তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা

সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস। 

প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি। 

তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি। 

বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)। 

এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;

তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। 

আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত। 

বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। 

ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন। 

ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল। 

উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস) 

তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল। 

১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল। 

সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে। 

সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। 

তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা। 

১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান। 

অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।” 

দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়। 

সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।” 

অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। 

উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র। 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস) 

তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়। 

দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়। 

এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়। 

একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়। 

এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়। 

বাতকস এর লক্ষ্য 

বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।” 

বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য 

নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। 

বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর

বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।

বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। 

২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে। 

বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল

তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল। 

বাতকস এর সম্মেলন সমুহ  

১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন। 

এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল। 

এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।

১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। 

উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন। 

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন। 

এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। 

বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী 

বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-

১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়। 
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। 
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। 
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। 
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে। 
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে। 
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১

লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা, বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ

পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা , কবিরত্ন (১৯২০- ২২শে মার্চ ১৯৯৭)


ড. মনিরুজ্জামান

ভূমিকাঃ

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য-চর্চার ইতিহাস দুই ধরণের। এক. গেঙ্গুলি তথা চারণকবিদের গীত উভাগীত, ধনপুদির গীত, ‘পুরান কদা’ কিংবা শিবচরণের (অষ্টাদশ শতক) গােসাইনলামা অথবা রামায়ণ-মহাভারত ও জাতকাদির জনপ্রিয় কাহিনীর ব্যাখ্যামূলক নীতি বা গীতিকা রচনা। 

এসব গীত গেঙ্গুলিদের সংগৃহীত, হস্তলিখিত এবং প্রাচীন চাকমা (মনক্ষেমর) ও বার্মা লিপিতে চাকমা/তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। এর সবই অপ্রকাশিত (উভাগীতের কিছু অনুবাদ যথা সলিল রায় কৃত ইংরেজি অনুবাদ ও বঙ্গীয় সংস্করণ এর ব্যতিক্রম)। গেঙ্গুলি সংগ্রহের কিছু নমুনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারে ফটোকপি হিসাবে চয়িত আছে।

এই ধরণের রচনা ব্যতীত আর যা পাওয়া যায় তা বাংলা ভাষায় রচিত পার্বত্যবাসীদের নানা গ্রন্থ ও সম্পাদিত নানা পত্রিকা ও সাময়িকা, – যার প্রধান ভাষা বাংলা। অর্থাৎ এ গুলিকে চাকমা ও অন্যানা পার্বত্যজাতির বাংলা ভাষাপ্রীতির ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রকাশ। এবং সাহিত্যের নানা দিকে নিজেদের প্রতিভা স্ফুরণের প্রচেষ্টা। 

এখানে বাংলাভাষী লেখকদের সাথে প্রতিযােগিতার কোনও প্রয়াস এখনও লক্ষ্য করা যায় না যদিও বাংলা সাহিত্যের (বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির) সমালোচনার যােগ্যতা তারা রাখেন এবং সেসব রচনা বাস্তবিক উপভােগ্য। 

সাহিত্যের নানা বর্গে (genre) তাদের এই পদচারণার(নাটকে উপন্যাসে গল্পে আলােচনায়। অনুবাদে ও গানে এবং মৌলিক কবিতায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা তাদের এসব সৃষ্টির প্রয়াস যথেষ্ট উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়) কোন স্বতন্ত্রমূল্য আছে বা হবে কি না তা এখনও বলার সময় আসে নি। 

তবে এই সব সৃষ্টি বা প্রকাশনার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ভাষিক ও সাহিত্যিক মূল্য একদিন হয়তবা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। আজ কাল ডায়াসপােরা ( Diaspora) বা অভিবাসিতের সাহিত্যের যে মূল্যায়ন হচ্ছে, সেই রকম এসব বিভাষীদের বাংলা চর্চার মূল্যও যে কালের দাবী হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে? এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় আমরা রাজস্থলী (কাপ্তাই) এক অস্ফুট কিন্তু অসাধারণ এক প্রতিভা কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার পরিচিতি প্রদানে প্রবৃত্ত হবাে।

পটভূমিঃ

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর পার্বত্যবাসীদের উল্লেখ করে প্রমথবিশী বলেছিলেন, বঙ্গভূমি কেবল পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলাই নয়, পার্বত্য বাংলাও। যাই হােক, বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় পার্বত্যবাসীরাও বাংলা চর্চায় আগ্রহী হন। 

যদিও নন্দলাল শর্মার ভাষায় ‘বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের অবাধ বিচরণের সংবাদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত’। যাই হােক তঞ্চঙ্গ্যাদের এই বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাস চাকমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের সাথে যুক্ত। 

একথা সত্য যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রথম আলিঙ্গন জানান চাকমা রাজবাড়ির প্রধান পুরুষগণ। তবে যতদূর জানা যায় এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়েরও একটি সক্রিয় ভূমিকা আছে। স্কুলটি বিশ শতকের গোড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র ঘােষ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ত্রয়ােদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় (কলিকাতা, ১৩১৪) ‘চাকমাদিগের ভাষা তথ্য’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। 

পরে তিনি (সম্ভবত রাজবাটির উৎসাহ ও প্রণােদনায়) ‘জ্যোতি’ পত্রিকার লেখক গগনচন্দ্র বড়ুয়ার সূত্র ব্যবহার করে ও বহু শ্রম স্বীকার করে ‘চাকমাজাতি’ ( ১৩১৬ সন) শীর্ষক একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। 

সিবিলিয়ানদের পরে ও বাংলাভাষাতে এটিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণের সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বঙ্গীয় অম্বেষণ। এক দশক পরে রাজা ভুবনমােহন রায়-এর ‘চাকমা রাজবংশের ইতিহাস’ (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। এটিই চাকমাদের কর্তৃক বাংলা চর্চার আদি নির্দশন। 

তবে কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় (বিচিত্রা, দেশ প্রভৃতি) রাজ পরিবারেরই লেখা কিছু কিছু গল্প কবিতা এর আগেও প্রকাশিত হয়ে থাকবে। কুমার কোকনদক্ষ রায়ের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। 

যাই হােক, বাংলা ভাষা চর্চায় পৃষ্ঠপােষকতা দানে পরবর্তী কালেও রাজবাটির উৎসাহের প্রাবল্য লক্ষ্য করা গেছে। রানী কালিন্দী রায়, রানী বিনতা রায়, রাজা নলিনাক্ষ রায়, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, এঁরা সকলেই যেমন নিজেরা যােগ্যতার সাথে বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছেন, তেমনি অন্যদেরও সে সুযােগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষা-চর্চার এই পরিবেশটি আসলে গড়ে ওঠে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকেরও মধ্যকালে এসে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের নিজের সাহিত্য- পটভূমিতেও নানা পরিবর্তন যােজিত হতে থাকে। 

নতুন পত্র পত্রিকার আবির্ভাব, উনিশ শতকের সাহিত্যের ভিন্ন মূল্যায়ন, মাক্সির্য় দর্শনের প্রভাব, লােকসংস্কৃতির পঠনপাঠন (কবি জসীম উদদীনেরও আবির্ভাব এই সময় : রাখালী ও কর’ ১৯২৭, নকশীকাঁথার মাঠ ১৯২৯, সােজন বাদিয়ার ঘাট ১৯৩৩ প্রভৃতি) এবং রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নৰ জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ‘কাল-চিহ্ন’ বহন করে চলছিল সময়ের নিম্নবাহী স্রোত। 

সমকালীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আধুনিকতার নামে এক ‘তিমির তীর্থ’ পরিক্রমণে উদ্যোগী তখন। এই পটভূমি বৃহত্তর দেশ ও তার সংস্কৃতিকে অন্যরকম প্রতিক্রিয়ার মুখােমুখি করে। অর্থাৎ একদিকে এক ধরেণর নম্রজাতীয়তাবাদ ও অন্যদিকে নাগরিক বােধ সৃষ্টি ও বিশ্বমুখিন চেতনা বিকাশের নামে শিকড়বিহীন যে আধুনিক সাহিত্য ও নব সংস্কৃতি সৃষ্টি, তার প্রতি অনীহা সংস্কৃতি- সচেতন মানুষকে তার অন্তবােধের প্রতি বিশ্বস্ত হতে প্রেরণা যােগায়। 

বৃত্তের মধ্যে যে কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিমুখী শক্তির কথা বলা হয়। এখানে যেন তারই উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়। এইভাবেই কেন্দ্র থেকে দূরে প্রান্তীয় অবস্থানে বাংলাভাষার লােকজ, আঞ্চলিক বা গ্রামীণ, এবং উপসীমান্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা গড়ে উঠতে থাকে। 

রেঙ্গুনে ‘বুদ্ধবাণী’ প্রকাশ ও পার্বত্য চট্টগ্রােম ছাত্র সমিতির মুখপত্র ‘প্রগতি’ প্রকাশনা (যদিও অস্থায়ী) এবং রাঙ্গামাটিতে গৈরিকা-গােষ্ঠীর উত্থান তারই প্রামাণ্য বহিঃপ্রকাশ। 

গৈরিকা’র প্রভাবে ও গৈরিকা’র অবর্তমানে পরে আরও কিছু পত্রিকার ও আবির্ভাব ঘটে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। ‘গৈরিকা’র প্রকাশ কাল (১৯৩৬- ১৯৫১), পরে বান্দরবানে ‘ঝরণা’ (১৯৬৬), এবং আরও পরে রাঙ্গামাটিতেই ‘বনভূমি’, ‘পার্বত্যবাণী’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ‘পার্বত্যবাণী’ সম্পাদনা করেন বিরাজমােহন দেওয়ান (১৯৬৭-১৯৭০;মােট সংখ্যা ২৬টি)। এতে আগরতারা ও উভাগীত এবং রাজ পরিবারের অনেকের রচনা ও স্মৃতি কথাও (রানী বিনীতা রায়ের জীবনস্মৃতি সহ) প্রকাশিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বিশেষ করে রাঙ্গামাটি থেকে পরবর্তীতে বহু পত্র-পত্রিকা ও সংকলন প্রকাশিত হলেও (বিস্তৃত তালিকার জন্য বর্তমান লেখকের গােষ্ঠী পত্রিকা ও সাময়িকী ২০০৬ দেখা যেতে পারে। এছাড়া নন্দলাল শর্মারও একটি সমীক্ষা রয়েছে)। ‘গৈরিকা’র ভূমিকা ঐতিহাসিক। ‘গৈরিকা’র নামকরণেরও ঐতিহ্য আছে। এটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। রানী বিনীতা রায়ের পরিচালনায় রাঙ্গামাটি থেকেই এটি প্রকাশিত হয়। 

রাজা নলিনাক্ষ রায়ের প্রয়াণে তার স্মৃতি সংখ্যাটিই এর শেষ সংখ্যা ছিল (১৯৫১)। প্রভাতকুমার দেওয়ান ও পরে অরুণ রায় পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। অরুণ রায়ের প্রথম প্রকাশ ‘বুদ্ধবাণী’তে (রেঙ্গুন)। 

আরও অনেকের প্রাথমিক প্রস্তুতি বাইরের, তন্মধ্যে কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ও রবীন্দ্রপ্রভাবিত গীতিকার চূণীলাল দেওয়ানের কথাও বলা যায়। কুমার কোকনদাক্ষ রায়ের কথা আগেই বলা হয়েছে। 

কিন্তু নন্দলাল শর্মার উক্তিটি সমর্থন করে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালে চাকমা ভাষায় যে কবিতা চর্চা হচ্ছে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে ‘গৈরিকা’। নন্দলাল শর্মা গৈরিকা’র লেখকদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছেন এভাবে। 

প্রভাত কুমার দেওয়ান, অরুণ বা, কন্যার কোকনদাক্ষ রায়, বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ান, রানী বিনীতা রায়, অবিনাশচন্দ্র দেওয়ান, কালাঞ্জয় চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান, ভগবানচন্দ্র বর্মন, শেখর দেওয়ান, ও সােমেন দেওয়ান (আসলে বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ানের দুটি ছদ্মনাম), কুমার বিপাক্ষ রায়, গােপাল চন্দ্র গুর্খা, তনুৱাম খীসা, নীলা রায়, বিপুলেশ্বর দেওয়ান, রাজা নলিনাক্ষ রায়, চমীকাল দেওয়ান, শান্তি রায়, সুনীতিজীবন চাকমা, গিরীন্দ্র বিজয় দেওয়ান, নীরােদরঞ্জন দেওয়ান, কুমার রমণী মােহন রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, জগদীশ চন্দ্র বর্মন ও রাজেন্দ্রনাথ তালুকদার। 

এই তালিকায় হয়তাে আরও দু একটা নাম যুক্ত হতে পারে যেমন, কুমার কুবলয়াক্ষ রায়, সৌমেন্দ্র নারায়ণ দেওয়ান, নােয়ারাম চাকমা, বেণীমাধব বড়য়া প্রভৃতি। পরবর্তীতে আমরা এমন অনেককে পাই যাদের নাম এই তালিকায় পাই, যেমন- বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়কেতন চাকমা বা মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা প্রভৃতি। 

হতে পারে গৈরিকা-গােষ্ঠী ভুক্ত ছিলেন না তারা। সেই রকমই একটি নাম হল কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (১৯২০-২২শে মার্চ ১৯৯৭)। 

