নিজের ভাষায় আবেগ আছে

  লিখেছেন মিলিন্দ তনচংগ্যা

লেখার শিরোনাম নিয়েছি জনপ্রিয় ভারতীয় চ্যানেল জি বাংলা থেকে। পশ্চিম বাংলার ওই চ্যানেল সবকটি নাটক, সিরিয়াল প্রচারিত হয় বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গের যে বাংলা ভাষার প্রচার ও চর্চার প্রতিষ্ঠা ও নিজের অস্তিত্ব এবং স্বকীয়তাকে মনে করিয়ে দেয় এবং নিজের স্বাতন্ত্রবোধ বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম মাধ্যম ভাষা, অন্তত আমার মতে। তাই নিজের ভাষায় সবসময় ভালোবাসা ও আবেগ কাজ করে। আবেগ, ভালোবাসা না থাকলে কোন কিছুর অস্তিত্ব জিইয়ে রাখা অসম্ভব। লেখার শিরোনাম যদিও ভারতীয় চ্যানেলের শ্লোগান দিয়ে, এ লেখাতে আমি আমার মায়ের তনচংগ্যা ভাষার কথায় লিখবো।

 

তনচংগ্যার ভাষা ও অক্ষরঃ

আদিকাল থেকে তনচংগ্যা জাতির মধ্যে বৈদ্য, কবিরাজ এবং বয়োবৃদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা নিজের কথামালা, নিজের আবেগ অনুভূতি কিংবা প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী নিজস্ব অক্ষরে লিখে রাখতেন বলে ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায়। এ বর্ণমালা গুলি নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণি মানুষের ব্যবহার ও বুঝার উপযোগী ছিল বিধায় তা সর্বসাধারণের মাঝে বুঝার বোধগম্য হয়ে ওঠেনি। যার ফলে নিজের অক্ষর যেমন অজানায় থেকে গেলো তেমনি বিলুপ্তির পথও সুগম হয়। কথায় বলে না, অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়, বিষয়টি অনেকাংশ তেমনি। চর্চার, বুঝার, জানার অভাবে তা আমাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় আর বিলুপ্তপ্রায় নিজের এই অক্ষর বা বর্ণমালা। তবে তনচংগ্যাদের বর্ণমালা বা অক্ষর হারিয়ে ফেলার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো তনচংগ্যারাও অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো যাযাবর টাইপের ছিল। যার ফলে নিজের ক্ষুধা নিবারণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে সাহিত্যচর্চা তো দূরের কথা, নিজের অক্ষর পর্যন্ত সংরক্ষণ করার মতো সুযোগ পায়নি।
দিন বদলেছে, মানুষের মনোভাব ও চেতনাও বদলেছে। নিজের অস্তিত্ব খোঁজা বা ঠিকিয়ে রাখার তাগিদে মানুষ কত কিছুই না চেষ্টা করে। একটা জাতিকে বেশ কয়েকভাবে চিহ্নিত করা যায় বা চেনা যায়। তন্মধ্যে ভাষা ও পোশাক অন্যতম, আমার মতে। পোশাক দৃশ্যমান, তাই দেখেই অনুমান করা যায় সে কোন জনগোষ্ঠীর বা কোন জাতির। অপরদিকে ভাষা অদৃশ্যমান তবে শ্রবণ ইন্দ্রিয় সাহায্যে বুঝা যায় তার ভাষার কথ্য বা লিখিত বর্ণরূপ কোন শ্রেণির।
নিজের অস্তিত্ব ও ভাষাকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য ৫২ ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। দেশ তথা রাষ্ট্র নিজের ভাষাকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য যতনা কিছু আয়োজন করেছে, স্বদেশে অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য এতো ব্যবস্থা বা আয়োজন করেনি বললেই চলে। যা কিছু আয়োজন অধিকাংশ বৈদেশিক অর্থ সহযোগী সংগঠনের আর দিন শেষে যখন ফল খাওয়ার সময় এসেছে রাষ্ট্র সামান্য ইট বালু দিয়ে সাহায্য করে রাষ্ট্র প্রচার করলো রাষ্ট্র এটা ওইটা আয়োজন করছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য। সব ফসল রাষ্ট্রের গোলায়। রাষ্ট্র ছাগল দিয়েছে কিন্তু রশি দেয় নি। ঘর দিয়েছে কিন্তু চৌকিদার দেয় নি, এরকম অবস্থা। ঘটা করে ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রচার করা হয়েছিল পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় মাতৃভাষা পড়াশুনার জন্য বই ছাপিয়েছে সরকার। এটুকুতেই দায়িত্ব শেষ। এরপরে যে আরো ৪০ টি জনগোষ্ঠী আছে, তাদেরও নিজস্ব ভাষা অক্ষর আছে তাদের নিয়ে কবে নাগাদ ঢাকঢোল বাজানো হবে তা এখনো জানার পথ অনেক দূরে রেখেছে রাষ্ট্র।
