পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা , কবিরত্ন (১৯২০- ২২শে মার্চ ১৯৯৭)


ড. মনিরুজ্জামান

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য-চর্চার ইতিহাস দুই ধরণের। এক. গেঙ্গুলি তথা চারণকবিদের গীত উভাগীত, ধনপুদির গীত, ‘পুরান কদা’ কিংবা শিবচরণের (অষ্টাদশ শতক) গােসাইনলামা অথবা রামায়ণ-মহাভারত ও জাতকাদির জনপ্রিয় কাহিনীর ব্যাখ্যামূলক নীতি বা গীতিকা রচনা। 

এসব গীত গেঙ্গুলিদের সংগৃহীত, হস্তলিখিত এবং প্রাচীন চাকমা (মনক্ষেমর) ও বার্মা লিপিতে চাকমা/তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। এর সবই অপ্রকাশিত (উভাগীতের কিছু অনুবাদ যথা সলিল রায় কৃত ইংরেজি অনুবাদ ও বঙ্গীয় সংস্করণ এর ব্যতিক্রম)। গেঙ্গুলি সংগ্রহের কিছু নমুনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারে ফটোকপি হিসাবে চয়িত আছে।

এই ধরণের রচনা ব্যতীত আর যা পাওয়া যায় তা বাংলা ভাষায় রচিত পার্বত্যবাসীদের নানা গ্রন্থ ও সম্পাদিত নানা পত্রিকা ও সাময়িকা, – যার প্রধান ভাষা বাংলা। অর্থাৎ এ গুলিকে চাকমা ও অন্যানা পার্বত্যজাতির বাংলা ভাষাপ্রীতির ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রকাশ। এবং সাহিত্যের নানা দিকে নিজেদের প্রতিভা স্ফুরণের প্রচেষ্টা। 

এখানে বাংলাভাষী লেখকদের সাথে প্রতিযােগিতার কোনও প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা যায় না যদিও বাংলা সাহিত্যের (বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির) সমালোচনার যােগ্যতা তারা রাখেন এবং সেসব রচনা বাস্তবিক উপভােগ্য। 

সাহিত্যের নানা বর্গে (genre) তাদের এই পদচারণার(নাটকে উপন্যাসে গল্পে আলােচনায়। অনুবাদে ও গানে এবং মৌলিক কবিতায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা তাদের এসব সৃষ্টির প্রয়াস যথেষ্ট উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়) কোন স্বতন্ত্রমূল্য আছে বা হবে কি না তা এখনও বলার সময় আসে নি। 

তবে এই সব সৃষ্টি বা প্রকাশনার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ভাষিক ও সাহিত্যিক মূল্য একদিন হয়তবা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আজ কাল ডায়াসপােরা ( Diaspora) বা অভিবাসিতের সাহিত্যের যে মূল্যায়ন হচ্ছে, সেই রকম এসব বিভাষীদের বাংলা চর্চার মূল্যও যে কালের দাবী হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে? এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় আমরা রাজস্থলী (কাপ্তাই) এক অস্ফুট কিন্তু অসাধারণ এক প্রতিভা কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার পরিচিতি প্রদানে প্রবৃত্ত হবাে।

পটভূমিঃ

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর পার্বত্যবাসীদের উল্লেখ করে প্রমথবিশী বলেছিলেন, বঙ্গভূমি কেবল পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলাই নয়, পার্বত্য বাংলাও। যাই হােক, বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় পার্বত্যবাসীরাও বাংলা চর্চায় আগ্রহী হন। 

যদিও নন্দলাল শর্মার ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের অবাধ বিচরণের সংবাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত’। যাই হােক তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস চাকমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের সাথে যুক্ত। 

একথা সত্য যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রথম আলিঙ্গন জানান চাকমা রাজবাড়ির প্রধান পুরুষগণ। তবে যতদূর জানা যায় এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়েরও একটি সক্রিয় ভূমিকা আছে। স্কুলটি বিশ শতকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘােষ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ত্রয়ােদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (কলিকাতা, ১৩১৪) ‘চাকমাদিগের ভাষা তথ্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। 

পরে তিনি (সম্ভবত রাজবাটির উৎসাহ ও প্রণােদনায়) ‘জ্যোতি’ পত্রিকার লেখক গগনচন্দ্র বড়ুয়ার সূত্র ব্যবহার করে ও বহু শ্রম স্বীকার করে ‘চাকমাজাতি’ ( ১৩১৬ সন) শীর্ষক একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। 

সিবিলিয়ানদের পরে ও বাংলাভাষাতে এটিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বঙ্গীয় অম্বেষণ। এক দশক পরে রাজা ভুবনমােহন রায়-এর ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এটিই চাকমাদের কর্তৃক বাংলা চর্চার আদি নির্দশন। 

তবে কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় (বিচিত্রা, দেশ প্রভৃতি) রাজ পরিবারেরই লেখা কিছু কিছু গল্প কবিতা এর আগেও প্রকাশিত হয়ে থাকবে। কুমার কোকনদক্ষ রায়ের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। 

যাই হােক, বাংলা ভাষা চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা দানে পরবর্তী কালেও রাজবাটির উৎসাহের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রানী কালিন্দী রায়, রানী বিনতা রায়, রাজা নলিনাক্ষ রায়, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, এঁরা সকলেই যেমন নিজেরা যােগ্যতার সাথে বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছেন, তেমনি অন্যদেরও সে সুযােগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা-চর্চার এই পরিবেশটি আসলে গড়ে ওঠে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকেরও মধ্যকালে এসে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্য- পটভূমিতেও নানা পরিবর্তন যােজিত হতে থাকে। 

নতুন পত্র পত্রিকার আবির্ভাব, উনিশ শতকের সাহিত্যের ভিন্ন মূল্যায়ন, মাক্সির্য় দর্শনের প্রভাব, লােকসংস্কৃতির পঠনপাঠন (কবি জসীম উদদীনেরও আবির্ভাব এই সময় : রাখালী ও কর’ ১৯২৭, নকশীকাঁথার মাঠ ১৯২৯, সােজন বাদিয়ার ঘাট ১৯৩৩ প্রভৃতি) এবং রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নৰ জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ‘কাল-চিহ্ন’ বহন করে চলছিল সময়ের নিম্নবাহী স্রোত। 

সমকালীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আধুনিকতার নামে এক ‘তিমির তীর্থ’ পরিক্রমণে উদ্যোগী তখন। এই পটভূমি বৃহত্তর দেশ ও তার সংস্কৃতিকে অন্যরকম প্রতিক্রিয়ার মুখােমুখি করে। অর্থাৎ একদিকে এক ধরেণর নম্রজাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে নাগরিক বােধ সৃষ্টি ও বিশ্বমুখিন চেতনা বিকাশের নামে শিকড়বিহীন যে আধুনিক সাহিত্য ও নব সংস্কৃতি সৃষ্টি, তার প্রতি অনীহা সংস্কৃতি- সচেতন মানুষকে তার অন্তবােধের প্রতি বিশ্বস্ত হতে প্রেরণা যােগায়। 

বৃত্তের মধ্যে যে কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির কথা বলা হয়। এখানে যেন তারই উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। এইভাবেই কেন্দ্র থেকে দূরে প্রান্তীয় অবস্থানে বাংলাভাষার লােকজ, আঞ্চলিক বা গ্রামীণ, এবং উপসীমান্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠতে থাকে। 

রেঙ্গুনে ‘বুদ্ধবাণী’ প্রকাশ ও পার্বত্য চট্টগ্রােম ছাত্র সমিতির মুখপত্র ‘প্রগতি’ প্রকাশনা (যদিও অস্থায়ী) এবং রাঙ্গামাটিতে গৈরিকা-গােষ্ঠীর উত্থান তারই প্রামাণ্য বহিঃপ্রকাশ। 