তিনি কোনও দলভুক্ত হয়ে সাহিত্য চর্চার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন নি বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি স্বাধীনভাবেই সাহিত্য চর্চা করেছেন, যদিও ‘পার্বত্যবাণী’তে তাঁর কিছু রচনা প্রকাশিত হতে দেখা যায়। 

অন্য পত্রিকায়ও তার রচনা প্রকাশিত হয়ে থাকবে। বস্তুত কার্তিকচন্দ্রের আবির্ভাব কালের সময় ও পরিবেশ ছিল এটাই। অবশ্য তাঁর প্রথম আবির্ভাবের তথ্যটি অর্থাৎ প্রথম রচনা প্রকাশের তথ্য এখনও অস্পষ্ট। তাঁর অনেকগুলি পান্ডুলিপি পাওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা স্বীকার্য। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ভূমিকা ও অবস্থান 

কবি কার্ত্তিকচন্দ্র যা কিছু রচনা করেছেন তা মূলত বৌদ্ধ সাহিত্য এবং তাঁর সবই বাংলা ভাষায় রচিত। তিনি কি বৃহত্তর পাঠকের চিন্তা থেকেই তা করেছিলেন? তঞ্চঙ্গ্যা সমাজেই বা তার অবস্থান কোথায়? – এ প্রশ্নের উত্তরে ও বিশ শতকের তৃতীয় দশকেই যেতে হবে আমাদের, যখন পালিসাহিত্য চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন বিলাইছড়ি রাইংখ্যং-এর আশাছড়িমুখ নিবাসী এক লােক চিকিৎসক- কবি পমলাধন।

পমলাধনের সমকালে বা সামান্য আগে শরৎ রােয়াজার এবং চূনীলাল দেওয়ানের সংগীত ও কাব্যচর্চার কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেন (দ্রষ্টব্য, নন্দলাল শর্মা, ঐ), কিন্তু। তাদের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। 

পলাধন ধর্ম- সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি। তারই যােগ্য উত্তর পুরুষ কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। পলাধনের সাহিত্যকে বিস্তৃত করেন তিনি। এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়েই তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থানকে উজ্জ্বল করেন এই দুই কৃতিমান পুরুষ। 

কার্তিকচন্দ্রের জন্ম হয় ১৯২০ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর । তিনি চাকমা জাতির ইতিকথা’র বিখ্যাত লেখক বঙ্কিমকৃষ্ণা দেওয়ান এর সমবয়সী এবং বিরাজ মােহন দেওয়ান (চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত), প্রভাতকুমার দেওয়ান (গৈরিকা-সম্পাদক), চূনীলাল দেওয়ান (চাকমা কবিতা, জুমিয়া গৃহিণী –লেখক), কবি অরুণ রায়, গল্পকার জগদীশ দেব বর্মন, প্রবন্ধকার ভগবানচন্দ্র বর্মন, ‘প্রগতি’ সম্পাদক শরৎচন্দ্র তালুকদার ও সুনীতিজীবন চাকমা, কবি-অনুবাদক সলিল রায়, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি’র লেখক বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখের তিনি সমকালীন বা অগ্রজ। তাঁর “বৌদ্ধগল্পমালা’ (১৩৯৬) গ্রন্থের ভূমিকায় (আমার কথা) প্রদত্ত দুটি তথ্য নিম্নরূপ:

“… রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া শাক্যমনি বিহারের অধ্যক্ষ বৌদ্ধসাহিত্য সুসাহিত্যিক ও সুপন্ডিত শ্রীমৎ প্রিয়দর্শী মহাস্থবির মহােদয় আমার রচিত এই বৌদ্ধগল্পমালা পুস্তকের পান্ডুলিপিখানা আগাগােড়া পড়ে আমাকে ধর্ম প্রচারের জন্য বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেন। আমি মহাস্থবির মহােদয়ের নিকট চির কৃতজ্ঞ। 
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটী সরকারী কলেজের বাংলার অধ্যাপক বাবু নন্দলাল শৰ্মা তাঁহার লিথিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের (বাংলা) সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ পুস্তকে আমার রচিত পুস্তক সমূহ বিশেষভাবে সমালােচনা করে আমাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রেখেছেন।”…

দুটি মন্তব্যের অনুরূপ বক্তব্য তাঁর অপরাপর গ্রন্থেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ কবি তাঁর প্রতিটি গ্রন্থেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে কোনও না কোনও ধর্মগুরু বা রাজগুরুর কথা উল্লেখ করেছেন এবং ধর্মপ্রচার ও মানুষের মঙ্গলের বিবেচনাকেই সেখানে প্রধান্য দিতে দেখা গেছে। 

মহাস্থবির মহােদয়ের প্রভাবে তিনি এই গ্রন্থ শেষেও বলেছেন, ‘এই পুস্তকের দ্বারা ধর্মপ্রাণ নর-নারীগণের যৎসামান্য উপকারে আসলে আমার রচনা শ্রম সার্থক মনে করবাে।’ এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৩৯৪/১৯৮৭ ইং। অর্থাৎ এর আগেও তিনি যেসব ধর্মকেন্দ্রি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, যেমন- মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বুদ্ধ সালামী গাথা (১৯৮৫) কিংবা যেসব রচনার পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে যেমন – রাধামন ধনপতি প্রভৃতি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােক গাথা এবং “অশােক চরি” নামীয় একটি চরিত কাব্য ও অন্যান্য কিছু রচনা, – সেগুলিরও প্রত্যেকটি মধ্যেই কবির এই ধর্মপ্রীতি ও ধর্মপ্রচারের আকাঙ্খা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

আগেই উল্লেখিত হয়েছে, (১৯৩৬ সালে) পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘ধর্মজ জাতক’ গ্রন্থটি মূল পালি থেকে পদ্যানুবাদ করে বা পদ্যরীতিতে ভাবানুবাদ করে এবং তৎসহ ‘ধর্ম্ম হিত উপদেশ’ সংযােজন করে বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্ম সাহিত্য রচনার সূচনা করেছিলেন, কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাকেই আদর্শ হিসাবে নিয়েছেন। 

এই সাহিত্যের শাখাকে বিস্তৃত করাতেই মনােযােগী হয়েছেন তিনি। কাজটি তিনি সম্পন্ন করেছেন, দুই ভাবে- মননী মেধা প্রয়ােগে (যেমন, তত্ত্ব- কাব্য ও ধর্মকাব্যের মাধ্যমে) ও সৃজনী মেধার মাধ্যমে বা মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ চরিত কাব্য, কাহিনী বা গাথা কাব্য ও কাব্য নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে। 

রচনার বিষয় ও তার সরস প্রকাশ, নাটকীয় গুণ ও কাব্যবােধ মিলিয়ে উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সকল সৃষ্টিতেই। উল্লেখ্য কার্ত্তিকচন্দ্র ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’র সাথে পমলাধনের ‘ধর্যধ্বজ জাতক’ গ্রন্থটিও সম্পাদিত ও সংশােধিত আকারে প্রকাশ করেন। 

এই কারণে তিনি রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক “পন্ডিত” ও ‘উদয়ন যন্ত্র’ রচনার জন্যে প্রিয়দর্শী মহাস্থবির কর্তৃক “কবিরত্ন” উপাধি লাভ করেন রাঙ্গুনীয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির আয়ােজনে। 

কবি কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা রচনা পরিচিতি 

কবি তাঁর একাধিক গ্রন্থে অধ্যাপক নন্দলাল শর্মার উল্লেখ করে বলেছেন তিনি তাঁর (কবির) গ্রন্থের মূল্যায়ন করেছেন, এজন্য তিনি তাঁর (অধ্যাপক শর্মার) কাছে কৃতজ্ঞ। ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ (১৯৮১) পুস্তিকায় নন্দলাল শৰ্মা পাহাড়ী বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার কথাও এসেছে প্রাসঙ্গিক ভাবেই। উক্ত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে কার্ত্তিকচন্দ্রের মূল্যায়ন সমূহ আমরা প্রথমে তুলে ধরতে চাই। তা নিম্নরূপ –

১. উদয়ন বস্তু:

১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘উদয়ন বস্তু’। পয়ার ছন্দে লিখিত এবং ছাব্বিশটি ছােট ছােট অধ্যায়ে বিভক্ত। এই কাব্য গ্রন্থে বর্ণিত শ্যামাবতীর কাহিনী যুদ্ধের সমকালীন ঘটনা হলেও অনেকটা বুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা সম্বলিত। 

বার্মায় ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vathu) অনুসরণে কাব্যটি রচিত। কর্মফলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কবি এ কাব্যের শেষাংশে বলেছেন- 

“দানশীল ভাবনাতে মন কর স্থির
কুশল কর্মেতে লিপ্ত থাক সদা ধীর।”

২. অনাগত বংশ : 

“অনাগতবংশ’ নামে তিনি একখানা কাব্য প্রণয়ন করেছেন। বর্মী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেন চিনি অং মাষ্টার। সেখান থেকে কার্তিক বাবু সরল পয়ার ছন্দে বইটি রচনা করেন। এ কাব্যে আর্থমিত্র প্রমুখ অনাগত বৃদ্ধদের সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণিত হয়েছে।” (পৃ. এগার)

৩. বিজয়গিরি:

“মূলত কবি হলেও কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (জন্ম ১৯২০) দু’খানা নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকদ্বয় প্রকাশিত হয় নি। ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘বিজয়গিরি’ চার অঙ্কের নাটক। 

চম্পক নগরের রাজা উদয়গিরির পুত্র বিজয়গিরিকে রাজ্যভার অর্পন করে শ্রী বৌদ্ধ মন্দিরে গমন করতে চান। কিন্তু বিজয়গিরি বের হতে চান দিগ্বিজয়ে। এ সময় উদয়পুরের রাজা জংলী কুকীরাজ কালঞ্জয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাঁদের শরণাপন্ন হন। 

বিপুল বিক্রমে বিজয়গিরি মিত্ররাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রোয়াং দেশের রাজা মঙ্গল উদয়পুর লুণ্ঠন করতে আসলে সেনাপতি তা প্রতিহত করেন। বিজয় অভিযানে বের হয়ে বিজয়গিরি রােয়াং রাজ্য জয় করেন। এই হল নাটকের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। 

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতি অনুগত থেকেও নাট্যকার কতিপয় কাল্পনিক চরিত্র-নাগরিকগণ, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী, গয়ারাম, গঙ্গরাম প্রভৃতি চরিত্র উপস্থাপন করে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। 

এ নাটকের সংলাপ কখনাে গদ্যে আবার কখনাে মিলহীন প্রবহমান। পয়ার ছন্দে রচিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কথনাে দৃশ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে। বিবেক চরিত্র ও সংগীতের সংযােজন নাটকটিকে যাত্রাভিনয়ের মর্যাদা দান করেছে।” 

৪. মানুষ দেব :

“ ভগবান গৌতম বুদ্ধের অতীত (জাতক) কাহিনী অবলম্বনে কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ‘মানুষ দেবতা’ নামে তিন অঙ্কের একখানা নাটক রচনা করেছেন। রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। 

মঘবা নামে বােধিসত্ত্ব মানুষকে পঞ্চশীল পালনে ও জনহিতকর কার্যে উধুদ্ধ করেন। মাতালদের বিচার করে উৎকোচ করত মন্ডল। মদ্যপান বন্ধ হয়ে গেলে সে মঘবাকে ডাকাত বলে রাজ সমীপে নালিশ করে। বিনা বিচারে মঘবার শাস্তি হয়। কিন্তু মহমী মঘবাকে পদলিত না করায় রাজা নিজের ভুল বুঝে মঘকে মুক্তি ও মন্ডলকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। 

জাতকের এ কাহিনীকে যাত্রাগানের মত নাট্যকার উপস্থাপিত করেছেন। আধুনিক নাট্যকলা শ্ৰী তঞ্চঙ্গ্যার নাটকে অনুপস্থিত। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনাই তাঁকে নাট্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।” 

৫. রাধামন ধনপুদি গেঙ্গুলী গীত : 

“ বান্দরবান মহকুমার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হেডম্যান ও জনসাধারণের একমাত্র মুখপত্র ত্রৈমাসিক ‘ঝরণা’র প্রথম সংখ্যার ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত হয়। 

… চার সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ‘ঝরণা’ বন্ধ হয়ে যায়। ঝরণা’তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন- কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার ‘রাধামােহন ধনবতী কাহিনী অবলম্বনে ‘গেঙ্গুলী গীত’ … ইত্যাদি।”

৬. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষাঃ

শ্রী নন্দলাল শর্মার বর্ণিত গ্রন্থে কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এই পাঁচটি গ্রন্থের বিবরণ ছাড়া আর একটি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায় গ্রন্থের পরিশিষ্টে ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থের তালিকাংশে। উক্ত গ্রন্থের নাম ‘বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা’। 

গ্রন্থটির প্রকাশকাল দেওয়া নেই এবং প্রকাশের স্থানে উল্লেখ আছে (রাইংখ্যং মুখ?), অর্থাৎ প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্যটি অনিশ্চিত বা অজ্ঞাত। এছাড়া ‘পার্বত্যবাণী’ পত্রিকায় বা অন্যত্র ও অন্যভাবে কবি যে ‘কালেভদ্রে’ দুএকটা কবিতা প্রকাশ করেছেন তার উল্লেখ আছে কিছুটা সমালােচনার ভঙ্গিতে-

“কবি অরুণ রায় ও কবি কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা সত্তরের দশকে নিজ নিজ কাব্য প্রতিভার অবক্ষয় অপরােক্ষ করলেও কালে ভদ্রে দু’চার চরণ। কবিতা লেখা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না।”