সরকারি হিসেব মতে বাংলাদেশে ৪৫টির মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে। বায়ান্ন পরবর্তী একাত্তর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কিংবা বায়ান্ন থেকে ৬৪/৬৫ বছর পর যদি শুধুমাত্র ৫ (পাঁচ) জনগোষ্ঠীর ভাষায়, বর্ণমালায় পড়ার শেখার সুযোগ হয় বাকি আরো ৪০ টি জনগোষ্ঠীর ভাষার স্বীকৃতি কবে মিলবে? তখন কি উক্ত জনগোষ্ঠীর ভাষার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে? অর্থাৎ ৫২ উত্তর ৬৪/৬৫ বছর লেগেছে নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পড়ার সুযোগ পেতে (শুধুমাত্র পাঁচটি) আর বাকিগুলির জন্য কয় যুগ লাগতে পারে একটু হিসেব কষা যেতে পারে।
তনচংগ্যা বর্ণমালা কাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো বা কাদের কাছে বোধগম্য ছিল তা নিয়ে প্রারম্ভে ছোট্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর বর্ণমালা গুলি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বেশ গবেষণার। কাজটি মোটেও সহজ নয়। আর এ কঠিন কাজটি সহজ করে দিয়েছিলেন ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরেট অব ডিসটেন্স এডুকেশনের সহকারী পরিচালক গবেষক ও লেখক ড. রূপক দেবনাথ মহোদয়। যিনি তনচংগ্যা বর্ণমালার পূর্ণাঙ্গ চার্ট তৈরি করেছিলেন। যা এডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার হাতে তিনি তুলে দেন। পরে আমেরিকা নাগরিক ড. জন কিফটন তনচংগ্যা বর্ণমালা কম্পিউটারে কাজ করার উপযোগী সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন। অনেকে মনে করে থাকে যে, তনচংগ্যা বর্ণমালার সাথে চাকমা বর্ণমালা এক। সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে বলি, শুধু দুই জনগোষ্ঠী কেন? তনচংগ্যা, মারমা, চাকমার এ ত্রয়ী জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালার প্রায় মিল আছে দুই চারটা একটু এদিক ওদিক ছাড়া। তাছাড়া এক থাকারই কথা কারণ পাহাড়ের আদিবাসী জনগোষ্ঠী মঙ্গোলীয় এবং আরাকান হতে যাযাবরের মতো এ দেশ হতে অন্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, কিন্তু শেখড়ের জায়গা একটা আরাকান। অক্ষর মিল থাকলেও উচ্চারণগত বেশ তফাৎ আছে। এ বর্ণমালা মিলকরণের সাথে অনেকে আবার চাকমা ও তনচংগ্যা জনগোষ্ঠীকে এক জাতির পেয়ালায় ফেলে দেয়। যা অযৌক্তিক এবং অবান্তর। ওদের যুক্তি ভাষা নাকি ৬০% মিলে বা এক। এখন রোহিঙ্গা (রোইয়াঙ্গা)দের অনেকে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করে কারণ তাদের ভাষাও বাংলা (চাঁটগাইয়া)। কিন্তু এটা একেবারেই খোঁড়া যুক্তি। কেননা ভাষা এক হলেই জাতি এক হয় না। এটা সত্য যে, ভাষা একটি জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম উপাদান কিন্তু একমাত্র ও প্রধান উপাদান নয়। এটার সাথে আরো একটা যুক্তি যায় কিনা, মারমা জনগোষ্ঠীর সাথে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু শব্দচয়ন বা কথার সুর মিলে যায় তবে কি আমি এই দুই জনগোষ্ঠীকে এক জাতি বলে আখ্যায়িত করবো?

