তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা

সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস। 

প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি। 

তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি। 

বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)। 

এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;

তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। 

আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত। 

বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল। 

উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস) 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল। 

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল। 

সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে। 

সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। 

তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা। 

১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান। 

অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।” 

দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়। 

সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।” 

অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। 

উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র। 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) 

তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়। 

দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়। 

এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়। 

একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। 

বাতকস এর লক্ষ্য 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।” 

বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য 

নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর

বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।

বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। 

২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে। 

বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল

তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল। 

বাতকস এর সম্মেলন সমুহ  

১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। 

এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল। 

এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।

১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। 

উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন। 

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। 

বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী 

বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-

১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়। 
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। 
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। 
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে। 
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা, বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ

তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রসঙ্গ

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা*

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রী: পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দিনটিও সুন্দর ছিল, বছরের শেষ দিন এবং অফিস ছুটিও ছিল তখন। তাছাড়া পরিবারকে নিয়ে বের হওয়া যায় না সহজে। সময়, সুযোগ, বাস্তবতা অনেকটা অনুকূলে থাকে না। আর পরিবারের সদস্যদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বিশেষ করে ছোটদের, বড়দের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ এটি নয়। তবে যৎসামান্য প্রসঙ্গও থাকবে বৈকি।

বহুদিন থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে যথেষ্ট আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক হচ্ছে। আলোচনাগুলো মূলত: তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক অন্যদের দ্বারা বিকৃতি, অসম্মান, অসুন্দর উপস্থাপন এবং ব্যবহার প্রসঙ্গ নিয়ে। “তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র” (অনলাইন)- গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রীঃ তারিখে একই প্রসঙ্গ একটি পোস্ট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় (facebook)। স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা – সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক শুরু হয় এবং নানা মতভেদ দেখা দেয়। মূলতঃ দুজন চাকমা যুবক-যুবতীর ‘খবং’ পরাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি তর্কের সূত্রপাত। তঞ্চঙ্গ্যাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংগুলো তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী “মাধা হাবং”( তঞ্চঙ্গ্যারা অনেক সময় খবং বা মাধা খবং’ও বলে। তবে গ্রামের মানুষজনকে ‘মাধা হাবং’ উচ্চারণ করতে শুনেছি । আমিও আমার লেখায় ‘মাধা হাবং’ শব্দটি ব্যবহার করছি) এবং চাকমা রমণীরা অতীতে কখনো এরকম খবং পরেনি এবং কেউ পরেছে সেরকমও চোখে পরেনি। পিনন, খাদি, ব্লাউজ এই থ্রী বস্ত্র চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান পোশাক। অন্যদিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকের মত- চাকমারা (পুরুষ-মহিলা) আগে থেকেই এই খবং ব্যবহার করতো। ব্যবহার না করার ফলে হারিয়ে ফেলেছে তবে বর্তমানে চেষ্টা করছে পুরনো ঐতিহ্যকে (খবং) ফিরিয়ে আনতে।

‘খবং’ কোন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বা করে না এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনস, যুক্তি-তর্কের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগটি এককভাবে আমার নেই, তাই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘কারা ঠিক বলছে?’ প্রশ্নটি সামনে রেখে একটু স্টাডি করতে শুরু করি। স্টাডি অংশ হিসেবে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি, চাকমা সমাজের কিছু গুণী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং সাথে কিছু পরিচিত চাকমা রমণীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি।

প্রথমে বই এর রেফারেন্স প্রসঙ্গে আছি- সুগত চাকমা তাঁর ‘বাংলাদেশের উপজাতি’ (পৃষ্ঠা-১২) গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫ খ্রী:, বাংলা একাডেমি, ঢাকা) চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে নিম্নাংগে ‘পিনোন’ এবং বক্ষবন্ধনী ‘খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরুষরা পোশাক হিসেবে কবোই, ধুতি, গামছা এবং খবং (এক জাতীয় পাগড়ি) ব্যবহার করেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন।

বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আর পুরুষদের পোশাক হিসেবে ধুতি, চাদর, উঞ্চীষ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে উক্ত গ্রন্থে।

ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন তাঁর ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ’ গ্রন্থে (প্রকাশ:১৮৬৯) যে ছবি (পৃষ্ঠা: ২৩৮ থেকে শুরু) তিনি ব্যবহার করেছেন সেখানে চাকমা রমণীদের (যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সকল মহিলার মধ্যে) পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় কোন খবং ছিল না। শুধু পিনন, খাদি, ব্লাউজ আর সাথে অলংকার ছিল।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ-১৯০৯ খ্রী:। পৃষ্ঠা-২২১) তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের পোশাক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- চাকমা পুরুষদিগের পোশাক ছিল সাধারণত হিন্দুগণের ন্যায়, দেখিতে বড়ুয়া অর্থাৎ বাঙ্গালী মঘ বলিয়াই মনে হয়। পৌঢ়সমাজ মস্তকে ‘খবং’ বাঁধিয়া থাকে। নানা পূজা, অনুষ্ঠানে সাধারণত তাঁরা এই খবংটি পরে থাকে। নারীরা খবং পরে বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেননি।

মুস্তফা মজিদ তাঁর ‘চাকমা জাতিসত্তা’ গ্রন্থে (প্রকাশ: ২০১৯ খ্রীঃ। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা -৮৮) তিনি চাকমা পৌঢ় বা বৃদ্ধরা খবং বাধঁতেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনোন এবং খাদি’র কথা উল্লেখ করেন। বস্ত্র হিসাবে খবং এর কথা তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৭। ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী'(৫) খন্ডে (এই খন্ডে মোট ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা আছে) ‘চাকমা’ পর্বে (লেখক: সুগত চাকমা) যে পোশাক-পরিচ্ছদ এর বর্ণনা আছে (পৃষ্ঠা:৭৪-৭৬) সেখানে লেখক চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম শুধু ‘পিনোন- খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাথায় সাদা কাপড় এবং মধ্যবয়সী মহিলারা অন্য রঙযুক্ত কাপড় সামান্য পেঁচিয়ে পরেন বলে মত দেন। এই পেচাঁনো কাপড়কে তিনি ‘খবং’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুল খোলা অবস্থায় খাবারে বা যত্রতত্র যাতে চুল না পড়ে (চুল দিয়ে অনেকে কালো যাদু করে এই আশঙ্কা থেকে), জুমে বা জমিতে খররৌদ্র, ঝুড়ি বহনে সহায়ক হিসেবে এই খবং এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও খবং চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যের একটি পোশাক সে কথাটি উল্লেখ করেননি। ৩১/১২/২০২২ খ্রি: পরিবার নিয়ে আগ্রাবাদস্থ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঘুরতে গেলাম আমরা, যে কথাটি শুরুতেই বলেছি আমি। জাদুঘরে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রদর্শন রয়েছে। সেখানে চাকমা রমণীদের ব্যবহার্য বস্ত্র হিসাবে ‘খবং’ ছিল এরকম কোন প্রদর্শনী আমার চোখে পড়েনি, সঙ্গে যারা ছিল তাদেরও চোখে পড়েনি।