পাঁচ. কবির মাধ্যম, প্রকরণ ও মূল্যায়নঃ কবির পূর্ণ গ্রন্থতালিকা এটি নয়। বর্ণিত তালিকা ও বিবরণ থেকে কবির একটি সামান্য পরিচয় মাত্র লাভ করা যায় যা অধ্যাপক গবেষক নন্দলাল শর্মা পরিশ্রম সহকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 

আমার অপর ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তনচংগ্যার সহায়তায় আমি একটি শ্রেণীকৃত রচনা তালিকা তৈরীর প্রয়াস পেয়েছি, সেটি পরিশিষ্টে যােগ করা হল। 

কবির রচনাপঞ্জি (আংশিক নয়) নির্মিত না হলে এবং সমুদয় রচনা প্রকাশিত না হলে। তাঁর সম্পর্কে পূর্ণ মূল্যায়ন অপেক্ষিত থাকে। আমরাও এখানে কবির কর্মের সম্পূর্ণ মূল্যায়নে বিরত থাকলাম তার অধিকাংশ রচনাই অপ্রকাশিত থাকার কারণে।

কবির মূল রচনা সমূহ কাব্যাকারে রচিত, যদিও এসব রচনা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত, যথা রাধামন ( রাধামােহন)-ধনপুদি (ধনবতী) গাথা একটি মিথ ভিত্তিক জাতীয় লােকগাথা শ্রেণীর, অশােক চরিত একটি কাব্যনাট্য শ্রেণীর, অনাগত বংশ একটি মিশ্র রীতির রচনাগুচ্ছ, অধিকাংশ নাটক আবার পালা বা যাত্রা জাতীয় এবং কাব্য শ্রেণীর গ্রন্থগুলি ধর্মদেশনা ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক। কবির সব রচনাই আবার পয়ার ছন্দে বদ্ধ। 

তাঁর প্রবন্ধ সমূহ ও কিছু কিছু গীতি ও নীতি কবিতা এর ব্যতিক্রম মাত্র। অধিকাংশ বা প্রায় সমুদয় রচনা বাংলা ভাষায় রচিত হলেও ‘বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা’ (১৯৮৫) এই বার পৃষ্ঠার প্রার্থনামূলক গ্রন্থটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় রচিত। তাঁর ভাষার নমুনা এই রূপ – 

বুদ্ধ ধৰ্ম্ম সংঘ গুণ 
ভাবনা গরং মনত্তুন। 
কায়ামনে কধায়ে,
ভজন গরং সদায়ে। 

এখানে ভাষাই পরিবর্তিত হয় নি, ছন্দরীতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। 

ছয়. পরিশিষ্ট – ১ 

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের প্রকাশনা সংক্রান্ত অন্যান্য তথ্য

১. বৌদ্ধ শিক্ষা (১৩৪৬) ও ২. উদয়ন বন্ধ (১৩৬৮):

“মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪) গ্রন্থের ভূমিকায় (‘আমার কথা’) উল্লেখ আছে : “আমি ইতিপূর্বেও কয়েকখানা বই লিখেছিলাম। ১৩৪৬ সন বাংলাতে ‘বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামক একখানা বই লিখে প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করেছিলাম। 

আর ১৩৬৮ বাংলা সনে উদয়ন বস্তু” নামে একখানা বই লিখে, তাহা প্রেসে ছাপিয়ে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নর-নারীগণের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আরও কিছু বই লিখেছি। কিন্তু ছাপাকারে প্রকাশ হয়নি। …” 

৩. উদয়ন বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮/১৯৬১ ইং), গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১৩০ 

গ্রহারম্ভে ‘মূল গাথা’, ‘পরিচিতি’ ও ‘আমার কথা’ যুক্ত ‘পরিচিতি থেকে উদ্ধৃতি- 

“অপ্রমাদ মূল পাথা ভাষিত যখন 
মহারাজ উদয়ন সময়ে তখন। 
আরম্ভ করিব গল্প কাহিনী বিস্তার,
কার্তিক তঞ্চঙ্গ্যা রচে শ্বায় পার।” 

“আমার কথা” 

“বৌদ্ধধর্ম কর্মহী; লােকে যাহা কর্ম করে তাহাই কর্মের ফলরূপে ভােগ করিয়া থাকে। ‘উদয়ন বন্ত্র’ গল্প কাহিনী কর্মফলের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ ।…

বার্মার ষষ্ঠ সংঘায়নের কার্যকারক বার্মা ইউনিয়ন বুদ্ধ শাসন কাউন্সিল কর্তৃক প্রচারিত The light of the Dhamma ( ধর্মের আলাে) নামক প্রচার পত্রের The story of udena (Udena Vatlu) ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে ‘উদয়ন বন্ধু’ নামকরণে এই পুস্তক প্রণয়ন করিলাম ।…”

সূচিপত্র

বিষয় – দুইবন্ধু – উদয়ন- উদয়নের রাজ্যলাভ – অভিষেক উৎসব- তৃষ্ণালয়ে জন্ম দাসীর ভাগ্য- সাধু সঙ্গ লাভের ফল- কৰ্ম্মফল ভুগিতে হয়- কৰ্ম্ম রাখে যারে কে মারিতে পারে- ঘােষক শ্ৰেষ্ঠী- সুখ দুঃখ চক্রবৎ-শ্রেষ্ঠী কুমারী শ্যামাবতী- মহারাজ চন্দ্র প্রদ্যোতরাজকুমারী বসুল দত্তা- দ্বিজ নন্দিনী মাগন্দ্বিরা – অর্দ্ব উপোসথের ফল- কৌশাম্বীতে বুদ্ধের শুভাগমন- কুজোত্তরা- মাগন্দ্বিয়ার শক্রতা- শ্যামাবতীর বর লাভ কৰ্ম্মফলমাগন্দ্বিয়ার সাজা- ভিক্ষগণের প্রতি বুদ্ধের উপদেশ- উপসংহার । 

৪. মহাৰােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); গ্রন্থ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৮। প্রকাশকের (শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: ভিক্ষু) নিবেদন’… ভগবান বুদ্ধের অমৃতময় দেশবাণীকে প্রচার করা (র) … সংকল্প পােষণ করে আমার দায়ক শ্রদ্ধাবান উপাসক কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচিত ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ তৎসঙ্গে স্বর্গীয় কবিরাজ মশাধন তঞ্চঙ্গ্যা রচিত ‘ধৰ্ম্মধ্বজ জাতক’ বই খানা … প্রকাশ করতে কৃত সংকল্প… হলাম । এই পুস্তক প্রচারের দ্বারা ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ নরনারী গণের যৎকিঞ্চিৎ উপকার হলে আমার আশা পূর্ণ হবে।’ 

আমার (গ্রন্থকার) কথা- 
‘মহাকারুণিক শান্তা তথাগত ভগবান গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখতে আমি বহুদিন ধরে আশা পােষণ করে আসছি।… বুদ্ধের… এসব বিষয়ে সর্বসাধারণের সহজে যাতে বােধগম্য হতে পারে মােটামুটি এক নজরে বুদ্ধকে জানবার জন্য আমি ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ নাম দিয়ে এই বইখানা… মহাবােধি পালঙ্কের আদি বিবরণ সরল বাংলা পয়ার ছন্দে লিখে… পাঠ করে শুনালে শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ শান্ত জ্যোতি: স্থবির বইখানা প্রেসে ছাপাইয়া প্রকাশ করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাই আমি শ্রদ্ধেয় ভান্তের নিকট চির কৃতজ্ঞ।’ 

উৎসর্গ – 
‘স্বর্গীয় পিতৃদেব আন্তখা তঞ্চঙ্গ্যা (কালাবৈদ্য) স্বর্গীয় মাতৃদেবী মনপুরি তঞ্চঙ্গ্যা – তাঁহাদের পূণ্য স্মৃতি স্মরণে’ । (১০ ঢরণের কবিতা সহ)। 
বিষয়: বন্দনা – মাতাপিতা গুরু বন্দনা – মহাবােধি পালঙ্ক কথা – কুলপুত্র নন্দিয় কথা। 

৫. ধর্মধ্বজ জাতক : কবিরাজ পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা প্রণীত, পন্ডিত শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবি রত্ন কর্তৃক সংশােধিত ও সম্পাদিত ১৩৯০: পৃ. ৩৯-৮০। সুচিপত্র। বন্দনা- সূচনা- বারমাসী পুরীর বর্ণনা- বিনিশ্চয় বিচার- ধর্থ ঋজকে পঞ্চকৰ্ম্ম আদেশ-বিশ্বকৰ্মাকর্তৃক গজদন্ডময় গৃহ নিৰ্মাণ- ছত্রপানি কর্তৃক চণ্ডুবিধ গুণ।

ব্যাখ্যা- রাজা যশাপানিকে পঞ্চজের উপদেশ দান- কবিরাজ পমপান তঞ্চঙ্গ্যা সংক্ষিপ্ত জীবনী।

৬. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (১৯৮৫/২৫২৯ বুদ্ধাব্দ) 
উৎসর্গপত্রঃ ‘আমার পিতামহ পরম উপাসক স্বর্গীয় শােভাধন তঞ্চঙ্গ্যা ও তাহার সহধর্শিনী উপাসিকা স্বর্গীয় কইবী তঞ্চঙ্গ্য-এর পূণ্যস্মৃতি স্মরণে’। (১২ চরণের কবিতা সহ)

সাত, পরিশিষ্ট -২

কবিরত্ন কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার রচনাসমূহ
(শ্রেণীকৃত তালিকা) 

১। প্রকাশিত গ্রন্থ (কাব্য বা ধৰ্মকাব্য)
ক. ভাষা: তঞ্চঙ্গ্যা- বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা (আগষ্ট ১৯৮৫)। 
খ. ভাষা: বাংলা – বৌদ্ধশিক্ষা (১৩৪৬); উদয়ন বস্তু বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮); মহাবােধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); বৌদ্ধ গল্পমালা (১৯৮৭)। 
২। সম্পাদিত গ্রন্থ 
ক. ধৰ্ম্ম ঋজ জাতক – পলাধন তঞ্চঙ্গ্যা মূলগ্রন্থের সংশােধন ও সম্পাদনা (১৩৯০)। 
৩। প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ-
ক. লােকগাথার কাব্যরূপ ঐতিহাসিক) : রাধামন ধনপুদি কাব্য। 
খ. চরিত কাব্য: অশােক চরিত (রচনা ১৯৮৩); অনাগতবংশ। 
গ. নাট্য কাব্য (ঐতিহাসিক) : বিজয়গিরি। 
ঘ. চরিত নাটক (ধর্মীয়); মানুষ দেবতা। 
ঙ. তপ কীর্তন ও যাত্রা পালা । বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা (রচনা ২৫/০৪/১৯৮৫) শ্রীবুদ্ধের বারােমাস স্মৃতি (রাজস্থলী মৈত্রী বিহার প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ, ২৬/০৩/১৯৭৮) 
চ. বিবিধ শ্রেণীর কল্পতরু দান ফল কথা; বন্দনা ও দান ফল কথা; অক্ষর গাথা। 
৪। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা – 
ক. ‘নববর্ষ’। রাজবলাকা (১৫ এপ্রিল ১৯৮৭ সংখ্যা)। 
খ. ‘আশ্বিনী পর্ণিমা’। নৈরঞ্জনা (সম্পা, সয় চাকমা, ২০ আশ্বিন ১৩৮৮ সংখ্যা)। 
গ. দেবৱিলােকন’। সম্বােধি (সম্পা. ভিক্ষু শদ্ধা প্রিয়, ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা ১৩৯০)। 
ঘ. ‘জীবন রহস্য’। পার্বত্যবাণী (সম্পা. বিরাজ মােহন দেওয়ান) ১ম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭।

৫। প্রকাশিত প্রবন্ধক- 
ক. ‘চাকমা পেঙ্গুলীগীত’ (লােক কাহিনী): 
ঝরণা ১ম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা মার্চ ১৯৬৭ (সম্পাদক, সৈয়দ খাজা আহমদ) 
ঝরণা ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা জুন ১৯৬৭ (সম্পাদক, সুনীতি বিকাশ চাকমা)। 
ঝরণী ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ (সম্পাদক,সুনীতি বিকাশ চাকমা) 
খ. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি (জাতিতত্ত্ব) : সাপ্তাহিক বনভূমি, ২৬ মার্চ ১৯৮৪ (সম্পাদক : এম মকসুদ আহমদ)*

তথ্য নির্দেশ 
১। শ্রী নন্দলাল শর্মা (১৯৮১): পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিক। 
রাঙ্গামাটি 
২। বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (১৯৯৫) : তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি। বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি। 
৩। ‘গৈরিকা’র ফাইল 
৪। শ্রীমান কর্মধন তন্চংগ্যার ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

* টিকা : কার্তিকচন্দ্রের প্রকাশিত গ্রন্থের নামপত্রেও অনেকগুলি গ্রন্থের নাম আছে। কিন্তু সব গ্ৰন্থই প্রকাশিত কিনা জানা যায় না। নন্দলাল শর্মার গ্রন্থে (১৯৮১) বৌদ্ধ ধর্ম। শিক্ষার উল্লেখ থাকলেও কবির ‘মহাবােধি পালঙ্ক কথা’ র আখ্যাপত্র প্রদত্ত পুস্তক তালিকার মধ্যে এবং উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা (আমার কথা”)-তেও বৌদ্ধ শিক্ষা’ নামটিই পাওয়া যায়। নন্দলাল শর্মা ‘ধর্মপ্লজ জাতক’ এর প্রকাশ কাল ১৯৩৬ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি গ্রন্থটি সম্পাদিত রূপ (কবিরত্ন কার্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকর্তৃক ১৯৮৪ সংস্করণ)- টি সম্ভবত পান নি।

