তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রসঙ্গ

– কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা*

৩১শে ডিসেম্বর ২০২২ খ্রী: পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম। দিনটিও সুন্দর ছিল, বছরের শেষ দিন এবং অফিস ছুটিও ছিল তখন। তাছাড়া পরিবারকে নিয়ে বের হওয়া যায় না সহজে। সময়, সুযোগ, বাস্তবতা অনেকটা অনুকূলে থাকে না। আর পরিবারের সদস্যদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বিশেষ করে ছোটদের, বড়দের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ এটি নয়। তবে যৎসামান্য প্রসঙ্গও থাকবে বৈকি।

বহুদিন থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে যথেষ্ট আলোচনা এবং যুক্তি-তর্ক হচ্ছে। আলোচনাগুলো মূলত: তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক অন্যদের দ্বারা বিকৃতি, অসম্মান, অসুন্দর উপস্থাপন এবং ব্যবহার প্রসঙ্গ নিয়ে। “তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র” (অনলাইন)- গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রীঃ তারিখে একই প্রসঙ্গ একটি পোস্ট দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায় (facebook)। স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনা – সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক শুরু হয় এবং নানা মতভেদ দেখা দেয়। মূলতঃ দুজন চাকমা যুবক-যুবতীর ‘খবং’ পরাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি তর্কের সূত্রপাত। তঞ্চঙ্গ্যাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংগুলো তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী “মাধা হাবং”( তঞ্চঙ্গ্যারা অনেক সময় খবং বা মাধা খবং’ও বলে। তবে গ্রামের মানুষজনকে ‘মাধা হাবং’ উচ্চারণ করতে শুনেছি । আমিও আমার লেখায় ‘মাধা হাবং’ শব্দটি ব্যবহার করছি) এবং চাকমা রমণীরা অতীতে কখনো এরকম খবং পরেনি এবং কেউ পরেছে সেরকমও চোখে পরেনি। পিনন, খাদি, ব্লাউজ এই থ্রী বস্ত্র চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান পোশাক। অন্যদিকে চাকমা জনগোষ্ঠীর অনেকের মত- চাকমারা (পুরুষ-মহিলা) আগে থেকেই এই খবং ব্যবহার করতো। ব্যবহার না করার ফলে হারিয়ে ফেলেছে তবে বর্তমানে চেষ্টা করছে পুরনো ঐতিহ্যকে (খবং) ফিরিয়ে আনতে।

‘খবং’ কোন জনগোষ্ঠী ব্যবহার করে বা করে না এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনস, যুক্তি-তর্কের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগটি এককভাবে আমার নেই, তাই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘কারা ঠিক বলছে?’ প্রশ্নটি সামনে রেখে একটু স্টাডি করতে শুরু করি। স্টাডি অংশ হিসেবে কিছু বইপত্র ঘাটাঘাটি, চাকমা সমাজের কিছু গুণী, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব এবং সাথে কিছু পরিচিত চাকমা রমণীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলি।

প্রথমে বই এর রেফারেন্স প্রসঙ্গে আছি- সুগত চাকমা তাঁর ‘বাংলাদেশের উপজাতি’ (পৃষ্ঠা-১২) গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৫ খ্রী:, বাংলা একাডেমি, ঢাকা) চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে নিম্নাংগে ‘পিনোন’ এবং বক্ষবন্ধনী ‘খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরুষরা পোশাক হিসেবে কবোই, ধুতি, গামছা এবং খবং (এক জাতীয় পাগড়ি) ব্যবহার করেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন।

বিরাজ মোহন দেওয়ান তাঁর ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমা রমণীদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনন’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। আর পুরুষদের পোশাক হিসেবে ধুতি, চাদর, উঞ্চীষ ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে উক্ত গ্রন্থে।

ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন তাঁর ‘চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল ও তার অধিবাসীবৃন্দ’ গ্রন্থে (প্রকাশ:১৮৬৯) যে ছবি (পৃষ্ঠা: ২৩৮ থেকে শুরু) তিনি ব্যবহার করেছেন সেখানে চাকমা রমণীদের (যুবতী, বয়োবৃদ্ধ সকল মহিলার মধ্যে) পোশাকের অংশ হিসেবে মাথায় কোন খবং ছিল না। শুধু পিনন, খাদি, ব্লাউজ আর সাথে অলংকার ছিল।

সতীশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে (প্রথম প্রকাশ-১৯০৯ খ্রী:। পৃষ্ঠা-২২১) তিনি চাকমা সম্প্রদায়ের পোশাক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- চাকমা পুরুষদিগের পোশাক ছিল সাধারণত হিন্দুগণের ন্যায়, দেখিতে বড়ুয়া অর্থাৎ বাঙ্গালী মঘ বলিয়াই মনে হয়। পৌঢ়সমাজ মস্তকে ‘খবং’ বাঁধিয়া থাকে। নানা পূজা, অনুষ্ঠানে সাধারণত তাঁরা এই খবংটি পরে থাকে। নারীরা খবং পরে বলে তাঁর গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেননি।

মুস্তফা মজিদ তাঁর ‘চাকমা জাতিসত্তা’ গ্রন্থে (প্রকাশ: ২০১৯ খ্রীঃ। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা -৮৮) তিনি চাকমা পৌঢ় বা বৃদ্ধরা খবং বাধঁতেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মেয়েদের পোশাক হিসেবে শুধু ‘পিনোন এবং খাদি’র কথা উল্লেখ করেন। বস্ত্র হিসাবে খবং এর কথা তিনি উল্লেখ করেননি।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৭। ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী'(৫) খন্ডে (এই খন্ডে মোট ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা আছে) ‘চাকমা’ পর্বে (লেখক: সুগত চাকমা) যে পোশাক-পরিচ্ছদ এর বর্ণনা আছে (পৃষ্ঠা:৭৪-৭৬) সেখানে লেখক চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম শুধু ‘পিনোন- খাদি’র কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি গ্রামের বয়স্ক লোকেরা মাথায় সাদা কাপড় এবং মধ্যবয়সী মহিলারা অন্য রঙযুক্ত কাপড় সামান্য পেঁচিয়ে পরেন বলে মত দেন। এই পেচাঁনো কাপড়কে তিনি ‘খবং’ হিসেবে উল্লেখ করেন। চুল খোলা অবস্থায় খাবারে বা যত্রতত্র যাতে চুল না পড়ে (চুল দিয়ে অনেকে কালো যাদু করে এই আশঙ্কা থেকে), জুমে বা জমিতে খররৌদ্র, ঝুড়ি বহনে সহায়ক হিসেবে এই খবং এর কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও খবং চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যের একটি পোশাক সে কথাটি উল্লেখ করেননি। ৩১/১২/২০২২ খ্রি: পরিবার নিয়ে আগ্রাবাদস্থ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরে ঘুরতে গেলাম আমরা, যে কথাটি শুরুতেই বলেছি আমি। জাদুঘরে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রদর্শন রয়েছে। সেখানে চাকমা রমণীদের ব্যবহার্য বস্ত্র হিসাবে ‘খবং’ ছিল এরকম কোন প্রদর্শনী আমার চোখে পড়েনি, সঙ্গে যারা ছিল তাদেরও চোখে পড়েনি।

বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি” (প্রকাশ:১৯৯৫ খ্রীঃ) গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবে খবং বা মাধা হাবং এর ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।

রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতি’ গ্রন্থেও একই কথা লিখেছেন। যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর ‘তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি’ গ্রন্থে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের খবং বা মাধা হাবং ব্যবহারের তথ্য দিয়েছেন।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণে করে আমার মনে হয়েছে ‘খবং’ চাকমা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী বা সংস্কৃতির অংশের পোশাক নয় বিধায় লেখকগন (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থে এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেনি বা এড়িয়ে গেছেন।