গৈরিকা’র প্রভাবে ও গৈরিকা’র অবর্তমানে পরে আরও কিছু পত্রিকার ও আবির্ভাব ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। ‘গৈরিকা’র প্রকাশ কাল (১৯৩৬- ১৯৫১), পরে বান্দরবানে ‘ঝরণা’ (১৯৬৬), এবং আরও পরে রাঙ্গামাটিতেই ‘বনভূমি’, ‘পার্বত্যবাণী’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ‘পার্বত্যবাণী’ সম্পাদনা করেন বিরাজমােহন দেওয়ান (১৯৬৭-১৯৭০;মােট সংখ্যা ২৬টি)। এতে আগরতারা ও উভাগীত এবং রাজ পরিবারের অনেকের রচনা ও স্মৃতি কথাও (রানী বিনীতা রায়ের জীবনস্মৃতি সহ) প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বিশেষ করে রাঙ্গামাটি থেকে পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশিত হলেও (বিস্তৃত তালিকার জন্য বর্তমান লেখকের গােষ্ঠী পত্রিকা ও সাময়িকী ২০০৬ দেখা যেতে পারে। এছাড়া নন্দলাল শর্মারও একটি সমীক্ষা রয়েছে)। ‘গৈরিকা’র ভূমিকা ঐতিহাসিক। ‘গৈরিকা’র নামকরণেরও ঐতিহ্য আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। রানী বিনীতা রায়ের পরিচালনায় রাঙ্গামাটি থেকেই এটি প্রকাশিত হয়। 

রাজা নলিনাক্ষ রায়ের প্রয়াণে তার স্মৃতি সংখ্যাটিই এর শেষ সংখ্যা ছিল (১৯৫১)। প্রভাতকুমার দেওয়ান ও পরে অরুণ রায় পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। অরুণ রায়ের প্রথম প্রকাশ ‘বুদ্ধবাণী’তে (রেঙ্গুন)। 

আরও অনেকের প্রাথমিক প্রস্তুতি বাইরের, তন্মধ্যে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ও রবীন্দ্রপ্রভাবিত গীতিকার চূণীলাল দেওয়ানের কথাও বলা যায়। কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের কথা আগেই বলা হয়েছে। 

কিন্তু নন্দলাল শর্মার উক্তিটি সমর্থন করে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালে চাকমা ভাষায় যে কবিতা চর্চা হচ্ছে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে ‘গৈরিকা’। নন্দলাল শর্মা গৈরিকা’র লেখকদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন এভাবে। 

প্রভাত কুমার দেওয়ান, অরুণ বা, কন্যার কোকনদাক্ষ রায়, বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ান, রানী বিনীতা রায়, অবিনাশচন্দ্র দেওয়ান, কালাঞ্জয় চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান, ভগবানচন্দ্র বর্মন, শেখর দেওয়ান, ও সােমেন দেওয়ান (আসলে বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ানের দুটি ছদ্মনাম), কুমার বিপাক্ষ রায়, গােপাল চন্দ্র গুর্খা, তনুৱাম খীসা, নীলা রায়, বিপুলেশ্বর দেওয়ান, রাজা নলিনাক্ষ রায়, চমীকাল দেওয়ান, শান্তি রায়, সুনীতিজীবন চাকমা, গিরীন্দ্র বিজয় দেওয়ান, নীরােদরঞ্জন দেওয়ান, কুমার রমণী মােহন রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, জগদীশ চন্দ্র বর্মন ও রাজেন্দ্রনাথ তালুকদার। 

এই তালিকায় হয়তাে আরও দু একটা নাম যুক্ত হতে পারে যেমন, কুমার কুবলয়াক্ষ রায়, সৌমেন্দ্র নারায়ণ দেওয়ান, নােয়ারাম চাকমা, বেণীমাধব বড়য়া প্রভৃতি। পরবর্তীতে আমরা এমন অনেককে পাই যাদের নাম এই তালিকায় পাই, যেমন- বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়কেতন চাকমা বা মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা প্রভৃতি। 

হতে পারে গৈরিকা-গােষ্ঠী ভুক্ত ছিলেন না তারা। সেই রকমই একটি নাম হল কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯২০-২২শে মার্চ ১৯৯৭)। 

তিনি কোনও দলভুক্ত হয়ে সাহিত্য চর্চার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি স্বাধীনভাবেই সাহিত্য চর্চা করেছেন, যদিও ‘পার্বত্যবাণী’তে তাঁর কিছু রচনা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। 

অন্য পত্রিকায়ও তার রচনা প্রকাশিত হয়ে থাকবে। বস্তুত কার্তিকচন্দ্রের আবির্ভাব কালের সময় ও পরিবেশ ছিল এটাই। অবশ্য তাঁর প্রথম আবির্ভাবের তথ্যটি অর্থাৎ প্রথম রচনা প্রকাশের তথ্য এখনও অস্পষ্ট। তাঁর অনেকগুলি পান্ডুলিপি পাওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা স্বীকার্য। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ভূমিকা ও অবস্থান 

কবি কার্ত্তিকচন্দ্র যা কিছু রচনা করেছেন তা মূলত বৌদ্ধ সাহিত্য এবং তাঁর সবই বাংলা ভাষায় রচিত। তিনি কি বৃহত্তর পাঠকের চিন্তা থেকেই তা করেছিলেন? তঞ্চঙ্গ্যা সমাজেই বা তার অবস্থান কোথায়? – এ প্রশ্নের উত্তরে ও বিশ শতকের তৃতীয় দশকেই যেতে হবে আমাদের, যখন পালিসাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন বিলাইছড়ি রাইংখ্যং-এর আশাছড়িমুখ নিবাসী এক লােক চিকিৎসক- কবি পমলাধন।

পমলাধনের সমকালে বা সামান্য আগে শরৎ রােয়াজার এবং চূনীলাল দেওয়ানের সংগীত ও কাব্যচর্চার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেন (দ্রষ্টব্য, নন্দলাল শর্মা, ঐ), কিন্তু। তাদের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। 

পলাধন ধর্ম- সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি। তারই যােগ্য উত্তর পুরুষ কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। পলাধনের সাহিত্যকে বিস্তৃত করেন তিনি। এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়েই তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থানকে উজ্জ্বল করেন এই দুই কৃতিমান পুরুষ। 

কার্তিকচন্দ্রের জন্ম হয় ১৯২০ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর । তিনি চাকমা জাতির ইতিকথা’র বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমকৃষ্ণা দেওয়ান এর সমবয়সী এবং বিরাজ মােহন দেওয়ান (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত), প্রভাতকুমার দেওয়ান (গৈরিকা-সম্পাদক), চূনীলাল দেওয়ান (চাকমা কবিতা, জুমিয়া গৃহিণী –লেখক), কবি অরুণ রায়, গল্পকার জগদীশ দেব বর্মন, প্রবন্ধকার ভগবানচন্দ্র বর্মন, ‘প্রগতি’ সম্পাদক শরৎচন্দ্র তালুকদার ও সুনীতিজীবন চাকমা, কবি-অনুবাদক সলিল রায়, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি’র লেখক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখের তিনি সমকালীন বা অগ্রজ। তাঁর “বৌদ্ধগল্পমালা’ (১৩৯৬) গ্রন্থের ভূমিকায় (আমার কথা) প্রদত্ত দুটি তথ্য নিম্নরূপ:

“… রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া শাক্যমনি বিহারের অধ্যক্ষ বৌদ্ধসাহিত্য সুসাহিত্যিক ও সুপন্ডিত শ্রীমৎ প্রিয়দর্শী মহাস্থবির মহােদয় আমার রচিত এই বৌদ্ধগল্পমালা পুস্তকের পান্ডুলিপিখানা আগাগােড়া পড়ে আমাকে ধর্ম প্রচারের জন্য বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেন। আমি মহাস্থবির মহােদয়ের নিকট চির কৃতজ্ঞ। 
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটী সরকারী কলেজের বাংলার অধ্যাপক বাবু নন্দলাল শৰ্মা তাঁহার লিথিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের (বাংলা) সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ পুস্তকে আমার রচিত পুস্তক সমূহ বিশেষভাবে সমালােচনা করে আমাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রেখেছেন।”…

দুটি মন্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য তাঁর অপরাপর গ্রন্থেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ কবি তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনও না কোনও ধর্মগুরু বা রাজগুরুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং ধর্মপ্রচার ও মানুষের মঙ্গলের বিবেচনাকেই সেখানে প্রধান্য দিতে দেখা গেছে। 

মহাস্থবির মহােদয়ের প্রভাবে তিনি এই গ্রন্থ শেষেও বলেছেন, ‘এই পুস্তকের দ্বারা ধর্মপ্রাণ নর-নারীগণের যৎসামান্য উপকারে আসলে আমার রচনা শ্রম সার্থক মনে করবাে।’ এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৩৯৪/১৯৮৭ ইং। অর্থাৎ এর আগেও তিনি যেসব ধর্মকেন্দ্রি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেমন- মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বুদ্ধ সালামী গাথা (১৯৮৫) কিংবা যেসব রচনার পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে যেমন – রাধামন ধনপতি প্রভৃতি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােক গাথা এবং “অশােক চরি” নামীয় একটি চরিত কাব্য ও অন্যান্য কিছু রচনা, – সেগুলিরও প্রত্যেকটি মধ্যেই কবির এই ধর্মপ্রীতি ও ধর্মপ্রচারের আকাঙ্খা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

আগেই উল্লেখিত হয়েছে, (১৯৩৬ সালে) পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘ধর্মজ জাতক’ গ্রন্থটি মূল পালি থেকে পদ্যানুবাদ করে বা পদ্যরীতিতে ভাবানুবাদ করে এবং তৎসহ ‘ধর্ম্ম হিত উপদেশ’ সংযােজন করে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সাহিত্য রচনার সূচনা করেছিলেন, কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাকেই আদর্শ হিসাবে নিয়েছেন। 

এই সাহিত্যের শাখাকে বিস্তৃত করাতেই মনােযােগী হয়েছেন তিনি। কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন, দুই ভাবে- মননী মেধা প্রয়ােগে (যেমন, তত্ত্ব- কাব্য ও ধর্মকাব্যের মাধ্যমে) ও সৃজনী মেধার মাধ্যমে বা মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ চরিত কাব্য, কাহিনী বা গাথা কাব্য ও কাব্য নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে। 

রচনার বিষয় ও তার সরস প্রকাশ, নাটকীয় গুণ ও কাব্যবােধ মিলিয়ে উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সকল সৃষ্টিতেই। উল্লেখ্য কার্ত্তিকচন্দ্র ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’র সাথে পমলাধনের ‘ধর্যধ্বজ জাতক’ গ্রন্থটিও সম্পাদিত ও সংশােধিত আকারে প্রকাশ করেন। 

এই কারণে তিনি রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক “পন্ডিত” ও ‘উদয়ন যন্ত্র’ রচনার জন্যে প্রিয়দর্শী মহাস্থবির কর্তৃক “কবিরত্ন” উপাধি লাভ করেন রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির আয়ােজনে। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা রচনা পরিচিতি 

কবি তাঁর একাধিক গ্রন্থে অধ্যাপক নন্দলাল শর্মার উল্লেখ করে বলেছেন তিনি তাঁর (কবির) গ্রন্থের মূল্যায়ন করেছেন, এজন্য তিনি তাঁর (অধ্যাপক শর্মার) কাছে কৃতজ্ঞ। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ (১৯৮১) পুস্তিকায় নন্দলাল শৰ্মা পাহাড়ী বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার কথাও এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। উক্ত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে কার্ত্তিকচন্দ্রের মূল্যায়ন সমূহ আমরা প্রথমে তুলে ধরতে চাই। তা নিম্নরূপ –

১. উদয়ন বস্তু:

১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘উদয়ন বস্তু’। পয়ার ছন্দে লিখিত এবং ছাব্বিশটি ছােট ছােট অধ্যায়ে বিভক্ত। এই কাব্য গ্রন্থে বর্ণিত শ্যামাবতীর কাহিনী যুদ্ধের সমকালীন ঘটনা হলেও অনেকটা বুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা সম্বলিত। 

বার্মায় ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vathu) অনুসরণে কাব্যটি রচিত। কর্মফলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কবি এ কাব্যের শেষাংশে বলেছেন- 

“দানশীল ভাবনাতে মন কর স্থির
কুশল কর্মেতে লিপ্ত থাক সদা ধীর।”

২. অনাগত বংশ : 

“অনাগতবংশ’ নামে তিনি একখানা কাব্য প্রণয়ন করেছেন। বর্মী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন চিনি অং মাষ্টার। সেখান থেকে কার্তিক বাবু সরল পয়ার ছন্দে বইটি রচনা করেন। এ কাব্যে আর্থমিত্র প্রমুখ অনাগত বৃদ্ধদের সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণিত হয়েছে।” (পৃ. এগার)

৩. বিজয়গিরি:

“মূলত কবি হলেও কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (জন্ম ১৯২০) দু’খানা নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকদ্বয় প্রকাশিত হয় নি। ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘বিজয়গিরি’ চার অঙ্কের নাটক। 

চম্পক নগরের রাজা উদয়গিরির পুত্র বিজয়গিরিকে রাজ্যভার অর্পন করে শ্রী বৌদ্ধ মন্দিরে গমন করতে চান। কিন্তু বিজয়গিরি বের হতে চান দিগ্বিজয়ে। এ সময় উদয়পুরের রাজা জংলী কুকীরাজ কালঞ্জয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁদের শরণাপন্ন হন। 

বিপুল বিক্রমে বিজয়গিরি মিত্ররাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোয়াং দেশের রাজা মঙ্গল উদয়পুর লুণ্ঠন করতে আসলে সেনাপতি তা প্রতিহত করেন। বিজয় অভিযানে বের হয়ে বিজয়গিরি রােয়াং রাজ্য জয় করেন। এই হল নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। 

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি অনুগত থেকেও নাট্যকার কতিপয় কাল্পনিক চরিত্র-নাগরিকগণ, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, গয়ারাম, গঙ্গরাম প্রভৃতি চরিত্র উপস্থাপন করে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। 

এ নাটকের সংলাপ কখনাে গদ্যে আবার কখনাে মিলহীন প্রবহমান। পয়ার ছন্দে রচিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কথনাে দৃশ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে। বিবেক চরিত্র ও সংগীতের সংযােজন নাটকটিকে যাত্রাভিনয়ের মর্যাদা দান করেছে।” 

৪. মানুষ দেব :

“ ভগবান গৌতম বুদ্ধের অতীত (জাতক) কাহিনী অবলম্বনে কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ‘মানুষ দেবতা’ নামে তিন অঙ্কের একখানা নাটক রচনা করেছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। 

মঘবা নামে বােধিসত্ত্ব মানুষকে পঞ্চশীল পালনে ও জনহিতকর কার্যে উধুদ্ধ করেন। মাতালদের বিচার করে উৎকোচ করত মন্ডল। মদ্যপান বন্ধ হয়ে গেলে সে মঘবাকে ডাকাত বলে রাজ সমীপে নালিশ করে। বিনা বিচারে মঘবার শাস্তি হয়। কিন্তু মহমী মঘবাকে পদলিত না করায় রাজা নিজের ভুল বুঝে মঘকে মুক্তি ও মন্ডলকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। 