প্রসঙ্গঃ 

তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাঃ একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে জন্ম

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সাহিত্যটা গড়ে উঠে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে বিশেষ করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যটা। জুম চাষের মধ্য দিয়ে তারা তাদের সাহিত্যের স্বপ্নগুলিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং জীবনের বীজ বুনতো। তঞ্চঙ্গ্যারা এই জুমকে ভালোবাসে এবং এই জুম সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা সেই স্বরণাতীতকাল থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। স্বরণযোগ্য যে বর্তমানে যারা তন্চংগ্যা বা তঞ্চঙ্গ্যা নামে পরিচিত, এককালে তারা দাইনাক বা দৈনাক পরিচয়ে আরাকান বা মায়ানমারের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য দান্যাওয়াদি থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। পরবর্তীতে তারা তঞ্চঙ্গ্যা নামে কক্সবাজার, টেকনাফ ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী তৈনছড়ি-তৈনগাঙ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটির অন্যান্য অঞ্চল ও চট্টগ্রাম জেলার রইস্যাবিলি রাঙ্গুনীয়া অঞ্চলে। তবে কক্সবাজার এবং টেকনাফের তঞ্চঙ্গ্যারা এখনো অনেকে চাকমা পদবী ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কথা বলেন তঞ্চঙ্গ্যার ‘মো’ গছাদের মতো। আবার অনেকে বর্তমান তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে আসল চাকমা বলেও মানেন, এটি অবশ্যই ইতিহাসের পাঠ্য। পরে অনেকে কাপ্তাই বাঁধের নতুন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী ও স্বীকার পরবর্তী বাসিন্দা ভারতের নানা প্রদেশ। সাধক কবি শিবচরণ, রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, রাজ গেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থির এর মতো প্রগতিযশা ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি আজ একটি  আলোকিত জাতি হিসেবে স্বকৃীত।   

আমি যখন কলেজে পড়তাম তখন থেকে একটি চিন্তা আমার মাথায় সবসময় ঘুরপাক খেত, তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে নিয়ে। আমি যতটুকু জানি তঞ্চঙ্গ্যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। নানা কারণে এই ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলি তঞ্চঙ্গ্যাারা রক্ষা বা লালন-পালন করতে পারেনি এটি তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ব্যর্থটা নয় এটি ঐতিহাসিকতার ব্যর্থটার ফল। 

তন্চংগ্যাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল শুধু এই কথা বলে বসে থাকলে আমাদের চলবে না,চর্চা এবং লালন-পালন করে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মুলতঃ এই আগ্রহ এবং দায়িত্ববোধ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তন্চংগ্যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রকাশনা বের করার চিন্তাটা প্রথমে আমার মাথায় আসে যখন আমি ২০০১-০২ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্র্তি হই। তাছাড়া আমি যতদূর জানি তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়মিত কোন প্রকাশনা বের হয় না। পরে মিটিং এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকাশনা বের করার। অনেক নাম প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অজয় দা’র (অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা) দেওয়া নাম ‘পহ্ জাঙাল সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এরপর ১লা বৈশাখ ১৪১০ বাংলা, ১৪ই এপ্রিল ২০০৩ ইংরেজী পহ্র জাঙাল প্রথম সংখ্যা সফলভাবে প্রকাশিত হয় এবং উদ্বোধনী সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন পলাশ তন্চংগ্যা। ১১ই এপ্রিল’০৩ ওয়াগ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় এটির প্রথম সংখ্যা মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে অবশ্যই বলাকা, বিষু, ছিনা-মোইন(২০০২)এক সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পহ্র জাঙাল এর হাত ধরে তৈনগাঙ, রাঙাফুল, ন-আ শমন প্রকাশ হয়। তৈনগাঙ এখনো নিয়মিত প্রকাশ হলেও বাকীগুলো কিছু সংখ্যার পর আর প্রকাশ হয়নি। তবে প্রতিটি সংখ্যায় এক ঝাক প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আগমনীর বার্তা আমাদের আন্দোলিত এবং অনুপ্রাণীত করেছিল।তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- 

(ক)    প্রথম ভাগে– সাধক শিবচরণ এবং ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী

(খ)     দ্বিতীয় ভাগে– রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র 

তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির,ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির,যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর 

কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

(গ)     তৃতীয় ভাগে– লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, এ্যাড.দীন নাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, 

ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন),পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় 

বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা,উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা 

(মনিচান), দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা। আরো অনেকে। 

 ক. প্রথম ভাগের লেখকদের মধ্যে আমি তন্চংগ্যা সাহিত্যের পটভূমিকার সমৃদ্ধ বীজ লক্ষ্য করি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেও এই লক্ষণটি সম্প্রসারিত হয়। যদিও প্রথম ভাগটি শুরু হয় মধ্যযুগীও সাহিত্যের সাথে মিল রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে। এটি মূলতঃ লেখকের সাথে সময়ের একটি যোগসূত্র, আমরা এটাকে সময় বা সমাজের চাহিদাও বলতে পারি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ভাগের রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের লেখার মধ্যেও এই লক্ষণটি স্পষ্ট। তবে এখানে ইতিহাসও যোগ হয়েছে। মূলত একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের জন্ম। যা জাতি হিসেবে যে কেউ গর্ববোধ করতে পারে। তারা সমাজ এবং ইতিহাসকে সাথে নিয়ে বাংলা, তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা ভাষায় এইসব রচনা করেন। 

খ. দ্বিতীয় ভাগের প্রত্যেকটি লেখক সমাজ সচেতন ও প্রগতিযশা ছিলেন। সমাজ ও জাতির জন্য তাদের অবদান অনেক। রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যার নিজস্ব হস্তচালিত প্রেস ছিল। সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে এটিই প্রথম প্রেস। এখানে উল্লেখ্য যে, বিংশ শতকের দিকে এসে ‘গৈরিকা’(১৯৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের একটা ধারা সৃষ্টি করলেও তার আগে কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’(১৯৩১),‘সত্য নারায়ণের পাঁচালী’(১৯৩৩) রচিত হয়। তার এই ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’পয়ার ছন্দে রচিত একটি মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। এই প্রেক্ষিতে তন্চংগ্যা সাহিত্যিকগণই গৈরিকার পথ প্রর্দশক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা ধর্ম-সাহিত্যের দিক থেকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের আদি কবি (ড.মনিরুজ্জামান, পহর জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা-২০০৮, পৃষ্ঠা-১০)। এই পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাাকে রাজা ভুবন মোহন রায় ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আর কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি মুখে মুখে ছন্দ বাক্য রচনা করতে পারতেন(তথ্যঃ এ্যাড.দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা)। ‘ধর্ম্মধ্বজ জাতক’ সম্পাদনা ও সংশোধিত আকারে প্রকাশের জন্য রাজস্থলী বিহারপতি কর্তৃক ‘পন্ডিত’ এবং রাঙ্গুনিয়া উত্তর পদুয়া বৌদ্ধ সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রিয়দর্শী ভিক্ষু কর্তৃক ‘উদয়ন বস্তু’ রচনার জন্য তাকে ‘কবিরত্ন উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট্য ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাকে ‘পাহাড়ী বাংলার কবি’ বলেছেন। তার কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক (কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) তাঁর পুত্র দিলিপ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যার মাধ্যমে উদ্ধার করেন ১২ই জুন ২০০৮ সনে রাজস্থলী থেকে। তার এই অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি লেখক দায়িত্ব নিয়ে ‘পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ’ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে রাধামন ধনপতি কাব্য, বিজয়গিরি, মানুষ দেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সবার ক্ষেত্রেও পহ্র জাঙাল একই আগ্রহ পোষণ করে।  আর পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্ম সুবিস্তারে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির। ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে রাজা ত্রিদিব রায় তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ‘রাজগুরু’ পদে বরণ করেন। এর আগে রাজা নলিনাক্ষ রায় কর্তৃক শ্রীমৎ প্রিয়রত্ন মহাস্থবিরকেও (গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা) ‘রাজগুরু’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত রেঙ্গুনে অনুষ্ঠিত‘ষষ্ঠ বিশ্ব বৌদ্ধ মহাসংগীতি’তে একজন সংগীতিকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। তারই অমূল্য অবদানের জন্য মহাসংগীতি আয়োজক কমিটি তাকে ‘অগগ মহাপন্ডিত উপাধিতে সম্মানিত করেন। এছাড়া ২০০৪ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক তাকে ‘অগ্গমহাসধম্মজোতিকাধ্বজ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির এর মাধ্যমে সম্ভবতঃ পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে তন্চংগ্যারাই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তার সুবিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ‘রাউলী’ সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়। সেসময় রাউলী সম্প্রদায় চাকমা ও বড়ুয়াদের ধর্মীয় পুরোহিত হিসেবে ছিলেন। এই অগ্রবংশ মহাস্থবির ও ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবিরের অপ্রকাশিত অনেক লেখা রয়ে গেছে। এই লেখাগুলি ছাপানোর ক্ষেত্রে সমাজের সচেতন এবং বিত্তবানদের সুদৃষ্টি কামনা করছি। কারণ এগুলি আমাদের জাতীয় মূল্যবান সম্পদ। আমি যতটুকু শুনেছি এরই মধ্যে রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবিরের কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুযোগে কেউ হয়তো নিজের নামে চালিয়ে বা ছাপিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। যেটা হলে আমরা ঠিক আগের মতো ঐতিহাসিক ভাবে আবার ভুল করবো বা ভুল করতে যাচ্ছি।

 গ. তৃতীয় ভাগের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান হচ্ছেন লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। তার লেখার মধ্যে ইতিহাস ও সমাজ সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণাদায়কও তিনি। আমার জানা মতে ১৫-২০টি পসন এবং ৩৫০-৪০০টি প্রবাদ তার সংগ্রহে রয়েছে যা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ড.মনিরুজ্জামান স্যারকে তার ‘প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ’(৫ম সংখ্যা, ৯ই আগস্ট-২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা) লেখার জন্য এই প্রবাদ সংগ্রহশালা থেকে লেখক রেফাসেন্স হিসেবে সংগ্রহ করে দেন। ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাসের পুরনো দিনের স্মৃতিকে ধারণ করে রচিত ‘আদামর ফুল’ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্য ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ যা পহ্র জাঙাল প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আর এ্যাড. দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ নামে একটি লেখা ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’র ৫ম ভলিউমে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ‘বাংলা পিডিয়া’তেও প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। নারী লেখিকাদের মধ্যে পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা অগ্রগামী, পুরো পার্বত্য অঞ্চলেও তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তার লেখা সাহিত্যগুলি জুম্ম জাতি ও নারী সমাজকে আলোড়িত করে। পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা নারী লেখকের প্রতিনিধি। কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা ‘পহ্র জাঙাল’ প্রকাশনার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং উদ্যেগটা। তার কবিতা এবং প্রবন্ধ চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকা ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে। তার মোট প্রকাশিত প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় ১৫-২০টি। তার লেখা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (বাতকস) এর মুখপত্র সিঙকাবা এর প্রধান সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত আদিবাসীদের সাহিত্য পত্রিকা ‘রদেঁভু’ এর তিনটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাস এনজিও থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘খৈয়ুম’ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ‘ধূপছায়া’ এর সহ-সম্পাদক ছিলেন। তিনি সম্ভবত তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সর্বপ্রথম পান্ডুলিপি সংগ্রাহক।   

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের সাহিত্য চর্চাটি এগিয়েছে কিছু ঐতিহাসিক সংস্কৃতির উপাদান এবং সময়ের পটভূমিকে কেন্দ্র করে।

১. জুম সাহিত্যঃ 

পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের মতো তঞ্চঙ্গ্যারাও জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তারা জুম চাষের জন্য প্রতি বছর উর্বর জায়গার সন্ধানে পাহাড়ের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরীত হয়। যার ফলে তাদের জীবনচক্রও গড়ে উঠেছে এই জুমকে কেন্দ্র করে। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের জীবন ধারণ এবং সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে জুম উঠে এসেছে খুব সহজে। যেটি আমরা লক্ষ্য করেছি তন্চংগ্যাদের আদি সাহিত্যের মধ্যেও। বারোমাস,উভাগীত,পসন্,ধাঁধা,কবিতা,ছড়ার মধ্যে আমরা এই জুমকে খুজে পাই। এই জুমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পালাও রচিত হয় তার মধ্যে ‘জুম কাবা, রাইন্যা বেড়ানা পালা’ অন্যতম। ইতিহাস বলে তৎসময়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদেরও চিত্ত বিলাসের অন্যতম স্থানও এই জুম। যেটি গিংগুলী গানের গায়কের কন্ঠে আমরা লক্ষ্য করি। বিষ’ুর সময় যে পাইসন রান্না হয় তার বেশী ভাগ সবজি কিন্তু পাওয়া যায় এই জুম থেকে। তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পাঁচ কাপড়(পিনউন, খাদি, মাদা কাবং, পা-দুরি, সালুম) বুননে যে ফুল গুলি ব্যবহার করা হয় তার বেশীর ভাগ নাম এই জুম সবজি থেকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষায়(এম.এল.ই) যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওখানেও জুম বিষয়ে গল্প, ছড়ার বই ও থিম পিকচার করা হয়েছে। বর্তমানের লেখকদের মধ্যেও এই জুম সংস্কৃতি ঘুরে ফিরে চলে আসছে।