এখন ব্যক্তি পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে আসি-

চাকমা ইতিহাস রচয়িতাদের (বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা) গ্রন্থে কোথাও ‘খবং’ হিসেবে চাকমা রমণীদের পোশাক ছিল এই কথাটি উল্লেখ নেই। বিষয়টি নিয়ে চাকমা জাতির দু’জন বিশিষ্ট সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক গবেষকের সাথে কথা হয় আমার । তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল উল্লেখিত ব্যক্তিদের লেখার মধ্যে তো চাকমা রমণীদের খবং ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য উল্লেখ নেই। তাই আমি বা আমরা কি প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি চাকমা রমণীদের ‘খবং’ এর ব্যবহার ছিল না অতীত থেকে? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আশ্চর্য এবং অদ্ভুত একটা উত্তর দিলেন আমাকে। তিনি বললেন- বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা মহোদয়রা কখনো চাকমা জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। কথাটি শুনে আমি বিষম অবাক হলাম এবং শক খেয়েছি। কারণ আমি যতটুকু জানি একজন লেখক যখন নিজের জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লিখেন, তিনি কিন্তু প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে অগোচরে নিজের এবং জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। সাথে এটাও সত্য আমরা সকলে কোন না কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করি। বিষয়টি নিয়ে আমি আরো পরিচিত কয়েকজন চাকমা জনগোষ্ঠীর রমণীর সাথে কথা বলি। সকলেই মত দেন চাকমাদের (পুরুষ মহিলা উভয়ে) মধ্যে অনেক আগে থেকে খবং ব্যবহার ছিল। তবে এখন ব্যবহার করে না আগের মতো। তাদের সকলের কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে- খবং তাঁরা (চাকমা) আত্মরক্ষার বস্ত্র (ধুলোবালি, রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা এবং কাঠ, পানি বহনের সময় নিরাপত্তা) হিসেবে ব্যবহার করতো। তাছাড়া কোন অনুষ্ঠান (যেমনঃ বৈদ্যরা তাদের পূজা অর্চনা) সময় এটি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে । আর বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিকে বরণ, অভিষেক (রাজ্যাভিষেক) সময়ও এই খবং ব্যবহারে প্রচলন রয়েছে। তবে সব তথ্যকে চাপিয়ে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন- চাকমারা ‘খবং’ ব্যবহার করলেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘পাঁচ কাপড়'(মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পাদুরি, পিনন) এর মতো অবিচ্ছেদ্য কোন বস্ত্র নয় এটি। তাই এর কোন সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বা কাঠামো নেই। এক টুকরো সাদা কাপড়,অনেক সময় ফুল তোলা কাপড় (আমি আমার দিদিকেও দেখেছি ফুল তুলে মাপলার বুনতে। বাবা এবং আমাদের জন্য), গামছা, তোয়ালে, মাপলারও এই খবং হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি কিনা আমরা? চাকমাদের ‘খবং’ ব্যবহার ছিল সিজনাল (Seasonal) আর তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘মাধা হাবং’ ব্যবহার ছিল ট্রেডিশনাল (Traditional)।

