকে এখনই মেরে ফেলব। শূকর বুঝতে পারল বাঘটির কথায় কোন কৃত্রিমতা নেই। রূঢ় অথচ সত্যি কথাই বলছে বাঘ।

শূকর অনুনয় বিনয় করে আমতা এবং ভয় জড়িত কন্ঠে বলল, এ বনে অনেক পশু-পাখি আছে যারা এ বনেরই অপর প্রাণীর ভক্ষ্য। তথাপি বনের রাজা সিংহের শাসনাধীনে একই বনে যার যার প্রাণ রক্ষা করে বেঁচে আছে।

আমাদের সকলের রাজা সিংহ মহাশয়ের সমীপে চল, তিনি যদি বলেন, তোমার স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী তুমি আমাকে ভক্ষণ করতে পারবে, তাহলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। বন্ধুর জন্য আমার এ দেহ হাসিমুখে বিসর্জন দেব।

বাঘ জানে যে, শূকর কোনদিন তার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। সে যখন ইচ্ছা করে তখনই শুকরকে হত্যা করতে পারবে।

এও জানে যে, মহাপরাক্রমশালী পশুরাজ সিংহ অবশ্যই তার পক্ষেই রায় দেবে, স্বপ্নের বিবরণ অনুযায়ী শূকরকে হত্যা করার নির্দেশ অবশ্যই দেবে। এসব কথা ভেবে বলল, ঠিক আছে বন্ধু, তোমাকে এ সুযোগ দিলাম। চল, পশুরাজ সিংহের দরবারে।

যথাসময়ে পশুরাজ সিংহের দরবারে হাজির হল তারা। পশুরাজ সিংহ শূকরকে দেখে অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করল এবং শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে তাজা রক্ত পান করার প্রবল ইচ্ছা কোন রকমে চাপা দিয়ে রাখল।

শূকর বাঘকে দেখিয়ে তার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পশুরাজ সিংহের কাছে প্রার্থনা জানাল। বাঘ কেন শূকরকে আক্রমণ করতে চায়, তা পশুরাজ জানতে চাইলে বাঘ দৃঢ় কন্ঠে তার স্বপ্নের বিবরণ পশুরাজকে খুলে বলল।

উভয়ের আর্জি শুনে সিংহ তার স্বভাবজাত কায়দায় গর্জন করে বলল, এ অরণ্য রাজ্যের ছোট, বড় প্রায় সকল পশু-পাখিই আমার দরবারে হাজির হয়েছ। শূকরের আবেদন এবং বাঘের স্বপ্নের বিবরণ সবাই শুনেছ। স্বপ্ন হল স্বর্গীয় ব্যাপার।

এটি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ। বাঘ শুকরের মাংস খাচ্ছে বলে যে স্বপ্ন দেখেছে তা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশই হয়েছে। কাজেই বাঘ শূকরকে এখন খেতে পারবে। বন্য কুকুর এবং শিয়াল ভয়ে ভয়ে চাপা কন্ঠে বলল, স্বপ্নে যাহা দেখে বাস্তবে তা হয় বা হওয়া প্রয়োজন এরকম কোন নজির নেই।

অতএব বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে শূকরকে কি করে ভক্ষণ করবে তা বুঝা যায় না। পশুরাজ সিংহ রাগান্বিত হয়ে বলল, শিয়াল, কুকুর তোমারও মাংস পেলে ছাড় না………… তোমাদের মুখে এ কথা সাজে না, চুপ কর।

সিংহের গর্জনে তারা গুটিশুটি মেরে বসে রইল। হাতি তার বড় বড় কান দুটি এবং লেজটি নেড়ে সিংহের গর্জন শুনে তার শুঁড়টি উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঘের এ স্বপ্নটি অতি অদ্ভুত।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন স্বর্গীয় হবে কেন? আর সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ হলে স্বপ্নের মধ্যে শূকর মরে যেত……….. সেতো এখনো বেঁচে আছে। কাজেই এ স্বপ্নটি মিথ্যা।

এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন কেউ কি দেখে? তার পাশে দাঁড়ানো পর্বতের মত বিশাল দেহধারী গন্ডার তার নাকের উপর অবস্থিত শিং সহ দুবার উপর নীচে সঞ্চালন করে গোঁ গোঁ শব্দে হাতিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি জঙ্গলের সবার চেয়ে প্রকান্ড জন্তু, বনের অন্যদের সাথে তোমার তেমন সংশ্রব নেই। কে কী রকম স্বপ্ন দেখে তুমি জানবে কিভাবে?

শুধু বাঘ নয় আর অন্য কেউ এর চেয়েও অদ্ভুত লোমহর্ষক স্বপ্ন দেখতে পারে। কারণ এটি স্বর্গীয় ব্যাপার। এবার সে পশু রাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মহারাজ, বাঘ যা স্বপ্ন দেখেছে তা আমি বিশ্বাস করি। এবার আপনার রায় ঘোষণা করুন।”

গন্ডারের কথায় সিংহ আহ্লাদিত হয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে রায় ঘোষণা করল। বাঘ তার স্বপ্নের বিবরণ মত শূকরকে ভক্ষণ করবে আমি অনুমতি দিলাম। চারদিকে গুঞ্জন হল।

বাঘ মুখ ব্যাদান করে হাসতে হাসতে শূকরকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হচ্ছে এমন সময় হাতি বাঘের সামনে গিয়ে তার গতিরোধ করে সিংহকে লক্ষ্য করে বলল, মহারাজ বাঘকে ক্ষান্ত দিয়ে শূকরকে কিছুদিনের অবকাশ দিন। শূকর মৃত্যু ভয়ে কাঁপতে থাকে।

হাতির কথায় একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে পশুরাজকে কাতর হয়ে নিবেদন করল; মহারাজ! আপনি ধর্মাবতার, আমাকে একমাস অবকাশ দিন, আমি আমার পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে হাজির করব। সিংহ তার নিবেদন শুনে হাতির কথা মনে করল।

হাতি প্রথম থেকেই স্বপ্নের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছে। শূকরের অবকাশ অনুযায়ী তাকে অবকাশ দিল। তবে মাত্র পনের দিন, এক মাস নয়। বাঘ বিস্মিত হয়ে সিংহের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সিংহ আবার গর্জন করে শূকরকে বলল, পনের দিনের শেষ দিন তোমার উকিল হাজির করবে, না পারলে আর কোন ক্ষমা নেই। তারপর দিনই বাঘ তোমাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেবে। অন্যান্য পশু-পাখিদের সে দিন যথা সময়ে হাজির থাকার আদেশ দিয়ে বিচার সভা ভেঙ্গে দিল পশুরাজ।

তৃণভোজী এবং সমগোত্রীয় পশু এবং পাখিদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে তার পক্ষে ওকালতি করার জন্য শূকর কোন পশু কিংবা পাখি পেল না। সে উকিলের সন্ধানে অনিশ্চতার পথে পা বাড়াল।

কোন দিকে চলছে নিজেরও খেয়াল নেই, দিন-রাত শুধু চলছেই। দু’চোখ ভরে তার পানি। কিছুই দেখতে পায় না। তবু হাঁটতে থাকে যদি ভাগ্যক্রমে কোন শুভাকাঙ্ক্ষী পায়। সাত দিন একটানা হাঁটার পর একরাতে ভোর হয় এ অবস্থায় ক্লান্ত শূকরটি একটি মাঝারি গাছের কান্ডে ঢুঁ মারল।

গাছটি লিকলিকে হলেও মাথায় ঘন ঝোপ। ঝোপসহ গাছটি কেঁপে উঠল। শূকর মাথায় মারাত্মক যন্ত্রণা পেয়ে থেমে গেল। গাছের ঝোপে ঝিমুচ্ছিল পেঁচা।

সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত করার পর ভোররাতে একটু ঘুমুতে চেষ্টা করছিল আরাম-আয়েশ করে। ঝাঁকুনি খেয়েই আচমকা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। আপন মনে নিচে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, কে গাছকে এমন নাড়া দিল?

শূকরকে দেখতে পেল সে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে এমনিতেই রেগে গিয়েছে পেঁচা, আর শূকরের মত একটি জড় বুদ্ধি সম্পন্ন আবর্জনা প্রিয় জন্তু দেখে তার রাগ শতগুণ বেড়ে গেল। ঝোপ থেকে নীচে নেমে শূকরের মাথায় কয়েক লাথি মেরে আশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি আরম্ভ করে দিল।

বেঁটা অন্ধ, বেকুব, গন্ড, মূর্খ সামনে কোথায় কি আছে দেখতে পাচ্ছিসনা। শূকর তার বিপদের কথা বলে বিলাপ করতে আরম্ভ করল। পেঁচার চোখের পাতা নেই বলে সূর্যালোতে সে বের হতে পারে না, অগত্যা ঝোপের আড়ালে বসে কিংবা ঘুমিয়ে সূর্যালোকিত দিনের বেলাটা কাটিয়ে দেয়। সারারাত আহারের সন্ধান করে।

এজন্য অন্যান্য পাখিরা এদিক ওদিক উড়তে দেখে পেঁচা দিনের বেলায় ঝোপের মধ্যে থাকে বলে সে নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে। শূকরের অবস্থা দেখে এবং তার বিলাপ শুনে বুঝতে পারল শূকর মহাবিপদে নিপাতিত হয়েছে।

সিংহ ও বাঘ চক্রান্ত করে শূকরকে ভক্ষণ করার মতলব করেছে। পেঁচা তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বুঝে নিল। একবার বনের মধ্যে পাখিদের মাঝে কী একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সংগীতের কিংবা সে ধরণের এক প্রতিযোগিতা।

ঐ প্রতিযোগিতায় পেঁচাই বিজয়ী হয়ে পুরস্কার পেত, কিন্তু সারারাত ডাকাডাকি করে সবার চাইতে অধিক যোগ্যতা দেখালেও ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ে এবং যথাসময়ে বনের রাজা সিংহের সামনে হাজির হতে পারে নি।

পেঁচার ডাকাডাকিতে কাঠঠোকরার ঘুম ভাঙ্গলে ভোর রাতে সিংহের দরবারে গিয়ে কিচির-মিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে। ফলে আর কাউকে না দেখে সিংহ কাঠঠোকরাকে সোনার মুকুট দিয়ে পুরস্কৃত করে।

সে সময় থেকে কাঠঠোকরার মাথায় সোনার মুকুট শোভা পাচ্ছে। এ কারণে পেঁচা পশুরাজ সিংহের প্রতি খুবই ক্ষুব্দ। সে সারারাত ডাকাডাকি করে বনভূমি মুখরিত রাখে আর কাঠঠোকরা ভোররাতে কয়েকবার কিচিরমিচির কক কক কোকর ধ্বনি করে সিংহের সামনে হাজির হতেই সিংহ তাকে সোনার মুকুট মাথায় পরিয়ে দিল।

এ সম্পর্কে বনের অন্য পশু-পাখিরা নির্বুদ্ধিতার জন্য কটাক্ষ করে থাকে। এজন্য পেঁচার দুঃখের অন্ত নেই। বাঘের স্বপ্ন দর্শন অনুসারে সিংহের প্রদত্ত নির্দেশ শুনে শূকরের প্রতি তার সহানুভুতি জাগল।

তাকে সমবেদনা জানাল এবং সিংহকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যভাবে বলল, বাঘের স্বপ্নকে স্বর্গীয় ব্যাপার বলে তদনুযায়ী বাঘ শূকরকে ভক্ষণ করবে, সিংহের কী রকম বিচার এটা! আচ্ছা দেখা যাবে তারপর শূকরকে বলল, বাঘ স্বপ্নে দেখেছে বলে তোমার ঘাড় মটকাবে!

বাহঃ কী সুন্দর যুক্তি সিংহের। আর বাঘের স্বপ্ন কত স্বর্গীয়। স্বপ্ন স্বর্গীয় বটে, আমিও কত স্বপ্ন দেখি, সে সবই স্বর্গীয়। একটু আগেও আমি রাজ সিংহাসনে বসে এ বনে রাজত্ব করতে স্বপ্ন দেখলাম।

শূকরকে অভয় দিয়ে পেঁচা বলল, সে শূকরের পক্ষে ওকালতী করবে সিংহের নির্ধারিত দিবসে সে দরবারে হাজির হয়ে যথাযতভাবে তার পক্ষে ওকালতী করবে। এ বলে পেঁচা সেখান থেকে উড়াল দিয়ে গভীর বনে ঢুকে গেল।

পেঁচার কথা গুলো বাগাড়ম্বর মাত্র মনে করল শূকর। পেঁচা কি তাকে বাঘের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হবে? তার আশংকা দূর হলনা। জীবনের আশা একদম ছেড়েই দিল শূকর।

তবে বিচারের নির্ধারিত দিনে রাজদরবারে হাজির হবে এবং তার পক্ষে ওকালতী করবে বলে পেঁচা যে বলে গেল, একথাকে সিংহকে জানালে ভাল হয় মনে করে শূকর সেদিনই সিংহকে তার উকিল পেঁচার কথা জানিয়ে আসল।

ইতিমধ্যে বাঘের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি। বাঘটির উদ্দেশ্য কত জঘন্য তা ভাবতে ভাবতেই শূকর বুঝতে পারল সবলের সঙ্গে দুর্বলের বন্ধুত্ব কত ভঙ্গুর।

পশুরাজ সিংহ যে দিনটি বিচারের জন্য নির্ধারণ করেছিল সে দিনই ঠিক বিচার সভা বসল। বনের পশু-পাখি একে একে হাজির হচ্ছে। হরিণ, খরগোশ, সজারু, বানর প্রভৃতি তৃণভোজী পশুর দল শূকরের চারপাশ ঘিরে বসেছে।

তারাও যেন শূকরকে সমবেদনা জানাচ্ছে। এছাড়া তাদের কিছু করার নেই। শিয়াল, বন্য কুকুর, নেকড়ে বাঘের সামনে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তারা ঘন ঘন বাঘ আর সিংহের মুখের দিকে তাকাতে থাকে। বুনো মহিষ, সম্বর, হরিণ, গয়াল, গন্ডার, হাতি সবাই পরস্পর সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাজ দরবারের পাশে ঘন ঝোপের বন ছিল।

পশুরাজ তার রাজকীয় আসনে এতক্ষণে এসে বসেছে। প্রচন্ড হুংকার ছেড়ে শূকরের আগমন জানতে চাইল।

তখন শূকর ভীষণ ভাবে কাঁপতে কাঁপতে এক লাফ দিয়ে বেদনার্ত কন্ঠে জবাব দিল, আমি হাজির, ধর্মাবতার। সিংহ জিজ্ঞেস করল, কোথায় তোর উকিল? দুবার, তিনবার জিজ্ঞেস করলেও শূকর কোন জবাব দিতে পারল না।

তার উকিল পেঁচার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। সিংহ গর্জন করে উঠল এবং শূকরকে লক্ষ্য করে বলল, তুই ছেলে খেলা পেয়েছিস, তোর উকিল হাজির করবে বলে অনর্থক সময় নষ্ট করেছিস, আমাকেও অপমান করলি। তারপর বাঘকে সিংহ বলল বাঘ তুমি তৈরি হও।

সভায় পশুদের গুঞ্জন উঠল। বাঘ শরীর একঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শূকরের মৃত্য সে যেকোন সময় ঘটাতে পারে। কেবল পশুরাজের হুকুমের জন্য অপেক্ষা। পশুরাজ তাকে তৈরি হতে নির্দেশ দিয়েছে।

হত্যা কর বললেই সে এক মুহূর্তও বিলম্ব করবে না, প্রয়োজনও নেই। এক লাফেই সে শূকরের ঘাড় ভেঙ্গে দেবে। সিংহ এবার তার শেষ নির্দেশ দেবার জন্য গলা পরিষ্কার করে নিল।

ঠিক তখনিই সিংহের মাথার উপ্রে অবস্থিত ঝোপের আড়াল হতে বের হয়ে পেঁচা পশু সভার মধ্যে মহা উল্লাসে নাচতে লাগল। নাচছে তো নাচছেই, নাচতে নাচতে এক পর্যায়ে উড়ে বাঘের মাথায় লাথি মারে, আবার শুন্য উঠে।

আবার নীচে নেমে সিংহের সামনে উল্লাসে নাচতে থাকে। শূকর খেয়াল করল তারই উকিল পেঁচা। কিন্তু এরকম করছে কেন তার উকিল? রাজ সভায় ওকালতী করতে এসে একি বেয়াদবি। এতে আরও বিপদ বেড়ে গেল, নয় কি? রাজা ভীষণ রেগে যাচ্ছে।

এখনি হুকুম করে সব শেষ করে দেবে। শিয়াল বাহাদুরী দেখাবার জন্য এক থাবা দিয়ে সিংহের সামনে নৃত্যরত পেঁচাকে ধরে ফেলল। পেঁচা তখন আর্তনাদ করে উঠল; আ-হা-হা, করলে কি! করলে কি!

রাজ সিংহাসনে বসতে না বসতেই তুমি আমাকে ধরে ফেললে! তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলে! তারপর পেঁচা সিংহকে উদ্দেশ্য করে বলল, মহারাজ আপনি ধর্মাবতার! আপনি বিচার করুন। আমার স্বর্গীয় স্বপ্ন শিয়াল ভেঙ্গে দিল।

সিংহ উম্মত হয়ে গর্জন করে উঠল। বেটা তোর আবার কি স্বপ্ন? যত সব আজগুবি ব্যাপার। তখন পেঁচা শিয়ালের হাত থেকে এক সুযোগে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে উঠে বসল। তারপর বলল, বনের পশু-পাখি ভাই বোনেরা, আপনারা কেউ কি স্বপ্ন দেখেন না?

কোন দিন কেউ স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখেছেন। শুধু এ বাঘই স্বপ্ন দেখে কি? স্বপ্ন দেখার কি তারি একচেটিয়া অধিকার? তখন গন্ডার তার মুখ উঁচু করে গোঁ গোঁ করে বলল, স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে এবং সবাই স্বপ্ন দেখে, কেন না স্বপ্ন হচ্ছে স্বর্গীয় ব্যাপার।

সিংহ একটু নরম হল। পেঁচাকে বলল, তোর স্বপ্নটা আবার কী? পেঁচা বলল, স্বপ্নটা বর্ণনা করতে আমার ভয় হচ্ছে মহারাজ। আপনি যদি অভয় দেন আমি বলব। সিংহের মুখে একটু বিদ্রুপ ভ্রূকুটি দেখা গেল।

তাচ্ছিল্য ভরে বলল, দেখি, বল দেখি, তোর কেমন স্বর্গীয় স্বপ্ন! যার দর্শনে তুই উম্মাদ হয়ে গিয়েছিস! এবার পেঁচা খুব বিনয় সহকারে দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিল; মহারাজ ধর্মাবতার!

আমি স্বপ্নে দেখলাম আপনি আপনার মেয়েকে মহা ধুমধামের সহিত আমার সাথে বিয়ে দিয়ে সুসজ্জিত রাজ সিংহাসন দান করছেন তারা সবারই আপনার আস্তানায় বিপুল খাদ্য ভোজ্য উদর পূর্তি করছে। আহা! কত আনন্দ! কী স্বর্গীয় আনন্দ মহারাজ!

সিংহের রাগ শতগুণ, সহস্রগুণ বেড়ে গেল। উম্মত আক্রোশে আসন ছেড়ে উঠে হুংকার ছাড়ল; বেটা কোন সাহসে তুই একথা উচ্চারণ করলি? তুই বেটা স্বপ্ন দেখলি কেন?