২. সাধক শিবচরণ এবং গসাইন্ লামাঃ

আমরা কম-বেশী সবাই শিবচরকে কবি হিসেবে চিনলেও কিন্তু কবি’র চেয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাধক বা ব্যাদি হিসেবে বড় ছিলেন। ব্যাদির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এই আছে এই নেই,তারা মুহুত্বের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। তারা চারিযুগ অমর এবং যমসুরী। এই চারিযুগ হচ্ছে-সত্যযুগ,দ্বাপরযুগ,টেট্টাযুগ ও কলিযুগ। শিবচরণ শৈশব কাল থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। জগৎ সংসার থেকে মুক্তিই যেন তার একমাত্র নেশা। তার আধ্যাত্বিকটা মা,ভাই ও ভাবীকে ভাবনা এবং চিন্তার দোলাচলে ফেলে দিলেও মাঝে মধ্যে বৎসনা করতেন জগৎ সংসারের প্রতি তার উদাসীনতা দেখে। 

শিবচরণ ‘মানবজন্ম’ এবং ‘ফুইরা আলাম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেন। ‘মানবজন্ম’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের শরীরগত বিদ্যাকে নিয়ে। শরীর কি,শরীর কি দিয়ে তৈরী বা গঠিত হয়েছে,শরীরের কোথায় কি আছে,কার কি কাজ ইত্যাদি বিষয়কে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর ‘ফুইরা আলাম’ গ্রন্থে তন্চংগ্যাদের ৩৬(ছত্রিশ)টি অক্ষরের(বর্ণমালা)বর্ণনা আছে। যেগুলোকে  ‘আন্জী অক্ষর’ বলা হয়। আনজী অক্ষর হলো-একটি অক্ষরের ‘গভীরতম অর্থ’ যেখানে সৃষ্টির পেছনে কারণ বা রহস্য নিহিত থাকে। যেমন-‘অ’তে বুদ্ধ অনিত্য বুঝেছেন। এই অক্ষরগুলো মাধ্যমে পুরো শরীরের অবস্থান,অংশ বা গঠনকে বুঝা যায়। শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার কোথায় অবস্থান এই আনজী অক্ষর দিয়ে নির্ধারণ এবং চিহ্নিত করা যায়। বৈদ্য বা কবিরাজ-রা এই আনজী অক্ষরের মাধ্যমে ‘নাড়ীবেদ’ পরীক্ষা করে রোগী চিকিস্যা করে। এই বিষয়ে প্রত্যেকটি বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। ‘মানবজন্ম ও ফুইরা আলাম’ দুটো গ্রন্থের ভূমিকা হচ্ছে মূলতঃ গসাইন বা গোসাইন লামা। শিবচরণ সাধক বা ব্যাদি ছিলেন। (তথ্যঃ বৈদ্য ফুলেশ্বর তঞ্চঙ্গ্যা,গর্জনীয়া পাড়া-ওয়া¹া,বয়স:৬৫,তারিখঃ১১/০৯/২০১০,রোজ শনিবার)। তিনি তার গসাইন্ বা গোসাইন্ লামায় উল্লেখ করেছেন যে,“সাকিন্ ছালাম য্যং মুই কাপ্তেই গাং,মানিয়া পুরীত্তুন্ তুরি যাং” অর্থাৎ সাকিন কাপ্তাই গাঙকে ছালাম জানিয়ে,আমি মনুষ্য ধরাধম থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে,চাকমারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গোজেন বলে না। তারা বলে গোই(ঐ)। কিন্তু তঞ্চঙ্গ্যারা গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ মুর্তিকে গসাইন বা গোসাইন বলে। তাছাড়া আমি আরো লক্ষ্য করেছি যে শ্রী অশোক কুমার দেওয়ান কর্তৃক সংগৃহীত ‘চাকমা ভাষায় শব্দ কোষে’গ্রন্থে(সুগত চাকমা কর্তৃক সম্পাদিত ১৯৯৬ সনে প্রকাশিত) গোজেন শব্দটি অনুপস্থিত। গসাইন বা গোসাইন লামা গ্রন্থ থেকে জানা যায় শিবচরণের জন্ম ১১৮৪ মঘী বা মঘাব্দ আর ইংরেজী সন হচ্ছে ১৮২২ সাল। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)

এই সাধক বা ব্যাদি শিবচরণের জন্ম কাপ্তাই এর নাড়াই পাহাড়ে। আবার অনেকের মতে বর্তমান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত রাজস্থলী বাজারের নিকটবর্তী বাজার নাড়ামূখ পাড়া গ্রামে। লক্ষনীয় বিষয় দুটি নামের মধ্যে কিন্তু একটা শব্দগত মিল আছে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে এই পাড়ার পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে তার নাম কাইত্তি গাঙ বা কাপ্তাই নদী। তাছাড়া আগে কাপ্তাই,বিলাইছড়ি,রাজস্থলীটি চন্দ্রঘোনার থানার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এই পাড়ার গ্রামবাসীরা এক সময় মাতামহুরীর তৈনগাঙে বসতি স্থাপন করেন। আমরা যদি ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসি তাহলে দেখব তন্চংগ্যারা আরাকান থেকে এসে প্রথমে তৈনছড়িতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তারা ছোট ছোট অংশে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে(রাইংখং,কাপ্তাই ওয়া¹া অঞ্চল)। আর তারা আরাকান থেকে আসার সময় কাল্লাঙের (ঝুড়ি) করে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে আসে।(রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল)। পরবর্তীতে যুদ্ধের কারণে তারা তাদের এত দিনের বাসস্থান(কাপ্তাই)ছেড়ে আবার তাদের আদি বাসস্থান মাতামুহুরি নদীর উপনদী তৈনছড়িতে চলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা সবাই অবগত যে তৈনছড়ি বা তৈনগাঙ এর সাথে তন্চংগ্যাদের ইতিহাস অতোপ্রতোভাবে জড়িত আর এখানেই কিন্তু শিবচরণের শৈশব ও কৈশোরকাল কেটেছে। এই ঐতিহাসিক যুক্তি বা তথ্য থেকেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় কিনা-কবি শিবচরণ তন্চংগ্যা জাতির গর্বিত সন্তান ছিলেন। তার রচিত গসাইন/গোসাইন লামা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহাসিক সম্পত্তি। এর সাথে গেঙ্গুলী বা উবাগীতের পালা,বারোমাস,গল্প,প্রবাদ-প্রবচনের মতো ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলিও দাবীর তালিকায় থেকে যাচ্ছে। কারণ শিবচরণের গসাইন লামার সাথে এইসব সৃষ্টির একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। যদি উল্লেখিত বিষয় বা মতগুলি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি হয় তাহলে আমি বলবো পার্বত্য জাতি গোষ্ঠীর ইতিহাস বিশেষ করে চাকমা জাতির ইতিহাস নিয়ে আরও নতুন করে ভাববার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বা সময় এসেছে।

৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা, বর্ণমালা ও ভাষার বই

 তন্চংগ্যাদের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বর কোমল ও নরম। উচ্চস্বরে এবং গলা তুলে কথা বলা তাদের বৈশিষ্ট্যে নেই। তাদের স্বরের মধ্যে সবসময় নরম ও কোমল টান লক্ষণীয়। বর্তমানে এসে ভাষার আদিরূপটা প্রাকৃতিক নিয়মে পরিবর্তন লক্ষনীয় হলেও বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা নিজ ভাষা ব্যবহার ও চর্চাকে অধিকারবোধ থেকে চিন্তা এবং বিচার করে। তারা সবসময় সচেতনভাবে সচেষ্ট থাকে চর্চার অভাবে নিজ ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে কিনা বা অন্যের ভাষার প্রভাবে নিজ ভাষা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও লক্ষনীয়। জানিনা তারা নিজেদেরকে অভার র্স্মাট বা অতি বিশ্বায়নী হিসেবে ভাবেন কিনা। আমি ভাষা জানাকে প্রয়োজনীয় হিসেবে মেনে নিয়ে নিজের সমৃদ্ধ ভাষাকে ছেড়ে অন্যের ভাষাকে নিজ মাতৃভাষার মতো ধারণ এবং চর্চাকে প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে কিনা জানি না। ভাষার মধ্যে দিয়ে কিন্তু জাতির পরিচয় ফুটে উঠে বা বহন করে। ভাষার মাধ্যমেই জানা যায় কে কোন জাতির বা জনগোষ্ঠীর লোক। এই মাঝে ভাষা নিয়ে নিজের একটা চোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- একদিন অফিস থেকে বের হয়ে গরু দুধ কিনব বলে দোকানে গিয়ে দোকানিকে (দোকানি ৪০/৪৫ বছর বয়সের একজন চাকমা ভদ্র মহিলা) বললাম তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায়- ‘ম-ই গোরু দোউত্ আহে’ ( মাসি গরু দুধ আছে)। আমার কথা শুনে দোকানি বলল- আছে। আমার কথা শুনে চাকমা ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন- তুই কি তঞ্চঙ্গ্য নে ? আমি বললাম হ্যাঁ। পরবর্তীতে আমি চিন্তা করলাম শুধুমাত্র ভাষার জন্য হয়তো উনি আমাকে ‘বাবু আপনি তঞ্চঙ্গ্যা’ বলে সম্বোধন করেছেন বা চিনতে পেরেছেন। না হলে হয়তো উনিও দশজনের  মতো চেহারাগত সাদৃশ্যের কারণে আমাকেও একজন চাকমা বলে জানতেন। সুতরাং শুধুমাত্র ভাষার কারণে উনি আমাকে তন্চংগ্যা হিসেবে চিনতে পেরেছেন, অন্যথায় নয়। হয়তো এই উপলদ্ধি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন আগে নিজ ভাষা গাথুনী পরে অন্য ভাষা। কারণ আমি বুঝি আমি যদি আমার ভাষা চর্চা বা ব্যবহার না করি অন্য কেউ এসে তা করে দিবে না। আর সেটি চর্চার অভাবে কোন একদিন হারিয়ে যাবে। আর আমরা সবাই অবগত প্রতিদিন পৃথিবী থেকে দুই/একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তন্চংগ্যাদের ভাষাও যে হারিয়ে যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই। 

তঞ্চঙ্গ্যাদর ভাষা ও বর্ণমালা আজ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কারণ বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি’র প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামে আর ১২টি জাতির মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্যেও নিজস্ব বর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন যদি কেউ বলে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা এবং বর্ণমালা নেই তাহলে তিনি আইনগত অপরাধী হিসেবে গন্য হবেন। এর আগে অবশ্যই বর্ণমালা ব্যবহার ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যা বৈদ্যরা অগ্রগামী। তবে শুনে এসেছি তন্চংগ্যা বৈদ্যরা যে বর্ণমালা ব্যবহার করতেন সেগুলো নাকি চাকমা বর্ণমালা। পরে ইতিহাস পাঠে জেনেছি তঞ্চঙ্গ্যারা যদি আসল চাকমা হন তাহলেতো এই বর্ণমালাগুলি চাকমা বর্ণমালা পক্ষান্তরে তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালার সাথে বর্তমান উভয়(তঞ্চঙ্গ্যাও চাকমা) বর্ণমালার একটা সাদৃশ্যের ঐক্যমান লক্ষণীয়। যেটি চাকমাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। যেমন- তঞ্চঙ্গ্যারা অধিক মাত্রায় বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে (কিছিম্যা কা, গছিম্যা খা, চাইন্দ্যা গা- খাই, যাই, গাই ইত্যাদি) এবং কথা বলেও আ-কারান্ত দিয়ে। আর চাকমারা তাদের বর্ণমালা উচ্চারণ করে আ-কারান্ত দিয়ে কিন্তু কথা বলে অধিক মাত্রায় এ-কারান্ত দিয়ে(চুচাঙ্যা কা, গুজাঙ্যা খা, চান্দ্যা গা-খেই, যেই, গেই ইত্যাদি)। একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে এই বিষয়টি আলাপ করলে তিনিও গবেষণার যোগ্য এবং লক্ষণীয় বিষয় বলে মত দেন।

অনেক আগে থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ণমালা থাকলেও সেটি কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। পরে ভারতীয় এক গবেষক রূপক দেবনাথ বার্মা, ভারত ও বাংলােেদশ ঘুরে একটা সাজানো এবং গোছানো রূপ দাঁড় করান। একে সর্বাত্বকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যাকল্যাণ সংস্থা(বাতকস)। মূলতঃ তঞ্চঙ্গ্যারা ‘তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালার একটি গোছানো রূপ’ পাওয়ার ক্ষেত্রে  রূপক দেবনাথ ও এ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার অবদান স্বরণীয়। আর সফ্ওয়ার উন্নয়নে জন্ ক্লিফটন্। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য স্ববর্ণে এবং স্বভাষী শিক্ষক দিয়ে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেখানে গল্প বই(বিগ বুক),ছড়া বই(শুনার গল্প),বর্ণমালার বই,বর্ণমালা চার্ট,নাম্বার চার্ট,কার্ড এবং অংক বই প্রকাশিত হয়। সাথে আরো ছবি সম্বলিত সিরিজ পিকচার এবং থিম পিকচার প্রকাশিত হয়। এগুলি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটি, মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাও কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা(মাল্টিলিংগুয়াল শিক্ষা অফিসার যখন ছিলেন)। এই শিক্ষা কার্যক্রমে গল্প ও ছড়া লেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তারা হলেন-সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা,লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, মিলন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা,বিজয় তঞ্চঙ্গ্যা (কুতুবদিয়া)। আর বর্তমানে ক্লাস ওয়ানের উপযোগী ‘আমার বই আর গণিত বই’ তৈরী করার কাজ চলছে। আর এইসব বই বা উপকরণ তৈরীর জন্য ১৫(পনের) সদস্য বিশিষ্ট একটি তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা কমিটিও আছে।