তনচংগ্যাদের মোট বারোটি গছা আছে, তা হলোঃ

. কার’অয়া (কারবয়া) গছা।
২. মো(অ) গছা।
৩. ধন্যা গছা।
৪. অঙ্য গছা।
৫. মংলা গছা।
৬. মেলং গছা।
৭. লাঙ গছা।
৮. লাপোস্যা গছা।
৯. রাঙী গছা।
১০. ওয়া গছা।
১১. তাশ্বী গছা।
১২. মুলিমা গছা।
এরমধ্য প্রথম ৭ টি গছা বাংলাদেশ ও বাকি ৫ টি গছা ভারত (ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল) এবং মায়ানমার আরাকানে আছে জানা যায়। অবশ্য উক্ত পাঁচ গছার সাথে অন্যান্য গছাও ভারত ও মায়ানমারে বাস করছে। তনচংগ্যাদের ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা সম্ভূত বাংলার আদিরূপ। বহুপালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা পরিপূর্ণ এবং ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তনচংগ্যা ভাষার সব শব্দই স্বরান্ত। তনচংগ্যাদের আদিকবি শিবচরণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গোসাইন লামা। গছাভেদে তনচংগ্যা ভাষার উচ্চারণগত টিউন (সুর) ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। যেমনঃ বাংলা- “আমি লেখাপড়া করি
১. কার’অয়া গছাঃ – মুই লেয়াপড়া সিয়ং।
২. মো’অ গছাঃ – মুই আঘ শিগং
৩. ধন্যাগছাঃ – মুই লেগা চিগংয়ে।
৪. মেলং গছাঃ – মুই আহ সিহংগর।
৫. লাং গছাঃ – মুই আহ সিহংগর।
৬. অঙ্য গছাঃ – মুই আহ সিহংগর।
৭. মংলা গছাঃ – মুই লেগা শিগয়ত।
বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ মতো তনচংগ্যা ব্যঞ্জনবর্ণও স্বরধ্বনি ব্যতিত উচ্চারণ করা সম্ভব হয় না। তনচংগ্যা কথ্য ও লেখ্যরূপ একই আ- কারান্ত। ক্রিয়াপদের শুরুতে ‘আ’ উচ্চারিত হয়। তনচংগ্যা বর্ণমালা মোট ছত্রিশ (৩৬) টি। তন্মধ্যে পাঁচটি (৫) স্বরবর্ণ।