জাতকের এ কাহিনীকে যাত্রাগানের মত নাট্যকার উপস্থাপিত করেছেন। আধুনিক নাট্যকলা শ্ৰী তঞ্চঙ্গ্যার নাটকে অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনাই তাঁকে নাট্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।” 

৫. রাধামন ধনপুদি গেঙ্গুলী গীত : 

“ বান্দরবান মহকুমার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হেডম্যান ও জনসাধারণের একমাত্র মুখপত্র ত্রৈমাসিক ‘ঝরণা’র প্রথম সংখ্যার ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয়। 

… চার সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ‘ঝরণা’ বন্ধ হয়ে যায়। ঝরণা’তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘রাধামােহন ধনবতী কাহিনী অবলম্বনে ‘গেঙ্গুলী গীত’ … ইত্যাদি।”

৬. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষাঃ

শ্রী নন্দলাল শর্মার বর্ণিত গ্রন্থে কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এই পাঁচটি গ্রন্থের বিবরণ ছাড়া আর একটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় গ্রন্থের পরিশিষ্টে ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের তালিকাংশে। উক্ত গ্রন্থের নাম ‘বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা’। 

গ্রন্থটির প্রকাশকাল দেওয়া নেই এবং প্রকাশের স্থানে উল্লেখ আছে (রাইংখ্যং মুখ?), অর্থাৎ প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যটি অনিশ্চিত বা অজ্ঞাত। এছাড়া ‘পার্বত্যবাণী’ পত্রিকায় বা অন্যত্র ও অন্যভাবে কবি যে ‘কালেভদ্রে’ দুএকটা কবিতা প্রকাশ করেছেন তার উল্লেখ আছে কিছুটা সমালােচনার ভঙ্গিতে-

“কবি অরুণ রায় ও কবি কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা সত্তরের দশকে নিজ নিজ কাব্য প্রতিভার অবক্ষয় অপরােক্ষ করলেও কালে ভদ্রে দু’চার চরণ। কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না।”

পাঁচ. কবির মাধ্যম, প্রকরণ ও মূল্যায়নঃ কবির পূর্ণ গ্রন্থতালিকা এটি নয়। বর্ণিত তালিকা ও বিবরণ থেকে কবির একটি সামান্য পরিচয় মাত্র লাভ করা যায় যা অধ্যাপক গবেষক নন্দলাল শর্মা পরিশ্রম সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 

আমার অপর ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তনচংগ্যার সহায়তায় আমি একটি শ্রেণীকৃত রচনা তালিকা তৈরীর প্রয়াস পেয়েছি, সেটি পরিশিষ্টে যােগ করা হল। 

কবির রচনাপঞ্জি (আংশিক নয়) নির্মিত না হলে এবং সমুদয় রচনা প্রকাশিত না হলে। তাঁর সম্পর্কে পূর্ণ মূল্যায়ন অপেক্ষিত থাকে। আমরাও এখানে কবির কর্মের সম্পূর্ণ মূল্যায়নে বিরত থাকলাম তার অধিকাংশ রচনাই অপ্রকাশিত থাকার কারণে।

কবির মূল রচনা সমূহ কাব্যাকারে রচিত, যদিও এসব রচনা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত, যথা রাধামন ( রাধামােহন)-ধনপুদি (ধনবতী) গাথা একটি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােকগাথা শ্রেণীর, অশােক চরিত একটি কাব্যনাট্য শ্রেণীর, অনাগত বংশ একটি মিশ্র রীতির রচনাগুচ্ছ, অধিকাংশ নাটক আবার পালা বা যাত্রা জাতীয় এবং কাব্য শ্রেণীর গ্রন্থগুলি ধর্মদেশনা ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক। কবির সব রচনাই আবার পয়ার ছন্দে বদ্ধ। 

তাঁর প্রবন্ধ সমূহ ও কিছু কিছু গীতি ও নীতি কবিতা এর ব্যতিক্রম মাত্র। অধিকাংশ বা প্রায় সমুদয় রচনা বাংলা ভাষায় রচিত হলেও ‘বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা’ (১৯৮৫) এই বার পৃষ্ঠার প্রার্থনামূলক গ্রন্থটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। তাঁর ভাষার নমুনা এই রূপ – 

বুদ্ধ ধৰ্ম্ম সংঘ গুণ 
ভাবনা গরং মনত্তুন। 
কায়ামনে কধায়ে,
ভজন গরং সদায়ে। 

এখানে ভাষাই পরিবর্তিত হয় নি, ছন্দরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। 

ছয়. পরিশিষ্ট – ১ 

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের প্রকাশনা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য

১. বৌদ্ধ শিক্ষা (১৩৪৬) ও ২. উদয়ন বন্ধ (১৩৬৮):

“মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪) গ্রন্থের ভূমিকায় (‘আমার কথা’) উল্লেখ আছে : “আমি ইতিপূর্বেও কয়েকখানা বই লিখেছিলাম। ১৩৪৬ সন বাংলাতে ‘বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামক একখানা বই লিখে প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করেছিলাম। 

আর ১৩৬৮ বাংলা সনে উদয়ন বস্তু” নামে একখানা বই লিখে, তাহা প্রেসে ছাপিয়ে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নর-নারীগণের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আরও কিছু বই লিখেছি। কিন্তু ছাপাকারে প্রকাশ হয়নি। …” 

৩. উদয়ন বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮/১৯৬১ ইং), গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১৩০ 

গ্রহারম্ভে ‘মূল গাথা’, ‘পরিচিতি’ ও ‘আমার কথা’ যুক্ত ‘পরিচিতি থেকে উদ্ধৃতি- 

“অপ্রমাদ মূল পাথা ভাষিত যখন 
মহারাজ উদয়ন সময়ে তখন। 
আরম্ভ করিব গল্প কাহিনী বিস্তার,
কার্তিক তঞ্চঙ্গ্যা রচে শ্বায় পার।” 

“আমার কথা” 

“বৌদ্ধধর্ম কর্মহী; লােকে যাহা কর্ম করে তাহাই কর্মের ফলরূপে ভােগ করিয়া থাকে। ‘উদয়ন বন্ত্র’ গল্প কাহিনী কর্মফলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ ।…

বার্মার ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma ( ধর্মের আলাে) নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vatlu) ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে ‘উদয়ন বন্ধু’ নামকরণে এই পুস্তক প্রণয়ন করিলাম ।…”

সূচিপত্র

বিষয় – দুইবন্ধু – উদয়ন- উদয়নের রাজ্যলাভ – অভিষেক উৎসব- তৃষ্ণালয়ে জন্ম দাসীর ভাগ্য- সাধু সঙ্গ লাভের ফল- কৰ্ম্মফল ভুগিতে হয়- কৰ্ম্ম রাখে যারে কে মারিতে পারে- ঘােষক শ্ৰেষ্ঠী- সুখ দুঃখ চক্রবৎ-শ্রেষ্ঠী কুমারী শ্যামাবতী- মহারাজ চন্দ্র প্রদ্যোতরাজকুমারী বসুল দত্তা- দ্বিজ নন্দিনী মাগন্দ্বিরা – অর্দ্ব উপোসথের ফল- কৌশাম্বীতে বুদ্ধের শুভাগমন- কুজোত্তরা- মাগন্দ্বিয়ার শক্রতা- শ্যামাবতীর বর লাভ কৰ্ম্মফলমাগন্দ্বিয়ার সাজা- ভিক্ষগণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশ- উপসংহার । 

৪. মহাৰােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); গ্রন্থ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮। প্রকাশকের (শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: ভিক্ষু) নিবেদন’… ভগবান বুদ্ধের অমৃতময় দেশবাণীকে প্রচার করা (র) … সংকল্প পােষণ করে আমার দায়ক শ্রদ্ধাবান উপাসক কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচিত ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ তৎসঙ্গে স্বর্গীয় কবিরাজ মশাধন তঞ্চঙ্গ্যা রচিত ‘ধৰ্ম্মধ্বজ জাতক’ বই খানা … প্রকাশ করতে কৃত সংকল্প… হলাম । এই পুস্তক প্রচারের দ্বারা ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নরনারী গণের যৎকিঞ্চিৎ উপকার হলে আমার আশা পূর্ণ হবে।’ 