আহাম্মক কোথাকার! তখন হাতি তার দুইকান ও লেজ নেড়ে শুঁড় উর্ধে তুলে শোঁ শোঁ করে বলল, কি অদ্ভুত স্বপ্নরে বাবা! বড় অদ্ভুত স্বপ্ন! বাঘের স্বপ্নের কথা আমি বিশ্বাস করতাম না। এবার কিন্তু বিশ্বাস করলাম।

পেঁচাকে আমাদের সবার সামনে রাজ সভায় উল্লাসে নৃত্য করতে দেখলাম। রাজার সামনে এরূপ নৃত্য করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু পেঁচা যে স্বপ্ন দেখেছে এটি স্বর্গীয় ব্যাপারই বটে, তা সত্য, অতি সত্য। গন্ডার গোঁ গোঁ করে বলল, আমিও বলেছিলাম শুধু বাঘ নয়, আরো অনেকেই নানা রঙের স্বপ্ন দেখতে পারে এবং দেখেও থাকে।

তৃণভোজী প্রাণীরা এবার উল্লাসিত হয়ে উঠল। তারা বলল, রাজকন্যার সঙ্গে পেঁচার বিয়ে হতে হবে, এখনই বিয়ে হোক। পেঁচাকে সিংহাসন প্রদান করে বনের পশু-পাখিগণকে বিয়ের খানা ভুরি ভোজ দেয়া হোক। আমরা উদর পূর্তি করে খাব।

সিংহ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইল। বাঘ অম্লান মুখে সিংহের দিকে আর মাঝে মাঝে শুকরের দিকে তাকায়।

পেঁচা আবার খুব নম্র এবং বিনয়ের সাথে সিংহকে বলল, মহারাজ ধর্মাবতার, আপনি বনের অধিবাসী পশু-পাখিদের রাজা, সর্বময় কর্তা বাঘের স্বপ্নের শর্তপূরণ করার জন্য বাঘকে যদি শূকরকে মারতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি সে স্বপ্নের শর্ত অনুযায়ী রাজ কন্যা বিয়ে করতে এবং সিংহাসন লাভ করার জন্য আমাকেও নির্দেশ দেন।

পশুরাজ সিংহ নিজের ফাঁদে নিজে জড়িয়ে পড়ছে দেখে ঘাবড়িয়ে গেল। উপস্থিত বনের পশু-পাখিরা কলরব করে উঠল।

বাঘ তখন ম্লান মুখে পশুরাজ সিংহের প্রতি চেয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ভাবার পর পশুরাজ সিংহ স্বপ্ন দর্শন অনুসারে শূকরকে ভক্ষণ করার বাঘকে যে অধিকার দিয়েছিল তা নাকচ করে দিল।

অধিকন্তু, শূকরটির কোন বিপদ হলে তাতে বাঘকেই দায়ী করা হবে। এই ফরমান জারি করে পশুরাজ নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস পেল।


তথ্যসূত্র : তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা : তেন্দেরার পচ্ছন

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা

জালিম্বর একজন আঙু। “আঙু” হল সমাজপতি বা দলপতি। পরবর্তীতে কোন তালুকের অধিকারীকে আঙু বলা হয়।

জালিম্বর একদল লোক নিয়ে রোয়াঙ্গ (আরাকান) থেকে যখন আনকে (চট্টগ্রাম অঞ্চলকে রোয়াঙ্গারা আনক অর্থাৎ পশ্চিম দেশ বলে) আসে তখনো চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোগলদের প্রভাব ছিল।

তাই দলবল নিয়ে সে নাক্ষ্যংছড়ি ও রামু হয়ে উত্তর দিকে সরে ক্রমে ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

তখন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে কোন সরকারী বনাঞ্চল ছিল না, বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল মুক্ত বনাঞ্চল। জালিম্বর আঙুর দলবল তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই ছিল।

বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের এক সুবিধাজনক স্থানে গ্রাম পত্তন করে জালিম্বর আঙু তাঁর দলবল নিয়ে বাস করতে থাকে। তাঁর দলের লোকেরা জালিম্বরকে আঙু বলে মেনে নেয়।

সে জালিম্বর-আঙু নামে পরিচিত হয়। বিয়ের সাত বছর পর তাঁর একমাত্র পুত্রের জন্ম হয়। জালিম্বর এবং তাঁর স্ত্রী বাদীমুই ছেলেটিকে কিভাবে আদর করবে তা নিয়ে দুইজনের মধ্যে ঝগড়া হত।

তাঁরা অতি আদরের ছেলেটির নাম রাখল চিজিগুলা। কিন্তু পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ আদর করে কিংবা বিদ্রুপ করে ডাকে গুলা। চিজি বাদ দিয়ে শুধু গুলা। তাঁরা অতি আদর যত্ন নিয়ে ছেলেটিকে বড় করতে লাগল।

কিশোর বয়সে চিজিগুলার জন্য বৌ আনতে শখ জাগল জালিম্বর আঙুর। পাড়ার সবচাইতে সুন্দরী ফুলরেণুকে চিজিগুলার জন্য বৌ ঠিক করা হল।

ফুলরেণু বয়সে গুলার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং পূর্ণ যুবতী না হলেও তার বিয়ের সাধ হয়েছে। বাগল্যার সঙ্গে তার আইপাই (মন দেয়া নেয়া) এবং ঘনিষ্টতার কথা কারোর অজানা ছিল না।

ফুলরেণু এ বিয়েতে কোন মতেই রাজি নয়। তার অভিযোগ হচ্ছে গুলা তার চেয়ে বয়সে ছোট, এখনো কিশোর এবং গুলা ভাল করে কথা বলতে পারে না, তার জিহ্বায় আড়ষ্টতার দোষ আছে।

ফুলরেণুর বাবা মা আঙুর একমাত্র সন্তান বিবেচনা করে গুলার সঙ্গে মেয়ে ফুলরেণুর বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে। বিয়ে যে দিন হবে, তার আগের রাতে ফুলরেণু বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে যায়।

সকাল হতে না হতেই ঐ খবরটি জালিম্বর জানতে পারে। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে একজন বিশ্বাসী লোক পাঠিয়ে দিল ভিনগ্রামের তাঁর মামাত ভাই নাগর্য্যার কাছে।

লোকটি গিয়ে নাগর্য্যাকে বলল, জালিম্বর তাঁর ছেলে চিজিগুলোকে বর সাজিয়ে নিয়ে আসছে, সে যেন তার মেয়ে মুগুলিকে কনে সাজিয়ে রাখে।

চিজিগুলা আর মুগুলির আজই বিয়ে হবে। সব ব্যবস্থা যেন নাগর্য্যা করে রাখে। নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী খবরটি পেয়ে বিস্মিত হলেও বরঞ্চ খুশি হল।

তার মেয়ে মুগুলির বয়স চিজিগুলার চেয়ে দু বছরের বড়। এমনিতে আত্মীয় আর জালিম্বর হচ্ছে আঙু বা দলপতি, কাজেই নাগর্য্যা আর তার স্ত্রী জালিম্বরের কথায় বেরাজী হল না।

মুহূর্তের মধ্যেই লোকজন দিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল নাগর্য্যা মহা ধুমধাম সহকারে না হলেও সে দিন ঠিক ঠিক চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ে হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশীরা এসে ভুরি ভোজন করে চিজিগুলা আর মুগুলিকে আশীবাদ করল।

জালিম্বর আঙু জুম চাষ করলেও তার কিছু ধান্যজমি আছে। গরু, ছাগল, মহিষ, শূকর, হাঁস-মুরগি গৃহপালিত পশু-পাখি তাঁর অঢেল আছে। তাঁর পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল। একেবারে ধনী বলা না গেলেও দরিদ্র নয় জালিম্বর আঙু।

মুগুলির সঙ্গে বিয়ে হলেও চিজিগুলা ফুলরেণুকে ভুলতে পারেনি। তার কথা মাঝে মাঝে মুগুলিকে শোনায়।

উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটি হয়। চিজিগুলা আর মুগুলির বিয়ের তিন বছর পর জালিম্বরের স্ত্রী মারা যায়।

এর চার বছর পর জালিম্বরও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। চিজিগুলা আর মুগুলির জোড়া তালি দিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। পাড়ার লোকেরা তাদের শেষাংশ উচ্চারণ করে ডাকে। যেমন – চিজিগুলাকে শুধু গুলি।

উভয়ের কথা বলতেই শুধু গুলাগুলি উচ্চারণ করে হাসে আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। গুলাগুলির সংসারে বিয়ের দীর্ঘ ছয় বৎসরেও কোন সন্তান সন্ততি হয়নি।

জালিম্বর আঙু স্বপ্নে দর্শন দিয়ে গুলাকে বলে, চিজিগুলা তোমরা বড় একা হয়ে গেছ, আমি আসছি। আমি তোমার ঘরে আসছি।

কিছুদিনের মধ্যে গুলা বুঝতে পারল গুলি গর্ভধারণ করেছে। সে তার স্বপ্নের কথা গুলিকে বলে ফেলল। তাদের বিশ্বাসমতে গুলার পিতা জালিম্বর পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছে।

এতে তারা খুশি হল। ঠিক দশ মাস দশদিন পর মুগুলি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। তাদের আনন্দ এখন দেখে কে!

সন্তানটি বড় হতে থাকে। যখন হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে, পাড়া মাতিয়ে রাখে ছেলেটি। তার বাবা-মাকে সে বাবা-মা ডাকে না।

বাবাকে ডাকে গুলা আর মাকে ডাকে গুলি। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন প্রকৃতির হয়েছে ছেলেটা। তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচরণে চাতুর্য প্রকাশ পেতে থাকে।

পাড়ার লোকেরা তাকে তেন্দেরা নামে ডাকতে থাকল। একদিন গুলা এবং গুলিও ছেলেটিকে তেন্দেরা নামেই ডাকতে থাকে।

একদিন গুলা জঙ্গল থেকে একটি কচ্ছপ ধরে নিয়ে এল ঘরে। ডিমওয়ালা কচ্ছপ। কচ্ছপ কেটে রান্না করা হলে তেন্দেরা বলল যে, সে ডিমগুলোই খাবে, ডিম বাদে কিছুই খাবে না।

গুলা এবং গুলিও এতে খুশি। একটি মাত্র ছেলে, সে না খেলে খাবে কে? কিন্তু কচ্ছপের সেই হলদে রঙ্গের ডিমগুলো খাওয়া শেষ করে তার বাবা-মাকে বলতে লাগল, ইস!

তোমরা কী খাচ্ছ? আমাকে একটুও দিলে না। আমিও কচ্ছপের মাংস খাব। কচ্ছপের মাংস পেট ভরে খেল ডিমগুলো খাওয়ার পর।

খেয়ে বলতে লাগল, ইস এটা ডিমের চেয়ে সুস্বাদু। সে মুরগি বা মোরগের গিলা, কলিজা খায় না, শুধু খায় মাথা, ঠ্যাং ইত্যাদি। গুলাগুলি এই ডানপিটে ছেলে তেন্দেরার কান্ডে অবাক হয়ে থাকে।

বয়স বার, তের হতে না হতেই তেন্দেরার দেহে, মনে যৌবন এসে গেল। সে পাড়ার তরুণীদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায়।

পাড়ার ছেলেরা তাকে চোখে চোখে রাখে, সাবধান করে। গুলাগুলি ছেলের এই আচরণ দেখে মর্মাহত হয় এবং তার জন্য বৌ আনার সিন্ধান্ত নেয়।

পাড়ায় অনেক তরুণী তাকে পছন্দ করলেও তেন্দেরা বিয়েতে রাজি হয়নি। তাই একদিন তারা তেন্দেরাকে ঘর থেকে নামিয়ে দেয়। তাকে বলে দেয় যে, সঙ্গে বৌ না নিয়ে আসলে ঘরে উঠতে পারবে না।

তেন্দেরা কোন কথা না বলে বেড়িয়ে পড়ল শূণ্য হাতে। পকেটে টাকা পয়সা নেই। কোন যুবতীর মন পেতে হলে নূন্যতম পক্ষে সুগন্ধি তৈল, আয়না, চিরুনি দিতে হয় একথা তেন্দেরার জানা আছে কিন্তু সে এগুলো পাবে কোথায়?

টাকা পয়সা থাকলে বাজার থেকে সে কিনে নিতে পারত। কিভাবে টাকা পাওয়া যায় একথা ভাবতে ভাবতে তেন্দেরা এক স্থানে গিয়ে দেখে একজন চাষী হাল চাষ করছে।

এক জোড়া মহিষের হাল। সে মিষ্টি কথা বলে চাষীর সঙ্গে সখ্যতা করে বলল, দাদা তুমি বিশ্রাম কর, আমি তোমার বদলে হাল চালাই। লোকটি তাতে রাজি হল এবং তেন্দেরা হাল চষতে লাগল।

বেশ খানিকক্ষণ চষার পর তেন্দেরা লোকটিকে বলল, দাদা মশা-মাছি মহিষ দুটোর গায়ে বসে বড় উৎপাত করে। এতে মহিষগুলো বিরক্ত হয়, লাঙ্গল টানতে চায় না।

বরঞ্চ মহিষ দুটোর গায়ে কাদা লেপে দিলে মশা-মাছি গায়ে বসে উৎপাত করবে না। মহিষ দুটো আরাম করে হাঁটবে, লাঙ্গল টানবে। দাদা, আমি তাই করি,  কী বল?

লোকটি আপত্তি করল না। তেন্দেরা মহিষ দুটোর গায়ে ভালভাবে কাদা লেপে দিল। সূর্যের তাপে কাদা শুকালে মহিষ দুটোর কালো রং সাদা হয়ে গেল এবং দুটো সম্পূর্ণ নতুন মহিষ বলে মনে হতে লাগল।

তেন্দেরা একটু পর লোকটিকে বলল, দাদা আমার পানির তৃঞ্চা পেয়েছে, তোমার ঘরে গেলে কি পানি খেতে পারব? লোকটি বলল, “সে কি কথা? পানি কেন পাবে না?

যাও ঐ যে টিলার ওপর ঘর, ওখানে গিয়ে স্ত্রীকে বললে পানি দেবে। তেন্দেরা সন্দেহের ভান করে বলল, দাদা যদি পানি না দেয়, তখন আমি তোমাকে বলব, দিচ্ছে না তাহলে তুমি তাকে দাও, দাও বলবে তো?” লোকটি স্বাচ্ছন্দে রাজি হল।

তেন্দেরা ধীর পায়ে টিলার ওপর লোকটির ঘরে গিয়ে তার স্ত্রীকে বিনয় সহকারে কুশল জিজ্ঞেস করে, খুশি করল।

তারপর বলল, বৌদি দেখ, দাদা মানে তোমার স্বামী একটু আগে আমার কাছ থেকে এক জোড়া হালের মহিষ কিনেছে ঐ দেখ সাদা মহিষগুলি।

তোমার নিকট থেকে মহিষ দুটোর দাম দু’শো টাকা নেবার জন্য দাদা পাঠিয়েছে, তুমি আমাকে দু’শো টাকা দাও। তখন স্ত্রী লোকটি উত্তরে বলল, কি যাতা বলছ, আন্দাজে কেন টাকা দেব?

তেন্দেরা বলল, তাহলে আমি তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছি, দেখ সে কি বলে। তেন্দেরা ডাক দিয়ে লোকটিকে বলল, দাদা কথামত তোমার স্ত্রী দিচ্ছে না। এই কথা শুনে লোকটি রাগত স্বরে জোরে জোরে বলল, আরে দাও, দাও।

অগত্যা স্ত্রী লোকটি বাক্স থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দুশো টাকা দিয়ে দিল। তেন্দেরা টাকা পাওয়া মাত্রই সেখান থেকে চম্পট দিল দূরে অনেক দূরে।

হাঁটতে হাঁটতে সাত গাঙ সাত পাড়া পার হয়ে এক বাজার থেকে সুগন্ধি তেলের বোতল, আয়না, চিরুনি এবং অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী কিনে থলে ভর্তি করে নিল।

একদিন সাঁঝের বেলা শামুকছড়ি পাড়ে এক পাড়ায় এসে পৌঁছাল তেন্দেরা। পাড়ার এক প্রৌঢ়া ও একজন তরুণী। মা ও মেয়ে। মা মেয়েটিকে নদী থেকে পানি আনতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি সাঁঝের বেলায় একা পানি আনার জন্য যেতে ভয় পাচ্ছে।

তেন্দেরা তরুণীকে দেখে পছন্দ করল। প্রৌঢ়া মহিলাকে মাসী সম্বোধন করে কুশল জিজ্ঞাসা করল। প্রৌঢ়া মহিলা বিস্মিত হয়ে তেন্দেরাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে গো! আমাকে কেন মাসী ডাকছ, আমার তো এ জম্মে কোন বোন নেই।

তুমি কোথেকে এলে? তেন্দেরা বিনীতভাবে বলল, আমি তোমাকে আমার মায়ের মতই দেখছি। আমার মায়ের চেহারা ঠিক তোমার মত। যা হোক আমি তোমাকে মাসি বলে ডাকব।

মাসী আমাকে কলসিটা দাও, আমি পানি এনে দিচ্ছি। মা ও মেয়ে উভয়ে খুশি হল। তরুণীটি কলসিটি তেন্দেরার হাতে দেওয়ার সময় তেন্দেরা তার থলেটি তরুণীর হাতে দিয়ে বলল, বোন এই থলেতে যা আছে সব তোমার জন্য এনেছি, তুমি রেখে দাও।

তেন্দেরা কলসিটি ভরে পানি নিয়ে উঠানে পৌঁছার আগে থেকে প্রৌঢ়া বকবক করছিল। তেন্দেরার কানে গেল প্রৌঢ়ার কথা গুলো, কোথা থেকে কে আসল এই সাঁঝের বেলা।

তাকে রাত্রে থাকতে দেব কিভাবে? তেন্দেরা মনে মনে ভাবল তাহলে তাকে কি এখানে থাকতে দেবে না? সে ফন্দি আঁটতে লাগল কিভাবে এই ঘরে থাকা যায়?

পানির কলসি ঘরে তুলে দিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, মাসীমা কী কী কাজ আমাকে দাও আমি করে ফেলি। আমাকে অন্য ঘর খুঁজতে হবে থাকার জন্য। মহিলা বুঝল তেন্দেরার এখানে থাকার ইচ্ছা নেই, অথচ কাজ করে দিতে বলছে।

তখন তেন্দেরাকে জিজ্ঞস করল, তুমি কোথা থেকে আসছ? কে তুমি? তেন্দেরা জবাব দিল সে আঙু জালিম্বরের নাতি। তখন মাহিলার মনে আগের কথা স্মরণ হল, ভাবতে লাগল সে।

জালিম্বর আঙু তার ছেলে চিজিগুলার জন্য তাকে বৌ ঠিক করেছিল। কিন্তু যে দিন বিয়ে হবে তার আগের রাতে বাগল্যার সঙ্গে সে পালিয়ে গিয়েছিল।

ছয়/ সাত বছর সুখে ঘর করে একমাত্র কন্যা কুকলিকমালা জম্ম গ্রহণ করে এবং তার জম্মের এক বছর পর বাগল্যা মারা যায়।

প্রৌঢ়া ফুলরেণু তেন্দেরার বাপের নাম জিজ্ঞেস করতেই তেন্দেরা জবাব দিল, তার বাপের নাম গুলা। এবার ফুলরেণু বলল, তুমি চিজিগুলার ছেলে তাহলে?

তেন্দেরা হ্যাঁ বলল, এই সাঁঝের বেলা আর কোথায় যাবে, এখানেই থাক। এর আগে কোনদিন কোন ছেলে বা পুরুষকে আমাদের ঘরে থাকতে দেইনি, আমার মেয়ে কুকলিকমালা।

মেয়ে কুকলিকমালাকে তেন্দেরাসহ তিনজনের ভাত রাঁধতে বলল ফুলরেণু। কুকলিকমালা ইতোমধ্যে তেন্দেরার দেওয়া থলে থেকে সুগন্ধি তেল মাথায় দিয়ে আয়না দেখে চুল আঁচড়িয়ে মনের মত সেজেছে।

সে কোন কথা না বলে ভাত রাঁধতে শুরু করে। তেন্দেরার আগমনে সে খুশি হয়েছে!

একদিন দুদিন থেকেও তেন্দেরা ঘর থেকে চলে যাওয়ার নাম করল না। মা আর মেয়েও উচ্চবাচ্য করেনি।

তেন্দেরা ফন্দি আঁটে কিভাবে কুকলিকমালাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবে। ফুলরেণু মাঝে মাঝে ভাবে, চিজিগুলা ভালভাবে কথা বলতে পারে না।

জিব্বায় যেমন জড়তা আছে তেমনি জড়বুদ্ধি সম্পন্ন। তার ছেলে তেন্দেরার বুদ্ধিইবা কত হবে, আর এই তেন্দেরা তার মেয়ে কুকলিকমালার জামাই হবে কিভাবে?

ফুলরেণু একদিন রাত্রে তেন্দেরাকে বলল, তুমি দেখছি এখানে থেকে চলে যাবার নামও করছ না, এভাবে থাকলে লোকে বদনাম করবে।

তুমি আমার জন্য তিনটা জিনিস নিয়ে আস, যদি নিয়ে আসতে পার তবে এখানে থাকতে পারবে এবং আমার মেয়ে তোমাকে পছন্দ করলে তার সাথে বিয়ে দেব।

আর যদি তিন দিনের মধ্যে এ জিনিস গুলি আনতে না পার তবে এখান থেকে চলে যাবে বুঝলে? সেই তিনটি জিনিস হল – (১) বোঁটাহীন ফল, (২) যে ফলের বিচি বাইরে এবং (৩) যে জিনিস এক বাটি খেলেও সেই বাটি পূর্ণ থাকে সেই জিনিসে।

এই তিন দ্রব্যের নাম শুনে তেন্দেরা বোকা বনে গেল। আসলে সে ঐগুলি চিনে না। সে হতাশ হয়ে গেল।

তেন্দেরা ম্লান মুখে কুকলিকমালাকে বলল যে, সে এখান থেকে চলে যাচ্ছে। কুকলিকমালা তেন্দেরাকে পছন্দ করে ফেলেছে তাই তেন্দেরাকে এই তিনটি দ্রব্য কী কী এবং কোথায় পাওয়া যায় তার সন্ধান দিল।

সে বলল, তুমি চিন্তা কর কেন? এগুলো নিয়ে আস যাও। সে বলল, আমাদের ঘরের পাশে যে ছড়া তার নাম শামুকছড়ি।

এই ছড়ার উজানে যেতে যেতে ডানে একটা ছড়া দেখবে তার নাম তামছড়ি। সেই ছড়ার দু’ধারে অনেক ফল গাছ। ওগুলো তাম গাছ। দেখবে তাম (কাগু বাদাম) ধরে আছে গাছে। ফলগুলোর বাইরে বিচি।

এখান থেকে তাম পেড়ে নিয়ে আসার সময় দেখবে ছড়াতে অনেক শামুক। সেই শামুক কুড়িয়ে নিয়ে আসবে। যাও দেরি করোনা।

তেন্দেরা তার কথামত গিয়ে দেখে সত্যই গাছে তাম ফল ঝুলতেছে। সে পাকা তাম ফল এক থলে নিয়ে আসার সময় এক থলে শামুকও কুড়িয়ে নিল ছড়া থেকে।

তখন দুপুর হয়ে গেছে। ঠিক তখন কুকলিকমালার মুরগিটা কক কক কতাক কক কক কতাক করে ঘরের বেড়ায় টাঙ্গানো খোপ থেকে নেমে গেল।

তেন্দেরা সেখানে পৌঁছলে কুকলিকমালা তাকে ঐ খোপ থেকে মুরগির পাড়া ডিম নিয়ে আসতে বললে তেন্দেরা ঠিক ডিমটা নিয়ে এল।

এবার কুকলিকমালা তেন্দেরাকে ঐ তিনটা জিনিস সহ তার মার কাছে নিয়ে গেল। ইশারায় ঐসব জিনিস তার মাকে দিতে বলল কুকলিকমালা।

ফুলরেণু তিনটা জিনিস পেয়ে খুশি হল। তখন কুকলিকমালা তেন্দেরাকে বলল ডিম হচ্ছে বোঁটাহীন ফল, তার কোন বোটা নেই। তামের বিচি ফলের বাইরে। ফলের নিচে ঝুলে থাকে।

আর শামুক একবাটি খেলেও (তার সাঁশ খাওয়া যায়) খোলসগুলো পড়ে থাকে কাজেই একবাটি খেলেও এক বাটিই অবশিষ্ট থাকে।

তেন্দেরা কুকলিকমালার কথা মত বুঝিয়ে বলল। ফুলরেণু খুশি হল। কিন্তু তা স্বত্বেও তার মেয়ে কুকলিকমালাকে চিজিগুলার ছেলে তেন্দেরার জন্য বৌ দিতে রাজি নয় ফুলরেণু।

কুকলিকমালা জানে তার মা ফুলরেণু তার বাবা বাগল্যার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কাজেই তার মা যদি পালিয়ে গিয়ে তার প্রেমিককে বিয়ে করতে পারে, সে কেন তেন্দেরার সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না, ভাবে কুকলিকমালা।

এক রাত্রে সত্যি সত্যি তেন্দেরার হাত ধরে পালিয়ে গেল কুকলিকমালা। তেন্দেরা কুকলিকমালাকে নিয়ে সোজা ঘরে ফিরে এল। গুলাগুলি ছেলে আর ছেলের বৌ দেখে মহা খুশি হল।

কিছুদিন পর গুলা তেন্দেরাকে নিয়ে পাড়ালিয়াদের সঙ্গে কাট্টনে গেল। নৌকার কাট্টন। তারা এক মাসের খোরাকি নিয়ে দেড় দিনের হাঁটা পথের গভীর বনে চলে গেল।

ঘরে রইল গুলি আর তেন্দেরার নববধূ কুকলিকমালা। একমাসের প্রায় শেষ, কিন্তু নৌকার কাজ এখনো অনেক বাকি এদিকে খোরাকিও প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

তাই তেন্দেরা বাড়ি ফিরল খোরাকি নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ি ফিরে দেখল তার মা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কুকলিকমালা কী করবে দিশেহারা হয়ে আছে।

তেন্দেরা বৈদ্য এনে তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাল। কিন্তু কয়েকদিন পর তার মা গুলি মারা গেল। তেন্দেরা তার বাবা গুলাকে খবর দিতে পারল না – তার মা শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করল।

এদিকে খোরাকি নিয়ে না গেলে তার বাবা উপোসে মরবে, আর খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবার কাছে গেলেও ঘরে কুকলিকমালা একা থাকতে পারবে না।

তাই একদিন সে ফুলরেণুকে তেন্দেরার নিজেদের ঘরে আনতে গেল। তেন্দেরা অবশ্য ভেবে নিয়েছে- ফুলরেণু তাদের ঘরে কোনদিন যাবে না।

তাই ফুলরেণুর কাছে  পৌঁছামাত্র হাউ মাউ করে কেঁদে বলল, আমরা বাপবেটা নৌকার কাট্টনে গিয়েছিলাম- সেখানে নৌকার কাজ অর্ধেক করে বাবা গুলা মারা গেছে আর সেদিন মা গুলিও মারা গেল।

এখন নৌকাটার কাজ সম্পন্ন করে নিয়ে আসতে হবে। বিক্রি করলে টাকা পাবে। তাই আমি কাট্টনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘরে কুকলিকমালা একা থাকবে কিভাবে?

আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। তেন্দেরার কথা ফুলরেণু ভেবে দেখল।অমনি সে একা থাকা পছন্দ করেনা – এখন তার মেয়ের সঙ্গে তাদের ওখানে থাকলে খারাপ কিছু নয়, তাই তেন্দেরার কথায় সে সহজেই রাজি হয়ে গেল।

ঘরের জিনিসপত্র যতটুকু পারে তেন্দেরা নিয়ে নিল। ফুলরেণুও তার কাপড় চোপড় ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যা পারল সঙ্গে নিয়ে তেন্দেরার ঘরে এসে পৌঁছল।

দুদিন পর তেন্দেরা কিছু দিনের খোরাকি নিয়ে কাট্টনে তার বাবা গুলার কাছে চলে গেল। সে তার মা গুলির মৃত্যুর কথা তার বাবা গুলার কাছে গোপন রাখল।

সে বরঞ্চ বলল যে, তার মা গুলি ভয়ানক অভিমান করে আছে। এত দীর্ঘ সময় যে কোনদিন প্রবাসে কাটায়নি। এবার দীর্ঘদিন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রবাসে চলে এসেছে গুলা।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর প্রতি দিওয়ানা হয়ে আছে।ছেলের কথা শুনে মনে মনে খুব আফসোস করল। মনে মনে ভাবল এতদিন প্রবাসে থাকা কী ঠিক হল ?

তেন্দেরা আবার বলল, তুমি ঘরে গেলে মা কামরাতেই পড়ে থাকবে দেখো। গুলা মনে মনে ঠিক করল তাতে কী আছে যায়, ঘরে গিয়ে সোজা কামরার ভিতরে গুলিকে জড়িয়ে ধরলে সব অভিমান ভেঙ্গে যাবে গুলির। তাই সে জড়িয়ে ধরবে। মনে মনে ঠিক করল গুলা।

কয়েকদিন পরিশ্রম করে বাপ-বেটা অসস্পূর্ণ নৌকাটি সম্পূর্ণ করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। দেড় দিন নদীর পথে নৌকাটি ভাসিয়ে এনে একদিন সন্ধ্যায় বাজার ঘাটে ভিড়াল তারা।

তেন্দেরা তার পিতাকে বলল, তুমি নৌকাটি বাজারে বিক্রি কর আর আমি আমাদের কুড়াল, দা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি ঘরে নিয়ে যাই।

মাকে তুমি এসেছ বলে সংবাদ দিব-তাকে তোমার কথা বুঝিয়ে বলব। এই কথা বলে সে ঘরে এল আর গুলা নৌকাটি বিক্রির জন্য বাজারে থেকে গেল।

ঘরে এসে তেন্দেরা ফুলরেণুকে বলল, আমরা নৌকাটা নিয়ে এসেছি, আমি একা পারিনা বলে আমার এক মামাও সঙ্গে এসেছে।

তাকে নৌকা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠিয়েছি। সে নৌকা বিক্রি করে রূপার টাকা নিয়ে ঘরে আসবে। সে হয়ত ফিরতে রাত হবে।

তোমার খওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে পার ,আমি আমার মামার জন্য জেগে থাকব।গ্রামে সন্ধ্যা হতে না হতেই লোকজন খাওয়া–দাওয়া করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তেন্দেরার কথামতে তারা সাঁঝের আঁধার হতে না হতে খাওয়া দাওয়া শেষ করল। তেন্দেরা যতদিন কাট্টনে ছিল, ততদিন ফুলরেণু আর তার মেয়ে কুকলিকমালা ঘরের বারান্দাতে ঘুমাত।

আজ তেন্দেরা ঘরে আসাতে কুকলিকমালা আর তেন্দেরা ঘরের পিছনের কক্ষ অজলেঙে ঘুমাবে। তেন্দেরা গুলরেণুকে বলল, আমার মামা এলে খাওয়া দাওয়া, করে এখানে থাকবে। সে বারান্দাতে ঘুমাবে, কাজেই তুমি ভিতরের কামরাতে ঘুমাও।

ফুলরেণু ঘরের ভিতরে বিছানা করে শুয়ে পড়ল। কুকলিকমালা তাদের জন্য অজলেঙে বিছানা প্রস্তুত করে তেন্দেরার কথিত মামার জন্য বারান্দাতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

গুলা বাজারে নৌকাটি বিক্রি করে রাত হলে রূপার টাকা নিয়ে খুশি মনে ফিরে এল। গুলার মনে আছে, তেন্দেরা বলেছে গুলি তার প্রতি অভিমান করে আছে।

গুলা ঘরে ফিরে তেন্দেরা আর কুকলিকমালাকে দেখল কিন্তু গুলিকে দেখলনা। গুলি নিশ্চয়ই অভিমান করে ভিতরে শুয়ে আছে মনে করে গুলা সোজা ভিতরে চলে গেল।

তখন সেখানে অন্ধকার। গুলা হাতড়িয়ে ধরতে পেল কে একজন শুয়ে আছে। সে জড়িয়ে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ঘুম থেকে জেগে হতভম্ব হয়ে হাত–পা ছঁড়তে লাগল।

গুলা ততোধিক জোরে চেপে ধরল ফুলরেণুকে। ফুলরেণু ভূত ভূত বলে চিৎকার করলে গুলা বলতে লাগল–না–না আমি ভূত নই।  ফুলরেণু ভয়ে গুলাকে জোরে জড়িয়ে ধরল।

তাদের এই হৈ চৈ কালে তেন্দেরা আর কুকলিকমালা বাতি নিয়ে সেখানে হাজির হল। বাতির আলোতে ফুলরেণু দেখল গুলাকে আর গুলা দেখল ফুলরেণুকে উভয়েই হতভম্ব। লজ্জায় তাদের মুখ লাল হয়ে গেল।

তাদের এ অবস্থা দেখে তেন্দেরা বলল, তোমরা এভাবে জড়াজড়ি করেছ একথা লোকে জানতে পারবে। কলঙ্কের একশেষ হবে। তার চেয়ে উভয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া ভাল।

গুলা আর ফুলরেণু কিছুই বলতে পারল না। তাদের স্মরণ হল – কৈশরেই তো তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তখন হয় নি এখন শেষ বয়সে হলে ক্ষতি কী?


[পচ্ছন – রূপকথা। চিজি – (তুলনীয়) খোকা, গুলা- ফল/fruit.]

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তঞ্চঙ্গ্যা- রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী


তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি: পাহাড় কোলে নক্ষত্ররাজি

লিখেছেনঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম জেলার রাগুনিয়া উপজেলা, কক্সবাজার, টেকনাফ এবং উখিয়া অঞ্চলে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি নাম দাইনাক, অনেকে দৈনাক নামেও ডেকে থাকেন। যার অর্থ যোদ্ধা। ইতিহাসের তথ্য মতে- তাঁরা শৌর্য, বীর্যে এবং বীরত্বে জগৎ খ্যাত ছিলেন। আরাকানে স্বাধীন দান্যাওয়াদি রাজ্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘকাল ঐ অঞ্চল স্বাধীনভাবে শাসন করেন এবং বসবাস করে এসেছেন। সময়ের পরিক্রমায় পরবর্তীতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে এই অঞ্চলে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার তৈনছড়ি নদীর তীরে এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই তৈনছড়ি থেকে তাঁরা অন্য অঞ্চলে বা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই তৈনছড়ি নদীটি তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে এখনো ঐতিহাসিক এবং আবেদনের একটি জায়গা হিসেবে রয়ে গেছে, সাথে ভালোবাসার একটি নামও। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান পঞ্চম এবং শিক্ষার হার দ্বিতীয়। বাংলাদেশে তাদের আনুমানিক জনসংখ্যা প্রায় ১.০০ (এক) লাখের কাছাকাছি এবং শিক্ষার হার ৮০% এর উপরে। পরিসংখ্যান তথ্যমতে  ৪৭% তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা, মিজোরাম সিএডিসি ও এর বাইরে ৩.৩% শতাংশ লোক বসবাস করে, অবশিষ্ট ৫০% শতাংশ তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করে মায়ানমার এবং অন্যান্য দেশে।

(তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশের আদিবাসী, এথনোগ্রাফিয় গবেষণা, প্রথম খন্ড, ডিসেম্বর- ২০১০ খ্রি)

গছা বা গোত্র

তঞ্চঙ্গ্যারা মোট ১২ টি গছা বা দলে বিভক্ত। গছাগুলো হলো- কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা, লাপুইসা গছা, অঙ্যা গছা, মুলিমা গছা, রাঙী গছা, ওয়া গছা, তাশী গছা। কারবআ গছা, মো গছা, ধন্যা গছা, মংলা গছা, মেলংগছা, লাঙগছা এই সাতটি গছা বাংলাদেশে বসবাস করে বর্তমানে। বাকিগুলো মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে বসবাস করছে বলে জানা যায়। আবার প্রতিটি গছায় রয়েছে উপগছা বা উপশাখা। যেমন: কারবআ গছার কয়েকটি উপগছা হলো- বউ গোত্তি, বলা গোত্তি, বাঅ-ল গোত্তি, আরয়া গোত্তি, ফারাঙচা গোত্তি ইত্যাদি। এভাবে অন্য গছায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে উপগছা রয়েছে।

তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব, স্বতন্ত্র মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। তাদের মাতৃভাষা এবং বর্ণমালা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তঞ্চঙ্গ্যাদের মাতৃভাষার নাম “তঞ্চঙ্গ্যা” ভাষা। জনগোষ্ঠীর নামের সাথে মিল রেখে ভাষার নামটি নির্ধারণ করা হয়।

জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন ১৯০৩ সনে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত “লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে  তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে পৃথক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-এ্যারাবিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত বলে মত দেন। তিনি আরো মত দেন, তঞ্চঙ্গ্যারা ইন্দো-আর্য শাখার পৃথক একটি ভাষায় কথা বলেন যা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় আঞ্চলিক ভাষার (চট্টগ্রাম অঞ্চলের) সাথে একই অন্তর্ভুক্ত হলেও তিবেতো-বর্মন কিছু বৈশিষ্ট্য তারা ধারণ করেছে। অনেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা পালি, প্রাকৃত, সংস্কৃত বাংলা ভাষা বলে মত দেন। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষার মধ্যে প্রচুর আরাকান বা মারমা শব্দের উপস্থিতি, প্রচলন এবং প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ব্যবহ্ত বর্ণমালাগুলো বার্মিজ বর্ণমালার সাথে মিল রয়েছে এই মূল উৎপত্তি “মনখমের” দের থেকে। ব্রাহ্মী লিপি থেকে এই বর্ণমালার উৎপত্তি বলে অনেকে মত দেন। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার নাম দাইনাক বর্ণমালা এবং বর্তমানে ব্যবহ্ত বর্ণমালার নাম ছালাম্যা বর্ণ বা ছালামী পাঠ যার অর্থ গোলাকার। বর্ণমালার সংখ্যা সর্বমোট ৩৬টি। স্বরবর্ণ ০৫ আর ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আরো আছে নিজস্ব সংখ্যা বা গননা পদ্ধতি।  

তাদের বর্ণমালার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো কথ্য এবং লিখিত রূপ আ-কারান্ত। তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশেষত হচ্ছে এর উচ্চারণ এবং কথ্যরীতি ¯স্বর কোমল, নরম এবং কর্কশ নয় শ্রবণে মধুর। শব্দ, বাক্য প্রয়োগে প্রকৃতির একটা সরলতা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ গছা বা শাখাভেদে তাদের ভাষা অভিন্ন।

পোশাক ও অলংকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব পোশাক ও অলংকার রয়েছে। গছাভেদে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাকের স্বতন্ত্র বা পার্থক্য রয়েছে। তবে কারবআ গছা রমণীদের রাজকীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় সবাইকে আকর্ষণ করে। রঙে, ঢঙে এবং বৈচিত্র্যে অনন্য। এই পাঁচ কাপড়গুলো হলো- পিনৈন (নির্মাঙ্গ বস্ত্র), জুম্ময়া সালুম (লম্বা হাঁটা শার্ট), মাদা কাবঙ (পাগড়ি), পা-দুরি (কোমড় বন্ধনী) এবং জুম্ময়া খাদি (ওড়না বিশেষ)। প্রতিটি পোশাকে রয়েছে নিজস্ব এবং ¯স্বতন্ত্র নকশা, ফুল এবং ডিজাইন। এসকল নকশা এবং ফুলগুলো জুম এবং প্রকৃতি থেকে নেওয়া, পাওয়া। আর ছেলেদের পোশাক সাদা ধূতি এবং লম্বাহাটা সাদা শার্ট। অলংকার হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যারা প্রাচীনকাল থেকে নিজস্ব স্টাইল এবং ডিজাইনে অলংকার পড়ে থাকে। এক সময় রৌপ্য অলংকার ব্যবহারে প্রচলন ছিল বেশ। এখন রৌপ্য পাশাপাশি স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতুর অলংকার ব্যবহার করে তাঁরা। যেমন- কানে রাইজ্জু ও জংগা, কব্জিতে বাঘোর, কুসই খারু, কিয়াইংশিক, বাহুতে তাজ্জুর, গলায় চন্দ্রহার, আলচুরি, জামছড়া, পিসিছড়া ইত্যাদি। তবে আধুনিককালে গলায় স্বর্ণ, রুপোর চেইন, আংটি, নুপুর, নেকলেস পড়ে থাকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা। পুরুষরাও চেইন, আংটি পড়ে থাকে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ জুনু তঞ্চঙ্গ্যা (হিল এক্সপ্রেস)

ঘর-বাড়ি ধরণ এবং বসতঘর

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এই পাহাড় এক সময় প্রচুর বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। চারিদিকে গহীন বন। তখন এই বনে প্রচুর পরিমাণে হিংস্র বন্য পশু-পাখি বসবাস করতো। আদিবাসীরা যেহেতু পাহাড়ে এবং বনের মধ্যে বসবাস করে তাই বন্য হিংস্র পশু-পাখির সাথে এক প্রকার সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হতো। মূলতঃ বন্য পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরা ঘরগুলো মাচাং আকারে মাটি থেকে একটু উচুতে তৈরি করতো। মূল ঘরের সাথে একটি ইচরও থাকতো। ইচর মূলতঃ খোলা হাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেওয়া, বসে আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা। একটি মূলঘরের সাথে কয়েকটি অংশ থাকে। অংশগুলো হলো- সিঙকাবা, পিনা, গুদি, বারান্দা এবং রান্না ঘর। এগুলো ছাড়াও আরো কিছু ঘর থাকে তঞ্চঙ্গ্যাদের। ঘরগুলো হলো-জুমঘর (জুম চাষের সময় তৈরি করা হয়। একে প্রভাস্যা ঘরও বলা হয়), ডেইরি ঘর (যেখানে ঘরের নানা জিনিসপত্র যেমনঃ চাষের নানা যন্ত্রপাতি, উপকরণ রাখা হয়), গোয়াল ঘর, ছাগল ঘর, হাসঁ-মুরগী ঘর, দারবআ ঘর (জ্বালানি কাঠ রাখার ঘর)। তবে বর্তমানে তাদের মূল ঘর তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন তাঁরা আর মাচাঙ ঘর তৈরি করে না। কারণ আগের মতো পাহাড়ে আর গভীর বন নেই, সাথে নেই হিংস্র পশুপাখিও। বাঁশ এবং শনের পরিবর্তে এখন ইট, কংক্রিট, টিন, রড, সিমেন্টের ঘর তৈরি করে তাঁরা। বর্তমান বসতগুলো মজবুত এবং দীর্ঘাস্থায়ী হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘরগুলো তার ঐতিহ্য এবং নিজস্বটা হারিয়ে  ফেলেছে।

ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান

তঞ্চঙ্গ্যারা মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তাদের প্রতিটি পাড়া বা গ্রামে একটি করে  বৌদ্ধ বিহার আছে। ওখানে ভিক্ষু সংঘ আছে। তাদেরকে সকলে মিলে ভরণপোষণ করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। এছাড়া আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা বা ফানুস উত্তোলন পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমার পর একমাস ব্যাপি প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে দানোত্তম দান শ্রেষ্ঠ শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িতেও তাঁরা সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনা করে।

রাজগুরু শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাথেরো (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা), ষষ্ঠ সংগীতিকারক রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির (ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা), ত্রিপিটক বিশারদ ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, আর্যানন্দ মহাস্থবির, শ্রীমৎ অজিতা মহাথেরো (ধ্যান ভান্তে), ধর্মানন্দ মহাস্থবির, সুমেধানন্দ মহাস্থবির প্রমূখ বৌদ্ধ ধর্মের সাধক পুরুষ। তাঁরা হলেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সূর্য সন্তান এবং ধর্মীয় পন্ডিত। 

সামাজিক উৎসব

বিষু (বাংলা নববর্ষ) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান এবং অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বা উৎসব। বিষু উৎসবকে তাঁরা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে। ফুল বিষু, মূল বিষু এবং বিষু।

ফুল বিষু মূলত চৈত্র মাসের শেষ দিনের আগের দিন। মূল বিষু হলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আর বিষু হলো পহেলা বৈশাখ। ফুল বিষু দিনে ফুল দিয়ে বুদ্ধকে পূজা দিয়ে প্রার্থনা করা হয় এবং নদীতে ফুল পূজা দেওয়া হয় (অনেকে ফুল ভাসানোও বলে থাকেন) এই দিনে ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

মূল বিষুতে প্রায় শতপদের সবজি দিয়ে পাইচন রান্না করা হয়। এই পাইচন বিষু’র অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ। বহুপদের সবজি দিয়ে এই পাইচন রান্না হয় বলে এর ঔষধিগুনও বেড়ে যায় বহুগুণ। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মুল বিষু’র দিনে পাইচন খেলে শরীরে যত রোগব্যাধি আছে সব চলে যায়। মূল বিষুর দিনে বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়োবৃদ্ধদের গোসল করানো হয়।

বিষু দিন সকলে নতুন কাপড় -চোপড় পড়ে, বুদ্ধ এবং ভিক্ষুদের জন্য আহার্য নিয়ে বিহারে যায়। প্রার্থনা করে নিজের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, সমাজ, জাতি, দেশ এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর মঙ্গল এবং সুখ-শান্তির, সমৃদ্ধির জন্য। বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুয়ে আর্শীবাদ নেয়। বিষু দিনে সকলে সকলের বাড়িতে বেড়াতে ঘুরতে যায়। সকলে যে যার সাধ্যমতো খাবার এবং নাস্তা-পানির আয়োজন করে থাকে। সে সময় তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা- সাইন্ন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, মালি পিঠা, আলসী পিঠা, তেলের পিঠা, কলা পিঠা, কাঁকন চালের পায়েস  আয়োজন করে থাকে। সাথে মিষ্টি এবং ফলমূলও থাকে। বিষু’র মূল আনুষ্ঠানিকতা তিন দিন হলেও পুরো সপ্তাহ দশদিন এর আমেজ থাকে গ্রামে এবং পাড়ায়।

এই অনুষ্ঠান ছাড়াও নতুন ভাত খাওয়া, আর্শীবাদ অনুষ্ঠান, আহলপালানী উৎসবও হয়ে থাকে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য চর্চা

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চার দীর্ঘ একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। সাধক, ব্যাধি এবং আদি কবি শিবচরণ তাদের অনুপ্রেরণা। শিবচরণের রচিত “গোসাইন লামা” তাদের সাহিত্য চর্চার অন্যতম ভিত্তি। পরবর্তীতে রাজকবি শ্রী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা যিনি তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যকে নতুন একটি মাত্রায় নিয়ে যান। তাঁর রচিত “ধর্ম্মধ্বজ জাতক” (১৯৩১) পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গ্রন্থ। এছাড়া ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার দিক থেকেও প্রথম।  ‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’ (১৯৩৩) তাঁর অন্যতম প্রকাশিত গ্রন্থ। তিনি “চান্দোবী বারমাস, রুত্তি বারমাস,আলস্যা মেলার কবিতা এবং বিয়াল্লিশর ভাতরাদ” বারমাস রচনা করেন। তিনিই প্রথম হস্তচালিত প্রেস স্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা রাজ সভার সভাকবি বা রাজকবি ছিলেন তিনি।

লোকসাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যাদের লোকসাহিত্যর সম্ভার বেশ সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব রূপকথার গল্প আছে, আছে প্রবাদ-প্রবচন। ঘুমপাড়ানি ছড়াও আছে। সাথে আছে কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক অনেক পালাও। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, জুমকাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা ইত্যাদি।