তনচংগ্যা ভাষার ব্যাকরণ পাঠঃ

১. পদ প্রকরণ:
বাংলা ভাষার মতো তনচংগ্যা ভাষার পদ পাঁচ প্রকার- বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় ও ক্রিয়া।
ক. বিশেষ্য: তা’অল (দা), কাল্লঙ/ পুল্ল্যাঙ (ঝুড়ি), কিচিং (দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান), তারেঙ (পাহাড়ের খাড়া ভাগ), ইককুল (বিদ্যালয়), মানাই (মানুষ), মেলা (মেয়ে/নারী), প’আ (ছেলে), মুরাহ্ (পাহাড়)।
খ. বিশেষণ: দক/লাবা/দোউল (সুন্দর), ধুব (সাদা), দা’অর (বড়), চি’অন (ছোট), মিদা (মিষ্টি), হর (টক), বাদি (খাটো), অসল (উঁচু)।
গ. সর্বনাম: মুই (আমি), আমি (আমরা), ম-র (নিজের), আমা/আমার (আমাদের), তুই (তুমি), তুমি (তোমরা/আপনারা), তে (সে), ইয়ান (এটা/ইহা), উইয়ান (ঐটা), সিবা (সেটা), ইয়ুন (এগুলো)।
ঘ. অব্যয়: যুদি (যদি), ছালে (তাহলে), এনেক্কেয়া (এমন), যেন (যেমন)।
ঙ. ক্রিয়া: হনা (বলা), লনা (নেওয়া), যানা (যাওয়া), গরানা/ গ’আনা (করা), খাইয়ং (খেলাম), খালুং/খাইয়ি (খেয়েছি), ক’উন (বলব), ত-উন (রাখবো)।
২. পদাশ্রিত নির্দেশকঃ
তনচংগ্যা ভাষায় বাংলা ব্যকরণের পদাশ্রিত নির্দেশকের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো।
ক. তনচংগ্যা ভাষাতে প্রাণিবাচক শব্দের ক্ষেত্রে স্বরবর্ণের অন্তে শব্দের শেষে টি-এর আদলে বা যুক্ত হয় মাত্র। যেমন- মেলা+বা= মেলাবা (মেয়েটি),, প’আ+বা= প’আবা (ছেলেটি), কুরা+বা = কুরাবা (মুরগিটি), কুমুরা+বা= কুমুরাবা (কুমড়াটি), লেয়া+বা= লেয়াবা (লেখাটি), কলা+বা= কলাবা (কলাটি)।
খ. বাংলা খানা- খানির স্থলে -লান/আন, রানি যুক্ত হয়। যেমন: চেয়া+রান = চেয়ারান (চেয়ার খানা), টেবি+লান= (টেবিল খানা), তেমনি চেয়ারানি, টেবিলানি, টেবিলান, ঘর+আন=ঘর’আন।
গ. বাংলার গুলো/গুলি এর স্থলে উন, উনি যুক্ত হয়। চেয়ার+উনি= চেয়ারউনি, টেবিল+উনি= টেবিলউনি, মানুচ+উন = মানুচউন (মানুষগুলি)।
৩. বাংলা ক্রিয়া কালের মতো তনচংগ্যা ভাষায়ও কাল তিন প্রকারের দেখা যায়। বর্তমান কাল:
তনচংগ্যা: মুই লেয়াপড়া গরংগর বাংলা: আমি পড়াশোনা করছি। অতীত কাল: তনচংগ্যা: মুই লেয়াপড়া গুজ্জং বাংলা: আমি পড়াশুনা করেছিলাম। ভবিষ্যৎ কাল: তনচংগ্যা: মুই লেয়াপড়া গুরিন বাংলা: আমি পড়াশোনা করবো।
৪. বাক্য ও বাক্যগঠনরীতিঃ
ক. তনচংগ্যা সাধারণ বাক্য গঠন হয় (কর্তা+ কর্ম + ক্রিয়া) নিয়মানুযায়ী। উদাহরণস্বরূপঃ -মুই ইক্কুলত যাং (আমি বিদ্যালয়ে যাই) -তুই বুই পড়র (তুমি বই পড়ছ) -তে লেয়া লিয়ের (সে লেখা লিখছে)
খ. প্রশ্নবোধক বাক্যঃ কি, কেবাই, ক্যায়া, কুত্তুন, কিদে ইত্যাদি শব্দগুলি বাংলা প্রশ্নবোধক বাক্যের শব্দের মতো। উদাহরণ: ত নামান/নাংয়ান কি? (তোমার নাম কি?), তুই গম আহত্তে ন’অইনে? (তুমি ভালো আছ তো?) তদ্রুপ তুই কুত্তুন আসত্তে? (তুমি কোত্থেকে আসছ?), তুই ক্যায়া তা সমারে ন যাবে? (তুমি কেন তার সাথে যাবেনা?), তে কামান গোজ্যেদে নে? (সে কি কাজটা করেছিল নাকি?)
গ. না বোধক বাক্যঃ বাংলা নাবোধক আর তনচংগ্যা নাবোধক বাক্য প্রকাশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাংলায় বাক্যের শেষে না বোধক শব্দ বসে নাবোধক বাক্যে রূপ নেয়। কিন্তু তনচংগ্যা ভাষাতে হয় এ নিয়মানুযায়ী- কর্তা+কর্ম+না+ক্রিয়া।