আমার (গ্রন্থকার) কথা- 
‘মহাকারুণিক শান্তা তথাগত ভগবান গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে আমি বহুদিন ধরে আশা পােষণ করে আসছি।… বুদ্ধের… এসব বিষয়ে সর্বসাধারণের সহজে যাতে বােধগম্য হতে পারে মােটামুটি এক নজরে বুদ্ধকে জানবার জন্য আমি ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ নাম দিয়ে এই বইখানা… মহাবােধি পালঙ্কের আদি বিবরণ সরল বাংলা পয়ার ছন্দে লিখে… পাঠ করে শুনালে শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: স্থবির বইখানা প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি শ্রদ্ধেয় ভান্তের নিকট চির কৃতজ্ঞ।’ 

উৎসর্গ – 
‘স্বর্গীয় পিতৃদেব আন্তখা তঞ্চঙ্গ্যা (কালাবৈদ্য) স্বর্গীয় মাতৃদেবী মনপুরি তঞ্চঙ্গ্যা – তাঁহাদের পূণ্য স্মৃতি স্মরণে’ । (১০ ঢরণের কবিতা সহ)। 
বিষয়: বন্দনা – মাতাপিতা গুরু বন্দনা – মহাবােধি পালঙ্ক কথা – কুলপুত্র নন্দিয় কথা। 

৫. ধর্মধ্বজ জাতক : কবিরাজ পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রণীত, পন্ডিত শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবি রত্ন কর্তৃক সংশােধিত ও সম্পাদিত ১৩৯০: পৃ. ৩৯-৮০। সুচিপত্র। বন্দনা- সূচনা- বারমাসী পুরীর বর্ণনা- বিনিশ্চয় বিচার- ধর্থ ঋজকে পঞ্চকৰ্ম্ম আদেশ-বিশ্বকৰ্মাকর্তৃক গজদন্ডময় গৃহ নিৰ্মাণ- ছত্রপানি কর্তৃক চণ্ডুবিধ গুণ।

ব্যাখ্যা- রাজা যশাপানিকে পঞ্চজের উপদেশ দান- কবিরাজ পমপান তঞ্চঙ্গ্যা সংক্ষিপ্ত জীবনী।

৬. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (১৯৮৫/২৫২৯ বুদ্ধাব্দ) 
উৎসর্গপত্রঃ ‘আমার পিতামহ পরম উপাসক স্বর্গীয় শােভাধন তঞ্চঙ্গ্যা ও তাহার সহধর্শিনী উপাসিকা স্বর্গীয় কইবী তঞ্চঙ্গ্য-এর পূণ্যস্মৃতি স্মরণে’। (১২ চরণের কবিতা সহ)

সাত, পরিশিষ্ট -২

কবিরত্ন কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচনাসমূহ
(শ্রেণীকৃত তালিকা) 

১। প্রকাশিত গ্রন্থ (কাব্য বা ধৰ্মকাব্য)
ক. ভাষা: তঞ্চঙ্গ্যা- বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা (আগষ্ট ১৯৮৫)। 
খ. ভাষা: বাংলা – বৌদ্ধশিক্ষা (১৩৪৬); উদয়ন বস্তু বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮); মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); বৌদ্ধ গল্পমালা (১৯৮৭)। 
২। সম্পাদিত গ্রন্থ 
ক. ধৰ্ম্ম ঋজ জাতক – পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা মূলগ্রন্থের সংশােধন ও সম্পাদনা (১৩৯০)। 
৩। প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ-
ক. লােকগাথার কাব্যরূপ ঐতিহাসিক) : রাধামন ধনপুদি কাব্য। 
খ. চরিত কাব্য: অশােক চরিত (রচনা ১৯৮৩); অনাগতবংশ। 
গ. নাট্য কাব্য (ঐতিহাসিক) : বিজয়গিরি। 
ঘ. চরিত নাটক (ধর্মীয়); মানুষ দেবতা। 
ঙ. তপ কীর্তন ও যাত্রা পালা । বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা (রচনা ২৫/০৪/১৯৮৫) শ্রীবুদ্ধের বারােমাস স্মৃতি (রাজস্থলী মৈত্রী বিহার প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ, ২৬/০৩/১৯৭৮) 
চ. বিবিধ শ্রেণীর কল্পতরু দান ফল কথা; বন্দনা ও দান ফল কথা; অক্ষর গাথা। 
৪। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা – 
ক. ‘নববর্ষ’। রাজবলাকা (১৫ এপ্রিল ১৯৮৭ সংখ্যা)। 
খ. ‘আশ্বিনী পর্ণিমা’। নৈরঞ্জনা (সম্পা, সয় চাকমা, ২০ আশ্বিন ১৩৮৮ সংখ্যা)। 
গ. দেবৱিলােকন’। সম্বােধি (সম্পা. ভিক্ষু শদ্ধা প্রিয়, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ১৩৯০)। 
ঘ. ‘জীবন রহস্য’। পার্বত্যবাণী (সম্পা. বিরাজ মােহন দেওয়ান) ১ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।

৫। প্রকাশিত প্রবন্ধক- 
ক. ‘চাকমা পেঙ্গুলীগীত’ (লােক কাহিনী): 
ঝরণা ১ম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা মার্চ ১৯৬৭ (সম্পাদক, সৈয়দ খাজা আহমদ) 
ঝরণা ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জুন ১৯৬৭ (সম্পাদক, সুনীতি বিকাশ চাকমা)। 
ঝরণী ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ (সম্পাদক,সুনীতি বিকাশ চাকমা) 
খ. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি (জাতিতত্ত্ব) : সাপ্তাহিক বনভূমি, ২৬ মার্চ ১৯৮৪ (সম্পাদক : এম মকসুদ আহমদ)*

তথ্য নির্দেশ 
১। শ্রী নন্দলাল শর্মা (১৯৮১): পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক। 
রাঙ্গামাটি 
২। বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৯৫) : তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। 
৩। ‘গৈরিকা’র ফাইল 
৪। শ্রীমান কর্মধন তন্চংগ্যার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

* টিকা : কার্তিকচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থের নামপত্রেও অনেকগুলি গ্রন্থের নাম আছে। কিন্তু সব গ্ৰন্থই প্রকাশিত কিনা জানা যায় না। নন্দলাল শর্মার গ্রন্থে (১৯৮১) বৌদ্ধ ধর্ম। শিক্ষার উল্লেখ থাকলেও কবির ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ র আখ্যাপত্র প্রদত্ত পুস্তক তালিকার মধ্যে এবং উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা (আমার কথা”)-তেও বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামটিই পাওয়া যায়। নন্দলাল শর্মা ‘ধর্মপ্লজ জাতক’ এর প্রকাশ কাল ১৯৩৬ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি গ্রন্থটি সম্পাদিত রূপ (কবিরত্ন কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকর্তৃক ১৯৮৪ সংস্করণ)- টি সম্ভবত পান নি।

প্রসঙ্গঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রসঙ্গ

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা*

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রী: পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দিনটিও সুন্দর ছিল, বছরের শেষ দিন এবং অফিস ছুটিও ছিল তখন। তাছাড়া পরিবারকে নিয়ে বের হওয়া যায় না সহজে। সময়, সুযোগ, বাস্তবতা অনেকটা অনুকূলে থাকে না। আর পরিবারের সদস্যদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বিশেষ করে ছোটদের, বড়দের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ এটি নয়। তবে যৎসামান্য প্রসঙ্গও থাকবে বৈকি।