৪. লোকসাহিত্যঃ তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অন্যতম অহংময় উপাদান হচ্ছে তাদের প্রাচুর্য্যময় লোকসাহিত্যের ভান্ডার। সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আচার-আচরণের সাথে নিত্যদিনের কর্মকান্ডে এবং চিন্তা ভাবনা এই সাহিত্য ফুটে উঠছে। তার মধ্যে উবাগীত, প্রবাদ, ধাঁধা, গল্প, ছড়া ও বারোমাস উল্লেখযোগ্য।

উবাগীতঃ আদিকাল থেকে তঞ্চঙ্গ্যাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল গেঙ্গলী/উবাগীতের অনুষ্ঠান। নবান্ন উৎসবে এই গানের আসর বসত। তাছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় কীত্তনের পাশাপাশি এই গেঙ্গলী গান হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানেও এই গানের আয়োজন হতো। যারা এই গানের রচয়িতা তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান অকল্পনীয়। তারা তাদের চিন্তাকে সুপ্রসারিত করেছে সে সময়ের জ্ঞানকে আশ্রয় করে। বিশেষ করে তারা রোমান্স ও ইতিহাসকে সাথে নিয়ে এই অমর সাহিত্য ভান্ডার সৃষ্টি করেছে। এই গানে একটা সুর থাকত যেটা আমরা পাহাড়ী বা আদিবাসী সুর বলি। এই সুরের সাথে প্রাকৃতি,ঝর্ণা,পাখির কূজন,বনভূমি একাকার হয়ে যেত। যেন স্বয়ং প্রকৃতি সুর দিচ্ছে, সুর তুলছে এবং সুর মিলাচ্ছে। এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি কাহিনী থাকে এবং পঙ্তির শেষে অন্ত মিল থাকবে। আর এটি গাইতে হয় বেহেলা দিয়ে। এই গেঙ্গুলীদের মধ্যে জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা অন্যতম। যাকে সবাই কানাগেঙ্গুলী হিসেবে চিনে। স্বরস্বতীর অকৃপন কৃপায় তিনি অসাধারণ অনুভূতি শক্তি ,স্মৃতি ও মর্মাবধারণ সম্পন্ন সেকাল একাল শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী হিসেবে তিনি সমাদৃত। তিনি ভূবন মোহন,নলিনাক্ষ ও ত্রিদিব রায় এই তিন রাজার অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন। রাজা নলিনাক্ষ রায় তাকে ‘রাজগেঙ্গুলী’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। সেই অগনিত নাম না জানা ত্যাগী, গুণী ও জ্ঞানীদেরকে অসীম নমঃ নমঃ এবং জয়তু। এই রকম কিছু পালা বা রচিত সাহিত্য তন্চংগ্যা সমাজে খুবই পরিচিত। 

উবাগীতের পালাসমূহঃ জুম কাবা পালা,রাইন্যা বেড়ানা পালা,নাকসু ফুল পারা পালা,ঘিলা পারা পালা,রদংস পালা,বার্কী ধরা পালা,চাদিগাঙ ছড়া পালা,রাধামন ধনপতি পালা,লক্ষী পালা,ধর্ম পালা,রিজার্ভ পালা,অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা(রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা),লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা,মেদঙা-মেদঙী পালা,মিয়াধন-মিয়াবী,কুঞ্জধন-কুঞ্জবী,নিলংধন-নিলংবী,কামিতধন-কামিতবী,হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন তাদের মধ্যে অন্যতম।(পালাগুলি লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) নিম্মে একটি উবাগীতের পঙ্তি দেওয়া হলো-

             নানান-ভই-চর নানান রং,

             ধানে সুধায়  উ-ল সং।

             ধান ছরাত ধুল্ল রঙ,

             গাবুজ্যা গাবুরী উলাক সং।

             দেবংশী ফুলর গিলার তাক্,

             আদামত্ বেড়াইদন গাবুরী ঝাক।

             উদানত্ খেলিদন্ গুরালক্,

             পাল,পাল বেড়াইদন্ গাবুরলক।

             উরায় বইয়ারে তুলা-নি,

             আইছ্যা গাবুর লক্কুন কি গরন্ কি জানি।

             ই-চ-র মাদাত ধান তলই,

             জলা-জলি গাইততন্ গাবুরীলই।

             মিল্লা ধানতলই কুরায় খায়,

             কি জানি পরান বিরে আইছ্যা কন্না পায়।

             পশ্চিমে ডুবেল্লই পুব বেল,

             চুবে-চাবে গাবুজ্যা গাবুরীরে কই গেল।

             জুন পইজ্যা ভূই আদে,

             পরান দ ন জুড়ায় তুই বাদে।

             কদান কইনে লাঙ্যা দা গিয়ে গই,

             ঘর উবরে উইচ্ছে গই।

             ঝুবুক গাইছত্ পাইছ্ বাহ্,

             বাঁশি বা-ধল্লই লাঙ্যা দা।

             বাঁশী র শুনি মন কানে,

             ইন্দি লাঙ্যাবী চন রানে।

             চন তাবা চিদলে,

             লাঙ্যাবী মন দি ন পারের গমে দোলে।

             চনান উদুরাই পরেল্লই পেলাত্তুন,

             ঔল গুরি ভাত পেলা বাদ দি-লই নুন।

             জুরি পজ্যেই বু-য় খাদিয়ান ,

             মাদিত্ পজ্যেই কাদিয়ান।

             ধারা বা-ই-নে পরের ঘাম,

 লাঙ্যাবীত্তুন আদত ন উদের কন কাম।। (বি.এন তঞ্চঙ্গ্যা,আদামর ফুল। পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা)

প্রবাদ/ধাঁধা/গল্প/ছড়া

ছোট বেলায় মা-বাবা থেকে অনেক গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধা শুনেছি। আবদার করতাম সময় সুযোগ পেলে। বিশেষ করে যখন অবসরে থাকতাম সবাই। আর সঙ্গী-সাথী ও ভাই-বোন মিললেতো কোন কথায় নেই। প্রবাদ ও ধাঁধা ধরাধরি করতাম কে কতটা বলতে পারে। মাঝে মধ্যেতো এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, রাগারাগি হতো তবে সব কিছু সাময়িক পরে আবার ঠিক হতো। এভাবে অতিবাহিত ছোট বেলার প্রত্যেকটি দিন। মাঝে মধ্যে ভয় পেয়ে যেটাম মা-বাবারা যখন রাক্ষস বা ভূতের গল্প বলতেন। তবে রাজপুত্র যখন রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতেন রাক্ষসপুরী থেকে তখন আবার ভয় না পেয়ে খুশী বা মজাই পেতাম বেশী। 

তঞ্চঙ্গ্যাদের গল্প, প্রবাদ ও ধাঁধার মধ্যে প্রকৃতির সাথে মানবিক ভারসাম্যতা বিদ্যমান। এখানে প্রতিটি বাক্য এবং চিন্তার সাথে প্রকৃতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত সাথে আরো আশেপাশের প্রাণীকুল। তাদের নিত্য দিনের জ্ঞান,স্বভাব,অভ্যাস এবং আচরণগত নানা দিক। তন্চংগ্যারা প্রকৃতির সন্তান বলে তাই তাদের চিন্তার সাথে প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে। তারা প্রকৃতির মতো কোমল-নরম,বিনয়ী,নম্রভাষী এবং লাজুক। প্রকৃতির মতো তাদের হাত পাথার(ভিক্ষা)কোন অভ্যাস নেই। কাউকে সহজে বড় কথাও বলতে পারে না। কথাবার্তা সবসময় সংযত। তন্চংগ্যাদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে চিন্তার সাথে তাদের আচরণগত ভারসাম্যতা । তাই তাদের প্রত্যেকটি সাহিত্যবার্তা বা সৃষ্টিবার্তার মধ্যে এই আচরণ ও অভ্যাসগত চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। নিম্মে সে রকম কিছু প্রবাদ,ধাঁধা ও গল্প তুলে ধরা হলো-

(ক) কিট্সা/ দা-অ কদা/প্রবাদঃ 

পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান, মুয়ত জয় মুয়ত খয়, পেদৎ বোক মুয়ত লাইত, এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কা(আ)ড়া, নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান, মরা বাই-স সমারে জেদা বাই-স পুরি জান, আক্কল বাধি অনা, ইচা শুউনি অনা, ইহিম কামত্ ফল পানা,উসুনা কুড়ায় ডাক কারা না, কুড়া লাইত্, চি-ল দরে কুড়া ছ ন পুছানা, সিনডালে-অ লো ন নিড়ানা, মুঅ গুনে ব্যাঙ মরা, ঠেঙ(অ) কোইত্ ঊরি দেনা, দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা,পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্, গুউত্তুন মুত্ গম্ অনা, রাঙা কালা মু অনা, ভুত্তোয়্যা কুউরে রোঙ কারা-না, আইদে আইদে ধদাডোদি টিক্ষ্যা কা(অ)রা গুরি, দা-শি দিলে নাচি খায় সবা-ইত্ ন পালে মা-ই খাই, ইসা-ব(হিসাব)গোরু(গরু) বায়ে(এ) খাই, খাঙ ন খাঙ ন খাঙ বালা যাঙ ন যাঙ ন যাঙ বালা, মুয়ত যউক পেদৎ ন যউক,বায়ু ফিরানা, নিমায়া নিতু,চিয়ন পআ কদা কুরা গু,সর্গ গু ন চিনা না,টাউ সুমা,ছাঅ-ল কানত্ মন্ত্র বরায় দেনা,আইছ কানত্ কুউরে বোউ না,সাপ্য়া উলে পুদাই দ ব্যাঙয়্যা উলে লাফাই দ,আগে গেলে বা-য় খায় পিছে তালে সোনা পাই । (ড. মনিরুজ্জামান,প্রবাদ ও তন্চংগ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ- পহ্র জাঙাল, ৫ম সংখ্যা এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত )

(খ) ধাঁধাঃ 

এক কা-য়া খালে এক কা-য়া তায়(শামুক), মাদি বিধিরে রোউত্ পুদি(হলুদ),ফিরের গুর গুর ফাদের মাদি(লাঙ্গল), মাদিত্তুন অচল ঘরততুন নিচল(মাচাং), মা-বা কানে ছ-বা দাঅর অই(নাদি সিরা/নাতাই ও সুতার টুম), ধুজ্যা সাগরত্ থালা ভাস্ন(তারা), আকাশত্ ঘর পাদালত্ দুয়ার কোই ন পাইলে খাবে চয়ার(বাবুই পাখির বাসা), ন পালে তয়ায় পালে ন আনে(পথ),গাইচ বুরে পানি কয়া(ডাব), এক বুজ্জ্যা খান দ্বি-বুজ্জ্যা চায় তান(মুখ ও দুটি হাটু), চিয়ন লক্কে কাদা বুড়া উলে পাদা(শন), বিল ছোয়ালে বয়া মরে(কেরোসিনের বাতি), বাঁ ঘরত্ বুজ্জ্যা দুদ্দুরায়(খই ভাঙ্গানো), ঘর আহে দুয়ার নাই মানু-অত্ আহন র নাই(উই পোকার বাসা), দুইল্লে এক মুঠ ইরি দিলে এক্ বেদেরাং(জাল), আখা আহে দুছা নাই দেল্লা আহে পাদা নাই(স্বর্ণলতা), বুক ডুব বিছি কালা কদা কয় মধুমালা(বেহেলা), কাইদে গুলা বুদুনী নাই(ডিম), এক বুজ্জ্যা কদা কয়(বই),শিরা নাই বুজ্জ্যা মানইত্ গিলে(শার্ট), একুল পানি ওকুলত্ যাই(মদ), আহা কাবিলে দুসা মরে(গাঙ), চাইত্ উবা খাইলত্ লেত্(দোলনা), রাজার আইত্ লেজত্ দোইলে কাইত্(ঢেঁঙি), লুদি টানিলে মোইন গুচুরে(কিংখরঙ), এরিং বিরিং তিরিং বাই চোক দ্বি-বা তার মাদা নাই(কাকঁড়া)। (লেখক কর্তৃক সংগৃহীত) 

(গ) পস(গল্প)

কলাত্থুর কন্যা,বাঘ ও শূকরের মিতালী,তেন্দেরার পচ্ছন,দুলুক্কুঙী,পিত্তয়া চান,চিমুজ্যার লুক্ষীবর পানা,পুরীকন্যা মানোহারী,নিতাং সুতাং,রাঙকাইত্ বুলির সর্গ মারা না,মানিক পুদি কন্যা,বেঙ্গমা-বেঙ্গবী,টুনটুনি ও কুস্যা ব্যাঙ,ভূতের গল্প, কুজ্যা কুইনি পসন,বুজ্যা বুড়ির পিদা খানা,মিত্তিন্যা পসন,কবী-ধবী,বেঙ্যা,বান্দুরী,আল্চিয়া,ভলা গুরু,দুলোক কুনি,মিরা রাচা,সুবাত্তুরী আ পেত্তয়া ফিউং,আলচিয়া মিদি ঙ্যা,এক বিগৈইশ্যা,গুল চিনা,ভুলা-ভুলি,শেয়াল্যা আ হ্আইতস্যোয়া,বুজ্যা-বুড়ী আ বাঘ্যা,বুড়ী আ ভুত্তোয়া,বেলেই কন্যা,খুস্যোয়া বেঙ আ সুবাত্তুরী,শুগ মা,রাচা ভাগান্যা নাক্কোন্ চিলা,কাইত্ কন্যা,শুগবা বাঘ্যা আ পেচাবা,বুজ্যা বুড়ী,দাদু ঙ্যা দাদুঙী,মিরা আ পারান্ বন্,চানমুনি সূর্য মুনি,আল্চিয়া,ঊইঙোয়া আ কবাবা বন। (রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা জাতি,প্রকাশ-২০০০ এপ্রিল এবং লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