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” (প্রকাশ:১৯৯৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে খবং বা মাধা হাবং এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ গ্রন্থেও একই কথা লিখেছেন। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি’ গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের খবং বা মাধা হাবং ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে করে আমার মনে হয়েছে ‘খবং’ চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী বা সংস্কৃতির অংশের পোশাক নয় বিধায় লেখকগন (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেনি বা এড়িয়ে গেছেন।

এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে আসি-

চাকমা ইতিহাস রচয়িতাদের (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) গ্রন্থে কোথাও ‘খবং’ হিসেবে চাকমা রমণীদের পোশাক ছিল এই কথাটি উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে চাকমা জাতির দু’জন বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষকের সাথে কথা হয় আমার । তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল উল্লেখিত ব্যক্তিদের লেখার মধ্যে তো চাকমা রমণীদের খবং ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উল্লেখ নেই। তাই আমি বা আমরা কি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি চাকমা রমণীদের ‘খবং’ এর ব্যবহার ছিল না অতীত থেকে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আশ্চর্য এবং অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন আমাকে। তিনি বললেন- বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা মহোদয়রা কখনো চাকমা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। কথাটি শুনে আমি বিষম অবাক হলাম এবং শক খেয়েছি। কারণ আমি যতটুকু জানি একজন লেখক যখন নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেন, তিনি কিন্তু প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অগোচরে নিজের এবং জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাথে এটাও সত্য আমরা সকলে কোন না কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করি। বিষয়টি নিয়ে আমি আরো পরিচিত কয়েকজন চাকমা জনগোষ্ঠীর রমণীর সাথে কথা বলি। সকলেই মত দেন চাকমাদের (পুরুষ মহিলা উভয়ে) মধ্যে অনেক আগে থেকে খবং ব্যবহার ছিল। তবে এখন ব্যবহার করে না আগের মতো। তাদের সকলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে- খবং তাঁরা (চাকমা) আত্মরক্ষার বস্ত্র (ধুলোবালি, রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা এবং কাঠ, পানি বহনের সময় নিরাপত্তা) হিসেবে ব্যবহার করতো। তাছাড়া কোন অনুষ্ঠান (যেমনঃ বৈদ্যরা তাদের পূজা অর্চনা) সময় এটি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে । আর বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বরণ, অভিষেক (রাজ্যাভিষেক) সময়ও এই খবং ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে। তবে সব তথ্যকে চাপিয়ে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন- চাকমারা ‘খবং’ ব্যবহার করলেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘পাঁচ কাপড়'(মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পাদুরি, পিনন) এর মতো অবিচ্ছেদ্য কোন বস্ত্র নয় এটি। তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বা কাঠামো নেই। এক টুকরো সাদা কাপড়,অনেক সময় ফুল তোলা কাপড় (আমি আমার দিদিকেও দেখেছি ফুল তুলে মাপলার বুনতে। বাবা এবং আমাদের জন্য), গামছা, তোয়ালে, মাপলারও এই খবং হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিনা আমরা? চাকমাদের ‘খবং’ ব্যবহার ছিল সিজনাল (Seasonal) আর তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘মাধা হাবং’ ব্যবহার ছিল ট্রেডিশনাল (Traditional)।

খবং’ বা পোশাক হিসেবে কে কি কাপড় ব্যবহার করবে এটি ব্যক্তির বা জাতির পছন্দ-অপছন্দ এবং রুচির ব্যাপার, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা -সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো কাউকে নিষেধ করেনি বা বলেনি যে, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ছাড়া কেউ এই ‘তঞ্চঙ্গ্যা পোশাক’ পরতে পারবে না, অবশ্যই পরতে পারবে। তবে পরার পেছনে কোন অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্য এবং বিকৃত উপস্থাপন যেন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যে পরে একে অন্যের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সন্মান করার। সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক, ছোট নৃ-গোষ্ঠীরা যেন সকল বিষয়ে আগ্রাসনের স্বীকার না হয়। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের “মাধা হাবং” কে চাকমা জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘খবং’ এর অংশ হিসেবে যদি দাবি বা উপস্থাপন করেন বা করতে চান তখন অবশ্যই যুক্তি-তর্ক, আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন আছে, সাথে প্রতিবাদও হবে। কারণ আমরা চাইলে চাকমা রমণীদের পিননকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পিনন হিসেবে দাবী করতে পারবো না। দাবির পিছনে ঐতিহাসিক, যৌক্তিক একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার থাকতে হবে। আমি মনে করি চাকমা জনগোষ্ঠীর সে সুযোগটি নেই, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবংকে তাদের ‘চাকমা খবং’ হিসেবে দাবি করার বা প্রতিষ্ঠা করার। অন্তত সেই প্রমাণ বা কথাটি বলছে বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা এর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ এবং অন্যান্য গবেষণাপত্র। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের কাছে মাধা হাবং মানে গামছা, তোয়ালে, মাপলার বা সাদা কাপড় নয়। তাদের কাছে খবং মানে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ের (মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি, পিনন) অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম, ঐতিহ্য, প্রতীক এর নাম। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ে একটা স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা রয়েছে। এই কাপড়গুলো বুনার সময় মেয়েরা নানা নকশা এবং ফুল তুলেন। এই ফুলগুলো তারা জুম এবং প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। সুতরাং মাধা হাবং সহ অন্য সকল পোশাকের ফুলের সাথে ঐতিহ, জুম এবং প্রকৃতির একটা হৃদতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা নিম্নে ফুলগুলো সাধারণত তাদের মাধা হাবং এ ব্যবহার করে- “দাঅর পদ্ম ফুল, চিয়ন পদ্ম ফুল, কর্ণধাদী ফুল, ক্যারাবক ফুল, উলু ফুল, বুলচুগ্ ফুল, তালুকতিজ্যা ফুল, বিসইন ফুল, চাবুরি ফুল, সাম্মাদোলি ফুল, কুরাচুগ্ ফুল, বেয়ুনবিচি ফুল, গাইত ফুল, কই ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কুমড়া বুক ফুল, দিইহরা ফুল, কা-রা বিচি ফুল, আলসুরি ফুল, পাইন্যাপোক ফুল, আয়ত্তলা ফুল (তুলতে ভুলে গেলে অমঙ্গল হয়), মাম্মাবিচি ফুল, কা-ড়া দার ফুল, পাইন্নাঙ ফুল, ছেরাবক ফুল, সুচ্ছাং ফুল, রোবক ফুল, ঘিলাটাক ফুল, রে ফুল” দিয়ে মাধা হাবং বুনা হয়। শুধু মাধা হাবং নয়, পিনন, জুম্ময়া খাদি, জুম্ময়া সালুম, পা-দুরির জন্যও আলাদা আলাদা ফুল রয়েছে। তবে প্রায় জুম্ময়া সালুম, মাধা হাবং, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি’র জন্য ঘুরেফিরে একই ফুল ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কে কোন ফুল কোথায় ব্যবহার করবে নিজের পছন্দ অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আর তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো ‘মাধা হাবং’কে আলাদা করে ‘খবং’ বা ‘হবং’ বলে না। শব্দটি ‘মাধা হাবং’ যুগল করে বলে। পুরনো দিনে এই পাঁচ কাপড় আমাদের রমণীরা সব সময় পরতো। বর্তমান সময়ে সব সময় না পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহারে দিন দিন সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা দলবেঁধে পাঁচ কাপড় পরে যাচ্ছে। এতে জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রচার হচ্ছে এবং পাশাপাশি জাতির প্রতি দায়িত্ব, গৌরব ও অহংবোধ তৈরি হচ্ছে। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা বর্তমানে বক্ষবন্ধনী হিসেবে যে খাদিটি ব্যবহার করে সেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম্ময়া খাদি’ নয়। সেটি চাকমা খাদি। তঞ্চঙ্গ্যা খাদি বৈচিত্র্যময়, ইউনিক এবং আভিজাত্য। আর বর্তমান বৈচিত্র্যতা এবং আধুনিক নামে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাককে ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলে নানা রকম বাহারী ডিজাইনে এত বিকৃত করা হচ্ছে কিছুদিন পর তঞ্চঙ্গ্যা পাঁচ পোশাক তার ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা হারাতে বসবে। তখন হয়তো তঞ্চঙ্গ্যা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে, বলতে হবে। এটি আমাদের জাতির জন্য অশনিসংকেত। এই পোশাক বিকৃতি আমাদের জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নষ্ট করছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যময় বৈচিত্র্যতাকে।