বহুদিন থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে যথেষ্ট আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক হচ্ছে। আলোচনাগুলো মূলত: তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক অন্যদের দ্বারা বিকৃতি, অসম্মান, অসুন্দর উপস্থাপন এবং ব্যবহার প্রসঙ্গ নিয়ে। “তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র” (অনলাইন)- গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রীঃ তারিখে একই প্রসঙ্গ একটি পোস্ট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় (facebook)। স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা – সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক শুরু হয় এবং নানা মতভেদ দেখা দেয়। মূলতঃ দুজন চাকমা যুবক-যুবতীর ‘খবং’ পরাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি তর্কের সূত্রপাত। তঞ্চঙ্গ্যাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংগুলো তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী “মাধা হাবং”( তঞ্চঙ্গ্যারা অনেক সময় খবং বা মাধা খবং’ও বলে। তবে গ্রামের মানুষজনকে ‘মাধা হাবং’ উচ্চারণ করতে শুনেছি । আমিও আমার লেখায় ‘মাধা হাবং’ শব্দটি ব্যবহার করছি) এবং চাকমা রমণীরা অতীতে কখনো এরকম খবং পরেনি এবং কেউ পরেছে সেরকমও চোখে পরেনি। পিনন, খাদি, ব্লাউজ এই থ্রী বস্ত্র চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান পোশাক। অন্যদিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকের মত- চাকমারা (পুরুষ-মহিলা) আগে থেকেই এই খবং ব্যবহার করতো। ব্যবহার না করার ফলে হারিয়ে ফেলেছে তবে বর্তমানে চেষ্টা করছে পুরনো ঐতিহ্যকে (খবং) ফিরিয়ে আনতে।

‘খবং’ কোন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বা করে না এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনস, যুক্তি-তর্কের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগটি এককভাবে আমার নেই, তাই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘কারা ঠিক বলছে?’ প্রশ্নটি সামনে রেখে একটু স্টাডি করতে শুরু করি। স্টাডি অংশ হিসেবে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি, চাকমা সমাজের কিছু গুণী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং সাথে কিছু পরিচিত চাকমা রমণীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি।

প্রথমে বই এর রেফারেন্স প্রসঙ্গে আছি- সুগত চাকমা তাঁর ‘বাংলাদেশের উপজাতি’ (পৃষ্ঠা-১২) গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫ খ্রী:, বাংলা একাডেমি, ঢাকা) চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে নিম্নাংগে ‘পিনোন’ এবং বক্ষবন্ধনী ‘খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরুষরা পোশাক হিসেবে কবোই, ধুতি, গামছা এবং খবং (এক জাতীয় পাগড়ি) ব্যবহার করেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন।

বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আর পুরুষদের পোশাক হিসেবে ধুতি, চাদর, উঞ্চীষ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে উক্ত গ্রন্থে।

ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন তাঁর ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ’ গ্রন্থে (প্রকাশ:১৮৬৯) যে ছবি (পৃষ্ঠা: ২৩৮ থেকে শুরু) তিনি ব্যবহার করেছেন সেখানে চাকমা রমণীদের (যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সকল মহিলার মধ্যে) পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় কোন খবং ছিল না। শুধু পিনন, খাদি, ব্লাউজ আর সাথে অলংকার ছিল।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ-১৯০৯ খ্রী:। পৃষ্ঠা-২২১) তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের পোশাক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- চাকমা পুরুষদিগের পোশাক ছিল সাধারণত হিন্দুগণের ন্যায়, দেখিতে বড়ুয়া অর্থাৎ বাঙ্গালী মঘ বলিয়াই মনে হয়। পৌঢ়সমাজ মস্তকে ‘খবং’ বাঁধিয়া থাকে। নানা পূজা, অনুষ্ঠানে সাধারণত তাঁরা এই খবংটি পরে থাকে। নারীরা খবং পরে বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেননি।

মুস্তফা মজিদ তাঁর ‘চাকমা জাতিসত্তা’ গ্রন্থে (প্রকাশ: ২০১৯ খ্রীঃ। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা -৮৮) তিনি চাকমা পৌঢ় বা বৃদ্ধরা খবং বাধঁতেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনোন এবং খাদি’র কথা উল্লেখ করেন। বস্ত্র হিসাবে খবং এর কথা তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৭। ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী'(৫) খন্ডে (এই খন্ডে মোট ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা আছে) ‘চাকমা’ পর্বে (লেখক: সুগত চাকমা) যে পোশাক-পরিচ্ছদ এর বর্ণনা আছে (পৃষ্ঠা:৭৪-৭৬) সেখানে লেখক চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম শুধু ‘পিনোন- খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাথায় সাদা কাপড় এবং মধ্যবয়সী মহিলারা অন্য রঙযুক্ত কাপড় সামান্য পেঁচিয়ে পরেন বলে মত দেন। এই পেচাঁনো কাপড়কে তিনি ‘খবং’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুল খোলা অবস্থায় খাবারে বা যত্রতত্র যাতে চুল না পড়ে (চুল দিয়ে অনেকে কালো যাদু করে এই আশঙ্কা থেকে), জুমে বা জমিতে খররৌদ্র, ঝুড়ি বহনে সহায়ক হিসেবে এই খবং এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও খবং চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যের একটি পোশাক সে কথাটি উল্লেখ করেননি। ৩১/১২/২০২২ খ্রি: পরিবার নিয়ে আগ্রাবাদস্থ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঘুরতে গেলাম আমরা, যে কথাটি শুরুতেই বলেছি আমি। জাদুঘরে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রদর্শন রয়েছে। সেখানে চাকমা রমণীদের ব্যবহার্য বস্ত্র হিসাবে ‘খবং’ ছিল এরকম কোন প্রদর্শনী আমার চোখে পড়েনি, সঙ্গে যারা ছিল তাদেরও চোখে পড়েনি।

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” (প্রকাশ:১৯৯৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে খবং বা মাধা হাবং এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ গ্রন্থেও একই কথা লিখেছেন। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি’ গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের খবং বা মাধা হাবং ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে করে আমার মনে হয়েছে ‘খবং’ চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী বা সংস্কৃতির অংশের পোশাক নয় বিধায় লেখকগন (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেনি বা এড়িয়ে গেছেন।

এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে আসি-

চাকমা ইতিহাস রচয়িতাদের (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) গ্রন্থে কোথাও ‘খবং’ হিসেবে চাকমা রমণীদের পোশাক ছিল এই কথাটি উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে চাকমা জাতির দু’জন বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষকের সাথে কথা হয় আমার । তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল উল্লেখিত ব্যক্তিদের লেখার মধ্যে তো চাকমা রমণীদের খবং ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উল্লেখ নেই। তাই আমি বা আমরা কি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি চাকমা রমণীদের ‘খবং’ এর ব্যবহার ছিল না অতীত থেকে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আশ্চর্য এবং অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন আমাকে। তিনি বললেন- বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা মহোদয়রা কখনো চাকমা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। কথাটি শুনে আমি বিষম অবাক হলাম এবং শক খেয়েছি। কারণ আমি যতটুকু জানি একজন লেখক যখন নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেন, তিনি কিন্তু প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অগোচরে নিজের এবং জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাথে এটাও সত্য আমরা সকলে কোন না কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করি। বিষয়টি নিয়ে আমি আরো পরিচিত কয়েকজন চাকমা জনগোষ্ঠীর রমণীর সাথে কথা বলি। সকলেই মত দেন চাকমাদের (পুরুষ মহিলা উভয়ে) মধ্যে অনেক আগে থেকে খবং ব্যবহার ছিল। তবে এখন ব্যবহার করে না আগের মতো। তাদের সকলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে- খবং তাঁরা (চাকমা) আত্মরক্ষার বস্ত্র (ধুলোবালি, রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা এবং কাঠ, পানি বহনের সময় নিরাপত্তা) হিসেবে ব্যবহার করতো। তাছাড়া কোন অনুষ্ঠান (যেমনঃ বৈদ্যরা তাদের পূজা অর্চনা) সময় এটি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে । আর বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বরণ, অভিষেক (রাজ্যাভিষেক) সময়ও এই খবং ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে। তবে সব তথ্যকে চাপিয়ে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন- চাকমারা ‘খবং’ ব্যবহার করলেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘পাঁচ কাপড়'(মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পাদুরি, পিনন) এর মতো অবিচ্ছেদ্য কোন বস্ত্র নয় এটি। তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বা কাঠামো নেই। এক টুকরো সাদা কাপড়,অনেক সময় ফুল তোলা কাপড় (আমি আমার দিদিকেও দেখেছি ফুল তুলে মাপলার বুনতে। বাবা এবং আমাদের জন্য), গামছা, তোয়ালে, মাপলারও এই খবং হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিনা আমরা? চাকমাদের ‘খবং’ ব্যবহার ছিল সিজনাল (Seasonal) আর তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘মাধা হাবং’ ব্যবহার ছিল ট্রেডিশনাল (Traditional)।