পূজা-অর্চনা

তঞ্চঙ্গ্যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রকৃতির সন্তান হিসেবে তাঁরা প্রকৃতিকে সেবা-যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা সরূপ নানা পূজা অর্চনা করে থাকে। তাঁরা মনে করে প্রকৃতির ভালোবাসা, আর্শীবাদ এবং আনুগত্য ছাড়া কারো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাস এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটি করলে প্রকৃতি মাথা খুশি, সন্তুষ্ট হয় এবং আর্শীবাদ করে। এজন্য গাঙ পূজা, ভূত পূজা, চুমুলাঙ পূজা, মিত্তিনি পূজা,লক্ষ্মী পূজা, কে- পূজা এবং বুল পারা পূজাসহ বেশ কিছু পূজা-অর্চনা তঞ্চঙ্গ্যারা পালন করে থাকে।

জুমচাষ, জীবন এবং জীবিকা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম পেশা হচ্ছে জুমচাষ। জুমচাষ মূলতঃ মাল্টি এগ্রিকালচার। একই জায়গায় বহু ফসলের চাষ করা হয় এবং একটির পর একটি ফসল উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই চাষের একটি বছরের সমাপ্তি হয়। জুমচাষ মূলতঃ বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন কার্তিক মাস পর্যন্ত সময়। তবে এর দুই তিন মাস আগে থেকে জুম প্রস্তুতি অংশ হিসেবে জুমের জায়গা নির্বাচন, জুম কাটা, কাটা জঙ্গল আগুন দেওয়া এবং পরিস্কার করতে হয়। এই জুম চাষে পুরুষ মহিলা সকলে একসাথে অংশগ্রহণ করে থাকে।

এক সময় এই জুমচাষই তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র উপার্জন এবং জীবন- জীবিকার অবলম্বন ছিল। তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন বস্তুগত উপাদানের সাথে এই জুম প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা লেখাপড়া শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যও করছে অনেকে। আবার অনেকে ফলজ বাগান করে আয়-রোজগার করছে। আধুনিক কৃষির সাথেও অনেকে যুক্ত। এছাড়া অনেকে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি, শুকর পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

জুমচাষ করতে হলে জুম কাটার স্থানে একটি জুমঘর তৈরি করতে হয়। জুমঘর মূলতঃ বিশ্রাম নেওয়ার একটা জায়গা আর কাজের অতিরিক্ত চাপের কারণে রাতে থাকা, জুমের নতুন ফসল মজুদ করণের উদ্দেশ্য এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। আর একজন জুম চাষীর তাঁর গ্রামের ঘর থেকে জুমের দুরত্ব যদি বেশি হয় সময় কমিয়ে আনা, কাজের সুবিধার্থেও এই জুমঘরটি তৈরি করা হয়। এই জুমঘর শুধু শস্য উঠা পর্যন্ত— মানে একবছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এজন্য তঞ্চঙ্গ্যারা জুমঘরকে ‘প্রবাস্যা ঘর’ও বলে থাকে।

বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা উচ্চ শিক্ষিত

কৃষকের পাশাপাশি, শিক্ষক, ব্যাংকার, আইনজীবী, এমবিবিএস ডাক্তার, ডেন্টাল, হোমিও ডাক্তার, প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী জজ, সশস্ত্র বাহিনীর কমিশন এবং নন-কমিশন অফিসার, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিজিবি সদস্য, যুগ্ম সচিব (অবঃ), ইউএনও, উপ-সচিব, দূতাবাসের ১ম কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (অবঃ), সাংবাদিকতাসহ নানা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন।

এছাড়া রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তির, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে থেকে এযাবত মহান জাতীয় সংসদে দুজন প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমজন ছিলেন মালতি প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা (এরশাদ সময়কার), আর অন্যজন হলেন জ্বরতী তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) সংরক্ষিত মহিলা ৩৪৮ আসনের সংসদ হিসেবে শপথ নেন। উভয়ের বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলা থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়েরা দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। অনেকে স্কলারশিপ নিয়েও বাইরে লেখাপড়া করছে। দেশের বাইরেও অনেকে চাকরি ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

সম্পত্তি উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের পারিবারিক কাঠামো পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তির উত্তরাধিকার একমাত্র ছেলেরা পেয়ে থাকে। তবে ছেলে সন্তান না থাকলে মেয়েরা এর অধিকার পায়। স্বামী মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রী যদি পূনরায় বিয়ে না করে তাহলে স্বামী সকল সম্পত্তি সে পাবে।

সামাজিক প্রথা

তঞ্চঙ্গ্যারা সমাজবদ্ধভাবে এবং গ্রামে বসবাস করে। তাদের গ্রামের প্রধান হলেন কার্বারী। তিনি গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচার এবং যেকোন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তিনি মৌজা প্রধান হেডম্যান এর অধীন এবং হেডম্যান সার্কেল চীপ বা রাজার অধিনে কাজ করেন। গ্রামে বা সমাজে যেকোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন।

ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা

ঘিলা খেলা, নাদেঙ খেলা, ধুধু খেলা, কুমির কুমির খেলা, গোল মরিচ খেলা, গাত্তয়া খেলা, গাইত খেলা, তেদোই বিচি খেলা, গোয়াং খেলা, পুত্তি খেলা, আংগী খেলা, তিং খেলা,লুআলুই খেলা, গুদু খেলা,বুলি খেলা,কক্কেমা বা খাবামা খেলা, শামুক খেলা এবং তুম্বুর খেলা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসকল খেলা বিশেষ করে ঘিলা এবং নাদেঙ খেলা অন্য সময় খেলা হলেও বিষু দিনে এর আকর্ষণ এবং আবেদন বহুগুণ বেড়ে যায়। তখন যুবক-যুবতীরা এক গ্রামের সাথে আরেক গ্রামের এই খেলায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। তাঁরা অনেক আনন্দ মজা করে। বিবাহিত  পুরুষ এবং মহিলারাও এই খেলায় অংশগ্রহণ করে।

সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, নাট্য সাহিত্য

তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে সংগীত প্রিয়। এই ধারাবাহিকতায় তাদের অনেক ঐতিহাসিক পালা পর্ব রয়েছে। যেমন- রাধামন ধনপুদি পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসকল পালাগুলো যারা সুর, তাল এবং সুকণ্ঠ দিয়ে পরিবেশন করতেন তারা হলেন চারণ কবি গিঙ্গিলি।

জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা নামে একজন গিঙ্গিলি আছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। তাঁর সময়কাল এবং আজ পর্যন্ত তাঁর সমমান কোন গিঙ্গিলি কোন আদিবাসী সমাজে বা জাতিতে জন্ম হয়নি। তিনি অন্ধ ছিলেন, এজন্য তিনি কানা গিঙ্গিলি নামেও সবার কাছে পরিচিত। তাঁর আরো একটা পরিচয় ছিল তিনি রাজগিঙ্গিলি ছিলেন। পরবর্তীতে ভাগ্যধন গিঙ্গিলি, দুলামন গিঙ্গিলি অনেক সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, আদি চরণ তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে নামডাক পরিচিতি আছে তঞ্চঙ্গ্যা এবং আদিবাসী সমাজে। তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে দেশাত্মবোধক, রোমান্টিকসহ নানা ধাঁচের গান উপহার দিয়েছেন। তঞ্চঙ্গ্যা সংগীত অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের ছোঁয়ায়।

গুনী শিল্পী হিসেবে দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনীলা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, সুচন্দা প্রভা তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যানি তঞ্চঙ্গ্যা, রিনি তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। পরবর্তীতে চম্পা তঞ্চঙ্গ্যা, জ্যাকলিন তঞ্চঙ্গ্যা, সূর্যসেন তঞ্চঙ্গ্যা, অমিত তঞ্চঙ্গ্যা, সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রক শিল্পী হিসেবে বুলু তঞ্চঙ্গ্যা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে।

জাতীয় পর্যায়ে অনেক নৃত্য শিল্পী রয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যা জাতিতে। বাঁশি,ধুরূক, খিংকরং, শিঙা তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। নাট্য সাহিত্যে তঞ্চঙ্গ্যারা বহুদূর এগিয়েছে। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তাঁরা তঞ্চঙ্গ্যা নাটকের পুরোধা। রন্ত কুমার তঞ্চঙ্গ্যার হাত ধরে আধুনিক তঞ্চঙ্গ্যা নাটক আরো ব্যাপকতা লাভ করেছে। তাঁর হাত ধরেই- “বর পরঙ, মন উকুলে, রত্নমালা” নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে। “চানপুদি” নামে তাঁর একটি শিশু চলচ্চিত্রও ঢাকা শিশু চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করে দর্শক এবং সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বিবাহ পদ্ধতি

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বিয়ে সাধারণত দুইভাবে হয়। অনুষ্ঠান করে বিয়ে এবং পলায়ন করে বিয়ে। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করাকে ‘সাঙা’ বিয়ে বলে আর পালিয়ে করাকে ‘ধাবারা’ বিয়ে বলে।

সাঙা অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবশীকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হয়। আর ধাবারা বিয়েটে এসব কোন কিছুই হয় না। এই ধাবারা বিয়েটে অনেক সময় ঘরের সকল সদস্যদের (মা, বোন জানলেও) জানার সুযোগ থাকে না। তবে কনে এবং বর বিষয়টি অবগত থাকে, সাথে তাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।

ধাবারা বিয়ের জরিমানা হিসেবে বর পক্ষ কনে পক্ষকে শুকর বা সামান্য কিছু টাকা দিতে হয় যুব সমাজ এবং সামাজিক দাবী হিসেবে। বিয়ে নিয়ে কিছু ধরাবাঁধা এবং সামাজিক নিয়ম রয়েছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে। যেমন: নিজের আপন ভাই-বোনের মধ্যে, মাসি-পিসি, চাচা-চাচিকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অবৈধ একটি কাজ। আপন চাচাত ভাইবোনের মধ্যেও বিয়ে অবৈধ। মামা, পিসি, মাসিত ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ করা সামাজিকভাবে স্বীকৃতি আছে।

এই একই সম্পর্কে বিধবা মেয়ে বা বিপত্নীকেও বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে বর কনে উভয়ে উভয়কে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী কিছু অলংকার দিতে হয়। তবে কি পরিমাণ দিতে হবে তার কোন নিয়ম নেই, দাবীও নেই। আর এর বাইরে বর কনে উভয়ে উভয় পক্ষ থেকে কোন কিছু দাবী করার পারিবারিক, সামাজিকভাবে দাবি করার কোন সুযোগ এবং নিয়ম নেই। দাবি করা ন্যায় এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক একটি বিষয় যা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গন্য হয়।

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ এবং জাতিতে ভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে বিবাহ করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাঁরা বিশ্বাস করে এতে জাতি, সমাজ এবং পরিবারের শৃক্সখলা নষ্ট হয়। জাতির অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি সংকটের মধ্যে পড়ার একটি সম্ভাবনা বা আশঙ্কা তৈরি হয়।

অবস্থান ও বসতি

তঞ্চঙ্গ্যারা রাঙ্গামাটি জেলার রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, জুরাছড়ি, কাউখালী উপজেলায় বসবাস করে। বান্দরবান জেলার মধ্যে বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, নাক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম উপজেলায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে রাঙ্গুনিয়া আর কক্সবাজার জেলার মধ্যে টেকনাফ, উকিয়া উপজেলায় তাদের বসবাস রয়েছে।

ভারতে মিজোরাম, ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা, আগরতলা আর মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বসবাস রয়েছে। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তঞ্চঙ্গ্যারা স্থায়ী বা চাকরিসূত্রে বসবাস করছে।

নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি

এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র বা পদ্ধতির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে পরিচয় ঘটে। বৈদ্য, কবিরাজ এবং কালেভদ্রে ভান্তেরা একজন চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন। বনজ গাছ-গাছড়া, বাকল, শেকড়, লতাপাতা, ফলমূল দিয়ে বানানো বনৌষধি নানা রোগ নিরাময়ে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। বৈদ্য, কবিরাজগণ ঔষধের সমস্ত তালিক বা তালিকা নিজস্ব খাতায় বা নোটে লিপিবদ্ধ করে রাখেন। বৈদ্যরা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বান-টনা, আঙ ডালি, পূজা কর্ম দিয়েও নানা রকম চিকিৎসা করতো। তাছাড়া তখনকার সময়ে চিকিৎসায় একমাত্র সম্বল ছিল এই বৈদ্য এবং কবিরাজরা। বর্তমান সময়ে এসেও আদিবাসী সমাজে বৈদ্য, কবিরাজের চিকিৎসা পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়।

নারীর অবস্থান

আদিবাসী জনগোষ্ঠী মতো তঞ্চঙ্গ্যা নারীরাও অনেকটা স্বাধীন জীবন-যাপন করে থাকেন।

তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে মিলেমিশে জুম, ক্ষেতে খামারে কাজ করে থাকেন। তবে গৃহস্থালি কাজগুলো মেয়েরা বেশির ভাগ সময় করে থাকে, পুরুষরাও সহযোগিতা করে। অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমমর্যাদা ভোগ করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের পরেই তাদের অবস্থান।

নারীরা পিতা-মাতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর সকল প্রকার ভরণপোষণ স্বামীর নিকট থেকে সে পেয়ে থাকে। যদি স্বামী দিতে অপারগ করে বা অস্বীকৃতি জানাই তাহলে সে চাইলে গ্রাম প্রধান বা কার্বারী নিকট আইনগত আশ্রয় চাইতে পারে। স্ত্রীর অমতে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করলে প্রথম স্ত্রী সতীনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মতি জানালে সেক্ষেত্রে স্বামী ভিটায় বা বাবার বাড়িতে অবস্থান কালীন সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব সে স্বামী থেকে পাবে। যদি সেও দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ না করে সেটি আর পাবে না।

বর্তমানে এসে সময় এবং যুগ পাল্টে গেছে অনেক। পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে এবং তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তাঁরাও এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের যোগ্যতায়। তাঁরা নিজের পছন্দ অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। তাঁরাও পরিবারকে সুন্দরভাবে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে এবং রাখছে। এটি সৃষ্টি মানবজাতির জন্য সুন্দর একটি দিক।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি এবং সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। দেশকে স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক্ষ পরোক্ষভাবে তঞ্চঙ্গ্যারাও অংশগ্রহণ করে। দেশের জন্য নিজের জীবন এবং পরিবারকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাঁরা। সমতল থেকে রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নির্যাতনে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে আসা শত শত বাঙালি পরিবারকে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় এবং খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। অসুস্থ রোগীকে নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলে। নাম না জানা অনেক তঞ্চঙ্গ্যা এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও অনীল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা একজন সরকারি গেজেটেড এবং ভাতা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি কাপ্তাই কাপ্তাইয়ের উপজেলার ১০০ নং ওয়াগ্গা মৌজার আগুনিয়াছড়া গ্রামে। তিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য  যুদ্ধ করেছেন।

শ্রীমতি গনমালা তঞ্চঙ্গ্যা, স্বামী- ভাগ্যধন তঞ্চঙ্গ্যা, বাড়ি রাজস্থলী উপজেলাধীন গাইন্দ্যা ইউনিয়নের তাইতং পাড়া যৌথ খামার গ্রামে। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা। দেশের জন্য তাঁরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।

স্বভাব এবং সামাজিক মূল্যবোধ

তঞ্চঙ্গ্যারা স্বভাবে শান্ত, নম্র এবং ভদ্র। তাঁরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ, পালন ও আচরণ করে। অপরের সাথে রাগ, বদমেজাজ স্বরে কথা বলে না। কথা বলার মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে চলে। স্বভাবে একঘেয়েমিতা নেই। কথায় কথায় মুখে অসুন্দর শব্দ, বাক্য প্রয়োগ করে না এবং করা থেকে বিরত থাকে। চেহেরার মধ্যেও একটা প্রকৃতিকতার আবেদন আছে।

সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রাপ্তির সহজলভ্যতার কারণে অন্যান্য চিকিৎসার মতো নবজাতক জন্মদান এখন নিরাপদ এবং সহজ হয়ে উঠেছে।

একসময় তঞ্চঙ্গ্যা তথা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সন্তান জন্মদান ভগবানের কৃপা এবং প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল সকলে। তখন গ্রামে “অসা বুড়ি”(ধাত্রী) নামে একজন বয়স্ক মহিলা সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়ার সাথে থাকতেন। তখন সাবান, ব্লেড বা ছুরি কাঁচি পরিবর্তে বাঁশের ধারালো কঞ্চি দিয়ে কাটাছেঁড়া কাজটি সম্পূর্ণ করা হতো এবং ভুত্তোয়া লতা নামক একধরনের লতার কান্ড দিয়ে সাবান বা পরিস্কারের কাজটি ছাড়তে হতো। নিমপাতা সিদ্ধ করে সন্তান প্রস্রবের স্থানটি পরিস্কার করা হতো।

সন্তান জন্মদানের সাত দিনের মাথায় একটি অনুষ্ঠান করা হয়, যা ‘কসুই পানি লনা’ নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠান না হওয়া আগ পর্যন্ত নতুন মাকে ঘরের সকল কাজ করা থেকে বিরত রাখা হয়। মূলতঃ এসময় নতুন মা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল থাকেন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘরের কাজ পুনরায় করার অনুমতি পান। এই সময় অসাবুড়িকে  কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ স্বরূপ কিছু নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়া হয়। তাঁকে যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। গ্রাম প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দাওয়াত করা হয় এসময়। তাঁরাও নতুন অতিথি এবং মায়ের জন্য নানা উপহার নিয়ে আসেন। পরবর্তী ঘরের সদস্য সকলে মিলে জন্মবার এবং পঞ্জিকা দেখে সন্তানের জন্য সুন্দর একটি নাম রাখেন।

ছয় মাস পর বিহারের বড় ভান্তের হাত দিয়ে এবং আর্শীবাদ নিয়ে বা ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তাঁকে মুখে প্রথম ভাত খাওয়ানো হয়।

মৃত্যু, সৎকার এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা

মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী তঞ্চঙ্গ্যারা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করে। দাহ করার আগে মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো হয়। এরপর “বিয়াঘর” তৈরি করে মৃত ব্যক্তিকে ঐ ঘরে রাখা হয় (বিয়াঘর মূলতঃ শ্মশান যাত্রার আগ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তিকে রাখার অস্থায়ী ঘর)

পরবর্তীতে বাঁশ, তার, দড়ি বা রশি এবং নানা রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা মন্দির সাদৃশ্য ‘প্যারাসাইট’ নামক একটি প্যাটিকায় আবদ্ধ করে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকে অশ্রুজলে বিদায় নিয়ে জগত সংসারের সকল আনুষ্ঠানিকতা মেনে এবং ছেড়ে কাঁধে বহন করে চিদাকলায় (শ্মশান) নিয়ে যাওয়া হয়।

ছেলেদের শ্মশান সাজানো হয় পাঁচ ধাপ/টাক দিয়ে আর মেয়েদের সাত ধাপ বা টাক গাছ দিয়ে। নদীর গতিপথ অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির মাথা এবং পা কোন দিকে হবে সেটি নির্ণয় করা হয়। নদী বা ছড়া যদি উত্তর থেকে দ¶িণ দিকে নেমে যায় তাহলে মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে শুয়ানো হবে মাথা উত্তর দিকে করে আর পা দক্ষিণ দিক করে। দাহ করার পরদিন পরিবারের এবং আত্মীয় -স্বজন গিয়ে মৃত ব্যক্তির ধাতুগুলো(হাড়) খুঁজে নিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নদীতে বিসর্জন বা ভাসিয়ে  দেওয়া হয়। নদীতে গিয়ে ঘাটের উভয় পারের টাকা-পয়সাও দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তি যেন বিনা বাঁধায় তাঁর সুপথে গমন করতে পারে।

দাহ করার সাত দিনের মধ্যে ভালো একটি দিন দেখে সাপ্তাহিক সংঘদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় মৃত ব্যক্তির আত্মা সুখ শান্তি এবং সদ্গতি কামনা করে। সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানকে তঞ্চঙ্গ্যারা ‘সাতদিন্যা’ বলে। এই দিনে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য “চেরাগঘর” নামে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর তাদের পরম আত্মীয় এবং পরিবারের সদস্য গৃহহীন যেন না থাকে এই উদ্দেশ্য ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়। সাথে মৃত ব্যক্তিকে খাবার দেওয়ার জন্য তৈরি করে দওয়া হয় “তামাঙ-ত ঘর”।

সংঘদানে ভিক্ষু সংঘকে ফাঙ বা দাওয়াত করা হয় সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং পাড়া- প্রতিবেশীকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করা হয় সকলকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্য আয়জন করা সকল খাবার রাত বারোটার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয়। যদি থেকে থাকে এগুলো নদীতে পেলে দিতে হয়। কাউকে দেওয়া যায় না। ছোট বাচ্চাদের উক্ত সংঘদানে অংশগ্রহনে নিরুৎসাহিত করা হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের ছোট সদস্য ছাড়া।

সংঘদান অনুষ্ঠানকে সুন্দর করে তোলার জন্য মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক এবং বস্তুগত উপাদান দিয়ে সহযোগিতা করা হয় আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়া প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে। এই সহযোগিতা তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সামাজিক এবং নৈতিক একটি দায়িত্ব বলে মনে করে। মৃত দুধের শিশুকে দাহ করা হয় না, তাঁকে কবর বা দাফন করা হয়। এই কবরকে ‘পআকাবা’ বলে।

উপসংহার

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়। নিজেদের সংস্কৃতিকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা আরো বিশ্বাস করে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষায় নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে।

জুম, পাহাড়, ছড়া, ঝিরি -ঝর্ণার মতো অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং ভ্রাতৃপ্রেমে নিজের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির উপাদানসূহ সকলের সাথে বিনিময়ের পাশাপাশি অন্যের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিনগুলো। দেশ, জাতির সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে এবং সংকট প্রশ্নে একসাথে কাজ করতে চাই সকলের সাথে মিলেমিশে হাতে হাত রেখে।

লেখকঃ “পহর জাঙাল” প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা, সম্পাদক, প্রকাশক, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, নাট্যকার ও ভাষা গবেষক”

“তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস প্রসঙ্গে”