যেমন: তুই ভাত ন হাবে/খাবে। (তুমি ভাত খাবেনা) মুই লেয়া ন পুরিন। (আমি লেখা পড়ব না) তে কদা হুলে ন শুনে। (সে কথা বললে শুনে না) তারানে মুই ন দেহং। (তাদেরকে আমি দেখিনি)
৫. বচনঃ তনচংগ্যা ভাষায়-
বাংলা ভাষায় (একবচন—-বহুবচন)
পয়া/পয়াবা- পয়াউন (ছেলে-ছেলেরা)
ঘরান–ঘরোনি (ঘর- ঘরগুলি)
গাবুর– গাবুরলক (যুবক-যুবকরা)
দেশ- দেশ্চুনি (দেশ – দেশগুলো)
পাত্থর- পাত্থরুন (পাথর- পাথরগুলি)
মেলা-মেলাউন (মেয়ে-মেয়েরা)
জুম- জুমুনি (জুম-জুমগুলি)।
তনচংগ্যা সমাজে (বিশেষত শ্বশুর গোত্রের) বড়জন কারোর সাথে কথা বলার সময় এক বা বহুবচনের ক্ষেত্রে সম্মানার্থে ‘দাই’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন- বাবা দাই, দাদা দাই, বুসি দাই, বেবে দাই। অবশ্য বয়োজ্যেষ্ঠরাও কনিষ্ঠদের সম্মানার্থে দাই শব্দটি ব্যবহার করে। যেমন- জামাই দাই, মা-দাই, প্রভৃতি। অপরদিকে তেমনি বহুবচন ক্ষেত্রে ‘লক'(সকল অর্থে বুঝায়) শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন- বাপ লক, ভাই লক, মা বোইন লক।
৬. লিঙ্গঃ
বাংলা ভাষার ন্যায় তনচংগ্যা ভাষাতেও লিঙ্গ চার প্রকার- পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ, ক্লীবলিঙ্গ ও উভয়লিঙ্গ।
ক. পুংলিঙ্গ: বাপ (বাবা), হাক্কা (চাচা), মামু (মামা), আসু (নানা/দাদু), বনুই (বড় বোনের জামাই), বাইনা (ভাগ্নে)
খ. স্ত্রীলিঙ্গ: মামা (মা), হাক্কি (চাচী), ফেইপে (ফুফা), মোই (মাসিমা), নুনু (দাদি/ নানী), লুক্কুবি (ছোটবোনকে ডাকা হয়), মাদুক্কু (ভাগ্নি)।
গ. ক্লীবলিঙ্গ: গাইত(গাছ), বা-ত(বাঁশ), কারেগা(চেয়ার), পাদুরি(কোমর বন্ধনী), মাদা কাবঙ(পাগড়ি), পিনউন (থামি), কুরা (মুরগি)।
ঘ. উভয়লিঙ্গ: মানুউত (মানুষ), চিয়ন প’আ(বাচ্চা), সমাজ্জ্যা (বন্ধু), ইক্কুল্ল্যা প’আ (ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝায়)।
৭. লিঙ্গান্তরঃ (তনচংগ্যা- বাংলা)
পুরুষবাচক—-স্ত্রীবাচক
ক. নেক – মুক (স্বামী- স্ত্রী)
খ. হাক্কা- হাক্কি (চাচা-চাচী)
গ. বোবো- মামা (বাবা-মা)
ঘ. দাংগো- বেবে (দাদা- দিদি)
ঙ. ভাইউক্কো- লুক্কুবি (ভাই- বোন)
চ. পিসা- ফেইপে ( ফুফুর জামাই-ফুফু)
ছ. আসু- নোনু (দাদু- দাদী)
ধন/চান যোগে পুংলিঙ্গ শব্দ পুদি/বি যুক্ত করে স্ত্রীবাচক শব্দে রূপান্তর হয়।
ধন/ধনা- ধনপুদি, পুনংচান- পুনংবি, মনিচান- মুনংপুদি।
৮. পুরুষঃ
তনচংগ্যা ভাষায় পুরুষ তিন প্রকার বলে অনেক ভাষাবিদ মনে করেন। যথা- উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও নাম পুরুষ। পুরুষ —-একবচন —-বহুবচন
উত্তম—–মুই ——— আমি
মধ্যম—–তুই ——— তুমি
নাম——তে ——— তারা/তারাই
৯. সমার্থক শব্দঃ
ক. অল্প- ইত্তুক, ইক্কিনি, এক্কেনা।
খ. তাড়াতাড়ি- ঝাদি ঝাদি, ঝাদিমাদি, সুরুতগুরি, হুড়িনুড়ি।
গ. দুইবার- দ্বিপল্ল্যা, দ্বিগেদা, দ্বিজলা।
ঘ. বাবা- বোঙগু, বাপপয়া, বা(আ)বা।
ঙ. ময়লা- আনাচার, কারিচ্চ্যা, আল্লয়াং।
চ. খাটো- বাদি, মাদিতং। ছ. বাঁকা- ব্যাঁয়া, থের(অ)ত, মুসুজ্যা।
এরূপ উদাহরণ আরো অনেক আছে।