যে ছবি নিয়ে এত যুক্তি-তর্ক, আলোচনা -সমালোচনা, চাকমা লেখকদের খবং বর্ণনায় খবং এর অনুপস্থিতি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবং- তৈরিতে ফুলের যে ব্যবহার এই থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘মাধা হাবং’ ছিল(!!!) সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বিচারের ভারটি পাঠক গবেষক এবং সুধীমহলের জন্য তোলা রইল। আর বর্তমান সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অনেকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী হয়তো এসব কাপড়গুলো (খবং) পেয়েছে। এসব কাপড় বিক্রয়ে বিক্রেতা হয়তো সাময়িক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় কিন্তু সাথে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাদের নামে সাপ্তাহিক ক্রিয়া (সংঘদানে) এই পাঁচ কাপড় দান হিসেবে দেওয়ার একটা প্রচলন আছে। পুনর্জন্মে তাঁর (মৃত ব্যক্তিনীর) যেন কাপড়ের অভাব না হয় এই বিশ্বাস থেকে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) এই পাঁচ কাপড় দান করে। এগুলো অনেকে পুরো সেট (পাঁচ কাপড়) ভান্তে থেকে নামমাত্র ৩০০-৫০০ মূল্যে কিনে অন্যজনদের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে দেওয়ারও কথা প্রচলন রয়েছে সমাজে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে একটা সংস্কার প্রচলিত আছে এসব মরা-মৃত্যু এবং দানীয় বস্তু(কাপড়) বিধবা মহিলা ছাড়া কেউ পরতে পারে না, পরলে অমঙ্গল হয়। আরো অনেকে মত দেন যে, তঞ্চঙ্গ্যা ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ের মাধ্যমেও তাঁর আত্নীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড়ের প্রসার এবং অপব্যবহার ঘটছে। যে খবং নিয়ে এত বিতর্ক এবং আলোচনা চাকমাদের মধ্যে নতুন করে এর প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বয়স কিন্তু বেশিদিন নয়, বছর ৪/৫ হবে মাত্র।

আর নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক নিজের কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, সন্মান, শ্রদ্ধার। অন্যদের কাছে এটি শুধু একটি পরনের বস্ত্র। সুতরাং তাদের হাতে এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি। এই শঙ্কা তৈরি থেকে আজকে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে হচ্ছে। এই তঞ্চঙ্গ্যা পোশাককে বিকৃত উপস্থাপন (নৃত্যে) নিয়ে এর আগেও আমার বেশ কিছু লেখা, আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে।

খবং হিসেবে কে, কি কাপড় ব্যবহার করবে একজন ব্যক্তি বা জাতির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তবে অসঙ্গতি প্রশ্নে অবশ্যই তর্ক বির্তকের প্রয়োজন আছে। সময়ের ব্যবধানে তঞ্চঙ্গ্যারা মহামূল্যবান ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ/সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে মত দেন- চুরি হয়ে গেছে। সময়, সুযোগের অপব্যবহার করে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাধামন ধনপুদি পালা, গেঙ্গুলীর উবাগীত, শিবচরণ এর গোসাইনলামাসহ সকল উপাদানগুলো। এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমা জনগোষ্ঠী উভয় নিজেদের বলে দাবী করে। এখন তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের একটি অংশ “মাধা হাবং” এর উপর এত আলোচনা যুক্তি তর্ক মূলতঃ অতীতের অসুন্দর অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা থেকে। তাই তঞ্চঙ্গ্যারা আর চাই না নতুন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় এবং অন্য সকল সংস্কৃতি উপাদানগুলো চুরি বা বেহাত হয়ে যাক। তাই তারা চাই সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকুক তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি উপাদানগুলো।

এই আলোচনা যুক্তি তর্ক আসলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্ম, চিন্তা, মেধা এবং চেষ্টাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য নয়, আমাদের একে অপরের সংস্কৃতিকে সন্মান এবং ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ও সহযোগিতা মানস গড়ে তোলার লক্ষ্য এই আলোচনা। আর এই আলোচনায় আমি আমার জাতির অস্তিত্ব এবং সংকটের কথা বলছি, আমার অধিকারের কথা বলছি। কারো অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার কথা বলছি না। সময়ের দাবী হিসেবে হয়তো হয়তো আমরা অনেক কিছু গ্রহন করেছি আর অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। কিন্তু যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা সংরক্ষণের নিমিত্তে আর নিজেদের শেকড়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ও প্রশ্নে আমাদের সচেতন হওয়া এবং এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলকে নিতে হবে। হ্যাঁ অনেকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা লিখতে চান না, তাঁরা এর বদলে সম্প্রীতি ভ্রাতৃপ্রেমের কথা বলেন। আমরাও অবশ্যই সকলে চাই সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বপ্রেমের। কিন্তু আমাদের এটাও সাথে মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতের সংকটের সময় নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের কথা বলতে হবে জানান দিতে হবে। তাই আমি মনে করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যেখানে জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব হুমকি, সংকট তৈরি হবে সেখানে আওয়াজ তুলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐক্যে জাতি এগিয়ে যাবে। জাতি হবে সমৃদ্ধ উর্বর। প্রাণ ফিরে পাবে তার হারানো অতীত ঐতিহ্য গৌরব।

আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ককে সাথে নিয়ে সত্য, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অনুপ্রেরণা হোক আমাদের পথ চলা। আর আগ্রাসনের স্বীকার না হয়ে আমাদের সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক, সংরক্ষণ থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়।

———————

ছবি- বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া। তাই নির্দিষ্ট কাউকে ছবির ক্রেডিট দিতে পারছি না। তার জন্য সকলের কাছে সুন্দর ক্ষমা প্রার্থনা কামনা করছি।

———————

*সাবেক সম্পাদকঃ ‘পহর জাঙাল’, ‘রঁদেভু’ এবং ‘সিঙকাবা’ প্রকাশনা।

তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন এবং সংস্কৃতি

কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সুপ্রচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে। মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তনচংগ্যাদের বসবাস রয়েছে। এই বসবাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বটে। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যারা দাইনাক নামে পরিচিত। এই দাইনাক/দৈনাক শব্দটি একটি ঐতিহাসিক শব্দ, যার অর্থ যোদ্ধা। ঐতিহাসিকভাবে তঞ্চঙ্গ্যারা যুদ্ধজাতি হিসেবে পরিচিত। ভারতে নানা প্রদেশে, অঞ্চল বিশেষে তারা তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা এবং চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত। তনচংগ্যারা তিবেতো-বর্মন-ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠীভুক্ত, যদিও বর্তমানে তাদের ভাষা ভারতীয় আর্য ভাষার অর্ন্তভুক্ত। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান বসতি। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলায় রাঙ্গুনীয়া উপজেলার উত্তরা-পূর্বাংশে এবং কক্রবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় তাদের বসতি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চল (দক্ষিণ ত্রিপুরা) এবং মিজোরাম রাজ্যের চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদ(সিএডিসি) অঞ্চলে তাদের প্রধান বসতি। মায়ানমারে তঞ্চঙ্গ্যাদের মূল বসতি বর্তমানে আকিয়াবের সিত্তুয়ে জামপুই হিলের দক্ষিণে কলদান নদীমুখ অবদি। তাছাড়া বসতি রয়েছে আরাকানের ভুসিডং,রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে, মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায়। তঞ্চঙ্গ্যারা ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলা নববর্ষ বা বিষু হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। এর পাশাপাশি ধর্মীয় নানা পূজা-পার্বনও তারা পালন করে থাকে। 

ইতিহাসের প্রেক্ষাপটঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সুদীর্ঘকালের যে ইতিহাস সেটি শুরু হয় মায়ানমারে আরাকান প্রদেশ/রাজ্য থেকে। যেখানে দান্যায়াদি নামে একটি ঐতিহাসিক স্বাধীন রাজ্যের গড়া পত্তন হয়। মূলতঃ দাইনাক বা দৈনাক থেকে দান্যায়াদি নামের ঊৎপত্তি। বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান বা দান্যায়াদিতে দাইনাক বা দৈনাক নামে বসবাস করে যা এখনো বর্তমান। ইতিহাস বলে তঞ্চঙ্গ্যারা আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে প্রথমে বান্দরবান জেলায় আলিকদম উপজেলায় তৈনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে। ধারণা করা হয় এই তৈনছড়ি থেকে তঞ্চঙ্গ্যা নামটি উৎপত্তি। এর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত হয়ে সুদীর্ঘকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করছে যা এখনো বর্তমান। শ্রী মধাব চন্দ্র চাকমা তার রাজনামা গ্রন্থে চাকমাদের দুটি শাখার কথা বলেছেন। একটি হচ্ছে ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘আনক্যা চাকমা’। এই ‘রোয়াঙ্গ্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা আর ‘আনক্যা চাকমা’ হচ্ছে বর্তমান চাকমারা। একদা ইতিহাসে আরাকান/দান্যায়াদি অংশকে বলা হতো ‘রোয়াঙ্গ্যা’ আর চট্টগ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বলা হতো ‘আনক’। এই আনক্ থেকে ‘আনক্যা’ শব্দটি এসেছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস শুরু হয় মূলতঃ আরাকান-পার্বত্য চট্টগ্রাম-ভারত আর চাকমাদের ইতিহাস শুরু হয় ভারত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাই ইতিহাসের সরল ভাষ্যমতে এই আনক্যা চাকমারা আদৌ আরাকানে বসতি স্থাপন করেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয়। ইতিহাস গবেষকদের মতে রাজনামা বা চাকমা রাজনবর্গে তাদের ধারাবাহিক ইহিহাস পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি) থেকে সাত্তুয়া (পাগলা রাজা) পর্যন্ত রাজারা ছিলেন রোয়াংগ্যা চাকমাদের(তঞ্চঙ্গ্যা) বংশধর আর ধাবানা থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজারা হচ্ছেন আনক্যা চাকমাদের(বর্তমান চাকমা) বংশধর। তাছাড়া চাকমা ইতিহাস লেখকদের লেখনীতে তাদের ইতিহাসের দোলাচলতা আমরা লক্ষ্য করি। ‘চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার’ গ্রন্থে অশোক কুমার চাকমা বলেছেন- চাকমা জাতির ইতিহাসের একটি কাহিনী বা অংশ চাক জাতিও নিজেদের বলে দাবী করছে। তাহলে কি এই কাহিনী চাকরা আমাদের কাছ থেকে চুরি করেছে ? না আমরাই তাদের কাহিনীকে নিজেদের (চাকমাদের) বলে চালিয়ে দিচ্ছি। তাই অশোক কুমার চাকমা ‘চাক ও চাকমাদের মিলে যাওয়া ইতিহাসের’ অংশ নিয়েও এই রকম একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। আর জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যারা নাকি আসল চাকমা, এটি অবশ্যই গবেষণার বিষয়। তাই আমরা লক্ষ্য করেছি তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস ত্যাগের ইতিহাস আর চাকমাদের ইতিহাস compromise এর ইতিহাস। 