(ঘ) ছরা/ছআ (ছড়া) ঃ 

ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের একটি উর্বর উপাদান। আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক ছড়া দেখেছি বিশেষ করে ঘুম পাড়ানী ছড়া। এই রকম ঘুম পাড়ানী ছড়া তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের মধ্যেও আমরা লক্ষ্য করি। মা যখন জুমে যায় কাজ করতে তখন ছোট ভাই-বোনকে লালন পালন করতে বড় ভাই-বোনকে যে কি রকম বিড়ম্বনা সইতে হয় এই ছড়ার মধ্যে তা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে খাওয়ানো ও ঘুম পাড়ানোর সময়। এই ঘুম পাড়ানী ছড়া ছাড়াও আরো আছে খেলাধূলা(৬ নং ছড়া)আর রোমান্টিক টাইপের কিছু ছড়া(৪নং ছড়া)। 

    (১)   নাক্সো গাইছর রিয়াং জু,

               দোলউন্ বুনি কেরেং জু।

               কেরেং দোলাইত্ কেরেক চাক্,

               উয়াং দইত্তন ঝুইতগি থাক্ ।

       (২)    ডুলু বাইছর দোলইন্,কাই-জ্যা উদাল দুরি।

               ঘুম যাবদে ম লক্ষোবা,সোনা দোলইনত্ গুরি।

       (৩)   বেঙয়া দরের করক করক,ভাইজ্যা ডুবাত্ তলে।

               লক্ষোবিরে বৌ দিবং, রাঙা শুক্ষোর বারে।

       (৪)   জুম লেছাত্ উবা কইন, 

               সমারে বেরাইদন্ দ্বি-বা বইন্।

               দ্বি-বইনত্তুন কন্ন্যা লইন,

               দাঅর বইন্যা ন পালে, চিয়োন্যা লইন,

               কারে-য়-ন পালে , মৈন্ছাঙ অইন।

(৫)       আম পাদা তেল তেল,কাট্টল পাদা বেল।

  ম-হ(অ)াদত্ ভাত্ জরাবা , লক্ষো পেদত্ গেল।

  ভাততুন খাইনে দাঞর অইনে, কোন্ দেশত্ গেল ।

       (৬)   আম পাদা লক্ষণ, তরে মাইত্তে কদক্ষণ।

              আমত্ তলে সমালুং, বরই কাদা ফুদা লুং।

              বরই কাদা এদক বিদ, তিবিরিত তিবিরিত।

              শমই পাদা লরে চরে, তরে লড়াইদে বল্ পড়ে। (বি.এন তন্চংগ্যা থেকে লেখক কর্তৃক সংগৃহীত)

৫. পার্বত্য চুক্তি ও সাহিত্য চর্চা

১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সাথে প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একটা নবজাগরণ সূচিত হয়। এটি সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এই ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যারাও পিছিয়ে নেই। এর মধ্যে নবীন কিন্তু প্রতিভাবান একটা লেখক শ্রেণীর উদয় হয় যার সংখ্যা অনেক। এই ক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রকাশনা গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও পহ্র জাঙাল এখানে অগ্রগামী। তারা দেশ, সমাজ ও জাতি নিয়ে চিন্তা করে এবং সাথে তারা আদিবাসী অধিকার নিয়েও সচেতন। সেজন্য আমি এই সময়কে  তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নবজাগরণের সময় বা যুগ বলি। তারা সব কিছু ভেদাভেদ ভুলে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সদয় প্রত্যয়ী। এই ক্ষেত্রে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা(এনজিও)গুলোর ভূমিকাও অনেক। তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

৬. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এর অবদান

পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’(পূর্বনাম উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট)আদিবাসীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বিশেষ একটা জায়গায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি তা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি গুটিকয়েক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে। উক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের(রাঙ্গামাটি) কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলে আমার এই সত্য উপলদ্ধিতা আরো গভীর এবং বদ্ধমূল হয়েছে। আমি মনে করি উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামের যথার্থতা বা সার্থকতা মুল্যায়িত হওয়া দরকার। সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ভবিষ্যতে এই দায়িত্বটা স্বরণে রাখবে আশা রাখি। 

৭. তঞ্চঙ্গ্যারা সম্মানিত ও গর্বিত জাতিঃ 

আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে তঞ্চঙ্গ্যারাই সবচেয়ে সম্মানিত এবং গর্বিত জাতি। কারণ তাদের জাতির মধ্যে রয়েছেন এমনসব বিরল সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি যাদের কর্মকান্ড বা অবদান দেশ,কাল,সমাজ ও জাতির উর্ধে উঠে পুরো পৃথিবীকে করেছে আলোকিত আর জাতিকে করেছেন সম্মানিত। তারা হলেন সাধক কবি শিবচরণ,রাজগুরু প্রিয়রতœ মহাস্থবির(গৃহী নাম পালকধন তন্চংগ্যা), রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির(গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা),রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রেষ্ঠ গেঙ্গুলী বা রাজগেঙ্গুলী জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা(কানা গেঙ্গুলী), শ্রেষ্ঠ বলি লাল মুনি তঞ্চঙ্গ্যা,কবিরত্ন কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা। সবগুলি রাজকীয় মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্ত্বের স্বীকৃতি। এত রাজকীয় মর্যাদা বা উপাধি এবং স্বীকৃতি প্রাপ্তি একটি জাতির জন্য আর কি চাওয়া থাকতে পারে।  

উপসংহার

এইভাবে একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্য বিকশিত এবং প্রসারিত হয়। স্বরণযোগ্য বলে এই বাক্যটি শেষে এসে আবার বলছি। তঞ্চঙ্গ্যা জাতি যদি অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আরো একটু সচেতন হয় তাহলে আমি আশা রাখতে পারি সামনে তাদের সুদিন আসছে। বর্তমানে প্রচুর তঞ্চঙ্গ্যা ছেলে-মেয়ে দেশে এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছে। তারা ভবিষ্যতে জাতির কান্ডারী হবে। যদি আমরা চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে আসতে পারি। সেটি হচ্ছে শিক্ষিত প্রজম্মের মধ্যে জাতিত্ত্ববোধের সচেতনতা। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত ডিগ্রীধারীদের ক্ষেত্রে। তারা যদি নিজ জাতির প্রতি জাতিপ্রীতি হন তাহলে আমরা হয়তো এই সুফলটা পেতে পারি অন্যথায় নই। বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের(বিবাহ)ক্ষেত্রে। এই সময় তারা যদি একটু বেশী নিজ জাতিকে নিয়ে ভাবেন জাতি এতে উপকৃত হবে। এইক্ষেত্রে অবশ্যই জাতির অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখানে টার্গেট করা হচ্ছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্মকে। যাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক মর্যাদা অপেক্ষা করছে। দিনের আলোর মতো খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে বেশীর ভাগ লোক যারা অন্য সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করেছে তারা আত্বীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব,সমাজ এবং সর্বোপুরী সামাজিক ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের অর্ধাঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এসে ‘তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের একজন’ হয়ে উঠতে পারেননি। সুখে দুঃখে এখনো সে তার মাতৃজাতির যাবর কাটছেন বা স্বপ্ন দেখছে। জানিনা এটি জাতির জন্য নতুন একটি ষড়যন্ত্র বা কূটকৌশল কিনা। কারণ অতীতে তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমরা সেরকম অনেক ইতিহাস দেখেছি। তবে বেশীদূর যেতে হবে না ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তের দিকে তাকালে হবে। সেসময় পাকিস্তানীরা এবং তাদের সহযোগীরা যখন আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পেরে উঠছে না তারা বুদ্ধিজীবি এবং শিক্ষিত প্রজন্ম নিধনে পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং অনেকটা সফলও হয়। আমি এই কথাগুলি এই কারণে এখানে বলছি কারণ শিক্ষিত প্রজন্মই জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। তাদের চিন্তায় এবং সহচার্যে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকশিত হবে এবং টিকে থাকবে। একটি পত্রিকার ভাষ্য মতে-বৃটিশ পুরুষরা নাকি অন্য জাতি বা সম্প্রদায় মেয়েকে বিয়ে করতে আগ্রহী নয়। কারণ তাদের সংস্কৃতি ধ্বংস বা বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এতবড় সম্পত্তিশালী এবং শক্তিশালী জাতির যদি জাতি বা সংস্কৃতি ধ্বংসের চিন্তাটা মাথায় আসে তাহলে আমরা সাগরের এক কণা বালির মতো একটি জাতি হয়ে নিজ জাতির জন্য কি চিন্তা বা ভূমিকা রাখছি। আমি সব সময় আশঙ্কায় থাকি জাতি থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি নাতো। কারণ পৃথিবী থেকে নাকি প্রতিদিন কিছু না কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই ধ্বংস ও বিলুপ্ত আশঙ্কা হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষিত এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তি আমাদের সমাজে খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এইক্ষেত্রে অভিভাবকদেরকেও ছাড় দিতে হবে জাতি ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে। নাই বা কম বলে আমি এই আশঙ্কাটুকু করি। এটি কিন্তু চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকে নয়। তবে আমি আশাবাদী কারণ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে একটি জাতি বা সমাজ বিকশিত হয়। তন্চংগ্যা সমাজও সেভাবে বিকশিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তঞ্চঙ্গ্যাদেরও সে সুদিন আসবে, সেই প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

পরিশেষে উল্লেখিত সাহিত্যিক এবং তাদের সাহিত্যকর্ম ছাড়াও আরো অনেক সাহিত্যিক  এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম হয়তো আছে যেগুলো এখানে আসেনি বা আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি, পরবর্তীতে তথ্যপ্রাপ্তিতে সংযুক্তির সুযোগ রেখে তাদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

                                                         …………………………

তঞ্চঙ্গ্যাদের কর্তৃক রচিত, প্রকাশিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন প্রকাশনা এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের একটা তালিকা নিম্মে দেওয়া হলো-

১. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক রচিত সাহিত্যকর্ম

  ১।  সাধক শিবচরণ

       মানবজন্ম , ফুইরা আলাম,আর ‘গোসাইন লামা’ হচ্ছে (মানব জন্ম ফুইরা আলাম) এর ভূমিকা মাত্র।

  ২।  কবিরাজ পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা

 ক. ধর্ম্মধ্বজ জাতক(১৯৩১) – কার্ত্তিক চন্দ্র তন্চংগ্যা কর্তৃক সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা।

 খ. চান্দোবী বারমাস, সত্য নারায়ণের পাঁচালী (সিন্নি পুঁথি), চাংমা লেখা শিক্ষা(১৯৩৮),

              রুত্তি বারমাস, আলস্যা মেলার কবিতা,বিয়াল্লিশর ভাত্রাদ(বারমাস)।

       ৩। কবি গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা  

            ক্যাঝুরী,মুলি,কলিযুর্গ ও দ্বিমুক্যা বারমাস নামে চারটি বারমাস রচনা করেন।

  ৪। শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা 

      ক. বুদ্ধ সালামী গাথা মনত্ ভাবি চেবা (আগষ্ট-১৯৮৫)

      খ. বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা (১৯৪৫),উদয়ন বস্তু বা কর্মফল(১৩৬৮),মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪), বৌদ্ধ গল্পমালা(১৯৮৭) 

       সম্পাদিত গ্রন্থ: ধর্ম্মধ্বজ জাতক(কবিরাজ পমলাধন তন্চংগ্যা মূলগ্রন্থের সংশোধিত ও সম্পাদিত, ১৩৯০ বাংলা)।

      প্রাপ্ত পান্ডুলিপি ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ:

            ক. রাধামন ধনপুদি কাব্য (পহ্র জাঙাল-৪র্থ সংখ্যা ২০০৮ প্রকাশিত)

            খ. অশোক চরিত(১৯৮৩); অনাগতবংশ।

            নাট্য কাব্য: 

            ক. বিজয়গিরি (পহ্র জাঙাল-৫ম সংখ্যা, ২০০৯ থেকে প্রকাশিত)

            খ. চরিত নাটক(ধর্মীয়): মানুষ দেবতা,মোহবসান এবং কুলধর্ম(কাব্য)

            গ. তপর্কীতন ও যাত্রাপালা : বুদ্ধ সন্ন্যাস পালা(২৫/০৪/১৯৮৫)

            ঘ. শ্রী বুদ্ধের বারোমাস স্মৃতি(রাজস্থলী মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়-২৬/০৩/১৯৭৮)

            ঙ. কল্পতরু দান ফল কথা, বন্দনা ও দান ফল কথা, অক্ষর গাথা। 

এছাড়া রাজবলাকা,  নৈরঞ্জনা, সম্বোধি, পার্বত্য বাণী পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়।

         ৫। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা

–        তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি(গ্রন্থ)।

এছাড়া বান্দরবান থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘ঝর্ণা’,রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘পার্বত্য বাণী’ ও সাপ্তাহিক  ‘বনভূমি’ তার ভিবিন্ন সময় কবিতা প্রকাশিত হয়।তার মধ্যে- অবিস্মরণীয়া,নিশা,আমি একাকী,পথিক,বান্দরবন,মায়াময় পৃথিবীতে,পার্বত্য চট্টলার প্রতি,অব্যক্ত অনুভূতি,বরষা,বৈশাখী পূর্ণিমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

   ৬।  রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির

              প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

সমবায় বুদ্ধোপাসনা, বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বুদ্ধপাসনা (লোকত্তর বিভাগ), বুদ্ধপাসনা(লোক বিভাগ), চাঙ্মা গীদেন্দি মঙ্গল সূত্র, পরিণাম(নাটক), শ্রামণ কর্তব্য, মানব ধর্ম পঞ্চশীল, The Stop Genocide Hill Tracts of Bangladesh.