লেখকঃ সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা

স্বজাতির অতীত সম্পর্কে জানার সাধারণ ও স্বাভাবিক আগ্রহের কারণে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি সম্পর্কে কিছু লেখা পড়েছি। এ থেকে আমার মনে হয়েছে আমাদের অতীত ইতিহাসের উপর ধারণা অপেক্ষাকৃত বেশী যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । একই সাথে বর্তমানে আর্থ – সামাজিক অবস্থান ও সংস্কৃতির ধরণ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ গতিমুখ সম্পর্কে একটা আভাস / সম্ভাবনা অনুমান করাও আবশ্যক ।

“বার্মা ও ভারতে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান এবং তাদের অন্যান্য বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান শিরোনামে একটি প্রবন্ধে (ন – আ শমন , ৩য় সংখ্যা , ৩য় বর্ষ , ২০০৬ ইং ) এ সি তঞ্চঙ্গ্যা পরিসংখ্যান সহ উল্লেখ করেছিলেন যে , “তঞ্চঙ্গ্যাদের ৭ টি গছার লোকজন দাইনাক নামে বার্মায় বসবাস করছে । “তঞ্চঙ্গ্যাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্বনামধন্য লেখক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( ১৯৩৪-২০১৪ খ্রীঃ ) একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন- “ আরাকানের দানাওয়াদি তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য ” (পহর জাঙাল , ৫ম সংখ্যা, ২০০৯ ইং )। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন- “ তঞ্চঙ্গ্যাগণ দাইনাক পরিচয়ে দানাওয়াদি’র (আরাকান) মূল অধিবাসী ছিল ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমা ভাষা, অঞ্জলী ১ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ১১৫ পৃ: (তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল সমূহের প্রবীণ ডেপুটি ইস্পেক্টর শ্রীযুক্ত গগন চন্দ্র বড়ুয়া কর্তৃক লিখিত বলে অনুমিত) থেকে উদ্ধৃত করে ‘ চাকমা জাতি ‘ গ্রন্থে (১৯০৯ ইং সনে । প্রকাশিত) সতীশ চন্দ্র ঘোষ লিখেছেন- আরাকানের পাহাড়ী জাতির অপর এক সম্প্রদায়  তাহাদের সহিত মিশ্রিত হইয়া চাকমার অনুকরনে কথাবার্তা বলিতে শিখিলেও চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে । “(অনলাইন সংস্করন, পৃ : ৫৩-৫৪ ) । এর পর সতীশ ঘােষের মন্তব্য- “ এংখ্যং ও ইয়ংখ্যংবাসী দৈনাকেরাই আরাকানের পাহাড়ী তঞ্চঙ্গীয়া হইবে । অতএব এখানে আমরা আরও দৃঢ়তার সহিত দৈংনাক ও তঞ্চঙ্গ্যাদিগকে এ অভিন্ন জাতি বলিয়া স্বীকার করিতে পারি । ” একই গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ” দৈনাকেরা যে চাকমাগণেরই অন্যতম শাখা তাহা সর্বদিসম্মত । ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে । বিবাহ সম্বন্ধীয় গোলযোগই ইহার কারণ । ” অথচ ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “ অনেক প্রাচীন চাকমাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছি দৈনাক ‘ টিও তাহাদের অত । পরন্তু মঘেরা টংচঙ্গ্যাদিগকেই দৈনাক নামে অভিহিত করিয়াকে । ”

‘চাকমা দুই রাজবংশ ‘ (২০১৪ ইং সনে প্রকাশিত) পুস্তকের পৃঃ – ১০ এ লাইন ১৩- ২০ তে লেখক কুমুদ বিকাশ চাকমা তার আরাকান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন “যাদুঘর ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমন এক জায়গা ও কক্ষে স্বামী – স্ত্রী বা পুরুষ – মহিলার মডেল হিসাবে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পোষাকে দেয়ালে রাখা হয়েছে ।

১ নং মডেল খুমী জাতি ।

২ নং মডেল ম্রো জাতি ।

৩ নং মডেল রাখাইন জাতি ।

৪ নং মডেল দৈনাক ‘ জাতি । (যেটা আমাদের বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি)

৫ নং মডেল থেক বা সেক জাতি ।

Tanchangya Community, Bangladesh.

এই থেক বা সেক ‘ জাতির পোশাক অবিকল আমাদের চাকমা মহিলাদের পিনন খাদি । পিননের উপরে চাবুগীটা রয়েছে। ”উপরোক্ত বিভিন্ন সূত্রের আলােকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা হচ্ছে- দাইনকি ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষ একই গোত্রজাত তথা এক জাতি । তাদের উত্তরসূরী বর্তমান মায়ানমার এর আরাকানে দাইনাক এবং বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা । তাহলে একই ধারার জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় দুই নামে হলো  কিভাবে ? এবং কোনটি আগে, কোনটি’র নামকরণ বা পরে! এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সতীশ ঘোষের ‘ চাকমা জাতি ’ বই এর ৫৩ পৃষ্ঠা এবং সাংবাদিক জামালউদ্দিন এর লেখা “ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ‘ ( প্রকাশকাল- ২০১১ ইং ) বই এ ( পৃ: – ১১৩ ) উল্লিখিত লাইনগুলাে পড়তে হয় । Captain T H Lewin ( D C of Chittagong Hill tracts in 1866- 69 & 1871- 74 ) লিখিত Hill Tracts of Chittagong and dwellers there in ( 1869 তে প্রকাশিত ) গ্রন্থের বরাত দিয়ে লেখকগণ উল্লেখ করেছেন যে , “ ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান থেকে ফা’র নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার টুংটইংগা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে এসেছিল । এই টুইংগারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অনুমতি লাভে নিজেদের শ্রম ও অর্থকড়িতে চট্টগ্রাম নগরীতে জব্বার খা প্রতিষ্ঠিত রাজাপুর নামক স্থানে একটি মনােরম বাড়ী নির্মাণ করে দেয় । ধরম বক্স খা ঐ সময় ফাপ্র , কে টুংটইংগাদের প্রধান হিসাবে স্বীকার না করায় তাদের অনেকে তার সাথে অন্যত্র চলে যায় । বর্তমানে ( ১৮৬৯ খ্রীঃ অব্দে এখানে ) ইহাদিগের সংখ্যা ২৫০০। প্রাচীনেরা আরাকানী ভাষায় আলাপাদি করে ; পরবর্তী পুরুষ অন্যদের ( অর্থাৎ চাকমাদিগের ) অনুকরনে বিকৃত বাঙ্গালা ব্যবহার করিয়া থাকে । ” এই টুংটইংগা ‘ নামটির বানান ইংরেজীতে লুইন সাহেব লিখেছিলেন Taungjyny । তার উল্লিখিত টুংটইংগাদের চট্টগ্রাম আগমনের সময় থেকে ৫০ বছর পর জনগোষ্ঠীটার নাম তিনি নিশ্চয়ই সরকারী নথি থেকেই পেয়েছেন অথবা শুনেছেন । আরাকান থেকে আগত উক্ত জনগোষ্ঠী যদি দৈনাক বা দাইনাকদের একটা অংশ হয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের নাম কেন ‘ Taungjyny ‘ হল , ‘ চাকমা ‘ হলো না কেন ? ফাপ্রু যদি দলপ্রধান হিসেবে ধরম বক্স খা কর্তৃক স্বীকৃত হতেন তাহলে হয়তো আগত লোকেদের জাতিগত / সম্প্রদায়গত অথবা গছার পরিচিতি ফাপ্রুর নামে হত । তা হয়নি ।  

শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- পৃ : – ৪ ) , শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয় পৃ: – ৫ ) এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- পৃ : – ১২ ) প্রমূখ লেখকগণের মতানুসারে- “তৈনছড়ি থেকে আগত বলে তারা তৈ – তং – য়্যা / তৈনতংগ্যা / তংচয়্যা নামে অভিহিত হয়েছেন ।” উল্লেখ্য যে , বর্তমানে বান্দরবান জেলার অন্তর্গত আলীকদম উপজেলায় মাতামুহুরীর একটি উপনদী হচ্ছে তৈনছড়ী। মারমারা নদী বা খালকে দুং বলেন । তৈনছড়ী উপনদীকে মারমারা বলেন তৈনছং । “দৈনাকদের একটা অংশ দীর্ঘদিন ধরে তৈনছড়ি এলাকায় বসবাস করে ছিল ” (Tanchangya- by Rupak Devnath , page- 89 ) । তাই তৈনছড়ী বা তৈনচং থেকে আগত রাজানগরে ধরম বক্স খার নিকট আশ্রয়প্রার্থী জনগোষ্ঠীকে যদি রাজ – কর্মচারী বা কর্মকর্তাগণ Taungjyny বলে রেকর্ডভূক্ত করেন তবে সেটাই স্বাভাবিক । Taungjyny থেকে টংতংয়া ( চাকমারা যে নামে বলেন ) , টংতংয়া থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে আগত দাইনাক জনগোষ্ঠীর একটা অংশের বর্তমান জাতিগত পরিচয় বাংলা বানানে ‘ তঞ্চঙ্গ্যা ’ ( Tanchangya ) নামে অভিহিত হচ্ছে।

দাইনাকদের সম্পর্কে এ.সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন । এ কথা বলা আবশ্যক যে , দাইনাকদের জাতিগত নামকরণের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় তিনি সতীশ চন্দ্র ঘােষের বর্ণিত দেঙ্গাওয়াদি আরেদফুং ( দান্যাওয়াদি আরে তবুং ) এবং আরাকান নিবাসী বােলয়্যা দাইনাকের মত অনুসরণ করেছেন । মনিজগিরি ( মইচাগিরি ) ‘ র কথিত যে রাজা ইয়ংজ আরাকান রাজা মেঙ্গাদি কর্তৃক পরাজিত ও বন্দী হবার ফলে ধৃত তার দশ হাজার প্রজাদেরকে দাইনাক আখ্যা দেয়া হয়েছিল বলে উল্লিখিত হয়েছে- সেটি ইতিহাসের বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ । Hisyory of Burma ( 1883 ) গ্রন্থের লেখক Sir Arthur Phayre এর বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অশোক কুমার দেওয়ান তার চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ‘ বই ( প্রকাশকাল -১৯৯১ ইং ) এর ৬১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , “ ফেইরীর ব্রহ্মইতিহাসে আরাকান রাজ মেংদি কর্তৃক সাক রাজ্য জয়ের কোন বিবরণ নেই বরং Myinsaing এর শান জাতি কর্তৃক উল্টো আক্রমনেরই উল্লেখ আছে । “দেঙ্গ্যাওয়াদিতে যে সময়ে রাজা মেংদি কর্তৃক শাক রাজ্য জয়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ঠিক সে সময়ে Myinsaing এর সান রাজাগণের বংশতালিকায় রাজা U – Za – Na বা Usana- র নাম পাওয়া যায় , যিনি ৬৮৪ মঘাব্দে বা ১৩২২ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৪২ খৃষ্টাব্দ অবধি বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত তারিখ যদি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তবে উপরোক্ত ঘটনা তারই সময়ের ।”

উপরে উদ্ধৃত বক্তব্য সঠিক গণ্য করলে যুদ্ধবন্দী দশহাজার চাকমা থেকে দৈনাক জাতির উৎপত্তি’র যে কাহিনী প্রচলিত তা ‘ বানোয়াট ও মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় ।

এ সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে যুক্তি দিয়ে অনুমিত সিদ্ধান্ত টেনেছেন আরাকানের প্রাচীন নগরী ‘দান্যাওয়ার্দীতে যাদের উৎপত্তি বা বিকাশ ঘটেছে তারা দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছেন অথবা বলা যেতে পারে দাইনাকদের আবাস অঞ্চল কিংবা তাদের শাসিত অঞ্চলকে দানাওয়াদি নামে অভিহিত করা হয়েছে ‘।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অতীত ইতিহাস দাইনাক নামের সাথে সম্পর্কিত । একারণে দাইনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথাযথ যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । তেমনি দেশান্তরিত হয়ে দাইনাকদের একটা অংশের চট্টগ্রাম আগমন ও জমিদার ধরমবক্স খাঁ’র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণও স্পষ্ট হওয়া দরকার । এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আরাকানের ইতিহাস থেকে এ সম্পর্কে হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে ।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়- খ্রীষ্টপূর্ব হাজার বছর আগে থেকে আরাকানের রাধানী হিসেবে ধান্যাওয়াদি ( Dhanyavadi ) নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । শেষ পর্যায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইন্দো – আর্য ভাষা ভাষী দ্বন চন্দ্র ( Dvan candra ) নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ১০১ জন রাজাকে পরাভূত করে আরাকানে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাপূর্বক তৃতীয় ধান্যাওয়াদি নগর নির্মাণ করান । উক্ত ধান্যাওয়াদি নগর থেকে তিনি ৩৭০- ৪২৫ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানে অধিকৃত অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন। ( মায়ানমার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আবিষ্কৃত একটি ধান্যাওয়াদি নগর সিত্তোয়ে শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটার উত্তরে কলাদান ও লেমরু নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত )। উক্ত রাজার উত্তরসূরীগণ ধান্যাওয়াদি নগরের ৯ কিলোমিটার দক্ষিনে ভেসালি (Vesali / VVetheli) নামে একটি নগর স্থাপন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে এর পূর্ব থেকে তিব্বেতো – বার্মান ভাষা ভাষী বৈদেশিক শক্তির আক্রমনে চন্দ্রবংশের রাজ – শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে । ৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে আরাকান পাগানের করদ রাজ্যে পরিণত হয় । ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে এ্যা- মিঙ – ঞা তুন ( Nga – Meng nga tun) নামে সাঃ (Sak বা Thek) বংশীয় ( Harvey এর অনুমান) একজন রাজপুত্র ভেসালি ( Vesali / Wetheli ) অধিকার করে ইহার নাম দেন সম্বক ( Sambawak )। পাগানরাজের স্লাইনমা ( বমী ) বাহিনীর সহায়তায় লোমিন – নান (Letyamin – nan) নামে একজন রাজা ১১১৮ খ্রীষ্টাব্দে তার পূর্বসূরীদের সিংহাসনে বসেন এবং আরাকানের রাজধানী পারেইন (Parein) এ সরিয়ে নেন। পরবর্তী সময় পাগানের শক্তি দূর্বল হয়ে পড়লে ১২৩৭ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) এ রাজধানী স্থাপিত হয় । এর কয়েক বছর পর থেকে ১৩৭৪ পর্যন্ত আরাকান রাজারা অনেকটা স্বাধীন থাকে। এ সময়ে আরাকান রাজ্য পশ্চিমে বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । চতুর্দশ শতাব্দির প্রথম দিকে Myinsaing ও Panya থেকে সান রাজা আরাকান আক্রমন করেছিল বলে Phayre উল্লেখ করেছেন । চতুর্দশ শতাব্দির শেষ দিকে রাজ্যে বেশ কিছু অভ্যুত্থান ঘটে । একের পর এক ক্ষমতার হাত – বদল হয় । অবশেষে ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) বার্মারাজ মেঙখামং এর দখলে চলে যায় । আরাকানরাজ মিঙ সমউন বঙ্গদেশে পালিয়ে গিয়ে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র দরবারে আশ্রয় নেন । আরাকান উচ্চব্রহ্মে আভার মাইনমা ( বর্মী ) এবং নিম্নব্রহ্মে রাজধানী পেশুর মনদের ক্ষমতার লড়াইয়ের গুটিতে পরিণত হয় । বাংলায় ২৪ বছর আশ্রিত থাকার পর ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ’র সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিজ রাজ্য ফিরে পেলেন এবং লউংগ্রেট ( Launggret ) থেকে রাজধানী (Mrauk U ) বা ম্রোহং – এ স্থানান্তরিত করেন । পরবর্তীতে বাংলার শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগে মিঙসমউন এর পূত্র বা স পু চট্টগ্রাম দখল করেন । উক্ত ক্রমের দ্বাদশতম রাজা মিন বিন ( ১৫৩১- ৫৩খ্রীঃ ) পর্তুগীজদের সহযোগীতায় ঢাকা পর্যন্ত রাজ্য সম্প্রসারণ করেন । মিন বিনের মৃত্যুর পর ( ১৫৫৩ খ্রীঃ) রামু থেকে উত্তরের ভূ – খন্ড আরাকানের হাতছাড়া হয় । আরাকান রাজ মেনখ ফলিঙ ( ১৫৫০-১৫৯৩ ) রামু এবং গােটা চট্টগ্রাম দখলে নেন , তখন থেকে ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইহা আরাকান রাজ্যের অধীনে থাকে। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে বাংলার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উমেদ যা চট্টগ্রাম দখল করেন । শঙ্খনদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোগল আমলে মোগল অধিকারভূক্ত থেকে যায়।

উল্লেখ্য যে , অধিকাংশ ইতিহাস গ্রন্থ নির্দিষ্ট কোন স্থান / অঞ্চল / রাজ্য বা দেশের শাসক / রাজা কিংবা কীর্তিমান ব্যক্তিগণের বংশপরিচয় , জীবন বৃত্তান্ত , কীর্তিকলাপ , যুদ্ধ সংঘাত ইত্যাদির বিবরণ নিয়ে লিখিত । সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনধারা , ভাষা , সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর আলোকপাত তাতে কমই বিবৃত থাকে । তা সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ সময়ের সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাজা – রাজড়াদের অভিযান , যুদ্ধ – বিগ্রহ ইত্যাদির বিবরনের মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট গণমানুষের জীবন প্রবাহ সম্পর্কে রূপরেখা টানা সম্ভব। উপরে বর্ণিত বিবরণ থেকে হয়তাে দাইনাক দের অতীত সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। উল্লিখিত হাজার / দেড় হাজার আগে ধান্যাওয়াদীর উৎপাদন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল?

মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ও রাজাদের রাজ্য শাসনপ্রণালীর আলোকে অনুমান করা যেতে পারে – ধান্যাওয়ার্দীর রাজপরিবার , রক্ষীদল , রিজার্ভ সেনা , কর্মাধ্যক্ষ , কর্মচারী , দাস – দাসী প্রভৃতি পরিজন পরিবৃত হয়ে রাজা প্রাচীর বেষ্টিত নগরের অভ্যন্তরে থাকতেন , এ ছাড়া অধিকাংশ লোকের বসবাস ছিল নগরের বাইরে । এ ছাড়া ছিল জেলে , তাঁতী , কামার , কুমার , সুতার , প্রভৃতি বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর লােকজন , পরিবার পরিজন নিয়ে তারা নগরের উপকণ্ঠে জনপদগুলোতে থাকতো । নগরের নিকটে কলাদান ও লেমরু নদীর অববাহিকায় সমতল জায়গাগুলোতে ভূমিদাসরা চাষাবাদ করে । নগরবাসীদের জন্য রসদ যোগাতো। আজ্ঞাবহ বিভিন্ন গোত্রের লোকজন পাহাড় এলাকাগুলোতে জুমচাষ , পশুশিকার , পশুপালন , মধু আহরণ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। গোত্র প্রধানদের মাধ্যমে রাজা কর আদায় সহ তাদেরকে পরিচালনা করতেন , যুদ্ধের সময় গোত্র প্রধানরা প্রয়োজনে রাজার সেনাদলে লোক যোগান দিত , যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত । যুদ্ধবাজ কোন কোন গোত্রপ্রধান অথবা বিজিত ১০১ জন রাজাদের অনুসারী কেউ কেউ হয়তো মাঝে মধ্যে বিদ্রোহ করতো , রাজ্যে উৎপাত সৃষ্টি করতো। শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন দেব – দেবীর মন্দির নির্মাণ করে রাজাগণ ভারতবর্ষ থেকে ব্রাহ্মণ এনে পূজা অর্চনার জন্য তাদেরকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন , প্যাগোডা , চৈত্য , মন্দির নির্মাণ করে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন ।

৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পাগান থেকে স্রাইনমা ( পরবর্তীতে বর্মী নামে অভিহিত ) বাহিনী কর্তৃক ধান্যাওয়াদী অধিকৃত হবার ফলে তথায় ইন্দো – আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমশ : হ্রাস পেলো , বিপরীতে চীনের ইউনানের নানজাও রাজ্য থেকে আগত স্রাইনমা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো , নগরের প্রশাসনিক কাঠামো ও সমাজের শ্রেণীবিন্যাস পরিবর্তিত হলো। লেত্ত্যা মিন নান ‘ এর সময় নগরের বাইরে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের রাজার প্রতি আনুগত্যেরও পরিবর্তন ঘটলো। হত্যা , লুণ্ঠন , যুদ্ধ , সংঘাত প্রভৃতি কারণে এক একটি এলাকা বা অঞ্চল কয়েক বছর অথবা কয়েক দশকের জন্য জনশূন্য হয়ে থাকা , নিরাপত্তা এবং শুধু অর্থনৈতিক ( জুম চাষাদি) কারণেও সমগোত্রীয় বা সমভাষী জনগোষ্ঠীর বাসস্থান পরিবর্তন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা । এরূপই যদি হয়ে থাকে তাহলে হয়তো আরাকান রাজের অনুগত কোন গোত্রের আদি বাসভূমি ধান্যাওয়াদি নাম থেকে তাদের পরবর্তী জনগোষ্ঠী দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । মধ্যযুগীয় গছা ( গোত্র ) ভিত্তিক কাঠামোর উপর দাইনাক এবং তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠির সমাজ গঠিত । উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোর উপর লোকসমাজের জীবনধারা ও সংস্কৃতি আবর্তিত হয় । এই গছা , গুত্তি ( উপ – গোত্র ) ও ডেল (বংশধারা )  ভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক কাঠামো অর্ধ শতাব্দী পূর্বেও যথেষ্ট দৃঢ় অবস্থায় ছিল । তখন একটি পাড়াতে প্রধানতঃ একই গছার লোকজনই বসবাস করত । সামন্তযুগীয় আর্থ – সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সৃষ্ট গোত্র ভিত্তিক সামাজিক কাঠামো তাই হাজার বছর ব্যাপী বিবর্তনের মাধ্যমে এসে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সাম্প্রতিক কালেও বিদ্যমান ছিল । হয়তো ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রবংশীয় রাজাগণের প্রতিষ্ঠিত সম্বক ( Sambawak ) নগরেও এককালে পূর্বপুরুষগণ বাস করেছিলেন বলে প্রাচীন দাইনকরা কেউ কেউ বলতেন যে , তাদের আদি বাসস্থান সম্বক নগর বা তারা সম্বক নগর থেকে এসেছেন ।