খবং’ বা পোশাক হিসেবে কে কি কাপড় ব্যবহার করবে এটি ব্যক্তির বা জাতির পছন্দ-অপছন্দ এবং রুচির ব্যাপার, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা -সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো কাউকে নিষেধ করেনি বা বলেনি যে, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ছাড়া কেউ এই ‘তঞ্চঙ্গ্যা পোশাক’ পরতে পারবে না, অবশ্যই পরতে পারবে। তবে পরার পেছনে কোন অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্য এবং বিকৃত উপস্থাপন যেন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যে পরে একে অন্যের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সন্মান করার। সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক, ছোট নৃ-গোষ্ঠীরা যেন সকল বিষয়ে আগ্রাসনের স্বীকার না হয়। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের “মাধা হাবং” কে চাকমা জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘খবং’ এর অংশ হিসেবে যদি দাবি বা উপস্থাপন করেন বা করতে চান তখন অবশ্যই যুক্তি-তর্ক, আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন আছে, সাথে প্রতিবাদও হবে। কারণ আমরা চাইলে চাকমা রমণীদের পিননকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পিনন হিসেবে দাবী করতে পারবো না। দাবির পিছনে ঐতিহাসিক, যৌক্তিক একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার থাকতে হবে। আমি মনে করি চাকমা জনগোষ্ঠীর সে সুযোগটি নেই, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবংকে তাদের ‘চাকমা খবং’ হিসেবে দাবি করার বা প্রতিষ্ঠা করার। অন্তত সেই প্রমাণ বা কথাটি বলছে বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা এর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ এবং অন্যান্য গবেষণাপত্র। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের কাছে মাধা হাবং মানে গামছা, তোয়ালে, মাপলার বা সাদা কাপড় নয়। তাদের কাছে খবং মানে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ের (মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি, পিনন) অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম, ঐতিহ্য, প্রতীক এর নাম। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ে একটা স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা রয়েছে। এই কাপড়গুলো বুনার সময় মেয়েরা নানা নকশা এবং ফুল তুলেন। এই ফুলগুলো তারা জুম এবং প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। সুতরাং মাধা হাবং সহ অন্য সকল পোশাকের ফুলের সাথে ঐতিহ, জুম এবং প্রকৃতির একটা হৃদতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা নিম্নে ফুলগুলো সাধারণত তাদের মাধা হাবং এ ব্যবহার করে- “দাঅর পদ্ম ফুল, চিয়ন পদ্ম ফুল, কর্ণধাদী ফুল, ক্যারাবক ফুল, উলু ফুল, বুলচুগ্ ফুল, তালুকতিজ্যা ফুল, বিসইন ফুল, চাবুরি ফুল, সাম্মাদোলি ফুল, কুরাচুগ্ ফুল, বেয়ুনবিচি ফুল, গাইত ফুল, কই ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কুমড়া বুক ফুল, দিইহরা ফুল, কা-রা বিচি ফুল, আলসুরি ফুল, পাইন্যাপোক ফুল, আয়ত্তলা ফুল (তুলতে ভুলে গেলে অমঙ্গল হয়), মাম্মাবিচি ফুল, কা-ড়া দার ফুল, পাইন্নাঙ ফুল, ছেরাবক ফুল, সুচ্ছাং ফুল, রোবক ফুল, ঘিলাটাক ফুল, রে ফুল” দিয়ে মাধা হাবং বুনা হয়। শুধু মাধা হাবং নয়, পিনন, জুম্ময়া খাদি, জুম্ময়া সালুম, পা-দুরির জন্যও আলাদা আলাদা ফুল রয়েছে। তবে প্রায় জুম্ময়া সালুম, মাধা হাবং, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি’র জন্য ঘুরেফিরে একই ফুল ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কে কোন ফুল কোথায় ব্যবহার করবে নিজের পছন্দ অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আর তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো ‘মাধা হাবং’কে আলাদা করে ‘খবং’ বা ‘হবং’ বলে না। শব্দটি ‘মাধা হাবং’ যুগল করে বলে। পুরনো দিনে এই পাঁচ কাপড় আমাদের রমণীরা সব সময় পরতো। বর্তমান সময়ে সব সময় না পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহারে দিন দিন সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা দলবেঁধে পাঁচ কাপড় পরে যাচ্ছে। এতে জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রচার হচ্ছে এবং পাশাপাশি জাতির প্রতি দায়িত্ব, গৌরব ও অহংবোধ তৈরি হচ্ছে। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা বর্তমানে বক্ষবন্ধনী হিসেবে যে খাদিটি ব্যবহার করে সেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম্ময়া খাদি’ নয়। সেটি চাকমা খাদি। তঞ্চঙ্গ্যা খাদি বৈচিত্র্যময়, ইউনিক এবং আভিজাত্য। আর বর্তমান বৈচিত্র্যতা এবং আধুনিক নামে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাককে ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলে নানা রকম বাহারী ডিজাইনে এত বিকৃত করা হচ্ছে কিছুদিন পর তঞ্চঙ্গ্যা পাঁচ পোশাক তার ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা হারাতে বসবে। তখন হয়তো তঞ্চঙ্গ্যা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে, বলতে হবে। এটি আমাদের জাতির জন্য অশনিসংকেত। এই পোশাক বিকৃতি আমাদের জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নষ্ট করছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যময় বৈচিত্র্যতাকে।

যে ছবি নিয়ে এত যুক্তি-তর্ক, আলোচনা -সমালোচনা, চাকমা লেখকদের খবং বর্ণনায় খবং এর অনুপস্থিতি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবং- তৈরিতে ফুলের যে ব্যবহার এই থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘মাধা হাবং’ ছিল(!!!) সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বিচারের ভারটি পাঠক গবেষক এবং সুধীমহলের জন্য তোলা রইল। আর বর্তমান সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অনেকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী হয়তো এসব কাপড়গুলো (খবং) পেয়েছে। এসব কাপড় বিক্রয়ে বিক্রেতা হয়তো সাময়িক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় কিন্তু সাথে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাদের নামে সাপ্তাহিক ক্রিয়া (সংঘদানে) এই পাঁচ কাপড় দান হিসেবে দেওয়ার একটা প্রচলন আছে। পুনর্জন্মে তাঁর (মৃত ব্যক্তিনীর) যেন কাপড়ের অভাব না হয় এই বিশ্বাস থেকে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) এই পাঁচ কাপড় দান করে। এগুলো অনেকে পুরো সেট (পাঁচ কাপড়) ভান্তে থেকে নামমাত্র ৩০০-৫০০ মূল্যে কিনে অন্যজনদের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে দেওয়ারও কথা প্রচলন রয়েছে সমাজে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে একটা সংস্কার প্রচলিত আছে এসব মরা-মৃত্যু এবং দানীয় বস্তু(কাপড়) বিধবা মহিলা ছাড়া কেউ পরতে পারে না, পরলে অমঙ্গল হয়। আরো অনেকে মত দেন যে, তঞ্চঙ্গ্যা ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ের মাধ্যমেও তাঁর আত্নীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড়ের প্রসার এবং অপব্যবহার ঘটছে। যে খবং নিয়ে এত বিতর্ক এবং আলোচনা চাকমাদের মধ্যে নতুন করে এর প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বয়স কিন্তু বেশিদিন নয়, বছর ৪/৫ হবে মাত্র।