১০. কারক ও বিভক্তিঃ

ক. কর্তৃকারক (শূন্য, এ, য়) তনচংগ্যায়- রাধামনে বাছরত যায় বাংলায়- রাধামন বাজারে যায়।
খ. কর্মকারক (রে) তনচংগ্যায়- তুই ধনপুদিরে ভাত দে বাংলায়- তুমি ধনপুদিকে ভাত দাও।
গ. করণকারক (লই/দি) তনচংগ্যায়- ইয়ান দুরিল্লুই বান বাংলায়- এটা দঁড়ি দিয়ে বাঁধো।
ঘ. সম্প্রদানকারক (রে) তনচংগ্যায়- তুই ভিখারিবারে দউত তেয়া দে বাংলায়- তুমি ভিখারিকে দশটাকা দাও।
ঙ. অপাদান কারক (থুন) তনচংগ্যায়- তে ঘরত্থুন আসের বাংলায়- সে বাড়ি থেকে আসছে।
চ. অধিকরণ কারক (ত) তনচংগ্যায়- তে ঘরত আহে বাংলায়- সে বাড়িতে আছে।

১১. দ্বিরুক্ত শব্দঃ

ক.আধিক্য বুঝাতে
তনচংগ্যায়– বেইত বেইত গুরি হা।
বাংলায়– বেশি বেশি করে খাও।
খ. বিকট শব্দ বুঝাতে
তনচংগ্যায়– দেবাবা গুরুংগুরুং গরের।
বাংলায়– আকাশের মেঘের গর্জন।
গ. ক্রিয়া বিশেষণ
তনচংগ্যায়– পুনংচানে আহদি আহদি আসের। (তয়াতুয়ী)
বাংলায়– পুনংচান হেঁটে হেঁটে আসছে। (খুঁজাখুঁজি)
ঘ. অনুরূপ বুঝাতে
তনচংগ্যায়– ত সংসমাজ্জ্যাউন হুদি?
বাংলায়– তোমার সঙ্গী সাথীরা কোথায়?
ঙ. জোর/তাড়াতাড়ি বুঝাতে
তনচংগ্যায়- হামান বুরুত বুরুত গর।
বাংলায়- কাজটা তাড়াতাড়ি কর।
চ. সামান্য করে বুঝাতে
তনচংগ্যা- তে ইত্তুক ইত্তুক গুরি বেয়াক্কান হায় ফুরাল।
বাংলায়- সে অল্প অল্প করে সব খেয়ে ফেলল।
ছ. বিশেষ্যপদ বুঝাতে তনচংগ্যায়- তারায় দ্বিজনে লাঙ্যা-লাঙনী।
বাংলায়- তারা দুজনে প্রেমিক প্রেমিকা।