ইতিহাসে উলেখ আছে তঞ্চঙ্গ্যাদের আগে বর্তমান চাকমারা পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেন, সেজন্য তারা তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে ‘পরঙী’ বা বসবাসের জন্য আগমনকারী হিসেবে অভিহিত করতেন। আর চাকমরা যদি কোন কারণে বা কালে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে থাকেন তাহলে তারা আরাকানকে স্বদেশ বা মাতৃভূমি হিসেবে মেনে নেয়নি বা গ্রহন করেননি। তার কারণ মগ রাজার সাথে তাদের সর্ম্পক ভালো ছিলনা। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে আরাকান বা মগ রাজাদের সর্ম্পক ভালো ছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিজয়গিরি প্রচুর সৈন্য সামান্ত নিয়ে রাজ্য জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন। এই সৈন্য সামান্তরা যে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যা জাতির বংশধর ছিলেন সেটাও ইতিহাস বলে। কারণ তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে মারমা এবং রাখাইনরা সেসময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত “দৈনাক” বলে সম্বোধন করেন। ইতিহাসে আছে বিজয়গিরি যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের কিছু অংশ এখানে থেকে যায় আর কিছু অংশ স্বদেশে বা আরাকানে চলে যান (বিচগ্রী যুদ্ধ জয়ের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়া)। ইতিহাসের তথ্যমতে রোয়াংগ্যা চাকমা বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যারা দিগ্বীজয়ী রাজা বিচগ্রী (বিজয়গিরি), সেনাপতি রাধামন, জয়রাম ও নিলংধনদের যোদ্ধাদের বংশধর এবং উত্তরসুরী। ইতিহাস আরো বলে তঞ্চঙ্গ্যারাই গৌতম বুদ্ধের বংশীয় শাক্য বংশের উত্তর পুরুষ। আরাকানে বসবাসরত তন্চংগ্যাদেরকে শাক্যবংশীয় উত্তরসুরী হিসাবে তদান্তিন জেনারেল উনু প্রতি বৎসর এ জাতির দম্পতিকে রেঙ্গুনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করতেন।

আবার অনেকে বলেন তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমারা পূর্বে অভিন্ন সম্প্রদায় ছিল। উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজা ধাবানা তার শাসন থেকে ‘চাকমা’ নামে একটি জাতি বা সম্প্রাদয়ের সংস্কার গড়ে তুলেন। তবে তার আগে তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমারা কি নামে সম্বোধন হতেন তা গবেষকগণ বলতে পারেননি। তবে লুইনের মতে চম্পক নগর থেকে আগত বলেই চাকমা নাম ধারণ করা হয়। কিন্তু চম্পক নগরের অস্থিত্ব নিয়ে ইতিহাসে নানা প্রশ্ন আছে। আর ত্রিপুরা রাজমালা’র মতে অতীতে চাকমা সম্পর্কিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই চাকমা পরিচয়ের শব্দটি এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে চাকমা নামের উলেখ পাওয়া যায় এই রাজমালা গ্রন্থে। আবার অনেকের মতে পূর্ব পুরুষদের আচার,আচারণ, অভ্যাাস ও অবস্থান দেখে আরাকানীরা হেঁয়ালীভাবে তাদেরকে চাংমাং বা চামা এবং তংসা নামে ডাকত। পরবর্তীতে এই শব্দদ্বয় থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা শব্দদ্বয় রূপান্তরিত  হয়ে থাকতে পারে। 

আরাকানের ভুসিডং, রাচিডং, মংদু, ক্যক্ত, তানদুয়ে,মাম্রাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যারা বসবাস করে আসছে। তৈনচংয়্যা/তংচয়্যা উচ্চারিত শব্দটি আরাকানে বা আলিকদমে বসবাসের সময় হতে শুরু। আরাকান থেকে এসে তারা তৈনছড়ি কিংবা তৈনগাঙ এলাকায় ক্রমে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৫১৬ খৃীষ্টাব্দে দিকে তৈন সুরেশ্বরী নামে দক্ষিণাঞ্চলের এক রাজা ছিলেন। এই তৈন থেকে তৈনছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছে স্থানীয় প্রবীনদের মত রয়েছে। ইতিহাস বলে পনের শতকের পর তঞ্চঙ্গ্যারা আলাদা ও পরিত্যক্ত জাতিরুপে বিবেচিত হয়। তঞ্চঙ্গ্যাদের আগমন চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁ আমল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আর রাজা ধরমবক্স খাঁ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বজাতি হিসেবে গ্রহণ করেননি। ১৮১৯ খৃীষ্টাব্দের দিকে তার আমলে ৪,০০০(চার হাজার) তঞ্চঙ্গ্যা আগমন করেন। এদের রাজা ছিলেন ফাপ্র“। তারা পর্তুগীজদের নির্মিত চট্টগ্রামের ‘লাল কুটির’ (বর্তমানে ডিসি বা নজরুল স্কয়ারের পাহাড়ের উপর বিল্ডিংটি) ক্রয় করে ধরমবক্স খাঁকে উপহার দেন।

ভাষা ও বর্ণমালা

তঞ্চঙ্গ্যারা জাতিতে মঙ্গোলীয় এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা চর্চা অনেক দিনের। জার্মান পন্ডিত বিশিষ্ট্য ভাষাতাত্বিক ড. জি এ গিয়ারসন তার ১৯০৩ সালে প্রকাশিত ‘লিঙ্গুয়েষ্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (Linguistic Survey of India)’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা ভাষাকে পৃথক ভাষা বলে উলেখ্য করেছেন এবং উভয় ভাষাকেই আর্য-হিন্দু বা ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অর্ন্তভুক্ত বলে মত ব্যক্ত করেন। তঞ্চঙ্গ্যাদর নিজস্ব লিপি আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের লিপি অনেকটা বার্মিজ লিপির কাছাকাছি। এর মূল উৎপত্তি হচ্ছে ‘মন’দের থেকে। বর্তমানে তঞ্চঙ্গ্যারা যে বর্ণমালাটা ব্যবহার করছে সেটি হচ্ছে দাইনাক বর্ণমালা। তাদের বর্তমান মোট বর্ণমালার সংখ্যা ৩৬টি। তার মধ্যে ব্যঞ্জনবর্ণ হচ্ছে ৩১টি আর স্বরবর্ণ হচ্ছে ৫ টি। তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সহজাত উচ্চারণ হচ্ছে ‘আকারান্ত’। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা শান্ত, নরম এবং কোমল। 

সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার

তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকারটা বিশেষ করে জমি-জমা, পাহাড়-পর্বত লাভ প্রথাগত। তারা এক পুরুষ ভোগ করার পর পরবর্তী পুরুষকে তার সম্পত্তিকে দেখভালে দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে ছেলেরাই অগ্রাধিকার বেশী পায়। তবে পুত্র সন্তান যদি না থাকে মেয়ে সন্তান থাকলে মেয়েরাই সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর পুত্র মৃত্যু পর পুত্রবধু যদি দ্বিতীয় বিবাহ না করে সে ঘরে যদি কোন সন্তান থাকে সেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। নিঃসন্তান হয়ে তারা যদি পালক সন্তান পালন করেন বা কেউ তাদেরকে লালন-পালন করেন (ভাইয়ের বা বোনের সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ) তখন তারা সম্পত্তির ভাগ পান। যদি স্বামী-স্ত্রীর কোন সন্তান না থাকে তাহলে তারা চাইলে তাদের সম্পত্তিগুলি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দানও করে দিতে পারেন। 