আর নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক নিজের কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, সন্মান, শ্রদ্ধার। অন্যদের কাছে এটি শুধু একটি পরনের বস্ত্র। সুতরাং তাদের হাতে এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি। এই শঙ্কা তৈরি থেকে আজকে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে হচ্ছে। এই তঞ্চঙ্গ্যা পোশাককে বিকৃত উপস্থাপন (নৃত্যে) নিয়ে এর আগেও আমার বেশ কিছু লেখা, আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে।

খবং হিসেবে কে, কি কাপড় ব্যবহার করবে একজন ব্যক্তি বা জাতির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তবে অসঙ্গতি প্রশ্নে অবশ্যই তর্ক বির্তকের প্রয়োজন আছে। সময়ের ব্যবধানে তঞ্চঙ্গ্যারা মহামূল্যবান ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ/সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে মত দেন- চুরি হয়ে গেছে। সময়, সুযোগের অপব্যবহার করে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাধামন ধনপুদি পালা, গেঙ্গুলীর উবাগীত, শিবচরণ এর গোসাইনলামাসহ সকল উপাদানগুলো। এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমা জনগোষ্ঠী উভয় নিজেদের বলে দাবী করে। এখন তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের একটি অংশ “মাধা হাবং” এর উপর এত আলোচনা যুক্তি তর্ক মূলতঃ অতীতের অসুন্দর অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা থেকে। তাই তঞ্চঙ্গ্যারা আর চাই না নতুন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় এবং অন্য সকল সংস্কৃতি উপাদানগুলো চুরি বা বেহাত হয়ে যাক। তাই তারা চাই সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকুক তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি উপাদানগুলো।

এই আলোচনা যুক্তি তর্ক আসলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্ম, চিন্তা, মেধা এবং চেষ্টাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য নয়, আমাদের একে অপরের সংস্কৃতিকে সন্মান এবং ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ও সহযোগিতা মানস গড়ে তোলার লক্ষ্য এই আলোচনা। আর এই আলোচনায় আমি আমার জাতির অস্তিত্ব এবং সংকটের কথা বলছি, আমার অধিকারের কথা বলছি। কারো অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার কথা বলছি না। সময়ের দাবী হিসেবে হয়তো হয়তো আমরা অনেক কিছু গ্রহন করেছি আর অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। কিন্তু যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা সংরক্ষণের নিমিত্তে আর নিজেদের শেকড়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ও প্রশ্নে আমাদের সচেতন হওয়া এবং এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলকে নিতে হবে। হ্যাঁ অনেকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা লিখতে চান না, তাঁরা এর বদলে সম্প্রীতি ভ্রাতৃপ্রেমের কথা বলেন। আমরাও অবশ্যই সকলে চাই সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বপ্রেমের। কিন্তু আমাদের এটাও সাথে মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতের সংকটের সময় নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের কথা বলতে হবে জানান দিতে হবে। তাই আমি মনে করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যেখানে জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব হুমকি, সংকট তৈরি হবে সেখানে আওয়াজ তুলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐক্যে জাতি এগিয়ে যাবে। জাতি হবে সমৃদ্ধ উর্বর। প্রাণ ফিরে পাবে তার হারানো অতীত ঐতিহ্য গৌরব।

আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ককে সাথে নিয়ে সত্য, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অনুপ্রেরণা হোক আমাদের পথ চলা। আর আগ্রাসনের স্বীকার না হয়ে আমাদের সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক, সংরক্ষণ থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়।

———————

ছবি- বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া। তাই নির্দিষ্ট কাউকে ছবির ক্রেডিট দিতে পারছি না। তার জন্য সকলের কাছে সুন্দর ক্ষমা প্রার্থনা কামনা করছি।

———————

*সাবেক সম্পাদকঃ ‘পহর জাঙাল’, ‘রঁদেভু’ এবং ‘সিঙকাবা’ প্রকাশনা।

পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর ১ম ম্যাজিষ্ট্রেট প্রয়াত জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যার কর্মজীবন।

লেখক: বিশু তনচংগ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জনগাষ্ঠীর প্রথম বি.কম. এল.এল.বি পাশ করা ম্যাজিষ্ট্রেট জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা । কবি কার্তিক চন্দ্র ে বড় ছেলে জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৪০ সালে ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজা রাঙামাটি সদর মহকুমায় জন্ম গ্রহণ করেন। 

তারা দুই মায়ের ৭ বোন এবং ৫ ভাই মোট ১২ ভাইবোন ছিলেন। 

রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মেট্রিকুলেশন পাশ করার পর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি লাভকারী তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের প্রথম ব্যাক্তি তিনি। তারপরে বি.কম. এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন প্রয়াত সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা মঞ্জু। জ্যোতিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৬৯ সালে ইষ্ট পাকিস্তান সার্ভিস কমিশনের (ইপিসিএস- বর্তমানে বিসিএস) অধীনে চট্টগ্রামের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম সুনামগঞ্জ,পাবনা ও সিরাজগঞ্জে

 ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সদরে সাব ডিভিশনাল কর্মকর্তা, ৪ জানুয়ারি ১৯৮২ থেকে ২১ অক্টোবর ১৯৮২ রাজশাহীতে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১ নভেম্বর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সারিয়াকান্দি বগুড়াতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক, ১৯৮৯-৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে মন্ত্রীর একান্ত সচিব, ১৯৯১ সালে মৌলভিবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভুমি মন্ত্রণালয়ের ভুমি জরিপ অধিদপ্তরের উপ মহা পরিচালক, ১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং সর্বশেষ ১২ মে ১৯৯৯ সাল থেকে দুই বছর চুক্তি ভিত্তিক পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলিক পরিষদের সর্বপ্রথম মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিষ্ঠার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন এক ছেলে ও‌ দুই মেয়ে সন্তানের পিতা। তার একমাত্র ছেলে প্রকৌশলী অনুপম তঞ্চঙ্গ্যা বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী। অনুপমের বড়বোন জ্যোৎস্না তঞ্চঙ্গ্যা স্বপরিবারে দুবাই ও ছোট বোন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জয়া তঞ্চঙ্গ্যা অষ্ট্রেলিয়াতে বসবাস করেন। স্ত্রী নিরুপমা তঞ্চঙ্গ্যা ২০১৬ সালে পরলোক গমন করেন।

এবং জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা গত ৮ জানুয়ারী ২০১৯ সোমবার বিকাল ৩ টায় রাঙামাটি শহরের পূর্ব ট্রাইবেল আদামের নিজ বাস ভবনে বার্ধক্য জনিত কারণে তিনি পরলোক গমন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। প্রয়াত জ্যোটিন্দ্র প্রসাদ তঞ্চঙ্গ্যা তিনি এক ছেলে দুই মেয়ে সহ আদিবাসীদের মধ্যে ১ম বাংলাদেশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয় স্বজনকে রেখে যান।