               অপ্রকাশিত গ্রন্থ সমূহঃ

 বিশুদ্ধিমার্গ(৩য় খন্ড), বিদর্শন ভাবনা নীতি(৫ম খন্ড),বুদ্ধোসামন্তিকা (৫ম খন্ড), অভিধম্মার্থ সংগ্রহ, ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ, জন্ম মৃত্যুর কথা, সাম্য বীথিকা, চন্দ্রগুপ্ত (নাটক), বাসবের পথে(নাটক), রূপনন্দা(নাটক), সঞ্চয়িতা, বাংলাদেশ বড়–য়া জাতি, মহা কঠিন চীবর বর্ণনা,বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ, অগ্নিমশাল(গীতি মঞ্জুরী),চাঙ্মা কধাদি ধর্মপদ,পথ তগেয়ে মন(চাক্মা ভাষায় নাটক), মহামানব গৌতম বুদ্ধ, আবিলাস্যা সংসার(চাক্মা ভাষায় নাটক), সিদ্ধার্থ চরিত, মহাস্বপ্ন (চাকমা ভাষায় নাটক), বেসান্তর কীর্ত্তন, মহাযাত্রী(গীতিনাট্য), দর্শন ও বিদর্র্শন, ধর্ম ও সমাজ, বুদ্ধের অবদান (৩য় খন্ড)।(তথ্যঃ মানব ধর্ম পঞ্চশীল,রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাস্থবির)।

    ৭। ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির

             প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমূহঃ

শাতিকাধাতু কথা স্বরূপিনী, অভিধর্মাথ সংগ্রহ স্বরূপিনী, যমক স্বরূপিনী, অভিধর্ম পিটকের বিভঙ্গ প্রকরণ, বুদ্ধ প্রকাশনী, পথ প্রদর্শন, চলার পথে।

     ৮। শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

  • ১৯৭৬ সালে বিরাজ মোহন কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘পার্বত্য বাণী’র প্রথম সংখ্যায় ‘কালিন্দী’ নামক ইতিবৃত্তমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কলিকাতা ‘বোধিভারতী’ পত্রিকায় তার কয়েকটি গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
  •  রাঙ্গামাটি পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ‘অঙ্কুর’ প্রকাশিত হয়।
  • রাঙ্গামাটি সাপ্তাহিক বনভূমি থেকে ‘সীমান্তের শান্তি’ চার সংখ্যা পর্যন্ত বের হয়।
  • ‘রুনুখাঁর উপাখ্যান’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস কয়েকটি অধ্যায় বের হয়েছে।
  • বুদ্ধের জীবনের উপর রচিত ‘অমিতাভ’ ১৯৬৭ সালে রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারে মঞ্চস্থ হয়।
  • ১৯৭০ সালে চাকমা নাটক ‘মূড়া যেক্কেনে’ নানিয়াচর উপজেলায় কৃঞ্চমাছড়া গ্রামে অভিনীত হয়। 
  • গিরি নির্ঝর পত্রিকায়  ‘রক্ততিলক’ প্রকাশিত হয়। 
  • তিনি রাঙ্গামাটি বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত ‘গান ও কথিকা’ লেখক।
  • ২০০১ সালে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করে। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ফোরামও ২৭শে চৈত্র ১৪১০ বাংলা সম্মাননা প্রদান করে। 
  • চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ২৫ বৎসর পূর্তি’ উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান করে। 
  • তার প্রণীত গ্রন্থ সমূহ- ‘তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা লোককাহিনী ও কিংবদন্তী, তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি, ভাগ্যরতœ’ । 
  • ছ. বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে ২০০৮ সালে সাহিত্যে সম্মাননা দেওয়া হয়।

      ৯।  অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান 

  • ক. তঞ্চঙ্গ্যা ও তাদের ভাষা-রূপ প্রসঙ্গ (১ম সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৩, সম্পাদকঃ পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • খ. ভাষার ঐকায়ন ও পৃথকায়ন: তন্চংগ্যার উত্তরাধিকার প্রশ্ন (২য় সংখ্যা, ১৪ই এপ্রিল-২০০৪ সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • গ. পাহাড়ী বাংলার কবি কার্ত্তিকচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন (৪র্থ সংখ্যা, ১৪ই আগস্ট-২০০৮, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • পার্বত্য কথাসম্ভার তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ (৫ম সংখ্যা, ৯আগষ্ট,২০০৯, সম্পাদকঃ কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)

      ১০।  রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা

            তঞ্চঙ্গ্যা জাতি, গীত পোই, চিত্রা (আর্ট বই)। এছাড়া স্থানীয়,জাতীয় অনেক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে তার বহু মূল্যবান গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি একজন প্রতিবাদী লেখক এবং সমাজ চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে আতœস্বীকৃত। 

      ১১।  রূপক দেবনাথ (ভারত)

     Rupak, Debnath, Ethnograpic Study of the Tanchangya of CHT, CADC, Sittwe and South Tripura Kolkata: Kreativmind, 2008.

.

      ১২।  কর্মধন তন্চংগ্যা

      প্রবন্ধ সমূহঃ 

  • আচ্ছ্যা বিষু-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১১ই এপ্রিল’০৫।
  • লুউই-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৯শে মে’০৫।
  • তন্চংগ্যা সমাজে বিষু উৎসব-দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৮ই এপ্রিল’০৬।
  • আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আমরাই বাচিঁয়ে রাখবো-রঁদেভূ,৬ষ্ঠ সংখ্যা,০৬।
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও মিডিয়া- রঁদেভূ ,৫ম সংখ্যা,০৫।
  • বিপন্ন আদিবাসী ভাষা-সমুজ্জ্বল সুবাতাস,ফেব্রয়ারী’০৫।
  • তন্চংগ্যাদের জুম চাষ,মিথলজি- পহ্র জাঙাল,৫ম সংখ্যা’০৯।
  • চাকমা কবিতায় তন্চংগ্যা ধনপুদি- পহ্র জাঙাল,৪র্থ সংখ্যা’০৮।
  • তন্চংগ্যাদের রাষ্ট্রভাষা চর্চা ও একটি প্রস্তাবনা- পহ্র জাঙাল,১ম সংখ্যা’০৩।
  • আদিবাসীরা বেঁচে থাকবে চিরদিন-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা),৮ম সংখ্যা, ২০০৬।
  • ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ এর মাতৃভাষার শিক্ষা কার্যক্রম-যেন প্রকৃতির ভাষার মধ্যে প্রাণ ফিরে পেলো, 

     সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট,সাস,ডিসেম্বর-২০০৯।

           ছোট গল্পঃ 

  • সাঙা -দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,৫ই জানুয়ারী’০৭।
  • নীলাকাশ- রদেঁভূ ,৭ম সংখ্যা’০৮।
  • পু-কাল্লাঙ-তৈনগাঙ,আদিবাসী দিবস সংখ্যা-২০০৬।

কবিতাঃ

  • জুমফুল পথ খোঁজার সাথী হয় না; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৪ নভেম্বর’০৬।
  • জুম দেশের বৃষ্টি; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,১৯জানুয়ারী’০৭। 
  • বয়স ৩; পহর জাঙাল,৩য় সংখ্যা’০৫।
  • জীবনের গদ্যকবিতা,ধূপছায়া,২য় সংখ্যা,২০০৩।
  • স্বপ্ন,নব সভ্যতার-চেদ্না(মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা), ২০০৪।

           গুচ্ছ কবিতাঃ

  • রুমালের ফুলে মুখ লুকাতে, তুমি যাবে আমাদের গ্রামে, বনে আলো প্রবেশ করে না;

      দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ১৬ই ফেব্রয়ারী’০৭। 

  • নূপুরবিহীন জুমনৃত্য, প্রকৃতির লজ্জা; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২রা ফেব্রয়ারী’০৭।
  • তিনটা জীবন, ওপর-নিচ সমান্তরাল; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৪ জুলাই’০৫।
  • আজ কবিতা লিখব না চিঠি লিখব, শুধু ভালোবাসে না তারা আমাকে; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ,২৮শে আগষ্ট’০৫।
  • জুম পরানীর আত্মা, স্যারের কবিতা বাতাসে উড়ে যায়; দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৩মে’০৫।
  • অনন্ত কাল ধরে বহুদিন, আমরাও জেগে আছি ধরিত্রীর মাঝে, যদি তোমায় একটি বার দেখা পাই; 

           দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৮শে এপ্রিল’০৫।

           অনুবাদ কবিতাঃ (তন্চংগ্যা ভাষায়) 

           ন-য়া ব-সর; (শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড.মনিরুজ্জামান স্যারের ‘ইদানিং বিপন্ন বড়ো’র পঞ্চতপার গান এর ‘নববর্ষ’ কবিতার অবলম্বনে)।

           সম্পাদনা করেন : 

  • পহ্র জাঙাল (একটি তন্চংগ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা)। ২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা, প্রকাশনায়ঃ পহ্র জাঙাল  প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  •  রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক), ৬ষ্ঠ, ৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহ:সম্পাদক। 

২. তন্চংগ্যাদের কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন সমূহ

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা, রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদনায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তন্চংগ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তন্চংগ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তন্চংগ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তন্চংগ্যা-৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তন্চংগ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তন্চংগ্যা-৩য় সংখ্যা,অমিত তন্চংগ্যা-৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা, সুতিল কুমার তন্চংগ্যা-২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক: সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক: আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • রদেঁভূ-(চবি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত)-৫ম (সহ:সম্পাদক),৬ষ্ঠ,৭ম সংখ্যা সম্পাদক ।
  • ধূপছায়া- (চবি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত)-১ম, ২য় সংখ্যা (সহ:সম্পাদক- কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা)।
  • সোশ্যাল এ্যাডভান্সমেন্ট- প্রকাশনায়: সাস, সহঃসম্পাদক: কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা । 

     ৩. তন্চংগ্যাদের সম্পাদিত নিজস্ব প্রকাশনা:

  • বলাকা- সম্পাদক: বাবুল সেন তঞ্চঙ্গ্যা (প্রয়াত)।
  • বিষু-১ম সংখ্যা (প্রকাশনায়- বাংলাদেশ তন্চংগ্যা কল্যাণ সংস্থা,রাংগামাটি সদর অঞ্চল, সম্পাদরায়-সংকলন প্রকাশনা উপ-কমিটি/১৪০৮ বাংলা।
  • পহ্র জাঙাল- সম্পাদক : পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা -২য়,৪র্থ,৫ম সংখ্যা,উজ্বল তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা ও সস্তোষ তঞ্চঙ্গ্যা -৬ষ্ঠ সংখ্যা। প্রকাশনায়: পহ্র জাঙাল প্রকাশনা পর্ষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে মোট ১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 
  • তৈনগাঙ- সম্পাদক : জ্যোতি বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা-১ম সংখ্যা,মৃণাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা,অছ্য কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -৩য় সংখ্যা,অমিত তঞ্চঙ্গ্যা -৪র্থ সংখ্যা।
  • রাঙাফুল- সম্পাদক: কমল সেন তঞ্চঙ্গ্যা -১ম সংখ্যা,সুতিল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা -২য় সংখ্যা
  • ছিনা-মোইন-সম্পাদক:সুমন জ্যোতি ভিক্ষু,ফারুয়া শিক্ষা-ছাত্র কল্যাণ ট্রাস্ট।
  • ন-আ শমন-সম্পাদক:আনন্দ সেন তঞ্চঙ্গ্যা, তঞ্চঙ্গ্যা ইয়ুথ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত, মোট ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 

                                                ……………………………

তথ্য সূত্রঃ 

১. পহ্র জাঙাল (একটি তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা-সব সংখ্যা)।

২. তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা।

৩. গোজেনের লামা বা গোঁসাই পালা- বিরাজ মোহন দেওয়ান। পার্বত্য বাণী, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ফেব্রয়ারী-১৯৬৮।

৪. সাধক শিবচরণ-যামিনী রঞ্জন চাকমা। গিরি নির্ঝর, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা,মে-১৯৮২।

৫. তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি- শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। 

৬. তঞ্চঙ্গ্যা জাতি-শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। 

৭. তৈনগাঙ, ন-আ শমন, রাঙাফুল প্রকাশনা।

৮. সাধক কবি শিবচরণ জীবনালেখ্য-আশীষ চাকমা,রঁদেভূ,আগষ্ট-২০০৫।

১০. প্রয়াত সুবাস তঞ্চঙ্গ্যা, বারঘোনীয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া, রেশম বাগান-কাপ্তাই।