১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্মী বাহিনী কর্তৃক রাজধানী লউংগ্রেট ( Launggret ) দখল হবার পর আরাকান রাজ মিঙসমউন ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গদেশে গিয়ে আশ্রয় নেয় । তার প্রতি অনুগত বিধায় বর্মী সেনাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে নিজ নিজ গোত্র সর্দারদের নেতৃত্বে দাইনকরাও পশ্চিমে আরাকানের শেষপ্রান্তে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ করে নাফ নদীর পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী নদীর উপত্যকার দিকে সরে এসেছিল। সংখ্যাল্পতা কিংবা শক্তি – সামর্থ্যের দূর্বলতার কারণে তখন হয়তো তারা। দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় প্রধানতঃ জুম চাষের উপর নির্ভর করে এ সময় যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল।

ক্যাপ্টেইন লুইন এর লেখার মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত বলতে পারছি যে , ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে Taungjyny রা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলিতে এসেছিল এবং তারা জমিদার ধরমবক্স খার অনুমতিক্রমে এখানে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল। তারও অনেক আগে এই জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীগণ অত্র পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল বলে হয়তোনিশ্চিতভাবে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , কিন্তু অনুমান করা সহজ যে- মিন সমউন এর বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড়ে ২৪ বছর অবস্থানের সময় আরাকানে চরম অরাজক অবস্থা বিরাজ করেছিল । গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দিন এর সেনাদের সাহায্যে ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে মিন সমউন সামন্ত রাজার মত পূন : আরাকানের সিংহাসন লাভ করেন। তখন হয়তো পুর্বোক্ত শরনার্থীদের কিছু অংশ নাফনদীর পূর্বদিকে ফিরে যায় । আবার পরবর্তী আরাকান রাজ মেঙ খ্য রী ( ১৪৩৪- ১৪৫৯ ) বাংলার সুলতানের কর্তৃত্ব মেনে নেননি এবং তিনি পূর্বোক্ত সুলতানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকজনদের প্রতি বিরূপ ছিলেন।

১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের পর আবার আরাকানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে শাহ সুজার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে মোগলদের সাথে আরাকান রাজার বিরোধ শুরু হয়। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মোগল বাহিনী চট্টগ্রাম ও রামু থেকে আরাকানী সেনা ও তাদের সহযোগী পর্তুগীজদের বিতারিত করে ।

১৬৬৯ থেকে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সর্দাররা পর্যায়ক্রমে আলীকদমে জুমিয়া জমিদারী পরিচালনা করেছিলেন। ফতে খাঁ ( ১৬৬৯ ) থেকে জালাল খাঁ ( ১৭১৬- ১৭২৪) প্রত্যেকে ছিলেন শাহ্ সুজার সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মাধ্যক্ষ বা সেনাপতি । রামুতে জমিদারী পরিচালনাকালে জালাল খার সাথে চট্টগ্রামের নবাবের সম্পর্কের অবনতি হলে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের মোগল সেনাধ্যক্ষ কিষাণ চাদ ও শের জামাল খাঁ অভিযান চালিয়ে আলীকদমের সকল স্থাপনা ধ্বংস করে দিলে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সেখানকার জমিদারী চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় । এর পর ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে দেয়াঙ ( বর্তমান আনোয়ারা ) এর মোগল বংশীয় জমিদার শেরমস্ত খা আলীকদমে বসবাসকারী সহযোদ্ধাদের জন্য চট্টগ্রামের নবাব জুলকর খাঁর কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা এলাকার পার্বত্য ভূমি বন্দোবস্তি নিয়ে বসবাস ও জমিদারী প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেন এবং উদ্বাস্তু চাকমা জুমিয়াদের জড়ো করে কোদালায় নিয়ে আসেন এবং চাষাবাদে নিয়োজিত করেন (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস- জামাল উদ্দিন , পৃঃ ২১৯-২২০ )।

১৭৩৭ থেকে ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পরম্পরা কয়েকজনের পর মোগল বংশীয় শেষ জমিদার ধরম বক্স খার সময় Taungjyny রা আরাকান (?) থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বসবাসের জন্য (রাজানগরে) এসেছিল । তাই এখান থেকে (১৮১৯ খ্র 🙂 দাইনাকদের একটা অংশের ইতিহাসের বাঁক তঞ্চঙ্গ্যা নামে শুরু ।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস দীর্ঘ না হলেও জটিলতা মুক্ত নয় । এ জন্য নিমে লিখিত কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক । যথাঃ(১) চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পর্ক । (২) চাকমাদের রাজা (ধরম বক্স খা) র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণ । এবং (৩) তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক ।

দৈনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্কিত ইয়ংজ কাহিনীর ভিত্তিতে সতীশ ঘোষ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে লিখেছিলেন – “দৈনাকেরা যে চাকমাগনেরই অন্যতম শাখা , তাহা সর্ববাদিসম্মত” সতীশ ঘোষের এ লেখার প্রেক্ষিতে প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যারা চাকমাদের একটি শাখা । অর্থাৎ ইতিহাসের গতিধারায় একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয়ে চাকমা নামের উৎপত্তি আগে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের একটা অংশ দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । ক্যাপ্টেইন লুইন এর মতে- “চাকমা নামটি চট্টগ্রামের অধিবাসীদিগেরই দ্বারা প্রদত্ত ” ( সতীশ ঘোষের বই এর পৃ : ৮ এবং জামাল উদ্দিনের বই এর পৃ : ১৬৭ ) । তা – ই যদি হয় , তবে দৈনাক নামটি কি ইহার পরে ?

কুমুদ বিকাশ চাকমা বর্ণিত আকিয়াব যাদুঘরে রক্ষিত মডেল থেকে যে একটা তথ্য স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, আরাকানে প্রাচীন অধিবাসী কোন জনগোষ্ঠীর নাম ‘চাকমা ছিল না, ছিল দাইনাক। থেক / সেকদের পোষাকের সাথে চাকমাদের মিল থেকে এটুকু মাত্র বলা যায় যে থেক / সেকদের একটা অংশ বাংলার ভূমিতে আসার পর ‘চাকমা ‘ নামে অভিহিত হয়েছে । থেক / সেক ‘ এবং ‘ দাইনাক’ দুইটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী । তদ্রুপ তঞ্চঙ্গ্যা ‘ এবং চাকমা ‘ ভিন্ন জনগোষ্ঠী।

অনলাইনে Daingnak ওয়েব সাইট এ দেখা যায় – দাইনাকেরা নিজেদেরকে Sangma বলেন । উখিয়া, টেকনাফ এলাকায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের নামের শেষে চাকমা লেখেন । এ থেকে আবার দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে একই জনগোষ্ঠীর তিনটি শাখা বলে প্রতীয়মান হয় ।

চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থে (পৃঃ ৬৬-৬৭) অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন – ব্ৰহ্ম আরাকান ইতিহাস বরাবরই একটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত শাক্য জাতি বা শাক বা সাক জাতির অস্থিত্ব কল্পনা করা হয়ে আসছে । আরাকানীরা সম্ভবত: তাদের প্রাচীন Legend এর ধারাকে অনুসরণ করে উত্তর দিক থেকে আগত যে কোন নবাগত বা অপরিচিত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীকেই সাক নামে অভিহিত করতো।

আরাকানীদের উচ্চারণে শব্দের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায় উহ্য থাকে। তাই ‘ সাক ‘ উচ্চারণ প্রায় সাঃ এর মত হয়। রাজাকে বলা হয় মাং । সাক রাজাকে সাঃ মাং এবং সাক লোকদেরকে সাঃ মেও বলেন। সাঃ মেও বা চাকমাদের পূর্বসূরীগণ হয়তো কোন এক কালে সম্বক ( Sambawak ) নগরে বসবাস করেছিলেন । দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণের ন্যায় তাদের একটা অংশ দশম / একাদশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ – বিগ্রহ ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে মাতামুহুরী উপত্যকায় এসে উপনীত হয়ে তথায় বসতি স্থাপন করেন। সম্ভবত : তদকালে গৌড়ে আশ্রিত রাজা মিঙ সউন এর প্রতি অনুগত ছিল বিধায় তারা গৌড়ের সুলতানের অনুগ্রহ লাভ করে আলীকদমের পার্বত্য ভূমিতে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । বহু ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দে কথিত ধাবানা নামে একজন সর্দারের নেতৃত্বে , তারা ‘ সাংমা ‘ নামে নতুনভাবে সংগঠিত হয়। সতীশ চন্দ্র ঘােষ তার চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থের ১ ম অধ্যায়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- “ ধুর্যা , কুর্যা , ধাবানা , পীড়াভাঙ্গা ইত্যাদি নেতৃচতুষ্টয়ের নামানুসারেই সর্বপ্রথমে চারিটি গোষ্ঠী গঠিত হয় । এই চারিটি গোষ্ঠী লইয়াই বংশবিভাগ আরম্ভ হইয়াছিল । ধুর্য, কুর্যাদি নের্তৃবৃন্দ যাহাদের উপর প্রভূত্ব করিত, তাহারও চারিটি দলে বা গোছা’য় বিভিন্ন ছিল” লেখক এর পরে উক্ত চারিটি গছা থেকে শাখা – প্রশাখায় বর্ধিত চাকমাদের তদুকালে মোট একত্রিশটি গোছা ও ১৩৩ টি গুত্তির তালিকা দেন (পৃঃ ৫৬-৬০) উক্ত তালিকায় দাইনাক (তঞ্চঙ্গ্যাদের পুর্বেল্লিখিত ৭ টি গোছার নাম নেই । এ থেকেও বলা যায় -দাইনাক ( তঞ্চঙ্গ্যা) এবং চাকমারা ভিন্ন গোত্রজাত।

১৬৬০ এর পরবর্তী সময়ে শাহ সুজার অনুসারী সেনাদের উপস্থিতির ফলে দক্ষিন চট্রগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে । ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে তারা মোগল বংশীয় জমিদারগণের প্রজা হিসেবে পরিগণিত হয় । জমিদারগণের বাসস্থান ( রাজধানী ) পরিবর্তনের সাথে সাথে উক্ত চাকমা প্রজাগণও বাসস্থান বদলাতে থাকেন । জমিদারের নৈকট্যে থেকে চাকমা প্রজাদের মধ্য থেকে দেওয়ান , তালুকদার , খীসা প্রভৃতি খেতাব নিয়ে একটা ক্ষুদে সমস্ত শ্রেণি তৈরী হয় । সামন্তপ্রভুদের মত বিশেষ করে দেওয়ান স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা সাধারণ প্রজাদেরকে তাদের সেবক বা হুকুমের পাসের মত গণ্য করত । অপরদিকে দাইনাকেরা নিজ নিজ গোত্র প্রধানদেরকে কেন্দ্র করে সম্ভবত : পূর্বের মাতামুহুরী উপত্যকা বা উহার নিকটবর্তী অঞ্চলে জুম চাষ করে যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল । ফলত : তাদের মধ্যে অনুরূপ কোন শ্রেণি বিভাজন গড়ে উঠেনি। সে সময় মূলত : চাকমাদের দেওয়ান প্রভৃতি সামন্ত শ্রেণির লোকেরাই দৈনকদের প্রতি হেয় মনোভাব পোষণ করতো । হয়তো তাই সতীশ ঘোষের লেখাতে পাই- “ চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃনার চক্ষে দেখিয়া থাকে। ” উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য সূচিত হবার ইহা আর একটা কারণ । উপরোক্ত চাকমা ও দাইনাকদের পূর্বপুরষগণ শত বর্ষ পূর্বে যদি একটা গোত্রের লোকও হতেন তবুও দুইটা জনগোষ্ঠীকে আলাদা গণ্য করার জন্য এই শ্রেণি বিভাজনের পার্থক্যই যথেষ্ট । পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে , জমিদার শেরমস্ত খা’র সময় ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে অধিকাংশ চাকমা আলীকদম এলাকা থেকে কোদালায় স্থানান্তর হয়েছিল । ধারণা করা যায় – জুমচাষে অভ্যস্ত দাইনাক লোকেরা হয়তো হাল চাষে অনীহার কারণে পূর্ব বসতি পাহাড় জঙ্গলের জায়গা ছেড়ে চলে আসেনি অথবা আসার পর আবার জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যত্র কোন পাহাড় – জঙ্গলময় এলাকায় চলে যায় । এ জন্যই হয়তো সতীশ ঘোষ আরো লিখেছিলেন- “ ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈনাকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে ” । অর্থাৎ দৈনাকদেরকে তিনি চাকমা থেকে বেরিয়ে যাওয়া ( ! ) একটি শাখা হিসেবেই গণ্য করেছেন (১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে উল্লিখিত গছাভিত্তিক সামাজিক কাঠামোতে চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার ভিন্নতা বিবেচনায় এ বক্তব্য সমর্থনযোগ্য হয় না )

মাঝখানে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মোগল সম্রাটের নিকট থেকে পুরো ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায় । জমিদার শের দৌলত খাঁ ( ১৭৬৫-১৭৭২ ) এর সময় থেকে টব্বর খা ( ১৭৯৮-১৮০১ ) পর্যন্ত চাকমাগণ বৃটিশ বিরােধী সংগ্রাম চালান । জমিদার জব্বর খা ( ১৮০১-১৮১১ ) এর সময় থেকে বৃটিশদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে চাকমারা কিছুটা শান্তিতে বসবাস করতে পারে । সম্ববত : দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ থাকার কারণে দক্ষিণে রোয়াঙ ( রামু থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব ভূভাগ এক সময় রোয়াঙ নামে পরিচিত ছিল) থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজানগরে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ’র নিকট এসে ৪০০০ দাইনাক আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল । (আমার বাবার কাছ থেকে ১৯৬৩-৬৬ খ্রীঃ সময়ে জেনেছি , তাঁর পিতামহ তারও পিতামহের মুখ থেকে শুনেছেন – রাজার অনুমতিক্রমে তাদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ রোয়াঙ থেকে আগত লোকেরা প্রথমে চন্দ্রঘোনার নিকটে সীতা পাহাড় ও রাম পাহাড় এলাকায় জুমচাষ করে ছিলেন । সেখান থেকে এক অংশ ক্রমান্বয়ে উত্তরে ওয়াগৃগী এবং অপর অংশ পূর্বে কর্ণফুলীর উপনদী কাপ্তাই ও রাইংখ্যং এর দিকে ছড়িয়ে পড়েন )।

যে কারণেই হোক, কিছু লোক অন্যত্র চলে যায় । পরিসংখ্যান সূত্রের ভিত্তিতে জনসংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পাবার কথা । অথচ ৫০ বছর পর ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তাদের সংখ্যা অবশিষ্ট ছিল ২৫০০ (ক্যা, লুইন) । একান্তই স্বজাতি বোধে এসে থাকলে কিংবা দেওয়ান পরিষদ বেষ্টিত জমিদার তাদেরকে একই চাকমা জাতি গণ্য করলে তাদের বেশীর ভাগ লোক নিশ্চয় থেকে যেত।

১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বার্মারাজ বোধাপায়া আরাকান দখল করে । বর্মীবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায় , কয়েক লাখ লোক আরাকান থেকে বিতারিত হয়ে বৃটিশ অধিকৃত পূর্ববঙ্গে , প্রধানত : চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়। ইংরেজ সরকার তাদেরকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) এবং পটুয়াখালিতে পূনর্বাসিত করে । ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে বোমাং তার মগ ( মারমা ) অনুসারীগণ সহ বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অথবা উপরোক্ত উদ্বাস্তু লোকেদের আসার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়, হয়তো জুমচাষের পাহাড় ভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণেও দাইনাকদের কিছু অংশ বসবাসের জন্য সমগোত্রীয় গণ্য করে উত্তরদিকে চাকমাদের কাছাকাছি এসেছিল । ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান সহ সমগ্র বার্মা বৃটিশের অধীনে চলে যায় । সীমান্তের বাধা নিষেধ রইল না। বৃটিশ সরকার ইতিপূর্বে উদ্বাস্তু হয়ে আসা লোকজনদেরকে পূনরায় আরাকানে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে। এটাও হতে পারে – যাযাবর জুমিয়া দাইনাকদের কিছু অংশ হয়তো তখন আরাকানে ফিরে গিয়েছিল।

১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে প্রতিবেশী বাঙ্গালীদের সংস্পর্শে থাকায় চাকমাদের ভাষাতে বহুল পরিমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ প্রবিষ্ট হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামে (১৬৬৬ খ্রীঃ পর্যন্ত আরাকানের অংশ) বসবাসের সময় এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রামী বাঙ্গালীদের সাথে প্রয়োজনে কথাবার্তায় দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যারাও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতে শেখেন ( যে কারণে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলা বলে অনেকে মনে করেন ) এবং ধীরে ধীরে তাদের ভাষায় ঐ শব্দগুলো প্রবিষ্ট হতে থাকে । তাই ভিন্নভাষী , বিশেষ করে বাঙ্গালীদের নিকট চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলারূপে আপাত : একই রকম মনে হতে পারে । তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমাদের একটি শাখা বলে গণ্য করার পেছনে এটিও একটি কারণ । অথচ চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যা সাধারণের কথা অনেক সময় বুঝতে পারেন না । একশ ‘ বছর আগে সতীশ ঘোষের লেখা ( ১৯১০ খ্রীঃ) থেকে জানা যায়- তকালে তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা নিজেদের মধ্যে আরাকানী ভাষায় কথা – বার্তা বলে আর কম বয়সীরা চাকমাদের অনুকরণে বিকৃত বাংলায় বলে । এ থেকে ধারণা করা যায়- তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চাকমাদের বেলায়ও সে একই কথা প্রযোজ্য।

জমিদার ধরম বক্স খা’র মৃত্যুর (১৮৩২ খ্রীঃ) ১২ বছর পর রানী কালিন্দী জমিদারী লাভ করেন ( ১৮৪৪ খ্রী ) । জামাল উদ্দিন তার পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ( প্রকাশ কাল ২০১১ খ্রী ) গ্রন্থে ( পৃ : ১৫৬-২৫৭ ) লিখেছেন- “ জমিদারীর কর্তৃত্ব লাভের জন্য বিপক্ষীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রানীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তঞ্চঙ্গ্যারা । ” এ কারণে পরবর্তী সময়ের জমিদার তথা চাকমা রাজাগণ তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন বলে জানা যায় । শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা’র “ তঞ্চঙ্গ্যা জাতি ” গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি- চাকমা রাজা ভূবন মােহন রায় ( ১৮৭৬-১৯৩৪ খ্রীঃ ) কবিরাজ শ্ৰী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে রাজকবি উপাধিতে ভূষিত করে রাজসভায় সমাসিন করেন । রাজা নলিনাক্ষ রায় ( ১৯০২-১৯৫১ খ্রীঃ) শ্রীমৎ প্রিয় রত্ন মহাস্থবির ( গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু মর্যাদায় ভূষিত করেন । জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( যিনি কানা গিংখুলী নামে খ্যাত ) কে ‘ রাজুগিংখুলী ’ উপাধি দিয়ে প্রতিবছর রাজপূণ্যাহ উপলক্ষে রাজসভায় সমাসিন করতেন । রাজা ত্রিদিব রায় (১৯৩৩- ২০১৩ খ্রীঃ) ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির (গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু পদে অভিষিক্ত করেন । উক্ত রাজাগণের সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মৌজা হেডম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেন । একালের প্রতীকী ‘ রাজা ’ নামে চাকমা জমিদারগণ গুণীজনদের মর্যাদা দিয়েছেন , সম্মান রক্ষা করেছেন , তঞ্চঙ্গ্যা , গোত্র বা জাতিগতভাবে ভিন্ন কি না তা বিবেচনা করেননি।

বৃটিশদের পর ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের একটা অংশরূপে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিবর্তিত হয় । জমিদারী প্রথা রহিত হয় । সমাজে শ্রেনীগত স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে । কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু আধা – সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যায় । পূর্বোক্ত দেওয়ান তথা কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতা খর্ব হয় । তা সত্ত্বেও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির (তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা , পৃ : ১১২ ) রেশ এর পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়েছিল । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কাগজের কল বসে । ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হয় , কর্ণফুলী নদীতে বাঁধের জলে উজানে ৪০০/৫০০ বর্গমাইল এলাকা হ্রদে পরিণত হলে প্রায় ৫৪,০০০ একর আবাদী জমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে । এতে ১৮,০০০ পরিবারের লক্ষাধিক লোক (অধিকাংশ চাকমা , কিছুসংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাঙ্গালী ) ক্ষতিগ্রস্ত হয় । প্রায় ৪০,০০০ লোক ভারতে ( এদের বেশীর ভাগই চাকমা এবং কিছু সংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা ) এবং ২০,০০০ লোক আরাকানে চলে যায় । এসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী পরিচালিত ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার ঘটে । এ ক্ষেত্রেও তঞ্চঙ্গ্যাদের তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায়নি ।

পাকিস্তানের সময় থেকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রসার ঘটে । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে রামগড় হাইস্কুল , ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কে , পি , এম উচ্চ বিদ্যালয় , ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি শহরে শাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিত -১৮৯০ খ্রীঃ) সহ ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের শুমারীতে মোট উচ্চ বিদ্যালয় ৭ টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ১৪ টি, এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৬১ টি (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস জামাল উদ্দিন , পৃ : ৩২৩) পাওয়া যায় । ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে নতুন রাঙ্গামাটি শহরে একটি কলেজ স্থাপিত হয় ।

বলা বাহুল্য – বিদ্যালয়গুলো অধিকাংশ চাকমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে স্থাপিত হওয়ায় সাধারণ চাকমা ছেলে-মেয়েরাই সে সুযোগ লাভ করে। মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যতীত তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশই উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ নিতে পারেনি। ফলত: শিক্ষাগত দিক দিয়েও চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয় ।

১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। বনায়নের জন্য বিস্তীর্ণ পাহাড় ভূমি অধিগ্রহণ, রাবার বাগানের জন্য ধনী ও প্রভাবশালী লোকদেরকে হাজার হাজার একর পাহাড় ইজারা প্রদান প্রভৃতি কারণে জুমচাষের ভূমি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে জুমিয়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকেদের জীবিকা নির্বাহের প্রথান উপায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশ লোক ছিল জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ; এখন তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ বাগান ইত্যাদি গড়ে তুলে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে ; চাকরী , ব্যবসা প্রভৃতি পেশাতেও প্রতিযোগীতায় পিছনে পড়ে থাকে। অধিকাংশ দিন মজুরী থেকে শুরু করে যখন যা পাচ্ছে সে কাজ করে কোন রকমে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । যাদের পক্ষে সম্ভব তারা ছেলে – মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করছেন , যদিও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তারা অনুমানিক ১০ % এর বেশী হবে না।