পোষাক-পরিচ্ছদ এবং আলঙ কানিঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা সরকারী ভাষায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রয়েছে তনচংগ্যাদের পোষাক তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ। মূলত এই বৈচিত্র্যময় পোষাক দিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের আলাদা এবং স্বকীয়ভাবে সহজে চেনা যায়, বিশেষ করে মেয়েদের ‘পাঁচ কাপড়ের’ পোষাকটা। মেয়েদের এই পাঁচ কাপড় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে রেখেছে। এই পাঁচ কাপড় হচ্ছে- পিনন(পরনের কাপড়), খাদি (ওড়না), মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী), পা-দুরি(কোমড় বন্ধনি), সালুম(শার্ট) এগুলি হচ্ছে মেয়েদের জাতীয় পোষাক। আর ছেলেদের জাতীয় পোষাক হচ্ছে- ধুতি, হাফ হাটা সাদা ফুটুয়া এবং মাদা কাবঙ(মাথার পাগড়ী)। মেয়েরা তাদের কাপড়গুলি নিজেরাই তৈরী করে, কোমড় তাঁত এর মাধ্যমে। ‘আলঙ কানি বা আলাম’ হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের নকশা পুথি। এটি মূলত একটি নকশা করা কাপড় যেখানে সমস্ত বুননের ডিজাইনগুলি নকশা করা থাকে। এই ডিজাইনের ফুলগুলি জুমে উৎপাদিত নানা ফুল,ফল এবং প্রকৃতি ও জীবজন্তুর নানা উপাদান থেকে নেওয়া। তাই এই বুনন উপাদনের সাথে জুমের একটা আত্মার সর্ম্পক রয়েছে। এই জুমের ফুল নিয়ে তনচংগ্যা সংস্কৃতিতে রচিত হয়েছে গান, সাহিত্য। রয়েছে ঐতিহাসিক উবাগীত, রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যেও। রাধামন-ধনপুদি পালার মধ্যে রাধামন-ধনপুদি পোষাকের মধ্যে আমরা এই জুমফুল এবং আলঙ কানি ফুলগুলির বর্ননা পাই। যেমন- কুরা চোখ ফুল(মুরগী চোখ ফুল),বিঅন বিচি ফুল(বেগুন বীজের ফুল),রাধাচুলা ফুল(মোরগের ফুল),গাইত ফুল(বিশেষ করে শার্ট বোনা হয়), কুরাঙা কাবা ফুল,কাঙারা চোখ ফুল,প্রজাপতি ফুল(বিশেষ করে থলে তৈরী করা হয়),বিসন ফুল(এই ফুল দিয়ে শার্ট বোনা হয়),কুমুড়া বুক্ক্যা ফুল,মাম্মা বিচি ফুল,ধুদি পাল ফুল,আইদ ফুল, আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল,বুল চুক্ক্যা ফুল, কই ফুল(শার্ট বোনা হয়),কেরেঙ ফুল, জনশ্রুতিতে আছে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড় (পোষাক) হচ্ছে রাজকীয় পোষাক। তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাক বিশেষ করে মেয়েদের পোষাক নিয়ে সমাজে আরো কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। ব্রিটিশরা আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার সময় চাকমা শাসক ছিলেন রানী কালিন্দী। আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার সময় ব্রিটিশ লর্ড নাকি রানী কালিন্দীর সাথে দেখা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং তারা দূত মারফত সে খবরটি পৌঁছে দেন। আর অনুরোধ করেন আসার সময় চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নিয়ে আসার উপহার হিসেবে। সেগুলি উপহার স্বারক হিসেবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখবে। রানী কালিন্দী নিজে না গিয়ে তার কিছু হেডম্যানকে ব্রিটিশ লর্ডের সাথে সাক্ষাতের করার জন্য প্রেরণ করেন এবং চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক (পিনন, খাদি এবং ব্লাউজ) উপহার হিসেবে পাঠান। ব্রিটিশ লর্ড তাদের সাক্ষাতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং রানী কালিন্দীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এক পর্যায়ে হেডম্যানরা রানীর দেওয়া চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাকগুলি ব্রিটিশ লর্ডের হাতে তুলে দেন। ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি পেয়ে খুশী হন এবং রানীকে হেডম্যানদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান। পরে তাদের সামনে ব্রিটিশ লর্ড কাপড়গুলি খুলে দেখেন এবং অবাক হয়ে নাকি বললেন-“এগুলিতো চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রেস নয়”। তখন এই হেডম্যানরা নাকি পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যাদের পাঁচ কাপড়(পিনন,খাদি,সালুম,পা-দুরি, মাদাকাবঙ) দিয়ে আসেন এবং ব্রিটিশ লর্ড বললেন- এগুলিই হচ্ছে চাকমাদের আসল পোষাক। তার জন্য আবারো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানান। জনশ্রুতিতে আরো আছে এই পাঁচ কাপড়গুলি নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে তখনকার স্বারক শাসনের স্বারক হিসেবে। 

জুম চাষের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাকের একটা মিল আমরা দেখতে পাই। আর এই মিলটা হচ্ছে ফুলের। এই ফুলগুলি তঞ্চঙ্গ্যাদের পোষাককে বৈচিত্র্যভাবে এবং নানা রঙে ফুটিয়ে তোলার ভূমিকা পালন করেন। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যেসব পোষাক হাতে এবং বুননের মাধ্যমে তৈরী করে তার মধ্যে যেসব ফুলের কারুকাজ ব্যবহার করা হয় সে ফুলের নামগুলিও জুমে উৎপাদিত নানা ফল বা ফলের বীজ এবং ফুল থেকে নেওয়া। যেমন- বেউন বিচি ফুল, কুরা চোখ ফুল, গাইত ফুল, বিসইন ফুল, সুইচ্ছাং ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কাঙারা বিচি ফুল, কুমুড়া বুক্কয়া ফুল, মাম্মা বিচি ফুল, ধুদি পাল ফুল, আই-দ ফুল,আয়াততলা ফুল, দিই হরা ফুল, বুল চোক্কয়্যা ফুল, কই ফুল, বিঞ্চ ফুল, হাদি চ ফুল, প্রজাপতি ফুল,মাইত ফুল। রাধামন-ধনপদি পালার পোষাকের মধ্যে আমরা তঞ্চঙ্গ্যাদের এই জুম ফুলগুলির বর্ণনা পাই।

সামাজিক সংগঠন বা গছা/গোত্রঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের বংশ পরিচয় পিতৃসূত্রীয়। তাদের সর্বমোট বারটি গোত্র আছে। তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় গোত্রকে গছা বলে। তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার সংখ্যা হচ্ছে ১২(বার)টি। এই গছাগুলি হচ্ছে -র্কারআ গছা, মুঅ গছা, ধন্যা গছা, লাং গছা,মংলা গছা, মেলং গছা, অঙ্যা গছ, রাঙ্যা গছা, লাপ্যোসা গছা, ওয়াহ গছা, মুলিমা গছা,তাসসি গছা। এই গছাগুলির আবার রয়েছে উপগছা। তঞ্চঙ্গ্যাদের মৌজা প্রধানের নাম হেডম্যান এবং গ্রাম/পাড়া প্রধান হচ্ছেন কার্বারী। তারা সামাজিক নানা বিচার-আচার পরিচালনা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। 