১২. তনচংগ্যাদের সংখ্যা গণনাঃ

তনচংগ্যাদের সংখ্যা গণনার সাথে মারমা বা বর্মি লিপির মিল আছে। তনচংগ্যা সমাজের কবিরাজ বা বৈদ্যরা তাদের ওষুধের তালিকা (তালিক) করার জন্য এ সংখ্যা গণনা ব্যবহার করে থাকে। ১ (এক), ২ (দ্বি), ৩ (তিন), ৪ (চাই), ৫ (পাইত্) ৬ (চৈ), ৭ সা(আ)ত, ৮ (আইত্য), ৯ (নং), ১০ (দইত)।

উপসংহারঃ

তনচংগ্যা আমার মাতৃভাষা, নিজের ভাষায় আমি আমার মনের কথা যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকাশ করতে পারবো অন্যভাষায় তা অসম্ভব এবং নিজের ভাষায় আলাদা আবেগ ভালোবাসা কাজ করে। ভাষা আমাদের নিজস্ব সম্পদ, আমার আত্মপরিচয়। সুতরাং ভাষাকে জিইয়ে রাখার আমার আপনার সকলের দায়িত্ব। পুঁজিবাদী সমাজের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে যদি আমাদের নিজের ভাষাকেও বাজারের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করে দিই, তবে কোন একদিন তনচংগ্যা জাতি বলে নিজের আত্মপরিচয় দেওয়ার মতো কোন কিছুই থাকবেনা। তখন আর হায় হায় করেও অতীত সময়কে ফিরে পাওয়া যাবেনা। তাই সময় থাকতে গাছ খুঁজে রাখতে হবে যেন হাতি আসলেই কাজে লাগানো যায়। তনচংগ্যা একটা প্রবাদ দিয়েই আমার লেখার ইতি টানছি। “আইত্ আহ্’লে গাইত থয়ানা” অর্থাৎ সময়ের শেষ পথে তাড়াহুড়ো করা। তাই আগেভাগে গাছ খুঁজে রাখার ব্যবস্থা করাটা জরুরি।

তথ্যপঞ্জিঃ

ক. মাতৃভাষা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা। প্রকাশকাল: জানুয়ারি-জুন ২০১৫। প্রধান সম্পাদক: জীনাত ইমতিয়াজ আলী
খ. চালৈন প্রকাশনা পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত, চালৈন সংকলন। প্রকাশকাল-২০১৪, সম্পাদক: মিলিন্দ তনচংগ্যা।
গ. পহর জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত (পহর জাঙাল), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশ সংখ্যা- প্রথম (২০০৩) ও দ্বিতীয় সংখ্যা (২০০৪)। সম্পাদনায় যথাক্রমে- পলাশ তনচংগ্যা ও কর্মধন তনচংগ্যা।
ঘ. তনচংগ্যা বর্ণমালা শিক্ষা, সম্পাদনায়: তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, প্রকাশকাল- ২০১৩।
ঙ. নাসির উদ্দিন রাহমান- রোহিঙ্গা নয় রোয়াইঙ্গা। (অস্তিত্বের সংকটে রাষ্ট্রহীন মানুষ), প্রকাশকাল: ২০১৭।

Classifier (a suffix for the noun etc.) in Tanchangy Language

  • Jawn

It is a suffix for the noun such as Person, man etc. For example – Manuit ek jawn, a person, man etc.

  • khawa

One thing for saying animal, round thing, container such as bottle, shirt,  umbrella,  for      plastic bag, mate, book, pen, mountain, pillow, torch light, cloud (by adding  caga (lump      of cloud)), man, woman etc, Pagoda, marble, head, dead body.

For eg. Mawa ek-khawa (a dead body)

  • An

For long thing such as fan, one word of speech, piece of paper, table, chair, river, spoon,    blanket , Airplane, bus, wire, monastery, catapult  scale,

Rawt tinnan (three airplanes)

  • Pawt

For saying type of curry,

Sawn tin pawt (three kinds of curry)

  • Dawl

Group such as one group one   child, thief.

Su ekdawl (a gang of robber)

  • Pal

For group such as a herd of cattle, elephant, school of fish, cow, goat,

For eg. Guru ek-pal (a herd of cattle).

All the readers are warmly welcomed whatever constructed suggestion do  have  you, for the improvement of the above grammatical rule in Tanchangya Language.