মূলত : জুম পদ্ধতির আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল যাযাবর দাইনাক তথা তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর লোকজন হাজার বছরের জীবন পরিক্রমায় গোত্রগত তথা জাতিগত পূর্বপরিচয় ইতিহাসের ঝরা পাতায় রেখে এখন নতুন যুগে পরিবর্তিত ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী যারা তিনশ ’ বছর পূর্বেও একই জাতিরূপে একই দেশে বসবাস করে ছিল , এখন তারা ত্রিধা বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ভারত – এ তিনটা দেশের নাগরিক। ভিন্ন তিনটা দেশে তারা তিনটা ভিন্ন নৃ – গোষ্ঠী নামে পরিচিত হবে , নিজস্ব মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও সংস্কৃতিচর্চা না থাকলে উক্ত পরিচিতিও এক সময় হারিয়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ সম্ভাবনাটা আরো বেশী প্রকট।

জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা আবশ্যক; কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশগত কারনে শিক্ষিত ছেলে – মেয়েরা নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে , পূর্বে প্রচলিত ছিল এমন অনেক শব্দ তাদের কথাবার্তায় ক্রমাগত বাংলা অথবা ইংরেজী শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে । তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় কোন সাহিত্য – সংস্কৃতির চর্চা তেমন না থাকায় তাদের ভাষার সংরক্ষণ হচ্ছে না , বিকাশও ঘটছে না । চাকমা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের একাংশ এ বিষয়ে যথেষ্ট সক্রিয়, তারা চাকমা বর্ণমালা শিক্ষাদান সহ মাতৃভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা বহু বছর পূর্ব থেকে শুরু করেছেন , প্রজন্ম পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন । তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষিত ব্যক্তি তথা বুদ্ধিজীবিগণ বলতে গেলে এখনো ঘুমিয়ে । আলাদা একটি জাতিসত্ত্বা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে- এটা আনন্দের বিষয়; এটি দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে জাতি হিসেবে চাকমা থেকে আলাদা বলতে পারা যায়। কিন্তু ইতিহাসের গতিধারায় আমরা কী দেখতে পাই ? দাইনাক চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করে আসছেন যে, সবাই (পূর্ব পুরুষগণ) একসময় চম্পক (সম্বক!) নগরে ছিলেন । কাব্য রূপে কিংবদন্তী রাধামন – ধনপদী কাহিনীও প্রত্যেকে নিজেদের পূর্বপুরুষগণের ইতিহাস (!) বলে মনে করেন । হয়তো দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষগণ অতীতে কোন এক সময় একই গোত্র বা জাতিভূক্ত ছিল । প্রবন্ধে আলোচিত বিবরণ অনুযায়ী এ কথা বললে সম্ভবত: ভুল হবে না- তঞ্চঙ্গ্যা / দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণ (সর্দারগণ) সমকালীন পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি বিধায় উত্তরসূরীগণ অগ্রযাত্রায় চাকমাদের তুলনায় পর্যায়ক্রমে পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিল । ভাষা হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জাতি হিসেবে গণ্য হবার প্রাথমিক ও মূল ভিত্তি , সংস্কৃতি হচ্ছে তার আবরণ । জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

লেখক- রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৭ ইংরেজী তে অবসরপ্রাপ্ত একজন সহকারী শিক্ষক । এবং সদস্য – সচিব, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা আহ্বায়ক কমিটি (২০০৮ ইং গঠিত) ।

তনচংগ্যাদের সামাজিক বিবাহ আইন

————– ————— ————— ——
তনচংগ্যারা বিয়ে বা বিবাহকে “সাঁ” বা “সাঙা” বলে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সচরাচর দু’রকমের বিবাহ দেখা যায়।
(ক) সামাজিক বিবাহ /নিয়মিত বিবাহ ও
(খ) পলায়ন বিবাহ/ অনিয়মিত বিবাহ।

ক. সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ:

সামাজিক বিবাহ হলো যেটা পাত্র পাত্রীর অভিভাবক বা পিতা মাতার সম্মতিতে এবং সামাজিক রীতিতে বিবাহ সম্বন্ধ ধার্য করা হয় অথবা পাত্র পাত্রী পরস্পর পছন্দের মাধ্যমে অভিভাবক সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাকেই সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ বলা হয়। সামাজিক বিবাহ আবার দুধরণের হয়।

(১) প্রথাসিদ্ধ বিবাহ:

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সামাজিক বা প্রথাসিদ্ধ বিয়ে বহুবিদ আনুষ্ঠানিকতায় আড়ম্বরভাবে হয়ে থাকে। এ বিয়ের ধারাবাহিক কার্যাবলী এরকম হয়ে থাকে। তেম্মাঙ (শলাপরামর্শ), বউ পুছা গরানা (বৌ দেখতে যাওয়া, দাভা (নূন্যতম কিছু অর্থ ধরা হয়), সাজনী বা বোয়ালী সামগ্রী (সাজার জন্য অলংকার বা পোশাকাদি), বউ হছা যানা (বৌ আনতে যাওয়া), জামাই তুলানা (জামাই বরণ), ফংগুরি দেনা (স্বামী স্ত্রী বন্ধন), সেফ ফুদা লনা (আশীর্বাদ নেওয়া), খানা সিরানা (খাবারদাবার সম্পন্ন), বউ লামাই দেনা ও বউ তুলানা (বাপের বাড়ি হতে বউকে বিদায় এবং জামাই বাড়িতে বরণ। তবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে লক্ষণীয় যে স্বামীও নিজের স্ত্রী আনতে যায়। উক্ত অনুষ্ঠানাদি সম্পাদন বাধ্য কারণ এগুলি রীতিসিদ্ধ এবং তনচংগ্যা সংস্কৃতির অংশও বটে।
(২) ঘরজামাই তুলে বিয়ে:
ঘরজামাই তুলে বিবাহ এরকম এখনো তনচংগ্যা সমাজে কম চোখে পড়ে। এটাও প্রথাসিদ্ধ ও নিয়মিত বিবাহ বলে ধরা হয়। তবে এ ধরনের বিয়ে এত্ত আড়ম্বরপূর্ণ হয়না, কনের পিতা বরের কাছে কোন ধরনের দাভা ও সাজনী সামগ্রী দাবি করে না। কনের বাপের বাড়িতে পাত্রকে ঘরজামাই তোলাত পর সামাজিক নিয়মানুযায়ী সাঙা বা সাঁ করা হয়।

খ. পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ দু’রকমের হয়ে থাকে, প্রথমত হল ছিলানী বিবাহ (সাঁঙ) আর দ্বিতীয়ত হল বউ ঘরে উঠে বিবাহ।
(ক) ছিলানী বিবাহ (সাঁ বা সাঙা)- যুবক যুবতী বা প্রেমিক প্রেমিকা উভয়ের মনোমিলনে এবং তাদেত অভিভাবকদের অসম্মতিতে অথবা এক পক্ষের সম্মতিতে প্রথাসিদ্ধ নিয়মের বাইরে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে স্বামী স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে তনচংগ্যা সমাজে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ (ছিলানী সাঁ) বলে। সাধারণত যুকব যুবতী পালিয়ে গিয়ে দূরে কোন এক আত্মীয় বাসায় আশ্রয় নিতে হয়। এরপরে আত্মীয়ের মারফতে পিতামাতাকে খবরটা জানানো হয় যে ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছে। এতে পরে গ্রাম্য শালিস হয়, গ্রামের যুবক যুবতীদের পক্ষে যুব প্রধান বা মুরব্বিরা মানে যুবতীর সমাজ যুবক (প্রেমিক) পরিবার বা তার কাছে কিছু অর্থ দাবি করে, যেটা অনেকটা অর্থদণ্ড হিসেবেও বলা যায়। তবে অর্থদণ্ড যেটা বলা হয় বেশি মোটা অংকের হয়না অনেক সময় গ্রামের মানুষেত মনোভাব ও সামর্থ্য বিবেচনায় রাখে।
(খ) বউ ঘরে উঠে বিবাহ:
অনেক সময় পরিবারের অজান্তে মেয়ে পালিয়ে যায় স্বামীর ঘরে। তবে এখানে কিছু কারণ আছে অনেক সময় পরিবারের সামর্থ্য অভাবে নিয়মিত বিবাহ পদ্ধিতে কার্যসাধন সম্ভব নয়, তাই পালিয়ে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে ফেলা হয়। এতে অল্প ক’জন গণ্যমান্য বা মুরব্বি ডেকে আশীর্বাদসহ খাবার পরিবেশন করলেই বিয়ের কার্য সমাপ্তি হয়।
তবে হ্যাঁ, প্রত্যেক বিয়ের কার্যসম্পাদনের মধ্যে ভান্তেদের মাধ্যমে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করা হয়। এতে সাংসারিক জীবন সুন্দর ও মঙ্গলময় হয় বলে তনচংগ্যারা বিশ্বাস করে।

উপরিউক্ত আলোচিত বিবাহের বাইরে আরো বেশ কিছু প্রচলিত অপ্রচলিত বিবাহ পদ্ধতি বিবাহ চোখে পড়ে। যেমনঃ
ক) কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ, খ) মিশ্র বিবাহ গ) অসাঙ্যা / নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ, ঘ) বিধবা বিবাহ।

ক. কোর্ট ম্যারেজ মূলত:

আদালতের কোন প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক তনচংগ্যা সমাজে ইদানীং কোর্ট ম্যারেজ বিবাহ পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত অভিভাকদের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্চুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে মিলে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক -এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রাচীনকালের মনোমিলনের পলায়নের আধুনিক সংস্করণ “কোর্ট ম্যারেজ”। যদিও এটি মাত্র শপথনামা, কিন্তু আইনত এ বিবাহ অনলঙ্ঘনীয়ও নয়।

খ. মিশ্র বিবাহ:

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অন্যান্য জনগোষ্ঠী সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে মিশ্র বিবাহ বলে। মিশ্র বিবাহ বন্ধন সচরাচর তনচংগ্যা শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের মধ্যে দৃশ্যমান। এই বিবাহের নেতিবাচক ইতিবাচক দুটো দিক আছে। বিশেষকরে পরবর্তী প্রজন্মে তার বেশ প্রভাব পড়ে এবং তুলনামূলক ভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকীস্বরূপ।

গ. অসাঙ্যা/নিষিদ্ধ বিবাহ:

তনচংগ্যা সমাজের প্রথা অনুসারে নিষিদ্ধসম্পর্কিত আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং তার শাস্তিস্বরূপ শুকর জরিমানা দিতে হয়। গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধে শাস্তি হচ্ছে অর্থদণ্ড। কাকে বিয়ে করা যাবে কাকে বিয়ে করা যাবেনা তার বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হলো।

ঘ. বিধবাবিবাহ:

তনচংগ্যা সামাজিক প্রথামতে বিধবাবিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা নারীও আবার বিয়ে করতে পারে। একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারের বা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একত্রে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরণপোষণ পাবার অধিকার রাখে। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামী ও শ্বশুর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে পূর্বস্বামীর সম্পত্তি পাবার অধিকার হারায়। তনচংগ্যা সমাজে একজন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ সামাজীকভাবে রীতিসিদ্ধ। তবে পূর্বেকার মতো দ্বিতীয় বিয়েটাও পিতা বা ভাইয়ের বাড়ি থেকে সম্পন্ন করতে হয়।

এবার আলোচনা করা যাক তনচংগ্যা সমাজে বৈধ অবৈধ বিবাহ কোনগুলিঃ
১. বৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
বিবাহের বেলায় ঘনিষ্ঠ কিংবা দূর সম্পর্কের কোন মামাতো, পিসতুতো, মেসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ হতে পারে। বড় ভাইয়ের শ্যালিকা, বড়বোনের ননদ কিংবা বড়ভাই মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে। শ্যালিকা বা সম্বন্ধীয় বিধবা বা তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা চলে এবং একই পরিবারভুক্ত না হলে পিতামহ বা মাতামহ সম্পর্কিত নাতি নাতনি মধ্যে বিবাহ হতে পারে।

২. অবৈধ সম্পর্ক বিবাহ:
সহোদরা ভাগ্নি, বিমাতা, ভাগ্নি, ভাইঝি, মাসি, মামী, পিসী, চাচী, জেঠি ইত্যাদি সম্পর্কীয় হলে বিবাহ করা চলেনা। সহোদর ভ্রাতাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে, একই পিতা মাতার ঔরসজাত ছেলেমেয়ের মধ্যে, স্ত্রী বড়বোন অথবা স্ত্রী বিমাতা, স্ত্রী ভাইঝি ইত্যাদি বিবাহ চলেনা এবং সামাজিকভাবে তা নিষিদ্ধ।

[তথ্য সহযোগিতায় এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা; সভাপতি, সদ্য নির্বাচিত জেলা আইনজীবী সমিতি রাঙামাটি]

The first Tanchangya artist Mr. Ratikata Tanchangya

Roti kanta

The most popular artist in Chittagong Hill Tracts is Mr. Rati Kanta Tanchangya. He is the son of Shikol Chand Tanchangya and a grandson of the richest man named Mr. Nikunja in Tanchangya community, born on 23rd of month Jesta in 1347 Bengali Year (June 6,1941) at the bank of Rainkyong,  Boradam village under the sub-district of Bilaichhury, Rangamati, Bangladesh. He is father of three sons namely, Dibyendo Tanchangya, Anupom Tanchangya, and Dipankar Tanchangya. During his service he worked in the department of agricultural expansion. 

Recognition 

Due to his dedicated service at Fine Art, he was awarded as Great Artist from the President of Bangladesh Ziaur Rahman on 1st January, 1981. Moreover, according to the examination of Bangladesh board, he has passed the examinations Sutta, Vinaya, and Abhidhamma. In 1978 he received the title of Visvakarma  from Venerable Sadhanananda (Vana Bhante). He is also recognized as a song composer of Bangladesh Radio Station in Rangamati  in Tanchangya, Chakma and Bengali.  In 1990 through Raja Devashis Rai, he was awarded as Artist and Writer in Gauhati, India. 

Contribution and Responsibilities 

Ratikanta Tanchangya introduces himself not as an artist rather as an art admirer. In 1979, he solely established the Charukola Akaedmy (Fine Art Academy), first academy in Chittagong Hill Tracts. This is the first Fine Art Academy in three Hill Districts that has established without any support  from government.  He has been supervising Rangamati Charukala Academy (Academy of Fine Arts) since 1979. Although in Chittagong Hill Tracts there were Jumma artists, practiced art before him but he was the first  person who took an initiative of teaching art to Jumma children. He not only practiced art but also had a vision of making like minded people in Jumma community. His success was indicated by many national and international prizes won by his students, while they were learning and practising art at his institute. His institution is not only changing and forwarding Jumma society, introducing art to Jumma culture but also bringing international fame for the country.  Besides his artist passion, he is also a prolific writer  and a regular columnist on Tanchangya history and culture in Bengali newspaper. 

On the one hand Mr. Ratikanta is an artist, on the other he is a song writer and poet. In 2007 during the caretaker government of Fakhruddin Ahmed, he chaired  a neutral person, member of Rangamati District Council. He is currently acting as the Chief and Principal of the Fine Arts Academy (Charu Kola Akademy) in Rangamati.

A writer being Artist

While painting arts, he also writes books. Every one of his books is well-acclaimed  and informative. His published books in Bengali are:

  1. Painting (চিত্রা) ( a book on fine art)- 1986.
  2. An Introduction to Tanchangya (original manuscript)- 1995.
  3. Tanchangya Tribe-2000
  4. Song Book (গীত পোই) in Tanchangya, Chakma and Bengali- 2008.
  5. Fine Art Practice- 2011
  6. Autobiography- 2012
  7. An Illuminated Tanchangya Buddhist Monk-2018.

He keeps writing time to time until now. He is not only a great person to Tanchangya tribe, but for the whole Chittagong Hill Tracts. His contributions towards Tanchangya tribe and the whole indigenous communities worth to be acknowledge.

কবি ও সাহিত্যিক বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

Tanchangya porichiti.jpg

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যে যেসকল মানুষের বিচরণ ছিল বা আছে তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা একজন অন্যতম। তাঁর পরিচয় ঘটে বিশেষত তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথার লেখনীতে। তিনি গ্রন্থ ছাড়াও আমৃত্যু লিখে গেছেন বিভিন্ন সাময়িকীর প্রকাশনায়। তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লেখকের পরিচয় জানা যাক-

লেখকে জন্মকথাঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৩৭ সালে ১৩ এপ্রিল তৎকালীন রাঙামাটি থানায় অন্তর্গত ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজ্যমণি তঞ্চঙ্গ্যা মাতার নাম রতিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা। পিতামাতার দুইপুত্র, এক কন্যার মধ্যে বীরকুমার সর্বকনিষ্ঠ। শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ ১৯৫৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ওই বছর কানুনগো পাড়া আশুতোষ কলেজেপড়ার সুযোগ পান। সেই কলেজ থেকেই তিনি আই.এ পাস করেন। এরপরে আর আর্থিক অভাবে পড়ার সম্ভব হয়ে উঠেনি তবে পরবর্তী তে ত্রিপিটকের “সুত্ত ও বিনয়” উপাধি পালি ও সংস্কৃত বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথমে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে চাকরি করেন, পরে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা প্রশাসনে অফিস সুপার পদে থেকে চাকরি অবসর নেন।

লেখকের সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানঃ

শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী ছিলেন। আর পরবর্তীতে তার চাকরি কর্মস্থল রাঙামাটি হওয়ায় সাহিত্যচর্চাটা বেশ ভালো ভাবে কাজে লাগান। ১৯৮৬ সালের দিকে শ্রী মদন মোহন দেওয়ান কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক “পার্বত্য বাণী” তে প্রথম সংখ্যায় “কালিন্দী” নামক ইতিবৃত্তমূলক একটা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশ পায়। এটায় শ্রী বীরকুমারের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ বলা যায়। এভাবে পরে রাঙামাটি পাবলিক লাইব্রেরি হতে তৎকালীন প্রকাশিত “অঙ্কুর” রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বনভূমি” খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত “পার্বতী”তে তাঁর বহু গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত নাটক “রুনুখাঁর উপাখ্যান” মঞ্চস্থ নাটক “অমিতাভ” যেটা গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্বলিত এবং ১৯৬৭ সালে রাঙামাটি মৈত্রী বিহারের মাঠ প্রাঙ্গণে সাফল্যের সাথে মঞ্চায়ন হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর রচিত চাকমা নাটক “মুড়া যেক্কেনে কানে” নামক নাটকটি নানিয়ারচর উপজেলায় কৃষ্ণমাছড়া গ্রামে মঞ্চস্থ হয়। “রক্ত তিলক” (জুমল্যান্ডের রাজকন্যা) নামক একটা নাটক রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট (তখন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট) গিরিনির্ঝর-এ প্রকাশিত হয়েছে। স্বদেশ ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বোধিভারতী” সাময়িকীতে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা বেতার কেন্দ্রের রাঙামাটি আঞ্চলিক শাখার গানের লেখক ও কথিকা ছিলেন। “ঢোলক/একতারা” শীর্ষক স্থানীয় আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বেতারে প্রতি মাসে প্রথম ও চতুর্থ সপ্তাহে প্রচারিত হতো। এখন আর প্রচারিত হয়না।

অবদান স্বীকৃতিঃ

সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য রাঙামাটি জেলাপরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য অঞ্চল ২০০১ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২৭ চৈত্র ১৪১৩ সালে “উপজাতীয় সামাজিক ফোরাম” শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠন “অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” সাহিত্য অবদানের জন্য এ গুণী লেখককে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।

সাহিত্যিকের লেখা বই ও নাটকঃ

১. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (গ্রন্থনা)

২. তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা।

৩. রক্ততিলক (নাটক)

৪. ভাগ্যরত্ন।

পরলোকগমনঃ

তঞ্চঙ্গ্যা ও আদিবাসী সমাজে সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণকারী ১২ নভেম্বর ২০১৪ সালে নিজ বাসায় রাঙামাটি দক্ষিণ কালিন্দীপুরে এ গুণী লেখক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর এ মৃত্যুতে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী তথা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ একজন গুণী ও প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিককে হারায়। যা খুব কম সময়ে তাঁর শূণ্যস্থান পূরণ হবার নয়। গোটা পার্বত্য অঞ্চলে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা ও লেখনীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

চিত্রশিল্পী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার সংক্ষিপ্ত জীবনী”

Roti kanta

জন্মকথাঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্রশিল্প জগতে এক অতি পরিচিত নাম শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। তাঁর পিতার নাম – শিকল চান তঞ্চঙ্গ্যা। তঞ্চঙ্গ্যা জাতির শ্রেষ্ঠ বিত্তশালী নিকুঞ্জ মহাজনের নাতী। জন্ম শুক্রবার ২৩ শে জৈষ্ঠ্যমাস ১৩৪৭ বাংলা, ১৯৪১ ইংরেজী। বর্তমান রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানাধীন ১২২ নং কুদুবদিয়া মৌজার রাইংখ্যং নদীর তীরে বড়াদম নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের দিকে চাকুরী জীবনে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর রাঙ্গামাটির অধিনে আমিন। তিনি তিন পুত্রের জনক, তাঁর পুত্রত্রয়- দিব্যেন্দো তঞ্চঙ্গ্যা, অনুপম তঞ্চঙ্গ্যা, দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা।

স্বীকৃতিঃ

চিত্রশিল্পে কৃতিত্বের জন্য ১৯৮১ ইং সনের ০১ জানুয়ারী তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গুণী শিল্পী হিসেবে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন। তাছাড়া তিনি ত্রিপিটকের সূত্র বিনয় ও অভিধর্ম উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাকে “বিশ্বকর্মা” হিসেবে উপাধি দেন। বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কর্তৃক তিনি তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গানের গীতিকার হিসেবেও স্বীকৃত। লেখক ও চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁকে ১৯৯০ সালে চাকমা রাজ দেবাশীষ রায় কর্তৃক ২০১৪ সালে ভারতের আসামে গৌহাটি শহরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