জীবন জীবিকা এবং চাষাবাদঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তাদের জুম চাষের মুল পর্বটা শুরু হয় বৈশাখের পরে। তবে বৈশাখের পূর্ববর্তীতে তারা জুমকে অনেকাংশে চাষের উপযোগী করে তৈরী করে রাখে। জুমকে কেন্দ্র তারা করে তাদের জীবন পুঞ্জিকা তৈরী করে। এই জুমে ধান, হলুদ, আদা, কলা, কচু, মরিচসহ নানা রকম সবজি উৎপাদন করে। জুম থেকে তারা সারা বছরের জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ পেয়ে থাকে। এই জুমকে কেন্দ্র করে তাদের ঐতিহাসিক নানা সাহিত্য এবং কাহিনী বা পালা রচিত হয়েছে। তার মধ্যে জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়া পালা। আর আছে নানা পৌরানিক উপখ্যান। তার মধ্যে লক্ষী মা ও মিত্তিন্যা পসন। বিষু সময় গ্রামের যুবক-যুবতীরা দল বেঁধে জুমে তরকারী খুজতে যেত। 

ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসঃ

 তঞ্চঙ্গ্যারা জন্মগতভাবে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তারা গৌতম বুদ্ধের অনুশাসনে অনুসারী। তাদের প্রত্যেকের গ্রামে একটি করে বিহার/প্যাগোডা রয়েছে। সকাল বিকাল তারা বিহারে গিয়ে পূজা-আর্চনা করে, বুদ্ধ এবং ভান্তেকে বন্দনা করে। সাথে প্রার্থনা করে জগতে সকল প্রাণী সুখী হওয়ার জন্য। তঞ্চঙ্গ্যাদের একটা রীতি আছে জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত একবার হলেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাকে শ্রামন্য দীক্ষা গ্রহন হরতে হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এর পাশাপাশি মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমাও তারা যথাযত ধর্মীয় অনুশাসনে পালন করে থাকে। 

পরিবারের ধরণঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে একক এবং যৌথ পরিবার লক্ষ্য করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যারা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। পিতাই পরিবারের প্রধান। তবে পিতার অবর্তমানে পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠই পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবার নেই বললে চলে।  

সঙ্গীত ও সাহিত্য

সাধক কবি শিবচরণ, রাজ কবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে আলোকিত করেছে। সাধক কবি শিবচরণ তার গোসাইন লামা সাহিত্য তঞ্চঙ্গ্যাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। তেমনি ভাবে সাদিগাঙছড়া, জুম কাবা, রাইন্যা বেড়া, ফুল ফারা, রাধামন ধনপুদি পালা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যকে সমৃদ্ধ শিখরে নিয়ে গেছে। সে সময় চারণ কবি গেঙ্গুলীরা গানের আসর জমিয়ে তুলতো এই পালাগুলি গেয়ে বেহেলার সুরে। তঞ্চঙ্গ্যাদের চারণ কবি বা শিল্পীদের গেঙ্গুলী বলা হয়। ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এবং রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম গীতিকার এবং সুরকার। দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুনিলা তঞ্চঙ্গ্যা, মিনা তঞ্চঙ্গ্যা, শোভা তঞ্চঙ্গ্যারা তঞ্চঙ্গ্যা গান এবং নৃত্যকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সমকালীন আধুনিক লেখকদের মধ্যে বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা(পরলোকগত), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। ‘পহর জাঙাল’(তঞ্চঙ্গ্যাদের শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা) তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রকাশনা সাহিত্যে অন্যতম পথ প্রদর্শক। এটির স্বপ্নদ্রষ্টা হচ্ছেন কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি যখন ২০০১-০২ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে বিষু উপলক্ষে। আর এটির উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যরিষ্টার দেবাশীষ রায় ওয়াগ্গা হাই স্কুলের হল রুমে। পরবর্তীতে পহ্ র জাঙাল এর পথ ধরে সিঙহাবা, চালৈন, তৈনগাঙ প্রকাশনাগুলি তঞ্চঙ্গ্যা আধুনিক সাহিত্য চর্চাকে অনেক দুর নিয়ে গেছে। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অন্যতম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক। 

বিবাহ

 তঞ্চঙ্গ্যাদের বিয়ে সাধারণত দুই রকেমের হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ‘দাবারা’ বিয়ে মানে পালিয়ে বিয়ে করা আর অন্যটি হচ্ছে ‘সাঙা’ করে বিয়ে করা মানে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা। এই দাবারা বা সাঙা বিয়ে অনেকটা পরিবারের আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। বর্তমান সময়ে সাঙা করে বিয়ে হলেও আগেকার দিনে বেশীর ভাগ বিয়ে হতো দাবারা করে। তখন এই বিয়েটা পালিয়ে এমনভাবে হতো পরিবারের কোন সদস্য জানতো না। শুধুমাত্র মেয়ের কিছু সঙ্গী-সাথী ছাড়া। পরের দিন জামাইয়ের পক্ষ থেকে কিছু মুরুব্বী এসে বলতো আমরা তোমাদের মেয়েকে বিয়ে নিয়ে গেছি তোমরা কোন চিন্তা করো না। তখন জামাইয়ের পক্ষ থেকে চুরি করে মেয়ে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে ক্ষতিপূরণ হিসেবে শুকর দিতে হতো। বিয়ের এক সপ্তাহ পর জামাই তার নতুন বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে আসতো। সাথে নিয়ে আসতো মিষ্টি-জিলাপী, বিনি পিঠা, সাইন্যা পিঠা, নারিকেলসহ নানা খাদ্য উপকরণ। এই ভাবে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে দুইবার বেড়াতে আসতে হতো। প্রথম বেড়াকে বলা হতো ‘জোড় পুরায় দে-না’ বা জোড় বেঁধে দেওয়া আর দ্বিতীয় বেড়ানকে বলে দ্বিতীয় বেড়া। তঞ্চঙ্গ্যারা মামাতো বোন, মাসিতো বোন এবং দুর-সম্পর্কের ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে। তবে ‘বড় কুদুম’ বা মাতৃতুল্য(মাসি, ফিসি) বিয়ে করা যায় না এবং এটি সামাজিক এবং নীতি বিরোধী। আর আপন ভাই-বোনের মধ্যেও বিয়ে সামাজিক নীতি বিরোধী। 