খবং’ বা পোশাক হিসেবে কে কি কাপড় ব্যবহার করবে এটি ব্যক্তির বা জাতির পছন্দ-অপছন্দ এবং রুচির ব্যাপার, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা -সমালোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো কাউকে নিষেধ করেনি বা বলেনি যে, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ছাড়া কেউ এই ‘তঞ্চঙ্গ্যা পোশাক’ পরতে পারবে না, অবশ্যই পরতে পারবে। তবে পরার পেছনে কোন অসৎ বা অশুভ উদ্দেশ্য এবং বিকৃত উপস্থাপন যেন না হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যে পরে একে অন্যের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং সন্মান করার। সাথে এটিও খেয়াল রাখতে হবে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, প্রান্তিক, ছোট নৃ-গোষ্ঠীরা যেন সকল বিষয়ে আগ্রাসনের স্বীকার না হয়। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের “মাধা হাবং” কে চাকমা জনগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘খবং’ এর অংশ হিসেবে যদি দাবি বা উপস্থাপন করেন বা করতে চান তখন অবশ্যই যুক্তি-তর্ক, আলোচনা- সমালোচনার প্রয়োজন আছে, সাথে প্রতিবাদও হবে। কারণ আমরা চাইলে চাকমা রমণীদের পিননকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পিনন হিসেবে দাবী করতে পারবো না। দাবির পিছনে ঐতিহাসিক, যৌক্তিক একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং অধিকার থাকতে হবে। আমি মনে করি চাকমা জনগোষ্ঠীর সে সুযোগটি নেই, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবংকে তাদের ‘চাকমা খবং’ হিসেবে দাবি করার বা প্রতিষ্ঠা করার। অন্তত সেই প্রমাণ বা কথাটি বলছে বিরাজ মোহন দেওয়ান এবং সুগত চাকমা এর রচিত ইতিহাস গ্রন্থ এবং অন্যান্য গবেষণাপত্র। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের কাছে মাধা হাবং মানে গামছা, তোয়ালে, মাপলার বা সাদা কাপড় নয়। তাদের কাছে খবং মানে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ের (মাধা হাবং, জুম্ময়া সালুম, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি, পিনন) অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের নাম, ঐতিহ্য, প্রতীক এর নাম। আর তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পাঁচ কাপড়ে একটা স্বতন্ত্রতা, নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা রয়েছে। এই কাপড়গুলো বুনার সময় মেয়েরা নানা নকশা এবং ফুল তুলেন। এই ফুলগুলো তারা জুম এবং প্রকৃতি থেকে খুঁজে নেয়। সুতরাং মাধা হাবং সহ অন্য সকল পোশাকের ফুলের সাথে ঐতিহ, জুম এবং প্রকৃতির একটা হৃদতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা নিম্নে ফুলগুলো সাধারণত তাদের মাধা হাবং এ ব্যবহার করে- “দাঅর পদ্ম ফুল, চিয়ন পদ্ম ফুল, কর্ণধাদী ফুল, ক্যারাবক ফুল, উলু ফুল, বুলচুগ্ ফুল, তালুকতিজ্যা ফুল, বিসইন ফুল, চাবুরি ফুল, সাম্মাদোলি ফুল, কুরাচুগ্ ফুল, বেয়ুনবিচি ফুল, গাইত ফুল, কই ফুল, কুরাঙা কাবা ফুল, কুমড়া বুক ফুল, দিইহরা ফুল, কা-রা বিচি ফুল, আলসুরি ফুল, পাইন্যাপোক ফুল, আয়ত্তলা ফুল (তুলতে ভুলে গেলে অমঙ্গল হয়), মাম্মাবিচি ফুল, কা-ড়া দার ফুল, পাইন্নাঙ ফুল, ছেরাবক ফুল, সুচ্ছাং ফুল, রোবক ফুল, ঘিলাটাক ফুল, রে ফুল” দিয়ে মাধা হাবং বুনা হয়। শুধু মাধা হাবং নয়, পিনন, জুম্ময়া খাদি, জুম্ময়া সালুম, পা-দুরির জন্যও আলাদা আলাদা ফুল রয়েছে। তবে প্রায় জুম্ময়া সালুম, মাধা হাবং, জুম্ময়া খাদি, পা-দুরি’র জন্য ঘুরেফিরে একই ফুল ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। কে কোন ফুল কোথায় ব্যবহার করবে নিজের পছন্দ অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে। আর তঞ্চঙ্গ্যারা কখনো ‘মাধা হাবং’কে আলাদা করে ‘খবং’ বা ‘হবং’ বলে না। শব্দটি ‘মাধা হাবং’ যুগল করে বলে। পুরনো দিনে এই পাঁচ কাপড় আমাদের রমণীরা সব সময় পরতো। বর্তমান সময়ে সব সময় না পরলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরে থাকে। তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ব্যবহারে দিন দিন সচেতন হচ্ছে। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা দলবেঁধে পাঁচ কাপড় পরে যাচ্ছে। এতে জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ প্রচার হচ্ছে এবং পাশাপাশি জাতির প্রতি দায়িত্ব, গৌরব ও অহংবোধ তৈরি হচ্ছে। তবে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা বর্তমানে বক্ষবন্ধনী হিসেবে যে খাদিটি ব্যবহার করে সেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম্ময়া খাদি’ নয়। সেটি চাকমা খাদি। তঞ্চঙ্গ্যা খাদি বৈচিত্র্যময়, ইউনিক এবং আভিজাত্য। আর বর্তমান বৈচিত্র্যতা এবং আধুনিক নামে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের পোশাককে ফুলে ফুলে রাঙিয়ে তুলে নানা রকম বাহারী ডিজাইনে এত বিকৃত করা হচ্ছে কিছুদিন পর তঞ্চঙ্গ্যা পাঁচ পোশাক তার ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা হারাতে বসবে। তখন হয়তো তঞ্চঙ্গ্যা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে হবে, বলতে হবে। এটি আমাদের জাতির জন্য অশনিসংকেত। এই পোশাক বিকৃতি আমাদের জাতির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। নষ্ট করছে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ঐতিহ্যময় বৈচিত্র্যতাকে।