অবদান ও দায়িত্বঃ

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটি ‘চারুকলা একাডেমি’ একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী আর্থিক সহযোগীতা ব্যতিরেকে তিন পার্বত্য জেলায় এটি সর্বপ্রথম ও একমাত্র চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র-ছাত্রী জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং জাতিসংঘ পুরস্কার লাভ করতে সমর্থ হয়। শ্রীঃ রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা একাধারে যেমন চিত্রশিল্পী আবার অপরদিকে গীতিকার ও কবিও। তিনি ২০০৭ সালের এক এগারোর সময়ে ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে রাঙামাটি জেলা পরিষদের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে তাঁর হাতে গড়া চারুকলা একাডেমির নির্বাহী প্রধান ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চিত্রশিল্পী যখন লেখকঃ

এ চিত্রশিল্পী যেমন আঁকিয়েছেন তেমনি লিখেছেন। তার প্রত্যেকটা গ্রন্থ আলোচনার দাবিদার এবং তথ্যমূলক। তার প্রকাশিত গ্রন্থ গুলো হলো-

১. চিত্রা (চারুকলা বিষয়ক পুস্তক)- ১৯৮৬।

২. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (মূল পান্ডুলিপি) ১৯৯৫।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- ২০০০ সালা।

৪. গীত পোই (তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা ও বাংলা গানের বই)- ২০০৪ সাল।

৫. চারুকলা অনুশীলন- ২০১১।

৬. আত্ম চরিতাবলী (জীবনী)- ২০১২।

৭. আলোকিত তঞ্চঙ্গ্যা ভিক্ষু (২০১৮)।

এ গুণী ব্যক্তি বিভিন্ন সাময়িকীতে নিয়মিত লিখছেন এখনো। তিনি শুধু তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নয়, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা দেশের গুণীব্যক্তি। স্বজাতি ও আদিবাসী সমাজে তাঁর অবদান অবশ্য স্বীকার্য।

———– ————- ————–

তথ্য সংগ্রহকারী এবং লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক “চালৈন প্রকাশনা পর্ষদ, রাঙামাটি” -সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।

আমাকে স্বজাতির মা দাও, আমি স্বজাতির ভাষা রক্ষার মানুষ দেবো প্রারম্ভিক প্রসঙ্গ এবং কিছু প্রেক্ষাপটঃ

Tanchangya

লেখকঃ মিলিন্দ তনচংগ্যা

ভাষা সভ্যতার মতোই জীবন্ত ও ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। ভাষার রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তাই কোনো ভাষার গুরুত্ব সাদামাটাভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
ভাষার আবিষ্কার বিজ্ঞানের অন্যতম অমীমাংসিত রহস্য। গবেষকদের মতে, সভ্যতার ভিত গড়ার আগেই জন্ম হয়েছিলো ভাষার, ন্যূনতম ১ লক্ষ বছর আগে। হোমো সেপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষদের সময়কালে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আরো সুসংহত হয়। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে ঠিক কতটি ভাষার জন্ম হয়েছে ও হারিয়ে গেছে, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। বর্তমানে প্রচলিত বেশিরভাগ ভাষাই ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষা গোষ্ঠীর সদস্য। হিব্রু, তামিল, পার্সিয়ান, লিথুনিয়ান, চীনা, বাস্ক, অ্যারাবিক, আইরিশ, গ্রিক, ফিনিশ, মেসিডোনিয়ান ইত্যাদি ভাষাগুলো জনসংখ্যার হিসেব, বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রয়োজনের তাগিদেই হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। ভাষা বিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট এথনোলগ (Ethnologue) এর মতে, বর্তমান পৃথিবীতে আনুমানিক ৭,০৯৭টি ভাষা জীবিত রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। এছাড়া, মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লিখিত প্রক্রিয়া। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো শুধু মৌখিকভাবেই প্রচলিত। পরিসংখ্যান অনুসারে, গোটা দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ ব্যবহার করে মাত্র ২৩টি ভাষা। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের ভাষাগুলো যথাক্রমে- চীনা ১.২ বিলিয়ন, স্প্যানিশ ৪০০ মিলিয়ন, ইংরেজি ৩৬০ মিলিয়ন, হিন্দি ২৬০ মিলিয়ন, আরবি ২৫০ মিলিয়ন, পর্তুগিজ ২১৫ মিলিয়ন, বাংলা ১৮০ মিলিয়ন, রাশিয়ান ১৬৬ মিলিয়ন, জাপানিজ ১৩০ মিলিয়ন, পাঞ্জাবি/লাহান্দা ১০০ মিলিয়ন প্রভৃতি।

অপরদিকে, ভাষা বৈচিত্র্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ ওশেনিয়া অঞ্চলের পাপুয়া নিউগিনি। আয়তনে ৪৬২,৮৪০ বর্গ কিলোমিটার ও ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটির অধিবাসীরা কৃষি, বনায়ন ও মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। অসংখ্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির এই দেশটি, পৃথিবীর মোট ভাষার প্রায় ১২ শতাংশের মালিক, মোট ভাষার ৮৫৬টি। অর্থাৎ জনসংখ্যার হিসেব করলে প্রতি ৯,৩৪৫ জনের জন্য একটি করে ভিন্ন ভাষা রয়েছে দেশটিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৭,৮৪,০০০ জন বাস করে। বাংলাদেশের নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী ও আদিবাসী নেতাদের দেওয়া তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মোট ৪৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে ৪টি ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে ১২-১৮টি ভাষা বিভিন্ন মাত্রায় বিপন্ন। ঢাকায় অবস্থিত সরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) বাংলাসহ ৩৭টি ভাষা সংরক্ষণ ও সুসংবদ্ধ করার প্রকল্প হাতে নেয়। এদের মধ্যে আবার মাত্র কিছু জনগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপি, বর্ণমালা রয়েছে- তন্মধ্যে তনচংগ্যা, মারমা, ম্রো, চাকমা, গারো, সাঁওতাল ও মণিপুরী ভাষা অন্যতম।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রামের বনভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসীদের বসবাস। এদের অর্ধেকের জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৮% আদিবাসী শিশু প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাত্র ২% মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে, [উইকিপিডিয়া]। অধিকাংশ শিশু পাঠ্যপুস্তকের বাংলা লেখা ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পারে না। যথোপযুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতির অভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাড়ি , বনাই, ডলুই, রাজবংশী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষার বদলে বাংলার ব্যবহার শুরু করেছে।

তনচংগ্যা আমার মাতৃভাষাঃ

ভাষা মানুষের প্রথম পরিচয়, মানুষ তার মাতৃভাষায় নিজের মনের ভাব যতো না সহজে প্রকাশ করতে পারে অন্য ভাষায় এতটা সম্ভব নয়। আপনার মুখের ভাষা যেদিন হারিয়ে যাবে, সেদিন আপনার অস্তিত্ব নিভে যাবে। ভাষায় মানুষ প্রাণ এবং শ্বাসপ্রশ্বাস। জনসংখ্যায় বাংলাদেশে তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর অবস্থান চতুর্থ, যদিও সরকারি হিসাব মতে অনেক কম কিন্তু বেসরকারি ও এলাকাভিত্তিক তথ্যমতে বাংলাদেশের তনচংগ্যা প্রায় এক লাখের কম বা বেশি। তবে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে বলা যায় এখনো। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো তনচংগ্যা জাতিরও নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালার লিপি আবিষ্কার হয়েছে খুব বেশি দিন হয় নি। তনচংগ্যা বর্ণমালার লিপির কথা যদি বলতে হয় তবে সর্বপ্রথম ড. রূপক দেবনাথের কাছে ঋণ স্বীকার কর�তে হবে। কেননা নতুন কোন কিছু আরম্ভ করতে গেলে অর্থ বিত্ত এবং শিক্ষা দরকার আছে, যেটা ড. রূপক দেবনাথ করতে পেরেছিলেন।

তনচংগ্যা বর্ণমালা কাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো বা কাদের প্রয়োজনীয়তা বেশী তা বোধগম্য ছিলো না। আর বর্ণমালা গুলি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বেশ গবেষণার। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। আর এ কঠিন কাজটি সহজ করে দিয়েছিলেন ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরেট অব ডিসটেন্স এডুকেশনের সহকারী পরিচালক গবেষক ও লেখক ড. রূপক দেবনাথ মহোদয়। যিনি তনচংগ্যা বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ চার্ট তৈরি করেছিলেন। যা এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার হাতে তিনি তুলে দেন। পরে আমেরিকা নাগরিক ড. জন কিফটন তনচংগ্যা বর্ণমালা কম্পিউটারে কাজ করার উপযোগী সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন।

তনচংগ্যা ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে অনেকে মনে করে থাকেন যে, তনচংগ্যা বর্ণমালার সাথে চাকমা বর্ণমালার নকল। সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে বলি, শুধু দুই জনগোষ্ঠী কেন? তনচংগ্যা, মারমা, চাকমার এ ত্রয়ী জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালার প্রায় অনেক লিপির মিল আছে দুই চারটা একটু এদিক ওদিক ছাড়া। তাছাড়া এক থাকারই কথা কারণ পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মঙ্গোলীয় এবং আরাকান হতে যাযাবরের মতো এ দেশ হতে অন্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, কিন্তু শেখড়ের জায়গা একটা আরাকান। আর সবকটি ভাষা ইন্দো-ইয়োরোপীয় শ্রেণীভুক্ত। অক্ষর মিল থাকলেও উচ্চারণগত বেশ তফাৎ আছে। এ বর্ণমালা মিলকরণের সাথে অনেকে আবার চাকমা ও তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলে প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। যা অযৌক্তিক এবং অবান্তর। ওদের যুক্তি ভাষা নাকি ৬০% মিলে বা এক। এখন রোহিঙ্গা (রোইয়াঙ্গা)দের অনেকে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করে কারণ তাদের ভাষাও বাংলা (চাঁটগাইয়া)। কিন্তু এটা একেবারেই খোঁড়া যুক্তি। কেননা ভাষা এক হলেই জাতি এক হয় না। এটা সত্য যে, ভাষা একটি জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম উপাদান কিন্তু একমাত্র ও প্রধান উপাদান নয়। এটার সাথে আরো একটা যুক্তি যায় কিনা, মারমা জনগোষ্ঠীর সাথে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু শব্দচয়ন বা কথার সুর মিলে যায় তবে কি আমি এই দুই জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলে আখ্যায়িত করবো? যুক্তির খাতিরে অনেক যুক্তি দাঁড় করানো যায়। এখন দরকার ভাষা রক্ষার এবং প্রচার ও প্রসারের। তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর সাথে চাকমা জনগোষ্ঠীর ভাষা ও বর্ণমালা প্রায় কাছাকাছি হওয়ার কিছু কারণ আছে তার ব্যাখ্যা এভাবে হতে পারে কিনা ভাবা যায় কী?

চাকমা জনগোষ্ঠী ভাষার সাথে তনচংগ্যা ভাষার তফাৎঃ

চাকমা ভাষা আর তনচংগ্যা ভাষা ইন্দো- আর্য ভাষা থেকে উদ্ভুত। [পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট- রাঙামাটি। সম্পাদনায় শুভ্রজ্যোতি চাকমা]
কিন্তু কিঞ্চিত পার্থক্য হয় এ জায়গায় “তনচংগ্যাদের ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা সম্ভূত বাংলার আদিরূপ। বহুপালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা পরিপূর্ণ। তবে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেছেন তনচংগ্যা ভাষা আর চাকমা ভাষার মিল বা ঘনিষ্ঠতা সমধিক। সংস্কৃতরূপ অপেক্ষা পালিরূপ তনচংগ্যা ভাষা নিকটতর।
[পহর জাঙাল, সম্পাদনায়- পলাশ তনচংগ্যা, চবি/২০০৩। “তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা রূপ প্রসঙ্গ- ড. মনিরুজ্জামান”, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ]
তনচংগ্যা ভাষা আর চাকমা ভাষার তুলনা বিশ্লেষণ-
চাকমা:—-তনচংগ্যা:—-মন্তব্য
– কুদু—-কুদি/কুরি—-উ/ই; দ/র।
– হিয়্যচ–খাইয়ৎ/খিয়ৎ—-ই/আই।
– বেই—-বা’ই/ভাই—-এ/আ; ব/ভ।
-বোন—-বইন/বোঞ—-ও/অই; ন/ ঞ।
– আগ—-আহ/ আয়—-গ/হ, য়।
– জিয়্যে—গিয়্যে——জ/গ।
এ পার্থক্য থেকে অনুমান করা যায়, তনচংগ্যা ভাষা ও চাকমা ভাষা একিশ্রেণী ভুক্ত ভাষার আদিরূপ হতে পারে; উচ্চারণ, শব্দতত্ত্বগত, ধ্বনিতত্ত্বগত তার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
তনচংগ্যাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে। মোট অক্ষর/বর্ণমালা আছে ৩৬ টি। তন্মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ ৩১ টি, আর স্বরবর্ণ ৫ টি। এই বর্ণমালাতে নিজস্ব কার ফলা চিহ্ন আছে।
[চালৈন, রাঙামাটি/২০১৪ খ্রীঃ- সম্পাদনায় মিলিন্দ তনচংগ্যা। “তনচংগ্যা ভাষা, বর্ণমালা এবং ব্যাকরণ প্রসঙ্গ- লিখেছেন শ্রী: কর্মধন তনচংগ্যা,”]

অপরদিকে ভাষা বিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট এথনোলগ (Ethnologue) এর মতে, তনচংগ্যা ভাষা হলো ” ইন্দো-ইয়োরোপীয়, ইন্দো-ইরানীয়, ইন্দো-আরায়ান, ইয়েস্টার্ন আসামের শ্রেণীভুক্ত ভাষায় অন্তর্ভুক্ত।” যেটার তাদের কোড নাম্বার ISO:639-3 tnv. দেওয়া আছে। এই ওয়েবসাইট বলছে তনচংগ্যা ভাষায় প্রায় লাখের কাছাকাছি লোক কথা বলে এবং লোকেশন হিসেবে “রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উল্লেখ করেছিল। এথনোলগ এটাও উল্লেখ করেছে যে, চাকমা ভাষার সাথে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার (৫৮%-৬৭%) মিল আছে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখিত শ্রেণীর কথায় বলছে, উভয়ই একি পরিবারের শ্রেণীভুক্ত ভাষা কিন্তু সংস্কৃত রূপে সামান্য তারতম্য ঘটেছে।

আমার ভাষা কিভাবে সুরক্ষা পেতে পারে?

হাতিয়ার যেহেতু নিজের হাতে সেহেতু সেটা রক্ষা করার দায়িত্বটাও নিজের ওপর বর্তায়। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। অনেকেই বলে তনচংগ্যা ভাষা বাংলা ভাষার বিকৃতি রূপ। স্বাভাবিক, কারণ তনচংগ্যা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার বেশ মিল পাওয়া যায়। যেমন বাংলায় যা ভাত, তনচংগ্যারাও ভাত বলে। তদ্রুপ কলা, আলু, মুলা, নুন প্রভৃতি শব্দ। হয়তো নিশ্চয় এসব শব্দগুলির তনচংগ্যা শব্দ আছে অজানা কারণে আমাদের অগোচরে থেকেই গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন তনচংগ্যা পাড়ায় গেলে হয়তো তার সন্ধান মিলতে পারে। যদিও সেটা সময় সাপেক্ষ তবে অসম্ভব কিছুই নয়। ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বজাতের পাশাপাশি রাষ্ট্রের ভূমিকাও রয়েছে। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারে। এখানে রাষ্ট্র বলতে ভাষা ও সস্কৃতি রক্ষার্থে যেসব ইট পাথরের ভবন ও ব্যক্তি আছে তাদের বুঝানো হচ্ছে। ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংবিধানের বিধান আছে, পাশাপাশি চুক্তির আইন আছে। কিংবা বৈশ্বিক পর্যায়ে কিছু পলিসি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ- এর ৩৩ নং ক্রমিকের খ(২) নং উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
তাই  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মাতৃভাষা সুরক্ষার জন্য অন্তত দুটি কাজ অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন। একটি হলো, প্রাথমিক স্তরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত- প্রতিটি ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষণ ও চর্চার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
অপরদিকে আদিবাসী ভাষা সুরক্ষার তাগিদে ২০১৯ আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষ ঘোষণা করা হয় যার  উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীব্যাপী আদিবাসীদের ভাষা, বিশেষত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়ন, সমঝোতা, সুশাসন ও শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষা সংরক্ষণ ও ভাষাগুলোর উপর আসন্ন বিপদ ও ঝুঁকি মোকাবেলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা। আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দৃশ্যমান ও শক্তিশালী আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ আয়োজন করা আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষের উদ্দেশ্য।
বর্ষটি উদযাপনের জন্য নিম্নোক্ত তিনটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের ২০১০ সালের টেকসই উন্নয়ন আলোচ্যসূচি ও ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সহায়ক হবে। বর্ষটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন আয়োজন আদিবাসী জনগণ, জাতিসঙ্ঘের অঙ্গ সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারী জনগণ এবং গণমাধ্যমের জন্য সহজলভ্য হবে।
ক. ভাষাগুলোর পুনরুজ্জীবন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও উপকরণ সৃষ্টি, বিস্তৃত ক্ষেত্রে সেবা প্রদান, ভাষার ব্যবহার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে সহায়তা করা। (সহায়তা)
খ. ভাষাগুলো সংরক্ষণ, আদিবাসী শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধদের জন্য তাদের ভাষায় তথ্য, জ্ঞান ও শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি, আহরিত তথ্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং তথ্য বিনিময়ের সুযোগ সহজলভ্য করা। (অবাধ প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি)
গ. আদিবাসীদের আহরিত জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে এবং সেই সাথে তাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও ক্রীড়াকে বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিস্তৃত করা। (উন্নতি)

একইভাবে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের কিছু কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করলেও তা চলছে ঢিমেতালে। প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা হয়—প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো—এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাওঁ (কুড়ুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষায়ও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে এমনটা কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম এখনো আলোর মুখ দেখছে না।
সে অনুযায়ী আবার প্রথম পর্যায়ের পাঁচটি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। এ বছর ২০১৯ সালেও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ একই দেশে বাঙালি শিশুরা পড়াশোনা করছে চিরচেনা মায়ের ভাষায়। তাই সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকছে। বিষয়টা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, হাতিয়ার দিলাম কিন্তু হাতিয়ার চালনার জন্য যে নূন্যতম জ্ঞান দরকার সেটা দেওয়া হয় নি। মোদ্দা কথা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে আইন পলিসি আছে তা যথাযথ ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা পেতে পারে।
এতদঃ কিছুর পরেও নিজের ভাষা রক্ষার কাজে নিজেদেরকে সবার আগেই এগিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে পাড়ার ছোট ছোট শিশু কিশোর কিশোরীদের নিজের ভাষার বর্ণমালাগুলি পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেটা হতে পারে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক পর্যায়ে।

শেষের আগেঃ

জন্মের সময় আমি আমরা সবাই মায়ের মুখ থেকে মাতৃভাষায় সবকিছু শিখি, প্রকৃতির সাথে পরিচয় হই, ভূমির সাথে নিবিড় সম্পর্কে বড় হই। যখন শিক্ষালয়ে যায় তখন পরিচয় ঘটে দ্বিতীয় কোন রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে, সম্পূর্ণ নতুন চেহারায় নতুন ঢংয়ে। প্রয়োজনের তাগিদে তার দরকার আছে, শিখতে হয়। আর সেই প্রয়োজন ও শেখাটা যদি দৈনিক রুটিন কাজে রুটিরুজি হয়ে যায় তবেই গলদটা আরম্ভ হয়। ভাষা জানাটা অন্যায় কিছুই নয়, বরঞ্চ অহংকারের। তবে সেই অহংকার যেন নিজের মাতৃভাষার অপমানের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। মাতৃভাষার মধ্যে কথায় কথায় “বাংলা/ইংরেজি /চায়নিজ” প্রবেশ করার মধ্যে বুক ফুলানোর মতো কিছুই নেই।
একটা কঠিন কথা বলে লেখাটা ইতি টানবো, রাঙামাটিতে থাকা কালিন বহু তনচংগ্যা ব্যক্তিকে দেখেছি কথায় কথায় চাকমা ভাষার কথার টিউন টানে এমনকি স্বজাতি লোক কিংবা ঘরের লোকের সাথেও চাকমা ভাষায় কথা বলে। জানি সেটা লোকাল এবং কমন ভাষা, সেখানকার প্রেক্ষাপটে। তার মানে এ না যে, নিজের ভাষায় বিকৃতি আনবো, অসম্মান করব। হ্যাঁ স্পষ্টত অসম্মানই বলবো। কারণ নিজের ভাষা থাকতে তবে নিজের ঘরের বাচ্চার সাথে কেন অন্যের কমন ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করব? এটার মাধ্যমে নিজের ভাষা যেমন প্রকাশ পায় নি তেমনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাতৃভাষাটাকে বিকৃতি করা হয়েছে। এখন এরকম চর্চা যদি নিজের ঘরেই করা হয় তাহলে ঘরের বাচ্চা কী শিখছে সেটা কি কখনোই ভেবে দেখেছি? তবে কী নিরদ্বিধায় বলা যায় নিজের ঘর থেকেই মাতৃভাষার মৃত্যুর ঘন্টা বাজা আরম্ভ হয়েছে।
জানা আছে, নেপোলিয়ন বলেছিলেন – “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটা শিক্ষিত জাতি দেবো”। তাঁর উক্তির সম্মান রেখে যদি বলি “আমাকে একটা নিজের স্বজাতের মা দাও, আমি স্বজাতের মাতৃভাষা রক্ষা করার মানুষ দেবো”। যেখানে ১৬ কোটি বাংলা ভাষাভাষী লোকেরা বাংলা ভাষা হারানোর ভয়ে থাকে সেখানে লাখের মতো তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীর মামুলি ব্যাপার মাত্র। ভাষা হারিয়ে যাওয়ার পিছনে রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অযত্ন যেমন আছে তেমনি আমাদের নিজেদের অবহেলা আছে। সেক্ষেত্রে বিজাতি বিবাহ করণকে আমি নিরুৎসাহিত করব। বৈচিত্র�্যটার নামে আমি ভাষা, সংস্কৃতির আগ্রাসন চাই না।

©মিলিন্দ তনচংগ্যা।
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক “চালৈন প্রকাশনা পর্ষদ, রাঙামাটি”
-সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।