তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যে যেসকল মানুষের বিচরণ ছিল বা আছে তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা একজন অন্যতম। তাঁর পরিচয় ঘটে বিশেষত তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথার লেখনীতে। তিনি গ্রন্থ ছাড়াও আমৃত্যু লিখে গেছেন বিভিন্ন সাময়িকীর প্রকাশনায়। তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লেখকের পরিচয় জানা যাক-
লেখকে জন্মকথাঃ
শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ১৯৩৭ সালে ১৩ এপ্রিল তৎকালীন রাঙামাটি থানায় অন্তর্গত ১২২ নং কুতুবদিয়া মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজ্যমণি তঞ্চঙ্গ্যা মাতার নাম রতিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা। পিতামাতার দুইপুত্র, এক কন্যার মধ্যে বীরকুমার সর্বকনিষ্ঠ। শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ ১৯৫৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং ওই বছর কানুনগো পাড়া আশুতোষ কলেজেপড়ার সুযোগ পান। সেই কলেজ থেকেই তিনি আই.এ পাস করেন। এরপরে আর আর্থিক অভাবে পড়ার সম্ভব হয়ে উঠেনি তবে পরবর্তী তে ত্রিপিটকের “সুত্ত ও বিনয়” উপাধি পালি ও সংস্কৃত বোর্ড পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৫৯ সালে প্রথমে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে চাকরি করেন, পরে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি জেলা প্রশাসনে অফিস সুপার পদে থেকে চাকরি অবসর নেন।
লেখকের সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানঃ
শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী ছিলেন। আর পরবর্তীতে তার চাকরি কর্মস্থল রাঙামাটি হওয়ায় সাহিত্যচর্চাটা বেশ ভালো ভাবে কাজে লাগান। ১৯৮৬ সালের দিকে শ্রী মদন মোহন দেওয়ান কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক “পার্বত্য বাণী” তে প্রথম সংখ্যায় “কালিন্দী” নামক ইতিবৃত্তমূলক একটা প্রবন্ধ প্রথম প্রকাশ পায়। এটায় শ্রী বীরকুমারের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ বলা যায়। এভাবে পরে রাঙামাটি পাবলিক লাইব্রেরি হতে তৎকালীন প্রকাশিত “অঙ্কুর” রাঙামাটি থেকে প্রকাশিত “সাপ্তাহিক বনভূমি” খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত “পার্বতী”তে তাঁর বহু গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত নাটক “রুনুখাঁর উপাখ্যান” মঞ্চস্থ নাটক “অমিতাভ” যেটা গৌতম বুদ্ধের জীবনী সম্বলিত এবং ১৯৬৭ সালে রাঙামাটি মৈত্রী বিহারের মাঠ প্রাঙ্গণে সাফল্যের সাথে মঞ্চায়ন হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর রচিত চাকমা নাটক “মুড়া যেক্কেনে কানে” নামক নাটকটি নানিয়ারচর উপজেলায় কৃষ্ণমাছড়া গ্রামে মঞ্চস্থ হয়। “রক্ত তিলক” (জুমল্যান্ডের রাজকন্যা) নামক একটা নাটক রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট (তখন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট) গিরিনির্ঝর-এ প্রকাশিত হয়েছে। স্বদেশ ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রকাশিত “বোধিভারতী” সাময়িকীতে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা বেতার কেন্দ্রের রাঙামাটি আঞ্চলিক শাখার গানের লেখক ও কথিকা ছিলেন। “ঢোলক/একতারা” শীর্ষক স্থানীয় আদিবাসীদের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বেতারে প্রতি মাসে প্রথম ও চতুর্থ সপ্তাহে প্রচারিত হতো। এখন আর প্রচারিত হয়না।
অবদান স্বীকৃতিঃ
সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য রাঙামাটি জেলাপরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য অঞ্চল ২০০১ সালে তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২৭ চৈত্র ১৪১৩ সালে “উপজাতীয় সামাজিক ফোরাম” শ্রী বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক সংগঠন “অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী” সাহিত্য অবদানের জন্য এ গুণী লেখককে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
সাহিত্যিকের লেখা বই ও নাটকঃ
১. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি (গ্রন্থনা)
২. তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা।
৩. রক্ততিলক (নাটক)
৪. ভাগ্যরত্ন।
পরলোকগমনঃ
তঞ্চঙ্গ্যা ও আদিবাসী সমাজে সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণকারী ১২ নভেম্বর ২০১৪ সালে নিজ বাসায় রাঙামাটি দক্ষিণ কালিন্দীপুরে এ গুণী লেখক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তাঁর এ মৃত্যুতে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী তথা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ একজন গুণী ও প্রতিভাবান কবি, সাহিত্যিককে হারায়। যা খুব কম সময়ে তাঁর শূণ্যস্থান পূরণ হবার নয়। গোটা পার্বত্য অঞ্চলে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা ও লেখনীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।