যে ছবি নিয়ে এত যুক্তি-তর্ক, আলোচনা -সমালোচনা, চাকমা লেখকদের খবং বর্ণনায় খবং এর অনুপস্থিতি, তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মাধা হাবং- তৈরিতে ফুলের যে ব্যবহার এই থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা তাদের (চাকমা যুগল) পরিহিত খবংটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ‘মাধা হাবং’ ছিল(!!!) সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং বিচারের ভারটি পাঠক গবেষক এবং সুধীমহলের জন্য তোলা রইল। আর বর্তমান সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে অনেকে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় ব্যবসার সাথে জড়িত। ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী হয়তো এসব কাপড়গুলো (খবং) পেয়েছে। এসব কাপড় বিক্রয়ে বিক্রেতা হয়তো সাময়িক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় কিন্তু সাথে জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়।

তাছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাদের নামে সাপ্তাহিক ক্রিয়া (সংঘদানে) এই পাঁচ কাপড় দান হিসেবে দেওয়ার একটা প্রচলন আছে। পুনর্জন্মে তাঁর (মৃত ব্যক্তিনীর) যেন কাপড়ের অভাব না হয় এই বিশ্বাস থেকে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) এই পাঁচ কাপড় দান করে। এগুলো অনেকে পুরো সেট (পাঁচ কাপড়) ভান্তে থেকে নামমাত্র ৩০০-৫০০ মূল্যে কিনে অন্যজনদের কাছে অনেক দামে বিক্রি করে দেওয়ারও কথা প্রচলন রয়েছে সমাজে। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে একটা সংস্কার প্রচলিত আছে এসব মরা-মৃত্যু এবং দানীয় বস্তু(কাপড়) বিধবা মহিলা ছাড়া কেউ পরতে পারে না, পরলে অমঙ্গল হয়। আরো অনেকে মত দেন যে, তঞ্চঙ্গ্যা ঘরে বউ হয়ে আসা অন্য জনগোষ্ঠীর মেয়ের মাধ্যমেও তাঁর আত্নীয় স্বজন এবং পরিচিতজনদের মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড়ের প্রসার এবং অপব্যবহার ঘটছে। যে খবং নিয়ে এত বিতর্ক এবং আলোচনা চাকমাদের মধ্যে নতুন করে এর প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বয়স কিন্তু বেশিদিন নয়, বছর ৪/৫ হবে মাত্র।

আর নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক নিজের কাছে সবচেয়ে পূজনীয়, সন্মান, শ্রদ্ধার। অন্যদের কাছে এটি শুধু একটি পরনের বস্ত্র। সুতরাং তাদের হাতে এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি। এই শঙ্কা তৈরি থেকে আজকে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে হচ্ছে। এই তঞ্চঙ্গ্যা পোশাককে বিকৃত উপস্থাপন (নৃত্যে) নিয়ে এর আগেও আমার বেশ কিছু লেখা, আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে।