সামাজিক অনুষ্ঠান এবং পূজা-পার্বন

তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিষু। তার পাশাপাশি নবান্ন উৎসব, আল পালনী, চুমুলাঙ, মিত্তিনি পূজা ইত্যাদি। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ উপলক্ষে বিষু উৎসব খুব ধুমধাম করে পালন করা হয়।  তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বিষুর আনুষ্ঠানিকতা মোট তিনদিন। ফুল বিষু, মুল বিষু এবং বিষু। ফুল বিষু সময় তারা ফুল তোলে এবং ঘর সাজায়। মুল বিষু দিন তারা পাইসন রান্নার জন্য জুম থেকে সবজি খুজে নিয়ে আসে আর খাবার পানি তোলে রাখে।  বিষুর দিনে সবাই নতুন কাপড় পড়ে ঘুরতে বের হয়, বড় জনকে পায়ে ধরে প্রণাম করে। গ্রামে বড়োবুড়ি থাকলে তাদের গোসলের ব্যবস্থা করে। এই বিষু দিনে প্রত্যেক বাড়িতে নানা পিঠা-পুটুলি আর নাস্তা পানি আয়োজন করা হয় এবং আপ্যায়ন করা অতিথিদেরকে। বিষু উপলক্ষে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতী মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। এবং গ্রামে গ্রামে আয়োজন করা হয় গেঙ্গুলী গানের আসর। 

বাসস্থানের ধরণ

তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐত্যিগত বাসগৃহ হচ্ছে বাঁশ এবং শন দিয়ে তৈরী মাচাংঘর। তঞ্চঙ্গ্যা ঘরের একটা নিদিষ্ট ডিজাইন আছে যা প্রত্যেক গৃহস্থ অনুসরণ করে। যা সহজে দেখলে চেনা যায়। ১. মূল ঘর, ২. বারান্দা, ৩.ইচর, ৪. টংঘর। 

খেলা-ধুলা

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধানতম খেলা হচ্ছে ঘিলা খেলা এবং নাদেং খেলা। ঘিলা খেলা হচ্ছে তঞ্চঙ্গ্যাদের জাতীয় খেলা। বিষু উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে ঘিলা খেলা, নাদেং খেলার আয়োজন করা হয়। যুবক-যুবতীরা মিলে দল বেঁধে এই খেলায় অংশ গ্রহন করে। তাছাড়া টুম্বুল খেলা, দু-দু খেলা, তেদই বিচি খেলা, গয়াঙ খেলা, শামুক খেলা, গাত খেলা, সই খেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, ইচিবিচি খেলা, গাইত খেলা,কুত্তা খেলা,লু-আ লুই খেলা,কাইন বা কঞ্চি খেলা, ঢাঙগুলি খেলা, গুলিক খেলা, চি কুতকুত খেলা, বলি খেলা ইত্যাদি। 

শিক্ষার হার এবং জনসংখ্যা

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকদুর এগিয়েছে। তাদের শিক্ষার হার প্রায় ৭৫-৮০% এর মতো। তারা লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়ে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে যোগ্যতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। আর বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার এর মতো। আর সারা পৃতিবীতে ৩-৪ লক্ষ এর কাছাকাছি।  

পিঠা-পুটুলি

তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের বাড়িতে নানা পিঠা তৈরী করে। অনেক সময় নানা উৎসবকে কেন্দ্র এই পিঠা তৈরী করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যারা যেসব পিঠা তৈরী করে সেগুলি হল- সাইন্যা পিঠা, বিনি পিঠা, আইলসি পিঠা, তেল পিঠা,মালি পিঠা(গুলিক/গাইস্যা পিঠা),কলা পিঠা, পাতি সাপ্তা ইত্যাদি পিঠা তৈরী করা হয়। তাছাড়া কইন ভাত, বিনি ভাত,মিষ্ঠান্নও তৈরী করা হয় নানা উপলক্ষ উপলক্ষে।

খাদ্যাভাসঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান খাবার হচ্ছে ভাত। এই ভাতের সাথে মাছ, মাংস (মুরগী, ছাগল, হাঁস, শুকর) তাদের প্রিয় খাবার। এর পাশাপাশি তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে ‘নাপ্পি/ছিদল’ এবং সিদ্ধ যেকোন তরকারী বা শাক-সবজি। শুটকিও তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যাদের জঙ্গল প্রাপ্ত নানা শাক-সবজিও তাদের খুব প্রিয়। 

জন্ম এবং মৃত্যুঃ 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে শিশু জন্মের পর সাতদিন পর্যন্ত মাকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরের কোন কাজ করতে দেয় না রান্না-বান্নাসহ। এটি মূলত একটি নিষেধাজ্ঞা যেখানে পরোক্ষভাবে অসুস্থ মাকে সুস্থ করে তোলার জন্য সবার সহযোগিতা করা। সন্তান প্রসবের পরবর্তী কয়েকটা দিন সে যেন নিজেকে সুস্থ করে তোলার সুযোগ পায়। সাতদিন পর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাকে তঞ্চঙ্গ্যারা বলে ‘পেলা আরি ধরানা’ বা ‘কসই পানি লনা’। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মূলত বাচ্চাকে ঘরের একজন সদস্য হিসেবে বরণ করে নেওয়া এব্ং সামাজিকভাবে স্বকৃীতি প্রদান করা হয়। 

মৃত্যুর পর তঞ্চঙ্গ্যাদের আগুনে দাহ করা হয়। এই দাহ করার স্থানকে তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় ‘ছিদাখলা’ বলা হয়। আর দাহ করতে যাওয়াকে ‘মগদায় যাওয়া’ বলে। তবে দুধের বাচ্চা হলে কবর দেওয়া হয়। ছোট বাচ্চাদের কবরকে ‘পআ কবা’ বলে। মৃত্যুর পর সাতদিনের মধ্যে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠানের আয়োজন করে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করে দেওয়ার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূণ্যানুষ্ঠান করতে তার যেন কোন সমস্যা না হয়। তবে অনেক জায়গায় সমাজের ঘর প্রতি এক কেজি চাল এবং কিছু টাকা দেওয়ার নিয়ম প্রচলন আছে। একে তঞ্চঙ্গ্যা ‘সাত দিন্যা’ বলে। এই সময় ভিক্ষুদের আপ্যায়নসহ নানা ব্যবহার্য সামগ্রি মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করে দেওয়া হয় তার স্বর্গ লাভের হেতুর জন্য। সাথে আপ্যায়ন করা হয় পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতী গোষ্ঠী এবং আত্মীয়-স্বজনকে।  

উপসংহার

অন্য দশটা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী জাতিসত্বার মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও দেশ, সমাজ এবং জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তারা দেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব হয়ে সবার সাথে এগিয়ে যেতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ তাদের গর্ব এবং অনুপ্রেরণা। কেননা এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেক তঞ্চঙ্গ্যাও সরাসরি এবং প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহন করে দেশকে স্বাধীন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তঞ্চঙ্গ্যারা বেঁচে থাকতে চায় অন্য দশটা সাধারণ মানুষের মতো নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিয়ে। বেঁচে থাকতে চায় তার নিজের সংস্কৃতির স্বকীয়টাকে সাথে নিয়ে। সাথে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় সামনে দিকে মায়ের মতো ভালোবেসে।