খবং হিসেবে কে, কি কাপড় ব্যবহার করবে একজন ব্যক্তি বা জাতির সিদ্ধান্ত, পছন্দ, অপছন্দ এবং রুচির উপর নির্ভর করে, এই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক বা আলোচনা করার কোন সুযোগ নেই। তবে অসঙ্গতি প্রশ্নে অবশ্যই তর্ক বির্তকের প্রয়োজন আছে। সময়ের ব্যবধানে তঞ্চঙ্গ্যারা মহামূল্যবান ঐতিহাসিক অনেক সম্পদ/সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে মত দেন- চুরি হয়ে গেছে। সময়, সুযোগের অপব্যবহার করে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাধামন ধনপুদি পালা, গেঙ্গুলীর উবাগীত, শিবচরণ এর গোসাইনলামাসহ সকল উপাদানগুলো। এসব ঐতিহাসিক সম্পত্তিগুলো তঞ্চঙ্গ্যা এবং চাকমা জনগোষ্ঠী উভয় নিজেদের বলে দাবী করে। এখন তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের একটি অংশ “মাধা হাবং” এর উপর এত আলোচনা যুক্তি তর্ক মূলতঃ অতীতের অসুন্দর অভিজ্ঞতা এবং আশঙ্কা থেকে। তাই তঞ্চঙ্গ্যারা আর চাই না নতুন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী পাঁচ কাপড় এবং অন্য সকল সংস্কৃতি উপাদানগুলো চুরি বা বেহাত হয়ে যাক। তাই তারা চাই সুরক্ষিত এবং নিরাপদে থাকুক তাদের ঐতিহ্য,সংস্কৃতি উপাদানগুলো।

এই আলোচনা যুক্তি তর্ক আসলে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্ম, চিন্তা, মেধা এবং চেষ্টাকে অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করার জন্য নয়, আমাদের একে অপরের সংস্কৃতিকে সন্মান এবং ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ও সহযোগিতা মানস গড়ে তোলার লক্ষ্য এই আলোচনা। আর এই আলোচনায় আমি আমার জাতির অস্তিত্ব এবং সংকটের কথা বলছি, আমার অধিকারের কথা বলছি। কারো অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার কথা বলছি না। সময়ের দাবী হিসেবে হয়তো হয়তো আমরা অনেক কিছু গ্রহন করেছি আর অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। কিন্তু যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষা সংরক্ষণের নিমিত্তে আর নিজেদের শেকড়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ও প্রশ্নে আমাদের সচেতন হওয়া এবং এক সঙ্গে কাজ করা উচিত। জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলকে নিতে হবে। হ্যাঁ অনেকে হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে বা লিখতে চান না, তাঁরা এর বদলে সম্প্রীতি ভ্রাতৃপ্রেমের কথা বলেন। আমরাও অবশ্যই সকলে চাই সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বপ্রেমের। কিন্তু আমাদের এটাও সাথে মাথায় রাখতে হবে জাতির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতের সংকটের সময় নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের কথা বলতে হবে জানান দিতে হবে। তাই আমি মনে করি সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। যেখানে জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অস্তিত্ব হুমকি, সংকট তৈরি হবে সেখানে আওয়াজ তুলতে হবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ঐক্যে জাতি এগিয়ে যাবে। জাতি হবে সমৃদ্ধ উর্বর। প্রাণ ফিরে পাবে তার হারানো অতীত ঐতিহ্য গৌরব।

আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ককে সাথে নিয়ে সত্য, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অনুপ্রেরণা হোক আমাদের পথ চলা। আর আগ্রাসনের স্বীকার না হয়ে আমাদের সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক, সংরক্ষণ থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়।

———————

ছবি- বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নেওয়া। তাই নির্দিষ্ট কাউকে ছবির ক্রেডিট দিতে পারছি না। তার জন্য সকলের কাছে সুন্দর ক্ষমা প্রার্থনা কামনা করছি।

———————

*সাবেক সম্পাদকঃ ‘পহর জাঙাল’, ‘রঁদেভু’ এবং ‘সিঙকাবা’ প্রকাশনা।

Leave a comment